প্রিয় প্রণয়িনী ২ পর্ব ১৭

প্রিয় প্রণয়িনী ২ পর্ব ১৭
জান্নাত নুসরাত

ড্রয়িং রুমে বসে কখন থেকে হাসছে তিন ভাই বোন। তাদের মধ্যে মুখ গোমড়া করে বসে আছে একমাত্র ইসরাত। সে এই তিনজনের আচরণে বিরক্ত। তাদের হাসি তামাশার মধ্যে এসে যোগ দিল আরো এক নমুনা। এতক্ষণ সে পড়তে ব্যস্ত ছিল। পড়াশোনা শেষ করে এসে বসেছে তাদের পাশ ঘেঁষে। মমো, নুসরাত, আহান আর ইরহামের কথা শুনে নিজেও হে হে করে হাসতে লাগল সবার সাথে তাল মিলিয়ে। ইরহাম টিপ্পনী কেটে বলে ওঠল,”এমন হাজবেন্ড আমি ও তো ডিজার্ভ করি।
নুসরাত হেসে নিয়ে বলে,

“এসব তোর ভাগ্যে নেইরে পাগলা।
আহান হা হা শব্দে হেসে ওঠল। লজ্জা পাওয়ার মতো ভঙ্গি করে বলে ওঠল,”কেন থাকবে না?
“তুই কী লেজবিয়ান যে তোর ভাগ্যে হাজবেন্ড থাকবে?
ইরহাম আর আহান দু-হাত দিয়ে গালে তওবা তওবা করল। ইরহাম দু-পাশে মাথা নাড়িয়ে বলল,”না, আমি কেন লেজবিয়ান হতে যাব? আমি পিউর কাপুরুষ, আই মিন পৌরুষ।
ইরহামের কথায় পুরো ড্রয়িং রুম হাসির ধমকে কেঁপে ওঠল। ইসরাত এবার কথা বলল তাদের মধ্যে। সে শান্ত কন্ঠে আরাম করে সবার মাঝে বসে বলতে লাগল,”যা আমি দোয়া করে দিলাম নুসরাতের মতো ওয়াইফ ম্যাটেরিয়াল একটা মেয়ে তোদের ভাগ্যে যেন জুটে।
আহান লাফ মেরে ওঠে দাঁড়াল। ইরহাম আর্তনাদ করে ওঠল। দু-হাতে মাথা চেপে ধরে বলে ওঠল,”এত বড় অভিশাপ দিও না আপি। আমি নিষ্পাপ বাচ্চা অকালে মারা যাব। এর চেয়ে ভালো তুমি আমায় কুয়ায় ঝাপ দিতে বললে সেটা আরো সহজ হতো।

আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন

নুসরাত ইরহামের টিপ্পনীতে বিরক্ত হয়ে পা তুলে লাথি মারল পেছন দিকে। ব্যঙ্গাত্মক গলায় ইরহামকে নকল করে আওড়াল,”এত বড় অভিশাপ দিও না আপি। আমি নিষ্পাপ বাচ্চা অকালে মরে যাব। তো মরে যা না, আমরা কী আটকে রেখেছি তোকে?
ইরহাম নিজেও নুসরাতের কাঁধে দুটো কিল বসাল ধুপধাপ করে। রাগী কন্ঠে বলল,”তুই মরে যা। আমি এখনো আমার একটাও বাচ্চা জন্ম হতে দেখিনি, বাচ্চা জন্ম হবে, বাচ্চার বিয়ে খাবো, আমার বাচ্চার বাচ্চা দেখব, তারপর গিয়ে আল্লাহর ইচ্ছে হলো মরব, নাহলে আরো কয়েক জীবন বাঁচার শখ আছে। এখন তুই চাইলে মরে যেতে পারিস, কারণ এই পরিবারের অলস একটা প্রাণী তুই। মরে যা শালি..!
নুসরাত চিৎকার করে বলে ওঠল,
“পশ্চাৎদেশে এমন লাথি মারব তোর,আমাকে আরেকবার মরে যাওয়ার কথা বললে। তুই মরে যা, তুই মরে যা, তুই মরে যা, শালা..!

নুসরাত আর ইরহাম ভালোয় ভালোয় কথা বলতে বলতে সেটা কাটাকাটি থেকে হাতাহাতিতে চলে গেল। দু-জন দু-জনের দিকে খ্যাপা ষাঁড়ের ন্যায় এগিয়ে গিয়ে একজন আরেকজনের চুল টেনে ধরল। চুলে ধরে সর্ব শক্তি দিয়ে দু-একটা ঝাঁকুনি দিল৷ দু-জনের থেকে দু-জন কম না, মুখের সাথে একই গতিতে চলল হাত-পা। আহান দাঁড়িয়ে সোফার উপর দু-জনকে চিয়ার আপ করছে। হাত মাইকের মতো মুখের কাছে চেপে ধরে বলছে,”তো ধর্ষক, আই মিন দর্শক বিন্দো আজ আপনাদের সাথে আমি সৈয়দ আহান নাওফিল। দু-জন ষাঁড়ের লড়াই সামনাসামনি আপনাদের দেখাতে যাচ্ছি আজাইরা নিউজ টিভি থেকে। এই দুই ষাঁড় প্রথমে একজন ভদ্র মহিলাকে টিপ্পনী কেটে হয়রানি করার চেষ্টা করেছে, তারপর নিজেরা নিজেদের সাথে কথা বলতে বলতে মুখ চালাতে লাগে। প্রথমে কথা কাটাকাটি হলেও শেষ পর্যন্ত তা হাতাহাতিতে পৌঁছে যায়। এখন কোন হাতি, আই মিন কোন ষাঁড় এই যুদ্ধে বিজয়ী হয় তা দেখার জন্য আমি আহান এবং আজাইরা টিভির সাথে থাকুন।

একপাশে নুসরাত আর ইরহাম চিৎকার করে বাড়ি মাথায় তুলে ফেলেছে। অন্যদিকে আহানের উল্টাপাল্টা তথ্য সম্পাদনে ইসরাতের মাথা ধরে গেল। শক্ত মুখ বানিয়ে নিজের জায়গা থেকে ওঠে দাঁড়াল সে। চোখ দিয়ে মমোকে ইশারা করল নুসরাতকে সরানোর জন্য। সে গেল ইরহামের দিকে। দু-জন দু-দিক থেকে টেনে নুসরাত আর ইরহামকে সরাতে চাইল, কিন্তু দু-জনের হাতাহাতিতে মাঝখান থেকে আঘাত প্রাপ্ত হলো ইসরাত আর মমো। আহান আবারো মাইকের মতো হাত মুখে পেঁচিয়ে নিয়ে বলে ওঠল,”আপনারা হয়তো দেখেছেন দু-জন হাতি ওই দুটো ষাঁড়কে থামাতে গিয়ে নিজেরা আঘাত প্রাপ্ত হয়েছে। আমি বুঝিনা মানুষ, স্যরি মিস্টেক! আই মিন দুটো হাতি কেন যায় দুটো খ্যাপা ষাঁড়ের যুদ্ধ থামাতে। এতে তো আঘাত প্রাপ্ত হবে নিজেরা। আমি এক ক্ষুদে পিপড়া, এসবে আমার কোনো ল্যানদেন নাই। পরিবর্তি কথা জানতে চোখ রাখুন আজাইরা টিভিতে। আমি বিশিষ্ট মিচকে শয়তান পিপড়া সৈয়দ আহান নাওফিল আপনাদের সাথে আছি।

আহানের বকবক আর নুসরাত আর ইরহামের ঝগড়া থামল না যতক্ষণ পর্যন্ত নাজমিন বেগম এসে খুন্তি দিয়ে দু-ঘা করে পাঁচ-জনের পিঠে না লাগালেন ততক্ষণ পর্যন্ত। নাজমিন বেগমের খুন্তির বারি খেয়ে পাঁচজন মুখ চুপসে মাথা নিচু করে বসে রইল। চোরের মতো মুখের ভাবভঙ্গি করে একে অন্যকে অবলোকন করে লাগল। ইসরাত পিঠে হাত বুলিয়ে চোখ খিঁচে মিনমিন করে জানতে চাইল,”আমাকে মারলে কেন?
নাজমিন বেগম তেড়ে এসে বললেন,
“চুপ একদম চুপ।

নাজমিন বেগমের ধমকে ইসরাত মমো মুখ চুপসে নিল। নুসরাত আর আহান, নাজমিন বেগমের ধমকে হে হে করে হেসে ওঠে মুখ চেপে ধরল সোফার মধ্যে। ইরহাম বিরশ মুখ করে, শঙ্কিত গলায় কিছুটা ভয় নিয়ে জিজ্ঞেস করল,” ডার্লিং হুয়াই ইউ্যের মাথা ওয়াজ সো গরম?
ইরহামের প্রশ্নে মমো হিহি করে হেসে ওঠল। নুসরাত আর আহান দু-জন গড়াগড়ি খাচ্ছে একজন আরেকজনের গায়ে। নাজমিন রেগে ফোঁস করে ওঠে বিড়বিড়িয়ে আওড়ালেন,”নির্লজ্জ সবগুলো।
আহান আকস্মিক কিছু মনে হওয়ার ভঙ্গিতে ওঠে বসল৷ চোখ বড় বড় করে বলে,”আজ কী হয়েছে জানো আপি আমাদের স্কুলে?

নাজমিন বেগম ও খুন্তি হাতে নিয়ে বসে পড়লেন জানার জন্য কী হয়েছে। নাজমিন বেগম চেয়ার টেনে তাদের সাথে বসায় কারোরই ভাবাবেগ হলো না। আহান সতর্ক আওয়াজে আগে নিশ্চিত হয়ে নিল,”মেজ আব্বু বাড়িতে আছেন?
নাজমিন বেগম ধৈর্যহীন কন্ঠে বললেন,
“নেই। এবার তাড়াতাড়ি বলো কী হইছে?
আহান আরাম করে বসে বলে ওঠে,

” ওই যে, আমার বন্ধুর কথা মনে আছে সেদিন বললাম। ও আর গার্লফ্রেন্ড ব্রেক-আপ করে আল্লাহর নামে কসম কেটে নিল যে একজম আরেকজনের সাথে আর জীবনে রিলেশন করবে না, আজ থেকে তারা ভাই বোন। কিন্তু সেদিন আবার দেখি নিব্বা নিব্বিগুলো হাত ধরে হাঁটাহাঁটি করছে। মানে কী পরিমাণ নির্লজ্জ এরা। দু-দিন পরপর ব্রেক-আপ করে আবার দু-দিন পরপর একজন আরেকজনকে সোনা, পাখি বলে হাত জড়াজড়ি করে।
ইসরাত আর মমো একজন আরেকজনের দিকে তাকিয়ে ইতস্তত করে দু-জন একসাথে বলে ওঠল,”জীবনে আমরা কী করলাম? এই বয়সে বাচ্চাগুলো রিলেশন করে আর আমরা?
আহান চেঁচিয়ে ওঠে বলে,

“তোমরা দু-জনে জীবনে বাবাজীকা লাড্ডু করেছ।
নাজমিন বেগম ও হেসে ওঠলেন। নিজের এতক্ষণের গরম হওয়া মস্তিষ্ক কিছুটা ঠান্ডা হয়ে এসেছে। আহান আরো কিছু বলছিল নাজমিন বেগম তা আর শুনলেন না, দ্রুত পায়ে চলে গেলেন রান্না করতে। রাতে ইসরাত আর নুসরাতের কাছ থেকে জেনে যাওয়া যাবে এই ভেবে।

আকাশে মেঘের ভেলা জমেছে। পাখিরা দল বেধে ফিরছে নিজেদের নীরে। পশ্চিম আকাশ লাল লালিমায় ছেয়ে আছে। পড়ন্ত বিকালের মিটে রোদ এসে পড়ছে সৈয়দ বাড়িতে। পর্দা টেনে রাখার জন্য সেই রোদ তা ভেদ করে ভেতরে প্রবেশ করছে না। ড্রয়িং রুমের সোফায় বসে কিছু একটা চুপচাপ ভাবছেন হেলাল সাহেব। মুখ গম্ভীর করে রাখা। নিজের মনে চাল চালছেন। হাত স্থির নেই সোফার উপর। তা দিয়ে বারবার হাত বুলাচ্ছেন নিজের আধ পাকা ছোটো ছোটো দাড়িতে। হেলাল সাহেবের চিন্তায় ভাটা দিয়ে কর্কশ কন্ঠের প্যান্টের পকেটে রাখা ফোনটা বেজে ওঠল। হেলাল সাহেব নড়েচড়ে বসে ফোনটা ধরে কানে লাগালেন। হ্যালো মুখ দিয়ে বের করতেই অপাশ থেকে এশমামের নাকি কান্না স্বর ভেসে এলো। এশমাম বলছে,”স্যার….
হেলাল সাহেব নাক কুঁচকে জিজ্ঞেস করলেন,

“কী?
নিজ মনে নিজেকে দুটো গালি দিতে ও ভুললেন না। কোন আজাব এসে তার মাথায় পড়েছিল যে এদের মতো দুই মাথা মোটা গাধাকে সে ইসরাতের উপর নজর রাখার জন্য দিয়েছিল। তার বিতৃষ্ণা আরো একটু বাড়িয়ে দিয়ে এহসান বলে ওঠে,” স্যার…!
হেলাল সাহেব দাঁতে দাঁত চেপে জিজ্ঞেস করলেন,
“ছাগলের মতো স্যার স্যার না করে বলো কী হয়েছে?
এশমাম ফোনের অপাশ থেকে হুহু করে কেঁদে ওঠল। চোখের কোণে জমা হওয়া একট্য পানি হাত দিয়ে মুছে নিয়ে দুঃখে ভারাক্রান্ত মনে বলে,” ম্যাম আমাদের ধরে ক্রিকেট ব্যাট দিয়ে পিটিয়েছেন।
“কী?

হেলাল সাহেবের মুখ দিয়ে অনাকাঙ্ক্ষিত ভাবে শব্দগুলো বের হয়ে আসলো। নিজের মুখ হাত দিয়ে চেপে ধরে ফিসফিস করে জানতে চাইলেন,” কীভাবে?
“স্যার আমরা ম্যামের উপর নজর রাখছিলাম হঠাৎ করে উনি কোথাও উধাও হয়ে গেলেন। আমি আর এহসান যখন ম্যামের খোঁজ করছিলাম আশেপাশে তখন পেছন থেকে এসে আমাদের ম্যাম টোকা দেন। আমি আর এহসান তড়াক করে পেছনে তাকাতেই দেখি ম্যাম আমাদের দিকে চেয়ে ঠোঁট টিপে হাসছেন। তারপর বললেন,ওদিকে কী দেখছ আমি এখানে! আমাকেই খোঁজছিলে তাই না? আমরা ও ভদ্রতার সাথে হ্যাঁ ভঙ্গিতে উপর নিচ মাথা নাড়াতেই ম্যাম হেসে ওঠলেন। তারপর হাতের ব্যাট দিয়ে আমাকে আর এহসানকে কোনো কিছু বুঝে ওঠার আগেই ধুমধাম কয়েকটা লাগিয়ে দিলেন। এখন আমি আর এহসান রাস্তার ধারে পড়ে আছি প্লিজ স্যার দয়া করে আমাদের মতো দুটো মানুষকে হসপিটালে ভর্তি করিয়ে দিন।
হেলাল সাহেব চিরচিরে কন্ঠে বলে ওঠেন,

” একটা ও কাজের না। you two are fire. নিজেরা নিজেরা ডাক্তারে যাও।
কোনো মতে কথা শেষ করে রাগে ফোন কেটে দিলেন তিনি। দুজনের আর একটা কথা শোনার মতো ধৈর্য হেলাল সাহেবের নেই। রাগে লাল হওয়া মুখ নিয়ে এক হাতে থুতনিতে হাত বুলাতে বুলাতে চিন্তায় ব্যস্ত হলেন। মনে মনে ঠিক করে নিলেন, এবার তাকেই কিছু একটা করতে হবে।

দশ টাকার প্রাণ লিচুতে চুমুক দিয়ে নুসরাত চোখ তুলে উপরে তাকাল। কোমরে হাত বুলিয়ে ভাবল নানা কথা।
সেদিন হেলাল সাহেবের সাথে ঝগড়া করতে গিয়ে মাটিতে পতিত হওয়ায় এখনো ব্যথা রয়ে গেছে। ডাক্তারে আরো যাবে দু-একদিন পর। যদি এর মধ্যে ব্যথা কমে যায় তাহলে ডাক্তার দেখানোর জন্য যে টাকা নাছির সাহেব দিয়েছেন তা সে মেরে দিবে। নিজের অতর্কিত চিন্তাগুলো একপাশে রেখে জুসে আরেকটা চুমুক দিল। খোপা করা চুলগুলো থেকে বের হওয়া ছোট চুলগুলো ভালো করে কানের পেছনে গুজে নিয়ে মাথায় কেলভিন কেলিনের লগো বিশিষ্ট কালো ক্যাপটা পরে নিল। এহসান আর এশমাম নুসরাতের সামনে ভীতু চোখে বসে আছে। নুসরাত চোখ সরু করে চেয়ে মৃদু কন্ঠে জিজ্ঞেস করল,”কী খাবে?

নিজের হাতের দশ টাকার জুসের বোতলটা এগিয়ে দিল সামনের দিকে। এহসান আর এশমাম দু-পাশে মাথা না ভঙ্গিতে নাড়াতেই নুসরাত বলে ওঠল,”গুড। আমি চাইলেও দিতাম না। ভদ্রতার খাতিরে জিজ্ঞেস করেছি আপনাদের। তো যা বলছিলাম! কী বলছিলাম আসলে?
দু-জন একসাথে বলে ওঠল,
“কিছু বলছিলেন না।
” তো বসে আছো কেন, যখন আমি কিছু বলছিলাম না। আজব মানুষ বসে বসে আমার মুখ দেখছ কেন, যাও নিজেদের কাজে বিদেয় হও।
এহসান আর এশমাম ওঠে দাঁড়াল। কিছুক্ষণ আগে ব্যাটের বারি খাওয়ায় হাঁটতে গিয়ে বেগ পোহাতে হলো। পা টেনে টেনে চলে যেতেই সেখানে এসে উপস্থিত হলো ইরহাম। নিজের পকেট থেকে ফোন বের করে দিয়ে নুসরাতের উদ্দেশ্যে বলল,”একটা এসথেটিক পিক তুলে দে তো।
নুসরাত ফোন হাতে নিয়ে ইরহামের ঘুরিয়ে ফিরিয়ে কয়েকটা পিক তুলে দিতে দিতে বলে ওঠে,”নতুন ট্রেন্ডিং এ একটা ভিডিও আসছে, ওইটা দেখছিস?
ইরহাম অবাক চোখে চেয়ে বলে ওঠে,

“নতুন ট্রেন্ড ভিডিও এসেছে আর তুই আর আমি এখনো তৈরি করিনি, এমন-কী আমি জানি না।
ইরহাম এগিয়ে আসতে আসতে নুসরাতকে জিজ্ঞেস করল,”তুই আমাকে জানাসনি কেন?
নুসরাত সে কথার উত্তর দিল না। মৃদু কন্ঠে বলে ওঠল,” সেটা ছাঁড়, চল ট্রেন্ডটা খেয়ে দেই। ট্রেন্ডের মাইরি বাপ করে ছেঁড়ে দেই আমি আর তুই মিলে। তারপর ভিউ আর ভিউ। আমি আর তুই ভাইরাল।
ইরহাম গোল গোল চোখে চেয়ে মাথা নাড়াল। নুসরাত কে জিজ্ঞেস করল,”আগে বল কোন ট্রেন্ডটা?
নুসরাত কপাল কুঁচলে হালকা গলায় বলে ওঠে,”ওই যে হাত ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে করে। কী যেন, স্নিকার স্নিকার স্নিকার, ওয়াইফি ওয়াইফি ওয়াইফি।
ইরহামের নুসরাতকে শুধরে দিয়ে বলে,

“স্নিকার নয় স্নাইপার।
” ওই একই হলো।
ইরহামের হাত থেকে মোবাইলটা কেড়ে নিয়ে ঘাসের উপর ধুপ করে বসে পড়ল নুসরাত। ইরহাম নুসরাতকে বসে যেতে দেখে নিজেও পাশ ঘেঁষে বসে পড়ল ঘাসের ওপর। নুসরাত পকেট থেকে টেনে টিস্যু বের করে আনলো। ইরহাম পাশে বসে কোনো প্রশ্ন ছাড়া চুপচাপ চেয়ে দেখল নুসরাতের কর্মকান্ড। নুসরাত টিস্যুর টুকরো দু-হাতের তালুতে মলে নিজের পায়ের চতুর্থ আঙুলে পরে নিল। ইরহামের পায়ের আঙুলে ও টিস্যুর টুকরো দিয়ে গোলাকার আংটি বানিয়ে পরিয়ে দিল।
তারপর মোবাইল হাতে তুলে নিল। গান বেজে ওঠতেই ইরহাম ক্যামেরায় নিজের পায়ের দিকে তাক করে চতুর্থ আঙুল ক্যামেরার সামনে এনে দোলাতে লাগল। ব্যাকরাউন্ড বিটের সাথে মিলিয়ে নিজের গলায় গেয়ে ওঠল,”হেডা, হেডা, হেডা, হেডা, হেডা।

অতঃপর নুসরাতের পায়ের দিকে ক্যামেরা ঘুরিয়ে নিল। নুসরাত হেসে ওঠল এমন ট্রেন্ডের বিনাশ করতে গিয়ে। তাই নিজেও ইরহামের মতো ব্যাকরাউন্ড বিটের সাথে মিলিয়ে পায়ের আঙুল নাচাতে নাচাতে গেয়ে ওঠল,”সাউয়া, সাউয়া, সাউয়া, সাউয়া, সাউয়া।
ভিডিও তৈরি করে নিজেদের টিকটক আইডিতে পোস্ট করে দিল। তারপর ওঠে দাঁড়াতে দাঁড়াতে নিজেদের দিকে তাকিয়ে দু-জনে হেসে দিল। নুসরাত এক হাতে ইরহামের কাঁধ জড়িয়ে নিতে নিতে বলে ওঠল,”একদম ট্রেন্ড খাইয়া দিছি তুই আর আমি মিলে। দেখি এবার কে বানায় এই স্নিকার, স্নিকার, স্নিকারের ভিডিও।
ইরহাম নিজেও হেসে ওঠল। নিজের হাত দিয়ে নুসরাতের কাঁধ জড়িয়ে ধরে হাঁটা ধরল। বাড়ির পথে যেতে যেতে দু-জনের দেখা হলো সৌরভির সাথে। সৌরভির সামনে দাঁড়িয়ে ইরহাম কথা বলতে নিলে সে পাশ কাটিয়ে চলে গেল। ইরহাম গোল গোল চোখে পিছু ফিরে চেয়ে দেখল সৌরভির মুখ ঘুরিয়ে চলে যাওয়া। নুসরাতের দিকে ঘুরে মলিন মুখে জিজ্ঞেস করল,”ও আমার সাথে কথা বলল না কেন?

নুসরাত দু-কাঁধ ঝাঁকায়। দু-পাশে মাথা নাড়িয়ে জানায় সে জানে না। অতঃপর ইরহামের পিঠে হাত বুলিয়ে দিয়ে বলে ওঠে,”কথা না বললে তোর তো কোনো সমস্যা হওয়ার কথা না। কোনো সমস্যা হচ্ছে কী?
ইরহাম নুসরাতের প্রশ্নাত্মক চাহনিতে দু-পাশে মাথা নাড়াল মলিন মুখে। মিনমিন করে বলতে লাগল,”তেমন কিছু না। এমনি জিজ্ঞেস করছি!
ইরহাম কথার উত্তর দিয়ে সামনের দিকে চুপচাপ হাঁটতে লাগল৷ নুসরাত শুধু তীক্ষ্ণ চোখে লক্ষ করল ইরহামের হঠাৎ করে মুখ কালো করে নেওয়া। নিজে থেকে আর কোনো কথা বলতে গেল না ইরহামের সাথে। ইরহামের সাথে তাল মিলিয়ে হাঁটতে হাঁটতে কিছু একটা ভেবে মুখ অন্ধকার হয়ে আসলো তার।

হেলাল সাহেব পেছনে হাত বেঁধে অনেক পায়চারি করার পর শেষ পর্যন্ত মাথা একটা বুদ্ধি খেলে গেল। জীবনে সর্ব প্রথম ভুল ছিল উনার মরহুম বাবার বিরুদ্ধে যাওয়া আর দ্বিতীয় ভুল ছিল এই দুই গাধাকে ইসরাতের পেছনে লাগানো। কতটা টাকা খরচ হয়ে গেল এই কাজ করতে গিয়ে। চিন্তা করতে করতে সিঁড়ি বেয়ে ওঠে গেলেন তিনি। নিজের রুমে না গিয়ে অগ্রসর হলেন আরশের রুমের দিকে। দরজা ঠেলে ভেতরে ঢুকতেই নাকে এসে লাগল পুরুষালি পারফিউমের সুগন্ধ। ধীরে ধীরে ঘরে প্রবেশ করতেই দেখলেন সোফার উপর কাপড়ের স্তূপ রাখা। একইভাবে বিছানার উপর হুডি, ড্যানিম জ্যাকেট, ওভারসাইজড টিশার্ট গুলো অগোছালোভাবে ফেলে রাখা। হেলাল সাহেব আরশের ট্রলির চেইন খুলে নিলেন। ট্রলি ভর্তি হাত ঘড়ি। আরশের উপর একটু বিরক্ত হলেন হেলাল সাহেব। এই মাথা মোটা লাগেজ ভর্তি শুধু ঘড়ি নিয়ে আসছে! নাক কুঁচকে নিয়ে বিছানার উপর হাত দিয়ে হাতালেন। নিজের প্রয়োজন মাফিক জিনিসগুলো নিয়ে রুম থেকে আলগোছে বের হয়ে আসলেন। আসতে আসতে দরজা লক করতে ভুললেন না।৷

নিজের রুমে ঢুকে উচ্চ শব্দে নিজের স্ত্রীকে ডেকে ওঠলেন। লিপি বেগম মৃদু কন্ঠে জবাব দিলেন,”আসছি।
কিৎকাল কেটে গেলে লিপি বেগম এসে রুমে প্রবেশ করলেন। রুমের দরজা হালকা লাগিয়ে নিয়ে সামনে তাকাতেই একজন অপরিচিত ব্যক্তিকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখলেন। মুখ দিয়ে বের হয়ে আসলো আত্মচিৎকার। ভয় পেয়ে দৌড়ে রুম থেকে বের হতে যাবেন, হেলাল সাহেব লিপি বেগমের হাত চেপে ধরলেন। ফল কাটার ছুরি চেপে ধরলেন লিপি বেগমের গলায়। লিপি বেগম চোখ বড় বড় করে কাঁদো কাঁদো কন্ঠে জিজ্ঞেস করলেন,”ককে আপনি? আমার হাজবেন্ড কোথায়?

হেলাল সাহেব কথার উত্তর দিলেন না। হাতের ছুরি আরেকটু দাবিয়ে ধরলেন লিপি বেগমের গলায়। লিপি বেগম বিরশ মুখে ভয়ে ঢোক গিলে নিয়ে পেছনে সরে গেলেন। পায়ের সাথে পা বেজে ধাক্কা খেলেন দেয়ালের সাথে। ভয়ে শঙ্কিত হওয়া চেহারায় বলে ওঠলেন,”দয়া করে ছেড়ে দিন, আমি কী করেছি? আর আমার স্বামী বা কোথায়?
হেলাল সাহেব স্ত্রীর ভয়ে শঙ্কিত হওয়া চেহারা দেখে হা হা করে হাসলেন। হাতের ছুরি ছুঁড়ে ফেলতে ফেলতে মুখ থেকে কালো ওয়ানটাইম মাস্ক খুলে নিলেন। চোখ ছোটো ছোটো করে লিপি বেগমের উদ্দেশ্যে বললেন,”নিজের স্বামীকে চিনলে না লিপি? আজ গিয়ে প্রমাণ হয়ে গেল, ত্রিশ বছরের এই সংসারে তুমি আমাকে এখনো ভালো করে চিনতেই পারোনি। কী ভয়টাই না ছিল তোমার চোখে!

লিপি বেগম যখন বুঝলেন এতক্ষণ যাকে অপরিচিত আগন্তুক ভেবেছিলেন সে আর কেউ নয় তার স্বামী তখন মেজাজ চড়ে গেল দপদপ করে। দাঁতে দাঁত চেপে স্বামীর বেশভূষা দেখলেন। গলবিলে তিতা কথা চেপে ঠাট্টা করে জানতে চাইলেন,”এমন কার্টুন সেজেছেন কেন?
হেলাল সাহেব স্ত্রীর দিকে তেছরা চোখে তাকালেন। আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে আগ-পিছ দেখতে দেখতে বললেন,”কোথায় কার্টুন লাগছে? ভালোই তো লাগছে।
আবারো আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে চুলে হাত বুলাতে বুলাতে বললেন,”আরশের কাপড়ে একটু বেশি হ্যান্ডসাম লাগছে মনে হচ্ছে।

লিপি বেগম কথা বললেন না। দাঁতে দাঁত চেপে দাঁড়িয়ে হাতের মুঠোয় কাপড় একদলা চেপে ধরলেন। নিজেকে স্বাভাবিক রাখার বৃথা চেষ্টা করে জিজ্ঞেস করলেন,”এই নাটক সাজছেন কেন?
হেলাল সাহেব চুল ভালো করে সেট করে নিলেন। গায়ে পারফিউম ব্যবহার করে, মুখে একটু লোশন লাগিয়ে নিলেন। ডেনিম জ্যাকেটের কলার ঠিক করে নিয়ে মাথায় ব্যাকেট হ্যাট পরে নিলেন। ডেনিম জ্যাকেটের বোতাম টেনে লাগাতে পারলেন না। স্ত্রীর উদ্দেশ্য বললেন,”সামান্য পেট উঁচু হওয়ায় বোতাম গুলো লাগছেই না!
লিপি বেগম তাচ্ছিল্য করে হেসে ওঠলেন। হেলাল সাহেবকে উদ্দেশ্য করে বললেন,”সামান্য পেট উঁচু? হাসালেন আপনি।

“তাহলে কী বেশি উঁচু হয়ে গেছে?
হেলাল সাহেব মাস্ক পরে নিয়ে উদ্বেগপূর্ণ কন্ঠে জিজ্ঞেস করলেন। লিপি বেগম নিরর্থক অভিমত পোষণ করলেন। হেলাল সাহেব আবারো স্টাইল করে একটা ব্যাগ কাঁধে ঝুলিয়ে নিতে নিতে স্ত্রীকে জিজ্ঞেস করলেন,” আজকে একটু বেশি হ্যান্ডসাম লাগছে তাই না?
লিপি বেগম নাক কুঁচকালেন। ঠোঁটে ব্যঙ্গাত্মক হাসি ঝুলিয়ে বলে ওঠলেন,”জি, অনেক বেশি হ্যান্ডসাম লাগছে আপনাকে।

হেলাল সাহেব রুম থেকে বের হতে হতে বলে ওঠলেন,”শেষ পর্যন্ত স্বীকার করলে আমি এখনো হ্যান্ডসাম। হাহ..! আমাকে হিংসে করো, তা কী আমি বুঝি না? হুহ… যতই হিংসে করো লিপি আমার মতো হ্যান্ডসাম হতে পারবে না।
লিপি বেগম অতিষ্ঠ হয়ে গেলেন নিজের স্বামীর এমন ব্যবহারে। টিপ্পনী কেটে, অক্ষিকোটর প্রশস্থ করে, স্বামীর পিছু পিছু রুম থেকে বের হয়ে আসতে আসতে জিজ্ঞেস করলেন,”আপনার মতো কে হতে চায়? আমার বয়ে গেছে আপনার মতো হবো বলে।

হেলাল সাহেব হেসে ওঠলেন। সিঁড়ি বেয়ে বড় বড় পা ফেলে নামতে নামতে বলে ওঠেন,”হ্যাঁ হ্যাঁ আমি সবই জানি। হিংসে করো আমাকে! এই রুপের জন্য, যৌবনকালে আমাকে বিয়ের করার জন্য তুমি দেওয়ানা ছিলে। আর আজ আমাকে মোটা বলে অপমান করছ, ভালো হয়ে যাও লিপি। ভালো হতে টাকা লাগে না।
লিপি বেগম কোনো শব্দ ব্যয় করার আগেই হেলাল সাহেব বাড়ি থেকে বের হয়ে গেলেন। পেছন থেকে চেঁচানো স্বর এলো লিপি বেগমের। তিনি জিজ্ঞেস করছেন,”আরে কোথায় যাচ্ছেন এত সেজেগুজে সেটা তো বলে যান?
হেলাল সাহেবের পুরুষালি গম্ভীর কন্ঠে স্বর ভেসে এলো বাড়ির বাহির থেকে,”তোমার জন্য একজন সুন্দরী সতিনের ব্যবস্থা করতে যাচ্ছি।

নুসরাত আর নাছির সাহেব ইসরাতের বারান্দায় বসে চায়ের আড্ডা দিচ্ছেন। দু-জনের চায়ের আড্ডা জমে ওঠেছে এতক্ষণে। নুসরাত চায়ে চুমুক দিয়ে নাছির সাহেবকে জিজ্ঞেস করল,”আব্বা কেমন চলছে আপনার ব্যবসা?
নাছির সাহেব নিজেও চায়ে এক চুমুক দিলেন। আশেপাশে চোখ বুলিয়ে বাড়ির পরিবেশ দেখতে দেখতে বললেন,”ভালো। কবে থেকে এসে বসছ ওখানে?
নুসরাত হাই তুলল। নিজের হুডির ক্যাপ টেনে মাথায় তুলে নিয়ে এক পা তুলে বসল বেতের সোফার ওপর। অলস ভঙ্গিতে বলে ওঠল,”আব্বা আমার দ্বারা এসব সম্ভব না।
নুসরাত অনিহা নিয়ে উত্তর করতেই নাছির সাহেব তড়াক করে একপেশে ভ্রু কুঁচকে জিজ্ঞেস করলেন,”কেন?
নুসরাত চায়ে চুমুক দিল। হালকা হাতে ভ্রু চুলকে নিয়ে বলে ওঠল,”ইন্টারেস্ট নেই আব্বা, আপনে তো জানেন। তারপর ও কেন জিজ্ঞেস করছেন? ইসরাতকে বলুন না বসার জন্য!

নাছির সাহেব কিছুটা বিরক্তি নুসরাতের দিকে তাকালেন। চোখের মণি সামান্য কুঞ্চিত করে নিষ্প্রভ কন্ঠে বললেন,”ও কাপড়েরটা সামলাচ্ছে, তুমি না হয় মেকআপ আর পারফিউমেরটা সামলাও।
নুসরাত কান খোঁচাল সামান্য। চোখ আশেপাশে ঘুরিয়ে বলল,”হবে না আমার দ্বারা।
নাছির সাহেব কিছু বলার আগেই গেটের দিকে তীক্ষ্ণ চোখে তাকিয়ে নুসরাত ওঠে দাঁড়াল। ইশারা দিয়ে না করল নাছির সাহেবকে কথা না বলার জন্য। চোখ ছোটো ছোটো করে এগিয়ে আসে বারান্দার রেলিঙের দিকে। দু-হাতে চেপে ধরে রেলিঙ। নাছির সাহেব নিজেও চায়ের কাপ সেন্টার টেবিলে রেখে এসে যোগ দিয়েছেন নুসরাতের সাথে। নিজেদের বাড়ির গেটের সামনে অদ্ভুত বেশভূষায় দাঁড়ানো লোকটাকে দেখে একটু চিন্তিত হলেন নাছির সাহেব। নুসরাতকে উদ্দেশ্য করে বললেন,”মনে হয় গরীব মানুষ। যাও টাকাগুলো দিয়ে আসো।

পকেট থেকে টাকা বের করে নাছির সাহেব নুসরাতের হাতে দিলেন। নুসরাত পাঁচশত টাকার কড়কড়ে নোটখানা হাতে নিয়ে অবাক হলো। বিস্ময় প্রকাশ করে উপরে তুলে ভালো করে সূর্যের আলোয় দেখে নেয় আসল কী-না নকল। নাছির সাহেব নুসরাতের এমন কান্ডে বিস্মিত হন। অবাক কন্ঠে জিজ্ঞেস করেন,”কি হয়েছে? এভাবে আলোয় নিয়ে টাকা দেখছ কেন?
“আসলে আব্বা দেখছিলাম টাকা আসল না-কী নকল। আপনি তো আবার কাউকে পাঁচশত টাকার দেওয়ার মানুষ না। এত টাকা আপনার পকেট থেকে কীভাবে বের হয়েছে তাই ভাবছি!

নুসরাত নাছির সাহেবের কথার উত্তর ঝটপট দিল। রেলিঙে ধরে সামান্য উঁকি দিতেই দেখে অদ্ভুত পোশাক পরিহিত লোকটা পাইপের কাছে এসে দাঁড়িয়ে হাত দিয়ে চেপে ধরে আছে। নুসরাত চোখ প্রশস্থ করে সতর্ক গলায় চিৎকার করে ওঠল। নাছির সাহেবের কাঁধ ঝাঁকিয়ে ফিসফিসিয়ে বলল,”আব্বা চোর, চোর, চোর। দিনে-দুপুরে চুরি করতে চলে আসছে। চলুন এভাবে আর বসে থাকা যায় না। চোরকে আপনি পাঁচশত টাকা দিতে চাচ্ছেন আর চোর আপনার বাড়ি লুটপাট করতে চলে আসছে। আজ একটা চোরকে উচিত শিক্ষা দিতে হবে।

নুসরাত টেনে নিয়ে গেল নাছির সাহেবকে নিজের সাথে। বাড়ি থেকে বের হতে হতে মাঝারি সাইজের দুটো লাঠি হাতে নিয়ে নিল সে। সতর্কতার সহিত বাড়ি থেকে বের হয়ে আসলেন নাছির সাহেব সাথে নুসরাত। নাছির সাহেবকে নুসরাত চোখ দিয়ে ইশারা করতেই নাছির সাহেব লাফ দিয়ে গিয়ে লোকটার গলা চেপে ধরলেন নিজের হাতের ভাঁজে। লোকটা যাতে চিৎকার করতে না পারে তাই একহাতে মুখ চেপে ধরলেন। নুসরাত লোকটার সামনে দাঁড়িয়ে হাতের লাঠিটা মাটির উপর ভর দিয়ে রেখে নাক টানল। তারপর নাছির সাহেবের উদ্দেশ্যে বলল,”আব্বা চোর তো দেখি ব্রান্ডেড চোর। সেনেলের পারফিউম ব্যবহার করেছে।
নাছির সাহেবের হাত থেকে বারবার ছুটার চেষ্টা করছে লোকটা। নাছির সাহেব কাঁধে হাতের কব্জা দিয়ে একটা মেরে নিচের দিকে ঝুঁকিয়ে রাখলেন অদ্ভুত বেশভূষা ধারী লোকটাকে। নাছির সাহেব রাগী কন্ঠে বললেন,”হয়তো ছাগলটা কোথা থেকে চুরি করেছে পারফিউমটা।

নুসরাত উপর নিচ মাথা নাড়িয়ে নাছি সাহেবের কথায় সমর্থন জানাল। হাতের লাঠি তুলে লোকটাকে মারতে গিয়ে থেমে গেল। তর্জনী আঙুল ঠোঁটে রেখে বলে ওঠল,”আব্বা এই চোর তো দেখি বড়লোক্স চোর। মাথায় ব্রান্ডেড ব্যাকেট হ্যাট লাগিয়েছে আবার কাপড় চুপড় ও ব্রান্ডেড। তাহলে আমাদের বাড়িতে কী চুরি করতে আসছে?
নুসরাত লাঠি দিয়ে মাটিতে আঘাত করতে করতে ভাবতে লাগল। তারপর তড়াক করে বলল,”আপনাকে নয় তো?
নাছির সাহেব আরেকটা কিল মারলেন লোকটার পিঠে যাতে নড়াচড়া করতে না পারে লোকটা। নুসরাতের কথায় অট্টহাসি দিয়ে নুসরাতকে প্রশ্ন করলেন,”আমাকে কেন চুরি করতে আসবে?

নুসরাত চোরকে বেশি লাফঝাপ করতে দেখে লাঠি তুলে ধীরে একটা বারি বসাল চোরের হাতে। তেমন একটা জোরে বসালো না। নাছির সাহেব এখনো শক্ত করে চেপে ধরে রেখেছেন লোকটাকে। নুসরাত কপালে ভাঁজ ফেলে বলল,”হয়তো আপনাকে কিডন্যাপ করে আপনার সকল সম্পত্তি নিজের নামে লিখিয়ে নিবে?
নুসরাতের কথায় নাছির সাহেব অট্টহাসিতে ফেটে পড়লেন। লোকটাকে নিচের দিকে আরেকটু ঝুঁকিয়ে চেপে ধরে ভাষণ দেওয়ার ন্যায় বলে ওঠলেন,”আরে না, আমার সব সম্পত্তির ব্যবস্থা আমি করে রেখেছি। আমি মরে গেলেও আমার সম্পত্তি তুমি আর ইসরাত ছাড়া কেউ পাবে না।
নুসরাত লোকটার গায়ে আস্তে করে আরেকটা বারি দিল। নাছির সাহেব চিরচিরে কন্ঠে নুসরাতের উপর বিরক্ত হয়ে বলতে লাগলেন,”কী? এত ধীরে মারছ কেন এই চোরকে, জোরে বারি দাও যাতে আর কারোর বাসায় গিয়ে দিনে দুপুরে চুরি করার সাহস করে না।
নুসরাত মোলায়েম কন্ঠে বলে ওঠে,

“আব্বা দেখতে তো বুড়োর মতো লাগে। তাই আমি একটু আস্তে ধীরে বারি দিচ্ছি। আপনি লাগিয়ে দেন দু-চারটা! আমি আবার উত্তেজনার বসে দু-ঘা লাগালে বুড়োটা একদম পগারপার হয়ে যাবে।
নুসরাত হাত দিয়ে দেখাল মরে যাবে তারপর হাত উপরে তুলে আকাশের দিকে আঙুল তাক করল। নাছির সাহেব নুসরাতের কথা শুনে সর্বোচ্চ শক্তি লাগিয়ে একটা ঘুষি মারতে নিবেন নুসরাত বলে ওঠল,” আব্বা থামেন। আগে চোরের মুখটা দেখে নেই। কে এই চোর যে আমার আর আপনার মতো সাহসী ঝগরুটে লোকের বাড়িতে দিনে দুপুরে ডাকাতি করতে আসে! আমাদের বিষয়ে এই বুড়োকে কী কেউ জানায়নি?

নুসরাত লাঠি দূরে ছুঁড়ে ফেলে লোকটার সামনে এসে দাঁড়াল। হাত ঝাড়া দিয়ে লোকটার মুখ থেকে তাবা মেরে খুলে নিল ব্যাকেট হ্যাটটা। এতক্ষণ লোকটার চোখ ব্যাকেট হ্যাটের আড়ালে ঢেকে থাকলেও এবার তা দৃশ্যমান হয়ে গেল। নুসরাত লোকটার চোখের দিকে না তাকিয়ে নাছির সাহেবের দিকে তাকিয়ে বলে ওঠল,”আব্বা এই বেডার মাথা দেখতে আপনার বিদেশ ফিরত আম্বানি বুড়ো ভাইয়ের মতো মনে হচ্ছে ।
নুসরাত নাছির সাহেবের সাথে কথা বলতে বলতে লোকটার মুখ থেকে টেনে হিঁচড়ে মাস্ক খুলে নিয়ে আসলো। নাছির সাহেবের দিকে থেকে চোখ ফিরিয়ে আনতে আনতে বলল,”দেখি সোনার চান্দ, তোর সোনা মুখটা দেখি। কত্ত বড় সাহস তোর! আমি নুসরাত নাছির এই বাড়িতে উপস্থিত থাকতে তোর চোরের এত সাহস, যে আমাদের বাড়িতে ঢুকে চুরি করার ধান্দা করররররছছছচ…

নুসরাত মাছের মতো হা করে চেয়ে রইল লোকটার দিকে। নাছির সাহেব নুসরাতকে কথা বলতে বলতে এমন করে থেমে যেতে দেখে অবাক হলেন। ফিকে হয়ে যাওয়া কন্ঠে জিজ্ঞেস করলেন,”কী হয়েছে? এরকম তোমার মুখ চুপসে গিয়ে হা হয়ে গেল কেন?
নুসরাত কথার উত্তর দিল না। ভেটকানো মার্কা চেহারা নিয়ে চেয়ে রইল সামনের দিকে হা করে। নাছির সাহেব লোকটার পেঁচানো গলা ছেড়ে দিয়ে সামনে আসতে আসতে নুসরাতকে ধাক্কা দিয়ে বললেন,”দেখি সর তো, এমন হা করে আছিস কেন? কার এমন মুখ দেখল….

নাছির সাহেব নিজেও থমকে গেলেন। নিজের বড় ভাইকে সামনে দাঁড়ানো দেখে কিৎকালের জন্য থমকালেন। জিহ্বার ডগায় থাকা কথাগুলো মিলিয়ে গেল নিমেষে। হেলাল সাহেব রাগে কড়মড় করে ক্ষুব্ধ চোখে দু-জনের দিকে তাকিয়ে আছেন। নুসরাত ঢোক গিলে নিজের হা করা মুখ বন্ধ করে নিল। জিহ্বা দিয়ে ঠোঁট মুছে নাছির সাহেবের দিকে ফিরে তাকাল। নাছির সাহেব ও একই সময় নুসরাতের দিকে অপ্রস্তুত ভঙ্গিতে তাকিয়েছেন। বাপ-মেয়ে একসাথে দু-জনের দিকে তাকিয়ে থেকে মাথা নাড়াল। নুসরাত ইশারা করল নাছির সাহেবকে আগে কেটে পড়ার জন্য। তাই নাছির সাহেব আলগোছে হেলাল সাহেবের লাল হয়ে যাওয়া চোখের দিকে এক পলক চেয়ে নিয়ে বড়ো বড়ো পদক্ষেপে বাড়ির দিকে চলে গেলেন। নুসরাত মনে মনে নিজেকে বলল,”পালা নুসরাত, পালা।

প্রিয় প্রণয়িনী ২ পর্ব ১৬

হেলাল সাহেবের দিকে চোখ বুলাতেই শুভ্র মুখে রাগের প্রতিফলন দেখল। চোখ উপরে তুলতেই চোখাচোখি হলো রক্ত বর্ণের চোখগুলোর সাথে। নুসরাত নাছির সাহেবের পেছন থেকে প্রশস্থ গলায় চিৎকার করে ডেকে ওঠল,” আব্বা, ও আব্বা, আমাকে একা রেখে আপনি পালাচ্ছেন? আমাকে নিয়ে যান। আমি নিষ্পাপ বাচ্চা কী করেছি? নিজের বাচ্চা মেয়েকে এভাবে একা ফেলে রেখে যেতে আপনার বিবেকে নাড়া দিল না।
নুসরাত উচ্চ শব্দে চেঁচিয়ে ওঠে হেলাল সাহেবকে না দেখার ভঙ্গিতে পাশ কাটিয়ে দৌড়ে সামনের দিকে চলে গেল।

প্রিয় প্রণয়িনী ২ পর্ব ১৮

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here