প্রনয়ের প্রথম পুরুষ পর্ব ৩২

প্রনয়ের প্রথম পুরুষ পর্ব ৩২
Zannat Xhowdury

টিক টিক ঘড়ির কাটা , সময় প্রায় ১০টা ৩৫। হল রুমে ঝিম ধড়ে বসে বসে অপেক্ষা প্রহর গুনছে সকলে। কেউ যেন শরীর ছেড়ে দিয়েছে সোফার গায়ে। কেউ কেউ বসে ঝিমোচ্ছ।
রিয়ান বিরক্ত বারবার তাকাচ্ছে ঘড়ির দিকে আবার ঠিক পর মূহুর্তে দৃষ্টি দিচ্ছে সিঁড়ি দিক। রাগে অলমোস্ট নাকের ডগা ফুলে উঠেছে। ঘন ঘন নিঃশ্বাস টেনে শান্ত করছে নিজেকে।
এই মেয়ের কি আদেও নামবে ?

অপেক্ষা সহ্য না হলে আসতে পারিস। তোদের জ্বালায় আমার পাখিটা বুঝি একটু সাজবেও না।
রিলেক্স মুডে ফোনের দিকে তাকিয়ে রিয়ানের দিকে ছুড়ে দেওয়া ,কথা যেন বারুদের মতো ধোঁয়ার সৃষ্টি করে রিয়ানের আশেপাশে। নাক কুচকে নির্ণয়ের দিকে তাকিয়ে ফোঁস করে এক নিঃশ্বাস ছাড়ে রিয়ান।
একটা মানুষ ৩ঘন্টা ধরে কি রেডি হচ্ছে বুঝি না বাবা।
প্রায় ১০টা ৪৩ এবার যেন ধৈর্য্য হারা হয়ে উঠছে সকলে। তাদের মনের বেহাল দোষা, হঠাৎ কানে আসে গুন গুন গানের শব্দ ওই যে, ওই গান টা
আমি মিস ক্যালকাটা চাইনা দিতে টিপস
এখনো কেউ জানে statistics
আমি মিস ক্যালকাটা 1976
আমি হারিনা থেকে মেলি ডানা,হয়ে চান্ডীগড়ের রানী
আসেন আসেন রানি আমার, শুধু রানী না মহারানী। আপনার প্রজারা আপনার অপেক্ষায় অধির আগ্রহে বসে রয়েছে রানীমা। দোয়া করে এসে আমাদের বিপদ থেকে উদ্ধার করুন।

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

খামোশ , তোমার এতো বড় আস্পর্ধা তুমি চন্ডীগড়ের রানী পথ আটকাও। এখনি তোমার মন্ডু কাটা হবে।
বলেই হিহি করে হাসতে শুরু করে রোজা এক পা এক পা পা ফেলে সিঁড়ি বেয়ে নিচে নামছে সে। পড়নে কালো জিন্স সাথে মিষ্টি কালার টিশার্ট । চুলগুলো দুপাশে বেনুনি করে ফেলানো। যাতে ঝুলছে হ্যালো কিট্টি দুটো রাবার ব্যান্ড। রোজা দুইবেনি টেনে হেলে দুলে নিচে নামতেই রিয়ান এগিয়ে গিয়ে মাথা টোকা মেরে চিবিয়ে চিবিয়ে বলে ,
ফাজিল মেয়ে , একটা জিন্স আর টিশার্ট পড়তে তোমার এতো সময় লেগেছে পাক্কা ৩ ঘন্টা।
আসলে হয়েছে কি জানো ভাইজান , আমি তো রেডি হচ্ছিলাম তবে কি পড়বো, কি পড়বো এসব ভাবতে ভাবতে কখন যে ঘুমিয়ে পড়েছি।

রোজার কথায় যেন উপস্থিত সকলে অবাক। হা হয়ে রয়েছে তাদের মুখ, চোখ যেন রসগোল্লার চেয়েও কম না।
আরে গাইচ মুখ বন্ধ করো আশেপাশে ডেঙ্গু মশার উপদ্রব বেড়েছে মুখে ডুকে গেলে আবার জ্বর ধরছে। তাই মুখ বন্ধ রাখো
রোজার কথায় যেন কাশি উঠে যায় আয়ানের খুক খুব করে কাশতে থাকে সে। এক হাতে মাথা হাত দিচ্ছে তো একহাতে গলা ধরছে সে।
নির্ণয় এবার ফোন ছেড়ে উঠে বসে সামনে থাকা পানির গ্লাস হালকা ঠেলে এগিয়ে দেয় আয়ানের দিকে। পানি পেয়েই এক নিঃশ্বাসে ঢকঢক করে পুরো পানি শেষ করে বেচারা।
পরিস্থিতি স্বাভাবিক হতেই রোজা দু’হাত কোমরে দিয়ে মঞ্চ কাঁপানো ভঙ্গিতে দাঁড়ায় সিঁড়ির শেষ ধাপে। গলাটা একটু খাঁকারি দিয়ে বলে —

আচ্ছা হয়েছে! এবার বেড়োবো তো নাকি! চলো, চলো সবাই। রাজসভা ভাঙো!
তার ভঙ্গিমা দেখে মনে হয় যেন সত্যিই কোনো রাণীমা তাঁর প্রজাদের নিয়ে বিজয় যাত্রায় বেরোচ্ছে। রিয়ান ফোঁস করে বলে,
তুই না থাকলে জীবনটা বেশ শান্ত হতো রে! অত্যাচার মুক্ত হতাম।
রোজা মুচকি হাসে , চোখগুলো কিছু টা পিচ্চি পিচ্চি হয়ে গিয়েছে। ভ্রু জোড়া কুঁচকে হেঁয়ালি স্বরে বলে,
আমার মত ঝড় না থাকলে তোমাদের জীবনে ধুলাও উড়তো না ভাইজান!”
সকলে এবার একে একে উঠে পড়ছে। কেউ ফোন খুঁজছে, কেউ ব্যাগ সামলাচ্ছে, কেউ আয়নার সামনে শেষবার চোখ বুলিয়ে নিচ্ছে।

রোজা ঘুম ঘুম চোখে হাই তোলে , যেন আপাতত তার ঘুরাতে যাওয়ার চেয়ে ঘুম important
আহারে ঘুমটা শেষ হয়নি। আপনি চাইলে আরেক দফা ঘুমিয়ে নিতে
মোটা তবে কেয়ারিং শান্ত স্বর কানে আসতেই তল পেটে যেন হাজারো প্রজাপতি উঠতে শুরু করে রোজা‌। এক এক করে বেরিয়ে পরে সকলে। একটু একটু করে এগিয়ে আসে নির্ণয়। রোজা কাছে আসতে ঠিক পেছনে থেকে মুখ রাখে রোজার কাধে।
আরো ঘুমাবে পাখি।
শিরশির এক শীতল হাওয়া যেন শরীরে বয়ে যায়। গায়ের প্রতিটি লোম যেন অটোমেটিক দাঁড়িয়ে যায়। রোজার নিঃশ্বাস ঘন হতে থাকে। ব্যপারটা নির্ণয়ের খেয়াল হতেই বাঁকা হেসে স্বরে দাড়ায় সে
যাওয়া যাক তবে ,

বাহিরে বেরোতেই ধূসর রঙের দুটো গাড়ি দাঁড়ানো। প্রথম গাড়িটি ফাঁকা, কিন্তু দ্বিতীয় গাড়িটা ছিল পুরাপুরি ভরা। হবে না পুরো‌গ্যাংটাই যেন‌ বসেছে এতে।
রোজা দূর থেকে তাদের দিকে তাকিয়ে রকমারি ভাবনা নিয়ে দাঁড়িয়ে রইল। এদিকে রোজার ভাবনা ছেদ না ঘটিয়ে পাশ‌ কাটিয়ে গাড়ির ড্রাইভিং সিটে গিয়ে বসল নির্ণয়।‌
হঠাৎ হর্নের‌ শব্দ কানে আসতেই ভাবনায় ভেদ পড়ে রোজার। সামনে খেয়াল হতেই বুঝে নির্ণয় অপেক্ষা করছে তার জন্য
রোজা এগিয়ে গাড়ির কাছে যেতেই দরজার লক ওপেন করে দেয় নির্ণয়। ধীরে এগিয়ে গিয়ে গাড়িতে চড়ে বসে রোজা।

গাড়ির দরজা বন্ধ হতেই যেন এক অদ্ভুত নিস্তব্ধতা নেমে আসে ভিতরে। ধীরে গাড়ি চলতে শুরু করে। বাইরের পরিচিত রাস্তাগুলো পিছনে পড়ে যেতে থাকে, আর সামনে এগিয়ে চলে এক অজানা গন্তব্যের দিকে।
রোজা একটু কুণ্ঠিতভাবে জানালার দিকে তাকিয়ে থাকে, চোখে অস্পষ্ট দুশ্চিন্তা। নির্ণয় ড্রাইভিংয়ে পুরো মনোযোগ দিলেও মাঝে মাঝে এক চিলতে তাকায় রোজার দিকে।
হালকা রোদের আলো এসে পড়েছে মেয়েটার গালের বাঁকে, চোখের পাতায়। নিঃসন্দেহে, এই চেহারায় কোনো যুদ্ধ শুরু করা যায়, আর কোনো শান্তিও খুঁজে পাওয়া যায়।‌মুহূর্তেই মাথা ঝাঁকায় সে।
ধুর শালা!
নিজেকেই নিজে একশত গালি ছুড়ে মাথায় এক জোড়ে বাড়ি মারে নির্ণয়।

নির্ণয়ের গাড়ি বেশ কিছু এগিয়ে গেলোও , এখনো স্টার্ট হয়নি দ্বিতীয় গাড়ি। তার কারণ হলো আজ নাকি তৃধা গাড়ি চালবে। এই কথাতেই যেন সকলের মাথায় হাত।
আজ বুঝি জীবনের শেষ ঘুরা ঘুরতে হবে ভাই !
আয়ানের বলা কথার টোন টেনে ধরে রিয়ান। কন্ঠে বিরক্তি তবে মুখে তার বহিঃপ্রকাশ খুব কম। শান্ত ভঙ্গিতে বলে
আমি তো ভাবছি এখনো বিয়ে হলো না । এখনি এই মাইয়া কেমনে পটল তোলার টিকিট হাতে করে এনেছে ভাই। তোরা গেলে যা আমি যাচ্ছি না।
তো নেমে যা বেঁধে রেখেছে নাকি কেউ ?
তৃধার কন্ঠে রাগ মনে অটল জেদ আজ যেন গাড়ি না চালিয়ে তার মন শান্ত হবার নয়। নিজের জেদের সাথে নো কম্প্রোমাইজ।

আয়ান এবার মুখে হাত চেপে হেসে ফেলল, দুজনের দিকে তাকিয়ে দুজনের মুখে ভঙ্গিমা দেখে আরো বেশ হাসি পেলো তবে নিজকে কোনো মতে সংযত করে বলতে লাগলো
“ভাই, শুরু হইছে তোদের আজ আর ঘুরা হবে না, তার চেয়ে চল আমরা বাসায় ঢুকে যাই।
তাই চল ! এই ড্রাইভিংটা রেস্টুরেন্টে থেকে অর্ডার কইরা আনা খাবার নয়। যে চাইলাম আর পেলাম এইটা শিখতে হয়, অনুশীলন করতে হয়।
রিয়ানে কথার বিন্দু পরিমাণ পাত্তা না দিয়েই তৃধা ড্রাইভিং সিটে বসে পড়ে। ঘাড় ঘুরিয়ে একবার তাকায় রিয়ানের আর আয়ানের দিকে।

যেতে চাইলে আসতে পারিস নয়তো আমি চললাম
কথাটুকু শেষ হতেই গাড়ির ইঞ্জিন গর্জে উঠলো। শুরু হলো চাকার ঘর্ষণ , তৃধার হাতে স্টিয়ারিং-এ, মনের সাথে যুদ্ধ করে ভয়ে ভয়ে গাড়িতে চড়ে বসে আয়ান তবে রিয়ান তখনো দাড়ানো। সেদিকে খেয়া করেই কাঁপা কাঁপা গলায় আয়ান বলে ,
ভাই উপায় নেই জলদি উঠে আয় নীড় অনেকটা এগিয়ে গিয়েছে
তৃধা আর একবার তাকায় রিয়ানের দিকে । ঠোঁট বাঁকিয়ে বলে
বেল্ট ঠিক মতো বেঁধে নেওয়ার আহব্বান জানালাম। আজকের রাইডটা মিস করলে আফসোস করি”
মনের ভিতর থেকে এক দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে আসে রিয়ানে উফ বলে নিঃশ্বাস ছেড়ে , সামনের সিটে বসে সে ।
ঠিক তখনই এক টানে স্টিয়ারিং ঘোরায় তৃধা। গাড়ি আচমকা ঝাঁকি খেয়ে সামনে গড়িয়ে চলে। পেছনের সিটে বসা আয়ান প্রায় হেঁচকি তুলে বলে,
হে আল্লাহ্‌! রক্ষা করো ।
তৃধা কিছু না বলে ঠোঁট শক্ত করে সামনে তাকিয়ে থাকে। চোখে তার জেদ, মুখে হালকা দৃঢ়তা। রিয়ান জানালার বাইরে দিকে তাকায়
কিছু সময়ের নিস্তব্ধতা ভেঙে এবার অপূর্ব বলে – ভাই সকলে দোয়া পড়ো আজ নিশ্চয়ই বড় ঝড় আসবে।

বেরিয়ে গিয়েছে দুটো গাড়ি , একটা একটু আগেই, আরেকটা খানিকটা দেরিতে। তবু শেষমেশ রওনা হয়েছে দুটোই।
দোতলা ঘরের জানালার ফাঁক দিয়ে দাঁড়িয়ে কেউ একজন সেই দৃশ্য দেখছিলো নিঃশব্দে। নজর যেন বাজপাখির মতো গাড়ি দুটোর উপরেই সীমাবদ্ধ।
ধীরে ধীরে দৃষ্টি অগোচর হয় গড়ি দুটি। হয়তো এই অপেক্ষাতেই চাতক পাখির মত ছিলো সে, ছিলো তার না বলা কামনা । গাড়ির ধোঁয়াটে ছায়া মিলিয়ে গেলো দূরে, চোখেমুখে ফুটে উঠলো এক অদ্ভুত শান্তি। কেমন এক বিজয়ের মৃদু হাসিযার মানে কেবল সেই জানালার ফাঁকেই বন্দী।
জানালার পাতলা সাদা পর্দাটা আলতো করে ছেড়ে দেয় সে। উল্টো ঘরে দাড়ায় সে ।পা টেনে ধীরে ধীরে এগিয়ে আসে ঘরের ভিতর দিকে। চারপাশে নিস্তব্ধতা , যেন কোনো অদৃশ্য ভার হঠাৎ নামিয়ে রাখা হয়েছে বুকে।
বিছানার পাশে এসে ধপ করে বসে পড়ে সে । নরম তুলতুলে বিছানায় ছুড়ে দেয় নিজের শরীর । এড়িয়ে যায় সব নিয়ন্ত্রন,

এ যেন অনেকদিন জমে থাকা ক্লান্তির পর এক বিশ্রী প্রশান্তি।
হঠাৎ এক ঠোট গলিয়ে এক উচ্চ হাসির শব্দ যেন পুরো ঘর মাতিয়ে তোলে , ফাঁকা ঘরের প্রতি দেয়ালে দেয়ালে বাড়ি খায় সেই হাসি । হাসির প্রতিটি প্রতিধ্বনি যেন কিছুটা পাগলাটে তবে কঠোর।
হাসির মাঝেই যেন শরীর কেঁপে উঠছে বার বার নিজেকে স্থির করে
শরীরটা হালকা ঘুরিয়ে বিছানার পাশে যত্নে পড়ে থাকা ফোনটা হাতে তুলে নেয় সে।
আঙুলের ছোঁয়ায় স্ক্রিন জ্বলে ওঠে। এক ঝলক আলো তার মুখে পড়ে। এতোক্ষণে পৈশাচিক রূপ যেন মূহুর্তে ঠান্ডা নির্লিপ্ততায় মিশে যায় ।

ফোনটা একটু ঘোরায় হাতে, তারপর ক contacts list খুলে স্ক্রোল করে কিছু নামের উপর দিয়ে। হঠাৎ থেমে যায় হাত স্ক্রিনে জ্বলতে থাকে পরিচিত এক নাম
থেমে থাকা হাতটি আবারো স্ক্রোল করে । তারপর চাপ দেয় ডায়াল বাটনে।
রিং হচ্ছে , ঘরের নিস্তব্ধতায় সেই রিংটোন যেন অসহ্য দীর্ঘ।
সে চুপচাপ শুয়ে থাকে, ঠোঁটের কোণে লেগে রয়েছে সেই হালকা এক বাঁকা হাসি।
থেমে যায় বাজতে থাকা শব্দ অপর পাশে কলটা রিসিভ হয়। কথা আসেনা মূহুর্ত খানিকের অপেক্ষা , কেবল নিঃশ্বাসের শব্দ। হালকা ঝাপসা গুঞ্জন।
বেড়িয়ে গিয়েছে ‘

শব্দ দুটো উচ্চারণ করে বিছানায় ছেড়ে উঠে আবারো এগিয়ে যায় সে সাদা পর্দা গ্লাস লাগানো দরজার কাছে। দৃষ্টি দেয় বাহিরে রাস্তার পাশে, চোখ দুটো লাল হতে থাকে তার।
শেষ করে দাও দুই রাজার প্রাণ ভোমরা কে ।
কথা শেষ করার আগেই হঠাৎ ঘাড়ে কিছু স্পর্শ পেতেই থামকে যায় জারা । বুকের মাঝে জোড়ো হয় ভয়ের দল দ্রুত হাতে থাকা ফোন কান থেকে নামিয়ে নেয় । শুষ্ক ঢোক গিলে ।
উল্টো ঘুরতেই চোখ-মুখে একঝলক গরম সিগারেটের ধোঁয়া! কাশেতে থাকে সে এক হাতে ঘাড় চেপে ধরে, অন্য হাত মুখের গলা জ্বলে, চোখ থেকে পানি পড়ে। ধোঁয়া কেটে যেতেই…
সামনে দাঁড়ানো মানুষটিকে দেখে ভয়ে তটস্থ হয়ে যায় সে । এক হাত পকেটে, অন্য হাতে সিগারেট ধরা…ঠোঁটে বাঁকা হাসি, চোখে সেই পুরনো গভীরতা। শরীরের অবয়বে ক্লান্তি, কিন্তু মুখে অদ্ভুত অবজ্ঞার ছাপ।
রেহান।

জারার গলা শুকিয়ে আসে। শব্দ বেরোতে চায় না , নিজেকে স্থির করার যেন দৃঢ় সংকল্প তার।
একাধিক পুরুষের শরীরের ঘ্রাণ শুঁষে নেওয়া নারীর সামন্য সিগারেটের ধোঁয়ায় শ্বাস কষ্ট হচ্ছে।
বুকের মাঝে কষ্টের ডানা বাধে ধুক করে ওঠে জারার। দম নিতে ও ভীষণ কষ্ট হয় তার। গলা জড়িয়ে আসছে বারংবার, চোখের কণা যেন ছলছল করে উঠছে তার জমতে থাকা পানিতে চোখ এক মুহূর্তে বেজায় ভিজে যায়, মুখে এক নিঃশব্দ আক্ষেপের রেখা ফুটে ওঠে
কেউ বোঝে না, কতটুকু ভাঙা আছে এই হৃদয়,
যে ডানায় বাঁধা কষ্ট কখনো মুক্তি পাবে কি না।

জারার বুক ছিড়ে বেড়িয়ে আসা কষ্টের বাণী গুলো রেহান শুনলো কি শুনলো না তা আর জানা নেই কথা শেষের আগেই জারা খেয়াল করলো বড় সেই জানালার কাছে গিয়ে দাড়ানো রেহান জারা নিজেও এগিয়ে যায় সেদিকে।
দোতলার সেই বিশাল জানালার সাদা পর্দা যেন মৃদু বাতাসে দোল খাচ্ছে, রেহান একদৃষ্টিতে বাহিরে সেই বিশাল লোহা ঘেরা গেঁটের পিচডালা রাস্তার দিকে তাকিয়ে সিগারেট টানছে,
তোমায় ভালোবেসে আমি চরিত্রহীনা।
মনোযোগে বিঘ্ন ঘটায় জারার কাপা কাপা গলায় বলা কথাগুলো। কাদছে মেয়েটা তবে সেই কান্না যেন পাষাণ পুরুষের হৃদয় গলাতে ব্যর্থ।
পতিতা কারো ভালোবাসা নয় বরং ভোগের সামগ্রী।

বাঁধ ভাঙা উপচে পড়া চোখের পানি গুলো অনাবরত পড়তে থাকে জারার সেদিকে একবারো না তাকিয়ে ঘরে থাকা কাঠের চেয়ারে গিয়ে আরমে বসে রেহান। এক পা রাখে অপর পায়ের উপর সিগারেটের শেষ ভাগে লম্বা টান দিয়ে ছুঁড়ে ফেলে ফ্লোরে। ডান হাতে হালকা ইশারায় কাছে ডাকে সামনে তার দিকে তাকিয়ে চোখের পানি বিসর্জন দেওয়া জারাকে। ঠোঁটের কোণে যেন একটুকরো নিষ্ঠুর প্রশ্রয়।‌ তার এক হাতের হালকা ইশারা,
একটা সাধারণ ডাক পুরোটাই যেন শত বছরের তৃষ্ণার জল।
জারা কাঁপতে কাঁপতে ধীরে ধীরে এগিয়ে যায়। চোখের পানি ঝড়ছে , বুক ফেটে যাচ্ছে, শ্বাস থেমে থেমে আসছে
এই পুরুষটা তাকে ছিঁড়ে ফেলেছে, অপমান করেছে, চুপ করে জ্বালিয়ে-পুড়িয়ে শেষ করে দিয়েছে। তবুও তার ডাক এড়িয়ে যাওয়া যেন অসম্ভব।

এক পা এক পা করে এগোয় জারা। প্রতিটা পদক্ষেপে যেন নিজেকে ভেঙে নিচ্ছে একটু একটু করে।রেহান মাথা সামান্য কাত করে তাকিয়ে থাকে তার দিকে চোখে সেই চিরচেনা দৃষ্টি। যেন জারা তার চেয়ে এক ধাপ নিচের ক্লান্ত খেলনা, যেটা সে বারবার ছুঁড়ে ফেলে আবার তুলে নেয়।
জারা এসে দাঁড়ায় তার সামনে। দূরত্ব মাত্র এক হাত। রেহানে ঠোঁট গলিয়ে পড়া বাঁকা হাঁসির প্রতিটি চিত্র যেন ছিন্ন বিচ্ছিন্ন করে মেয়েটির বুক। হাতে শিরায় বসতে বললেই ফ্লোরের দিকে নজর দেয় জারা।

বুকের অত্ন গহিন থেকে বেড়িয়ে আসে দীর্ঘশ্বাস, যা কেবল অর্ধেক লুকানো অর্ধেক প্রকাশিত। দু হাঁটু ভাঁজ করে মাটিতে বসতে শক্ত হাতের থাবায় অনুভব হয় গলায় , নিঃশ্বাস নিতেও যেন ভুলতে বসেছে সে। হঠাৎ আক্রমণে নিজেকে বাঁচানো বিন্দু মাত্র সুযোগ নেই
আমার নাকের ডোগায় বসে , আমার ফুল ছিড়ে ফেলার প্ল্যানে মেতে ওঠার মতো এত সাহস কোথায় পেলি তুই ?
ল লাগছে আ আমার ! আহ
হাতের বাঁধন আরো কিছুটা শক্ত করে রেহান। এবার আর শ্বাস নেবার একটুও জোড় নেই জারা চোখ লাল হতে শুরু করেছে প্রাণ পাখি যায় যায় তার চোখ দুটো নিভে আসছে , ধোঁয়াশা হয়ে আসছে সকল কিছু। হাত উঁচিয়ে ছুঁয়ে দিতে যায় রেহানে গাল , তবে আগেই নাক ছিটকে এক ঝটকায় জারার গলায় ছেঁড়ে দেয় দেয় রেহান ।
এই ন *টি এই , নষ্টার জাত। আমার মেহরিনের দিকে তোর নোংরা দৃষ্টি দেবার আগের কলিজা কি এক ছিটে ফোঁটাও ভয়ের জন্ম হয় নি।

খুক খুক করে কাশছে জারা। বার বার ঢোক গিলে নিজেকে শান্ত করছে নিজের শরীরের সমস্ত শক্তি যেন ফুরিয়ে এসেছে । রেহানের চোখ জোড়া যেন আগুনের জলন্ত লাভা। ওই চোখে দৃষ্টি যেন ভস্ম করে দেয় প্রেমে ব্যর্থ এক নারীর হৃদয়। কাঁপা কাঁপা গলায় জারা বলে ,
ঘৃ ঘৃণা হচ্ছে তোমার ?
আমার ঘৃণাতে থাকার মতো যোগ্যতা এখনো তোর হয়নি। তোর সাহস বলি হা…
বাকি কথা বলার আগেই হাত উঁচিয়ে থামিয়ে দেয় জারা। মুখে এক বিকৃত হাসি রেখে আবারো বলে ,
এক ন* ষ্টার ভালোবাসা প্রত্যাখ্যান করে আরেক ন*ষ্টার জন্য এতটা ব্যাকুলতা। হায় রে পুরুষ
আগুনে হালাকা ঘি ঢেলে তাপকে কিছুটা বাড়িয়ে তোলে জারা। হিংস্র বাঘ কে আরো খেপিয়ে তুলে নিজেকে বিপদে ফেলে সে ,

হঠাৎ পুরুষ হাতের শক্ত পোক্ত এক থাপ্পর এসে পড়তেই ঠোঁটের কোণ বেয়ে চির চির করে রক্ত বেড়িয়ে আসে জারার। রেহান হালকা ঝুঁকে জারার মুখের দিকে যার ফলে তার গরম নিঃশ্বাস আচরে পড়ছে জারার মুখে ,
আমার মেহরিন পবিত্র … আমার ছোঁয়া না পাওয়া অবদ্ধি সে পবিত্র। তার সাথে নিজেকে মেলাতে এসে , মৃত্যু কে ডেকো এনো না। ভুলে যেও না তোমাকে এখানে কেন এনেছি । নিজের কাজে মনোযোগ দেও নাহলে টিকিট ছাড়াই উপরে পাঠানো হবে তোমাকে।

প্রনয়ের প্রথম পুরুষ পর্ব ৩১ (৩)

কথা শেষে হন হন করে বেড়িয়ে যায় রেহান , পিছনে ঘুরে তাকানো বিন্দু মাত্র ইচ্ছে নেই তার। এদিকে মাটিতে বসে , থেকে পাকা সিমেন্টের মেঝেতে একের পর এক ঘুসি দিতে থাকে জারা।
মেহরিন,মেহরিন, মেহরিন।
এই নারীর ধ্বংসের মাঝেই গড়ে তুলবো আমার ভালোবাসা। ধ্বংস করবো দুই পুরুষের স্বপ্ন।
রেহান আমার । শুধু ই আমার

প্রনয়ের প্রথম পুরুষ পর্ব ৩৩