প্রিয় ইরাবতী পর্ব ১০
রাজিয়া রহমান
বিমানের ছোট্ট জানালা দিয়ে এক দৃষ্টিতে বাহিরে তাকিয়ে আছে ইশতিয়াক। পাশের সীটে ইখতিয়ার বসা।
কানে ইয়ারফোন গুঁজে কিছু দেখছে ফোনে।ইশতিয়াকের বুকের ভেতর কেমন খাঁখাঁ করছে।শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমান বন্দরে প্রথম পা রাখতেই নিজের অজান্তে দুই চোখ ভিজে উঠে ইশতিয়াকের।
দেশের মাটি!
নিচু হয়ে একটু ধুলো হাতে লাগায় ইশতিয়াক।
এই দেশ,এই দেশের মাটি সবটাই বুকের ভেতর কফিনে মুড়ে পেরেক গেঁথে রেখেছিলো ইশতিয়াক।
কিন্তু সত্যি কী পারা যায়?
জন্মভূমির টান কেউ কী অগ্রাহ্য করতে পারে!
ইশতিয়াক তো পারে নি।
কেনো ছুটে এসেছে এখানে?কে আছে তার?
এই বিপুল জনসংখ্যার দেশে তার নিজের বলে কেউ নেই অথচ তবুও এই দেশের প্রতিটি মানুষই তার চির আপন।
হাসিবুল শেখ,শায়লা,ইখতিয়ার এক গাড়িতে উঠলেও ইশতিয়াক উঠলো না। হাসিবুল শেখ জানতেন ইশতিয়াক শায়লার সাথে এক গাড়িতে যাবে না।তাই ছেলের জন্য আরেকটা গাড়ি আগেই এনে রেখেছেন।
ইশতিয়াক আরেকটা গাড়িতে উঠে বসলো। ড্রাইভার কাদের আলী ঘামছে। এসি চলছে গাড়িতে তবুও তার ভয় হচ্ছে।
ইশতিয়াকের চোখে কালো সানগ্লাস।
ছোট সাহেবকে কাদের আলী আগে কখনো দেখে নি।বড় স্যার তাকে আগেই বলে রেখেছে ছোট স্যারের সব কাজ যাতে বলার আগেই হয়ে যায়, কোনো কাজে যাতে বিন্দুমাত্র ভুল না হয়।তাহলে সোজা কাজ থেকে আউট করে দিবেন।
আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন
কাদের আলী এর আগেও বহু মানুষের গাড়ি চালিয়েছে।কিন্তু এখানে কাজ করে যেই আরাম পায়,যেই সুবিধা পায়,কোথাও এমন পাবে না।
চোখ থেকে সানগ্লাস খুলে ইশতিয়াক নরম সুরে বললো, “আপনার কোনো অসুবিধা হচ্ছে? আপনি নার্ভাস মনে হচ্ছে।”
“জি না সাহেব।কোনো সমস্যা নাই।”
“আপনি কী আমাকে ভয় পাচ্ছেন?বারবার আড়চোখে আমাকে দেখছেন আর ঢোক গিলছেন।”
“না স্যার, ভয় না।আপনাকে আগে কোনো দিন দেখি নাই তো।বড় স্যারের এরকম রাজকুমারের মতো পোলা আছে আগে জানতাম না।”
ইশতিয়াক হাসে।
রাজকুমার!
হ্যাঁ, অনেকেই ওকে এই নাম বলে। কিন্তু ইশতিয়াকের হাসি পায়। রাজকুমার তো সে বটে তবে দুঃখী রাজকুমার।
ইশতিয়াক বাহিরে তাকায়।কতো পরিবর্তন সবকিছু। ভেবেছিলো আসবে না আর অথচ কিসের অদৃশ্য টানে ছুটে আসলো!
শুধু কী বাবার অনুরোধে!
নাকি মাটির টানে!
গেইটের উপর বিশাল অলকানন্দা গাছটা হলুদ ফুলে ছেয়ে গেছে।
ইশতিয়াক গাড়ি থেকে নেমে গাছের গোড়ায় যায়।
বুকের ভেতর কেনো এমন কেঁপে উঠে ইশতিয়াক জানে না।
সেই কবে,বহুকাল আগে এই অলকানন্দা গাছটা ইশতিয়াক লাগিয়েছিলো।কয়েকদিন বেশ যত্ন আত্তি করেছিলো।কিন্তু তারপর পরই তাকে চলে যেতে হয়েছে।
বুকের ভেতর কতো স্মৃতি দাফন করেছে ইশতিয়াক!
অথচ স্মৃতিরা কিভাবে যেনো চোখের সামনে চলে আসে।ইশতিয়াক নিচে পড়ে থাকা একটা ফুল কুড়িয়ে হাতে নেয়।
শায়লা গাড়ি থেকে নেমেই সোজা চলে গেছে নিজের রুমে। ইশতিয়াক এতো বছর পর এসেছে যেহেতু একটু রিল্যাক্সে থাকুক।ছেলের পথের কাঁটা হতে চায় না শায়লা।
যদিও জানে আজীবন সে ইশতিয়াকের চোখে কাঁটা হয়েই থাকবে।
ইখতিয়ার লিনার রুমে গেলো বোনের সাথে দেখা করতে। লিনা ছুটে এসে ভাইকে জড়িয়ে ধরে।
ফিসফিস করে ইখতিয়ার বলে, “এরাই?”
“হ্যাঁ,সামান্য কিছু পয়সা খসালেই হবে শুধু।”
লিনার সাথে সকালে লিনার কয়েকজন বান্ধবী এসেছে। লিনাই নিয়ে এসেছে সবাইকে।
শায়লাকে ইখতিয়ার আগেই বলে রেখেছে, দেশে আসলে যদি ভার্জিন মেয়ে আর মদ এই দুটোর যাতে কমতি না হয়।
দীর্ঘদিন ধরে প্ল্যান করে লিনা বন্ধুবান্ধব জুটিয়েছে। বন্ধুত্ব করেছে নিরীহ শ্রেণির মেয়েদের সাথে, টাকা দেখলে লোভে যাদের চোখ চকচক করে তাদের সাথে।
ইখতিয়ার লিনাকে বললো, “কালো জিন্স পরা ওটাকে ম্যানেজ করে রাখিস।”
লিনা হেসে সায় দেয়।
ফুরফুরে মেজাজে ইখতিয়ার উপরে চলে যায়।ভীষণ আনন্দ অনুভব হয়। বিদেশি মেয়ে ট্রাই করতে করতে ইখতিয়ারের অরুচি ধরে গেছে।ওদের এখন ব্রয়লারের মতো লাগে।
মনটা অনেক দিন ধরেই দেশি মুরগী খাওয়ার জন্য আকুপাকু করছিলো।
বিশাল ডুপ্লেক্স বাড়িটার চারদিকে উঁচু পাঁচিল দিয়ে ঘেরা।
ইখতিয়ার নিজের রুমে পা দিলো ১১ বছর পর।
১১ বছর!
৪ হাজার ১৫ দিন!
রুমের দরজা খুলতেই খুলে গেলো বহু পুরনো স্মৃতির দরজা। শৈশবের কান্না,অসহায়ত্ব সবকিছু যেনো ভেসে উঠছে মানসপটে।
বুকের ভেতর থেকে থেকে মোচড় দিয়ে উঠছে কিন্তু চোখে কোনো উষ্ণতা নেই বরং মৃত্যুপুরীর শীতলতা।
নিজের রুমটা ভালো করে পর্যবেক্ষণ করে ইশতিয়াক। ক্যাবিনেটে ইশতিয়াকের ছোট বেলার ছবি,স্কুলের ক্রেস্ট, সার্টিফিকেট সব সাজানো আছে এখনো।বিছানায় সাদা ধবধবে চাদর বিছানো।সবকিছু পরিপাটি শুধু বুকের ভেতর রাজ্যের বিশৃঙ্খলা।
ইশতিয়াক ওয়াশরুমে ঢুকে আগে গোসল করে নিলো।কোমরে তোয়ালে জড়িয়ে বিছানায় উপুড় হয়ে শুয়ে পড়লো।আগে ঘুমানো লাগবে।
হাবিবা রাফির দিকে তাকিয়ে আছে। দুই চোখে ক্রোধ হাবিবার।এক রাস্তা মানুষের সামনে তার ছেলের গায়ে হাত তুলেছে ওই মেয়ে!
রাফি হিংস্র গলায় বললো, “আমি ছেড়ে দিবো না মা।আমি ওকে শিক্ষা দিয়েই ছাড়বো।”
এতো বড় সাহস ওই মেয়ের। তোর গায়ে হাত তুললো আর তুই দাঁড়ায় দাঁড়ায় দেখলি?তুই কী ব্যাডা মানুষ না?”
“আমার মাথায় রক্ত জমে আছে মা।আমার সাথে কথা বলো না।”
হাবিবার মেজাজ খারাপ।
রাফি নিজের ক্ষোভ সংবরণ করতে না পেরে শোকেসে একটা ঘুষি দিলো।ঝনঝন করে শোকেসের কাঁচ ভেঙে পড়লো।
ডান হাত কেটে গেলো রাফির।
ফিনকি দিয়ে রক্ত বের হতে লাগলো।
সাগর বাড়ি ফিরে চা নিয়ে বসেছে সবে।শফিকের কল এলো সেই মুহূর্তে। শারমিন সামনে বসে আছে গোমড়া মুখো হয়ে। ইরার সাথে কথা বলা বন্ধ করে দিয়েছে শারমিন।
সকালে রাফিকে ইরা থাপ্পড় দিয়েছে এটা ইতোমধ্যে পুরো মহল্লার লোক জেনে গেছে।
শারমিন ভেবেছিলো বুঝিয়ে সুঝিয়ে ইরাকে আজ কাল পাঠাবে পড়াতে ওই বাসায়।কিন্তু ইরা আজকে যে কাজ করেছে তাতে ওকবানে যাওয়া পুরোপুরি নিষিদ্ধ হয়ে গেছে।
মেয়ের উপর এজন্যই শারমিনের ক্ষোভ।
এতো ছ্যাঁত করে উঠার কি আছে!
ঘরে নিজের ভাইয়ের বউয়ের সাথে তো পারে না। বাহিরে মানুষের সাথে এতো ত্যাজ দেখায় কেনো!
সাগর কল রিসিভ করে সালাম দেয়।
শফিক থমথমে সুরে বললো, “উপমা বাসায় যাওয়ার জন্য কান্না করছে।”
“উপমা তো বাসায়-ই আছে।ওটাও তো বাসা।”
“ও তোমাকে ছাড়া থাকতে পারছে না।”
“হাস্যকর কথাবার্তা। ও যদি থাকতে না পারে সেটা ওর সমস্যা, আমার না আমাকে এসব জানানোর মানে কী?”
“তুমি একবার আসো।”
“কখনো না।”
“তোমার অনাগত সন্তানের জন্য ও কি আসবে না?”
“না।আমার সন্তান দুনিয়ায় আসার পর আপনারা রাজি থাকলে ওকে আমি নিয়ে আসবো।তবে আপনার বোনকে না।”
“দেখো,সম্পর্কে ভুল বোঝাবুঝি হয়েই থাকে।সেসব নিয়ে বসে থাকলে তো জীবন চলে না।আমি জানি আমার অনেক ভুল আছে।আমি তার জন্য ক্ষমা চাই।কিন্তু আমার জন্য তোমরা তোমাদের সংসার ভেঙে দিও না।”
“আপনার কোনো ভুল নেই।ভুল আমার। যার স্থান পায়ের নিচে হওয়ার তাকে মাথায় তুলে ফেলেছি।ভুল যখন করেছি তখন তার মাসুল দিতে ও আমার আফসোস নেই।”
“মাথা গরম করো না সাগর।মিটমাট করে নাও।”
“আপনাকে এবং আপনার বোনকে স্ট্যাম্পে সই করতে হবে।তারপর আপনার বোন আমার সংসারে আসতে পারবে।আর সেই স্ট্যাম্পে প্রথম শর্ত হবে আমার বোনের বিরুদ্ধে আপনার বোন কখনো একটা টুঁশব্দ করতে পারবে না।
দ্বিতীয়ত, আমার মায়ের সাথে অমিল হলে আমাকে জানাবে,আমি দেখবো।নিজে কখনো আমার মায়ের সাথে একটা কথা বলতে পারবে না।
তৃতীয়ত, বাবার বাড়ি,মা,বাবা,ভাই,বোন সব সম্পর্ক সম্পূর্ণ ত্যাগ করতে হবে।
যদি রাজি থাকেন তাহলে স্ট্যাম্পে লিখে আপনার বোনকে নিয়ে চলে আসবেন সকালে।আর নয়তো বাচ্চা হওয়ার পর তালাকনামা পেয়ে যাবে আপনার বোন।
আমাকে যদি এরজন্য যাবজ্জীবন কারাদণ্ড ও দেওয়া হয় আমি মাথা পেতে নিবো।”
সাগর কল কেটে দিয়ে ইরার দিকে তাকায়। ইরা হতভম্ব হয়ে বললো, “কি বললে এসব?”
“এসব আমার অনেক আগেই বলা উচিত ছিলো। ভালো হয়ে ছিলাম,ভালো লাগে নি ওদের। এজন্য এখন খারাপ হয়ে থাকবো।পোষালে আসবে নয়তো আসবে না।”
প্রিয় ইরাবতী পর্ব ৯
ইরা ধরা গলায় বললো, “তোমরা এমন নিষ্ঠুর হয়ে যাও কিভাবে?এমন করে কিভাবে কথা বলো?”
“ওরাই বাধ্য করে আমাদের নিষ্ঠুর হতে।”
উপমা শফিকের পাশে বসে ছিলো। লাউড স্পিকার দেওয়া থাকায় সবটাই কানে এলো ওর।
উপমা হতভম্ব হয়ে ভাবতে লাগলো, “কি এমন হয়ে গেলো এক দিনে!”
এখানে উপমার কষ্ট হচ্ছে ভীষণ। তাই সিদ্ধান্ত নিলো আগে একবার ওই বাড়ি যেয়ে নিক।এরপর বাচ্চাই হবে ওর আসল অস্ত্র!