প্রিয় প্রণয়িনী পর্ব ২২
জান্নাত নুসরাত
সময় প্রবাহমান। সময় কারোর জন্য অপেক্ষা করে না। দেখতে দেখতে এইভাবে এক সপ্তাহ কেটে গেল। ঘটনাটার কথা প্রায় সবাই ভুলে যাওয়ার চেষ্টা করছে। কিন্তু যার সাথে এই ঘটনা হলো সে কি ভুলতে পারছে? তা তো সেই একমাত্র জানে! আজকাল জায়িনকে খুব কম বাড়িতে দেখা যায়। আর দেখা গেলে কোনো না কোনো কাজ করতে থাকে। এমনি বসে থাকার থেকে নিজেকে কাজে বিজি রাখার প্রচেষ্টা চালায়। যাতে ডেলার কথা মনে না পড়ে।
বিছানার হেডবোর্ডে বালিশ দিয়ে পা লম্বা করে বসে কোলে উপর ল্যাপটপ রেখে এক ধ্যানে কোন কাজ করে চলেছে জায়িন। কিং সাইজের বিছানার এক কোনায় অবেহেলায় পড়ে আছে মুঠোফোন। জায়িনের কাজে ব্যাঘাত ঘটিয়ে মুঠোফোন কর্কশ আওয়াজে বেজে উঠলো। মুঠোফোনের কর্কশ আওয়াজে কি-বোর্ডে চলা হাতটা থেমে গেল জায়িনের। শুভ্র কপালে ভাঁজ ফেলে মোবাইল ফোনের দিকে বিরক্তির দৃষ্টিতে তাকিয়ে তাকলো। রিং হতে হতে ফোনটা কেটে গেল। জায়িন মোবাইল হতে দৃষ্টি ফিরিয়ে নিয়ে আবার ল্যাপটপে চোখ রাখলো। যার প্রয়োজন সে আবার কল দেবে! কিছুক্ষণ পর আবার ওই নম্বার থেকে কল আসলো। সেইভ নম্বরে ভেসে উঠল আরশ।
কল রিসিভ করে গম্ভীর কন্ঠে জিজ্ঞেস করল,
আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন
“কি হয়েছে?
ফোনের অপাশ থেকে কি বলল শোনা গেল না! আসছি বলে ফোন রেখে দিল জায়িন। ল্যাপটপ বিছানার পাশের বক্সে রেখে দিয়ে উঠে দাঁড়ালো। ব্ল্যাক শার্ট আর ডার্ক গ্রে কালার প্যান্ট নিয়ে ওয়াশরুমে চলে গেল। শাওয়ার শেষে টাওয়াল দিয়ে ভিজে চুল মুছতে মুছতে রুমে প্রবেশ করল। আজ আর টাওয়াল বারান্দায় নেড়ে দিল না। ঢিল মেরে বিছানার উপর ফেলে দিল টাওয়াল। যার জন্য নিজেকে গুছিয়ে নিয়েছিল সে তো আর এই জীবনে নেই। তাহলে এতো গুছিয়ে চলে কি লাভ? ভিজে চুল হাত দিয়ে ঠিক করে নিল। সিল্কি চুলগুলো এসে কপালের উপর পরে থাকল অবহেলায়। মানিব্যাগ পকেটে ঢুকিয়ে কাবার্ডের ভিতর থেকে গাড়ির চাবি বের করে আঙুল এর ঢগায় নিয়ে রুম লক করে বের হয়ে গেল জায়িন।
মিটিং রুমে সবাই সারিবদ্ধ ভাবে বসে আছে। সবার চোখ সামনের সাদা পর্দায়। সাদা পর্দা সামনে দাঁড়িয়ে রুবা কিছু পোডাক্ট দেখাচ্ছে আর তার বর্ণনা করছে।
” বর্তমানে বেশির ভাগ টিনেজ মেয়েরা মেকআপ বেশি ইউজ করে আর তারা মেকআপ ইউজ করতে ভালোবাসে। আর এই জেনারেশনের মেয়েরা বেশির ভাগ কেপপ ফ্যান। তাই আমার পরিকল্পনা এরকম যে আমরা যে নতুন মেকআপের পণ্যগুলো বাজারে সেল করব ওই সকল পণ্যের লগো কোনো কেপপ গ্রুপের লগো বা তাদের ছবি ব্যবহার করতে পারি। তাহলে তারা পণ্যগুলোর প্রতি আকৃষ্ট হবে বেশি। এবং আমাদের পণ্য বাজারে ভালো সেল হবে।
রুবা নিজের বক্তব্য শেষ করলো। সবাই হাত তালি দিল।রুবা ধন্যবাদ জানিয়ে এক কোণোয় দাঁড়িয়ে রইলো। আরশ শান্ত দৃষ্টিতে রুবার দিকে তাকিয়ে নিজের জায়গা থেকে উঠে দাঁড়ালে।
“আপনি বসতে পারেন।
রুবা নিজের সিটে গিয়ে বসে পড়ল। আরশ কোট খুলে নিজের চেয়ারের হ্যান্ডেলে রেখে দিয়ে সাদা স্ক্রিনে সামনে দাঁড়াল।
” তো মিস রুবা! আপনি বলছেন বর্তমান জেনারেশনের মেয়েরা মেকআপ করতে পছন্দ করে। কিন্তু আমার জানা মতে বা আপনি বলতে পারেন আমি এখনো পর্যন্ত যতো মেয়ে দেখেছি তার মধ্যে নাইন্টি পার্সেন্ট মেয়েরা মেকআপ করে না।
” স্যার আপনি হয়তো খেয়াল করেননি এখনকার নাইন্টি এইট পার্সেন্ট মেয়েরা মেকআপ ছাড়া বাহিরে যায় না। যারা বা যেসব মেয়েরা সচরাচর বাহিরে যায় হালকা ব্লাস অথবা লিপগ্লজ ইউজ করে। এন্ড ভার্সিটিতে যেতে হলেও তো হালকা মেকআপ করে থাকে।
আরশের চোখে নুসরাত আর ইসরাতের মুখ ভেসে উঠলো। তাহলে এরা কি ভিন্ন গ্রহের প্রানী। কোথা ও যেতে ইসরাত কিছুটা পরিপাটি হয়ে যায়, কিন্তু নুসরাত এতো চুলগুলো ঠিকভাবে বাঁধে কি না তাতে সন্দেহ আছে। মাথা ঝাঁকিয়ে দিয়ে নুসরাতের কথা মাথা থেকে ঝেড়ে ফেলে দিল আরশ।
” ঠিক আছে আপনার কথা সঠিক ধরে নিলাম,কিন্তু কেপপকে অনেকে পছন্দ করে আবার আমি দেখেছি? অনেক মেয়ে অপছন্দ করে। তারা তো পোডাক্টের উপর কেপপের ছবি দেখেই জিনিসটা ক্রয় করবে না। বাজারে তো পণ্যটা লস প্রজেক্ট হয়ে যাবে। বেড রিভিউ আসবে!
” স্যার আমি মনে করি বাংলাদেশে সেভেন্টি পার্সেন্ট মেয়ে কেপপ পছন্দ করে। তাই লস হওয়ার কোনো চান্স নেই। আর ত্রিশ পার্সেন্ট বেড রিভিউ আসলে সত্তর পার্সেন্ট গুড রিভিউ আসবে।
” কিন্তু বাকি ত্রিশ পার্সেন্ট মানুষ যদি না ক্রয় করে তাহলে কঈভাবে হবে? আমি হান্ড্রেড পার্সেন্ট গুড রিভিউ এবং হার্ন্ডেড পার্সেন্ট সেল চাই আমার পণ্যের।
” আই হ্যাভ আ গুড আইডিয়া স্যার!
“প্লিজ!
” স্যার বাকি থার্টি পার্সেন্ট গুড রিভিউ পেতে চাইলে আমরা একটা কাজ করতে পারি।
“কি?
” আমরা ফিফটি পার্সেন্ট পোডাক্টে কেপপ লগো ইউজ করব আর ফিফটি পার্সেন্টে আমাদের কোম্পানির লগো ইউজ করতে পারি।
সবাই সমস্বরে বলল,
” দিস ইজ আ গ্রেট আইডিয়া!
আরশ নিজের জায়গা ফিরে আসলো প্রজেক্টের অফ করে দিল।
“ওয়েল! আপনাদের কথা মেনে নিলাম। সামনে দেখি কি হয়? টুডেইজ মিটিং এন্ড’স হেয়ার!
জায়িন গাড়ি পাকিং করে দ্বিতীয় ফ্লোরে আসলো। মেইন ডোর দিয়ে প্রবেশ করার পর সবাই দাঁড়িয়ে গেল। সবাই সালাম দিতে লাগলে জায়িন সালামের উত্তর দিয়ে আরশের কেবিনের দিকে চলে গেল।
” ভিতরে আসব!
আরশ সম্মতি দিল। কেবিনে প্রবেশের পরই ডেলার সাথে জায়িনের চোখা-চোখি হলো। জায়িনের গলার আওয়াজ শুনেই ডেলা দরজার দিকে তাকিয়ে ছিল। জায়িন আলগোছে নিজের চোখ সরিয়ে নিয়ে আসলো। আরশ ডেলার পাশের সিটে বসার জন্য ইশারা করলো। জায়িন প্রতিক্রিয়া বিহীন আরশের দেখানো জায়গা বসে গেল। ডেলা নামক কোনো মানুষের উপস্থিত নেই, এমনভাব করল জায়িন। পুরো ডেলাকে ইগনোর করে আরশকে জিজ্ঞেস করলো,” কেন ডেকে পাঠিয়েছিস?
আরশ ডেলার দিকে ইশারা করে বলল,
” ভাবি তোমাকে কল করার জন্য বলেছে? ভাবির তোমার সাথে কি যেন কথা আছে?
জায়িন নিচের দিকে তাকিয়ে তাচ্ছিল্যের হাসি হাসল। ভাবি হয়ে গেল দু-দিনে। আরশের দিকে শান্ত চোখ তুলে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করলো,” কে ভাবি? আর এই ভাবির আমার সাথে কি কথা থাকতে পারে?
আরশ ইশারা করলো ডেলার দিকে। আগে যতই নাম ধরে ডাকুক না কেন কারণ ওটা প্রফেশনের জন্য ছিল। কিন্তু এখন উনি আশিকের স্ত্রী নাম ধরে কীভাবে ডাকবে? আরশ নিজের চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়াল।
“দুজন কথা বলুন! আমি একটু বাহিরে থেকে আসি।
আরশ প্রাইভেসি দিয়ে কেবিন থেকে বের হয়ে গেল। এসির টেম্পারেচার ২০ এ থাকা সত্ত্বেও কথা বলতে গিয়ে ডেলার কপাল ঘেমে গেল। কীভাবে কথা শুরু করবে বুঝতে পারল না? আগে তারা ফ্রেন্ড ছিল আর এখন সে জায়িনের ছোট ভাইয়ের বউ, আবার তাদের সম্পর্কে কিছুটা ফাটল ধরেছে, তার আর জায়িনের সম্পর্ক এখন আগের মতো নেই। ডেলা নিজেকে ধাতস্থ করে কিছু বলতে যাবে তার পূর্বেই জায়িন ডেলাকে থামিয়ে দিল।
” আপনি আমার ছোট ভাইয়ের বউ আর আপনার সাথে আমার বিশেষ কোন প্রয়োজনীয় কথা থাকতে পারে আমার জানামতে এমন কিছু নেই। তাই আজ উঠি! অন্যদিন আপনার সাথে কথা বলব। আমার কাজ আছে আজ।
জায়িন চেয়ার থেকে উঠে দাঁড়ালো। কেবিন থেকে বের হওয়ার সময় মনে হলো পা আর চলছে না। বেইমান পা-টাকে ইচ্ছা করল কেটে ফেলে দিতে। অসাড় শরীর কোনো রকম টেনে নিয়ে কেবিন থেকে বের হলো জায়িন। পিছন থেকে ডেলা ডাকল প্রতিউত্তর করার কোনো প্রয়োজন বোধ মনে করলো না। অন্যের প্রিয় মানুষের প্রতি মায়া বাড়িয়ে কি লাভ? মরিচিকার পেছনে ছোটে মরিচিকা ছাড়া কিছু পাওয়া যায় না। নিজেকে বোঝ দিয়ে জায়িন অফিস থেকে বের হয়ে গেল। যাওয়ার আগে আরশকে ও শাসিয়ে গেল, এসব ফালতু জিনিসের জন্য থাকে যেন আর ডেকে না পাঠায়।
পাকিং থেকে গাড়ি বের করে জায়িন গাড়ি স্টার্ট করলো। গাড়ি হাই স্পিডে চালিয়ে নির্জন এক স্থানে গিয়ে গাড়ি স্টপ করলো। গাড়ি থেকে বের হয়ে প্রান ভরে নিঃশ্বাস নিল জায়িন। এতোক্ষণ মনে হচ্ছিল,শ্বাস আটকে মরে যাবে। এখন কিছুটা শান্তি লাগছে এই নির্জন পরিবেশে।
“আই লাভ ইউ নুসরাত।
নুসরাত ছিটকে দূরে সরে গেল। ছেলেটার দিকে হা করে তাকিয়ে রইলো। কথা নেই, বার্তা নেই, এভাবে মানুষ মানুষকে প্রপোজ করে। নুসরাতদের আশে পাশে ক্যাম্পাসে যারা ঘুরছিল এখন তারা গোল হয়ে জটলা বেঁধে দেখছে এখানে কি হচ্ছে? ছাত্র ছাত্রীকে উৎসুক করে তোলেছে আরেকটা কারণে। নুসরাতকে যে প্রপোজ করেছে সে চতুর্থ বর্ষের বিজ্ঞান বিভাগের টপার। সবাই সমস্বরে বলে উঠলো,” এক্সেপ্ট, এক্সেপ্ট এক্সেপ্ট!
নুসরাত হতবিহ্বল হয়ে উৎসুক জনতার দিকে তাকালো একবার। আবার ছেলেটার দিকে তাকালো। এই ছেলেটাকে নুসরাত ক্যাম্পাসে প্রথমবার দেখছে। ছেলেটা হাঁটু ভেঙে বসে ফুল দিয়ে প্রপোজ করায় ফুল ধরা হাত থরথর করে কাঁপছে। নুসরাত ছেলেটার হাত থেকে ফুল হাতে নিল।
” দাঁড়াও!
ছেলেটা চোখ নিচের দিকে রেখে উঠে দাঁড়ালো। নুসরাত ছেলেটার দিকে তাকিয়ে ভ্রু কুঁচকালো।
” এভাবে কাঁপছো কেন?
“আমার তোমাকে ভয় লাগে।
নুসরাত বিরক্তির দৃষ্টিতে ছেলেটার দিকে তাকিয়ে তাকলো।
” প্রপোজ করতে ভয় লাগেনি আর আমার সামনে দাঁড়াতে ভয় লাগছে। ওয়াট আ জোক। আমি বাঘ না ভাল্লুক যে তোমার আমাকে ভয় লাগবে।
ছেলেটা মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে রইলো। নুসরাত উৎসুক জনতার দিকে তাকিয়ে ছেলেটাকে কিছু বলতে গিয়ে থেমে গেল।
প্রিয় প্রণয়িনী পর্ব ২১
” আগামীকাল শহীদ মিনারের সামনে আমার সাথে দেখা কর। তোমার উত্তর পেয়ে যাবে! এখন যাও।
ছেলেটা বিনা বাক্য ব্যয়ে মাথা নিচু করে চলে গেল। ধীরে ধীরে সবাই জটলা খুলে নিজ নিজ কাজে চলে গেল। নুসরাত, সৌরভি আর ইরহাম ভার্সিটির গেইটের দিকে গেল বাসায় যাওয়ার জন্য।