প্রণয়ের সন্ধিক্ষণে সিজন ২ পর্ব ১
আদ্রিতা নিশি
“আমি আপনার মতো কাঠখোট্টা, বদমেজাজি, যন্ত্রমানবকে বিয়ে করতে চাই এমপি সাহেব। যদি আপনি আমাকে বিয়ে করতে রাজি থাকেন তাহলে নিচে দেওয়া নম্বরে যোগাযোগ করুন। ”
নীল চিরকুটের মধ্যংশে গোটা গোটা অক্ষরে উক্ত লেখাটি পড়তেই চোয়াল শক্ত হয়ে উঠল নবনির্বাচিত এমপি সারহান ইদায়াত চৌধুরীর। সে রক্তচক্ষু চাহনিতে তাকাল তার পিএ আবিরের দিকে। চোখে মুখে ফুটে উঠেছে বিরক্তিভাব আর ক্রোধ। আবির মুখ কাচুমাচু করে মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে আছে। মুখাবয়বে ফুটে উঠেছে আতংক আর ভয়। কেন যে চিরকুটটা সারহানকে দিলো? একবার কাগজটা চেক করলে আর এই মসিবতে পরতে হতো না। নিজের বিপদ নিজেই ডেকে আনলো। এখন নিশ্চয়ই সারহান তার খবর করবে।
সারহান তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে দাঁতে দাঁত চেপে গম্ভীর কণ্ঠে শুধালো;
“ কোন বেয়াদব মেয়ে এই চিরকুট দিয়েছে?”
আবির ভীতিগ্রস্ত ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে আছে। তার গলা শুকিয়ে কাঠ হয়ে আসছে। ভয়ার্ত কন্ঠে উত্তর দেয়;
“ভার্সিটির একটা ছেলে এসে আমার হাতে চিরকুট ধরিয়ে দিয়ে বলল কোনো জরুরী কথা লেখা আছে তোকে যেন দেই।”
সারহানের ভাবমূর্তি অক্ষুণ্ণ রইল। ক্রোধের মাত্রা তরতর করে বাড়তে লাগল। পুরুষালী হাতের মুঠোয় নীল চিরকুটখানা সর্বোচ্চ শক্তি প্রয়োগ করে পিষ্ট করল। গাম্ভীর্য এঁটে বলল;
“ ছেলেটাকে আমার এই মুহুর্তে এখানে চাই আবির। ”
আবির দ্রুততার সহিত আমতা আমতা করে বলে উঠল;
“কাজ হয়ে যাবে। একটা প্রশ্ন করব?”
“কর।”
“কাহিনী হলো ছেলেটা তোকে কেন বিয়ে করতে চায়? না মানে একটা ছেলে আরেকটা ছেলেকে বিয়ে করতে চাইছে এটা কেমন যেন অদ্ভুত লাগছে?”
আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন
আবিরের মুখ থেকে বের হওয়া শব্দগুলি যেন সারহানের মধ্যে থাকা ক্রোধকে দ্বিগুন বাড়িয়ে দিয়েছে। আবির এমন একটি দাহ্যতা তৈরি করল যা সারহানের কাছে আগুনে ঘি ঢালার কাজ করেছে। সারহান নিজের অস্থিরতা আর রাগ সংবরণ করতে না পেরে চেয়ারটি তীব্র শব্দে ঠেলে সরিয়ে দিল। সে মুহূর্তেই উঠে দাঁড়াল পাঞ্জাবি সোজা করে গা-ছমছমে মনোবলে ক্রোধ নিয়ন্ত্রিত করে আবিরের সামনে স্থির হয়ে দাঁড়াল। সারহানের সূচালো দৃষ্টি যেন আবিরের অন্তরদৃষ্টি পর্যন্ত পৌঁছে যাচ্ছিল। তিরিক্ষি মেজাজে বদ্ধমূল কণ্ঠে বলল:
“লেখার ধরন বলে দিচ্ছে এটা কোনো মেয়ে আমাকে উত্তেজিত করার জন্য ইচ্ছে করে লিখেছে। আর কোনোদিন যদি এমন উল্টা পাল্টা বকেছিস, তাহলে কথা বলার অবস্থায় থাকবি না। যে কাজ দিয়েছি সেটা দ্রুত শেষ কর।”
আবির ভয়ে তটস্থ হয়ে গেছে। তার নির্বুদ্ধিতার কারণে সে গভীর লজ্জিত অনুভব করছে । আসলে এমন একটি চিরকুট কোনো মেয়ে দিতে পারে এমনটা তার মনে আসেনি। আজ বেঁচে গেছে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রোগ্রামে এসে, নয়তো পার্টি অফিসে থাকলে হয়তো পরিস্থিতি আরও ভয়াবহ হতো এবং তার পশ্চাতে দুই-চারটা লাথি পড়তো। আবিরের নিকটে এখানকার পরিবেশ রেড অ্যালার্টের মতো, যে কোনো মুহূর্তে বড় কিছু ঘটতে পারে। তাই সে দ্রুত সিদ্ধান্ত নিল এখান থেকে বেরোতে হবে। সময় নষ্ট না করে তাড়াতাড়ি প্রশাসনিক ভবনের একটি রুমে চলে গেল সে।
সারহান গম্ভীর মুখে আবারও বসে পড়ল চেয়ারে। এক হাতে কপালের মধ্যাংশে আঙুল দিয়ে স্পর্শ করল। নানা ভাবনা তাকে ঘিরে ধরেছে। আজ রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে একটা প্রোগ্রামে এসেছিল। মূলত নবনির্বাচিত এমপি হওয়ায় রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডে যুক্ত নেতাকর্মী সহ, বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রসমাজ এবং প্রফেসরেরা মিলে সংবর্ধনা দেওয়ার জন্য বিশ্ববিদ্যালয় প্রাঙ্গনে প্রোগ্রাম রেখেছিলেন। রাজশাহী “১” আসনের তরুণ প্রজন্মের আইডল এবং নবনির্বাচিত এমপিকে একনজর দেখার জন্য মানুষের ঢল উপচে পড়ছিল। দীর্ঘ তিন ঘন্টা সাধারণ মানুষসহ সকল পেশার ভালোবাসায় সিক্ত হয়েছে সারহান। প্রোগ্রাম শেষ করে প্রশাসনিক ভবনের একটা রুমে সাময়িক ভাবে বিশ্রামের জন্য ব্যবস্থা করা হয়েছিল। এর মাঝে আবির এসে চিরকুট দিল ব্যাস শান্তি যেন জানালা দিয়ে পলায়ন করল।
“ কি হলো ইয়াং ম্যান! বেশ চিন্তিত মনে হচ্ছে। ”
প্রফেসর নিয়াজ মোর্শেদের কন্ঠস্বর কর্ণকুহরে প্রবেশ করতেই সারহানের ভাবনায় ছেদ পড়ে। হাতে পিষ্ট চিরকুট বিক্ষিপ্ত ভঙ্গিতে পরনের শুভ্র রঙের পাঞ্জাবির পকেটে রেখে উঠে দাঁড়ায়। ভাবভঙ্গি স্বাভাবিক করে মৃদু হেসে বলে উঠল ;
“আসসালামু আলাইকুম স্যার।”
পঞ্চাশোর্ধ প্রৌঢ় ব্যক্তি অমায়িক হাসি দিয়ে ধীর পায়ে রুমের ভেতর প্রবেশ করলেন। তার মুখাবয়বে কোনো তাড়াহুড়ো ছিল না। আস্তে আস্তে এগিয়ে এসে সারহানের কাঁধে ভালোবাসাপূর্ণ চাপড় দিলেন। উচ্ছ্বসিত হয়ে জিজ্ঞেস করলেন;
“ওয়ালাইকুম আসসালাম, ইয়াং ম্যান। কেমন আছো?”
“ আলহামদুলিল্লাহ ভালো। আপনি কেমন আছেন স্যার?”
প্রৌঢ় ব্যক্তিটি বসলেন চেয়ারে। প্রসন্নতার সহিত গর্বিত হয়ে বললেন;
“ আলহামদুলিল্লাহ ভালো আছি। অনেকদিন পর দেখা। তোমার রাজনৈতিক ক্যারিয়ারের সাফল্যে আমি ভীষণ খুশি। আমার কাছে সব থেকে চমকপ্রদ খবর হলো তুমি প্রথমবারেই এমপি হয়েছো। আই অ্যাম ইমপ্রেসড।”
সারহান দৃঢ় শান্ত কন্ঠে প্রতিত্তোর করল;
“ আপনাদের ভালোবাসা আর দোয়ার জন্য সম্ভব হয়েছে। ”
“ তা তো বটেই। দাঁড়িয়ে আছো কেন? বসো। ”
সারহান ব্যক্তিটির পাশের চেয়ারে বসল।প্রফেসর নিয়াজ মোর্শেদ, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি ডিপার্টমেন্টের সিনিয়র প্রফেসর এবং একজন সশিক্ষিত ও অভিজ্ঞ মানুষ। যিনি ছাত্রদের মাঝে এক অদ্বিতীয় মর্যাদা ও শ্রদ্ধা অর্জন করেছিলেন। কিন্তু তার ছাত্র, সারহান, একেবারেই ভিন্ন একটি পথ বেছে নিয়েছিল। রাজনীতির প্রতি তার আগ্রহ ছিল শুরু থেকেই। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে ইংরেজি ডিপার্টমেন্টে ভর্তি হওয়ার পর থেকেই পড়াশোনার পাশাপাশি রাজনীতির মাঠে প্রবেশ করে।সারহান ছাত্র রাজনীতির মাধ্যমে প্রথম রাজনীতিতে পা রাখে। ছাত্র সংগঠনগুলোর মিটিং, মিছিল, আন্দোলনে সক্রিয় অংশগ্রহণ করতে করতে সে তার রাজনৈতিক কৌশল এবং দলীয় মনোভাব আরও মজবুত করে তোলে। বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রদের মধ্যে যে ধরনের তৎপরতা ছিল, তার মধ্যে সারহান নিয়মিত উপস্থিত থাকতো এবং বিভিন্ন ইস্যুতে তার দলীয় অবস্থান স্পষ্ট করত। তার বক্তৃতা এবং উপস্থিতি, বিশেষ করে আন্দোলন বা মিছিলের সময়ে, প্রমাণ করে যে সে শুধু একজন ছাত্র নেতা নয়, বরং একটি শক্তিশালী রাজনৈতিক চরিত্র হয়ে উঠতে পারে।
রাজনৈতিক জগতের প্রতি তার এই আগ্রহ তাকে আরও বড় পরিসরে পরিচিতি এনে দেয়।সে একসময় রাজশাহীর গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক নেতাদের সাথে সম্পর্ক স্থাপন করে। পেশাদার আইনজীবী, পুলিশ, প্রশাসনিক কর্মকর্তাদের সাথে নিয়মিত ওঠাবসা শুরু হয়ে, তার প্রভাব এবং ক্ষমতা বাড়তে থাকে। একদিকে যেখানে সাধারণ মানুষ তাকে ছাত্র রাজনীতির একজন উদীয়মান নেতা হিসেবে দেখতে শুরু করে, অন্যদিকে রাজনৈতিক নেতারা তাকে একটি দক্ষ এবং প্রতিশ্রুতিশীল নেতা হিসেবে মূল্যায়ন করতে শুরু করে।পরে, যখন প্রাক্তন এমপি মহোদয় অসুস্থ হয়ে পড়েন, সারহান দলের পক্ষ থেকে এমপি পদে দাঁড়ানোর সিদ্ধান্ত নেয়। তার রাজনৈতিক ধারনা এবং নেতৃস্থানীয় ব্যক্তিত্বের কারণে স্থানীয় জনগণের মধ্যে একটি নতুন আস্থা তৈরি হয়। সাধারণ মানুষের প্রতি তার নিবেদিত মনোভাব এবং জনকল্যাণমূলক কাজের অভিপ্রায় তাকে রাজশাহী ১ আসনের এমপি হিসেবে নির্বাচিত হতে সাহায্য করে।সারহানের নির্বাচনী প্রচারনা, জনসংযোগ এবং রাজনৈতিক কৌশল এমন ছিল যে, তার রাজনৈতিক সহযোদ্ধা এবং প্রতিপক্ষ সবাই তার উন্নত চিন্তাভাবনা এবং কার্যকারিতা মেনে নেয়। তার এ যাত্রা শুধুমাত্র একটি রাজনৈতিক অভিযান ছিল না বরং তিনি রাজনীতির আসল অর্থ এবং উদ্দেশ্যকে চ্যালেঞ্জ করে জনগণের সেবা এবং তাদের অধিকার আদায়ের জন্য দৃঢ়প্রতিজ্ঞ ছিলো।
প্রফেসর নিয়াজ মোর্শেদ অভিব্যক্তি দৃঢ়। তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে সারহানের দিকে তাকালেন। সচেতন করতে প্রগাঢ় কন্ঠে বললেন;
“ রাজনীতি মানুষকে মানুষ থেকে পশু বানিয়ে দেয় সারহান। কয়েকদিন আগে তুমি ছিলে একজন প্রথম সারির রাজনীতিবিদের ডান হাত আর এখন তুমি একজন এমপি। চোখ কান খোলা রেখে চলা ফেরা করো। যে পথে পা বাড়িয়েছো সে পথে কাটা ভীষণ। সাবধানে হাটঁলেও পায়ে কাটা বিদ্ধ হবে এটাই কঠিন বাস্তব। কি বলতে চাইছি নিশ্চয়ই বুঝেছো? ”
সারহান অদ্ভুত হাসে। শান্ত কন্ঠে প্রতিত্তোর করে ;
“ ইচ্ছাকৃত এই অন্ধকার রাজনীতিতে জড়িয়েছি নিজেকে। এই পথ আমার জন্য সুগম নয় বরং দুর্গম। মানুষের কল্যানে যদি এই পথে ম’রতে হয় তা আমি সমাদরে গ্রহণ করতে প্রস্তুত। আমার জীবনের পরোয়া করি না আমি।সব পিছুটান মাড়িয়ে তারপর এই পথে এসেছি সাধারণ জনগনের জন্য।”
প্রফেসর নিয়াজ মোর্শেদ অদ্ভুত হাসলেন। হাসি বজায় রেখে বললেন;
“পরিবারের পিছুটান কাটাতে পেরেছো কি? যখন বিয়ে করবে, সংসারী জীবন শুরু করবে, স্ত্রী এবং সন্তান থাকবে তখন কী করবে? নতুন করে পিছুটান তৈরি হবে, সেটা কি ভেবে দেখেছো?”
সারহান চেয়ারে শরীর এলিয়ে বসল। দুই চোখ বন্ধ করল। নিরেট কন্ঠে বলল;
“ পরিবারের পিছুটান সহজে কাটানো সম্ভব নয় স্যার। তবে আমার জীবনে পরিবার ব্যতিত অন্য কারো জন্য দুর্বলতা কখনো তৈরী হতে দেবো না।”
“আমি আপনাকে ভীষণ ভালোবাসি। আপনার মতো খাটাশ লোককে আমার ভালোবাসায় মানুষ বানাতে চাই এমপি সাহেব।”
এই কথাটি বলেই এক মেয়ে অট্টহাসিতে ফেটে পড়ল। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাফেটেরিয়ায় বসে ছিল পাঁচজনের একটি ছোট দল। যার মধ্যে হাস্যরসের প্রবাহ এক মুহূর্তের জন্য থামছিল না। গোল টেবিলের উপর সাজানো ছিল নানা রকমের খাবারের বিশাল সমাহার আর প্রত্যেকেই চেয়ারে আরামদায়ক ভঙ্গিতে বসে ধোঁয়া ওঠা চায়ে চুমুক দিতে ব্যস্ত। গোধূলি লগ্ন পেরিয়ে সন্ধ্যা ধীরে ধীরে আসছে কিন্তু সে মুহূর্তের স্নিগ্ধতায় কিছুমাত্র পরিবর্তন ঘটছে না এই শিক্ষার্থীদের মনে। তারা নিজেদের একান্ত জগতে মগ্ন আচ্ছন্ন নিজেদের ভাবনাতে যেন পৃথিবীর বাকি সমস্ত কিছুই তাদের কাছে গুরুত্বহীন।
রাহা চায়ে চুমুক দিয়ে চিন্তিত মুখে বলল,
“অরিত্রিকা, কাজটা কি ঠিক করেছিস? যদি একবার জানতে পারে, ওই চিরকুট আমরা উনাকে মজা করে দিয়েছি, তখন কি হবে, বুঝতে পারছিস?”
অরিত্রিকা নিশ্চিত হয়ে চায়ে চুমুক দিচ্ছে, যেন কিছুই হয়নি। তার মুখাবয়বে এক ধরনের আত্মবিশ্বাস ফুটে উঠছে। এমপিকে এসব আজেবাজে কথা লিখেও তার মনে কোনো ভয় কাজ করছে না, তা স্পষ্ট। সে আশপাশের সবাইকে এক ঝলক দেখে তারপর ভ্রুক্ষেপহীনভাবে বলে ওঠে,
“আমি ওই গোমড়ামুখো এমপিকে ভয় পাই নাকি! একবার আসুক না আমার সামনে, দেখিয়ে দিবো আমি কি জিনিস।”
একটু থেমে রুহানকে উদ্দেশ্য করে অরিত্রিকা লাজুক হাসার ভাণ করে বলল;
“ এমপি সাহেবকে আমার বিয়ের প্রপোজালটা ঠিকঠাক মতো পৌঁছে দিয়েছিস তো রুহান? ”
রুহান দাঁত কেলিয়ে হাসে। বেশ ভাব নিয়ে বলে উঠল ;
“ একদম ঠিকঠাক ভাবে পৌঁছে দিয়েছি। ”
তিশা আর রুদ্র অবাক চাহনিতে অরিত্রিকার দিকে তাকিয়ে আছে। এই মেয়ের মনে চলছে কি কেউ বুঝে উঠতে পারছে না। ক্যাম্পাসে এতো ছেলে বাদ দিয়ে অরিত্রিকা কেন এই এমপির পেছনে পড়ল বুঝে উঠতে পারছে না কেউ। যদি একবার ধরা পড়ে যায় তখন কি হবে ভেবেই হাত পা ঠান্ডা হয়ে আসছে দুজনের।
তিশা আশেপাশে সতর্কতার সহিত তাকাল। তারপর চাপা স্বরে বলল;
“ বইন এসব পাগলামি মাথা থেকে ঝেড়ে ফেল। আমি অকালে ম’রতে চাই না আর তোকেও ম’রতে দেখতে চাই না। ”
অরিত্রিকা যেন কথা শুনেও শুনলো না। নির্লিপ্ত ভঙ্গিতে বলল ;
“ এতো ভয় কেন পাচ্ছিস ভীতুর দল। যা করছি চুপচাপ দেখে যা। ”
“এসব কেন করছিস বল? আমি শিউর তুই এটা মজা করে করছিস না। তোর ইনটেনশন সারহান ইদায়াত চৌধুরীকে হেনস্তা করা। ”
“ সঠিক ধরেছো বাছা। আমার খেয়ে দেয়ে কাজ নেই ওই খাটাশ লোককে বিয়ে করবো। বদমেজাজি, কাঠখোট্টা লোক একটা অসহ্য। ”
রুহান চায়ে চুমুক দিয়ে এক নিমেষেই শেষ করে দিল। ফুরফুরে মেজাজে সামনের দিকে তাকাতেই হাসি মুখখানা চুপসে পাংশুটে বর্ণ ধারণ করল। ভয়ার্ত ভঙ্গিতে শব্দ করে চায়ের কাপ রাখল টেবিলে। কলেজ ব্যাগ কাঁধে নিয়ে তটস্থ ভঙ্গিতে উঠে দাঁড়াল চেয়ার থেকে। নিজেকে বাঁচাতে পা বাড়ালো অন্যত্র।
“ এই রুহান কই যাচ্ছিস?”
অরিত্রিকার কন্ঠস্বর শুনে রুহান পিছু ফিরে তাকায়। হাতের কনিষ্ঠ আঙুল উঁচিয়ে ঢোক গিলে মিনমিন করে বলল;
“ইয়ে পেয়েছে তাই ইয়ে করতে যাচ্ছি। ”
অরিত্রিকা বাদে সবাই শব্দ করে হেসে উঠল। অরিত্রিকা নাক মুখ কুঁচকে বলল;
“ দাঁড়িয়ে না থেকে দ্রুত ওয়াশরুমে যা। নয়ত এখানে ইয়ে করে দিবি। ”
রুহানকে আর পায় কে। বাছা আপন প্রাণ বাঁচিয়ে ছুটলো ক্যাম্পাসের ভেতরে। অরিত্রিকা আবারও মেতে উঠল আড্ডায়।
“তোমাদের মধ্যে রুহান কে?”
পেছন থেকে ভেসে আসা গভীর, দৃঢ় ও ভারী পুরুষালী কণ্ঠস্বর কর্ণকুহরে প্রবেশ করতেই অরিত্রিকাসহ উপস্থিত সকলে চমকে ওঠে। মুহূর্তের মধ্যে চেয়ার ছেড়ে তটস্থ ভঙ্গিতে উঠে দাঁড়ায় সবাই।পেছনে ফিরে তাকাতেই দেখা যায় একজন লম্বা, সুঠাম দেহের সুদর্শন পুরুষ দাঁড়িয়ে আছেন। পরণে সাদা পাঞ্জাবি। পাঞ্জাবির হাতা কনুই অব্দি গুটানো। খোঁচা খোঁচা দাড়িতে অসম্ভব সুন্দর লাগছে। চোখে কালো চশমা আর হাতে ব্ল্যাক বেল্টের ঘড়ি। তার চোখে মুখে জ্বলজ্বল করছে কঠোর অথচ আত্মবিশ্বাসী অভিব্যক্তি। যা উপস্থিত সকলকে মুহূর্তে নিস্তব্ধ করে দেয়। তার পেছনে দাঁড়িয়ে আছে চারজন দেহরক্ষী এবং আরও দুজন সহচর।
অরিত্রিকার মুখাবয়ব অটল ও নির্লিপ্ত। তার মসৃণ চোখজোড়া স্বাভাবিক থাকলেও গভীরে সূক্ষ্ম পরীক্ষা চলতে থাকে। লোকটির কঠোর মুখের দিকে সরু চোখে তাকিয়ে তার ভাবলেশহীন চেহারা তাকে বিভ্রান্ত করল। সরু চোখে তাকায় সারহানের গম্ভীর মুখে। ত্যাছড়া স্বরে বলে উঠল ;
“ আপনার মতো একজন রাজনীতিবিদ হঠাৎ আমাদের মতো সাধারণ মানুষকে খুঁজতে এসেছেন! হেঁটে এসেছেন নিশ্চয়ই, পা ব্যথা করছে হয়ত। এই রুদ্র উনাকে চেয়ার দে একটু জিরিয়ে নিক।”
উপস্থিত সকলের মুখাবয়বে অপ্রত্যাশিত বিপদের ছাপ ফুটে উঠল। কেউ যেন বোঝে না, কী ঘটছে, কেন এমন পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে। আর সারহান তার দৃষ্টি একেবারে অগ্নিশর্মা, অটুট এবং নির্দয়। তার চোখে এক ধরনের শীতল ক্রোধের আনাগোনা। যা ঝড়ের প্রথম তীব্র বাতাসের মতো পরিলক্ষিত। এই কঠোর দৃষ্টি দেখে মনে হচ্ছে মহাবিপর্যয় আসন্ন।
তিশা অরিত্রিকার হাত চেপে ধরলো। ভয়ার্ত ভঙ্গিতে ফিসফিস করে বলল;
“এই অরিত্রি চুপ কর। কিসব বকে চলেছিস? ”
অরিত্রিকা বেজায় বিরক্ত হলো। তিরিক্ষি মেজাজে বলল ;
“ আমার মুখ আমি যা ইচ্ছে বলব। একদম আমাকে বাঁধা দিতে আসবি না। ”
রাহা রুদ্রের পেছনে মুখ লুকিয়ে আছে। রুদ্র কি করবে বুঝে উঠতে পারছে না। এই মেয়ে তাদের ডুবিয়ে ছাড়বে নিশ্চয়ই। তিশা সাহস সঞ্চার করে বলল;
“ ইয়ে মানে অরিত্রিকার মাথায় একটু গন্ডগোল আছে। কোথায় কি বলতে হয় বুঝতে পারে না। আসলে পড়ুয়া মেয়ে তো। পড়তে পড়তে মাথায় সমস্যা হয়ে গেছে। যা বলেছে ভুলে বলেছে কিছু মনে করবেন না। ”
অরিত্রিকা রেগেমেগে অস্থির। সে সবার সামনে ধুপধাপ করে তিশার পিঠে মে*রে শান্ত হলো। সারহানের কঠিন মুখাবয়ব খানিকটা স্বাভাবিক হলো বোধহয়।গাম্ভীর্য ভাব বজায় রেখে চোখের চশমা ঠেলে ওষ্ঠ বাঁকিয়ে বলল;
“ অরিত্রিকা ফাইরুজ চৌধুরী। অনার্স ফার্স্ট ইয়ার ডিপার্টমেন্ট অফ পলিটিক্যাল সাইন্স।”
অরিত্রিকা ভড়কে গেল। সে স্কার্ফ ঠিকঠাক করল। দৃঢ় কন্ঠে বলল ;
“ আমার সব খোঁজ খবর রাখেন দেখছি। ভেবেছিলাম রাজনীতিতে যুক্ত হয়ে ভুলে গেছেন। ”
সারহান দীর্ঘ শ্বাস টেনে ওষ্ঠ কোণে হাসি বজায় রেখে আক্রোশ নিয়ে বলল;
“ যার একটা পদক্ষেপে পুরো পরিবারকে নিমিষে ভেঙে শেষ করে দিল তাকে কীভাবে ভুলতে পারি?”
“আপনার সাথে আমার কথা বলার কোনো ইচ্ছে নেই। ”
“আমারও ইচ্ছে নেই তোমার মতো স্বার্থপর মেয়ের সাথে কথা বলার। ”
সারহানের গম্ভীর, গভীর কণ্ঠ পরিবেশের নিস্তব্ধতাকে ভেঙে টুকরো টুকরো করে দিল। তার কণ্ঠে যেন বজ্রের গর্জন লুকিয়ে ছিল যা আশেপাশের সকলকে এক মুহূর্তে শীতল আতঙ্কে আচ্ছন্ন করে দিল। উপস্থিত সবাই যেন কেঁপে উঠল সেই স্বরের তীব্রতায়। অরিত্রিকার ঠোঁটের কোণে ফুটে ওঠা তাচ্ছিল্যের হাসি তার দৃঢ়তা আর অভিমানের বহিঃপ্রকাশ । তার চোখের চাহনি স্পষ্টভাবে সারহানের দিকে তীক্ষ্ণ ছুরির মতো ছুটে যায় যেন তাকে তুচ্ছ করে দেখানোই একমাত্র উদ্দেশ্য। অরিত্রিকার বন্ধুমহল আর দেহরক্ষীরা আসল দ্বন্দ্বের কারণ খুঁজতে ব্যর্থ হলো। শুধু নির্বাক দেখে চলেছে। শুধু আবির জানে এই নিঃশব্দ দ্বন্দ্বের কারণ।
“ যে কারণে বাড়ি ছেড়েছো, আমাদের পরিবারটাকে ভেঙে গুড়িয়ে দিয়েছো! সেই রাজনীতি একদিন তোমার গলার ফাঁ*স হবে দেখে নিও। ”
সারহানের গভীর গম্ভীর কণ্ঠ থেকে নিঃসৃত প্রতিটি শব্দ তীরের মতো বিক্ষত করল অরিত্রিকার হৃদয়। সেই কথাগুলো তার বুকে প্রচণ্ড ঝড় তোলে। যা শিরা-উপশিরা হয়ে উত্তাল নদীর মতো প্রবাহিত হতে থাকে। মুহূর্তেই তার মুখের রঙ পরিবর্তিত হয়। কোনো অলঙ্ঘ্য ভার তার অস্তিত্বকে চূর্ণ করে দিতে চাইছে।তার দেহ কিছুটা নিস্তেজ হয়ে গেলেও চোখে-মুখে ফুটে ওঠে অদম্য ক্রোধ। অন্তরের এই প্রবল উথালপাথাল নিয়ন্ত্রণ করতে গিয়েও সে নিজেকে সামলে নেয়। কিছুটা উত্তেজিত কণ্ঠে তীক্ষ্ণ অথচ দৃঢ় স্বরে বলল,
“এমন কিছু কোনোদিনই হবে না। আপনার উপস্থিতি আমার এবং আমার পরিবারের কাছে অর্থহীন। আপনি চলে যান এখান থেকে।”
সারহান এক মুহূর্তের জন্য তার তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে অরিত্রিকার ঝিমিয়ে পড়া মুখের দিকে তাকাল। সেই চাহনিতে যেন মিশে ছিল অব্যক্ত কথা। পরক্ষণেই তার ঠোঁটে ফুটে উঠল বিদ্রূপাত্মক হাসি। মুখ ঘুরিয়ে তিশার দিকে তাকিয়ে উপহাস মেশানো কণ্ঠে বলল,
“আপনার এই বান্ধবীকে নিয়ে পাবনার মেন্টাল হাসপাতালে গিয়ে ভর্তি করিয়ে দিন। অন্যথায় একদিন হয়তো খবর পাবেন, রাস্তায় যাকে পাচ্ছে তাকে কামড়ে দিচ্ছে।”
রুদ্র সিরিয়াস সময়ে ফিকফিক করে হেসে উঠল। তিশা অতি কষ্টে হাসি চেপে রেখেছে। কিন্তু শেষ রক্ষা হলো না। রাহা রুদ্রের পেছন হতে উচ্চস্বরে হেসে উঠল। আবির ও তাদের সাথে তাল মিলিয়ে হেসে উঠল। অরিত্রিকার মাথায় আগুন যেন দপদপ করে জ্বলছে। রাগে মাথা ফেটে যাচ্ছে। সকলের সামনে তাকে অপমান করল, মজা নিলো। এসব ভেবেই ক্ষোভে ফুঁসে উঠল। সারহানের ওপর জ্বলন্ত দৃষ্টি নিক্ষেপ করে ধপাধপ পা ফেলে কিছুটা গিয়ে দাঁড়াল।
সারহান কাঠিন্যতা এঁটে চুপচাপ শান্ত দৃষ্টিতে অরিত্রিকার ক্ষোভ এবং প্রতিক্রিয়া অবলোকন করল। তার চোখে কোনো ধরনের উত্তেজনা ছিল না, বরং এক ধরনের নির্লিপ্ততা এবং স্থিতিস্থাপকতা ফুটে উঠছিল। কোনো প্রতিক্রিয়া দেখানোর প্রয়োজন অনুভব না করেই, শাণিত পদক্ষেপে নিজের গন্তব্যে পা বাড়াল।আবির আর দেহরক্ষীরা সারহানের পিছু ছুটল। অরিত্রিকার বন্ধুমহল যেন হাঁপ ছেড়ে বাঁচল। তারা বান্ধবীর রাগ ভাঙানোর জন্য অরিত্রিকার কাছে গেল।
“সারহান ভাই। ”
মেয়েলী অতি পরিচিত উদ্বিগ্ন কন্ঠস্বর শ্রবণ হতেই সারহানে শাণিত পা জোড়া থেমে যায়। সে ভ্রু যুগল কুঁচকে তাকায় পেছনের দিকে। আবির আর দেহরক্ষীরা ও কৌতুহলবশত পেছনে তাকায়। অরিত্রিকা ছুটে আসছে উদভ্রান্তের মতো। এলোমেলো লাগছে কিছুটা। বারবার পেছনে তাকাচ্ছে। মুখাবয়বে ফুটে উঠেছে ভয়ের আভা। সারহান কিছু বুঝে উঠার আগেই বিকট শব্দে কেঁপে উঠল চারিপাশ। সকলে ভয়ে সিঁটিয়ে গেল। সারহানের থেকে কিছুটা দূরে লুটিয়ে পড়লো অরিত্রিকা। ধুলো বালিতে মেখে গেল অরিত্রিকার শরীর। সারহান ব্যতিব্যস্ত হয়ে ছুটলো অরিত্রিকার কাছে। হাঁটু গেড়ে বসে দুহাতে অরিত্রিকার বাহু চেপে একটু উঁচিয়ে ধরল। হাতে ভেজা ভেজা অনুভব হওয়ায় এক হাত উঁচিয়ে দেখল র*ক্ত।
সারহানের মুখ কঠিন হয়ে গেল। হুংকার ছাড়ল ;
“ গার্ডস যে বাস্টার্ড ফাইরুজকে শু*ট করেছে তাকে দ্রুত খুঁজে বের করো। যেখানে পাবে জ্যান্ত কব*র দিবে ইটস মাই অর্ডার। আবির আমার গাড়ি নিয়ে আয় কুইক। ”
দেহরক্ষীরা আদেশ পাওয়া মাত্র নিজেদের কাজে তৎপর হয়ে গেল। আবির ছুটলো পার্কিং প্লেস থেকে গাড়ি আনতে।
“ সারহান ভাই স্বার্থপর মেয়েটা আপনাকে বু*লেটের কবল থেকে বাঁচিয়ে দিল। ”
অরিত্রিকার রক্তশূন্য মলিন হাসি ফুটে উঠল। সেই হাসিতে ছিল অদ্ভুত বেদনাবোধ।যা সারহানের চোখের সামনে স্পষ্ট হয়ে উঠল। মুহূর্তের জন্য, সারহানের দৃষ্টি স্থির হয়ে গেল।তবে এক মুহূর্ত পর তার শরীরের প্রতিটি পেশী টানটান হয়ে উঠল, চোয়াল শক্ত করে। তার চোখে ক্রোধের ঘনঘটা আর কণ্ঠে যেন বজ্রের গর্জন। অরিত্রিকার অসহায় অবস্থাকে উপেক্ষা করে, সে ক্রুদ্ধ গলায় বলল,
“ তুই সত্যিই স্বার্থপর মেয়ে ফাইরুজ। তুই সত্যি স্বার্থপর। এর জন্য কঠিন শাস্তি পেতে হবে তোকে।”