প্রিয় প্রণয়িনী ২ পর্ব ১৮
জান্নাত নুসরাত
আকাশে থোকা থোকা মেঘ জমেছে। থেকে থেকে সেই মেঘ ডেকে ওঠছে একটু পরপর। বৃষ্টি আসার তোড়জোড় চলছে ভালোভাবে। নাছির মঞ্জিলের ড্রয়িং রুমের পর্দা বাতাসের তোপে আকাবাঁকা হয়ে নিজ মনে দোল খাচ্ছে। ঝিরিঝিরি বৃষ্টি নীল দিগন্তে পড়তেই ঠান্ডা আবহ এসে প্রবেশ করল নাছির মঞ্জিলে। বিদুৎ সংযোগ ছুটল তখনই। শীতল গা হীম বাতাস এসে প্রবেশ করল থাইগ্লাস হয়ে ফরফর করে। সেই বাতাসের সাথে নাছির সাহেবের শীতল দৃষ্টি এসে পড়ল নুসরাতের উপর। নুসরাত নিজেও চোখ বড় বড় করে নিজের বাবার দিকে তাকাল। নাকের পাটাতন ফুলে ওঠল তৎক্ষণাৎ। নাছির সাহেব নিজেও মেয়ের দিকে চেয়ে আছেন নাক ফুলিয়ে। গর্জে ওঠে বললেন,”সব দোষ তোমার!
নুসরাত নিজেও গর্জে ওঠল। রাগের বহিঃপ্রকাশ ঘটল তাৎক্ষণিক। নিজেও চিৎকার করে বলে,”সব দোষ আপনার আব্বা।
নাছির সাহেব নুসরাতকে শুধরে দিয়ে বললেন,
“না,সব দোষ তোমার।
“জি না আব্বা, সব দোষ আপনার। আপনি আগে দেখলেন না কেন?
নাছির সাহেব নিজের মুখের ঘাম হাত দিয়ে মুছে নিলেন। নুসরাতকে বললেন,”আমাকে দোষ দিচ্ছ কেন? তুমি দেখতে পারোনি চোরটা আসলে কে?
নুসরাত দ্বিগুণ জোরে চিৎকার দিয়ে ওঠল। শক্ত কন্ঠে বলল,” আপনি দেখলেন না কেন, যে চোরটা আপনার শ্রদ্ধেয় বড় ভাই! আমাকে দোষ দিচ্ছেন কেন এখন আপনি? আব্বা মেনে নিন, সব দোষ আপনার।
নাছির সাহেব মানলেন না। নুসরাতকে দোষারোপ করে বলে ওঠলেন,”এ্যাহ বললেই হলো, সব দোষ তোমার। আমি তো চোর বলিনি, তুমি আগে বলেছ চোর।
আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন
“আব্বা আমি চোরকে আগে দেখিনি, আপনি আগে দেখেছেন।
” নুসরাত অস্বীকার করো না, তুমি কী মিথ্যাবাদী! এখন আমাকে ফাঁসিয়ে দিচ্ছ দোষ তোমার আর চাপাচ্ছো আমার উপর। তুমি আগে দেখেছিলে, আমি তো আরো মানবতা দেখিয়ে কিছু টাকা দিতে চাইছিলাম কিন্তু তুমি চোর বলে লাঠি নিয়ে বের হয়ে গেলে বড় ভাইকে মারতে।
নুসরাত চোখ তীক্ষ্ণ করে বলে ওঠে,
“আব্বা কী মিথ্যাবাদী আপনি, নিজের নিষ্পাপ,ভোলাভালা চেহারার নাদান বাচ্চাকে ফাসিয়ে দিতে আপনার লজ্জা করল না? এতবড় আরুপ নিয়ে কীভাবে বেঁচে থাকব? একদম আরাম করে বেঁচে থাকব সারাজীবন। আপনি মানতে বাধ্য আব্বা সব আপনার কারণে হয়েছে।
নাছির সাহেব নুসরাতকে মুখ ঝামটা দিয়ে অস্বীকার করলেন তিনি এরকম কিছু করেননি, এতে তার কোনো দোষ নেই। নুসরাত নিজেও বুকে আড়াআড়ি হাত বেঁধে মুখ ফিরিয়ে রাখল। শরীরে প্রতিটি শিরা উপশিরা সোজা করে টানটান হয়ে দাঁড়িয়ে রইল। নিজেকে সত্য প্রমাণ করার জন্য। সময় কাটল দু-জন চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকতে থাকতে পা ব্যথা শুরু হলো। আলগোছে দু-জন দু-জনকে পাত্তা না দিয়ে গিয়ে বসে পড়ল সোফায়। নুসরাত পায়ের উপর পা তুলে বসতে বসতে পকেট থেকে নিজের সাদা ফ্রেমের চশমা বের করল। চোখে লাগিয়ে ভাব নিয়ে সোজাসোজি হয়ে বসে রইল। নাছির সাহেব নিজেও এরকম করলেন।
মমো আর আহানের আগমন ঘটল তখন দো-তলা থেকে। দূর হতে বাপ – মেয়ের অদ্ভুত কান্ডকারখানা গুলো লক্ষ করল দু-জন। একজন আরেকজনের দিকে তাকিয়ে ভ্রু বাঁকিয়ে চলে গেল কিচেনের দিকে। নাজমিন বেগমের সন্নিকটে দাঁড়িয়ে আহান ফিসফিস করে ডেকে ওঠল,”মেজ আম্মু, দেখে যাও মেজ আব্বু আর আপু মিলে ড্রয়িং রুমে কী একটা নাটক জুরে দিয়েছে।
নাজমিন বেগম পাত্তা দিলেন না। নিজের কাজে একান্ত ব্যস্ত হয়ে, বিনা উদ্বেগে আওড়ালেন,”বাপ-মেয়ে যা ইচ্ছে করুক। তোরা দু-জন শুধু দূরে থাক, আর কিছু করিস না। এই উপকারটা কর আমাকে।
আহান নাজমিন বেগমের কাঁধ জড়িয়ে ধরল। মমো নিজেও অন্যপাশ জুড়ে নিল নাজমিন বেগমের। দু-জন সতর্কতা সহিত চোখাচোখি করে নিল। মমো বলে ওঠল,”মেজ মামনি কিছু একটা গন্ডগোল আছে৷ নুসরাত আর মেজ মামা মিলে নির্ঘাত কোনো কিছু করেছেন, নাহলে নুসরাত এভাবে চুপ করে বসে থাকার মানুষ না।
নাজমিন বেগম সিঙ্কে বাটির স্তূপ রাখলেন। হাত ভালো করে পানি দিয়ে পরিস্কার করে নিলেন। তোয়ালি হাতে নিয়ে অবশিষ্ট হাতের পানি মুছে অগ্রসর হলেন ড্রয়িং রুমের দিকে। মমো আর আহান ও পিছু পিছু যেতে শুরু করল। নাজমিন বেগম স্বামীর সামনের সোফায় বসে জিজ্ঞেস করলেন,”কী হয়েছে?
নাছির সাহেব আর নুসরাতের সরু দৃষ্টি এক সাথে এসে পড়ল নাজমিন বেগমের উপর। নাজমিন বেগম কপাল কুঞ্চিত করে স্বামীর দিকে তাকিয়ে রইলেন প্রশ্নের উত্তর পাওয়ার আশায়।
নাছির সাহেব একটু সময় নিয়ে দীর্ঘশ্বাস ফেললেন। স্ত্রীর দিকে ঘোলাটে চোখে চেয়ে আড়ষ্ট গলায় আওড়ান,”বড় ভাইকে চোর ভেবে নুসরাত লাঠি পেটা করেছে।
নাজমিন বেগম মুখ চেপে ধরলেন। মমো আর আহান আতঙ্কে দু-জনের মুখ চাওয়া চাওয়ি করল। ইসরাত পেছন থেকে শঙ্কতি গলায়, আঁতকে ওঠে ডেকে ওঠল,”নুসরাত.!
নিজের দিকে সবার দৃষ্টি অনুভব করতেই নুসরাত দু-পাশে মাথা নাড়াল। নিজেকে নির্দোষ প্রমাণ করতে ঝটপট বলল,”আম্মা আব্বার সব দোষ। এখন আমার উপর চাপাচ্ছেন। উনি আগে শ্রদ্ধেয় আব্বার ভাই ইসরাতের শশুরকে দেখেছেন। আমাকে বলেছেন ওই দেখ চোর। আর আরেকটা কথা আমি আব্বার ভাই ইসরাতের শশুরকে অত্যাচার করিনি। সব কিছু করেছেন আব্বা।
নাছির সাহেব নুসরাতের দিকে চোখ গোল গোল করে তাকিয়ে বললেন,”কী মিথ্যুক তুমি আম্মা। আমি কখন আগে বললাম চোর? তুমি নিজেই বলেছ আর এখন তোমার নিজের বাপের উপর দোষ চাপাচ্ছো।?
নুসরাত চশমা নাকের ডগায় তুলে নিল। হাতের তালুতে নাক ঢলে বলে ওঠল,”আব্বা আমি কিন্তু রেগে যাচ্ছি, সত্যি করে বলে দেন সব দোষ আপনার। নাহলে…
নাছির সাহেব শক্ত কন্ঠে জিজ্ঞেস করলেন,
“নাহলে কী?
“নাহলে আপনার সব সম্পত্তি আমি বিক্রি করে দিব। আব্বা সাবধান, নিজের দোষ স্বীকার করুন আর বলুন আমি বাচ্চা শিশু নির্দোষ।
নাছির সাহেবের বিস্ময়ে কোটর থেকে চোখ বের হয়ে আসলো। নুসরাতকে কিছু বলতে নিবেন, সে হাত তুলে থামিয়ে দিল। নুসরাত নাজমিন বেগম আর ইসরাতে পানে চেয়ে নাছির সাহেবের দিকে ইশারা করে বলে ওঠল,” বিশ্বাস হলো তো আব্বার সব দোষ। আব্বা এমনি এমনি আমাকে ফাসিয়ে দিয়েছেন। হাহ..!
শরতের মেঘলা আকাশ ঘনঘন মেঘের আবাশে অন্ধকার। নীল দিগন্তে সাদা মেঘের আচ্ছাদন। মেঘেরা ডানা মেলে খেলা করছে আকাশে। বড় বড় সাদা মেঘের ভেলা গর্জন করছে কিছুক্ষণ পরপর। বিদ্যুৎ চমকানো বেড়েছে অনেক বেশি। নীল অম্বরের সাদা মেঘ বৃষ্টি হয়ে নেমে আসলো পৃথিবীতে। উত্তাল পাত্তাল বাতাসের ঢেউ এসে ছুঁয়ে গেল প্রকৃতির নৈস্বর্গিকতাকে। পানির সংস্পর্শে এসে এতদিনে ঝিমিয়ে পড়া পৃথিবী সতেজ হলো। সবুজ নির্মলতা এসে ছুঁয়ে গেল পৃথিবী। সাদা পর্দার দোদুলীয়মান নৃত্য শুরু হলো। সেদিকে মনোযোগ সহকারে চোখ রেখে হাতের কফি মগে চুমুক দিল আরশ। চোখের সাদা ফ্রেমের চশমা ভেদ করে কালো মণিগুলো অদূরে নিবিষ্ট। হাতের কাছে থাকা ফোন অনীহার সহিত হাতে তুলে নেয়। চোখ সামনে স্থির রেখে কফির মগে আবার চুমুক দেয়। গম্ভীর মুখ বানিয়ে নিজের পরণের সাদা খোলা শার্টের বোতাম গুলোর দিকে তাকাল।৷ বুকের বাঁ-পাশে বাঁধা ব্যান্ডেজের দিকে সূক্ষ্ম চোখ বুলায় বিশাল দেহী পুরুষটা।। আলতো হাতে জায়গাটা স্পর্শ করল সে। ঠোঁটের কোণে ফুটে ওঠে মৃদু হাসির ফোয়ারা। পুরুষালি ক্লিন সেভ গালে সৃষ্টি হয় গর্তের। সেটা ধীরে ধীরে আরো বেশি বৃদ্ধি পায়। নিজের মুলেট কাট দেওয়া চুলে হাত বুলায়। কপালে কাছে ছোটো ছোটো পড়ে থাকা চুলগুলো ঠেলে দেয় পেছনে। হাত সরিয়ে নিতেই তা আবারো এসে নিজের জায়গা দখল করে নেয়। আরশ নিজের কাঁধের কাছে আঁচর কাটে। ঘাড়ের কাছে পড়ে থাকা চুলগুলোতে আলতো হাত বুলায়। কিছু একটা মনে করে হাসে। কানের মধ্যে থাকা এয়ারপড ভিপ ভিপ করে ওঠতেই কানের আশেপাশে আঙুল দিয়ে হাত চালায়। নিজের গম্ভীরত্ব বজায় রেখে নিরেট গলায় শুধায়,”অপাশের অবস্থা কী ইরহাম?
ইরহামের কাঁদো কাঁদো কন্ঠ ভেসে আসে। ফিসফিস করে বলে ওঠে,”ভাই…আরেকবার ভেবে দেখা যায় না। জীবন মরণের প্রশ্ন! আস্তো গিলে নিবে আমায়।
আরশ বিরক্তিতে কপাল কুঁচকে ফেলে। নিজের হাতে থাকা কফি মগ রেখে দেয় নাইটস্টেন্ডে। ওঠে দাঁড়িয়ে সামনের বড় বারান্দার দিকে এগিয়ে যেতে যেতে বলে,”কোনো ভাবাভাবির প্রয়োজন নেই, মিসেস ইডিয়টকে তো একটু জ্বালানো যায়।
ইরহাম বিছানায় পড়ে গড়াগড়ি খায়। এই দুই জামাই বউয়ের পাল্লায় পড়ে তার না আবার জীবন হারাতে হয়। মিনমিন করে মিনতি করে বলে ওঠে,”ভাই এই বাইক ওর শখের। বাইকে আগুন দিলে, আপনার খাতারনাক বউ আমার পেছনে আগুন লাগিয়ে দিবে।
আরশ প্রখর নিঃশ্বাস ফেলে। বিরক্ত হয় ইরহামের এত কথায়। দাঁতে দাঁত চেপে, চোয়াল শক্ত করে, কিড়মিড়িয়ে ডেকে ওঠে,”ইরহাম!
ইরহাম গলার কাছে কান্না আটকে বলে ওঠে,
“জিইই ভাই।
আরশ হেঁটে বারান্দার রেলিঙের উপর হাত চেপে ধরে ঝুঁকে দাঁড়ায়। বাসার নিচের বিলাসবহুল পুলের দিকে চোখ রেখে শুধায়,” আমি যা বলছি তুই করতে পারবি নাকি আমি অন্য ব্যবস্থা করব?
ইরহাম কপালে নিজের হাত দিয়ে দুটো থাপ্পড় দেয়৷ নিজের হতভাগা কপাল দেখে নিজেরই বিরক্ত লাগছে। মিনমিন করে উত্তর দিতে যাবে, তার আগেই আরশ দাঁতে দাঁত চেপে ডেকে ওঠে,”ইরহাম!
ইরহাম নড়েচড়ে বসে। গভীর শ্বাস টেনে নিজের ভিতরে নিয়ে নেয়। অত্যন্ত দুঃখী আওয়াজে, নিজের অপগারতা লুকিয়ে বলে ওঠে,”জিইই ভাই!
আরশ রাগী কন্ঠে শুধায়,
“জি ভাই কী? আমি এটা শুনতে চাইছি?
ইরহাম ইতস্তত কন্ঠে বলে ওঠে,
” আমি বলতে চাইছি ভাই বিকেলের ভেতর সব ব্যবস্থা হয়ে যাবে।
আরশ কাটখোট্টা গলায় বলে,
“ওই বাঁচাল মহিলাকে চারটার সময় নিয়ে ফুটবল মাঠে উপস্থিত থাকিস নাহলে…
ইরহাম তাড়াহুড়ো করে বলল,
” জানি ভাই জানি! আমি উপস্থিত হয়ে যাব ঠিক টাইমে। এভাবে ধমকি দাও কেন?
আরশ কথা না বলে ইরহামের মুখের উপর ফোন রেখে দিল। ফোন ঢিল মেরে বেতের সোফায় রেখে প্রলুব্ধ শ্বাস ফেলল। আরশের শান্তিতে ভাটা দিতে হেলেদুলে আগমন ঘটল মাহাদির। আরশের খোলা বুকের দিকে তাকিয়ে হে হে করে হেসে ওঠল। শুধুমাত্র আরশকে জ্বালানোর জন্য। ব্যঙ্গাত্মক হাসতে হাসতে লুটিয়ে পড়ল বেতের সোফার উপর। পুরুষালি ভারী ওজনের শরীর বেতের সোফাটায় পড়তেই শব্দ করে নিজের জায়গা থেকে সরে গেল তা। মাহাদি হাসি থামিয়ে কিছু একটা ভেবে নিজের মুখ গম্ভীর করে নিল। তর্জনী আঙুল তুলে ঘোরাতে ঘোরাতে বলে ওঠল,”ও আমার দায়িত্ব বুঝেছিস, এর বেশি কিছু না, বেশি কথা বললে একদম জানে মেরে ফেলব তোকে। তোর দায়িত্বের অবস্থা কী? বেচারি বুঝল না কোন হিংস্র নেকড়ের গুহায় পা ফেলেছে। নেকরের বুকে একদম গুলি মেরে দিল। ওয়াহ..! তোর বউয়ের সাহস আছে বলতে হবে।
আরশ চুপচাপ নিজের জায়গায় দাঁড়িয়ে রইল। পকেট থেকে চুইংগাম বের করে তা আলগোছে মুখে ঢুকিয়ে নিল। মাহাদিকে নিজের রাগ না দেখানোর বৃথা প্রচেষ্টা করল। কিন্তু মাহাদি আরশের পিছু ছাড়ল না। আবারো জ্বালানোর চেষ্টা করতে উদ্যত্ব্য হতেই আরশ শিকারী নয়ন তার দিকে নিক্ষেপ করল। মাহাদি ভয় পাওয়ার মতো দু-হাত সামনে এনে বলে ওঠল,”প্লিজ ভাই এরকম করে তাকাস না, আমি পিউর ভার্জিন একটা ছেলে। তোর এই খবিসের মতো চোখের চাহনি আমার পিউর ভার্জিনিটির রফাদফা করে ফেলবে। নজর ঠিক কর শালা লুচ্চা পোলা!
আরশ কথা বলল না। চুপচাপ চেয়ে রইল সামনের দিকে। মাহাদি নিজের বুকে হাত আড়াআড়ি বেঁধে বলল,”তোর বউয়ের দিকে এমন দৃষ্টি দিস। যেভাবে তাকাচ্ছিস মনে হচ্ছে, আমার মতো ছোট নাদান বাচ্চাটাকে চোখ দিয়েই প্রেগন্যান্ট বানিয়ে ফেলবি?
আরশ কথা বলল না। চোখ স্থির রেখে চুপচাপ এসে মাহাদির সামনে বসল পায়ের উপর পা তোলে।। গম্ভীর মুখ ভঙ্গি করে আরাম করে শুনতে লাগল মাহাদির হাসাহাসি। মাহাদি হাসতে হাসতে বলল,”তোর বউয়ের দিকে তুই তাকাবি। তাকিয়েই বা কী হবে! না তাকিয়েই তো বেচারিকে চোখ দিয়ে তুই ইভটিজিং করে ফেলিস।
আরশ এবার রাগী কন্ঠে ডেকে ওঠল,
“মাহাদি..!
মাহাদি জি জি করে ওঠল। আরশ কটমট করে বলল, “আমার হাতে মার খেতে চাস?
মাহাদি নিজের দু-কাঁধ ঝাঁকাল। নিষ্প্রভ চোখে চেয়ে আওড়াল,” তোর মতো মোষের হাতে মার খাওয়ার কোনো ইচ্ছে আমার নেই।
আরশ কিড়মিড়িয়ে বলল,
“তাহলে মুখ বন্ধ রাখ!
মাহাদি শ্রাগ করল। ঠোঁট টিপে একটু হাসল। একটুক্ষণ চুপ থেকে আবারো নতুন উদ্বেগে আরশকে জ্বালানোর জন্য বলে ওঠল,”আমি ছোটো মানুষ মুখ বন্ধ করে নিব। এই যে জিপার টানলাম মুখে। তার আগে একটা কথা বল!
আরশ কপাল কুঞ্চিত করে ইশারা করল জিজ্ঞেস করার জন্য। মাহাদি মৃদু আওয়াজে জিজ্ঞেস করল,”আমি কথা বললেই তোর যত সমস্যা, তোর বউ তো পুরোদিন বাঁচালদের প্যা প্যা করে কথা বলে, মুখ একমুহূর্তে জন্য বন্ধ করে না, মানুষ কথা না শুনলেও জোর করে বেঁধে তার কথা শোনায়। যখন তোর সাথে কথে বলে তখন তুই নিজেও উপরে উপরে ভাব নিলেও ভেতরে ভেতরে হা করে গিলস ওর কথা, তোর বউয়ের বেলা তাহলে ভিন্ন প্রন্থা কেন?
আরশ নির্বিকার চিত্তে চেয়ে রইল মাহাদির দিকে। নিজের বলিষ্ঠ পুরুষালি হাত জোড়া কোলের উপর রেখে মটমট করে শব্দ করল। গম্ভীর গলায় বলল,”তুই আমার বউ না।
মাহাদি ব্যথিত নয়নে তাকায় আরশের দিকে। দুঃখ পাওয়ার ভান করে হাত দিয়ে ডেকে নেয় নিজের চোখ। মিনমিন করে বলে,”হ্যাঁ হ্যাঁ ও বউ! বউ গুলি করে মেরে ফেললেও তা মিষ্টি, আর আমি কিছু বললেই তা তিতা।
আরশ গম্ভীর গলায় হাসল। নিজস্বতা বজার রেখে, রাশভারী গলায় আওড়ায়,”তা তুই ঠিক বলেছিস।
মাহাদি তড়াক করে আরশের চোখে দৃষ্টি নিক্ষেপ করে। তীক্ষ্ণ চোখ আরশের উপর নিচে বুলিয়ে প্রশস্থ গলায় চ্যাঁচিয়ে জিজ্ঞেস করল,”নুসরাত যখন তোকে গুলি করছিল, তা তোর কাছে মিষ্টি লাগছিল? মরার ভয় হয়নি?
আরশ দীর্ঘ নিঃশ্বাস ত্যাগ করল। উপর নিচে মাথা নাড়িয়ে মাহাদির কথায় সায় জানাল। মাহাদির শোনার মতো করে বলল,”মেয়েটার সবকিছুতেই মিষ্টতা ভাব আছে।
মাহাদি সুযোগের সৎ ব্যবহার করে জিজ্ঞেস করল,”সর্দির মধ্যে ও?
আরশ অন্যমনস্ক থাকায় খেয়াল করল না মাহাদির প্রশ্ন। উপর নিচ মাথা নাড়িয়ে রাশভারী আওয়াজে বলল,” হু!
মাহাদি নিজের হাসি কোনো মতে আটকে রেখে জিজ্ঞেস করল,”তুই খেয়েছিস?
গুরুগম্ভীর পুরুষালি পুরু স্বরে আরশের প্রশ্নের উত্তর এলো,”হু!
মাহাদি বেতের সোফা থেকে মাটিতে পড়ে গেল। চোখ গোল গোল করে চেয়ে আরশের উদ্দেশ্যে বলল,”কী খাইষ্ঠা তুই! ওয়াক,,, বউয়ের সর্দি খেয়ে নিয়েছিস?
আরশ শ্রাগ করল। নিজের জায়গায় বসে থেকে নির্লিপ্ততার সহিত স্বীকারক্তোতি দিল। মাহাদির প্রশ্নে তার ভাবাবেগ হলো না। যা বলার বলুক। আরশ মাহাদির বকবকানিতে কান দিল না।
নিঝুম দুপুরে আবারো ব্যথা শরীর নিয়ে বাড়িতে ফিরে আসলেন হেলাল সাহেব। ঝিরেঝিরে বৃষ্টি পড়ায় কপালের উপর সাদা কালো কিছু চুল পড়ে আছে। হাত দিয়ে ভেজাচুল স্পর্শ করতে গেলেন তখনই কাঁধে আরেক হাত চেপে আর্তনাদ করে ওঠলেন। চোখ খিঁচে নিয়ে নিজের পিঠ দেয়ালে ঠেকিয়ে দাঁড়ালেন ভরের আশায়।
কিচেন থেকে ধুপধাপ পায়ে কারোর এগিয়ে আসার শব্দে পুরুষালি শরীরটা দেয়ালের বিরুদ্ধে নিয়ে গিয়ে টানটান হয়ে দাঁড়ালেন। বোঝার উপায় নেই মেরুদণ্ডের হাঢ়ের ব্যথায় মধ্য বয়স্ক লোকটা প্রায় ভঙ্গুর। সোজা হয়ে দাঁড়াতেই নিজের পিঠে চিনচিনে ব্যথার অনুভূতি হলো। দাঁতে দাঁত চেপে নাছির সাহেবকে মনে মনে গালি দিলেন,”অসভ্য, খবিস। নিজের ভাইকে অত্যাচার করে। গাধা এক একটা!
লিপি বেগম কিচেন থেকে এসে স্বামীকে সামনে দাঁড়িয়ে অন্যমনস্ক দেখে ভ্রু বাঁকালেন। কী এমন হলো তার গুণোধর স্বামী, যিনি সবসময় সবাইকে চিন্তা প্রধান করেন আজ তার মুখেই চিন্তা। বিষয়টা আশ্চর্যজনক লাগছে লিপি বেগমের নিকট। কাছে এগিয়ে এসে স্বামীকে কিছু বলতে নিবেন, কথা কেটে দিলেন হেলাল সাহেব। আদেশ দিয়ে বললেন,”গরম পানি নিয়ে এসো। কোমর ব্যথা করছে।
নিজের আদেশ জারী করে কোমরে এক হাত চেপে উপরে ওঠে গেলেন। কোমড়ের হাড্ডির মটমট শব্দে মনে হলো এক্ষুণি তা ভেঙে হাতে চলে আসবে হেলাল সাহেবের। কিন্তু তেমন কিছুই হলো না, তিনি ভালোই নিজের রুম পর্যন্ত চলে গেলেন। দিব্বি আরাম করে শুয়ে পড়লেন ও বিছানায়, তবুও হাড্ডি হাতে আসলো না।
কিৎকাল অতিবাহিত হওয়ার পর লিপি বেগম মাথা ওড়না টেনে রুমের ভেতর প্রবেশ করলেন। গরম পানির পট এগিয়ে দিলেন হেলাল সাহেবের দিকে। ঠাট্টা করে জিজ্ঞেস করলেন,”সুন্দরী সতিন আনতে গেলেন আমার জন্য, কোথায় আমার সেই সুন্দরী সতিন?
হেলাল সাহেব স্ত্রী ব্যঙ্গাত্মক গলায় বলা কথা শুনে হাসলেন গা দুলিয়ে। হাসতে গিয়ে ঠিকভাবে গা দোলাতে পারলেন না, পিঠের ব্যথায়। চোখ খিঁচে নিয়ে বললেন,”এক শাকচুন্নি মহিলাকে সামলাতে পারছি না আবার নিয়ে আসব আরেক শাকচুন্নি। এটা ভাবাই তো আমার নিকট বিলাসিতা!
লিপি বেগম স্বামীর পিঠের দিকে তাকিয়ে থেকে চাপড় মারলেন। হঠাৎ ব্যথা স্থানে জোরে হাতের চাপ পড়তেই না চাইতে ও আর্তনাদ বের হয়ে আসলো হেলাল সাহেবের মুখ দিয়ে। লিপি বেগম ঠোঁট টেনে হাসলেন। আবারো একই জায়গায় চাপড় মেরে, স্থির দৃষ্টি স্বামীর পানে নিক্ষেপ করে জিজ্ঞেস করলেন,”তা নায়ক সেজে বের হয়ে গেলেন, আর দেখি ফিরে আসলেন চোর সেজে। ব্যাপার কী?
হেলাল সাহেব খ্যাক করে ওঠলেন। স্ত্রীর দিকে নিজের ক্ষিপ্ত চাহনি নিক্ষেপ করে জিজ্ঞেস করলেন,”কোন সাহসে আমাকে তুমি চোর বললে লিপি?
লিপি বেগম সে কথার উত্তর দিলেন না। বুঝলেন এই বিষয়ক কথা বলতে গেলে পানি বেশি গড়াবে। তাই বুদ্ধিমানের মতো আলগোছে কথা কাটিয়ে দেওয়ার তার কাছে ভালো মনে হলো। তখনো স্বামীকে জ্বালানোর চিন্তা রইল মাথায় অটল। তাই ব্যগ্রতা নিয়ে বলে ওঠলেন,”সতিন নিয়ে আসতে গেলেন, সতিন কোথায়? আমার ছেলেদের নতুন মা দেখার জন্য আমি অধীর আগ্রহে আপনার পথ চেয়ে বসে ছিলাম। আর এখন দেখি, আপনাকে মানুষ উত্তম মাধ্যম দিয়ে পাঠিয়েছে।
হেলাল সাহেব নিজের শরীরে ভাপ দিতে দিতে নড়েচড়ে অন্য পাশ ফিরে শুয়ে পড়লেন। তিক্ততায় পরিপূর্ণ কন্ঠে বলে ওঠলেন,”মানুষ আমাকে উত্তম-মাধ্যম দিবে কেন? আমি মানুষের কোন ভাড়াভাতে ছাই ফেলেছি?
“আমি সেটা বলতে চাইছি না…
” তাহলে তুমি এক্সেক্ট কী বলতে চাইছ লিপি?
“আমি মনে করেছি, আপনি আমার জন্য সতিন বাছাই করতে গিয়ে কয়েক ঘা খেয়ে এসেছেন।,মহিলা মানুষকে উত্যক্ত করার দায়ে..!
কথা শেষ করে ঠোঁট চেপে হেসে ওঠলেন লিপি বেগম। হেলাল সাহেব তড়াক করে পাশ-ফিরে তাকালেন স্ত্রীর দিকে। আওয়াজে শক্ততা এনে বললেন,”অনেক বেশি মিস করছ মনে হচ্ছে তোমার সতীনকে?
লিপি বেগম নির্লিপ্ত কন্ঠে বললেন,
” জি!
হেলাল সাহেব মন ভুলানো হাসলেন। মাথার নিচে এক হাত রেখে শুয়ে চোখ বন্ধ করে মুখ দিয়ে ব্যথাতুর শব্দ বের করলেন। গম্ভীর মুখে আওড়ালেন,” তাহলে যাও তোমার সতীনের কাছে। তোমার সতীনকে শেওড়া গাছে রেখে এসেছি, আর বলেছি তার বান্ধবী আমার বাড়িতে বসে আছে। একটু অপেক্ষা করতে, কিছুক্ষণের মধ্যে সে তার কাছে পৌঁছে যাবে। এখন যাও তোমার সতীনের কাছে। শেওড়া গাছের মগডালে বসে তোমাকে মিস করছে তোমার সতীন।।
লিপি বেগম ক্ষুব্ধ চোখে স্বামীর দিকে চাইলেন। রুঢ় আওয়াজে জিজ্ঞেস করলেন,”আপনি আমাকে পেত্নী বললেন?
হেলাল সাহেব অস্বীকার করলেন। ঠোঁট উল্টে না বোঝার মতো করে বললেন,”পেত্নী বলিনি, শুধু শেওড়া গাছের শাকচুন্নি বলেছি। তুমি নিজেই নিজেকে পেত্নী বলেছ, আমার কী দোষ এতে? তাহলে তুমি নিজেই মনে করো তুমি উন্নত জাতের একজন পেত্নী। আমি আর কী বলব?
লিপি বেগম রাগে হিতাহিত জ্ঞানশূন্য প্রায়,চোখ ছোট ছোট করে তীক্ষ্ণ কন্ঠে প্রশ্ন ছুঁড়লেন স্বামীর উদ্দেশ্যে,”আমি শাকচুন্নি, পেত্নী?
প্রিয় প্রণয়িনী ২ পর্ব ১৭
“তা আর বলতে।
হেলাল সাহেব কথা শেষ করেই আরাম করে চোখ বন্ধ করে নিলেন। আর একটা কথা বলার ইচ্ছে পোষণ করলেন না। এবার একটু শান্তি লাগছে তার৷ তাকে জ্বালাতে আসছে লিপি। এবার লিপি বুঝবে কত ধানে কত চাল।