প্রিয় ইরাবতী পর্ব ১৭

প্রিয় ইরাবতী পর্ব ১৭
রাজিয়া রহমান

একটা নির্ঘুম রাত কেটে গেলো ইরার।পরপর একইরকম দুটো ঘটনা ইরাকে বিধ্বস্ত করে দিলো।ভেতর থেকে একেবারে নিঃশেষ করে দিলো যেমন করে নিঃশেষ হয়ে যায় ফুটন্ত গোলাপ।ভোরের আলো ফুটে উঠে আস্তে আস্তে। চারদিক আলোকিত হয়ে উঠে শুধু অন্ধকার থেকে যায় ইরার বুকের ভেতরটা।ধীরে ধীরে ইরা উঠে দাঁড়ায়। সারারাত এক ঠাঁয় বসে ছিলো ইরা।
ওয়াশরুমের আয়নার দিকে তাকায় ইরা,কেমন ভেঙে গুড়িয়ে যাওয়া একটা মেয়েকে দেখতে পায়।ইরা অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকে।
দরজায় ঠকঠক শব্দ হয়।

ইরা এগিয়ে যায় আস্তে আস্তে,কোনো তাড়াহুড়ো নেই।
দরজা খুলতেই ইশতিয়াক ইরার দিকে তাকিয়ে চমকায়।বুকের ভেতর অজস্র মৌমাছি হুল ফোটায়।
“চলো,তাকে বাসায় দিয়ে আসি।”
ইরা জানে না বাসায় গেলে ইরা কী বলবে।বের হয়ে ইরা ঘর থেকে।
“আমার জামাকাপড়?এই বেশে আমি বাসায় যেতে পারবো না।”
ইশতিয়াক এক মুহূর্ত ভাবে।তারপর ইরাকে নিজের রুমে থাকতে বলে ইশতিয়াক বুয়াকে ডাকলো।বুয়া আসতেই বললো, “লিনার রুম থেকে লিনার বান্ধবীর ব্যাগটা নিয়ে আসো।”
ইরা চুপচাপ দাঁড়িয়ে রইলো ভেতরে। ইশতিয়াক বাহিরে।
বুয়া গিয়ে লিনাকে বললো, “আপনার বান্ধবীর ব্যাগ দিতে কইছে ভাইজান?”

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

“কোন বান্ধবীর ব্যাগ?কে বলেছে?”
“ছোট ভাইজান।”
লিনা ঢোক গিলে। ইরার ব্যাগটা বের করে বুয়ার হাতে তুলে দেয়।লিনা জানে না কী হবে আজকে!
ইশতিয়াক ব্যাগটা ইরাকে দিয়ে বললো, “চেঞ্জ করে নাও।”
ইরা ওয়াশরুমে ঢুকে নিজের কাপড় চেঞ্জ করে নেয়।পরনের পেটিকোট আর টি-শার্ট দ্রুত ধুয়ে দিলো।
তারপর ইশতিয়াকের রুমের বারান্দার গ্রীলের সাথে শুকাতে দিয়ে বের হয়ে এলো।
ইশতিয়াক যখন ইরাকে নিয়ে বের হচ্ছে ইকবাল তখন ঘুমে।

ইশতিয়াক নিজেই ড্রাইভ করলো। বাসায় ঢোকা অবদি ইশতিয়াক বাহিরে দাঁড়িয়ে রইলো। ইরা ভেতরে ঢুকে বারান্দায় যেতেই দেখে ইশতিয়াক দাঁড়িয়ে আছে। ইরাকে দেখে হাত নাড়িয়ে টাটা করে চলে গেলো।
শারমিন পেছন পেছন এসে জিজ্ঞেস করলো, “কিরে?চলে এলি যে?বলেছি ন কয়েকদিন থাকতে?”
“ভালো লাগে না মা।ঘুম আসছিলো না নতুন জায়গায়। তাই চলে এলাম।”
“তাই বলে এতো সকালে?কি হয়েছে?”
শারমিনের গলায় অবিশ্বাসের সুর।ইরা মা’কে জড়িয়ে ধরে বললো, “আমার ভালো লাগছিলো না মা।কিছুই ভালো লাগছিলো না।”

শারমিন ইরাকে ছাড়িয়ে নিয়ে বললো, “আমি আরো ভাবছিলাম তুই লিনাদের বাড়ি গেলে আমি ও মাঝেমাঝে যামু।কতো ভালো একটা মেয়ে,কতো বড়লোক।”
ইরার কান্না পায় মা’য়ের কথা শুনে। মা কেনো এরকম?
অথচ ইরার ইচ্ছে করে কাউকে আঁকড়ে ধরে থাকতে।ভীষণ শক্ত করে। যেমন করে মা মুরগী রাখে তার ছানাকে।
সাগর ঘুম থেকে উঠে হন্তদন্ত হয়ে বের হয়ে এলো। গলা ফাটিয়ে মা’কে ডাকতে থাকে।
শারমিন ইরাকে ছেড়ে বের হয়।ইরাও মায়ের পেছন পেছন বের হয়।
“মা,উপমাকে হাসপাতালে নিয়ে গেছে। ওর ব্লিডিং হচ্ছে না-কি! মা আমার বাচ্চা….!”
ইরার বুকের ভেতর মোচড় দেয়।
সাগর ছুটে যায় তৈরি হতে।এই মুহূর্তে বাচ্চার চিন্তা ছাড়া কোনো কিছু তাকে স্পর্শ করে না।
তৈরি হয়ে সাগর এসে শারমিনকে বললো, “যাবে না তুমি?”

শারমিন বিস্মিত হয়ে বললো, “কোথায় যাবো?”
সাগর, ইরা দু’জনে বিস্মিত হয়।
ইরা এসে বললো, “আমি যাবো তোমার সাথে।”
সাগর ইরা যখন হাসপাতালে পৌঁছায় ততক্ষণে যা হওয়ার তা হয়ে গেছে। শফিক বাহিরে দাঁড়িয়ে আছে।রাফিকে থানায় রাখলেও উপমাকে সে কলকাঠি করে বের করে নিয়ে গেছে বাসায়।
উপমা রাগে,ক্ষোভে পেটে অসংখ্য কিল,ঘুসি দিয়েছে। চিৎকার করে বলেছে এই বাচ্চা সে রাখবে না।
সৃষ্টিকর্তা উপমার ইচ্ছে পূর্ণ করেছে।
ভোররাত থেকে ব্লিডিং শুরু হয়,উপমা কাউকে ডাকে নি।সকাল হলে উপমা যখন বের হয় ততক্ষণে রক্তে ভেসে গেছে রুম।উপমা নিশ্চুপ।কান টানলে মাথা আসবেই।উপমার আজকে অসুস্থতার খবর শুনে সাগর ও আসবে।ছুটে আসবে।

এতো সোজা উপমাকে ছেড়ে দেওয়া?
শফিকের ভীষণ হতাশ লাগছে।অতি আদরেই কি উপমা নষ্ট হয়ে গেছে এরকম করে?
ডাক্তার এসে জানালো প্রচন্ড আঘাতে বাচ্চা মারা গেছে। তবে মা শঙ্কামুক্ত আছে।
সাগর, ইরা বাহিরে বসে ছিলো। খবরটা শুনে সাগর কেমন পাথর হয়ে গেলো। সারা শরীরের শক্তি নিঃশেষ হয়ে গেছে সাগরের। ইরার ভীষণ কান্না পাচ্ছে। আজীবন কী ভাই তাকে অপরাধী ভেবে যাবে?
উপমাকে বের করে না দিলে তো এরকম করতো না উপমা!
শফিকের মন মেজাজ ভালো লাগছে না।বাড়িতে কল করে সবাইকে জানালো।বড় বোনকেও জানালো।
অনেকক্ষণ পর নার্স হাতে করে একটা মৃতদেহ নিয়ে এলো একটা তোয়ালে জড়িয়ে। ইরা কাঁদছে।সাগর এগিয়ে গিয়ে কোলে নিলো বাচ্চার নিথর দেহটা।নার্স আস্তে করে বললো, “মেয়ে বাবু ছিলো।”

সাগর ছোট্ট দেহটার দিকে তাকায়। কি নিষ্পাপ, কি কোমল,কি স্নিগ্ধ! !
আস্তে করে চুমু খায় সাগর। শফিক নির্বাক তাকিয়ে দেখে।সাগরের বুক ফেটে যাচ্ছে যন্ত্রণায়।আল্লাহর কাছে কতো চেয়েছে আল্লাহ তাকে একটা মেয়ে দেয় যাতে।আলমারিতে দুই সেট মেয়ে বেবির ড্রেস এনে রেখেছে সাগর যখন জেনেছে উপমা প্রেগন্যান্ট। সবকিছু এলোমেলো হয়ে যাচ্ছে সাগরের।
প্রতিটি স্পর্শ যেন তার ভাঙা আশা আর স্বপ্নকে ছিঁড়ে দিচ্ছে। কান্না থামানো সম্ভব হল না সাগরের,হৃদয় ভাঙা আর্তনাদ বের হয়ে এলো বুক ছিঁরে।
সাগর বাচ্চার পায়ে চুমু খায়, এই পা দুটো দিয়েই তো তার কলিজাটা হেঁটে বেড়াতো।
শফিক তাকিয়ে থাকে অপলক।

এজন্যই হয়তো বলে, একটা ও খারাপ বাবা নেই।এই যে সাগর তার কাছে একজন জঘন্য মানুষ অথচ সে ও তার সন্তানের কাছে শ্রেষ্ঠ বাবা হতো হয়তো।
ইরা বাচ্চাকে কোলে নিলো।কি মায়াবী একটা মুখ!
স্বর্গীয় মনে হচ্ছে। ইরা মা মা বলে ডেকে উঠে। সে তো মা বলেই ডাকতো দুনিয়ায় এলে।
কিন্তু কি হলো!
আদরে আদরে ভরিয়ে দেয় ইরা। দুই পায়ে চুমু খেয়ে বলে, “আমাকে ক্ষমা করে দিস মা।আমার জন্য আজ তোদের সবার জীবন এলোমেলো হয়ে গেছে। আমারই বোধহয় মরে যাওয়া উচিত ছিলো।
তুই কেনো চলে গেলি মা?

আমি যে আজীবন নিজের কাছে নিযে অপরাধী হয়ে থাকবো মা।
আমাকে কেনো আজন্মের শাস্তি দিয়ে গেলি তুই চলে গিয়ে?”
শফিক এগিয়ে এসে সাগরের কাঁধে হাত রাখে।এই মুহূর্তে একজন বাবা হিসেবে শফিকের মনে হচ্ছে তার ছেলেটার জন্য তার যেমন কষ্ট হয়,সাগরের ও তো তেমনই হচ্ছে।
সাগর ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে থাকে শফিকের দিকে।কণ্ঠস্বর রুদ্ধ হয়ে আসে কান্নায়।অনেক কষ্টে ভেঙে ভেঙে সাগর জিজ্ঞেস করে, “কিভাবে এমন হলো?”
শফিক মিথ্যা কথা বললো না।আজ এই মুহূর্তে একজন সন্তানহারা বাবার সাথে মিথ্যা বলার মতো পাপ শফিক করতে পারবে না।তাহলে সে নিজেও যে একজন বাবা হিসেবে অপরাধী হয়ে যাবে।
“উপমা রাগ,ক্ষোভে এমন করেছে।নিজের পেটে নিজেই আঘাত করেছে। অসংখ্য, অজস্র।যার জন্য আজকে এই অবস্থা।”
সাগর অবাক হয়। এতো জঘন্য ও একজন মানুষ হতে পারে!!!

নাশতার টেবিলে হাসিবুল শেখের দুই পাশে ইকবাল এবং ইশতিয়াক দুজন বসেছে।হাসিবুল শেখ গতরাতের ঘটনা সবিস্তারে জেনেছেন।তিনি সেই প্রসঙ্গ তুললেন না।তিনি না তুললেও ইশতিয়াক তুললেন।
খেতে খেতে ইশতিয়াক বললো, “আমি বিয়ে করতে চাই।”
ইকবাল সরু চোখে তাকায় ইশতিয়াকের দিকে। ইশতিয়াক একটা আঙুর মুখে তুলে বললো, “ইরাকে বিয়ে করবো আমি।”

ইকবাল খিকখিক করে হেসে উঠে। হাসিবুল শেখের সামনে বললো, “নিজেকে আসল পুরুষ প্রমাণ করতে?”
নিজের বাম হাত তুলে ইকবাল চার আঙুল বন্ধ করে মধ্যমা আঙুল তুলে একটা অশ্লীল সাইন দেখায় ইশতিয়াককে।মুহুর্তেই ঝড়ের বেগে একটা কাচের গ্লাস এসে আঘাত করে ইকবালের কপালে।তারপর ঝনঝন শব্দে ভেঙে পড়ে।
ইকবালের কপাল কেটে যায়।ইশতিয়াক উঠে গিয়ে ইকবালের গলা টিপে ধরে প্রচন্ড আক্রোশে। ইকবালের দম বন্ধ হয়ে আসে,চোখ উলটে যায়।

প্রিয় ইরাবতী পর্ব ১৬

ইশতিয়াক ছেড়ে দিয়ে বললো, “ইরাকে নিয়ে যদি আবারও কোনো নোংরা কথা অথবা নোংরা অঙ্গভঙ্গি করেছিস,সেদিন আমি তোর আজরাইল হবো।”

প্রিয় ইরাবতী পর্ব ১৮