প্রিয় ইরাবতী পর্ব ১৯

প্রিয় ইরাবতী পর্ব ১৯
রাজিয়া রহমান

উপমা শুয়ে ছিলো। বুকের ভেতর কেমন শূন্যতা ভীড় করছে।উপমা জানে না এই অনুভূতির নাম কী হতে পারে কিংবা কার উপর দোষ চাপাবে সে এখন!
যা করেছে তার জন্য সে অনুতপ্ত না হলেও ভেতরে অস্থিরতা টের পায়। প্রতিমুহূর্তে মনে হচ্ছে এই বুঝি পেটের ভেতর থেকে তার বাচ্চাটা মৃদু নড়াচড়া করে উঠবে।

নার্স এসে বললো, “আপনার তো রিলিজ হয়ে গেছে, বাসায় যাচ্ছে না যে?আয়া আসবে ক্লিন করতে রুমটা।”
উপমা কিছুটা অবাক হলো। রিলিজ দিয়ে দিয়েছে তাকে?কই,ভাইয়া তো তাকে কিছু বললো না।
উপমা নার্সকে বললো, “বাহিরে আমার ভাই দাঁড়িয়ে আছে। ওনাকে একটু ডেকে দিবেন কষ্ট করে?”
নার্স বাহিরে গিয়ে দেখে এসে বললো, “না বাহিরে কেউ নেই।”
“আছে।সবুজ শার্ট পরা এক ভদ্রলোক দাঁড়িয়ে আছে।”
“ওহ,উনি!উনি তো আরো আগেই চলে গেছেন।আমি তখন বের হচ্ছিলাম,উনিও তখন বের হচ্ছিলো তাই মনে আছে।”
উপমার কলিজা কেঁপে উঠে।

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

বিছানা থেকে নেমে দাঁড়ায় উপমা।আস্তে আস্তে বাহিরে আসে।বাহিরে কেউ নেই।সব রুমের সামনেই মোটামুটি কেউ না কেউ আছে শুধু তার রুমের সামনে কেউ নেই।উপমার ভীষণ অসহায় লাগে।ভাইয়া চলে গেলো!!!
এতো বিস্মিত উপমা হয় নি আগে।
ভাইয়া ও তাকে ভুল বুঝবে এটা উপমার ভাবনাতেও ছিলো না।
হাসপাতালের বাহিরে এসে দাঁড়ায় উপমা।মাথার উপর গনগনে সূর্য। উত্তাপে উপমার সারা শরীর ঝলসে যাচ্ছে যেনো।উপমার বুকের ভেতর হাতুড়ি পেটা করে কেউ যেনো।সাগর এরকম ডাক্তার দেখাতে এলে ছাতা নিয়ে আসতো।উপমার মাথার উপর ছাতা ধরে রাখতো।

সূর্যের উত্তাপ এতোটাই তীব্র যে উপমার মনে হচ্ছে শরীরের যেটুকু অনাবৃত সেটুকু জ্বলে যাচ্ছে।
উপমা একটা সিএনজি নিয়ে বাসার দিকে যায়।ভাইয়ার সম্ভবত ইমার্জেন্সি কল এসেছে তাই চলে গেছে এমন করে।
সিএনজিকে দাঁড় করিয়ে রেখে উপমা ভেতরে এলো।তার কছে কোনো টাকা নেই।কলিং বেলের শব্দ শুনে জান্নাত রান্নাঘর থেকে বের হয়।
মেজাজটা খারাপ হয়ে যায় এতো ঘনঘন বেল দেওয়ায়।
দরজা তো কেউ কোলে নিয়ে বসে থাকে না।যে আসে সে সারা পথ হেঁটে আসতে পারে দরজার সামনে ৩০ সেকেন্ড আর অপেক্ষা করতে পারে না যেনো!
বিরক্তি নিয়ে জান্নাত পীপহোলে তাকায়।উপমা দাঁড়িয়ে আছে বাহিরে।
জান্নাত প্রস্তুতি নিয়ে দরজা খোলে।

উপমা ভেতরে আসার জন্য পা বাড়াতে বাড়াতে বললো, “ভাবী,৩০০ টাকা নিয়ে নিচে যাও তো।সিএনজি নিচে দাঁড় করিয়ে রেখে আসছি।ভাড়াটা দিয়ে আসো।”
জান্নাত হাত বাড়িয়ে পথ বন্ধ করে উপমাকে বললো, “এদিকে কোথায় যাচ্ছো?”
উপমা হতবাক হয়ে যায় এমন প্রশ্নে।
“এদিকে কী তোমার? কেনো আসছো এখানে?”
“মানে কী?আমার বাসায় আমি আসবো না?”
“তোমার বাসা?তোমার বাসা কবে হলো?এটা আমার বাসা উপমা।আমার সংসার। এখানে কে থাকবে আর থাকবেবনা সেটা আমি ঠিক করবো।তোমাকে আমার সংসারে আমি রাখতে পারবো না।মানুষকে মানুষ আশ্রয় দেয় কোনো ডাইনীকে না।”

“মুখ সামলে কথা বলো ভাবী!ইদানীং দেখেছি তুমি অনেক কথা শিখেছো।”
“হ্যাঁ, যেই কথা আমার বিয়ের পরপরই বলা উচিত ছিলো আমি তখন বলি নি।কিন্তু যতো দিন যাচ্ছে ততই দেখছি তোমরা কুকুর হলে আমাকে মুগুর হতেই হবে।”
“যে কথাগুলো বললে আমাকে,ভাইয়া আসুক।আমি সব বলবো।”
“ওসব ভয় জান্নাত এখন আর করে না বুঝলে।জুজুর ভয় জান্নাতের কেটে গেছে।”
“সরো,আমাকে ভেতরে যেতে দাও।”
“এটা তোমার বাপের বাড়ি না।ভাইয়ের বাড়ি।ভাইয়ের বাড়িতে থাকা এতটা সোজা না বুঝলে।তোমার ভাইকে আমি ক্লিয়ারলি বলে দিয়েছি এই ব্যাপারে। সে ও চায় না তুমি এখানে থাকো।এজন্যই তোমাকে হাসপাতালে ফেলে চলে এসেছে। তোমার নিজের রাস্তা নিজে দেখো।আমাদের ঘাড়ে চাপতে এসো না।টাকা পয়সা খরচ করে তোমার ভাই তোমার বিয়ে দিছে।

এখন তুমি নিজে সেই ঘর ভেঙে আসছো যেহেতু, আমাদের পক্ষে তো সম্ভব না তোমাকে বছর বছর বিয়ে দেওয়া।বের হও আমার বাসা থেকে।”
উপমার দুই চোখ ভিজে উঠলো। এতো অপমান!
উপমা গলা চড়িয়ে সাগরকে ডাকতে লাগলো।
“তোমার ভাই ঘুমাচ্ছে।এখানে দাঁড়িয়ে থেকে আমার সময় নষ্ট করো না।যাও এখান থেকে।নয়তো দারোয়ান ডেকে বের করবো তোমাকে।”
উপমাকে অবাক করে দিয়ে জান্নাত মুখের উপর দরজা বন্ধ করে দিলো।হতভম্ব উপমা বাহিরে দাঁড়িয়ে রইলো। পায়ের নিচে যেটুকু মাটি ছিলো সেটুকু ও হারিয়ে গেলো উপমার।
আস্তে আস্তে উপমা নিচে এলো।

সিএনজি ড্রাইভার বিরক্ত হয়ে বললো, “আরে আপা,এইডা কোনো কাম করছেন আপনি? আমারে এতো সময় দাঁড় করাইয়া রাখছেন।দ্যান ভাড়া দ্যান।”
উপমা নিজেকে সামলে নিয়ে বললো, “ভাই,মগবাজার চলেন।”
“না আপা,যামু না ওইদিকে।ভাড়া দেন।”
“আমার কাছে টাকা নাই।ওখানে চলেন,আপনার ভাড়া পেয়ে যাইবেন।”
বিরক্ত হয়ে সিএনজি ড্রাইভার সিএনজি স্টার্ট দিলো।
উপমা দুরুদুরু বুকে বোনের বাসার উদ্দেশ্যে রওয়ানা দিলো।রুমা আপা এখন ভরসা উপমার।
রুমা বাসাতেই ছিলো। উপমা সিএনজি থেকে নেমে বাসায় ঢুকে লুটিয়ে পড়ে। কাতর গলায় বোনকে বললো, “আপা,সিএনজি ভাড়া দে আগে।তারপর কথা বলবো।”

রুমা সবেমাত্র খাওয়া দাওয়ার আয়োজন করছে।উপমার অবসন্ন দেহের দিকে তাকিয়ে রুমা বুঝতে পারলো কোনো একটা ঝামেলা হয়েছে। দ্রুত গিয়ে ভাড়া দিয়ে এলো রুমা।
খাওয়া দাওয়ার পর দুই বোন বসলো সোফায়।
রুমা জানতে চাইলো কী হয়েছে। উপমা বোনের সাথে সবকিছু বলতে শুরু করে। নিজের দোষ না বলে সব দোষ সবার উপর চাপিয়ে দেয়।
রুমা সব শুনে রাগে ফেটে পড়ে যেনো।

শারমিন সানন্দে রাজি হয়ে গেলো। ইরা ভেতর থেকে বের হয়ে এসে বললো, “তুমি আমার অনুমতি না নিয়ে কীভাবে রাজি হও?আমি রাজি না।”
ইরা ক্ষোভে ফেটে পড়ে। ইশতিয়াকের সাথে বিয়ে এটা সে দু:স্বপ্নে ও ভাবে নি।
শারমিন কটাক্ষ করে বললো, “কেনো?কিছুক্ষণ আগেই না ধমক দিলি? এখনই ভুলে গেছিস?না-কি আমার ঘাড় থেকে নামতে ইচ্ছে করে না?”
ইরা লজ্জায় মাটির সাথে মিশে যেতে চাইলো।মানুষের সৎ মা ও এতটা নিকৃষ্ট হয় না তার আপন মা যেমন হচ্ছে দিনদিন।

ইশতিয়াক ইরার দিকে তাকিয়ে রইলো অপলক। ইরার চোখে মুখে হাজারো যন্ত্রণার ছাপ।অলকানন্দা ফুলের মতো কোমল যে মানুষ, তাকে এতো বেদনা মানায় না।কিছুতেই না।
এই বন্দী রাজকন্যাকে ইশতিয়াক এই রাক্ষসপুরী থেকে উদ্ধার করে নিয়ে যাবে।এক মুহূর্ত ও আর এখানে রাখবে না।এখানে আসার সাথে সাথে ইরার মা যেই রূপ দেখিয়েছে তারপর ইশতিয়াকের মনে হচ্ছে না ইরা এই মহিলার কাছে নিরাপদ থাকবে।
ইরার আপাদমস্তক জুড়ে বেদনার ঢেউ।এতো অপমান ও ভাগ্যে ছিলো!!!
শারমিনের চোখে মুখে জিতে যাওয়ার আনন্দ। ইশতিয়াক লিনার ভাই জানার পর থেকে শারমিনের আর হুঁশ নেই যেনো।
শারমিন ইরাকে উদ্দেশ্য করে বললো, “তোর আসলে সেই মুরোদ নাই।সংসার করার জন্য যোগ্যতা লাগে।পারবি শুধু আমার মাথায় কাঁঠাল ভেঙে খাইতে।বলেছিস না আমার এটা কারাগার। এখন কেনো এখান থেকে যেতে চাস না?”

ইরার বুক ভেঙে কান্না এলো।ইশতিয়াক আর সহ্য করতে পারলো না।অস্থির হয়ে উঠে ইরার হাত ধরে বললো, “আর এক মুহূর্ত ও আমি তোমাকে কারো কাছে অপমানিত হতে দিবো না ইরাবতী। এই মুহূর্তে তুমি আমার সাথে যাবে,কাজী অফিসে আমরা বিয়ে করবো।আপনি আসুন আমার সাথে।”

প্রিয় ইরাবতী পর্ব ১৮

ইরা নিজেকে তার ভাগ্যের হাতে ছেড়ে দিলো।ভেতরে ভেতরে ইরা একেবারে নিঃশেষ হয়ে গেছে মায়ের ঝাঁঝালো বাক্যবাণে। যেনো প্রতিটি শব্দ তীরের ন্যায় উল্কার বেগে ইরার কলিজা ক্ষত-বিক্ষত করে দিয়েছে।
সে তো চেয়েছেই এখান থেকে চলে যেতে।যা হবার হোক তার।বড় আপার মতো শেষ হয়ে যাক প্রয়োজন হলে।শেয়াল কুকুরে খুবলে খাক তবুও আর এই মা’য়ের কাছে এক মুহূর্ত ও না।
কোনো বাঁধা না দিয়ে ইরা ইশতিয়াকের সাথে চললো।জীবন তাকে যেখানে ইচ্ছে নিক,মা’য়ের কাছে আর না।

প্রিয় ইরাবতী পর্ব ২০