প্রিয় পূর্ণতা পর্ব ৪৩

প্রিয় পূর্ণতা পর্ব ৪৩
তানিশা সুলতানা

প্রেগন্যান্সির কিট হাতে আসমানের পানে তাকিয়ে আছে পূর্ণতা। দুই চোখ হতে অনবরত গড়িয়ে পড়ছে নোনাজল। জীবনের হিসাব নিকাশ মেলাতে হিমশিম খাচ্ছে। কি থেকে কি হয়ে গেলো?
রাতারাতি রাণী দাসীতে পরিণত হলো। নিয়তি বোধহয় এমনই?

অভির বিয়ের খবর জেনেছে ৩ দিন পেরিয়ে গেলো। এই তিন দিন পূর্ণতা পাগলের মতো খুঁজেছে অভিকে। জমিদার সাহেবের পা জড়িয়ে কেঁদেছে অভির সাথে একটু কথা বলিয়ে দেওয়ার জন্য। কুটিল হেসেছে জমিদার। পূর্ণতার চুলের মুঠো ধরে ধাক্কা দিয়ে ফেলে দিয়েছে দূরে। কপালে আঘাতও পেয়েছিলো। চিকিৎসার অভাবে সেই আঘাতে আজ চামড় ধরেছে। মমতা মায়াভরা নয়নে দেখেছে পূর্ণতাকে।

আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন

হঠাৎ করে বড্ড মায়া লেগেছিলো তার। কিন্তু এগিয়ে যাওয়ার সাহস পায় নি। পূর্ণতা মনোয়ারের পা জড়িয়েও কেঁদেছে প্রচুর। মনোয়ারের মন গলাতে পারে নি। অকাথ্য ভাষায় গালাগালি করেছেন মনোয়ার। ছেলের বউকে কখনো কোনো শশুর অশ্লীল ভাষায় গালি দিতে পারে জানা ছিলো না পূর্ণতার। মিষ্টির ফোন থেকেও হাজার বার কল করেছে অভিরাজের নাম্বারে। কিন্তু কল ধরা হয় নি। বাজতে বাজতে কেটে গিয়েছে।কতোশত মেসেজ পাঠানো হয়েছে কোনো উত্তর আসে নি।

পাগল হয়ে গিয়েছে পূর্ণতা। প্রতিনিয়ত চিৎকার করে কেঁদেছে নিজ কক্ষে। কেউ এগিয়ে আসে নি। হঠাৎ করে পূর্ণতার মনে পড়ে সেই ডাইরির কথা। নিশ্চয় কিছু লেখা আছে সেখানে। নতুন কোনো সুত্র। অভিকে ফিরে পাওয়ার রাস্তা।

চোখের পানি মুছে দাঁড়িয়ে পড়ে পূর্ণতা। হাঁটু ছাড়িয়ে পড়া লম্বা চুল গুলো যত্নের অভাবে উসকোখুসকো হয়ে আছে। জটলা বেঁধে গেছে। অগোছালো চুল গুলো হাত খোঁপা করে নেয়। কাপড়ে আঁচল টেনে কাঁধে জড়ায়। গুটিগুটি পায়ে এগিয়ে যাওয়া ডাইরির নিকট।
পড়ার টেবিলে বইয়ের ভাজে যত্ন করে রাখা ডাইরিখানা বের করে। পৃষ্ঠা আপনাআপনি উল্টে যায়। নিশ্চয় হাওয়া আসছে প্রবল বেগে।
৫৭ নাম্বার পেইজে এসে থামে। আর উল্টায় না পৃষ্ঠা। পূর্ণতা ঝাপসা দৃষ্টিতে তাকায়। কালো মোটা কালি দ্বারা লেখা হয়েছে

“এক জীবনে সব পেয়ে গেলে আফসোস করবে কি নিয়ে?
থাকুক না কিছু চাওয়া অপূর্ণ। যাতে দিন শেষে দীর্ঘ শ্বাস ফেলে বলতে পারো ” ইসসস যদি পেয়ে যেতাম”
কতোই না সুন্দর হতো জীবন।
আমি তোমার জীবন সুন্দর করতে চাই না, প্রতি মুহুর্তে আঘাত দিতে চাই।
আমি তোমার আফসোসে থাকতে চাই পূর্ণতা। কপালে নয়।
আমি তোমার কাজল কালো আঁখির অশ্রু হতে চাই। গোলাপি অধরের হাসি নয়।
আমায় ক্ষমা করো না কখনো।

আমার প্রতি ঘৃণা নিয়ে সারাজীবন বেঁচে থেকো। তবুও ক্ষমা করে অন্য কারো হইয়ো না।
ঠোঁট কামড়ে কান্না আটকানোর চেষ্টা করে পূর্ণতা। কিন্তু চোখের পানি যে বড্ড বেহায়া। কিছুতেই বাঁধ মানে না।
পরবর্তী পৃষ্ঠা উল্টায় সেখানে লেখা রয়েছে
“আমি জানি তোমার মধ্যে বেড়ে উঠছে আমার অংশ। তুমি যাতে কোনোদিনও আমায় ভুলতে না পারো তাই উপহার দিয়ে এসেছি তোমায়। আমার অনুমান ভুল না হলে মা হতে চলেছো তুমি।
ডাইরির পৃষ্ঠা দ্বারা ভাজ করে রাখা হয়েছে একটা প্রেগন্যান্সির কিট। এবং নিয়ম লিখে দিয়েছে। উত্তেজনায় হাত পা কাঁপছে পূর্ণতার। তারাহুরো করে লিখে রাখা পদ্ধতিতে পরিক্ষা করে ফেলে। কিট হাতে বেলকনিতে চলে আসে। নজর বুলায় একবার। পজিটিভ এসেছে।

দিশেহারা পূর্ণতা বুঝতে পারছে না কি করবে? ভাগ্য এতবড় খেলা খেললো তার সাথে?
আসমানের পানে তাকায়। থালার মতো বিশাল বড় চাঁদ উঠেছে। চান্দের আলোয় আলোকিত হয়েছে জমিন। আবসা আলোয় দেখা যাচ্ছে দূর দূরান্ত পর্যন্ত।
“আল্লাহ শুধু একবার আমার সাথে দেখা করিয়ে দিন তার। প্রাণ ভরে শেষবার দেখতে চাই তাকে। আর কিচ্ছু চাইবো না। তার কাছে আমার আর কিছু চাওয়ার নেইও। অভিযোগও নেই তার প্রতি। যোগ্য ছিলাম না আমি। তাই হয়ত ছেড়ে চলে গেলো।
তবে একটা প্রশ্ন করতে চাই তাকে।
” আমায় ভালোবাসলেন না কেনো এমপি সাহেব? একটু ভালোবাসলে ঠকতেন না।

হাঁটু ওবদি পানিতে দাঁড়িয়ে আছে মিষ্টি। বিশাল নদী শান্ত। একটা ঢেউ এর ছিঁটেফোঁটাও নেই। ইফতিয়ার ডাঙার দাঁড়ানো। কয়েকবার ধমকেছে মিষ্টিকে পানি থেকে উঠে আসার জন্য। কিন্তু দস্যি মিষ্টি ইফতিয়ারের কথা কানেও তুললো না। মেজাজ বিগড়ায় ইফতিয়ারের। এমনিতেই কিছু দিন হলো পূর্ণতাকে দেখতে পাচ্ছে না। অভিরাজ পূর্ণতাকে নিয়ে দূরে কোথাও চলে গিয়েছে। বুকটা খাঁ খাঁ করছে ইফতিয়ারের। হৃদয়ে রক্তক্ষরণ হচ্ছে প্রিয়তমাকে না দেখতে পেয়ে।

মিষ্টিকে হাজারবার অনুরোধ করেছে পূর্ণতার খবর জানাতে। কোথায় আছে ঠিকানা জানতে চেয়েছি। মিষ্টি বলে নি। আজকে হুট করে কল করবো এবং অনুরোধের সুরে বললো
“চৌধুরী সাহেব
আমাকে নিয়ে সমুদ্র সৈকতে বেড়াতে চলুন। কথা দিচ্ছি দেখা করিয়ে দিবো পূর্ণতার সাথে।
লোভ সামলাতে পারে নি ইফতিয়ার। পাড়ি জমিয়েছে সমুদ্র সৈকতে।
” মিষ্টি তুমি কথা দিয়ে কথা রাখতে পারো না। বাবা চাচাদের মতো হয়েছো। মিথ্যে বাদি। জমিদার বংশের রক্ত বইছে তোমার শরীরে প্রতি নিয়ত প্রমাণ করে চলেছো।

ইফতিয়ারের উচ্চস্বরে বলা কথা গুলো শুনে থেমে যায় মিষ্টি। এতোক্ষণ পানি নিয়ে খেলতে থাকলেও এবার সাগরের ঢেউয়ের ন্যায় শান্ত হয়ে দাঁড়ায়।
চোখ রাখে ইফতিয়ারে চোখে। মৃদু হেসে বলে
“আমি কথা রাখতে জানি চৌধুরী সাহেব। তাই তো মরার পরেও আমার আত্মা শান্তি পাচ্ছে না। আপনার দেওয়া দায়িত্বের ভাড়ে নুয়িয়ে পড়ছে। আমায় ভালো থাতে দিলেনা আপনি।
এক ফোঁটা সুখ পেলাম না আপনাকে ভালোবাসে। বড্ড নিষ্ঠুর আপনি। বেইমান।

মিষ্টির আঁখিতে অশ্রু জমেছে। চান্দের আলো মুখে পড়ায় সেই অশ্রু চিকচিক করছে। বড্ড আবেদনময়ী লাগছে মিষ্টিকে। ইফতিয়ারের মনে নিষিদ্ধ ইচ্ছে জাগে। জাপ্টে জড়িয়ে ধরে অধরে অধর মেলানোর সাধ জন্মায়। এই জনমানবহীন নির্জন সমুদ্রে নিজের পুরুষত্ব খাটাতে ইচ্ছে করছে। আদরে পিষিয়ে দিতে চাচ্ছে ছোট দেহখানা।
ইফতিয়ারও নেমে পড়ে পানিতে। ধীরে ধীরে পা ফেলে এগিয়ে আসে মিষ্টির নিকট। এক হাত রাখে মিষ্টির গালে এবং অপর হাত গলিয়ে দেয় কামিজের ফাঁকে। বক্ষদেশে গিয়ে থামে হাতের ছোঁয়া। মাথা নুয়িয়ে অধরের কাছে এগিয়ে আসে।
তখনই মিষ্টি আঙুল রাখে ইফতিয়ারের অধরে। মৃদু হেসে বলে

” এই জনমে আপনার নরম কোমল ঠোঁটের ছোঁয়া পাওয়ার ইচ্ছে পূরণ হলো না। তবে পরজনমে সব ইচ্ছে পুষিয়ে নিবো। ভালোবাসায় ভরিয়ে দিবো আপনার হৃদয়। আপনার ছোঁয়ায় বেসামাল হবো প্রতি রাতে।
হাতের ছোঁয়া গাড়ো হতে থাকে। ব্যাথা পেলো বোধহয় মিষ্টি। অস্ফুরণ স্বরে “আহহ” শব্দ করে ওঠে। হাত রাখে ইফতিয়ারের হাতের ওপর। ছাড়ানোর চেষ্টা করে।
ইফতিয়ার ছাড়ে না উল্টে বল প্রয়োগ করে জাপ্টে করে এবং অধৈর্য স্বরে বলে

“আমি নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারছি না মিষ্টি। প্রথমবার শখ জেগেছে নারীর শরীরে সুখ খোঁজার। বাঁধা দিও না। কষ্ট হচ্ছে। কথা দিচ্ছি এটাই প্রথম এবং এটাই শেষ।
মিষ্টি শুনলো না। বরং কঠিন গলায় বলে
” ছাড়ুন ইফতিয়ার। হাত সরান।

অভিমান হয় ইফতিয়ারে। মুখ গোমড়া করে ছেড়ে দেয় মিষ্টিকে। চলে আসতে নেয় একা ফেলে। তখন শুনতে পায় মিষ্টির বলা কিছু কথা
“আপনার পূর্ণতা ভালো নেই চৌধুরি সাহেব৷ আমার দাভাই তাকে ছেড়ে চলে গিয়েছে। কালকে বাবা দাদা পূর্ণতাকে মিথ্যে বদনাম দিয়ে বাড়ি থেকে তাড়িয়ে দিবে। এবং মাঝরাস্তা থেকে তুলে নিয়ে বিক্রি করে দিবে বিদেশিদের কাছে। পূর্ণতাকে বাঁচান চৌধুরী সাহেব। আপনার পূর্ণতাকে বাঁচান।
পরপর বিশাল একটা ঢেউ আসে। সেই ঢেউ ভাসিয়ে নিয়ে যায় মিষ্টি।
“মিষ্টটটটটটটটটটটটটি

চিৎকার দিয়ে বসে পড়ে ইফতিয়ার। বুকটা অস্বাভাবিক ভাবে কাঁপছে। গলা শুকিয়ে গিয়েছে। বড্ড পানির অভাব অনুভব করছে।
চোখ খুলে ইফতিয়ার। ঘড়ির কাটা টিকটিক করে জানান দিচ্ছে রাত একটা বেজে গিয়েছে। ড্রিম লাইটের মৃদু আলোতে গোটা কক্ষ আলোকিত। ইফতিয়ার জিভ দ্বারা ঠোঁট ভিজিয়ে হাঁটু মুরে বসে। দুই হাঁটুর ভাজে মুখ লুকিয়ে ফুঁপিয়ে কেঁদে ওঠে।
বিরবির করে বলতে থাকে

” আমি নিষ্ঠুর মিষ্টি। বড্ড নিষ্ঠুর। আমাকে ক্ষমা করে দাও।
কিভাবে শোধ করবো তোমার ঋণ? কি করে মেটাবো তোমার দুঃখ?
কোথাও গেলে তোমায় পাবো?
প্রতিনিয়ত আমাকে অপরাধী করে দিচ্ছো তুমি। তোমাকে আমি ব্যবহার করলাম শুধু
একটুও ভালোবাসতে পারলাম না।
পরপরই ইফতিয়ারের মনে পড়ে পূর্ণতার কথা। চট করে মাথা তুলে

“ঠিক আছে তো পূর্ণতা?
তখনই বাতাসের শা শা শব্দ শুনতে পায় ইফতিয়ার। সেই শব্দের সাথে ভেসে আসে মিষ্টির কন্ঠস্বর। সে তাচ্ছিল্যের স্বরে বলছে
” আপনার পূর্ণতার শিওরে বসে পাহাড়া দিচ্ছি আমি।

প্রিয় পূর্ণতা পর্ব ৪২

যতদিন আমার অস্তিত্ব আপনার মনে থাকবে ততদিন আপনার পূর্ণতার পিছু আমি ছাড়বো না। ছায়ার মতো পাশে থেকে বাঁচাবো তাকে কথা দিলাম।
কিন্তু যেই মুহুর্তেই আপনি আমায় ভুলে যাবেন সেই মুহুর্তেই আমার অস্তিত্ব বিলিন হয়ে যাবে ধরণীর বুক থেকে।

প্রিয় পূর্ণতা পর্ব ৪৪