প্রণয়ের সন্ধিক্ষণে সিজন ২ পর্ব ৮১ (২)

প্রণয়ের সন্ধিক্ষণে সিজন ২ পর্ব ৮১ (২)
আদ্রিতা নিশি

সারহান অরিত্রিকার হাত ধরে স্টেজে তুলতেই, ওপর থেকে লাল গোলাপের পাপড়ি ঝিরিঝিরি বৃষ্টির মতো ঝরে পড়তে লাগল। বিস্ময়ভরা দৃষ্টিতে অরিত্রিকা তাকাল গোলাপের পাপড়ি গুলোর দিকে। কিয়ৎ সময় পর নিজেকে সামলে সেই দৃশ্য উপভোগ করতে লাগল। সে চতুর্দিকে নজর বুলিয়ে নিল। ঠিক তখনই সামনে দেয়ালের পাশে স্থাপিত বিশাল প্রজেক্টরে ভেসে উঠল তাদের এনগেজমেন্ট ও আকদের দিনের কিছু মনোমুগ্ধকর ছবি।

এরপর দেখা গেল পরিবার-পরিজনের সঙ্গে তোলা ছবি এবং লেভির সঙ্গে কাটানো দু’জনের কিছু বিশেষ মুহূর্ত। তারপর পর্দায় ফুটে উঠল বিয়ের কাবিনের দৃশ্য। অরিত্রিকার চারবার উচ্চারিত কবুল শব্দ সবাই মনোযোগ দিয়ে দেখছিল। মুহূর্তেই চারপাশে মুখ চেপে হাসির ঢেউ উঠল; সারহানের বন্ধু ও কাজিনদের মধ্যে শুরু হলো হৈ-হল্লা। লজ্জায় অরিত্রিকার গাল লাল হয়ে উঠল। সে চোখের পাতা নামিয়ে সংকোচভরা দৃষ্টিতে সারহানের দিকে তাকাল। সারহান সেই দৃষ্টি দেখে তার হাতের মুঠোয় থাকা কোমল হাতটি দৃঢ়ভাবে চেপে ধরল। অতি শীতল কন্ঠে বলল;

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

“কি হয়েছে?”
অরিত্রিকা কুন্ঠা ঠেলে মিনমিন করে বলল;
“সবাই দেখে ফেলল আমি আকদের দিন চারবার কবুল বলেছিলাম। আমার লজ্জা লাগছে।”
সারহান হাসি সংবরণ করে পূর্বের ন্যায় বলল;
“সবাই দেখুক আমার বিবিজান আমাকে বিয়ে করার জন্য কতোটা উতলা হয়েছিল।”
অরিত্রিকা লজ্জায় হাসফাস করে উঠল। চক্ষুদ্বয় নিচে নিবদ্ধ করে ক্ষীণ স্বরে বলল;
“আমি মোটেও উতলা হইনি।”
“ভিডিওটা দেখে স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে তুই কতোটা ওভারএক্সাইটেড ছিলি।”
“আর আপনি আমাকে দেখার জন্য উতলা হয়েছিলেন মনে নেই।”
“মনে কেন থাকবে না? এখনো তো মনটা অশান্ত। ইচ্ছে করছে বউরুপে তোকে বুকে আগলে নিয়ে নিজেকে শান্ত করতে।”

“আস্তে বলুন। কেউ শুনে ফেলবে।”
অরিত্রিকা এহেন কথায় চমকে উঠে বলল। সারহান নিঃশব্দে মুচকি হাসল। তারপর অরিত্রিকার হাত ধরে তাকে নিয়ে পাশে বসে পড়ল। ততক্ষণে ভিডিওটা শেষ হয়ে গেছে। অতিথিরা একে একে ফুলের তোড়া হাতে এসে অভিনন্দন জানাতে লাগলেন। সেই পর্ব শেষ হতেই শুরু হলো ছবি তোলার অনুষ্ঠান। সারহানের বন্ধুমহল, পরিবার ও আত্মীয়রা পর্যায়ক্রমে এসে ছবি তুলল; এরপর দলীয় নেতারাও এসে একসঙ্গে ছবি তুললেন। অরিত্রিকার মামা-মামী এবং আয়নাল সাহেবের পরিবার এসে শুভেচ্ছা জানালেন। যদিও আহিয়াদ ও মীরাত উপস্থিত থাকতে পারেনি, তারা রাতেই ফোনে শুভকামনা জানিয়েছে। এভাবে দুপুর গড়িয়ে দুইটা বেজে গেল। অতিথিদের খাওয়া-দাওয়ার আয়োজনও ততক্ষণে সম্পন্ন হয়ে গেছে।

“কীরে ব্যাটা! আর কতোক্ষণ ভাবীর পাশে দাঁড়িয়ে থাকবি?”
পৃহালের এহেন কথা শুনে অরিত্রিকা সামনে তাকাল। গুটি কয়েক মানুষদের চিনতে তার অসুবিধা হলো না। এরা সবাই সারহানের বন্ধু-বান্ধব। কিন্তু সেসবের মাঝে ইলহামকে দেখে অস্বস্তি হলো। সে মাথা নত করে চুপচাপ বসে রইল। সারহান ভ্রুযুগল কুঁচকে তাকাল সবার দিকে। ইলহাম হেসে বলল;
“যে ছেলে আগে মেয়েদের ইগনোর করতো সেই ছেলে বউ পাগল হয়ে যাবে কে জানতো? ভাবীকে একমুহূর্ত ছাড়ছে না দেখেছিস!”
সবাই একযোগে বলে উঠল ;
“সেটাই দেখছি।”
অরিত্রিকা ভাবী ডাক শুনে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলল। মুন বলে উঠল ;

“সারহানের সাথে আবিরও বউ পাগল হয়েছে। ওই দেখ বউয়ের আশেপাশে ঘুরঘুর করছে।”
সবাই সেদিকে তাকাল। আবির অরিনের আশেপাশে ঘুরাঘুরি করছে তা দেখে হাসল। সারহান গম্ভীর কণ্ঠে বলল;
“সিঙ্গেলরা মিঙ্গেলদের সহ্য করতে পারে না তার প্রমাণ তোরা।”
সবাই তড়িৎ বেগে সারহানের দিকে তাকাল। এক প্রকার জোরালো কন্ঠে বিরোধীতা করতে লাগল। দলীয় নেতারা এবং কর্মীরা দাওয়াত কবুল করে চলে গেছে। যারা আছে তারা নিকট আত্মীয় স্বজন।
“আমার দিকে তাকিয়ে কি দেখছেন মিস্টার ইয়ারফোন?”
রাহার কথায় ইরফানের ধ্যান ভাঙল। সে এতোক্ষণ স্থান-কাল ভুলে তার একমাত্র বউকে দেখছিল। মেয়েটাকে গোলাপী শাড়ি পড়ে সদ্য ফোঁটা গোলাপের মতো লাগছে। এ রুপে সে ক্ষণে ক্ষণে বেসামাল হচ্ছে। নিজেকে সামলে পূর্ণ দৃষ্টি মেলে রমণীর পানে চাইল। সহালকা হেসে বলল;

“তোমাকে দেখছি।”
রাহা মৃদু হেসে বলল;
“আগে কখনো দেখেননি আমায়?”
“দেখছি তো। তবে আজকে তোমাকে মারাত্নক সুন্দর লাগছে। মনে হচ্ছে নতুন করে তোমার প্রেমে পড়ছি।”
“তাই! আপনাকেও হ্যান্ডসাম লাগছে মিস্টার।”
“থ্যাংকস ওয়াইফি।”
“ভাইয়া – অরিত্রিকাকে অনেক সুন্দর লাগছে তাই না?”
রাহা স্টেজের দিকে তাকিয়ে বলল। ইরফান সেদিকে একবার তাকিয়ে হাসি বজায় রেখে বলল;
“হুমম। একদম পারফেক্ট কাপল লাগছে।”
রাহা খানিকটা এগিয়ে এসে বলল;
“হুমম।”

“সারহান, অরিত্রিকার রিসেপশন দেখে আমাদের বিয়ের কথা মনে পড়ে যাচ্ছে। কেমন অদ্ভুত পরিস্থিতিতে পড়ে বিয়েটা হয়েছিল। তবে একদিক দিয়ে ভালোই হয়েছে তোমার মতো মিষ্টি একটা বউ পেয়েছি।”
“যদি ওমন ভাবে বিয়ে না হতো তাহলে আপনি কি আমায় বিয়ে করতেন?”
“তোমাকে বিয়ে আদৌও করতাম কিনা জানিনা। তবে কি জানো সৃষ্টিকর্তা তোমাকে আমার ভাগ্যে লিখে দিয়ে ভালো করেছেন। দ্বিতীয়বার ভালোবেসে তোমাকে আঁকড়ে ধরে বাঁচার সুযোগ দিয়েছেন। আমি সত্যি ভাগ্যবান তোমার মতো মিষ্টি মেয়েকে জীবনসঙ্গিনী হিসেবে পেয়ে।”
“আমিও ভাগ্যবতী আপনাকে জীবনসঙ্গী হিসেবে পেয়ে। ভালোবাসি মিস্টার ইয়ারফোন।”
রাহা হেসে নিচু স্বরে বলল। ইরফান হেসে উঠল। স্বাভাবিক ভাবে প্রতিত্তোর করল ;
“ভালোবাসি বাচাল মেয়ে।”
রাহা শব্দ করে হেসে উঠল। সেই মনোমুগ্ধকর হাসিতে ইরফানের চোখ আঁটকে গেল। হঠাৎ শীতল কন্ঠে বলে উঠল;

“রাহা!”
রাহা হাসি থামিয়ে বলল;
“বলুন।”
ইরফান মুচকি হাসল ;
“তুমি আমায় অনেক আগে থেকে ভালোবাসতে অথচ অনুভূতি প্রকাশ করোনি। কিন্তু আমি তোমার চোখে সেই অনুভূতির বহিঃপ্রকাশ দেখেছিলাম। তবুও আবেগ ভেবে চুপ ছিলাম। আমি ভুল ছিলাম তা এখন বুঝতে পারছি। ওটা আবেগ ছিল না বরং তোমার ভালোবাসা ছিলো।”
রাহা চক্ষুদ্বয় বড় হয়ে গেল। সে আশ্চর্যিত হলো৷ মানুষটা তার ভালোবাসা সম্পর্কে অবগত ছিলো? তবে এতোদিন পরে তা কেন জানালো। ইরফান সেই চাহনি দেখে বলল;
“কি হলো ওমন করে তাকিয়ে আছো কেন?”

রাহা থতমত খেয়ে গেল। সে দ্রুত অন্যত্র তাকাল। তখুনি ভেসে এলো মাইক্রোফোনের ভেসে এলো। সবাই সরাসরি তাকাল স্টেজের দিকে। আরশাদ সাহেব হাতে মাইক্রোফোন নিয়েছেন সবার উদ্দেশ্য কিছু বলার জন্য।
“আজ আমার বড় ছেলে, সারহান ইদায়াত চৌধুরীর বিয়ের রিসেপশন। এই বিশেষ দিনে আমাদের আনন্দের শেষ নেই। আমার পুত্রবধূ অরিত্রিকা ফাইরুজ চৌধুরী। সে শুধু ছেলের বউ নয়, আমাদের পরিবারেরই এক আদরের মেয়ে। এমন স্নিগ্ধ, মিষ্টি আর লক্ষ্মী সন্তান পুত্রবধূ হিসেবে পেয়ে আমরা গর্বিত। আর হ্যাঁ, এই আনন্দঘন মুহূর্তে আপনাদের সঙ্গে আরও একটি সুখবর শেয়ার করার আছে…।”

আরশাদ সাহেব উপস্থিত সবাইকে উদ্দেশ্য করে বলল। মেহমান, আত্নীয় স্বজনরা উৎসুক, আগ্রহী হয়ে তাকিয়ে রইল সুখবর শোনার জন্য। সারহান অরিত্রিকাকে সাথে নিয়ে এসে বাবার পাশে দাঁড়াল। অতঃপর ইশরা করল বাবাকে বলার জন্য। আরশাদ সাহেব সবাইকে একবার দেখে নিলেন। তারপর ভরাট কন্ঠে এনাউন্সমেন্ট করলেন;
“দুই পরিবারের সম্মতিতে আমার ছোট ছেলে সাদাত আসতাফ চৌধুরীর সঙ্গে আমার ভাগ্নি ইশরা শেখ-এর এনগেজমেন্টের সিদ্ধান্ত নিয়েছি। ওদের দুজনের পড়াশোনা শেষ হলে বিয়ে সম্পন্ন করা হবে। এনগেজমেন্টের দিন নির্ধারিত হয়েছে আগামী বছরের ৩০ জানুয়ারি।

এই শুভ অনুষ্ঠানে আপনাদের সবাইকে আন্তরিক আমন্ত্রণ জানাচ্ছি।”
আরও একটা বিয়ের অগ্রীম বার্তায় উপস্থিত সবাই খুশি হয়ে গেল। করতালিতে চতুর্দিক মুখরিত হয়ে উঠল। সাদাত এবং ইশরা পাশাপাশি দাঁড়িয়ে মনোযোগ সহকারে কথাগুলো শুনছিল। আচানক অপ্রত্যাশিত এনাউন্সমেন্ট শুনে দুজনে স্তব্ধ হয়ে গেল। স্তম্ভিত নয়নে স্টেজের দিকে তাকিয়ে রইল। সারহানের বন্ধুমহল, আফ্রিদি ইফা সবাই এসে ঘিরে ধরে শুভ কামনা দিতে লাগল। ইরফান এগিয়ে গেল বোনের দিকে। সামনে দাঁড়িয়ে হাসি মুখে বলল;
“ চড়ুই।”

ইশরার চক্ষুদ্বয় বেয়ে গড়িয়ে পড়ল অশ্রু। সে ভাই জড়িয়ে ধরে হুহু করে কেঁদে উঠল। ইরফান বোনের মাথায় হাত বুলিয়ে মজার ছলে বলল;
“কি হলো কাঁদছিস কেন? ছেলে পছন্দ হয়নি? বিয়ে, এনগেজমেন্ট ক্যান্সেল করে দিবো?”
ইশরা কন্দনরত ভেজা কন্ঠে বলল;
“ভাই.. মামু, তুমি… ”
ইরফান হেসে বলল;
“আমি অরিনের রিসেপশের মধ্যে বুঝতে পেরেছিলাম তুই সাদাতকে পছন্দ করিস। পরে খেয়াল করে দেখলাম সাদাত ও তোকে পছন্দ করে। প্রথমে এ বিষয় নিয়ে চিন্তা করছিলাম। পরে সারহানের সাথে কথা বললাম। তখন জানতে পারলাম ব্যাটা সব আগে থেকে জানতো। তারপর মামুকে জানালাম। তিনি কয়েকদিন ভেবে – চিন্তে বললেন এ সমন্ধে তার কোনো অমত নেই। ধরে নে,আজ এনাউন্সমেন্টটা সারহান আর আমার পক্ষ থেকে তোদের জন্য সারপ্রাইজ।”

ইশরার আনন্দে কান্নার বেগ বাড়ল। এতোক্ষণ বলা সব কথা সাদাত শুনল। কিন্তু নিজের কানকে যেন বিশ্বাস করতে পারল না। আবির ঝড়ের বেগে এসে সাদাতের কাঁধ চাপড়ে হাস্যজ্জ্বল ভঙ্গিতে বলল;
“শালাবাবু! সারপ্রাইজ পেয়ে কেমন বোধ করছো?”
সাদাত অবাকতার রেষ নিয়ে যান্ত্রিক কন্ঠে বলল;
“ভাইয়া, বাবা কি আমাদের সাথে মজা করছে?”
“মজা কেন করবে শালাবাবু! তুমি যা শুনছো সব সত্যি। সারহান তোমার টমেটোকে পাওয়ার রাস্তা ক্লিয়ার করে দিয়েছে। এমন রোবটের মতো দাঁড়িয়ে না থেকে হাসো।”
“ভাইয়া আমার বিশ্বাস হচ্ছে না.. ইশুর সাথে আমার এনগেজমেন্ট!”
“ঘোর থেকে বেরিয়ে এসো। সত্যি আর ছয় মাস পর তোমাদের এনগেজমেন্ট।”

আরশাদ সাহেব সাদাত এবং ইশরাকে স্টেজে ডাকল। দুজনে সংকোচ নিয়ে হেঁটে গিয়ে দাঁড়াল। অরিত্রিকার পাশে দাঁড়াল ইশরা আর সারহানের পাশে দাঁড়াল সাদাত। সে কাউকে পরোয়া না করে আবেগাপ্লুত হয়ে বড় ভাইকে জড়িয়ে ধরল। চোখের কার্ণিশ বেয়ে গড়িয়ে পড়ল আনন্দাশ্রু! কৃতজ্ঞতা জানিয়ে বলল;
“থ্যাংকস ভাই! ইশুকে আমার করে দেওয়ার জন্য। সারাজীবন আমি তোমার এ ঋণ ভুলব না।”
সারহান ভাইয়ের পিঠ চাপড়ে দৃঢ় কন্ঠে বলল;
“ইশরাকে পেয়ে গেছিস মানে এই নয় যে ওকে সহজে পাওয়া যায়। মনে রাখিস, ওর জীবনে যদি তোর কারণে একফোঁটা কষ্টও পায়, আমি কিন্তু ছাড়ব না। ভাই হই বলে ভাবিস না, অন্যায় করলে রেহাই পাবি। তাই এখন থেকেই নিজেকে ভদ্র আর সত্যিকারের জেন্টেলম্যান হিসেবে গড়ে তোলার চেষ্টা কর।”
সাদাত অশ্রুত চোখে হাসল;

“আমি ওর জন্য জীবন কুরবান করতে পারি ভাই। ওর জন্য নিজেকে বদলানো তো সামান্য বিষয়।”
“জীবন কুরবান করার দরকার নেই। যা বলেছি তাই করবি।”
“আচ্ছা।”
সাদাত হেসে সরে আসলো। তারপর আরশাদ সাহেবকে কৃতজ্ঞতা জানাল। দুই ভালোবাসার মানুষের হঠাৎ পূর্ণতা পাওয়া কতোটা সুখের তা প্রণয়ে পূর্ণতা পায় যারা শুধু তারাই জানে । আরশাদ সাহেব আরও কিছু কথা বললেন। অতঃপর একপাশে সারহান, অরিত্রিকা ও অপর পাশে সাদাত, ইশরাকে নিয়ে দাঁড়িয়ে ছবি তুললেন। আজমল সাহেব, তানিয়া বেগম ও সাথী বেগম স্টেজে আসলেন। অরিত্রিকা ও ইশরা হাসিমুখে বড়দের সালাম করল। সবাই দোয়া করে দিলেন দুই জুটিকে। চৌধুরী বাড়ির সবাই আজ ভীষণ আনন্দিত। সেই পর্ব শেষ হতেই মেহমানরা বিদায় নিতে লাগল।

অরিত্রিকার শরীরটা ভালোলাগছে না। কেমন যেন মাথা ঘুরছে। মাঝে মাঝে গা গুলাচ্ছে। সে চুপচাপ মাথা ধরে স্টেজের সোফায় বসে আছে। সারহান তার বন্ধুমহলকে বিদায় জানিয়ে স্টেজে আসতেই দেখল অরিত্রিকা নিশ্চুপ ভঙ্গিমায় বসে আছে। সে এগিয়ে এসে সম্মুখে দাঁড়াল। কিছুটা চিন্তিতগ্রস্থ কন্ঠে বলল;
“কি হয়েছে?”
অরিত্রিকা দৃষ্টি নত করে সেভাবেই ঝিমিয়ে যাওয়া কন্ঠে বলল;
“শরীর খারাপ লাগছে। মাথা ঘুরছে।”
সারহান উদ্বিগ্ন ভাব নিয়ে হাতের উল্টোপাশ দিয়ে মেয়েলী কপালে ছোঁয়ালো। শরীরের তাপমাত্রা একদম স্বাভাবিক। তবে কি গরমের কারণে অসুস্থ হয়েছে? হবে হয়তো। সে অরিত্রিকার দুই বাহু ধরে দাঁড় করালো। উদ্বিগ্ন ভাব নিয়ন্ত্রণ করে নরম কন্ঠে বলল;

“চল।”
অরিত্রিকা বিস্মিত কন্ঠে বলল;
“কোথায়?”
সারহান বলল;
“বাড়িতে।”
“কিন্তু..”
“কোনো কিন্তু না। তোর শরীর অসুস্থ এখানে আর থাকতে হবে না।”
কথাটা বলে সারহান অরিত্রিকাকে নিয়ে স্টেজ থেকে নেমে গেল। যাওয়ার সময় বাকীদের দ্রুত বাড়ি ফিরতে বলল।

রাত দশটা পেরিয়ে গেছে। চৌধুরী বাড়ির সবাই সন্ধ্যার আগেই ফিরে এসে ফ্রেশ হয়ে বিশ্রাম নিচ্ছে। অরিত্রিকাও এসে ফ্রেশ হয়ে একটু ঘুমিয়ে নিয়েছিল। সারাদিনের অতিরিক্ত চাপ ও ধকল তাকে অসুস্থ করে দিয়েছিল। তবে এখন অনেকটাই সুস্থ।রাহা, ইশরা ও অরিন মিলে তাকে পরিয়ে দিয়েছে অফ-হোয়াইট রঙের শাড়ি।যার পুরোটা জুড়ে সোনালি জরির কাজ। মুখে হালকা সাজ আর গহনার বদলে কাঁচা জারবেরা ও জুঁই ফুল দিয়ে তৈরি অলংকার।যা শোভা পাচ্ছে তার গলায়, হাতে ও টিকলিস্বরুপ কপালে মধ্যাংশে। আয়নায় নিজেকে দেখে অরিত্রিকা অপলক তাকিয়ে রইল। এমন সাজে তাকে সত্যিই অপরূপ লাগছে।

“আজকে সারহান ভাই তোকে দেখে চোখ ফেরাতেই পারবে না।”
ইশরার দুষ্টুমি করে বলে উঠল। লাজের আবেশে মুখশ্রী লাল হয়ে গেল। লাজ-শরমে মিইয়ে গেল। তা দেখে তিনজনে হাসল। অরিন বোনের কানের পিছে কাজলের টিপ দিয়ে দিলো। অতঃপর হেসে বলল;
“আমার কাঠখোট্টা ভাইটাকে শাড়ি পড়েই পাগল করেছিলি তাই না? আজও তোকে দেখে পাগল হয়ে যাবে। ”
বোনের মুখে এহেন কথা শুনে হতভম্ব হয়ে গেল অরিত্রিকা। সে উজবুকের মতো চাইল। অরিন হেসে উঠে বলল;
“আবির তোর আর ভাইয়ের প্রেমকাহিনী বলেছে আমায়।”
অরিত্রিকা মুখখানা কাচুমাচু করল। তখুনি রাহা বলে উঠল ;
“যদি রাজি হোস…… অবশেষে রাজিও হয়ে গেল। বিয়ে হয়ে রিসিপশনও হলো।”

অরিত্রিকা কটমট করে তাকাল। হাসি-ঠাট্টার মাঝেই তাকে সারহানের রুমে নিয়ে যাওয়া হলো। দরজা খুলে ভেতরে প্রবেশ করতেই কাঁচা ফুলের গন্ধ নাকে এসে লাগল। হরিণীর মতো আঁখি তুলে রুমটা দেখতেই সে হতবাক।পুরো ঘর সাজানো ক্যান্ডেল আর গোলাপে। বিছানার মাথার পেছনে সারি সারি সাদা রজনীগন্ধার মালা, ফাঁকে ফাঁকে গাঁথা লাল গোলাপ, আর মাঝখানে বাঁধা একগুচ্ছ গোলাপের সমারোহ। এমন ইউনিক সাজে যে কারও চোখ আটকে যাবে।রাহা, ইশরা আর অরিন মিলে তাকে বিছানার মাঝখানে বসিয়ে দিল। বউ ওড়না টেনে দিয়ে হাসি মুখে বাইরে চলে গেল তারা। বুকের ভেতর অরিত্রিকার নীরব তাণ্ডব শুরু হলো।কেমন যেন অদ্ভুত অনুভূতি। গলা শুকিয়ে আসছে, হাত পা ঠান্ডা হয়ে আসছে। সে শুকনো ঢোক গিলে বউ ওড়নার ফাঁক দিয়ে চারপাশে তাকাতে লাগল। মনে মনে অপেক্ষা করতে লাগল, কখন আসবে সেই কাঙ্ক্ষিত মানুষটি।

“দুই লাখ টাকা বের কর আগে তারপর রুমে দেওয়া হবে নয়তো সারারাত রুমের বাহিরে দাঁড়িয়ে থাক।”
আবিরের কথা শুনে সারহান গাম্ভীর্য ভাব নিয়ে তাকাল। আবির তা পরোয়া না করে পূর্বের ন্যায় দাঁত কেলিয়ে বলল;
“আমার দিকে ওভাবে তাকিয়ে লাভ নেই বন্ধু! এতো টাকা আমি ডিমান্ড করিনি। আশেপাশে যাদের দেখছিস তারা করেছে।”
ইশরা, রাহা হেসে একযোগে বলল;

“ভাইয়া, আমাদের মতো ছোটদের মানুষের ছোট্ট ডিমান্ড পূরণ করে দিন আর বউকে নিন। টাকা না দিলে রুমে ঢুকতে পারবেন না। কারণ দরজায় তালা মে*রেছি।”
কথাটা শেষ হতেই সাদাত পকেট থেকে চাবিটা বের করে গাল ভরে হেসে বলল;
“টাকা দাও, ভাবীকে নাও।”
সবাই ফিক করে হাসল। অরিন আর ইরফান দাঁড়িয়ে হাসছে। তারা এসবের মধ্যে নেই। প্রায় সারহানের কপালের মধ্যাংশে ভাজ পড়ল। গম্ভীর কণ্ঠে তাড়া দিয়ে বলল;
“ফ্রেশ হয়ে টাকা দিচ্ছি তার আগে রুমে ঢুকতে দে।”
আবির উচ্চস্বরে বলল;

“টাকার ক্ষেত্রে বাকীবর্গা চলবে না। আগে টাকা দে।”
সারহান গুরুগম্ভীর কন্ঠে বলল ;
“ওরা ছোট। কিন্তু তুই বড় হয়েও অবুঝের মতো ব্যবহার করছিস?”
আবির শব্দ করে হেসে বলল;
“স্যরি দোস্ত! তোর কষ্টটা বুঝতে পারছি কিন্তু আমার কিছু করার নেই।”
সারহান বিরক্তি সূচক শব্দ করে পাঞ্জাবির পকেট থেকে ফোনটা বের করে দুই লাখ টাকা আবিরের ব্যাংক একাউন্টে টান্সফার করল। অতঃপর ব্যতিব্যস্ত ভঙ্গিমায় বলল ;

“তোর একাউন্টে টাকা টান্সফার করেছি এবার দরজা খুলে দে।”
আবির ফোনটা বের করে চেক করল। দুই লাখ টাকা একাউন্টে টান্সফার হয়েছে দেখে বিশ্বজয়ের হাসি দিয়ে বলল;
“টাকা পেয়ে গেছি। শালাবাবু দরজা খুলে দাও।”
সবাই উচ্ছ্বসিত ভাব নিয়ে চিল্লিয়ে উঠল। সাদাত এসে দরজা খুলে দিতেই সারহান রুমে প্রবেশ করল। সময় ব্যয় না করে ঠাস করে দরজা বন্ধ করে দিলো। দরজার বাহিরে উপস্থিত সবাই ভয়ে লাফিয়ে উঠল। আবির বিরবির করে বলল;

“কি তাড়া!”
সারহান রুমে প্রবেশ করতেই সরাসরি তাকাল বিছানায় দিকে। বিছানা শূন্য, অরিত্রিকা নেই। তার ভ্রুযুগল কুঁচকে গেল। মেয়েটা রুম থেকে কোথায় হাওয়া হয়ে গেল? সে পুরো রুমে চোখ বুলালো। হঠাৎ দৃষ্টি স্থির হলো ডিভানে হেলান দিয়ে ঘুমিয়ে থাকা অরিত্রিকার পানে। সে মুহুর্তেই থমকে গেল। তার দুই চোখে ভর করল মুগ্ধতা, আবিষ্টতা। সে সম্মোহনী দৃষ্টি স্থির করে নিঃশব্দে ধীরজ পায়ে এগিয়ে গেল সেদিকটায়। মেয়েটার মুখ বউ ওড়নার আড়ালে লুকিয়ে আছে। পুরুষালি সত্তা বেসামাল হলো।

একপলক নিভৃতসুধার সুশ্রী মুখশ্রী দেখার জন্য অস্থির হয়ে উঠল। সে মনের ভাব সংগোপনে না রেখে দুই হাত দিয়ে বউ ওড়নাটা তুলল। অরিত্রিকার নিদ্রালু সুশ্রী মুখশ্রী দেখে মন- প্রাণ জুড়িয়ে গেল। সেই মুহূর্তে মনে হলো, তার রুমে নেমে এসেছে পূর্ণিমার চাঁদ।যার মৃদু আভায় আশপাশ স্নিগ্ধ হয়ে উঠেছে।অজান্তেই সারহানের ওষ্ঠকোণে ফুটে উঠল প্রশান্তির হাসি। বক্ষঃস্থলের গভীর থেকে ভেসে এলো দীর্ঘ, তৃপ্ত নিঃশ্বাস।তার ভেতরের সমস্ত অস্থিরতা, দিনের সব ক্লান্তি মিলিয়ে গিয়ে শুধু অনির্বচনীয়, অবর্ণনীয় টান অনুভব করল যেন পৃথিবীর সবচেয়ে আপন জিনিসটি এখন ঠিক তার হাতের নাগালে,অতি নিকটে । অস্ফুটস্বরে আওড়ালো ;

“ মাশাল্লাহ।”
অরিত্রিকার ঘুম ভেঙে গেল। সে তন্দ্রাচ্ছন্ন চক্ষুদ্বয় মেলে পিটপিট করে চাইল। সামনে তাকাতেই ভড়কে গেল। এক লাফে দাঁড়িয়ে বলল;
“আপনি কখন এলেন রুমে?”
সারহান স্বাভাবিকভাবে দাঁড়াল। স্বভাবসিদ্ধ গম্ভীরতা নিয়ে জবাব দিলো;
“তুই ঘুমচ্ছিলি তখন।”
“আসলে.. ক্লান্ত ছিলাম তাই ঘুমিয়ে গিয়েছিলাম।”
“বিছানায় না ঘুমিয়ে ডিভানে কেন ঘুমচ্ছিলি?”
“আপনি আসছিলেন না তাই এখানে এসে বসে ছিলাম। কখন ঘুমিয়ে গিয়েছিলাম বুঝতে পারিনি।”
“আর অপেক্ষা করতে হবে না।”

কথাটা অতি শান্ত কন্ঠে বলে সারহান অরিত্রিকার হাত ধরে নিজের কাছে টেনে নিলো। মেয়েটা বোধ হয় হচকচিয়ে গেল। কেমন ভ্রান্ত চাহনিতে তাকাল। সারহান আরেকটু গভীর ভাবে মিশিয়ে সুগভীর কন্ঠে বলল;
“অবশেষে অপেক্ষার অবসান ঘটিয়ে তুই আমার রাজ্যে প্রবেশ করলি।”
অরিত্রিকা কেঁপে উঠল। তার কন্ঠনালী হতে একটা শব্দও বের হলো না। কেমন জড়বস্তুর ন্যায় দাঁড়িয়ে রইল। সারহান কিছু মনে পড়তেই সরে দাঁড়াল। অতঃপর শাণিত পায়ে এগিয়ে গিয়ে আলমারী থেকে কিছু একটা বের করে এনে অরিত্রিকার হাতে ধরিয়ে দিলো। অরিত্রিকা ড্যাবড্যাব করে চাইল সেদিকে। একটা ডালায় পাঁচটি ব্লু ডি শ্যানেল পারফিউম ফ্লাস্ক। পাশে সাজানো ডায়মন্ডের একসেট গহনা, আংটি, দুইটি জামদানী শাড়ি এবং অ্যালবাম ।

“আমার তরফ থেকে তোর জন্য ছোট্ট উপহার।”
সারহান নিস্তব্ধতা ভেঙে দৃঢ় কন্ঠে বলল। অরিত্রিকা ফ্যালফ্যাল করে হাতে থাকা ডালাটার দিকে তাকিয়ে রইল। সে বুঝতে পারল এটা স্পেশাল ভাবে কাস্টমাইজ করা। বিস্মিয় ভাব নিয়ে সামনে দন্ডায়মান মানুষটির দিকে তাকাল। অবাক হয়ে বলল;
“এগুলোর কোনো দরকার ছিল না।”
সারহানের মাঝে কোনো হেলদোল দেখা গেল না। পূর্বের ন্যায় বলল;
“দরকার ছিল, লুকিয়ে আমার পারফিউম ব্যবহার করতি। তাই ভাবলাম, গিফট করি। আর এই বাকি জিনিসগুলো? আমাদের বিয়ের প্রথম রাত উম, দ্বিতীয় রাতে উপলক্ষে গিফট দিয়েছি। পছন্দ হয়নি?”
“পছন্দ হয়েছে।”
“আমার পারফিউম লেভির নাম করে আর ইউজ করবি না।”
“আপনি আমার আপনার পারফিউম ও আমার।”
“তাই!”
সারহান ভ্রুকুটি নাচিয়ে কন্ঠে শীতলতা মিশিয়ে বলল। অরিত্রিকা মৃদু হেসে রিনরিনে কন্ঠে বলল;
“হুমম।”

কথাটা বলে ডালাটা টি – টেবিলে রাখল। সারহান সেখান থেকে আংটিটা নিয়ে মেয়েলী হাতটা আলতো করে ধরল। অরিত্রিকা চকিত চাহনিতে তাকাল হাতের দিকে। তখুনি সারহান মধ্যমা আঙুলে আংটিটি পড়িয়ে দিল। অতঃপর সেই হাতটায় আঙুলের ভাঁজে ওষ্ঠদ্বয় ছুঁয়ে দিলো। সেই উষ্ণ ছোঁয়ায় মেয়েলী কায়া কেঁপে উঠল।
“ভার্সিটিতে পড়ার সময় নিজের ইনকামের টাকা জমিয়ে সবার জন্য উপহার কিনেছিলাম। তোর জন্যও ছিল, কিন্তু তুই এ বাড়িতে ছিলি না, তাই দিতে পারিনি। ভেবেছিলাম, সুযোগ বুঝে কোনো একদিন দেবো। আজ সেই সুযোগ এসেছে তাই নিজ হাতে পরিয়ে দিলাম।”
সারহান ক্ষীণ হেসে বলল। অরিত্রিকা চক্ষুদ্বয়ে ভীড় করল আনন্দাশ্রু! তার ওষ্ঠকোণে ফুটে উঠল হাসি। এটাই বুঝি ভালোবাসা! সে অন্যহাতে অশ্রু মুছল। ভেজা কন্ঠে বলল;
“আপনাকে কাছ থেকে যত দেখছি ততই অবাক হচ্ছি।”

সারহানের ওষ্ঠ প্রসারিত হলো। হঠাৎ করেই অরিত্রিকাকে কোলে তুলে নিল সে। আস্তে ধীরে এগিয়ে গিয়ে বসিয়ে দিল বিছানায়। অরিত্রিকা প্রথমে ভয়ে কুঁকড়ে গেলেও কিছুক্ষণ পর নিজেকে সামলে নিল; মুখশ্রীতে ছড়িয়ে পড়ল লাজুকতা। গুটিসুটি মেরে, চোখ-মুখ কুঁচকে চুপচাপ বসে রইল।সারহান বাঁকা হেসে লাইট নিভিয়ে দিল। ক্ষীণ ক্যান্ডেল আলো আর কাঁচা ফুলের গন্ধে রুমটা রোমাঞ্চকর হয়ে উঠেছে। ধীরে ধীরে এগিয়ে এসে সে অরিত্রিকার পাশে বসল, দু’হাতে কোমর জড়িয়ে কাছে টেনে নিল। তারপর ওষ্ঠদ্বয় ছুঁইয়ে দিল ললাটের মধ্যভাগে। মেয়েটা পরম আবেশে চক্ষুদ্বয় বন্ধ করল। মাথা রাখল প্রিয় মানুষটির বুকে। পুরুষালি স্পর্শের মাত্রা ধীরে ধীরে বাড়তে থাকল। অরিত্রিকা হঠাৎ ধাক্কা দিয়ে বিছানা থেকে নেমে তড়িঘড়ি করে ছুটল ওয়াশরুমের দিকে। অপ্রত্যাশিত এই ঘটনায় সারহান হতভম্ব হয়ে গেল। এক মুহূর্ত দেরি না করে সেও বিছানা ছেড়ে উঠে লাইট জ্বালাল। কিছু বোঝার আগেই ভেতর থেকে ভেসে এলো “ওয়াক ওয়াক” শব্দ। তৎক্ষণাৎ সারহান দৌড়ে গেল ওয়াশরুমের দিকে।

“ফাইরুজ!”
অরিত্রিকা বমি করে শরীর একবারে নেতিয়ে গেছে। সারহান ওকে ফ্রেশ করে ধরে নিয়ে ওয়াশরুম থেকে বের হয়ে আসলো। তার চোখ- মুখে ফুটে উঠেছে চিন্তিত, উদ্বিগ্ন ভাব। সেই ভাবে কয়েকবার ডাকল। অরিত্রিকা চক্ষুদ্বয় মেলে পিটপিট করে চাইল। দুর্বলচিত্তে জবাব দিলো ;
“হুমম।”
সারহান উদ্বিগ্ন ভাব নিয়ে বলল;
“আর ইউ ওকে?”
অরিত্রিকা পূর্বের ন্যায় বলল;
“আগের থেকে একটু ভালোলাগছে।”
“আমার মনে হচ্ছেনা তুই ঠিক আছিস। ডক্টরকে কল করে আসতে বলছি।”

“এতোরাতে.. ডক্টর ডাকার দরকার নেই। একটু রেস্ট নিলেই ঠিক হয়ে যাব।”
“বিকেলেও একই কথা বলে আমায় আটকিয়েছিস। তোর কথা শোনাই আমার ভুল হয়েছে।”
“সত্যি বলছি! আমি সুস্থ আছি। বিশ্বাস হচ্ছে না? ছেড়ে দিন আমি হেঁটে দেখাচ্ছি।”
কথাটি বলে একপ্রকার জোর করে নিজেকে ছাড়িয়ে নিল অরিত্রিকা। একপ্রকার জোর করেই নিজেকে ছাড়িয়ে নিল। তারপর যেন কিছুই হয়নি এমন ভঙ্গিতে মাতব্বরি করে হেঁটে দেখাতে লাগল। সারহান চোয়াল শক্ত করে সেই দৃশ্য লক্ষ্য করছিল। হঠাৎ অরিত্রিকার চোখের সামনে অন্ধকার নেমে এলো, মাথা ঘুরে উঠল আর পরক্ষণেই সে ঢলে পড়ল। ঠিক তখনই সারহান দ্রুত এগিয়ে এসে তাকে ধরে ফেলল। রাগ মিলিয়ে গিয়ে দুশ্চিন্তা ভর করলে অন্তঃকোণে। বহুবার ডাকলেও অচেতন অরিত্রিকা কিছুই শুনতে পেল না।

রাত একটা পেরিয়েছে। চৌধুরী বাড়ির লোকজন ঘুমিয়ে গিয়েছিল। কিন্তু অরিত্রিকার অসুস্থতার খবর শুনে সবার ঘুম উবে গিয়েছে। কিছুক্ষণ পূর্বে সারহান তার পরিচিত ডক্টরকে কল করেছিল৷ তিনি এসে অরিত্রিকাকে দেখছেন রুমের ভেতরে তানিয়া বেগম ও সাথী বেগম মেয়ের কাছে আছেন। দরজার বাহিরে বাড়ির সবাই চিন্তিতগ্রস্থ বদনে দাঁড়িয়ে আছেন। সারহানও চিন্তায় এদিক থেকে ওদিক পায়চারি করছে। ভেবে চলেছে, ফাইরুজের হঠাৎ কি হলো? তখুনি মনে হলো সাদাত তাকে বলেছিল সে ঢাকায় যাওয়ার পর অরিত্রিকা খাওয়া দাওয়া নিয়মমাফিক করতো না। ঠিকঠাক ভাবে ঘুমাতো না। কেমন যেন সবসময় মনমরা হয়ে থাকতো। নিশ্চয়ই শরীর দুর্বলের কারণে অসুস্থ হয়ে গেছে। ভেতরে ভেতরে রাগ লাগলো। তবুও সেই অনুভূতিকে ছাপিয়ে গিয়ে ভীড় করল দুশ্চিন্তা। কোনো গুরুতর অসুখ কিছু হয়নি তো?

“সারহান শান্ত হো। আমার মনে হচ্ছে সারাদিনের পেরেশানিতে অসুস্থ হয়ে গেছে।”
আবির বন্ধুর দুশ্চিন্তা দেখে বলে উঠল। সারহান দাঁড়াল নজর দিলো সবার দিকে। তারপর কন্ঠে দৃঢ়তা এনে বলল;
“এমনটাই যেন হয় আবির।”
আবির বলল;
“তুই টেনশন করিস না।”
সারহান উদ্বিগ্নতা চেপে নিশ্চল চাহনিতে দাঁড়িয়ে রইল। আরশাদ সাহেব এগিয়ে আসলেন ছেলের দিকে। বললেন;
“টেনশন করো না আব্বা। অরিত্রিকা সুস্থ হয়ে যাবে।”
সারহান অনুভূতি শূন্যের মতো বাবার দিকে তাকাল। কি বলবে বুঝতে পারল না। যত সময় পেরুচ্ছে ততই দুশ্চিন্তার মাত্রা বাড়ছে। সে রুদ্ধ শ্বাস ফেলে। আজমল সাহেব দূর থেকে সেই দৃশ্য খেয়াল করেন। চিন্তার মাঝেও শিথিল হয় মন। তিনি বুঝতে পারেন ছেলেটা তার মেয়েটাকে কতোটা ভালোবাসে। ইরফান, সাদাত, রাহা, ইশরা ও অরিন একপাশে দাঁড়িয়ে আছে উৎকন্ঠা নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। কিছুক্ষণ পরেই ডক্টর দরজা খুলে বেরিয়ে আসলো। আরশাদ সাহেব এবং আজমল সাহেব গিয়ে জিজ্ঞেস করলেন অরিত্রিকা কেমন আছে? কি হয়েছে? ডক্টর স্বাভাবিক ভাবে বললেন;

“টেনশনের কোনো কারণ নেই। অরিত্রিকা সুস্থ আছে।”
এতটুকু শুনে সবাই স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলল। সারহানের শঙ্কা বোধ হয় একটু কমল। তবুও সেথায় অনড় ভঙ্গিমায় দাঁড়িয়ে রইল। ডক্টর মনজুর এগিয়ে আসলেন। সারহানকে উদ্দেশ্য করে বললেন;
“কি ব্যাপার জেন্টলম্যান চুপচাপ আছো? অরিত্রিকা কেমন আছে জিজ্ঞেস করলে না?”
সারহানের ভাবমূর্তি ক্ষুন্ন হলো। ভরাট কন্ঠে বলল;
“আপনার কথা শুনেছি তাই দ্বিতীয়বার জিজ্ঞেস করিনি।”
ডক্টর মনজুর হঠাৎ সারহানের কাঁধ চাপড়ে দিয়ে হেসে বললেন;
“কংগ্রাচুলেশন জেন্টলম্যান! তুমি বাবা হতে চলেছো। দ্রুত মিষ্টিমুখ করানোর ব্যবস্থা করো।”

প্রণয়ের সন্ধিক্ষণে সিজন ২ পর্ব ৮১

ডক্টরের মুখে এমন কথা শুনে সারহান যেন মুহূর্তেই বজ্রাহত হয়ে গেল। তার চক্ষুদ্বয় বিস্ফোরিত হলো। বিস্ময়- বিমূঢ়কর হয়ে হঠাৎ চমকে উঠে দু’কদম পিছিয়ে গেল। তার পা টলমল, বুকের ভেতর অদ্ভুত কাঁপুনি অনুভব করল। বিস্ময়, অবাক আর একরাশ শিহরণ একসাথে ছড়িয়ে পড়ল সারা শরীরে। বাবা! সে…বাবা হতে যাচ্ছে! এটা কীভাবে সম্ভব! তার কাছে কথাটা কেমন অবিশ্বাস্য লাগছে।সেকেন্ড খানেক আগে পর্যন্ত সবাই স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলছিল অথচ এখন চারপাশ নিস্তব্ধ। বিস্মিত, হতবুদ্ধিকর আর কৌতূহলী সব দৃষ্টি একসাথে বিদ্ধ করে তাকিয়ে আছে সারহানের দিকে। তারা সবাই কি শুনল অরিত্রিকা প্রেগন্যান্ট!তখুনি নিস্তব্ধতা ভেঙে আবির চিল্লিয়ে বলে উঠল;
“দোস্ত এটা তুই কি করলি? বাসর ঘরে ঢোকার ত্রিশ মিনিট পরে বাবা হয়ে গেলি?”

প্রণয়ের সন্ধিক্ষণে সিজন ২ পর্ব ৮২