প্রিয় পূর্ণতা পর্ব ৪৮

প্রিয় পূর্ণতা পর্ব ৪৮
তানিশা সুলতানা

শশুর বাড়ি থেকে মিথ্যে অপবাদ দিয়ে তাড়িয়ে দেওয়ার পরে অনামিকা বেগমের ঠায় হয়েছিলো বাবার বাড়ি। বৃদ্ধা বাবা মায়ের কথার অবাধ্য হয়ে একদিন ঘর ছেড়েছিলো। ভাগ্য আবার তাকে দাঁড় করিয়েছিলো সেই বাবা মায়ের সম্মুখে। গোটা দুনিয়া যখন কলঙ্কিনী বলে আনামিকাকে তাচ্ছিল্য করছিলো তখন বাবা মা পরম মমতায় ঠায় দিয়েছিলো বুকে। ভালোবেসে আগলে নিয়েছিলো। নতুন করে বাঁচার স্বপ্ন দেখাচ্ছিলো।

কিন্তু বেশিদিন টিকতে পারে নি। সুখ কপালে সয় না যে। পনেরো দিন পরেই সেখানে উপস্থিত হয়েছিলো মনোয়ার। আনামিকাকে বাড়ি ফিরিয়ে আনার প্রস্তাব রাখে। ভালোবাসা অন্ধ অনামিকা মনোয়ারের সেই প্রস্তাব এড়িয়ে যেতে পারে নি। স্বামী সন্তান নিয়ে সুখে সংসার করার লোভ আষ্টেপৃষ্টে জড়িয়ে ধরেছিলো তাকে। তাই তো বেইমান স্বামীর হাত ধরে দ্বিতীয় বারের মতো বাবার ঘর ছেড়েছিলো। এবারেও আনামিকার হতভাগা বাবা মা বারবার মেয়েকে বারণ করছিলো। দ্বিতীয় বার ভুল না করার অনুরোধ জানাচ্ছিলো। এবারেও বাবা মায়ের চোখের পানির মূল্য দেয় নি আনামিকা।

আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন

মাঝরাস্তায় এসে মনোয়ার কুটিল হাসে। ছেড়ে দেয় অনামিকার হাত। জমিদার বাড়ির রাস্তার বিপরীত রাস্তায় পা বাড়ায়। ভয়ে আতঙ্কিত আনামিকা স্বামীর হাত ধরে মুঠো করে। মনোয়ার ছাড়ানোর চেষ্টা করলেও ছাড়ে না। কোথায় নিয়ে যাচ্ছে প্রশ্ন করার সাহস হয় না। স্বামী তো। নরকে নিয়ে গেলেও সেখানে যেতে হবে।
সত্যিই নরকই বটে।

জমিদারদের তৈরি পতিতালয়ে নিয়ে যায় আনামিকাকে। সব থেকে পয়সা ওয়ালা পুরুষের হাতে তুলে দেয় প্রাণপ্রিয় স্ত্রীকে। এবং লোকটার থেকে নেয় মোটা অঙ্কের টাকা।
সেই দিন থেকে দীর্ঘ চার বছর কাটিয়ে দেয় পতিতালয়ে। বিভিন্ন পুরুষের কাছে নিজেকে সপে দেওয়াই ছিলো অনামিকার কাজ। আফসোস হতো না আর। মেনে নিয়েছিলো ভাগ্যের লিখন। কিন্তু হঠাৎ ভাগ্য বদলাতে সেখানে আগমন ঘটে অভিরাজের। জন্মদাত্রী মাতার এমন বেহাল দশা,দেখে বাবার প্রতি ঘৃণা বাড়তে থাকে। প্রতিজ্ঞা করে নিজ হাতে জমিদার বাড়ির প্রতিটা মানুষকে ধ্বংস করার।

সেই দিন কৌশলে আনামিকাকে নিয়ে পালিয়ে আসে পতিতালয় থেকে। লোক সমাজে রটিয়ে দেয় মা রা গেছে অনামিকা। মনোয়ারের বিশ্বাস করতে কষ্ট হলেও ছেলের কথা মেনে নেয়।
অভি তার মা এবং বৃদ্ধা নানা নানুকে নিয়ে শহর ছাড়ে। জমিদার বাড়ি থেকে চুরি করে এনেছিলো কিছু টাকা। সেই টাকা দিয়ে নতুন শহরে নতুন ভিটে মাটির ব্যবস্থা করে। টিনের ছোট্ট ঘর তৈরি করে দেয়।
সেই থেকে সেখানেই বসবাস শুরু হয় অনামিকার। শুরু হয় নতুন জীবন।
প্রতি মাসেই অভি দুই – তিন দিন মায়ের সাথে কাটায়। সেটা জমিদার বাড়ির লোকজনদের দৃষ্টির অগোচরে।

ঢাকার শহর। নিঃসন্দেহে একটা ব্যস্ত নগরী। এখানে মানুষ সর্বক্ষণ ছুঁটে চলে নিজ ধান্দায়৷ এক দন্ডও কেউ স্থির থাকে না। ওদের কি জীবন উপভোগ করার ইচ্ছে জাগে না? অবশ্য জীবন উপভোগ করবে কি করে? সৌন্দর্যের ছিটেফোঁটাও নেই এখানে। গ্রামের মতো শান্তি নিঃশ্বাস টানার মতোও কায়দা নেই। পঁচা গন্ধ লোকজনের সোরগোল কুকুরের ঘেউঘেউ আওয়াজ যানবাহনের অযাচিত শব্দ দূর্ষণ। সব মিলিয়ে পূর্ণতা চট করে ঢাকার শহরের নাম দিয়ে ফেলে “অশান্তির নগর”

এই অশান্তির নগরে মানুষ বসবাস করে কিভাবে?
উঁচু উঁচু বিল্ডিং দেখা যাচ্ছে। এই বদ্ধ বিল্ডিং এ মানুষ থাকে কি করে? আলো বাতাসের সিঁটে ফোঁটাও তো বোধহয় ঢুকতে পারে না এখানে।
ভোরের আলো ফোঁটার সঙ্গে সঙ্গেই ব্যস্ত নগরীতে পৌঁছেছে ওরা। ইফতিয়ার সর্বপ্রথম পূর্ণতাকে নিয়ে ছোটখাটো একটা ভাতের হোটেলে ঢুকে পড়ে। কিন্তু সেখানে ভাত নেই। সকালের খাবারে তৈরি হচ্ছে রুটি ডাল সবজি এবং ডিম ভাজি।

এসব একদমই খেতে ইচ্ছে করছে না পূর্ণতার। তবুও জোর করে খেয়েছে।
খাওয়া দাওয়ার পর্ব চুকিয়ে আপাতত ওরা ব্যস্ত নগরীর যানযট দেখছে।
পাশ দিয়ে কয়েকটা লোক আসছে। কিছু পুরুষ মানুষ বরাবরই চরিত্রহীন। মেয়ে দেখলেই তাদের ছুঁয়ে দিতে ইচ্ছে করে। ইফতিয়ার ঠিক বুঝতে পারে লোকগুলো পূর্ণতার গা ছুঁয়ে যাবে। তাই অতি সর্তপনে পূর্ণতার ডান হাতটা নিজের হাতের মুঠোয় পুরে নিয়ে নিজের সামনে দাঁড় করিয়ে দেয়। পরপরই ছেড়ে দেয় হাত। কেমন অস্বস্তি হচ্ছে। মনে হচ্ছে সকলেই এইদিকে তাকিয়ে আছে। মিষ্টিও রয়েছে এখানে। কোমরে হাত দিয়ে তৃক্ষ দৃষ্টিতে তাকাচ্ছে ইফতিয়ারের পানে। যেনো মা র বে।

অভিরাজও রয়েছে এখানে। চিৎকার করে বলছে “এই চৌধুরী তোর হাত আমি কেটে নিবো”
শুকনো ঢোক গিলে মাথা নিচু করে ফেলে ইফতিয়ার।
পূর্ণতা ছোট ছোট নয়নে তাকিয়ে আছে ইফতিয়ারের পানে। হাত ধরেছিলো বেশ বুঝেছে পূর্ণতা। এবং এই মুহুর্তে অস্বস্তিতে ভুগছে এটাও ধরতে পেরেছে৷
ঘটনা এড়াতে পূর্ণতা বলে ওঠে
“চৌধুরী সাহেব। চলুন এখান থেকে৷ ভালো লাগছে না।

ইফতিয়ার মাথা নেরে রিকশা ডাকে। এখানকার রিকশা ওয়ালা গুলো বেকার যুবকদের মতো এক কোণায় বসে সিগারেট ফুঁকছে। অতিরিক্ত জনমানব হলেও রিকশায় ওঠার মতো মানুষের বড্ড অভাব।
ট্রাক ড্রাইভারের থেকে দুই হাজার টাকা রেখেছে ইফতিয়ার। ধার নিয়েছে। ওয়াদা করেছে সঠিক সময়ে ফেরত দিবে৷
রিকশা ছুটে চলছে আপন গতিতে। পূর্ণতা বুক ভরে শ্বাস টানে৷ এতোক্ষণ যেনো শ্বাস আটকে ছিলো। চোখ ঘুরিয়ে দেখতে থাকে চারিপাশ। নাহহ ঢাকার শহর এতোটাও খারাপ নয়। সৌন্দর্য এখানেও রয়েছে। দূরে একটা দশ তালা বিল্ডিং এর পানে নজর পড়ে পূর্ণতার। এতো উঁচু বিল্ডিং দেখে চট করেই গুনে ফেলে। পাঁচ তালার সাইনবোর্ডের পানে নজর আটকায়। স্পষ্ট ভাষায় গোটাগোটা অক্ষরে লেখা হয়েছে “ইফতিয়ার চৌধুরী”

পূর্ণতা ভেবে পায় না এখানে কেনো চৌধুরীর নাম লেখা হয়েছে?
জানার আগ্রহ বাড়ে। পাশ ফিরে তাকায় মানুষটার পানে। কিন্তু উদাসীন দৃষ্টি দেখে প্রশ্ন করার ইচ্ছেটা দমে যায়।
ইফতিয়ার আসমান পানে তাকায়। ভাবতে থাকে সামনে কি হবে? অভি পূর্ণতাকে নিয়ে যাবে। তারপর?
ইফতিয়ার কি করবে? কে রইলো ইফতিয়ারের জন্য? বাবা মা বোন প্রেমিকা কিংবা পছন্দের নারী কেউ থাকবে না। দিন শেষে নিঃসঙ্গতাই ইফতিয়ারের একমাত্র সঙ্গী হবে৷ একা জীবন কিভাবে কাটাবে?
হঠাৎ করে পূর্ণতার থেকে কিছু পাওয়ার লোভ জাগে। এবং তখুনি নিজ মনোভাব প্রকাশ করে ফেলে।
“পূর্ণতা তোমাকে আমি সর্বক্ষণ সাহায্য করেছি। ছায়ার মতো পাশে থেকেছি। তার বিনিময়ে যদি কখনো কিছু চাই তুমি আমার স্বার্থপর ভাববে?

আমার ঋণ মিটিয়ে দিবে না?
পূর্ণতা মনে মনে বলে ” ওহহ তাহলে গভীর মনোযোগ দিয়ে চৌধুরী সাহেব এটাই ভাবছিলো?”
মনে মনে এক দরফা হেসে নেয়। এতো এতো চিন্তার মাঝেও পূর্ণতার হৃদয়ে দোলা দিচ্ছে। মন বলছে “তুই যা চাচ্ছিস তাই রয়েছে তোর গন্তব্যে। ধাপে ধাপে এগিয়ে যাচ্ছিস তোর এমপি সাহেবের নিকট।
” আমাকে আমার স্বামীর কাছে পৌঁছে দিন। আমি আপনার ঋণ মিটিয়ে দিবো। এমন কিছু উপহার দিবো সেই উপহার আপনার ঠোঁটের কোণের হাসির কারণ হবে। বেঁচে থাকার অনুপ্রেরণা জাগাবে। প্রতি মুহুর্তে সুখের জোয়ারে ভাসাবে আপনাকে। কথা দিলাম।

ইফতিয়ার হাসে। বুকটা হালকা হলো। মনে মনে আওড়ায়
“তোমার পেটে বেড়ে ওঠা ওই ছোট্ট প্রাণটাকে আমি কেড়ে নিবো পূর্ণতা। সারাজীবন ঠকেছে। শেষ সময়টা একটু শান্তিতে বাঁচতে চাই। একটু ভালো থাকতে। আর আমাকে ভালো রাখতে পারবে তোমার অংশ।
কোলাহল মুক্ত সুন্দর রাস্তা পেরিয়ে রিকশা ঢুকে পড়ে আবারও লোক সমাগমে। চারিপাশ থেকে আবারও ভেসে আসতে থাকে কোলাহল। রিকশা আটকে পড়ে মাঝরাস্তায়। লম্বা লাইন পড়েছে। একপাশে ট্রাক প্রাইভেট কার অপরপাশে রিকশা অটো সিএনজি।

পূর্ণতা ভাবতে থাকে এভাবে দাঁড়িয়ে কেনো আছে সকলেই? গরমে অতিষ্ঠ পূর্ণতা বিরক্তির নিঃশ্বাস ফেলতেই হঠাৎ মনে হয় আশেপাশে অভিরাজ আছে। খুব নিকটে। গায়ে গন্ধ ভেসে আসছে। চঞ্চল দৃষ্টি মেলে এদিক ওদিক তাকাতে থাকে। খুঁজতে থাকে অভিকে৷ ওদের রিকশার পেছনে আরও রিকশা রয়েছে৷ পূর্ণতা চোখ বন্ধ করে বোঝার চেষ্টা করে গন্ধ কোন দিক থেকে আসছে।

ইফতিয়ার ভ্রু কুচকে তাকিয়ে আছে পূর্ণতার পানে। হঠাৎ চঞ্চল হয়ে উঠেছে কেনো? খারাপ লাগছে কি? জিজ্ঞেস করতে যাবে তখনই পূর্ণতা চট করে নেমে পড়ে রিকশা থেকে। এক গাল হেসে বলে
“চৌধুরী সাহেব এখানে আমার এমপি সাহেব আছে।
ইফতিয়ার বলে
” সত্যি আছে?
“একদম আছে। নেমে পড়ুন। গন্তব্যে পৌঁছে গিয়েছি আমরা।
ইফতিয়ার সত্যিই নেমে পড়ে। ভাড়া মিটিয়ে একপাশে গিয়ে দাঁড়ায়। পূর্ণতা কালো রংয়ের একখানা গাড়ির পানে তাকিয়ে আছে।

প্রিয় পূর্ণতা পর্ব ৪৭

একটা প্রশ্ন অনেকক্ষণ যাবত ঘুরপাক খাচ্ছে ইফতিয়ারের মনে৷
” এতো কিছুর পরেও অভিরাজের কাছে ফিরবে তুমি?
বাঁকা হাসে পূর্ণতা। মিষ্টি হাসি নয় সেটা। ভয়ংকর হাসি।
ইফতিয়ারের এলোমেলো চুল গুলো ঠিক করে দিতে দিতে জবাব দেয়
“ফিরতে তো হবেই। ফিরবো আমি।
শুধু এমপি সাহেবের কাছে নয় অতি দ্রুত জমিদার বাড়িতেও ফিরবো।

প্রিয় পূর্ণতা পর্ব ৪৯