প্রিয় পূর্ণতা পর্ব ৪৭
তানিশা সুলতানা
মেয়ের বিয়ের পর থেকে ঘুরেছে সালামের দিন। রিকশা চালক সালাম এখন সফল ব্যবসায়ি। বড়তলা বাজারের সব থেকে বড় কাপড়ের দোকানটি তার। বাড়িতে তুলেছে টিনের ঘর। দিয়েছে গোসলখানা, পাঁচটা গরুও কিনে ফেলেছে ইতোমধ্যেই।
ফ্রীজ কিনেছে টিভি কিনেছে। ভালো ভালো জামাকাপড় পড়ছে। প্রতি সপ্তাহে একদিন গরুর মাংস খায়। পাপন ক্লাস এইট এ উঠেছে। ছেলেকে ডাক্তার বানানোর স্বপ্নে সালাম দিন রাত এক করে পরিশ্রম করছে। ভেবে রেখেছে সামনের বছর পূর্ণতাকে একটা স্বর্নের চেইন বানিয়ে দিবে। খালি হাতে মেয়ে বিয়ে দিয়েছে। আজ ওবদি দুটো ফল নিয়ে মেয়েকে দেখতে যেতে পারে নি৷
আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন
সেলিনা বেগম গরুর মাংসের জন্য পেঁয়াজ কাটছে। সালাম বাড়ি ফিরলেই রান্না চড়াবে। তার ভাই রফিক আসবে আজকে। বাবার ঘর থেকে আসার পরে কখনো ভাই বাবাকে ভালো মন্দ দুটো খাওয়াতে পারে নি সেলিনা। আজকে যখন সুযোগ আসছে তখন হাতছাড়া করবে কেনো?
পাপনকে পাঠিয়েছে রফিককে এগিয়ে আনতে। সালমা গরুর মাংস হাতে নিয়ে সবেই বাড়ির উঠোনে দাঁড়িয়েছে। তখনই জমিদারের লোকদের দেখে ভয়ে বুক কেঁপে ওঠে সালামের। দীর্ঘ দিন জমিদাররা তাদের ওপর কোনো অত্যাচার করে না। অবশ্যই অভির হুকুমে। তবে আজকে কেনো এসেছে?
জমিদার হাসেব এর ডান হাত আতোয়ার হাতে লাঠি নিয়ে তেড়ে আসছে সালামের পানে। তার পেছনে আরও দশ বারোজন লোক রয়েছে। ভয়ের তাপটে গোনার সাহস হয় না সালামের।
মাংসের প্যাকেট জমিনে পড়ে যায় হাত ফসকে। মুহুর্তেই প্যাকেট ছিঁড়ে এদিক ওদিক ছড়িয়ে ছিটিয়ে যায় মাংসগুলো।
সালাম মাংসের দিকে তাকায় তখনই তার পিঠে আঘাত করে আতোয়ার। হুমড়ি খেয়ে পড়ে যায় মাটিতে। আতোয়ার অকথ্য ভাষায় গালাগালি করতে শুরু করে
“খা***** বাচ্চা। মেয়ে বানাইছাস মা******
এক জামাই দিয়া মন ভরে না। পরপুরুষের লগে পালাই যায়৷
শরীর ব্যাথা যেনো মুহুর্তেই গায়েব হয়ে গেলো সালামের। তার পূর্ণতা পালিয়ে গিয়েছে পরপুরুষের সাথে? স্তব্ধ হয়ে তাকিয়ে থাকে আতোয়ারের মুখ পানে।
সেলিনা বেগম এসেছিলেন বাইরে চেঁচামেচি কেনো হচ্ছে দেখতে। আতোয়ারের মুখে এমন কথা শুনে তিনিও বাকরুদ্ধ হয়ে যায়। অনবরত গড়াতে থাকে দু চোখের অশ্রুকণা।
ধরা গলায় প্রশ্ন করে
” আমার পূর্ণ পালাইছে?
আতোয়ার বোধহয় মজা পেলো। পান খাওয়া লাল দাঁত বের করে হাসে। তারপর সেলিনা বেগমের দিকে এগোতে এগোতে জবাব দেয়
“তোর মাইয়া তোর মতো বোকা না কি রে? এক জামাই নিয়া কয়দিন থাকা লাগে? ডালভাত প্রত্যেকদিন ভাল্লাগে না কি?
আমাগো জমিদারের বড় নাতি বিয়া করছে আবার। আর তোর মাইয়াও চৌধুরীর পোলার লগে পালাইছে৷
সেলিনার মাথা ঘুরছে। তার পূর্ণতা পালাতে পারে না। এই শিক্ষা তাকে কখনোই দেয় নি সেলিনা। আর অভি? তাদের জামাইও দ্বিতীয় বিয়ে করলো।
সেলিনা ভবিষ্যত দেখতে পাচ্ছে। তাদের সুখের সংসারের সমাপ্তি এখানেই৷ এখন হয়ত সে হবে জমিদারদের ভোগের পাত্রী আর সালামের ভাগ্যে লেখা থাকবে মৃত্যু। পাপন?
ছেলেটাকে কি করে বাঁচাবে সেলিনা? কার ভরসায় রেখে যাবে?
বিকট শব্দে মনোযোগ নষ্ট হয় সেলিনার। দেখতে পায় চোখের সামনে জমিনে লুটিয়ে পড়ছে তার স্বামী। কপাল ফুটো হয়ে গড়িয়ে পড়ছে অনাগল র ক্ত। কয়েক মুহুর্তেই নিস্তেজ হয়ে পড়েছে দেহখানা। দুবার জোরে জোরে শ্বাস টানলো অতঃপর হাত পা ছেড়ে চিরনিদ্রায় ঘুমিয়ে পড়লো। দৃষ্টি এখনো সেলিনার পানে। যেনো প্রাণপ্রিয় স্ত্রীকে শেষবার দেখলো।
আতঙ্কিত সেলিনা পেছন ঘুরে তাকায়। লাঠি ভর দিয়ে জমিদার সাহেব দাঁড়িয়ে আছে৷ অধর কোণে তার কুটিল হাসি। তারই পাশে পুলিশের পোশাকধারি কয়েকজনও রয়েছে। সকলের হাতে পিস্তল।
জমিদার তার ধবধবে সাদা রংয়ের দাঁড়িতে হাত বুলিয়ে বলে
” যে বাপের মেয়ে স্বামী সংসার ছেড়ে পালিয়ে যায় সেই বাপের বেঁচে থাকার কোনো অধিকার নাই।
সেলিনা দীর্ঘ শ্বাস ফেলে। চোখে তার পানি নেই। স্বামী মা রা গিয়েছে। তার তো হাউমাউ করে কাঁদা উচিত তবে সে কাঁদছে না। বরং দু পা জমিদারের দিকে এগিয়ে চোখে চোখ রেখে প্রশ্ন করে
“আর মায়ের?
জমিদার এবারেও হাসে। মানতেই হবে প্রাপ্ত বয়সে সুদর্শন একজন পুরুষ ছিলেন। যার প্রলেপ এখনো রয়েছে। চামড়া কুঁচকে গিয়েছে দাঁত পড়ে গিয়েছে দুটো। চুল দাঁড়ি এমনকি চোখের পাপড়ি সবই সাদা রং ধারণ করেছে। তবুও দেখতে সুন্দর লাগছে।
জমিদার সাহেব একটু এগিয়ে সেলিনার কানে ফিসফিস করে বলে
” তোমার স্থান হবে আমার বুকে। এবার তোমাকে ভোগ করার স্বপ্ন পূরণ হবে আমার।
সেলিনা তাচ্ছিল্য হেসে জবাব দেয়
“আমাকে ছুঁতেও পারবেন না জমিদার। আমার পানে হাত বাড়ালে আপনার হাত কা টা পড়বে।
মুহুর্তেই জমিদার সাহেবের হাসি মুখ চুপসে যায়। দাঁতে দাঁত চেপে আতোয়ারকে আদেশ করে
” ওই এই মা*****রে ধরে নিয়ে চল পতিতালয়ে। এর তেজ আজকে ভেঙে দিবো।
আতোয়ার ধরতে আসে সেলিনাকে। সেলিনা দু পা পিছিয়ে যায়। হাত উঁচু করে বলে
“চলেন। আমি যাইতেছি। ধরতে হইবো না।
বলেই আগে আগে হাঁটতে থাকে। একবার পেছন ঘুরে দেখে স্বামীর নিথর দেহখানা৷
জমিদার চিৎকার করে বলে
” এই শু***রের বাচ্চারে মাটি চাপা দে। আর ওপরে সাইনবোর্ড টাঙিয়ে লিখে দিবে “মেয়ের নষ্টামির জন্য বাবা প্রাণ হারিয়েছে। বে*ই*শ্যা পূর্ণতার বাপ সালাম”
দীর্ঘক্ষণ পুলিশ খোঁজাখুঁজি করেও যখন ইফতিয়ার এবং পূর্ণতাকে পেলো না। তখন তারা হতাশ হয়ে চলে যায়। সেই সুযোগেই ইফতিয়ার এবং পূর্ণতা গ্রামের মেঠোপথ ধরে চলে আসে মেইন রোডে।
ঘড়ির কাটায় রাত এগারোটা বেজে আট মিনিট। রাস্তাঘাট জনমানবহীন। একটা গাড়ির দেখা মিলছে না।
পূর্ণতা এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে জমিদার বাড়ির পানে। এই রাস্তা হতে জমিদার বাড়ি, চৌধুরী বাড়ি এবং হাসপাতাল তিনটেই দেখা যাচ্ছে।
হাসপাতালের কাজ এখনো শেষ হয় নি। দশতালায় কাজ চলছে৷ সম্পূর্ণ হাসপাতাল আলোয় আলোয় পরিপূর্ণ। এই হাসপাতালটি না কি পূর্ণতার নামে।
তাচ্ছিল্য হাসে পূর্ণতা। বিরবির করে আওড়ায়
“জীবনে সুখের দেখা পেয়েছিলাম ঠিকই তবে দীর্ঘস্থায়ী হলো না।
আর গোটা বিশ্ব আমাকে চিনবে ঠিকই তবে তখন আমি থাকবো না।
পূর্ণতার মনে পড়ে অভির কথা। এই শহরের অলিতে-গলিতে জমে আছে অভি পূর্ণের স্মৃতি। এই রাস্তায়ই তো একদিন এমপি সাহেবের সাথে বৃষ্টি বিলাস করেছিলো পূর্ণতা। সাথে ছিলো মিষ্টি।
কতো ভালো ছিলো দিন গুলো।
কোথায় হারালো মিষ্টি?
কোথায় গেলো অভি?
এই নিষ্ঠুর পৃথিবীতে পূর্ণতাকে একা ফেলে ওরা স্বার্থপরের মতো পালালো?
চিন্তিত ইফতিয়ার এদিক ওদিক দৃষ্টি ফেরাচ্ছে। তার কাছে পাঁচ টাকার একটা কয়েনও নেই। শূন্য হাতে বেরিয়েছিলো পূর্ণতাকে খুঁজতে। পায়ে জুতোও নেই।
পূর্ণতার ভেজা শাড়ি শুকিয়ে গিয়েছে অনেকক্ষণ আগেই।
শুকাবে না?
সারা রাত মুশলধারায় বৃষ্টির পরে সকালে কাঠফাটা রোদ্দুরের দেখা মিলেছিলো। একই ধাঁচের রোদ্দুর ছিলো সারা দিন৷
ইফতিয়ার বেশ বুঝতে পারে পূর্ণতার খিধে পেয়েছে। সারাদিন একাধারে না খাওয়া মেয়েটা। ভীষণ মায়া হয় ইফতিয়ারের। মনে মনে ভেবে ফেলে এই গ্রাম ছেড়ে বেড়তে পারলে আগে পূর্ণতাকে কিছু খাওয়াবে। তারপর অন্য কথা।
দূর হতে একটা ট্রাক আসছে। আর জমিদার বাড়ির সামনে থেকে লোকজন তেড়ে আসছে। হয়ত এখনো খুঁজে চলেছে ওদের। ওদের দিকে টচ লাইট ধরছে। জোছনা রাতে দূর হতে দুটো মানুষ দেখা যাচ্ছে তো তারা ইফতিয়ার পূর্ণতা কি না ওনারা বুঝতে পারছে না। ইফতিয়ার শুকনো ঢোক গিলে। যে করেই হোক ট্রাক থামাতে হবে।
মাঝ রাস্তায় দাঁড়িয়ে পড়ে ইফতিয়ার। হাত নাড়িয়ে থামতে বলে ট্রাক ড্রাইভারকে।
ইফতিয়ারের ইশারা অনুযায়ী থেকে যায় ট্রাক। উঁকি দেয় মাঝ বয়সী এক পুরুষ।
ইফতিয়ারকে দেখেই হেসে বলে
” ছোট সাহেব কোথাও যাবেন?
এই গ্রামের পথ ধরে যত গুলো ট্রাক বাস যাতায়াত করে সব গুলোই ইসমাইল চৌধুরীর। সেই সুবাদে ইফতিয়ার তাদের ছোট সাহেব।
ইফতিয়ার অনুরোধের সুরে লোকটিকে বলে
“ভাই আমাদের নিয়ে যাবে তোমার সাথে? সামনে কোথাও নামিয়ে দিলেই চলবে।
” ছোট সাহেব এভাবে কেনো বলছেন? অবশ্যই নিবো।
আপনাদের দয়ায় খেয়ে পড়ে বেঁচে আছি।
ইফতিয়ার মাথা নিচু করে বলে
“আমার কাছে কিন্তু টাকা নেই।
” লাগবে না সাহেব৷ উঠে আসুন। সাথে কে ভাবি?
“হ্যাঁ আমাদের ভাবি। জমিদার বাড়ির বড় নাতবউ।
লোকটি বেশ অবাক হয়। তার চোখেমুখে প্রশ্ন। ইফতিয়ার বুঝতে পারে।
” যেতে যেতে বলবো।
“পূর্ণতা উঠতে পারবেন একা?
পূর্ণতা মাথা নারিয়ে উঠে পড়ে। ইফতিয়ারও উঠে পড়ে।
ট্রাক চলতে শুরু করে।
পূর্ণতা বিরবির করে বলে
” আবার ফিরবো এই শহরে। আমাকে ঠকানো প্রতিটা মানুষকে কঠোর হতে কঠোর শাস্তি প্রদান করবো। প্রতিজ্ঞা করলাম।
প্রিয় পূর্ণতা পর্ব ৪৬
ইফতিয়ার আসমান পানে তাকিয়ে বিরবির করে বলে
“মিষ্টি আমার সাথে কথা বলো। আমাকে সাহস দাও। পথ দেখাও।
কোথায় খুঁজে পাবো অভিকে? পূর্ণতার দায়িত্ব যে আমি আর নিতে পারছি না।
মিষ্টি বোধহয় খিলখিল করে হেসে উঠলো। উচ্চস্বরে বললো
” চৌধুরী সাহেব আপনি দায়িত্ব এড়াতে ভালোবাসেন। বড্ড স্বার্থপর।
হঠাৎ সামনে থেকে লোকজনের আওয়াজ আসে। থেমে যায় ট্রাক।