প্রিয় ইরাবতী পর্ব ১২

প্রিয় ইরাবতী পর্ব ১২
রাজিয়া রহমান

উপমা এসেছে এক সপ্তাহ হয়ে এলো।শাশুড়ী ননদের সাথে মধুর ব্যবহার করলেও ভেতরে ভেতরে ফুঁসছে।সাগরের সামনে ভালো মানুষ হয়ে থাকতে চেষ্টা করছে উপমা।কিন্তু তক্কে তক্কে থাকছে রাফির সাথে যোগাযোগ করার জন্য। বাসায় পা দেওয়ার সাথে সাথেই খবরটা পেয়ে গেলো উপমা।
তারপর থেকে মাথায় পরিকল্পনা সাজাচ্ছে সে।
সাগর নিজের বোনকে উপমার উপরে প্রাধান্য দিয়েছে এটা উপমা কিছুতেই মানতে পারছে না।
উপমা সুযোগ বুঝে এমন বিষ কামড় দিবে যে সাগর কখনো আর ইরাকে বোন বলে ভাববে না।
উপমাকে সুযোগ করে দেওয়ার জন্যই শারমিন তার বোনের বাড়িতে বেড়াতে গেলো।

ইরা ভার্সিটিতে, সাগর অফিসে।
উপমা বাসায় একা।
উপমা গিয়ে ইরার রুমের বারান্দায় দাঁড়ায়। রাফি নিশ্চয় ছাঁদে দাঁড়িয়ে ইরাকে দেখে সেই ভাবনা থেকেই উপমা গিয়ে দাঁড়িয়ে থাকে। কিছুক্ষণ পর রাফিকে দেখতে পায় উপমা।
দ্রুত হাত ইশারা করে উপমা রাফিকে।
রাফি অবাক হয় প্রথমে।
কিন্তু উপমা বারবার ইশারা করায় রাফি ওখান থেকে হাত নাড়ে।
উপমা হাত কানে দিয়ে কল করার ইঙ্গিত দেয়।
রাফি বুঝতে পারে না কিভাবে কল করবে সে।আর এই মহিলা কে?
একটা কাগজে নিজের ফোন নাম্বার লিখে উপমা বারান্দা দিয়ে নিচে ফেলে রাফিকে ইশারা করে।
রাফি নেমে আসে ছাদ থেকে।
গালে এখনো সেই উত্তাপ টের পায় রাফি।
একটা থাপ্পড়!

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

এই একটা থাপ্পড়ের বদলা নেওয়ার জন্য রাফি সবকিছু করতে পারে।
নিচে এসে রাফি খুঁজে পায় না। উপমা আরেকটা কাগজ ছুঁড়ে ফেলে নিচে।
রাফি ফোনে নাম্বার তুলে ডায়াল করে উপমার নাম্বারে।
ব্যস্ত হয়ে উপমা হ্যালো বলে।
“কে আপনি?”
“আমি উপমা,ইরার ভাবী।”
“বলুন,কি জন্য কল করতে বলেছেন?”
“কি জন্য কল করতে বলেছি তোমার বুঝে যাওয়ার কথা তুমি যদি বুদ্ধিমান হও।”
“সোজা কথা বলুন।”
“একটা মেয়ের হাতে মাঝ রাস্তায় থাপ্পড় খেয়েছো,তবুও তোমার কোনো হেলদোল নেই না?তুমি পুরুষ না?তোমার ইচ্ছে করে না এর প্রতিশোধ নিতে।আমার তো এই কথা শোনার পর থেকেই তোমার জন্য মন কেমন করছে।তুমি আমার ভাইয়ের মতো।”

“কাঁটা ঘায়ে ঘায়ে নুনের ছিঁটা দিবেন না।”
“তুমি আসলে একটা কাপুরষ বুঝলে।নয়তো একটা মেয়ের হাতে থাপ্পড় খেয়ে কেউ এরকম ভ্যাবদা মেরে পড়ে থাকে?”
“আমি কাপুরষ না সুপুরুষ সেটা সুযোগ পেলে প্রমাণ করে দিবো।”
“আমি যদি তোমাকেন্সেই সুযোগ করে দিই?”
“আপনি কেনো দিবেন?আপনার স্বার্থ কিসের?”
“আমার স্বার্থ নেই। কিন্তু বললাম না,তুমি আমার ভাইয়ের মতো।”
উপমা রাফির সাথে বিস্তারিত কথা বললো।সাগর অফিস থেকে ফিরবে সন্ধ্যার পর।ইরা ফিরবে বিকেলে।শারমিন আজ ফিরবে না।আজকেই সুযোগ।
ইরা বিকেলে বাসায় ফিরে নিজের রুমে ঢুকতেই চমকে উঠে। বিছানার উপর হাসিমুখে রাফি বসে আছে।
চিৎকার করতে গিয়ে ও থেমে যায় ইরা।

বিপদে মাথা ঠান্ডা রাখতে হবে ইরা জানে।সাগর ফিরবে সন্ধ্যার দিকে।এইটুকু সময় ইরাকে ম্যানেজ করে নিতেই হবে।
চিৎকার চেঁচামেচি করলে আশেপাশের লোক জড়ো হবে,সবাই ইরাকেই দোষী বলবে।
রাফি অবাক হলো ইরাকে এরকম নির্লিপ্ত দেখে।উঠে এসে ইরার সামনে দাঁড়ালো রাফি।
ইরা চুলের পাঞ্চ ক্লিপটা খুলে ড্রেসিং টেবিলের উপর রেখে রাফির দিকে তাকিয়ে বললো, “আপনি এখানে?”
রাফি ইরার এমন শীতল কণ্ঠ শুনে দ্বিধায় পড়ে গেলো। ইরা কোনো রিয়েকশন দিচ্ছে না কেনো?
ইরা নিজের ফোনটা ব্যাগ থেকে রাফির দিকে পেছন ফিরে সাগরকে টেক্সট করে, “ইমার্জেন্সি বাসায় আসো ভাইয়া।”
মেসেজ ডেলিভারি হতেই ইরা ফোনের ফ্লাইট মোড অন করে দিলো যাতে কল না আসে আর।তাহলে সাগর দ্রুত আসবে।

তারপর রেকর্ডার অন করে ড্রেসিং টেবিলের উপর রাখে আলগোছে চার্জে লাগিয়ে।
“কেমন আছো ইরা?”
“আমি তো ভালো আছি কিন্তু আপনি এখানে কি মনে করে?কিভাবে আসলেন বাসায়?”
“তোমার টানে চলে এসেছি। সেদিন তোমার হাতের থাপ্পড় খেয়ে ভালো লেগেছে। আজ ভাবলাম সুযোগ যখন আছে তখন তোমার ঠোঁটের চুমু খেয়ে দেখি কেমন লাগে।”
ইরা মুচকি হেসে বললো, “দিবা স্বপ্ন!”
“না,দিবা স্বপ্ন না ইরা।আমি তোমাকে ভালোবাসছি,তোমার সাথে প্রেম করতে চেয়েছি।তুমি আমাকে অপমান করেছো।আমি তোমাকে ছেড়ে দিবো ভেবেছো?”
“আপনি আমাকে ভালোবেসেছেন সেই পর্যন্ত সব ঠিক ছিলো। কিন্তু আপনি রীতিমতো আমাকে অপমান করেছেন,আমাকে বিব্রত করেছেন,আমাকে অসম্মান করেছেন।ভালোবাসা আর সম্মান মুদ্রার এপিঠ ওপিঠ। যেখানে সম্মান করা যায় না সেটা ভালোবাসা হতে পারে না।”

“লেখাপড়া মনে হয় একটু বেশি করে ফেলছো,অনেক জ্ঞান দেওয়া কথা বলতেছো।মাস্টারনি হইবা মনে হয়? ভালোই তো,আমাদের পোলাপান পড়াইবা। বাহিরের মাস্টার লাগবে না।”
ইরার গা রি রি করে উঠে ঘৃণায়।কতো বড় স্পর্ধা এই লোকটার ইরা সেটাই ভাবছে মনে মনে।
উপমাকে ইরা সবসময় ক্ষমা করে এসেছে কিন্তু আজকের এই কাজের জন্য উপমাকে ইরা কখনো ক্ষমা করবে না।
কেউ বলতে হয় নি,ইরা দুইয়ে দুইয়ে চার মিলাতেই বুঝে গেছে উপমার সাথে হাত মিলিয়েই রাফি এখানে আসার স্পর্ধা করেছে।
রাফি এগিয়ে এসে ইরার হাত ধরতে চায়।

ইরা দুই পা পিছিয়ে গিয়ে বললো, “খবরদার, আমাকে স্পর্শ করবেন না।আপনি যদি সত্যি আমাকে ভালোবেসে থাকেন তাহলে অপেক্ষা করুন।আমাকে অসম্মানিত করলে আমি বি ষ খাবো নয়তো গলায় ফাঁ স দিবো।যদি সত্যি আমাকে ভালোবেসে থাকেন,আমাকে পেতে চান তাহলে আমাকে দশ জনের কাছে ছোট করবেন না অন্যায়ভাবে স্পর্শ করে। মনে রাখবেন,আমি অসম্মানিত হলে সেই বদনাম আপনার সাথে ও জড়িয়ে যাবে আজীবনের জন্য।”
“তোমাকে আমাকে জড়িয়ে বদনাম না হলে যে তোমাকে আমি সহজে পাবো না ইরা?যদিও আমার উদ্দেশ্য ছিলো তোমার বদনাম রটানো কিন্তু কি জানো?তোমার কাছে এলেই, তোমাকে দেখলেই আমার সবকিছু এলোমেলো হয়ে যায়।

বদনাম করলে তো শুধু বদনাম হবে,তুমি আমার হবে না।আমি চাই বদনামের সাথে যাতে তুমি আমার হও।আমার গালে একদিন থাপ্পড় দেওয়ার শাস্তি তুমি মরণ পর্যন্ত পাও।”
ইরা দেয়ালের সাথে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে থেকে বললো, “ঠিক কতটা জঘন্য মানসিকতা আপনার আপনি জানেন না।”
রাফি এক গাল হেসে বললো, “আমি জানি। তবে একা আমাকে দোষারোপ করো না ইরা।আমাকে আজকের এই চমৎকার প্ল্যান কে দিয়েছেন জানো?তোমার ভাবী।ভাবীকে হাজারো সালাম।”
“পাপের গড়া পূর্ণ হলে মানুষ এরকমই ভুল করে।”
“ভালোবাসা আর যুদ্ধে সবকিছুই সঠিক ইরা।”
সাগর সিঁড়ি দিয়ে হন্তদন্ত হয়ে উঠে আসে।ইরার মেসেজ পেয়ে সাগর কল দিলো কিন্তু ফোন বন্ধ।সাগর সাথে সাথে ছুটি নিয়ে চলে এলো।

কলিং বেল বাজতেই রাফি বললো, “ওই তো,তোমার ভাই এসেছে মনে হয়।এখন তো খেলা জমবে ইরা।
তুমি দরজা খুললে তোমার ভাই আমাদের দু’জনকে একসাথে দেখবে।এই যে ছুঁড়ে মারলাম তোমার গায়ের ওড়না।
কে বিশ্বাস করবে এখন যে বদ্ধ ঘরে আমি তোমাকে স্পর্শ করি নি?”
রাফি হাসতে লাগলো।
ইরা নিজের চুলগুলো দুই ভাগ করে কাঁধের উপর দিয়ে নামিয়ে দিলো সামনে। তারপর রাফির দিকে তাকিয়ে বললো, “সত্য সবসময় সুন্দর আর সবসময় প্রকাশ হয়।কেউ বিশ্বাস করতে হবে না।উপরে আল্লাহ আছেন তিনি সব জানেন।”
সাগর এসে দরজা ধাক্কা দিয়ে ইরাকে ডাক দিতেই রাফি গিয়ে দরজা খুলে দিয়ে হাঁপাতে হাঁপাতে প্যান্টের চেইন বন্ধ করতে লাগলো সাগরের সামনে।

সাগর হতভম্ব হয়ে বললো, “ও এখানে কেনো?”
ইরার আগে রাফি বললো, “আমাকে ইরা আসতে বলেছে।আন্টি আর আপনি বাসায় নেই তাই ও বলেছে আসতে।ওই দিনের পর ইরা আমার সাথে ফোনে কথা বলে।”
উপমা রুম থেকে বের হয়ে বললো, “ছি! লজ্জা থাকা উচিত তোমার ইরা।এতো দুশ্চরিত্র তোমার? ঘরে পুরুষ ঢুকিয়েছো তুমি?”
সাগর ইরার দিকে তাকিয়ে আছে। সে জানতে চায় ইরা কি বলবে।দুনিয়ার সবাই এক কথা বলুক,ইরা যদি তার বিপক্ষে বলে তবে সাগর ইরাকেই বিশ্বাস করবে।
উপমা সদর দরজা খুলে জোরে জোরে ইরাকে জড়িয়ে কথা বলতে লাগলো।

ফলস্বরূপ দুই একজন আগ্রহী জনতা আবারও এই বাসায় কোনো মঞ্চনাটক হচ্ছে ভেবে উঁকিঝুঁকি দিতে লাগলো।
ইরা উপমার দিকে তাকিয়ে হেসে বললো, “ এযাবৎ তোমার সব অন্যায়,অপরাধ আমি সবসময় ক্ষমা করে দিয়ে এসেছি। আমার বোনকে আল্লাহ দুনিয়া থেকে নিয়ে গেছে।তোমাকে পেয়ে আমি ভেবেছিলাম আবার তোমার মধ্যেই আমি আমার বোনকে পেয়েছি।তোমার সব অন্যায়কে ভাবতাম যদি আমার আপা করতো তখন তো আমি রাগ করে থাকতে পারতাম না তাহলে তোমার সাথে কেনো রাগ করবো।তুমি ঠিক হয়ে যাবে ভাবতাম।
কিন্তু আজ এই মুহূর্তে বলছি,আমার সবচেয়ে বড় অপরাধ ছিলো তোমার বোন ভাবা।
তুমি আসলে কালনাগিনী, যে সুযোগ পেলে ছোবল দিতে ছাড়ে না।
আমি ইরা নরম মনের হতে পারি তবে দুশ্চরিত্র নয়।
পরিস্থিতির প্রয়োজনে আমি ততটাই কঠোর হতে পারি।

তুমি যদি গর্ভবতী না হতে তবে একটা কষে থাপ্পড় মারতাম তোমাকে আমি।”
রাফি হাবিবাকে মিস কল দিতেই হাবিবা ছুটে আসে।মায়ের সাথে সবকিছু প্ল্যান করে এসেছে রাফি।
হাবিবার ভীষণ ক্ষোভ ইরার উপর। তার ছেলের গায়ে যেই মেয়ে হাত তুলেছে তাকে কি হাবিবা ছেড়ে দিবে!
হাবিবা ছুটে এসে বললো, “কি হয়েছে? আমার ছেলে এখানে কেনো?”
রাফি কাতর গলায় বললো, “মা ইরা আমাকে ডেকেছে।বলেছে ওর মা আর ভাই বাসায় নেই।আমি যাতে আসি।আমি সবার সামনে মিথ্যা কথা বলতে চাই না,ইরা আর আমি এতোক্ষণ এক সাথে ইরার রুমে ছিলাম।দুজনের মধ্যকার রাগ,অভিমান মিটিয়ে নিয়েছি আমরা। বাকিটা আর আমি বলতে পারবো না।”

প্রিয় ইরাবতী পর্ব ১১

ইরা আলমারি থেকে একটা বড় ওড়না গায়ে জড়িয়ে নেয়।সেই সাথে নিজের ফোনটা ও নেয়।
সাগরের দিকে তাকিয়ে বললো, “উনি মিথ্যা বলছেন ভাইয়া।আমি সবকিছু রেকর্ড করে রেখেছি ফোনে।”
রাফি চমকে যায়।
ইরা রেকর্ডিং প্লে করে দেয়।
সবাই শুনতে থাকে সবকিছু। উপমার গলা শুকিয়ে যায় আস্তে আস্তে।

প্রিয় ইরাবতী পর্ব ১৩