প্রিয় প্রণয়িনী গল্পের লিংক || জান্নাত নুসরাত

প্রিয় প্রণয়িনী পর্ব ১
জান্নাত নুসরাত

ভোর চারটা বেজে চল্লিশ মিনিট। ধরণীতে অন্ধকার থেকে ধীরে ধীরে দিনের আলো ফুটছে। পাখিরা গাছের ঢালে বসে কিচির-মিচির স্বরে গান গাইছে। দু-তলা বিশিষ্ট বাড়ির দু-তলার এক বারান্দার পর্দা সরে গেল দু-পাশে তীব্রতর গতিতে। পর্দার বাহিরে বের হয়ে আসলো দুটো মাথা। পরক্ষণেই শুভ্র বর্ণের মুখের মেয়েটা ঢুকে গেল আবার পর্দার ভিতরে,কিন্তু শ্যাম বর্ণের মেয়েটার ভাবাবেগ হলো না। লাফিয়ে ঝাপিয়ে বের হয়ে আসলো রুম থেকে। বড় সড় বারান্দায় এসে শ্বাস টেনে নিজের ভিতর নিল। হাত দু-পাশে মেলে হেসে উঠলো উচ্চ শব্দে। হাসির শব্দে রুমে থাকা শুভ্র বর্ণের মেয়েটা ভয় পেয়ে গেল। ভয়ার্ত চোখে রুমের বাহিরে তাকাতেই বারান্দার অবস্থিত মেয়েটা হুট করে রুমে ঢুকে ভয় দেখিয়ে দিল। শুভ্র বর্ণের মেয়েটা চোখ মুখ গোল গোল করে তাকিয়ে রইলো। ভয় পাওয়ার জন্য পিছনের দিকে সরে গেল দু-পা। ঠোঁট কামড়ে গোল চোখে তাকাতেই শ্যাম বর্ণের মেয়েটা খিলখিল করে হেসে উঠলো ভয় দেখাতে পেরে।

শুভ্র বর্ণের মেয়েটা হাত বাড়িয়ে থাপ্পড় মারলো শ্যাম বর্ণের মেয়েটাকে। মেয়েটা পিঠে থাপ্পড় খেয়ে ঠোঁট কুঁচকে শয়তানি হাসি দিল। চোখ ছোটো ছোটো করে বলল,
“যা নামাজ পড়তে যা ইসরাত!
শ্যাম বর্ণের মেয়েটা ঠোঁটে মৃদু হাসি ঝুলিয়ে এবড়ো তেবড়ো পা ফেলে আবার বারান্দায় আসলো। বারান্দার রেলিঙে হাতের তালু রাখলো। সকালের মিষ্টি বাতাস এসে ছুঁয়ে দিয়ে গেল মেয়েটার শরীর। শরীরে বেয়ে নেমে গেল শিরশিরানি! এক নাম না জানা অনুভূতি। সকালের এই নিস্তব্ধ পরিবেশ ভেঙে গেল অট্টহাসির শব্দে। মেয়েটা চোখ বন্ধ করে নিল।

আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন

সৈয়দ বাড়ির দ্বিতীয় ছেলে সৈয়দ নাছির উদ্দিনের দ্বিতীয় কন্যা সৈয়দা নুসরাত নাছির মানে আমি! একটু আগে যাকে ভয় দেখালাম সে আমার বড় বোন সৈয়দা ইসরাত নাছির! আমাদের যৌথ পরিবার! এখন সচারাচর যৌথ পরিবার দেখা যায় না! বলা গেলে, দেখাই যায় না, তবুও এই দেখা যায় না এর মধ্যে আমাদের পরিবার একটি। কবেই আমাদের পরিবারে ফাটল ধরতো যদি না চাচা, আব্বু, আব্বাদের মধ্যে অটুট বন্ধন থাকতো। ও হ্যাঁ আমাদের বাপ চাচা চার ভাই এবং দু-বোন! সবার নিজ নিজ সন্তান রয়েছে। আমার বড় চাচা প্রায় ত্রিশ বছর ধরে দূর প্রবাসে থাকেন উনার ছেলে ও স্ত্রী কে নিয়ে। বড় চাচা সৈয়দ হেলাল উনার তিন ছেলে। বড় ছেলে সৈয়দ জায়িন, মেজ ছেলে সৈয়দ জায়ান আর ছোটো ছেলে সৈয়দ আরশ।

গত বারো বছর ধরে উনারা দেশে আসেননি। বিভিন্ন সমস্যার জন্য! কবে আসবেন তা ও জানি না! তারপর ও এখনো পরিবার সামলাচ্ছে বড় চাচা! বড় চাচাকে আমার বিশেষ পছন্দ না! দ্বিতীয় আমার আব্বা, আর সেজ চাচা সৈয়দ শোহেব! চাচ্চুর এক ছেলে এক মেয়ে। ছেলের নাম ইরহাম আর মেয়ের নাম অনিকা। ইরহাম হলো আমার বন্ধু আর অনিকা টা ন্যাকা হওয়ার ধরুন একে আমি দু-চোখে সহ্য করতে পারি না।
ছোটো চাচ্চু সৈয়দ সোহেদ। উনার দুই সন্তান। বড় মেয়ে আরিশা আর ছোটো ছেলে আহান। দুটো দেখতে পুরো রসগোল্লার মতো গুলুমুলু সাথে সাদা।

ওহ হ্যাঁ আরেকটা কথা বলতে ভুলে গেলাম, সৈয়দ বাড়িতে আমি একমাত্র শ্যামলা বর্ণের আর সবাই সুন্দর। এক একজন এক একজনের তুলনায় দেখতে সুন্দর ও শুভ্র। হাহ!
বড় ফুফু লুৎফা বেগম। তিন সন্তানের জননী। বড় মেয়ে সাজিদা! বিবাহ হয়েছে সাত বছর আগে। এক ছেলে সন্তান ও আছে। মেজ ছেলে আশিক বড় চাচার ছোটো ছেলে আরশের বয়সী! ছোটো মেয়ে মমো,আমার আর ইরহামের বয়সী!

আমাদের ফ্যামেলিতে এতো এতো মানুষ অনেক সময় আমি নিজেই ভুলে যাই ওদের নাম। যাই হোক! ওহ নো আরেকটা কথা বলতে ভুলে গেলাম পুরো কাজিন গ্রুপে আমাকে বেয়াদব নামে অ্যাখ্যা দেওয়া হয়। রিলেটিভরা ও আমাকে বেয়াদব, অভদ্র, বেটাছেলে নামে ডাকে। কেউ কিছু বললেই বলে, ওহ নাছিরের বড় মেয়েটা যেমন ভদ্র ছোটো মেয়েটা তার থেকে দ্বিগুণ অভদ্র, বেয়াদব! এই বেয়াদব নামটা আমার জটিল পছন্দের! সবাই যখন বেয়াদব বলে আমায় ডাকে তখন নিজের কাছেই ঝাক্কাস লাগে।
পিছন থেকে এসে ইসরাত আমাকে চেপে ধরতেই চোখ মেলে তাকালাম।
ইসরাত ভ্রু নাচিয়ে জিজ্ঞেস করলো,
“কি? কি চিন্তা করছিস?

নুসরাত চুপ করে দাঁড়িয়ে রইলো। সূর্য ধীরে ধীরে নিজের তেজ ধরণীতে ফেলে ধরণীকে অভিভূত করছে। বাগানে ফুলের গাছগুলো কিছুটা মিইয়ে পড়েছে এই কয়েক দিনের রোদের কারণে। সকালের সেই মিষ্টি বাতাস এতক্ষণে ঢাকা পড়েছে সূর্যের তেজে।
ইসরাত এসে রেলিঙে নুসরাতের পাশ ঘেঁষে দাঁড়ালো। ঠোঁট কামড়ে চেয়ে রইলো সামনের দিকে। ধীরে ধীরে সৈয়দ বাড়ির পিচঢালা উঠোনে এসে জড়ো হলেন নাছির সাহেব, শোহেব সাহেব, সোহেদ ও ঘুমন্ত ইরহাম।
শোহেবের রুঢ় গলার আওয়াজ নিচ থেকে বারান্দা পর্যন্ত স্পষ্ট শোনা যাচ্ছে। গলা উঁচিয়ে শোহেব ইরহামকে ধমকা ধমকি করছেন ঘুমানোর জন্য। ইরহাম তবুও নিভু নিভু চোখে চেয়ে আবার চোখ বুজে ফেলছে।
নুসরাত মনে মনে গুণলো এক, দুই, — তিন গুণার আগেই গালে দাবাং থাপ্পড় পড়ল ইরহামের। এক থাপ্পড় খেয়ে ইরহামের ঘুম হাওয়া হয়ে গেল। গালে হাত দিয়ে ঠোঁট কামড়ে চেয়ে রইলো অবাক চোখে শোহেবের দিকে। এটা প্রতিদিনের কাজ! ইরহাম থাপ্পড় খেয়ে শোহেবের দিকে হা করে তাকিয়ে থাকবে। তারপর কাঁদো কাঁদো গলায় জিজ্ঞেস করবে আব্বু মারলে কেন?

আজ ও সেম প্রশ্ন জিজ্ঞেস করলো শোহেবকে,
” আব্বু মারলে কেন?
শোহেব তেড়ে মেড়ে এসে বললেন,
” আরেকটা খাবি!
ইরহাম দু-পাশে মাথা নাড়িয়ে না করলো। শোহেব বললেন,”ঘুম গিয়েছে নাকি আরেকটা থাপ্পড় মারবো! এতো বড় দামড়া ছেলে উনাকে ঘুম থেকে তুলে নামাজ পড়াতে হয়! হাঁটতে বের করতে হয়! যত্তসব খবিসি গিরি!
ইরহামের মুখ চুপসে গেল। এটা তার বাপ না মীর জাফর! তাকে থাপ্পড় মারতে একটু হাত বাদে না। তার ফুলের মতো টসটসে গাল এই লোক থাপড়ে থাপড়ে রক্তাক্ত করে ফেলছে। ঠোঁট কামড়ে সামনের দিকে তাকিয়ে রইলো! ঘুম পূর্ণ না হওয়ার জন্য চোখের কোণ বেয়ে পানি এক ফোটা গড়ালো। ইরহাম হাতের তালু দিয়ে চোখের কোণ ঘষে মুছে নিল।
শোহেব বকাবকি করে ভাইয়েদের সাথে পা মিলিয়ে চলে গেলেন গেটের দিকে। ইরহাম নড়বড়ে পা বাড়ালো বাবার পিছনে। হাঁটতে হাঁটতে চোখ বার বার ঘষে নিলো যাতে ঘুম চোখ থেকে চলে যায়।
নুসরাত আর ইসরাত দু-জন দুজনের দিকে তাকিয়ে দীর্ঘ শ্বাস ফেলল। রোজ এই নাটক দেখতে দেখতে তারা দু-জন বিরক্ত! তবুও ইরহামের বিরক্তি আসে না।

ঘড়িতে সকাল আটটা বাজতেই ডায়নিং টেবিলের সামনের দেয়ালে মোটা ঘড়িটা উচ্চ শব্দে বেজে উঠলো। বাড়ির কর্তীরা পা চালিয়ে খাবার নিয়ে এসে রাখতে লাগলেন টেবিলের উপর। সকল রুমের দরজা খোলার তীব্র শব্দ শোনা গেল। একে একে দপ দপ করে সিঁড়ি বেয়ে নিচের নামার শব্দ হলো।
আটটা পনেরো মিনিটে এসে সবাই নিজ নিজ জায়গা দখল করে নিল। নিজ নিজ প্লেট টেনে নিল নিজেদের দিকে। মেহেরুন নেছা! সৈয়দ বাড়ির কর্তী! তিনি এসে বসলেন মাঝ চেয়ারে। তার বরাবর যে সোজা চেয়ার সেটা খালি রইলো কেউ বসলো না সেখানে। মেহেরুন নেছা দীর্ঘ শ্বাস ফেললেন। ছেলেটাকে দেখেননি সামনা সামনি আজ বারো বছর হয়ে গেল। আসবো, আসবো বলে বারো বছর কাটিয়ে দিল তারপর ও আসা হলো না। চোখের কোণে জমা হলো হালকা পানি! তর্জনী আঙুল দিয়ে মুছে নিলেন সকলের অগোচরে! নুসরাত চোখ উলটে নিল মেহেরুন নেছার কান্ডে! এই বুড়ি অতিরিক্ত ওভার একটিং করে। জন্মের পর থেকে দেখে যাচ্ছে খেতে বসে এভাবে চোখ মুছছেন বুড়িটা।
নুসরাত চোখ মুখ উল্টিয়ে ভেঙ্গিয়ে বিড়বিড় করলো,

“যত্তসব আদিখ্যেতা! ভ্যা ভু করে কান্না করছেন ছেলের জন্য! আর ছেলের নাই খোঁজ দেশের আসার। হাহ…
নাজমিন বেগম পিছন থেকে নুসরাতের মাথায় গাট্টা মারলেন। আকস্মিক মাথায় ব্যথা অনুভব হতেই নুসরাত চোখ মুখ কুঁচকে পিছনে তাকালো। পিছনে তাকাতেই নাজমিন বেগম নিজের হাতের মধ্যে থাকা তেল নুসরাতের মুখে ঘষে দিলেন।
ইসরাতের দিকে তাকাতেই দেখলো ইসরাতের মুখে তেলে জবজবে হয়ে আছে। ঠোঁট চেপে হাসার আগেই নাজমিন বেগম মুখ চেপে ধরে আবার আরো কিছু তেল মুখে ঘষে দিলেন। নুসরাতের হাসি, মুখ থেকে হাওয়ার বেগে উড়ে গেল। ইসরাত হিহি করে হেসে উঠলো।
নুসরাত চোখ উলটে তাকালো। নাজমিন বেগম থমথমে গলায় বললেন,” দুটো মুখে কিছু না দিয়ে কি বানাচ্ছিস মুখের অবস্থা! তোদের তুলনায় ওই রহিমার ফেইস ভালো। ও নিজের মুখের যত্ন নেয় তোদের তুলনায় বেশি। তোদের বাপ প্রতি দিন এসব নিয়ে ক্যাট ক্যাট করে তোদের শোনতে খুব ভালো লাগে তাই না।
ইসরাত বিরক্ত হয়ে বলল,

“উফ আম্মু ভালো লাগছে না! কথা বলো না তো!
নাজমিন বেগম কিছু বলার আগেই নাছির সাহেব এসে ডায়নিং রুমে পদার্পণ করলেন। ডায়নিং টেবিলের ফিসফিস কথাবার্তা শেষ হয়ে গেল। নিস্তব্ধ হয়ে গেল চারপাশ! সবাই নিজ নিজ প্লেটের দিকে চোখ নামিয়ে নিল।
আদেশের স্বরে নাছির সাহেব বললেন,
” খাবার দাও নাজমিন!

নাজমিন বেগম স্বামীর প্লেট রুটি, আলু ভাজি, আর ডিম ভাজি দিলেন। ধীরে ধীরে সবাই নিজ নিজ প্লেটে খাবার তুলে নিল। চুপচাপ খেতে ব্যস্ত হলো সবাই।
সকল নিস্তব্ধতা ছাপিয়ে মেহেরুন নেছার সেমসাং অল্ড মডেলের মোবাইলে ভিডিও কল আসলো। নাছির সাহেব মায়ের দিকে একবার চোখ তুলে তাকালেন। গম্ভীর গলায় বললেন,”আম্মা আপনাকে না বললাম এই রিংটোন চেঞ্জ করার জন্য তাহলে এখনো করেননি কেন?

প্রিয় প্রণয়িনী পর্ব ২

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here