প্রণয়ের সন্ধিক্ষণে সিজন ২ পর্ব ৭৮

প্রণয়ের সন্ধিক্ষণে সিজন ২ পর্ব ৭৮
আদ্রিতা নিশি

“আপনার কাছে পুরনো অ্যালবামটা কিভাবে এলো?”
সারহান বেলকনিকে পেছনে ফেলে রুমে ফিরে এসেই অরিত্রিকার প্রশ্নের মুখোমুখি হয়। চোখে এক ধরনের শীতলতা নিয়ে স্থির দৃষ্টি নিয়ে সে তাকায় বিছানায় বসে থাকা অরিত্রিকার দিকে। অ্যালবাম হাতে মেয়েটা গভীর আনন্দে ডুবে আছে। তার উচ্ছ্বসিত মুখশ্রী দেখে মনে হয় যেন হঠাৎ কোনো অমূল্য ধন খুঁজে পেয়েছে। সারহান ধীরে ধীরে এগিয়ে আসে নিঃশব্দে বিছানার ধারে এসে বসে।অরিত্রিকার প্রাণবন্ত মুখ দেখে সারহানের ভেতরের অস্থিরতা, অশান্তি খানিকটা প্রশমিত হয়।

মুহূর্তটুকু শান্তির আশ্রয় হয়ে দাঁড়ায়। সে চোখ রাখে অ্যালবামের পাতায়। পুরনো সেই ছবিগুলোয় ধরা আছে চৌধুরী পরিবারের নানা মুহূর্ত!সবচেয়ে বেশি চোখে পড়ে ছোটদের ছবি। খেলাধুলা, উৎসব, পারিবারিক আনন্দঘন সময় সবই ধরা আছে ছবির ফ্রেমে।অরিত্রিকা পরম মমতায় একের পর এক পাতা উল্টাচ্ছে, ছোটবেলার পরিচিত মুখগুলো দেখে হাসছে। তার চোখেমুখে দীপ্তির ন্যায় ছলকে পড়ছে আবেগ আর আনন্দ। তিন বছর পর অ্যালবামটা হাতে পেয়ে স্মৃতির দরজা খুলে গেছে তার জন্য। প্রতিটি ছবিই একেকটা গল্প,যা তাকে ফিরিয়ে নিচ্ছে তার শৈশবে, হারিয়ে যাওয়া কিছু মুহূর্তে।

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

“তারমানে আপনি দরজা বন্ধ করে অ্যালবাম দেখছিলেন?”
অরিত্রিকা ঘাড় বাঁকিয়ে সারহানের পানে তাকিয়ে হাস্যজ্জ্বল ভঙ্গিমায় পুনরায় প্রশ্ন করে। সারহান মৌন রয়। সে দরজা আঁটকে অ্যালবাম দেখছিলো না। আলমারি থেকে কাগজপত্র ঘেঁটে কিছু তথ্য সংগ্রহ করে পুলিশকে দিচ্ছিল। তখন অ্যালবামটা পেয়েছিল। তাই বিছানার ওপর রেখেছিল। কিন্তু তা রাখতে ভুলে গেছে। সে দীর্ঘ শ্বাস ফেলে। অতঃপর কন্ঠে কোমলতা মিশিয়ে বলল ;
“উহু! আলমারিতে ছিল তাই বের করে বাহিরে রেখেছিলাম।”
অরিত্রিকার ওষ্ঠকোণের হাসি প্রসারিত হলো। পুনরায় অ্যালবামে দৃষ্টি স্থির করে বলল;
“ভাগ্যিস বের করে রেখেছিলেন। নয়তো এটা কখনো খুঁজে পেতাম না।”

অরিত্রিকা অ্যালবামের প্রথম পাতাগুলো মনোযোগ দিয়ে দেখতে শুরু করল। শুরুটা চৌধুরী বাড়ির কর্তা-গিন্নিদের ছবি দিয়ে ধারাবাহিকভাবে সাজানো সেসব ছবিতে ধরা রয়েছে পরিবারের শিকড়, পরম্পরা। মুখগুলোতে দম্ভ নেই বরংঅভিজাত শান্ত গাম্ভীর্য ফুটে উঠেছে। এরপরেই এল সারহানের ছোটবেলার ছবিগুলো। অরিত্রিকার দৃষ্টি সেখানে থেমে গেল। মেয়েলি কৌতূহল আর একরকম অনির্বচনীয় মুগ্ধতা নিয়ে সে ছবিগুলো পর্যবেক্ষণ করতে লাগল। কোথাও বালিশ দিয়ে দুর্গ বানিয়ে খেলছে, কোথাও আবার দৌড়াচ্ছে।একটা ছবিতে সারহান শুধু প্যান্ট পরে, খালি গায়ে দাঁড়িয়ে আছে চোখ দুটো বিস্ময়ে বড় বড় করে খুলে তাকিয়ে আছে ক্যামেরার দিকে। আর মুখে একরকম গোমড়া ভাব। বয়স কত হবে? দুই – তিন বছর। ছবির সেই সরল শিশুসুলভ অভিব্যক্তি দেখে অরিত্রিকার মুখে ফুটে উঠল দুষ্টু হাসি। নিঃশব্দে মিটিমিটি হেসে উঠল।সারহান তা লক্ষ্য করে কপাল কুঁচকে গম্ভীর কন্ঠে বলল;

“পাগলের মতো হাসছিস কেন? ছবি দেখে হাসার কি হলো?”
অরিত্রিকা শব্দ করে হেসে উঠল। আঙুলের ইশারায় একটা ছবি দেখিয়ে হাস্যরত কন্ঠে বলল;
“খালি গায়ে কেমন গোলগোল চোখ করে তাকিয়ে ছবি উঠেছেন। ওলে লে লে কত্তো কিউট বাবুটাহ! ইচ্ছে করছে গাল টেনে দিতে।”
সারহানের চক্ষুদ্বয় সংকুচিত হয়ে গেল। তির্যক চাহনিতে তাকাল অরিত্রিকার দিকে। ভরাট কন্ঠে বলল;
“এসব কি ভাষা?”
“কি ভাষা মানে? এটাকে আদর করে ডাকা বলে।”
“তাই? এমন অদ্ভুত ভাবে কেউ আদর করে ডাকে এই প্রথম শুনলাম।”
“ছোটবেলায় বাচ্চাদের এমন ভাবেই আদর করে ডাকে। বড় মা আপনাকেও ছোটবেলায় এমন ভাবে ডেকেছে।”
“বাজে কথা।”

সারহান গম্ভীর কণ্ঠে বলল। অরিত্রিকা মুখ টিপে হেসে হঠাৎ ভেংচি কাটল সারহানের ছবির দিকে। তারপর আবার অ্যালবামের পাতায় চোখ ফেরাল।সময়ের স্রোতে মিনিটখানেক কেটে গেল। হঠাৎই একটি ছবিতে এসে তার দৃষ্টি আটকে গেল। আগের সেই দুষ্টু হাসি মিলিয়ে গেল মুহূর্তে। চোখ দুটো বিস্ময়ে বড় হয়ে গেল।সে স্তব্ধ হয়ে তাকিয়ে রইল ছবিটার দিকে।ছবিটিতে দেখা যাচ্ছে এক আট-নয় বছরের ছেলে কোলে তোয়ালেতে মোড়া সদ্যোজাত এক শিশু কন্যাকে ধরে আছে। ছেলেটির মুখ গম্ভীর, চাহনিতে অদ্ভুত গভীরতা। যা বয়সের তুলনায় অনেক বেশি পরিণত। ছেলেটা তাকিয়ে আছে ছোট্ট বাচ্চাটার দিকে। মনে হচ্ছে, জীবনে প্রথমবার কোনো অলৌকিক কিছুর সাক্ষাৎ পেয়েছে।অরিত্রিকা এক মুহূর্তের জন্য যেন নিজের সত্তা হারিয়ে ফেলে। তারপর নিজেকে ধাতস্থ করে। ছবিটার দিকে হাত বাড়িয়ে আবারও ছুঁয়ে দেখে। আঙুল দিয়ে আলতোভাবে ছবির উপর দিয়ে বুলিয়ে নেয়। সারহান সেই দৃশ্য দেখে। তার ভাবমূর্তি ক্ষুন্ন হয়। সে অরিত্রিকার দিকে এগিয়ে আসে। দূরত্ব মিটিয়ে বসে নিঃশব্দে হেসে বলল;

“কি দেখছিস এতো মনোযোগ দিয়ে?”
অরিত্রিকার ধ্যান ভাঙল। সে ঘাড় বাঁকিয়ে তাকাল সারহানের দিকে। বিস্ময়াভিভূত কন্ঠে বলল;
“এই ছবিটা তো হারিয়ে গিয়েছিলো। অ্যালবামে কোথায় থেকে আসলো?”
সারহানের ওষ্ঠকোণ প্রসারিত হয়। স্বাভাবিক ভাবে বলল;
“পেনড্রাইভে ছিল।”
“ওহহ।”
“হুমম।”
“আপনি ছোটবেলা থেকে এমন গম্ভীর কেন? পুতুলের মতো বাচ্চাকে কোলে নিয়ে ছবি উঠেছেন অথচ মুখ বাংলার পাঁচের মতো করে আছেন। একটু হাসলে কি খুব ক্ষতি হতো?”
“হাসার মতো অবস্থায় ছিলাম না তখন। ”
সারহান হেঁয়ালিপূর্ণ কন্ঠে বলে উঠল। অরিত্রিকা অবুঝের ন্যায় বলে উঠল ;
“কেন?”
সারহান হাসি থামিয়ে দৃঢ় কন্ঠে বলল;
“ভালো করে ছবিটা দেখ।”

অরিত্রিকা আবারও ছবিটার দিকে তাকাল। সে তীক্ষ্ণ চাহনিতে রহস্য ভেদ করার চেষ্টা করল। অবশেষে কারণটা বুঝতেই লজ্জায় আড়ষ্ট হয়ে গেল। সে চোখ মুখ কাচুমাচু করে নিশ্চুপ রইল। ভাবতেই কেমন যেন লাগল সে সারহান ভাইয়ের কোলে হিসু করে দিয়েছিল। তাই উনি ওমন করে তার দিকে তাকিয়ে ছিলো। কি একটা জঘন্য কাজ করেছিল সে। এখন কি করে মুখ দেখাবে?

“তোর বয়স তখন মাত্র তিন দিন। বাড়িতে ছোট মেয়ে হওয়ার খুশিতে উৎসবমুখ পরিবেশ।হইচই, কোলাহল, আত্নীয়-স্বজনের ভিড়। সেদিন চাচা শখ করে ফটোগ্রাফার ডেকেছিল বাড়ির প্রতিটা সদস্যের সঙ্গে তোর ছবি তোলার জন্য।সবাই একে একে তোকে কোলে নিয়ে ছবি তুলল। শেষে আমার পালা এলো। আমি তখন বেশ গম্ভীর হয়ে বলেছিলাম—‘ও তো অনেক ছোট, কোলে নিলে যদি লেগে যায়!’ তাই আমি কোলে নেব না। কিন্তু মা তখন তোকে এনে জোর করে আমার কোলে দিয়ে গেলো।ছবির জন্য সামনে তাকাবো ঠিক তখনই তুই আমার জামাকাপড় ভিজিয়ে দিলি। আমি তোর দিকে বিরক্ত মুখে তাকালাম, আর ঠিক সেই মুহূর্তেই ফটোগ্রাফার ক্লিক করল ক্যামেরা।ছবিটা হয়ে গেল ইতিহাস। এরপর সবাই মজা হাসাহাসি, ঠাট্টা করতে লাগল।আর আমি তোকে কোলে নিয়ে থম মে*রে বসে ছিলাম।”

একটু থেমে বলল;
“তোর জন্মের তিন দিনের মাথায় তুই আমার সম্মান ভিজিয়ে দিয়েছিলি। সেই স্মৃতি এখনো অ্যালবামে যত্ন করে রাখা হয়েছে।”
সারহান স্মৃতিচারণ করে ঘটনাটা বেশ স্বাভাবিক ভাবে বলল।অরিত্রিকার মাটি ফাঁক করে ঢুকে যেতে ইচ্ছে করল। ইশ! কি লজ্জাজনক পরিস্থিতি। সারহান ওষ্ঠ কামড়ে হাসল ;
“ভাবতেই অবাক লাগে ছোটবেলায় ইয়ে করে আমার শার্ট প্যান্ট ভিজিয়ে দেওয়া বাচ্চাটা এখন আমার বউ।”
অরিত্রিকার কান গরম হয়ে গেল। সে আরেকদফা লজ্জায় মিইয়ে গেল। চোখ মুখ খিঁচে মৃদু চিৎকার দিয়ে বলল;
“সারহান ভাই! আপনি কিন্তু বেশী বলে ফেলছেন।”
“এখনো তো কিছুই বলিনি। জাস্ট ইয়ের কথা বলেছি।”
“আমি কিন্তু রেগে যাচ্ছি।”
“আমার রাগাশ্রয়ী মুখ দেখতে ভালোলাগছে।”
“একা একা বসে থাকুন। আমি চললাম।”
কথাটা বলে অ্যালবামটা হাতে নিয়ে অরিত্রিকা কোনো মতে বিছানা থেকে নেমে ছুটে রুম থেকে বেড়িয়ে গেল। সারহান সেই দৃশ্য দেখে ওষ্ঠ কামড়ে হাসল। মেয়েটাকে রাগাতে তার ভীষণ ভালোলাগে।

দেখতে দেখতে দুই দিন কেটে গেছে। চৌধুরী বাড়িতে একটু একটু করে স্বাভাবিকতা ফিরতে শুরু করেছে। সবাই নিজ নিজ কাজে ব্যস্ত থাকার চেষ্টা করছে।একদিন আগে রাহার বাবা-মা এসেছিলেন। আরশাদ সাহেব, আজমল সাহেব আর ইরফানের সঙ্গে অনেক কথা হয় তাদের। রাহার আচরণে তারা রীতিমতো রেগে ছিলেন। মেয়ের এমন হঠকারী সিদ্ধান্ত, হুট করে বিয়ে মেনে নিতে পারছিলেন না কিছুতেই। তারা অবাকও হয়েছিলেন, রাগও হয়েছিলেন।
তবে আরশাদ সাহেব আর আজমল সাহেব ঠান্ডা মাথায় সবটা বোঝানোর চেষ্টা করেন। তারা ইরফানের চরিত্র, পরিস্থিতি আর ঘটনার পেছনের যুক্তিগুলো তুলে ধরেন। ধীরে ধীরে রাহার বাবা-মা কিছুটা শান্ত হন। যদিও পুরোপুরি মন থেকে মেনে নিতে পারেননি তখনো, তবুও শেষমেশ কথা বলে, সব শুনে, বিদায় নেন।তাদের চলে যাওয়ার পর রাহা একদম ভেঙে পড়ে। বাবা-মায়ের সেই অবহেলা, সেই উপেক্ষা… কিছুতেই নিতে পারছিল না। ওর চোখের পানি যেন থামছিল না। তখন ইরফানই ওকে সামলায়।

সকাল ঠিক নয়টা। বাড়ির কর্তা ও ইরফান নাস্তা সেরে অফিসের দিকে রওনা হয়েছেন। সাদাত আর ইশরাও বেরিয়ে গেছে ভার্সিটিতে। আবির অরিনকে সঙ্গে নিয়ে একটু ঘুরতে বেরিয়েছে। বাড়ির গিন্নিরা তখন গৃহস্থলির কাজে ব্যস্ত, আর লেভি? সে তো নরম সোফায় গা এলিয়ে গভীর ঘুমে ডুবে।আজ সারহানের দায়িত্ব অরিত্রিকাকে ভার্সিটিতে পৌঁছে দেওয়া। রাহাও যাওয়ার কথা ছিল, কিন্তু মন খারাপ থাকায় আজ যাচ্ছেন না। সারহান গাড়িতে বসে অরিত্রিকার জন্য অপেক্ষা করছিল। কিছুক্ষণ পর, হালকা দুলে দুলে হেঁটে এসে অরিত্রিকা গাড়িতে উঠে বসল। আর একটুও সময় নষ্ট না করে সারহান গাড়ি স্টার্ট দিল। গন্তব্য রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়।

“আজকে এতো ফিটফাট হয়ে বেরোনো হয়েছে। কোথাও প্রোগ্রাম আছে নাকি?”
অরিত্রিকা সারহানকে পরখ করে কৌতূহলী ভাব নিয়ে শুধালো। সে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে অবলোকন করছে শ্যামমানবকে। চোখে কালো চশমা, পরনে শুভ্র রঙা পাঞ্জাবি। একদম হিরো ভাব। সারহান স্টিয়ারিং ঘুরায়, দৃষ্টি সামনে স্থির রেখে গম্ভীর কণ্ঠে জবাব দেয় ;
“আজকে জনসভা আছে। ওখানে যাবো।”
অরিত্রিকা কিছুক্ষণ মৌন থেকে প্রশ্ন করল;
“কি উপলক্ষে জনসভা?”
“স্থানীয় প্রশাসন আয়োজিত উন্নয়ন সংলাপ উপলক্ষে জনসভা।”
“আপনি প্রধান অতিথি? ”
“হুমম।”
“একটা প্রশ্ন করবো?”
অরিত্রিকা মিনমিন করে বলল। সারহান তৎক্ষনাৎ দৃঢ় কন্ঠে বলল;
“হুম। প্রশ্ন কর।”
অরিত্রিকা একটু সাহস সঞ্চার করে ক্ষীণ কন্ঠে বলল;
“আপনি ঘুষ জনগনের জন্য বরাদ্দকৃত টাকা মে*রে খেয়েছেন? কখনো কাউকে বিনা অপরাধে মা*রার অর্ডার দিয়েছেন?”

সারহান গাড়িটা একটু শ্লো করল। এক পলক অরিত্রিকা দিকে চাইল। তারপর পুনরায় সামনে তাকিয়ে দাম্ভিকতা নিয়ে বলল;
“আমাকে দেখে তোর স*ন্ত্রাসী, ঘুষখোর এমপি মনে হয়?”
অরিত্রিকা দু’দিকে মাথা নাড়িয়ে তড়িঘড়ি করে বলল;
“না না। আমি তো শুধু কৌতূহল মেটাতে প্রশ্ন করলাম। অনেকে তো এমন করে। না মানে এ যুগে ভদ্র, দুর্নীতি করে না এমন এমপি খুঁজে পাওয়া দুষ্কর। ”
“তোর কথা একেবারে অযৌক্তিক নয়। নেতিবাচক অভিজ্ঞতা থেকে মানুষের এমন ধারণা তৈরি হয়। কিন্তু আমি বিশ্বাস করি, এই ধারণা ভাঙার জন্যই কিছু মানুষকে অন্যরকম হতে হয়। আমি সেই চেষ্টায় আছি।”

“আমি জানতাম, আপনি ওমন ধরনের নন! যদি ওই লাইনের হতেন এতদিনে আপনার নামের পাশে ‘কোটি টাকার ক্লাব সদস্য’ লেখা থাকত। বাড়ির বদলে প্রাসাদ, গাড়ির বদলে হেলিকপ্টার, আর ফ্যানের বদলে ছাদে হেলিপ্যাড! টিকিট কেটে বিদেশ যাওয়ার দরকারই হতো না। আপনার তো এমন অবস্থা হতো, যেখানে ইচ্ছা সেখানে ঘন্টায় একবার করে যাওয়া-আসা করতে পারতেন। ফেসবুকে ছবি দিতেন: Breakfast in Bangkok, Lunch in London, Dinner in Dhaka! আর আমরা গরিবেরা লাইক দিয়ে ভাবতাম এটাই বুঝি ‘সার্ভ করতে আসা জনপ্রতিনিধি’!”

“কথাবার্তা ভালোই শিখেছিস।”
“সেদিন আবির ভাইয়াও এটাই বলছিলেন। আপনার হাওয়া লেগে আমি নাকি কথা বলতে শিখে গেছি।”
অরিত্রিকা ফিক করে হেসে বলল। সারহানের চোখ মুখ কুঁচকে গেল। গাম্ভীর্যতা বজায় রেখে বলল;
“ওর উল্টাপাল্টা কথা শুনে মাথা খারাপ করার দরকার নেই।”
অরিত্রিকা ভদ্র মেয়ের মতো মাথা দুলিয়ে একগাল হেসে বলল;
“আচ্ছা।”

“তোর ক্লাস শেষ হলে সাদাত তোকে নিয়ে যাবে। পাকনামী করে একা বাড়ি ফেরার দরকার নেই আর অপরিচিত মানুষের সাথে ভুলেও কথা বলবি না।”
“আচ্ছা।”
“ছুটির পর বাড়ি ফিরে আমায় কল করবি। মনে থাকে যেন।”
“হুমম।”
রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের মেইন গেটের সামনে গাড়ি থামল। পেছনে আরেকটা গাড়ি থামার শব্দ পেয়ে অরিত্রিকা গ্লাসের দিকে তাকাল। পেছনের গাড়িটায় সারহান ভাইয়ের দেহরক্ষী এবং কিছু দলের ছেলেরা রয়েছে। সে দৃষ্টি ফিরিয়ে সারহানের দিকে তাকাল। আগ্রহী কন্ঠে বলল ;

“এরা এখানে কি করছে?”
সারহান গ্লাসে দৃষ্টি স্থির করে বলল;
“আমার সাথে জনসভায় যাবে।”
“ওহহ।”
“হুমম।”
অরিত্রিকা গাড়ির দরজা খুলে ব্যাগটা কাঁধে নিয়ে নেমে দাঁড়াল। দরজাটা বন্ধ করে গ্লাস নামিয়ে রাখা স্থানটি দিয়ে ভেতরে তাকাল। মিষ্টি হেসে সারহানকে উদ্দেশ্য করে বলল;
“সাবধানে যাবেন। আর শুনুন।”
সারহান সরাসরি অরিত্রিকা দিকে তাকিয়ে বলল;

“বল।”
অরিত্রিকা লাজুক হেসে চঞ্চলা চিত্তে ফ্লায়িং কিস ছুঁড়ে বলল;
“ভালোবাসি নেতাসাহেব।”
কথাটা শেষ করতেই মেয়েটা এক প্রকার ছুটে পলায়ন করল। সারহান বিস্মিত চাহনিতে তাকিয়ে চলে যাওয়া দেখল।পেছন থেকে কোলাহল ভেসে আসেই ধ্যান ভাঙল। তার গম্ভীর মুখাবয়ব অতিশয় শান্ত দেখালো।

বিকেল চারটা পার হয়েছে। রাজশাহী শহরের ঐতিহাসিক মাদরাসা মাঠে এক বিশাল রাজনৈতিক জনসভা চলছে। দেশের অন্যতম শীর্ষ রাজনৈতিক দলের আয়োজনে এই জনসভায় উপস্থিত হয়েছেন দলের কেন্দ্রীয় ও স্থানীয় স্তরের বড় বড় নেতা-কর্মীরা। পুরো মাঠ জনসমুদ্রে পরিণত!চারদিক কানায় কানায় পূর্ণ মানুষের উপস্থিতিতে।স্টেজটি সাজানো হয়েছে রাজকীয়ভাবে। লাল-সবুজ রঙের ব্যানার, ফুলের তোড়া এবং পার্টির প্রতীক দিয়ে সুসজ্জিত এই মঞ্চে বসে আছেন দলের নামকরা নেতারা। মাঠজুড়ে টানটান উত্তেজনা, প্রতীক্ষা শুধু প্রিয় নেতার কণ্ঠস্বর শোনার। তাদের অপেক্ষার অবসান ঘটিয়ে সময় মাইক হাতে ভাষণ দিতে ওঠেন রাজশাহী-১ আসনের নবনির্বাচিত সংসদ সদস্য এবং তরুণ প্রজন্মের আইডল সারহান ইদায়াত চৌধুরী। তার বক্তব্যে মুহূর্তেই মুখরিত হয়ে ওঠে চারদিক। তরুণ থেকে বৃদ্ধ সব বয়সী মানুষ গভীর মনোযোগে শুনছে প্রতিটা কথা। গলায় আত্মবিশ্বাস, চোখেমুখে উদ্দীপনা আর প্রতিশ্রুতিশীল ভবিষ্যতের বার্তা।স্টেজের সামনের অংশজুড়ে ভিড় করছে বিভিন্ন প্রেস ও মিডিয়ার প্রতিনিধিরা। তারা লাইভ সম্প্রচারে ব্যস্ত আর দলের কর্মীরা মোবাইল ফোন ও ক্যামেরায় বন্দি করছে এই ঐতিহাসিক মুহূর্ত। সারহানের প্রায় পঁইতাল্লিশ মিনিটের উদ্দীপ্ত ও আবেগঘন বক্তব্য শেষ হতেই পুরো মাঠে গর্জে ওঠে করতালি ও স্লোগানের ঝড়। তারপরে আরও তিন-চারজন নেতা সংক্ষিপ্ত বক্তব্য রাখেন। ধীরে ধীরে জনসভা শেষের দিকে এগিয়ে যায়। জনতা শৃঙ্খলার সঙ্গে মাঠ ত্যাগ করে।

“দোস্ত! একবারে ফাটিয়ে দিয়েছিস। কি ভাষণ দিলি রে। সব তোর দেওয়ানা হয়ে গেছে।”
সন্ধ্যা ছয়টা। সারহান ক্লান্ত ভঙ্গিমায় এসে সরাসরি গাড়ির দরজা খুলে ড্রাইভিং সিটের পাশের সিটে বসে পড়ল। ড্রাইভিং সিটে বসে ছিল আবির৷ বন্ধুকে আসতে দেখে হাস্যজ্জ্বল ভঙ্গিমায় বলে উঠল। সারহান সিটবেল্ট লাগিয়ে গা এলিয়ে দিলো সিটে। নির্লিপ্ত কন্ঠে বলল;
“দেওয়ানা হয়নি। ওরা আমার প্রতি আস্থা রেখেছে এবং ভালোবাসার বহিঃপ্রকাশ ঘটিয়েছে। আজ আমি প্রতিটা মানুষের চোখে মুখে এক ধরনের উদ্দীপনা দেখেছি। সবাই হয়তো আমায় আগের থেকে বেশী ভরসা করতে শুরু করেছে। আমি সাধারণ মানুষের ভরসা মান রাখার সর্বোচ্চ চেষ্টা করব।”
আবির হাসল;

“আমিও তোর পাশে আছি।”
“গাড়ি স্টার্ট দে।”
“ওকে।”
আবির গাড়ি স্টার্ট দিলো। মাদরাসা মাঠের পার্কিং প্লেস থেকে গাড়ি বের করে মেইন রোডে উঠল। সারহান পাঞ্জাবির পকেট হাতড়ে ফোনটা বের করল। লক খুলে চেক করল অরিত্রিকা কল দিয়েছে কিনা? কিন্তু সে আশাহত হলো। মেয়েটা তাকে কল বা ম্যাসেজ কোনোটাই করেনি। মনে মনে রাগল। জোরে জোরে শ্বাস টেনে নিজেকে স্বাভাবিক করার চেষ্টা করল। আবির খেয়াল করল বিষয়টা। সে জিজ্ঞেস করল;

“ কোনো সমস্যা সারহান?”
সারহান চোখ মুখ শক্ত করে গম্ভীর কন্ঠে জবাব দিলো ;
“ভার্সিটি থেকে বাড়ি ফেরার পর ফাইরুজকে কল করতে বলেছিলাম আমায়। কিন্তু মেয়েটা কল করেনি।”
“হয়তো ভুলে গেছে কল করতে। তুই একবার কল করে নে।”
“বাড়িতে যাই তারপর ওর খবর নেবো আমি।”
“আরে রেগে যাচ্ছিস কেন? বাচ্চা মেয়ে হয়তো ভুলে গেছে।”
“তুই ওর সাইড নেওয়া বন্ধ কর। আমি শিউর ও লেভির জন্য আমার বলা কথা ভুলে গেছে।”
সারহান বিরক্তি প্রকাশ করে বলল। আবির শব্দ করে হেসে বলল;
“কি দিন কাল আসলো! একটা বিড়ালের ওপর এমপি সাহেব জেলাস হচ্ছে।”
সারহান সূঁচালো চাহনিতে তাকাল আবিরের দিকে। শক্ত কন্ঠে বলল;
“শাট আপ আবির।”
“আরে দোস্ত! বউয়ের রাগ আমার ওপর ঝাড়ছিস কেনো?”
“চুপ কর।”

“আচ্ছা চুপ করবো তার আগে একটা কথা বল। তুই অরিত্রিকাকে নিয়ে টেনশন কেন করছিস?”
“যতক্ষণ ওই কু*ত্তার বাচ্চাকে পুলিশ খুঁজে না পাচ্ছে ততক্ষণ আমি টেনশন মুক্ত হতে পারব না।”
সারহান লহু স্বরে বলে উঠল। আবির বুজতে পারল বন্ধুর উদ্বিগ্নতার কারণ। সে সামনে ড্রাইভিংয়ে মনোযোগী হলো। সামনে দৃষ্টি স্থির রেখে বলল;
“খুব শীঘ্রই খুঁজে পাবে। তারপর ফুপি শাশুড়ী, নয়ন তালুকদার আর ওর ডান হাতকে কাঠগড়ায় তোলা হবে আর অজানা কিছু ঘটনার সত্য বেরিয়ে আসবে।”
সারহান কাঠিন্যতা এঁটে বলল;
“তারপর দীর্ঘ সময়ের হাইড এন্ড সিক গেমের পরিসমাপ্তি ঘটবে।”

“সারহান আমার মনে হয় তোর একবার অরিত্রিকার মুখ থেকে আসল কাহিনী শোনা দরকার।”
“তুই হয়তো ভাবছিস, অরিত্রিকার সঙ্গে ছোটখাটো কিছু হয়েছে। কিন্তু আমি তা মনে করি না। আমার বিশ্বাস, ওর জীবনে আমরা যা ভাবছি তার চেয়েও বড় কিছু ঘটে গেছে।আমি ওর থেকে প্রায় দুই বছরের বেশি সময় দূরে ছিলাম।কিন্তু তবুও ওর খবর রাখতাম নীরবে।অরিন আমাকে নিয়মিত খবর দিত গোপনে।যাতে কেউ জানতে না পারে। সেখান থেকেই আমি বুঝতে পারি অরিত্রিকার আচরণ কেমন বদলে যাচ্ছে। হঠাৎ চুপচাপ হয়ে যাওয়া, অস্বাভাবিক ব্যবহার সব কিছু।আমি বহুবার ছুটে যেতে চেয়েছি।কিন্তু ওর চোখের ঘৃণা যেন আমাকে আটকে রাখত। তবুও আমি থেমে থাকিনি। অরিন, চাচা আর চাচীকে বলেছিলাম ওর প্রতি খেয়াল রাখার জন্য।ওকে মানসিকভাবে সাপোর্ট দেওয়ার জন্য। ধীরে ধীরে ওর সব স্বাভাবিক হতে শুরু করল। মেয়েটা আবার আগের মতো হয়ে উঠল। সবার সঙ্গে মিশতে লাগল, আগের মতো চঞ্চল হয়ে উঠল।”

প্রণয়ের সন্ধিক্ষণে সিজন ২ পর্ব ৭৭

“আমি জানি সবটা। তবে আমার মনে হয় তোর জানাটা জরুরী।”
“হুম জানবো। কিন্তু ফাইরুজের থেকে না, ওই ব্লাডি বিচের থেকে। তারপর জা*নোয়ারের কলিজা কত বড় হয়েছে চিঁ*ড়ে দেখবো।”
সারহান ক্রোধান্বিত কন্ঠে বলল। আবির আর এ মুহুর্তে কথা বাড়াল না। সে চুপচাপ গাড়ি চালাতে লাগল। এ সময়ে নিস্তব্ধতা ভেঙে সারহানের ফোনের রিংটোন কর্কশ শব্দে বেজে উঠল। সারহান হাতে থাকা ফোনের স্কিনে নজর দিলো। সাদাত কল দিয়েছে। সে সময় ব্যয় না করে কল রিসিভ করে কানে গুঁজল। তখনি সাদাতের উদ্বিগ্ন, শঙ্কিত কন্ঠস্বর শোনা গেল;
“ ভাই! অরিত্রিকাকে পাওয়া যাচ্ছে না।”

প্রণয়ের সন্ধিক্ষণে সিজন ২ পর্ব ৭৮ (২)