প্রিয় পূর্ণতা পর্ব ৫২
তানিশা সুলতানা
“খালা আপনার কষ্ট হচ্ছে?
আচমকা সেলিনা বেগমকে থেমে যেতে দেখে প্রশ্ন করে ইমন। ওরাও হাঁপাচ্ছে। ইতোমধ্যেই দৌড়ে পাঁচ কিলোমিটার পথ পাড়ি দিয়েছে। হাঁপিয়ে যাওয়াটা অস্বাভাবিক কোনো ঘটনা নয়।
সেলিনা বেগম বসে পড়ে। চোখ বন্ধ করে টেনে টেনে শ্বাস নেয়। ইমন ইশান এদিক সেদিক দৃষ্টি ঘুরিয়ে নিরাপত্তা পরোখ করে বসে। সেলিনা বেগম এর মুখ-মন্ডল ছুঁয়ে দিয়ে ফের চিন্তিত ভঙ্গিমায় বলে
” কোথায় কষ্ট হচ্ছে বলুন।
ধীরে সুস্থে চোখ মেলে সেলিনা বেগম। মুগ্ধ হয় বাচ্চা দুটোর মানবিকতা দেখে। নিকৃষ্ট জমিদারের নাতিপুতিরা এতো ভালো? কি করে হলো? শুনেছে গাছ ভালো না হলে ফল ভালো হয় না। এবার বুঝি এই কথার ধরণ বদলে দেবে ওরা?
নতুন উদাহরণ রচনা করবে “গাছ ভালো না হলেও ফল ভালো হয়”
মৃদু হাসে সেলিনা। ইমনের মাথায় হাত বুলিয়ে বলে
আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন
“কষ্ট হচ্ছে না আব্বা। তবে চিন্তা হচ্ছে। আমার বাড়িতে তোমাদের মতো একটা ছোট্ট ছেলে আছে।
ইশান চট করেই বলে ওঠে
” তাহলে আগে আপনার বাড়িতে চলুন। ওকে নিয়ে এই শহর ছাড়বো আমরা।
“কোথায় যাবো?
” দাভাইয়ের কাছে। সেখানে ভাবিও রয়েছে।
আশার আলো দেখতে পায় সেলিনা। চকচক করে ওঠে চোখ দুটো। অবশেষে সুখের মুখ দেখবে বুঝি? এই পাপের রাজ্য হতে মুক্তি মিলবে?
মুহুর্তেই সেলিনা দাঁড়িয়ে পড়ে। এতোক্ষণ একবিন্দু শক্তি না পেলেও এবার কোথা থেকে যেনো শক্তি চলে এসেছে গায়ে। আবার দৌড়াতে পারবে সে।
“চলো
এবার আর দৌড়ায় না ওরা। বড়বড় পা ফেলে এগিয়ে যায় উত্তর মধুপুর গ্রামের দিকে।
প্রথমেই নজরে পড়ে মধুপুর বাজার। সেখানে সব থেকে বড় দোকানটা সেলিম এর। টিনের তৈরি এই দোকানটি সর্বপ্রথম সকলের নজর কাড়বে। সেলিনা কপাল ওবদি ঘোমটা টানে। বাজারের ওপর দিয়ে যাওয়ার সময় এক পলক তাকায় দোকানের পানে। বড়বড় দুটে তালা ঝুলছে। বুঝবে না?
দোকানে বসা মানুষটিই যে আর নেই।
দীর্ঘ শ্বাস ফেলে সেলিনা। পায়ের গতি বাড়ায়।
দূর হতেই দেখা যাচ্ছে তাদের বাড়ির গেইট। টিনের তৈরি গেইট খানা রোদের আলোতে ঝলমল করছে। এই যে কিছু দিন আগেই নতুন টিন দ্বারা এই গেইট তৈরি করা হয়েছে।
বাড়ির সামনে যেতেই বুক মোচড় দিয়ে ওঠে সেলিনার। মানুষের সোরগোল শোনা যাচ্ছে। সচরাচর এই বাড়িতে মানুষ আসে না। আজকে তো আসবেই।
কাঁপা হাতে গেইট খুলে ভেতরে ঢুকে পড়ে। জটলা পাকিয়ে মানুষ দাঁড়িয়ে আছে। কানাঘুষা করছে ফিসফিস করে। সেলিনা শুকনো ঢোক গিলে। উপচে পড়ে চোখের পানু। ইশান ইমন থমকে দাঁড়ায়। বেশ বুঝতে পারে এখানে কি ঘটেছ। বুঝবে না? নিজ বাবা দাদার কৃতকর্ম হাড়ে হাড়ে জানা তাদের।
ভিড় ঠেলে ভেতরে ঢুকে পড়ে সেলিনা। মাটিতে নজর পড়তেই মাথা চক্কর দিয়ে ওঠে। স্বামীর মৃত দেহখানা সেভাবেই পড়ে আছে যেভাবে তিনি রেখে গিয়েছিলো। পার্থক্য শুধু এতোটুকু র ক্ত গুলো শুকিয়ে গিয়েছল। আর পাশে আরও একখানা দেহ পড়ে আছে। এবার হাউমাউ করে কেঁদে ওঠে সেলিনা। ধপ করে বসে পড়ে মাটিতে।
ছেলের র ক্তা ক্ত হাতখানা বুকে নেয় সেলিনা। আহাজারি করে বলে
“আমার বাজান। আমার কলিজা। দেখ মা এসে গেছে। ও আব্বা ওঠ না। আব্বারে। ও আব্বা
সেলিনার আহাজারিতে মুখরিত হয় চারিপাশে। ইশান ইমন হু হু করে কেঁদে ওঠে। ঘৃণা হয় নিজ পরিবারের পুরুষদের ওপর। কতোটা নিকৃষ্ট মনের তারা।
সেলিনা পাপনকে ছেড়ে সেলিম এর কাছে যায়। তার মুখে হাত বুলিয়ে দেয়। কাঁদে না। শান্ত দৃষ্টিতে দেখতে থাকে জীবন সঙ্গীকে।
সেলিনার ঢেড় মনে আছে। এই তো আঠারো বছর আগেই বিয়ে হলো তাদের। অভাব অনটনের সংসার হলেও সেলিম কোনোদিনও উচ্চস্বরে কথা বলে নি সেলিনার সাথে। সর্বক্ষণ চেষ্টা করেছে ভালোবাসায় মুরিয়ে রাখতে। বড় মেয়ে পূর্ণের যখন জন্ম হলো তখন খুশিতে বাচ্চাদের মতো লাফিয়েছিলে মানুষটা। মেয়েকে দেখে সবাই যখন বলতো ” সালাম তোর ঘরে চাঁদ উঠেছে”
মানুষটা তখন এক গাল হেসে বলতো “আমার সেলিনার মতো হইছে দেখতে মাইয়্যা। দুইটা চান আমার ঘরে”
পাখির জন্মের সময় একটু নারাজ হয়েছিলো মেয়ে হয়েছে বলে এবং গায়ের রংটা তার গায়ের রংয়ের মতো চাপা হয়েছে বলে। কিন্তু পরমুহূর্তেই হেসে মেয়েকে কোলে তুলে নিয়েছিলো। তিন ছেলেমেয়ের মধ্যে পাখিকেই একটু বেশি ভালোবাসতেন তিনি৷
সেই পাখিও জমিদারদের ভোগের শিকার হয়েছিলো। আজও বুক কাঁপে সেলিনার। মেয়ের মৃত শরীরের আঘাতের দাগ গুলো তাকে রাতে ঘুমতে দেয় না।
সেলিম মেয়ের মৃ ত্যুও সহ্য করেছে।
কিন্তু সেলিনা?
প্রথমে মেয়ে এখন ছেলে এবং স্বামী।
কি দারুণ ভাগ্য সেলিনার।
এক জীবনে আর কি কোনো দুঃখ পাওয়া বাকি আছে?
মৃত স্বামীর কপালে ওষ্ঠ ছোঁয়ায় সেলিনা। দীর্ঘক্ষণ কপালে কপাল ঠেকিয়ে চোখ বন্ধ করে রাখে। অতঃপর আসমান পানে তাকিয়ে ধীর গতিতে বলে
“আমি কেমনে সহ্য করমু?
আমার যে আর কেউ থাকলো না। ওই জমিদার আমারে সর্বহারা কইরা দিলো। ইয়া আল্লাহ তুমি এর বিচার করো।
সেলিনা জমিদার বাড়ি হতে পালানোর পরমুহূর্তেই জমিদার সাহেব লোক পাঠায় পাপনকে মারতে। পাড়াপ্রতিবেশির সাহস হয় না সেলিমর লা শ ছোঁয়ার। জমিদারের কড়া হুকুম ছিলো যে।
পাপন মৃত বাবার হাত ধরে উঠোনে বসে কাঁদছিলো। তারা এসে কেনো কথা বলে নি। এক জন পাপনের মাথায় কুড়াল দিয়ে কু পি য়েছে।
গলা কা টা মুরগীর ন্যায় কিছু মুহুর্ত ছটফট করে ধীরে ধীরে নিস্তেজ হয়ে পড়ে পাপন। নিভে যায় তাদের প্রাণ প্রদীপ। বিদায় জানায় পাপে ভরা সুন্দর পৃথিবীকে।
ম রার আগে সালাম বোধহয় আহাজারি করে বলেছিলো
” তুই এতো সুন্দর কেনো হয়েছিলি পূর্ণ? তোর সৌন্দর্য আমার গোটা পরিবারকে শেষ করে দিলো। ভালোই তো ছিলাম আমরা। খেয়ে না খেয়ে সুন্দর ভাবে বেঁচে ছিলাম। কেনো তোকে মনে ধরলো জমিদার বাড়ির ছেলের? কোনো তোর বিয়ে হলো সেথায়?
কোনো মরতে হলো আমার পাখিকে। আর এখন কোনো মরতে হচ্ছে আমাকে এবং আমার ছেলেকে?
তুইই আমাদের শেষ করে দিলি পূর্ণ৷ সব দোষ তোর।
“জীবনের প্রতি মায়া আমার কোনো কালেই ছিলো না। সাত বছর বয়সে নিজ চোখে দেখেছি মায়ের অপমান। আমার বাবা মায়ের ঘরে পরপুরুষ ঢুকিয়ে দিয়েছিলো। এবং কিছু মুহুর্ত পড়ে নিজেই চিৎকার চেচামেচি করে মানুষ জড়ো করেছিলো। ভীষণ মে রে ছিলো মাকে। তারপর বাড়ি থেকে বের করে দেয়। পাড়াপ্রতিবেশিরা মাকে নষ্টা বেই****** বলে গালিগালাজ করেছিলো। আমি ভীষণ কেঁদেছিলাম। মায়ের কাছে যাওয়ার জন্য ছটফট করেছিলাম। যেতে দেওয়া হয় নি আমায়। বন্দী করে রেখেছিলে কক্ষে।
তারপর কেটে গেলো কিছু দিন। একদিন বাবা আমায় ডেকে বললো ” মাকে আনতে যাচ্ছে”
জানে না পূর্ণতা। কি যে খুশি হয়েছিলাম আমি।
অপেক্ষা করতেছিলাম কখন আসবে মা। সারাদিন সদর দরজার পাশে বসে ছিলো। গভীর রাতে বাবা বাড়ি ফিরলো খালি হাতে। মাকে আনে নি। বাড়িতে ঢুকে সোজা চলে গিয়েছিলে দাদাভাইয়ের কক্ষে। বাবার পেছনে আমিও গিয়েছিলাম। দরজার আড়াল থেকে শুনতে পাই বাবা দাদাভাইকে বলছে
“আনামিকাকে দিয়ে এসেছি পতিতালয়ে। প্রথম রাতেই খদ্দের পেয়েছে তিন চারটা। পয়সাওয়ালা লোক। মোটা অঙ্কের পয়সা দেবে তারা”
ছোট ছিলাম। খদ্দের বুঝতাম না। পতিতালয় বুঝতাম না। শুধু বুঝতাম মা আছে পতিতালয়ে।
তারপর থেকে বাবা চাচাদের ওপর নজরদারি করতে লাগলাম। তারা নিশ্চয় যাবে সেখানে। একদিন শিউলি বেগমের মাকে দেখেছিলাম বাবাকে বোঝাচ্ছে তার মেয়েকে বিয়ে করতে। আর মায়ের নামে আজেবাজে কথা বলছে। এতো রাগ হয়েছিলো আমার। হাতের সামনে পড়ে ছিলো বিশাল তলোয়ার। সেটাই ছুঁড়ে মেরেছিলাম তার পানে। ভাবি নি লাগবে। কিন্তু আমাকে অবাক করে দিয়ে একদম তার গর্দান বরাবর লেগে যায়। মুহুর্তেই আলাদা হয়ে যায় মাথা।
পালিয়ে বেঁচেছিলাম সেইদিন।
তারপর দিন গুলো কাটতে লাগলো হতাশায়। বাবা দাদা আমাকে শেখাতে লাগলে নারী পাচার। বোঝাতে লাগলো এটাই ব্যবসায়। দিন গুলো ভীষণ বাজে কেটেছে। ইফাদের সাথে সারাক্ষণই ঝগড়া হতো। কথায় কথায় মারতো আমায় ইফাদ। তারপর ইফতি বড় হতে লাগলো। সেও মারতো। দুই ভাইয়ের মার খেতে খেতে বড় হতে লাগলাম।
চার বছর পরে বাবা নতুন বিয়ে করলো। বাড়িতে আনলো বউ। ভীষণ ভালো এবং মিষ্টি দেখতে ছিলো ছোট মা। বয়স তখন আমার বারো। বুঝতে শিখে গিয়েছি অনেক কিছু। ছোট মা ভীষণ ভালোবাসতো আমায়৷
বছর ঘুরতে না ঘুরতেই জন্ম নিলো মিষ্টি।
যেইদিন মিষ্টি পৃথিবীতে আসলো সেইদিনই আমি বাবাকে অনুসরণ করে পৌঁছে ছিলাম পতিতালয়ে। পেয়েছিলাম মায়ের দেখা। এবং বুঝেছিলাম বাজে জায়গায় আটকে আছে আমার মা।
তারপর থেকে চুরি করতে শিখে গেলাম৷ জমিদারের সিন্দুক থেকে টাকা চুরি করলাম। এবং তার বিশ্বস্ত হয়ে উঠতে চেষ্টা করলাম। পা বাড়ালাম পাপের পথে।
ছোট বাচ্চা এবং যুবতী মেয়েদের ছলেবলে ধরে বিদেশিদের কাছে বিক্রি করা। যারা কথা শুনতো না তাদের মুহুর্তেই খু ন করা।
মায়ের জন্য বাড়ি কিনলাম। ছক কষে। ইফতির সাহায্যে পতিতালয় থেকে বের করলাম মাকে। ছড়িয়ে দিলাম তিনি মা রা গেছে।
প্রিয় পূর্ণতা পর্ব ৫১
নানা নানু এবং মাকে রেখে আসলাম দূর দেশে। মাঝেমধ্যেই সেখানে থাকতাম আমি।
থামে অভি। পূর্ণতা স্থির হয়ে বসে আছে। বলার মতো কথা খুঁজে পাচ্ছে না।