প্রিয় প্রণয়িনী পর্ব ২৯
জান্নাত নুসরাত
জায়িন কাঁচা ঘুমে ছিল। মাঝরাতে ফোনের শব্দে ঘুম ভাঙল জায়িনের। আননোন নাম্বার থেকে ফোন আসতে দেখে বিরক্ত হলো। হাত দিয়ে চোখ চেপে ধরে জায়িন মোবাইল ভাইব্রেট সেট করলো। মোবাইল ঢিল মেরে বিছানার এক পাশে রেখে আবার শুয়ে পড়ল। কিছুক্ষণ পর পর কল আসে আর ভাইব্রেশনের শব্দে মোবাইল কেঁপে উঠে। জায়িন বিরক্ত হয়ে উঠে বসলো। চোখ মুছে মোবাইলের দিকে তাকালো। মুখ দিয়ে উচ্চারণ করলো, ” shalshiah.(কুকুরের বাচ্চা)
ফোন ধরে জায়িন অপরপাশের মানুষকে বলল,
“হ্যালো কে? এই মাঝরাতে ফোন দিয়ে ডিস্টার্ব করছেন কেন?
“Hello, what are you saying? I can’t understand MR jayin.
“Oh sorry!
” how can i help you ? And who are you?
“I am jack. MANAGER OF APPLE SOFTWARW DEBOLAPARE COMPANY.
” I am sorry for not being able to recognize you. How can i help you?
“Now, let’s get to the point.The position at our company is still vacant. You can rejoin if you wish.
“I will let you know within a day or two.
“okay MR JAYIN . Then, you will let us know after two days. We will wait for your response. Take care.
“Take care.”
জায়িন আবার শুয়ে পড়ল। চোখ বন্ধ করতেই চোখে ভেসে উঠলো এক শুভ্র রমণীর মুখ। চোখকে বিশ্বাসঘাতক বলে গালি দিল জায়িন।
আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন
দুইদিন পর ডেলার সাথে একটা রেস্টুরেন্টে বেড়াতে আসলো আশিক। আশিক চুপচাপ বসে ডেলার দিকে তাকিয়ে তাকলো। মেয়েটাকে সে যত দেখে তত মুগ্ধ হয়।ডেলা দু-কাপ কফি অর্ডার দিয়ে আশিকের দিকে তাকালো। আশিককে তার দিকে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে তাকতে দেখে জিজ্ঞেস করলো, “কি?
” কি?
“আমার দিকে এভাবে টাকিয়ে আছো কেন?
” আমার ইচ্ছে হয়েছে তাই।
“চোখ সরাও আশিক। আমার কী রকম লাগছে?
আশিক টেবিলের কিছুটা কাছে এসে বলল,
” কী রকম লাগছে তোমার?
“এটাও বলটে হবে?
” হ্যাঁ বলতে হবে। সব জানতে চাই আমি তোমার বিষয়ে।
“ডাবল মিনিং কঠা বলবে না আশিক।
আশিক নিচের দিকে তাকিয়ে হালকা হাসল। চোখ তুলে ডেলার দিকে তাকালো। ডেলা সামনের চেয়ার থেকে আশিকের চোখ চেপে ধরলো। আশিক হু হা করে হেসে দিল। ডেলা ও হালকা হাসল।
” আমাডের বাসায় আসবে কবে? টোমার মা আই মিন আন্টি কবে আসবে?
“দু-এক দিনের ভিতর।
” আ’ম সো এক্সাইটেড! আমি অনেক শপিং করবো, ফটোশেষণ করবো, কাপল পিক তুলবো, ডান্স করবো, আরো কট কি? আমাডের বিয়ের অনুষ্ঠান কবে হবে?
“আমি ও!
ডেলা কথা বলে গেল আর আশিক হা করে তাকিয়ে থেকে গিলল ডেলার কথা। চোখের পলক ফেলল না। ডেলা খিলখিল করে হাসলে আশিক হালকা হাসে। কী রকম মাতালের মতো তাকিয়ে রইলো আশিক নিজের বিবাহিত একান্ত, ব্যক্তিগত সম্পত্তির দিকে। বিড়বিড় করলো,” তুমি শুধু আমার ডেলা, শুধুমাত্র আমার, আর কেউর না। আমার ডেলা, আমার।
জায়িন আজ বাসায়, কাজে যায়নি। সকাল থেকে বাসায় বসে গতকাল রাতের কথা চিন্তা করছিল। সে একটা সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছে? এখন কে কী রকম রিয়েক্ট করবে তার নিজস্ব ব্যাপার? জায়িনের কিছু করার নেই। চাচাদের, ভাইদের কল করে জরুরি কথা আছে, দুপুরের খাবারের আগে কাজ শেষ করে বাসায় উপস্থিত থাকে যেন। দুপুরের খাবার আজ এক সাথে খাবে আর জরুরি কথা ও বলবে। সবাই বিনাবাক্যে রাজি হলো।
দুপুরের খাবারের আগে সবাই বাসায় এসে উপস্থিত হলো। দুপুরের খাবার খেতে সবাই এক সাথে বসলো। সবাই খাবার টেবিলে বসে ছিল। সবসময়ের মতো দুই মাঝের চেয়ারে হেলাল সাহেব ও মেহেরুন নেছা বসে আছেন। আর চারপাশে ছড়িয়ে ছিটিয়ে সবাই বসে আছেন।
সোহেদ বললেন,
“কি বলার জন্য এতো জরুরি তলব? তাড়াহুড়ো করে কাজ শেষ করে আসতে হলো।
শোহেব খাবার মুখে নিয়ে বললেন,
” হু হু শুরু করো!
জায়িন গলা পরিস্কার করে নিল। জায়িন সহজ সাবলীল গলায় কথা বলতে গিয়ে ও কথা গম্ভীর হয়ে বের হলো। নিজের উপর বিরক্ত হলো। কথা এরকম রুড হয়ে বের হচ্ছে কেন?
“যে জন্য আপনাদের সবাইকে জমায়েত করলাম গতকাল রাতে কোম্পানি থেকে আমার সাথে যোগাযোগ করেছে। আমার জায়গা টা খালি ছিল এবং তারা চাচ্ছে আমি আবার জয়েন করি। এখন আমি জয়েন হওয়ার চিন্তা ভাবনা করছি। তাই আপনাদের মতামত নিতে আসছি যে জয়েন হবো নাকি? আমি আশা করি, আপনাদের উত্তর আমার ইচ্ছাকে প্রাধান্য করে দিবেন।
সোহেদ বললেন,
” দেখো জায়িন, তুমি দেশে থাকলে ও আমাদের ব্যবসা সামলাচ্ছ না আর প্রবাসে থাকলে না। তাই তোমার যাওয়া না যাওয়া দিয়ে আমার কিছু যায় আসে না। এই দুঃখ থাকবে যে তুমি বিভিন্ন ফ্যামেলি ফাংশনে আমাদের সাথে উপস্থিত থাকবে না। তোমার শূন্যতা সবসময় অনুভব করবো। আর তুমি যদি এখানে কমফোর্ট না হও তাহলে যেখানে তুমি কমফোর্ট সেখানে থাকো। আমার কোনো অভিযোগ নেই? আর কোম্পানি যখন চাচ্ছে তোমাকে, ভালো বেতন দিচ্ছে , ভালোভাবে তোমার লাইফ লিড করবে সেখানে, তোমার যা ভালো মনে হয় তা করো।
“আমি সোহেদের সাথে একমত প্রকাশ করছি। তোমার কমফোর্ট জোনে তুমি থাকবে এতে আমার কোনো সমস্যা নেই। আর আমি মনে করি কারোর কোনো সমস্যা হবে না তোমার সিদ্ধান্তে?
জায়িন হেলাল সাহেবের দিকে তাকালো। হেলাল সাহেব ভাত খাওয়া হাত কখন থামিয়ে দিয়ে ছেলের দিকে গভীর মনযোগ দিয়ে তাকিয়েছেন। মনে কিছু হিসাব কষে বললেন,”এজ ইউ্যের উইস জায়িন। আই হেভ নো প্রবলেম। যা ভালো বুঝো করো।
লিপি বেগম মুখে কালো করে তাকিয়ে রইলেন স্বামীর দিকে। তিনি ভেবেছিলেন হেলাল সাহেব জায়িনের যাওয়ার ব্যাপারে বিরোধিতা করবেন। হেলাল সাহেব তো সহমত পোষণ করলেন।
নাছির সাহেব বললেন,
” আমি কখনো কোনো বিষয়ে কাউকে না করিনি,বড় ভাই যা বলেছেন তাতে সহমত পোষণ করেছি। এখানে যখন সবাই ইতিবাচক উত্তর দিচ্ছে আমি কেন নৈতিবাচক উত্তর দিব। আমি হ্যাঁ বললাম! যেখানে ভালো বুঝো সেখানে থাকো।
ইসরাত মনে মনে নেচে উঠলো। জায়িন বিদেশে গেলে আর এক যুগের আগে দেশে আসবে না। হয়তো জীবনেই আসবে না! সেখানে সেটেল হয়ে যাবে।! আহ সিঙ্গেল লাইফ চিল করবে সে। সে মিঙ্গেল হয়েও সিঙ্গেল থাকবে। জায়িনের সিদ্ধান্তে তার গালে অসংখ্য অদৃশ্য চুমু খেলো ইসরাত।
মেহেরুন নেছা ইসরাতের চিন্তায় এক বাল্টি পানি ঢেলে দিলেন। মেহেরুন নেছার কথা শোনে ইসরাতের হাসি ফুস করে উড়ে গেল।
“হু সব হুনলাম, ও বুজলাম। তুমি বিদেশ যাইবার চাও ভালা কথা কিন্তু তোমার বউরে আমাগো কাছে কেন রাইখা যাইবা? আমাদের কি ঠেকা লাগছে তোমার বউরে খাওয়ামু। অনেক খাওয়াইছি এই পর্যন্ত অনেক পিন্দাইছি, দায়বার উঠাইছি আমাগো মাইয়া বিয়া দিয়া দিছি এখন কেন আমরা এইসব করুম? নিজের বউ নিজে পালো। আমাগো আর টাকা পয়সা নাই তোমার বউরে খাওয়ানোর লগে। নিজের লগে লইয়া যাও। আমার বাড়িতে তোমার বউ আর রাখবার পারুম না। নিজ নিজ ঘর বাড়িয়ে যাও আমার বাড়ি খালি করো। এমনিতে আমার বাড়িতে মানুষ জায়গা হইতাছে না। তোমরা দুইজন গেলে আমার বাড়ির মানুষ কমবা।
নাছির সাহেব কিছু বলতে যাবেন মেহেরুন নেছা বললেন,
” চুপ! আমরা কেন অন্যের বউরে খাওয়ামু। তুই কথা বলবি না নাছির? জায়িন নিজের বউ সাথে নিয়ে যাও নইলে ব্যবস্থা কইরা দিয়া যাও নিজের বউয়ের। আমার বহুত খাওয়াইছি! এখন আমরা বহুত ক্লান্।
মেহেরুন নেছা ইশারায় সবাইকে সহমত পোষণ করতে বললেন।
হেলাল সাহেব বললেন,
“আম্মা ঠিক বলছে! তোমার তো দায়িত্ব ওর সব কিছুর খেয়াল রাখা। যেহেতু শরীয়ত মোতাবেক তোমাদের বিয়ে হয়েছে সেহেতু সব দায়িত্ব এখন তোমার। এখন আমাদের রেস্টের সময়। তুমি দায়িত্ববান ছেলে আমি জানি তুমি পারবে ইসরাতের দায়িত্ব নিতে।
” ঠিক আছে আমি ইসরাতের প্রতি মাসের খরচ আপনাদের কাছে পাঠিয়ে দিব।
“এইডা কইলে হইব না জায়িন। তোমার স্ত্রী থাকার ব্যবস্থা কইরা দিয়া যাও। আমার বাড়িতে আর রাখুম না। তুমি আমাগো কথা বুঝবার পারো নাই।
” তাহলে আমি এখন কি করবো দাদি?
“আমি কি জানি? তুমি তোমার বউয়ের কি করবা? আমরা বিয়া দিয়া দিছি আমাগো দায়িত্ব শেষ এখন তোমার দায়িত্ব শুরু। তুমি ওর স্বামী! তুমি ভালা জানো কি করবা?
ইরহাম বলল,
” বড় ভাইয়া এক কাজ করতে পারেন, আপুকে আপনার সাথে নিয়ে যেতে পারেন।
জায়িন বিরক্ত হয়ে তাকালো ইরহামের দিকে। মেহেরুন নেছা চোখ দিয়ে ইশারা করে বললেন, “হইতাছে চালাইয়ে যা।
” নিয়ে যাওয়ার কথা বললে তো নিয়ে যাওয়া যায় না। পাসপোর্ট বানানো লাগবে। পাসপোর্ট পাওয়ার পর আর কত স্টেপ রয়েছে সেগুলো করতে আরো দুই মাস লাগবে। এতো টাইম আমার কাছে নাই। আমি এই মাসের শেষের দিকে জয়েন দিব।
ইসরাত মুখ কালো করে দাদির দিকে রুষ্ট চোখে তাকিয়ে রইলো। দাদি তার সাথে এসব করতে পারে। বাড়ি থেকে বের করে দিচ্ছে। ইসরাত ভিতরে ভিতরে অভিমান করলো। চোখ নিচু করে ভাত মুখে দিল। ভাত গুলো মনে হলো দাঁত দিয়ে চিবতে পারছে না। আস্তো গিলতে গিয়ে মনে হলো গলায় আটকে গেছে। খাবার খেতে ইচ্ছে করছে না।
ইসরাত মিনমিন করে বলল,
” দাদি আমি আমার খরচ চালাতে পারবো। আর তোমাদের আমার খরচ বহন করতে হবে না। আমি নিজের থাকার জন্য জায়গা খুঁজে নিব। নিজের ব্যবস্থা করে নিতে পারবো।
নুসরাত ফোড়ন কেটে নিজের কথা ঢুকিয়ে দিল।
“তুই মেয়ে মানুষ, তুই একা চলাফেরা করতে পারবি না, আর মেয়ে মানুষ তুমি বড়দের মাঝখানে কথা বলো কেন? বড়রা আছে কথা বলবে! আমরা ছোট মানুষ রোবটের মতো হয়ে চুপ করে বসে থাকবো। বড়রা যা সিদ্ধান্ত নিবে তা হ্যাঁ তে হ্যাঁ মিলাবে না তে না! বুঝতে হবে তুমি মেয়ে মানুষ।মেয়ে মানুষ চাইলে বাসার বাহিরে যেতে পারবে না।
আরশের মনে হলো সূক্ষ্ম খোঁচাটা নুসরাত মেরেছে তাদের পুরো পরিবারকে।
” ভাইয়া আপনি ইসরাতকে আপনার সাথে নিয়ে যান। ইসরাতের মেইবি পাসপোর্ট আছে। আব্বা একবার বানিয়েছিল আমাদের পাসপোর্ট। আর রইলো বাকি জিনিস ওই গুলো তো তাড়াতাড়ি মনে হয় হয়ে যায়। আমার জানামতে, পাসপোর্ট করতে সময় লাগে যা বেশি আর আপনার তো সেখানে সেটে-জেন-শিপ রয়েছে।
ভাতের মধ্যে পানি ঢেলে উঠে দাঁড়ালো নুসরাত । ভাত খেতে ইচ্ছে করছে না তার।
“ওহ আরেকটা কথা, দাদা ইন্ডড্রায়েক্টলি না না, ইন্ডড্রায়েক্টলি না, ড্রায়েক্টলি বলছে আপনাকে আপনার বউ নিয়ে যাওয়ার জন্য। সে খাওয়াতে পারবে না এটা একটা বাহানা আপনার সাথে পাঠানো তার মূল উদ্দেশ্য। আন্ডাস্টোড।
নুসরাতের কথায় মুখ লুকালেন সবাই। মেহেরুন নেছার চোয়াল ঝুলে পড়ল। নুসরাতের দিকে নাক ফুলিয়ে তাকালেন।
“ওহ আরেকটা কথা, দাদা….
মেহেরুন নেছা ইরহামকে ইশারা করলেন এটাকে নিয়ে যাওয়ার জন্য। সব রহস্য ফাঁস করে দিচ্ছে তার! ইরহাম পিছন থেকে এসে এঁটো হাত দিয়ে নুসরাতের মুখ চেপে ধরলো। জায়িন ভ্রু উঁচিয়ে তাকালো ইরহামের দিকে। ভ্র নাচিয়ে জিজ্ঞেস করলো কি?
” নুসরাতের মুখ ছাড়ো ইরহাম।
ইরহাম বোকাদের মতো হাসল হি হি করে। কানে ফিসফিস করে বলল,” আর বলতে হবে না। অনেক বলেছিস বইন এবার চল। তোর সাথে ইম্পর্ট্যান্ট কথা আছে।
ইরহাম নুসরাতকে টেনে নিয়ে চলে গেল। জায়িন চুপ করে তাকিয়ে রইলো। নীরবতা ভাঙল জায়িন। পুরুষালি ভারী গলার আওয়াজ শোনা গেল।
“আপনারা যখন সবাই চাইছেন ইসরাতকে আমার সাথে নিয়ে যাই, ওয়েল আমি নিয়ে যাব। লাগেজ প্যাকিং শুরু করো ইসরাত। যা যা প্রয়োজনীয় সব গুছিয়ে নিও। আর তোমার পাসপোর্ট আমার কাছে কাউকে দিয়ে পাঠিয়ে দিও। ওকে….
মেহেরুন নেছা বললেন,
” ওকে।
ইসরাত প্লেট নিয়ে উঠে দাঁড়ালো। ভাত খেতে ইচ্ছে করছে না। চুপচাপ হেঁটে কিচেনে চলে গেল। কিচেনের দরজার সামনে আসতে দেখলো ইরহাম আর নুসরাত দু-জন চুলোচুলি করছে বেসিনের সামনে দাঁড়িয়ে। এঁটো হাত দিয়ে ইরহাম নুসরাতের চুল ধরে আছে। কিছু বলছে আর চুল ধরে টান মারছে সাথে শাসাচ্ছে।
নুসরাত ইরহামের পায়ের হাঁটুর হাড্ডির মাঝে কিক মারলো। ইরহাম পা ধরে মেঝেতে বসে পড়ল। নুসরাত এবার চুলে ধরে ঠুস ঠাস করে কিল বসালো ইরহামের পিঠে। ইসরাত ধাক্কা দিয়ে দু-জনের মাঝ দিয়ে হেঁটে গেল বেসিনের সামনে।
“নুসরাত তুই আমায় একটা বেশি মেরেছিস, সমান সমান করতে হবে। এই দিকে আয় আমি একটা মারবো তারপর আমাদের মারামারি শেষ হবে।
” তুই আগে আমায় মারলি কেন? তাও আবার ভাত খাওয়া হাত দিয়ে। চ্যাহ কি করেছিস আমার চুলের? মসলা মাখিয়ে আমার চুলের।
“তাহলে তুই ওখানে দাঁড়িয়ে সব বলে দিচ্ছিলি কেন? এজন্য তো শুধু একটা গাট্টা মেরেছি।
নুসরাত ভেঙ্গাল ইরহামকে। মুখ বাঁকা করে কপি করলো। ইরহাম থাপ্পড় মারলো নুসরাতের গালে। নুসরাতের রাগে ইচ্ছে করলো ইরহামকে মাথায় তুলে আছাড় মারতে।
“বালে মারছো তোমার! শালা খচ্চর, খবিস কোথাকার? এই ময়লা হাত দিয়ে তুই আমার চুলে হাত দিয়েছিস, তারপর মুখে এখন গালে, কোত্তা কোথাকার? তোর বাল করেছিস। গোসল করতে হবে আবার। বাল বাল করেছ? সারা শরীরে কাপড়ে তোর এঁটো হাত লাগিয়ে দিয়েছিস। আর হাত ধোয়ে কি করবা?
নুসরাত গালি দিয়ে শান্ত হলো না। আর দু-এক ঘা লাগালো ইরহামের পিঠে। আরশ অদ্ভুতভাবে তাকিয়ে রইলো। প্লেট রাখতে এসে এসব কি দেখছে? মনে হলো চিড়িয়াখানার এক প্রাণী আরেক প্রাণীকে মারছে। এক কোণায় ইসরাত দাঁড়িয়ে এদের মারামারি, লাথালাথি দেখছে। আরশ পকেট হাতরে মোবাইল বের করলো। বিড়বিড় করে বলল,” এটা বাসা নাকি চিড়িয়াখানা? বাঁ-হাতে প্লেট রেখে ডান হাত দিয়ে মোবাইলের ভিডিও অন করলো।
ইরহাম খেয়াল করলল আরশ তাদের ভিডিও করতে মোবাইল বের করেছে। নুসরাত উড়াধুড়া ইরহাম কে পিঠিয়ে সোজা হয়ে দাঁড়ালো। চুল গুলো পিছনের দিকে ঠেলে দিয়ে হাত খোপা করলো। গরমে মুখ ঘেমে গিয়েছে। আরশকে মোবাইল হাতে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে চোখ ছোট ছোট করল। ফিসফিস করে জিজ্ঞেস করলো,” এই ইরহাম এ মোবাইল এরকম করে ধরে রাখছে কেন? আমাদের ভিডিও করছে নাকি?
“হু বইন।
” শালাকে চমক দেখাই।
ইরহাম কীভাবে বলতে যাবে তার আগেই নুসরাত ইরহামকে জড়িয়ে ধরলো। ইরহাম চোখ বড় বড় করে তাকিয়ে রইলো নুসরাতের দিকে। নুসরাত আর ইরহাম দুই ইঞ্চির ডিফারেন্স। নুসরাত দুই ইঞ্চি খাটো আর ইরহাম দুই ইঞ্চি লম্বা।
নুসরাত থাকে জড়িয়ে ধরায় তার কপালের কাছে এসে পড়ল। মুখ কিছুটা কানের পাশে নিয়ে ফিসফিস করে বলল,” আমাগো ভালোবাসা দেখিয়ে দেই। শালা জড়িয়ে ধর। হা করে তাকিয়ে আছিস কেন? আমাকে জীবনে দেখিস নি? জড়িয়ে ধরতে গিয়ে আবার শরীরে হাত লাগাবি না। হাত লাগলে হাত ভেঙে গলায় জুলিয়ে দিব। মনে রাখিস আমি দু-দিন জিম করেছি। আমি যেরকম তোর শরীরে স্পর্শ না করে জড়িয়ে ধরে দাঁড়িয়ে আছি ওইরকম বুঝছিস।
“হ বুঝছি!
ইসরাত হা করে তাকিয়ে তাকলো। এই তো একজন আরেকজনের চুল ছিঁড়ে ফেলছিল। এখন আবার ভালোবাসা দেখাচ্ছে। জড়াজড়ি করছে। এদের সেকেন্ডের ভিতর ভালোবাসা আসে আবার দু-জনের সেকেন্ডের ভিতর ভালোবাসা উধাও হয়ে যায়। আরশ মোবাইল পকেটে পুরে প্লেট বেসিনে রেখে চলে গেল। ইসরাত ও নাক চোখ কুঁচকে নুসরাতদের দিকে তাকিয়ে চলে গেল। আরশ আর ইসরাত যেতেই আবার মারামারি লাগিয়ে দিল দুজন।
কাঁচ ভাঙার শব্দে ঝর্ণা কিচেনে দৌড়ে আসলেন। প্লেট ভাঙা দেখে হায় হায় করে উঠলেন। আরশ যে প্লেট বেসিনে রেখেছিল সেটা ভেঙে দিয়েছে দু-জন।
রাগী গলায় জিজ্ঞেস করলেন,
” কে ভেঙেছে?
নুসরাত ইরহামের দিকে আঙুল তুলল আর ইরহাম নুসরাতের দিকে। ঝর্ণা দু-জনের মাথায় দুটো গাট্টা মেরে কানে ধরলেন দুজনের। হালকা হেসে বললেন,
“আর কোনো দিন যেন দু-জনকে রান্না ঘরে না দেখি। যাও বের হও এখান থেকে! যখন আসো কিছু না কিছু ভেঙে যাও। তোদের মারামারি করার জায়গা এটা না।
নুসরাত ঠোঁটে ঠোঁট চেপে ইরহামের দিকে আর ইরহাম নুসরাতের দিকে তাকালো। এরপর নুসরাত আর ইরহাম মাথা উপর নিচ নাড়িয়ে হু বলে শব্দ করলো।
কয়েকদিন পরের কথা,
রাতের বেলা জায়িনকে ডেকে পাঠানো হলো মেহেরুন নেছার রুমে। মেহেরুন নেছার রুমে গিয়ে ভ্রু কুঁচকে গেল জায়িনের বাবা, আর চাচারা সবাই দল বেঁধে বসে আছে দেখে। জায়িন সিল্কি চুলগুলো কপালের উপর থেকে পিছনের দিকে ঠেলে দিয়ে বলল,” আসতে পারি।
নাছির সাহেব বললেন,
“আসো।
জায়িন গিয়ে সোফার উপর বসলো। দাদির দিকে জিজ্ঞাসা দৃষ্টিতে তাকালো কেন তাকে রাতের বেলা ডেকে পাঠিয়েছেন?
” যেই জইন্য তোমারে ডাইকা আনা হইছে তা হইলো বিদেশ যাইবার আগে তোমার আর ইসরাতের বড় কইরা অনুষ্ঠান করুম। আর সাথে আশিকের বউরে উঠাইয়া নিয়া আমু। মানুষ জনরে তো জানাইতে হইব তোমাগো বিয়া হইছে।
মেহেরুন নেছার কথায় জায়িনের বুকে সূক্ষ্ম ব্যথা অনুভব হলো।
“জি আপনারা যা ভালো বুঝেন তা করুন। আমার কোনো আপত্তি নেই।
” তাহলে সামনের সপ্তাহে শুক্রবারে অনুষ্ঠানের সময় রাখা হোক। তার মইধ্যে যার যা কিনার কিন্না নিবো আর যা অনুষ্ঠান করার কইরা নিবো।
“সবকিছুতে উপস্থিত থাকতে হবে আমাকে?
” তোমার ভালা লাগলে আইবা না লাগলে আর কইয়া কোনো লাভ নাই তুমি আইবা না। তোমার ইচ্ছা না হইলে আইসো না।
“তাহলে আমি এখন আসি।
” হু আসো। দাঁড়াও আরো একটা কথা ছিল ডেলার একডা বইন আছে তুমি জাইনতা?
জায়িন বলল,
” হ্যাঁ!
“মাইয়াডারে তুই দেখছিস কোনো দিন?
” না।
“ডেলার বোন ইনায়া বুঝলি, সেটা দেইখা আমি টাসকি খাইয়া গেছি।
জায়িন দু-পাশে মাথা নাড়ালো। যার মানে সে জানতো না।
“ডেলার বোন ইনায়া এটা আপনাকে কে বলল?
“সেদিন আশিকের জন্য প্রস্তাব নিয়ে গেলাম ওই সময় ছ্যাঁমড়ি ডারে দেখি। আমাগো দেইখা ছ্যাঁমড়ি অবাক আর ছ্যাঁমড়িরে দেইকা আমি অবাক হইয়া গেলাম। পরে ওর মা আমার সাথে পরিচয় করাই দিল তার ছোড মাইয়া ইনায়া। ও তুই মারে দেখছিস কোনো দিন?
জায়িন দু-পাশে মাথা নাড়ালো। মেহেরুন নেছা চোখ ছোট ছোট করে তাকিয়ে তাকলেন। মাইয়ারে ভালা পায় আর মাইয়ার ভাই বোন সম্পর্কে কিছু জানে না। এইডা কেমন ভালোবাসা?
” ওই ডেলা ওইখানে কার কাছে থাকতো? ওর মা আর বইন তো দেশে থাকতো। আর গেল বা কেমনে?
“ওর চাচার কাছে থাকতো। ছোট বেলায় ওকে এডোপ্ট করেছিলেন ওর চাচা।
” দেখলি জায়িন ওরা আমাগো দু-সম্পর্কের কুটুম। এক আশিকের শশুড় বাড়ির দুই জায়ানের শশুড় বাড়ি এক ঘর থাইকা দুইডা মাইয়া আমার বিয়া করাইয়া লইয়া আইতাছি।
জায়িনের কথা বলতে ইচ্ছে হলো না চুপ করে দাদির কথা শুনলো। মেহেরুন নেছা নিজের কথা শেষ করে বললেন,
“যাও এইবার গিয়া ঘুমাই যাও। অনেক রাইত হইছে।
“আপনি ও ঘুমিয়ে যান।
জায়িন মেহেরুন নেছার সাথে কথা বলা শেষ করে নিজের রুমে যেতে যেতে চিন্তা করলো জায়িন এ জন্য সেদিন ইনায়ার মুখটা এতোটা চেনে চেনা লাগছিল তার কাছে। ডেলার বোন বলেই। জায়িন দীর্ঘশ্বাস ছাড়লো।
অতিরিক্ত চিন্তা ভাবনা করতে গিয়ে জায়িন বুঝলো না কারোর পথ আটকে সে দাঁড়িয়ে আছে। ইসরাত কখন থেকে বলছে ভাইয়া রাস্তা ছাড়ুন জায়িন শুনছে না।
ইসরাত হাত দিয়ে জায়িনের কাপড় ধরে টান দিল।
জায়িন ধড়ফড় করে সামনের দিকে তাকালো।
” কি? এভাবে ভয় দেখাচ্ছিলে কেনো?
“ভাইয়া আমি আপনাকে ভয় দেখাচ্ছিনা। কখন থেকে রাস্তা ছাড়ার কথা বলছিলাম আপনি তো সরেই দাঁড়াচ্ছেন না।
” ওহ স্যরি! আমি শুনতে পাইনি।
“এবার রাস্তা দিন ভাইয়া আমি যাব।
” ইয়াহ সিউর।
ইসরাত সামনের দিকে যেতেই জায়িন ডেকে উঠলো পিছন থেকে। ইসরাত দাঁড়ালো পিছন ফিরে তাকালো না।
“তোমার আমার সাথে যেতে কোনো সমস্যা নেই তো?
ইসরাত বোকাদের মতো জিজ্ঞেস করলো,
” কোথায়?
জায়িনের হালকা হাসির ঝংকার শোনা গেল। ইসরাত পিছন ফিরে তাকালো। জায়িনকে হাসতে দেখে ইসরাত ও মলিন হাসল।
“তুমি বোকাদের মতো প্রশ্ন করছো? আমার সাথে আমার বাসায় আমার দেশে যেতে তোমার কোনো সমস্যা আছে। সমস্যা থাকলে বলতে পারো আমি তোমার থাকার ব্যবস্থা এখানে করে দিয়ে যাব? আমার কাছে মনে হলো তোমাকে প্রশ্ন করা উচিত? পারমিশনের একটা ব্যাপার আছে না!
ইসরাতের চোখে ভেসে উঠলো আজকে দুপুরের কথা। বাবা, আব্বু, চাচ্চু কিভাবে সবাই তাল মিলাল দাদির কথায়? সবাই যখন চায় সে আর না থাকুক সে যাবে জায়িনের সাথে। পরের কথা পরে ভাবা যাবে। এখন শুধু এ বাড়ি থেকে বের হওয়া উত্তম। তারা খাওয়াতে পারবে না তো কি হয়েছে সে নিজে রোজগার করে নিজের খরচ চালাবে? সে আর থাকবে না এ বাড়িতে ইসরাত আনমনা হয়ে বলল,” হু!
“হু কি? কেউ তোমাকে ফোর্স করবে না আমার সাথে যাওয়ার জন্য তুমি যদি না যেতে চাও। আমি তোমাকে জিজ্ঞেস করছি ইসরাত আবার যেতে চাও! সেখানে গেলে কিন্তু তাড়াতাড়ি আসতে পারবে না দেশে।
“আমি যাব আপনার সাথে!
প্রিয় প্রণয়িনী পর্ব ২৮
অভিমানের বসে ইসরাতের নেওয়া সিদ্ধান্ত কি ভবিষ্যতের জন্য ভালো কিছু বয়ে আনবে নাকি খারাপ কিছু বয়ে আনবে তা সময়ের উপর ছেড়ে দিল ইসরাত? সময় আর ভাগ্য কি তার সঙ্গ দিবে তা একমাত্র সৃষ্টিকর্তা ছাড়া আর কেউ জানে না।