প্রিয় প্রণয়িনী পর্ব ৯

প্রিয় প্রণয়িনী পর্ব ৯
জান্নাত নুসরাত

সময় এগারোটা বেজে সতেরো মিনিট। রুদ্রজ্জ্বল দিন হওয়ায় সূর্য খাড়াভাবে কিরণ ছড়াচ্ছে। এই রোদের মধ্যে নুসরাত এবং ইসরাত বাগানে গাছের নিচে জন্মানো আগাছা গুলো পরিস্কার করছিল। নুসরাত তিক্ত বিরক্ত ইসরাতের উপর। এই গরমের মধ্যে মানুষ এসির নিচে বসে থাকে আর ওরা কি করছে? আগাছা পরিষ্কার করছে। কপালে জমায়িত সেদ জল হাত দিয়ে পরিস্কার করে নিল। ইসরাতের দিকে তাকিয়ে দেখল নাজমিন বেগমের বড় ওড়না সাথে কালো রঙ্গের সুতি কামিজ পরে এই গরমে চুপচাপ আগাছা পরিষ্কার করে চলেছে। শুভ্র মুখ লাল হয়ে আছে রোদের তাপে। ঘামে সারা শরীর চপচপে হয়ে গেছে।

“বিকেলে করলে কি হতো? এখন চলে যাই পরে করব। দেখ ঘেমে লাল হয়ে যাচ্ছি।
ইসরাত পাত্তা দিল না। ও জানে মেয়েটা কাজ না করার জন্য বাহানা খুঁজছে। একবার যদি রুমে যায় আর এক মাসের মধ্যে বাগান নিয়ে আসা যাবে না। নুসরাতের কথা উত্তর না দিয়ে ইসরাত বলল,” পানির পাইপ নিয়ে আয়।
নুসরাত চিৎকার করে বলল,
“আমি এই গরমে সিদ্ধ হয়ে যাচ্ছি। আর তুই পানির পাইপ নিয়ে আছিস। আজ যদি আমি মারা যাই, এর দায়বার কি তুই নিবি?
নুসরাতের পিছন থেকে গম্ভীর স্বরে বলল আরশ,

আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন

” তুই এতো তাড়াতাড়ি মরবি না। যাহ কাজ কর গিয়ে! দিন দিন অলস হয়ে যাচ্ছিস। সারাদিন মোবাইল টিপা, খাওয়া, আর ঘুম ছাড়া কি করিস? সামান্য বাগান পরিস্কার করতে এসে এতো বাহানা করিস। তোর ভবিষ্যৎ তো দেখছি অন্ধকার। সেখানে কোনো আলোর ছিটে ফোঁটা নেই।
নুসরাত কপালে ভাঁজ ফেলল। নাক মুখ কুঁচকে পিছনে ফিরে আরশের দিকে তাকালো। রোদের তাপে সবকিছু অন্ধকার লাগালো। চোখের পাতা কয়েকবার বন্ধ করে খোলার পর সামনে আরশকে পরিস্কার দেখতে পেল। কালো শার্ট ও কালো ট্রাউজার পরে সামনে দাঁড়িয়ে আছে। সবসময়ের মতো এক হাত ট্রাউজারের পকেটে।
নুসরাত নিজ মনে গালি দিল আরশকে,
” শালা আবার চলে এসেছে। আমার কাজে বাঁ-হাত না ঢুকালে শালার পেটের ভাত হজম হয় না।
“দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে কি মুখ দেখছিস? যা পানির পাইপ নিয়ে আয়!
বিড়বিড় করল নুসরাত,

” শালা চলে এসেছে অর্ডার দিতে। আমাকে কি তোর চাকর পেয়েছিস আরইশ্শার বাচ্চা যে তোর কাজ করব? করব না?কি করবি দেখে নিব?
নুসরাত নিজের কথা রাখতে পারলো না আরশের জোরালো এক ধমকে দৌড়ে বাড়ির পিছনে চলে গেল পানির পাইপ আনতে। হালকা হাসিতে আরশের ঠোঁট বেঁকে গেল।
বাড়ির পিছন থেকে নুসরাত পানির পাইপ নিয়ে এসে ইসরাত উপর ছুঁড়ে ফেলল। পাইপের মাটি দু হাতে লাগায় ঝেড়ে ফেলার জন্য দু হাত এক সাথে করার আগে পিঠে কচি বাঁশের আঘাতে ছিটকে দূরে সরে গেল মেয়েটা। পিছন ফিরে অবাক দৃষ্টিতে তাকালো আরশের দিকে। মনে মনে ভাবলো “শালা মারল কেন?
মনের কথা মুখে প্রকাশ করলো,
“আমাকে কেন মেরেছেন?
আরশ উত্তর দিল,

” পানির পাইপ এভাবে ছুঁড়ে ফেললি কেন? ওটা যদি ইসরাতের মাথায় লাগতো, তো মেয়েটা ব্যথা পেতো না। অভদ্র মেয়ে মানুষ! বড় ভাই বোনের সাথে কীভাবে আচরণ করতে হয় জানিস না? কেউ ম্যানার্স শিখায়নি?
আরশ হাতের কচি বাঁশ দেখিয়ে বলল,
“এটা দিয়ে পিটিয়ে তোকে ম্যানার্স শিখাব।অভদ্র মেয়ে মানুষ !
শ্যামলা মুখ একে রোদে লাল হয়ে আছে তার উপর কচি বাঁশের আঘাতে শরীর জ্বালা করছে। ইসরাত চার হাত দূর
হতে আরশকে উদ্দেশ্য করে বলল,”ভাইয়া আমি তো ব্যথা পাইনি আর পাইপ তো আমার উপর পড়েনি। ওকে
এমনি এমনি মারলেন কেন?
আরশের প্রতিউত্তর ভেসে আসলো,

“ও দিন দিন অসভ্য,অভদ্র,হয়ে যাচ্ছে। ভবিষ্যতে যাতে এরকম কাজ রিপিট না হয় তাই একটা শিক্ষা দিলাম।
ইসরাত নুসরাতের দিকে তাকালো। নিশ্চুপ তাকিয়ে আছে আরশের দিকে। দূরত্ব বলতে এক হাত। ইসরাত আরশকে সাবধান করার পূর্বে যা ঘটার ঘটে গেল। নুসরাত দু-হাত ভর্তি বালু নিয়ে আরশের মুখের উপর ছুঁড়ে মারলো। ঝড়ঝড়ে বালি গুলো কিছু আরশের চোখে ঢুকলো আর কিছু শরীর ছুঁয়ে কাপড়ের ভিতর ঢুকলো।
আরশ দাঁতে দাঁত চাপলো। হাত মুষ্ঠিবদ্ধ করে রাগে লাল মুখ নিয়ে বলল,”বেয়াদব মেয়ে! থাপড়ে গাল লাল করবো। বড়দের সম্মান করতে জানে না। আজ যদি তোর গাল থাপড়ে লাল না করি আমার নাম বদলে দিস।
শ্যামলা বর্ণের রমণীর হাসির ঝংকার শুনা গেল। হাসির চোটে কথা ভেঙে ভেঙে আসলো।

” আগে চোখ থেকে বালু বের হোক! পরে না হয় আমাকে থাপড়ে লাল করবেন নাকি নীল করবেন সেটা ঠিক করবেন। টা টা বায় বায়!
ইসরাতের দিকে তাকিয়ে বলল,
“ডার্লিং উনাকে একটু বালু বের করতে সাহায্য কর। আমি যাচ্ছি রুমে!
নুসরাত মুখ দিয়ে চুকচুক শব্দ বের করে দু হাত দু দিকে মেলে বিজয়ের হাসি দিয়ে দু-তলা বিশিষ্ট বাড়ির ভিতরে চলে গেল।
আর বাহিরে চিৎকার করে চলেছে আরশ। হালকা কথার আওয়াজ নুসরাতের কানে এসে বারি খেল।
“আমি তোকে ছাড়ব না নুসরাত! শুধু বালি বের হোক চোখ থেকে।
নুসরাত পাত্তাই দিল না আরশের কথা। আগে বালি বের হোক পরে তাকে দেখবে। আর দেখলেই বা কি সে ভয় পায় নাকি আরশকে? নিজের বাপকে ও ভয় পায় না সে! ভিতর থেকে কেউ বলে উঠল সত্যি বাপকে ভয় পাস না? নুসরাত আমতা আমতা করে বলল,” ওইতো একটু!

ড্রয়িং রুমে সৈয়দ বাড়ির কর্তীরা গোল হয়ে দাঁড়িয়ে আছেন আরশকে ঘিরে। কিছুক্ষণ আগে ইসরাত আরশকে নিয়ে বাড়ির ভিতর এসেছে। এরপর থেকে লিপি বেগম আহজারি করে চলেছেন।
“এই মেয়ে এতো বেয়াদব কেন? বড় ভাইয়কে কেউ এভাবে হেনস্থা করে। বড় ভাই হিসেবে কি শাসন করতে পারবে না? সামান্য শাসন করায় বড় ভাইকে বালি ছুঁড়ে মারবে চোখে। অভদ্র!
নাজমিন প্রচুর ক্ষীপ্ত হলেন নুসরাতের উপর। এই মেয়ের জন্য তিনি এক দন্ড শান্তিতে থাকতে পারেন না। মুখ দেখে বোঝা যাচ্ছে আজ নুসরাতের পিঠে প্রচুর মার পড়বে। ঝড়ের গতিতে সিঁড়ি দিয়ে উপরে উঠে ইসরাতের রুমের দরজায় নক করলেন।

” এই দরজা খোল?
ইসরাত নাজমিন বেগমকে ঝড়ের বেগে নিজেদের রুমের দিকে যেতে দেখে নিজে ও মায়ের পিছনে দৌড়ালো। মায়ের কাছে গিয়ে হাত চেপে ধরলো। বোঝানোর জন্য বলল,
” আম্মু আজকের মতো ছেড়ে দাও! আর এরকম করবে না।
“না আজ ওর একদিন কি আমার একদিন?
দরজায় আঘাত করলেন ঠাস করে নাজমিন।
” এই কোথায় মরেছিস? দরজা খোল!
ইসরাত বলল,

“দরজা খুলবি না নুসরাত। তাহলে আজ তোর কপালে শনি আছে।
দরজার ওপাশে মা আর বোনের কথা শুনে নুসরাত বিমূর হয়ে দাঁড়িয়ে রইলো। একজন বলে দরজা খুল আরেকজন বলে খুলবি না। নুসরাত ইসরাতের কথা না শোনে দরজা খুললো।
নাজমিন বেগম তাড়াতাড়ি রুমে ঢুকে নুসরাতের শ্যামলা গালে ঠাস করে থাপ্পড় মারলেন। ইসরাত নাজমিন বেগমকে পিছন থেকে টেনে ধরলো।
” আরে মা, এরকম করছো কেন? ওর তো একার দোষ নাই। ভাইয়ার ও তো দোষ আছে।
নুসরাত মাথা নাড়ালো এক সাথে অনেকবার। কোনো কথা না বলে মাথা নাড়িয়ে বোঝালো ইসরাত যা বুঝাচ্ছে তা একশত পার্সেন্ট ঠিক।
নাজমিন আঙ্গুল তুলে শাসালেন।
“আরশের থেকে দূরে থাকবি। মনে থাকে যেন। আমি যেন তোর নামে আর কোন কমপ্লেইন না শুনি।
“……
” এইইইই কথা বলছিস না কেন তুই? মনে থাকবে বল!
নুসরাত উপর নিচ মাথা নাড়িয়ে বলল,
“হ্যাঁ মনে থাকবে!

নিচে শোরগোলের শব্দ শুনে জায়িন নিজের রুম থেকে বের হয়ে আসলো। ইসরাতের রুমের সামনে আসার পর নাজমিন বেগমকে চুপচাপ বের হতে দেখলো তার পিছন পিছন ইসরাত ও বের হলো। ইসরাত কে দেখে জায়িন পিছন থেকে ডেকে উঠলো।
” ইসরাত….!
ইসরাত শুনতে পেয়েও চুপচাপ চলে গেল। পিছনে ফিরে তাকালো না।
জায়িন বিড়বিড় করলো,
“এর আবার কি হলো?
নুসরাতকে রুমের ভিতর দেখে ডাক দিল। নুসরাত এগিয়ে এসে জিজ্ঞেস করলো কি হয়েছে ?
” নিচ তলা থেকে চিৎকারের শব্দ আসছিল। কিছু হয়েছে!
নুসরাত উড়িয়ে দিল জায়িনের কথা। হাত দিয়ে চারিপাশে মাছি তাড়ানো ভঙ্গি করে বলল,”আরে ভাইয়া এইসবে পাত্তা দিও না। এই পরিবারের মানুষের অভ্যাস তিল কে তাল বানিয়ে নেওয়া। চিল ব্রো চিল!
“আমি রহিমা কে বলেছিলাম কফি দেওয়ার জন্য এতোক্ষণ হয়ে গেল কফি নিয়ে আসছে না। প্লিজ একটা হ্যাল্প করো?

” আরে ভাইয়া প্লিজ বলতে হবে না। বলুন কি হ্যাল্প করতে হবে? আমি সব সময় রেডি থাকি মানুষের সাহায্যের জন্য।
“দু কাপ ব্ল্যাক কফি কষ্ট করে তৈরি করে আমার রুমে পৌঁছে দাও।
” ইয়াহ,ভাইয়া এক্ষুণি দিচ্ছি।
“থ্যাংক্স আ লট সিস!
“থ্যাংক্স দিতে হবে না ভাইয়ায়ায়া!
জায়িন নিজের রুমের দিকে চলে গেল। নুসরাত কিচেনে চলে গেল ব্ল্যাক কফি বানানোর জন্য। কিচেন যাওয়ার সময় ড্রয়িং রুমের সোফা বসে থাকা উজ্জ্বল শ্যাম বর্ণের পুরুষটির দিকে চোখ পড়ল নুসরাতের। নুসরাত ভালো করে সোফায় বসে থাকা পুরুষটার দিকে তাকাতেই পুরুষ টা এদিকে তাকালো লাল চোখ নিয়ে। নুসরাত কি একটু ভয় পেল? হয়তোবা! আরশ লাল লাল চোখ নিয়ে নুসরাত দিকে তাকিয়ে আছে। চোখ দিয়ে বুঝাচ্ছে একবার হাতের কাছে পাই তারপর দেখ কি করি তোর অবস্থা? নুসরাত ক্লান্ত ভঙ্গিতে চলে গেল কিচেনে। কিচেনে যেতে যেতে শোনলো লিপি বেগমের কথা বলার আওয়াজ।
“বাবা চোখ খচখচ করছে। এই ড্রপ দিয়ে দেই তাহলে কমে যাবে। দেখি তাকা আমার দিকে…..

কফি বানিয়ে জায়িনের রুমের বাহিরে গিয়ে নক করলো নুসরাত।
” ভাইয়া আপনাদের কফি নিয়ে আসছি।
রুমের দরজা হালকা চাপানো ছিল জায়িনের। দরজা খুলে কফির ট্রেটা হাতে নিল। কৃতজ্ঞতার হাসি হেসে বলল,”এগেইন থ্যাংকস।
নুসরাত প্রতিউত্তরে হালকা হাসলো। জায়িন ট্রে নিয়ে রুমের ভিতর চলে গেল। নুসরাত নিজের রুমে যাওয়ার জন্য পিছনে ঘুরতেই শক্ত কোনো বস্তুর সাথে ধাক্কা খেল। মাথা উপরে তুলে যখন দেখলো আরশ নিজের ভিতরের রুহ কেঁপে উঠলো।

প্রিয় প্রণয়িনী পর্ব ৮

“লা হাওলা ওয়ালা কুওয়াতা ইল্লা বিল্লাহ…… শেষ করার আগেই নুসরাতকে আরশ ঝাপটে ধরলো। আরশের মুখের কোনে ফোটে উঠলো বাঁকা হাসি। মুখের বাঁকা হাসি দিয়ে বোঝাচ্ছে কোথায় পালাবি তুই এখন আমার থেকে?
আজ আর তোর রক্ষে নেই আমার হাত থেকে।

প্রিয় প্রণয়িনী পর্ব ১০

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here