প্রিয় প্রণয়িনী ২ পর্ব ১১ (৩)

প্রিয় প্রণয়িনী ২ পর্ব ১১ (৩)
জান্নাত নুসরাত

সূর্যের আজ দেখা নেই। স্লান হয়ে আছে। গতকাল সন্ধ্যা থেকে এক নাগালে বৃষ্টি হওয়ায় সোঁদা মাটির মিষ্টি গন্ধ এসে নাকে লাগছে জোরালো ভাবে। নাক টেনে গন্ধটা নিতে যাবে নাকের দু-পাশে তীক্ষ্ণ ব্যথার উপলব্ধি করল নুসরাত। কুকিয়ে উঠল নিচু গলায়। পাশে বসা ইসরাত বই রেখে দেখার জন্য পাশ ফিরল, দেখল নুসরাত মাথা পর্যন্ত কাঁতা টেনে শুয়ে আছে। কাঁতা ধরে টান দিতেই বেরিয়ে আসলো নুসরাতের জখম হওয়া মুখ। পুরো মুখে ছেয়ে আছে দাগে। ছোপ ছোপ হয়ে রক্ত জমা হয়ে আছে নুসরাতের মুখের বাঁ-পাশ জুড়ে। ইসরাত আঁতকে ওঠল। হাত বাড়িয়ে স্পর্শ করল রক্ত জমাটবাঁধা স্থানে। অনেকগুলো প্রশ্নের উৎপত্তি হলো মনের অন্তর্কীণে।

তার মধ্যে একটা, এরকম বেরেহমের মতো কে মেরেছে? কথাটা ভাবার সময় নুসরাতের গালে হাতের চাপ একটু বেশি পড়ল। আর তা পড়তেই নুসরাত আবারো কুকিয়ে ওঠল। ব্যথার জ্বালায় ফুপিয়ে কেঁদে উঠল ধীরে ধীরে। যা সেকেন্ডের ভিতর নেমে গেল একদম নিচু স্বরে। ইসরাত নুসরাতের গালে হাত রেখে ফোন বের করল নিজের। গতকাল তো এমন ছিল না, আজ হঠাৎ এর উৎপত্তি হলো কোথা থেকে? নিজের মনের ভিতর চলা দোলাচাল একপাশে ফেলে বাদর লিখা নাম্বারে কল দিল। কল দিতেই ওপাশ থেকে কল পিক করলো মানুষটি। ইসরাত ইরহামকে কোনো কথা বলার সুযোগ না দিয়ে রাগী গলায় জিজ্ঞেস করল,”নুসরাত গতকাল তোর সাথে ছিল না, তাহলে ওর এ অবস্থা কেন?
ইরহাম বোকা কন্ঠে জিজ্ঞেস করল,

আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন

“কী অবস্থা?
ইসরাতের নিজের ইচ্ছে করল দেয়ালে মাথা বারি দিয়ে নিজেকে মেরে ফেলতে। কেন এই গর্দবগুলো তার ভাই-বোন হলো। শব্দ করে শ্বাস ফেলে বলল,” তুই কিছু জানিস না?
ইরহাম আবারো অবাক কন্ঠে জিজ্ঞেস করল,
“আমি কী জানবো?
প্রশ্নের বিপরীতে নিজে প্রশ্ন ছুঁড়ে দিল ইরহাম। সে আসলে বুঝতে চাইল ইসরাত কী জিজ্ঞেস করেছে! ইসরাত রাগে তিক্ত বিরক্ত হয়ে ইরহামের কথার উত্তর না দিয়ে ফোন কেটে দিল। ফুসফুস করে শ্বাস ফেলল। যেন বাতাসের ঘাটতি দেখা দিয়েছে পৃথিবীতে। এই বেটাকে সে প্রশ্ন করে, বেটা আবার তাকে ফিরিয়ে প্রশ্ন করে। মাথায় সমস্যা সবগুলোর এই বাড়ির মানুষের।

সুফি খাতুন ড্রয়িং রুমে বসে বাজ পাখির ন্যায় তাকিয়ে আছেন। গভীর তদন্তে লিপ্ত আছেন! কাকে বাঁশ দেওয়া যায় সাথে তা ও চিন্তা করছেন। ঠোঁটে লেগে আছে কুটিল হাসি। হেলাল সাহেবকে ড্রয়িংরুমে আসতে দেখেই কুচক্রীর মতো হেসে ওঠলেন মনে মনে। চোখ সরু করে মনে করলেন সেদিনকার ঝর্ণা বেগমের রাগী গলায় তার সাথে কথা বলা। কী-রকম তিক্ত বিরক্ত কন্ঠে কথা বলছিল ঝর্ণা তার সাথে। আজ ঝর্ণার ছেলেকে একটা বাঁশ না দিলেই নয়। হেলাল সাহেব এসে বসতেই সুফি খাতুন এগিয়ে গেলেন। সতর্ক গলায় বলে ওঠলেন,” হেলাল জানিস তোর অতি আদরের ভাতিজা কী করছে?
হেলাল সাহেব তীরিক্ষ কন্ঠে জিজ্ঞেস করলেন,

“কী?
দেখেই মনে হলো সুফি খাতুনের কথায় কোনো মনোযোগ নেই। সুফি খাতুন তবুও অতি উৎসাহি কন্ঠে ঠাট্টা করে বললেন,” তোর ছোট ভাতিজার সাথে নাছিরের মেয়ে ইটিস-পিটিস টাইপ সম্পর্ক।
হেলাল সাহেব তড়াক করে সুফি খাতুনের দিকে তাকালেন। বাকশূন্য কন্ঠে জিজ্ঞেস করলেন,”তুমি জানলে কীভাবে?
সুফি খাতুন একটু ভাবসাব নিলেন। ঠোঁট এলিয়ে হেসে বললেন,”এসব গোপন কথা জানা আমার বাঁ-হাতের খেল।
হেলাল সাহেব ফিকে হয়ে যাওয়া চোখে চেয়ে রইলেন নির্মিশেষ সুফি খাতুনের দিকে। মনে কুটিল হাসি ফুটে উঠল। এবার তাকে কে হারায়?

আরশের বিয়ে এবার অনিকার সাথে তিনি দিয়েই ছাড়বেন। উপরে নির্বাকতা টেনে এনে বিরশ কন্ঠে বলে ওঠেন,”এরকম কিছু হলে আমি অতি দ্রুত ওই মেয়ের সাথে শোহেবের ছেলের বিয়ে দিয়ে দিব।
সুফি খাতুন মনে মনে কুটিল হাসলেন৷ এবার জমবে খেলা। আমাকে অপমান করা বের হবে ঝর্ণা তোমার। অধর এলিয়ে হেসে সুফি খাতুন উঠে দাঁড়ালেন। চোখ মুখে বিজয়ের হাসি ঝুলিয়ে হেলে দুলে চলে গেলেন বাহিরের দিকে। একটু পাশের বাসায় গিয়ে বউ আর শাশুড়ীর মধ্যে আগুন লাগানো প্রয়োজন। অনেকদিন হয় কারোর ঝগড়া দেখতে পারেন না। আজ ঝগড়া লাগিয়ে দিয়ে সামনে বসে লাইভ দেখবেন। শাশুড়ী বউমার চুলোচুলি দেখতেই অসাধারণই লাগে!

ইসরাত ফোন রাখতেই ইরহাম দ্রুত পায়ে এগিয়ে যায় আরশের রুমের দিকে। সে যা সন্দেহ করছে, তা কী সত্যি তার যাচাই করতে। আরশের রুমের দরজা ভেজানো ছিল। হালকা হাতে নক করতেই ভেতরে আসার অনুমতি পেল সে। রুমে ঢুকে দেখল মাহাদি সোফায় হাত-পা ছড়িয়ে বসে আছে। আর আরশ মোবাইল হাতে নিয়ে পায়চারি করছে। আরশের দিকে তাকিয়ে ইরহাম মনে মনে নাক ছিটকাল। আরশের পরণে হাঁটু সমান থ্রি- কোয়াটার প্যান্ট আর উপরে হুডি। পায়ে এক জোড়া স্লিপার। ইরহাম মনে মনে বিড়বিড়াল,”উপর সৌদি আরব নিচ আমেরিকা,বিদেশি মানুষের বিদেশি স্টাইল।
ধীরে ধীরে মাথা নিচু করে ভেতরে প্রবেশ করতেই আরশ কর্কশ গলায় জিজ্ঞেস করল,”কী চাই?

“ইয়ে মানে!
আরশ ধমক দিল ইরহামকে। কপালে গাঢ় ভাঁজ ফেলে বলল,” যা বলতে এসেছিস বলে বিদেয় হো!
ইরহাম ঠোঁট জিহ্বা দিয়ে ভিজিয়ে নেয়। চোখের পাপড়ি ঝাপটে বলে ওঠে,”আপনি কী নুসরাতকে কিছু করেছেন?
আরশ ভ্রু বাঁকায়। বিরক্ত কন্ঠে জিজ্ঞেস করে,
“আমি কী করেছি?
” না মানে সকাল সকাল আপি ফোন দিয়ে বলল, নুসরাতের না-কী কী জানি হয়েছে!
আরশ ওহ বলল। তারপর তড়াক ইরহামের দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করল,”তুই কিছু জিজ্ঞেস করিসনি?
“জিজ্ঞেস করার আগেই ফোন কেটে দিয়েছে।
আরশ ক্লিনসেভ থুতনিতে হাত বুলায়। দাঁত দিয়ে ঠোঁট চেপে ধরে বলে ওঠে,”এক কাজ কর পাঁচ কেজি করে সব ফল নিয়ে আয়।
ইরহাম বিরশ কন্ঠে জিজ্ঞেস করল,

” কেন?
আরশ হাত তোলে তেড়ে আসতে আসতে বলল,
“গাধার বাচ্চা, প্রথমবার যাচ্ছি না শ্বশুরবাড়ি! খালি হাতে যাওয়া যাবে কী! উঁহু একদম না। আর সাথে রোগীকে ও দেখে আসব। তাই রোগীর জন্য ফল নিয়ে যাচ্ছি।
ইরহাম অবাক কন্ঠে জিজ্ঞেস করল,
” আপনি কীভাবে জানলে রোগী আছে ওখানে?
আরশ রহস্যময় হাসল। তারপর বলল,”তোকে যেতে বলেছি না, তাহলে এত প্রশ্ন কীসের?
আরশকে আবারো তেড়ে আসতে দেখে ইরহাম দ্রুত পায়ে রুম থেকে বের হতে হতে বলল,”আরে যাচ্ছি, যাচ্ছি ভাই! এরকম করছ কেন?

নিস্তেজ এক সকাল। নেই কোনো প্রাণ, নেই কোনো শিখা, নেই কোনো আনন্দের ছিটা। চারিদিক শুধু হাহাকার আর হাহাকার। হাহাকার ছাড়া নেই কোনো শব্দ। মানুষের হাহাকার থেমে গেলেই পুরো পরিবেশটা নিস্তব্ধ হয়ে যায়। ফ্যাকাশে বর্ণের মলিন সেই পরিবেশ।অস্বাভাবিক সেই নিস্তব্ধতা গ্রাস করে রেখেছে একটা সুবিশাল পরিবারকে। হসপিটালের করিডোরে দেয়ালে ঠেস দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে নুসরাত আর ইসরাত। ইরহাম বড় ভাইয়ের মতো নিজের বুকের কাছে আগলে রেখেছে বড় বোনকে। আরেক-হাত দিয়ে চেপে ধরে রেখেছে নিজের ছোট বোনকে। দুজনেই আজ নিস্তেজ। জড় পদার্থের ন্যায় নিজের জায়গায় দাঁড়িয়ে। সামনের আই-সি-ইউতে মেহেরুন নেছা রয়েছেন। বাহির থেকে ঝাপসা তার প্রতিচ্ছবি দেখা যাচ্ছে।

হসপিটালের অথোরিটি থেকে পাওয়া পরিহিত কাপড় জায়িনের গায়ে। সেই কাপড় পরে বিভিন্ন শর্তাবলী মেনে ভেতরে প্রবেশ করেছে সে। মেহেরুন নেছার একটাই কথা শেষবার তিনি জায়িনের সাথে দেখা করতে চান। তাই শুধু ভেতরে ঢোকার অনুমতি শুধু জায়িনের জন্য বরাদ্দ হয়েছে। জায়িনের চোখে মুখে অস্বাভাবিক গম্ভীরতা। মেহেরুন নেছা জায়িনকে দেখতেই কাঁপা হাতে নিজের মুখের অক্সিজেন মাস্ক খুলে নেন। থরথর করা সে হাত বাড়িয়ে দেন জায়িনকে ছুঁয়ে দেওয়ার আশায়। জায়িন নিজে এগিয়ে যায় মেহেরুন নেছার দিকে, হাত টেনে নিয়ে স্পর্শ করে নিজের গালে। প্রশ্নাতীত চোখে চেয়ে থাকে মেহেরুন নেছার কথা শোনার আশায়। মেহেরুন নেছা চোখ বন্ধ করে নিয়ে শ্বাস ফেলেন। ঘনঘন শ্বাস ফেলে ঠোঁট নাড়ালেন। যা জায়িনের কানে স্পষ্ট গেল না। তাই সে কান বাড়িয়ে দিল মেহেরুন নেছার মুখের সামনে, অস্পষ্ট কথাগুলো শোনার জন্য। মেহেরুন নেছা ভাঙা কথাগুলো জোড়া লাগিয়ে মৃদু কন্ঠে বললেন,”ইসরাতের হাত কখনো ছেড়ে দিও না। ককখনো আমমার স্বাআমীর মমান ভেঙে দিও…

মেহেরুন নেছা নিজের কথা পূর্ণ করতে পারলেন না। তার আগেই শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করলেন। মেহেরুন নেছাকে কথা বলতে না দেখে জায়িন কান আরেকটু কাছে নিল। না নেই, কোনো সারাশব্দ নেই। চোখ তুলে তাকাতেই ধীরে ধীরে তা লাল হতে শুরু করল। এক হাত বাড়িয়ে নিভিয়ে দিল মেহেরুন নেছার খোলা চোখগুলো। নিস্তেজ হয়ে পড়ে থাকা দু-খানা হাত তুলে নিয়ে মুখের কাছে চেপে ধরল৷ নিঃশব্দে গাল বেয়ে গড়িয়ে পড়ল এক ফোটা পানি। শার্টের হাতায় চোখ মুছে নিয়ে অগ্রসর হলো সবচেয়ে দুঃখজনক সংবাদ সবার নিকট পৌঁছাতে।

মানুষ জন্ম নেয় মরণের জন্য। যখন বাঁচার আশা মিটে যায় মানুষ বরণ করে নেয় মরণকে। কেউই এই পৃথিবীতে চিরস্থায়ী নয়। একদিন সবাইকে এই সুন্দর পৃথিবীর মায়া ত্যাগ করতে হয়। যারা নিজের বাঁচার অবলম্বন হারায় বা বাঁচার কোনো আশা থাকে না, তারা হয়তো কখনো নিজের বাঁচার অবলম্বন হিসেবে বেছে নেয় ভালোবাসা। অনেকেই ভালোবাসার জন্য জন্ম জন্মান্তর বাঁচতে চায়। কিন্তু সেটা কী কখনো সম্ভব! একটা কথা আছে এমন, we are born to be alone, but why we still looking for love?

জীবনানন্দ দাশের লিখিত সেই দিন এই মাঠ কবিতায় একটা কথা এমন ছিল, আমি চলে যাব বলে চালতা ফুল কি আর ভিজবে না শিশিরের জলে নরম গন্ধের ঢেউয়ে? লক্ষ্মীপেঁচা গান গাবে না, নাকি তার লক্ষ্মীটির তরে? কোনো কিছুই থেমে থাকবে না। পৃথিবীর নৈস্বর্গিক সৌন্দর্য সভ্যতা বেবিলীন ছাই হবে না। মানুষ চলে গেলে সেই কষ্ট কিছুদিন গ্রাস করে রাখে মানুষকে কিন্তু সময়ের পরিবর্তনে সত্যতা মেনে নিয়ে সবাইকে এগিয়ে যেতে হয় সামনের দিকে, ভবিষ্যতের দিকে। কোনো কিছু থমকে যায় না। প্রকৃতি, সৌন্দর্য, সভ্যতা সবই এগিয়ে যাবে নিজস্বতার তরে। যেই শোক সৈয়দ পরিবারকে গ্রাস করেছে হয়তো সময়ের সাথে কাটিয়ে উঠবে। কিন্তু হারানোর দুঃখ কী কখনো কাটাতে পারবে তা সময় বলে দিবে।

সিলেট সিটি হসপিটালের সামনে বুকে কম্পন নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে আরশ। ঘুম থেকে উঠে এসেছে এখানে তা ভালোইভাবে বোঝা যাচ্ছে। নড়বড়ে পায়ে হাঁটছে। এক হাত দিয়ে আগলে রেখেছে মাহাদি। চোখ মুখে দুজনের বিরাজ করছে গম্ভীরতা। করিডোর পার করতেই আই-সি-ইউ রুমের সামনে জটলা বেঁধে দাঁড়ানো সৈয়দ বাড়ির সদস্যকে দেখা গেল সবাইকে। বাড়ির প্রত্যেকটা সদস্য সেখানে দাঁড়িয়ে। কেউ কেউ দেয়ালে ঠেস দিয়ে দাঁড়িয়ে তো কেউ মেঝেতে এক পাশে বসে। চোখের মণি ঘুরিয়ে আশেপাশে খোঁজ করল কাউকে। অক্ষিকোটরের ভিতর তার মুখ ভাসতেই কিছুটা আঁতকে উঠল। গাল অস্বাভাবিক ফোলে গিয়েছে। চোখের নিচে একদিনে পড়েছে কালো দাগ। গালে শুকিয়ে যাওয়া পানির চিহ্ন। নিস্তেজ হয়ে মরার মতো গুটিসুটি মেরে মেঝেতে বসে আছে সে। আরশ ভাবেনি এত খারাপ অবস্থা হয়েছে নুসরাতের। সামান্য থাপ্পড়ে এই অবস্থা!

আরশ আই-সি-ইউ রুমের দিকে এগিয়ে গেল অনিশ্চয়তা নিয়ে। দরজা ঠেলে ভিতরে ঢুকতেই জায়িনকে দাঁড়িয়ে ডাক্তারের সাথে কথা বলতে দেখল। আরশকে দেখে জায়গা করে দিল ভেতরে যাওয়ার জন্য। আরশ আলগোছে পা বাড়াল। যত বেডের কাছে এগিয়ে গেল তত বুকের অস্বাভাবিক কম্পন বেড়ে গেল। বেডে শোয়া মানুষটার মুখের উপর পর্যন্ত সাদা কাপড় দিয়ে ঢাকা। হাত বাড়িয়ে সাদা কাপড় সরিয়ে নিতেই ফ্যাকাশে হয়ে যাওয়া মেহেরুন নেছার মুখ বের হয়ে আসলো। আরশ হাত বাড়িয়ে স্পর্শ করল মেহেরুন নেছার গালে। নেই কোনো নড়চড় সেই মানুষটার। বিছানা শুয়ে আছে মানুষটা নিস্তব্ধ হয়ে। গালে হাত বোলাতে বোলাতে বাচ্চাদের মতো আরশ ডেকে উঠল,”দাদি, ও দাদি।

মেহেরুন নেছার সারাশব্দ নেই। আরশ গালে চুমু খেল পাগলের মতো। চোখের পাপড়ি বারবার ঝাপটে ডেকে উঠল,”দাদি, শুনতে পাচ্ছ আমাকে?
আরশ মেহেরুন নেছার হাত ধরে ঝাকায়। হাতে চুমু খেয়ে জিজ্ঞেস করে,”আমাদের ছেড়ে চলে গেল কেন তুমি? দাদি ও দাদি..! তুমি কথা দিয়েছিল আমদের দেখা দেওয়ার আগে চলে যাবে না, দেখা পেতেই চলে গেলে। তুমি নিষ্ঠুর দাদি, নিষ্ঠুর।

মেহেরুন নেছাকে নাছির মঞ্জিলে আনা হয়েছে। শেষ গোসল দেওয়া হবে বাগানে। তাই সেখানে সকল ব্যবস্থা করা হচ্ছে। বাড়ির সামনে দেয়ালে ঠেস দিয়ে বসে আছে তিন-বোন। চুপচাপ বসে নিশ্চুপ হয়ে দেখছে শেষ গোসলের ব্যবস্থা। এই তো আর একটু সময় এরপর মাটির নিচে নিয়ে রাখা হবে মেহেরুন নেছাকে। চিরকালের জন্য হারিয়ে যাবে তার দেহ মাটির সাথে। আর কখনো দেখা হবে না। এই দেখা, শেষ দেখা। মানুষ যদি চলে যাবে তাহলে কেন এত মায়া জন্মায় নিজেদের প্রতি। কেন তাদের চলে যেতে হয়, থেকে গেলে পারে না। মানুষ কেন এই পৃথিবীর মিথ্যা মায়ায় পড়ে। সবই নিছক ছলনা। একবার চলে গেলে সব শেষ হয়ে যায়। এরপর থেকে যায় চলে যাওয়া মানুষটার শুধু স্মৃতি৷ আর সেই স্মৃতি এক সময় ছাই হয়ে যায়।

পাশে আগুন ধরানো হয়েছে। দাউদাউ করে জ্বলছে আগুনের সেই শিখা। নিমেষেই সেই আগুন জ্বালিয়ে দিতে পারে একজন মানুষকে। পানিতে দেওয়া হয়েছে বরই পাতা। নুসরাত এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে সেদিকে। পানি নিয়ে যাওয়া হয় মেহেরুন নেছাকে যেখানে শোয়ানো হয়েছে শেষ গোসল দেওয়ার জন্য সেই ঘরে। নুসরাত তাকিয়ে থাকে, এই উঠে আসবেন মেহেরুন নেছা এসে বলবেন, পানি গরম করতাছস ক্যা? দেইখা যা আমার কিছুই হয়নাই! নিছক কল্পনা মাত্র! এরকম কিছু হয় না মেহেরুন নেছা নিজের জায়গায় স্থির শুয়ে থাকেন, ওঠে আসেন না। নুসরাত নিজে উঠে দাঁড়ায়। এগিয়ে যায় শেষ গোসল দেওয়া জায়গার দিকে। চোখে পানি থেমে গিয়েছে, শুকিয়ে গিয়েছে মনে হয়। তার রেশ রয়ে গিয়েছে মুখের আশে-পাশে। ধীরে ধীরে এগিয়ে যায় চৌকির দিকে।

পাশ ঘেঁষে বসে পড়ে মেহেরুন নেছার দিকে। মেহেরুন নেছার চুলে হাত বুলিয়ে দেয়। নির্মিশেষ চোখে দেখে সুন্দর মুখটাকে। বয়সের ভারে যে মুখে ছাপ পড়েছে। নুসরাত এক দৃষ্টিতে শুধু দেখে আর দেখে। সময় গড়ায়, গড়াতেই থাকে। তবুও টু শব্দ করে না। নুসরাতের মনে হয় এই তো আর কিছু সময় পর দাফন করা হবে তারপর এই মানুষটা তাদের স্মৃতিতে মিশে যাবে। কেন রাখা যায় না মৃত মানুষকে নিজের সাথে? কেনওওও? নেই এই কেন এর উত্তর! সে কেন রাখতে পারবে না দাদাকে নিজের সাথে। দাদা কী রাগ করেছে তাদের সাথে?

এভাবে কোনো কিছু না বলে চলে গেল কেন? মিথ্যে এই মায়ার পৃথিবীতে জন্মায় কেন মানুষ যখনই চলে যাবে সবাই একদিন। মায়া কেন তৈরি করে নিজেদের প্রতি?? নুসরাত হাত বাড়িয়ে মেহেরুন নেছার গালে হাত বোলায়। ফিসফিস করে ডাকে, “চোখ খুলো দাদি। আমি জানি, তুমি ঘুমিয়ে আছো! তাড়াতাড়ি চোখ খুলো নয়তো আব্বা তোমাকে দাফন করে দিবে৷ এখনো সময় আছে, এই তাকাও আমার দিকে, এই দেখো আমি বসে আছি। চোখ খুলো দাদা, আর বেশি কথা বলব না। একদম চুপ হয়ে বসে থাকব। তারপরও চোখ খুলো। আমি মিথ্যে বলছি না।

মমো এসে নুসরাতের পাশে বসে। কেদেকেটে চোখ মুখ একাকার। কুর্তির হাতায় ভালোভাবে চোখ ঢলে মুছে নেয়। না আবারো চোখে জমা হয়েছে পানি। নাক টেনে চোখ মুছে বারংবার। বারবার আবারো ভিজে উঠে চোখগুলো। আজ আর চোখে পানি থামছে না। থামার নাম নিচ্ছে না। অর্ন্তলীণ এই সময় কাটছে না কেন। যেন থমকে আছে এই সময় এক জায়গায়। আজ আকাশ ও কাঁদছে। মেঘ জমেছে আকাশে। কালো আধারে ডুবেছে এই প্রকৃতি। বৃষ্টি হবে খুব তাড়াতাড়ি। মাটিতে পতিত হবে। বাসিয়ে নিয়ে যাবে সবকিছু পৃথিবীর সবকিছু। হারিয়ে যাবে কারোর অস্তিত্ব এই বৃষ্টির সাথে। মমো চোখ মুছে আর কাঁদে। নানি কেন ছেড়ে গেল তাদের? শেষবার তার সাথে দেখা করল না? কেন এই হঠাৎ চলে যাওয়া? এতদিন তো ভালো ছিলেন। গ্রো-আপ করছিলেন। ডাক্তার তো জানিয়েছিল কিছু দিন এভাবে গ্রোআপ করলেই নানি পুরো সুস্থ হয়ে ওঠবেন। তাহলে কেন এমন হলো? কেন তাকে চলে যেতে হলো? কী এমন তাড়া আসলো যে আরো কয়েকবছর বাঁচার ইচ্ছে পোষণ করলেন না? কেন সে চলে গেল? তাদের অপরাগতা কী? কি ভুল ছিল এমন যে এই শাস্তি দিল নানি?

নুসরাত বসে রইল মরা মানুষের মতো। তাকে পাশে এক জায়গায় বসিয়ে দিয়ে নাজমিন বেগম চলে গেলেন গোসল দেওয়ার জন্য। আস্তে আস্তে শুরু করলেন শেষ গোসল। এই গোসল দেওয়ার পর মানুষকে আর গোসল দিতে হয় না। কেন মানুষ অনাকাঙ্ক্ষিতভাবে মরে যায়? কেন তারা চলে যায় নিজের পরিবার পরিজনকে দুঃখের সাগরে ভাসিয়ে? কেন তারা এত স্বার্থপর হয়? কেন এরকম করে তারা? কেউ এই কেন ওর উত্তর দেয় না। কারোর কাছে এর সংজ্ঞা নেই। কেন নেই? কেন জানে না কেউ? কেউ শুনতে পায় না এত প্রশ্ন! দোলাচাল করতে থাকে মনের অন্তর্কীণে। কাউকে বলতে পারে না প্রশ্নগুলো! সাজাতে পারে না। পড়ে থাকে মনের এক কোণে অবেহেলায়, অবজ্ঞায়।

মেহেরুন নেছার গোসল শেষ হওয়ার পর গায়ে গোলাপজল ছিটিয়ে দেওয়া হলো। খাটিয়ায় শোয়াতেই ইসরাতের টনক নড়ল। নিয়ে চলে যাবে এখন মানুষটাকে। আর দেখতে পারবে না কোনোদিন, নিজের এই প্রিয় মুখকে। মাটির সাথে মিশে নিশ্চিহ্ন হয়ে যাবে এই দেহ। ইসরাত ডুকরে কেঁদে উঠল। হাহাকার করে ডেকে উঠল,”দাদি ও দাদি।
এগিয়ে গেল খাটিয়ার দিকে। হাত বাড়িয়ে স্পর্শ করল মুখে। বরফ ঠান্ডা হয়ে এসেছে পুরো শরীর। ইসরাতের চোখ বেয়ে ঝরঝর করে জল গড়িয়ে পড়ল। ঢোক গিলে বলল,”শেষ বারের মতো একটা কথা না বলে চলে যাচ্ছ? থেকে গেলে পারতে না তুমি? দাদি ও দাদি। শুনতে পাচ্ছ তুমি? এই চোখ খুলো না? দেখো, আমি আমি তোমার ইসরাত দাদি! আমাকে একা ফেলে চলে যাবে? তুমি মিথ্যাবাদী দাদি। তুমি বলেছিলে তুমি ফিরে আসবে? অনেকদিন আমাদের সাথে থাকবে। তুমি কথা রাখলে না দাদি কথা রাখলে না। কথা ভেঙে দিয়ে চলে যাচ্ছ। মিথ্যে বলেছ তুমি আমায়।

খাটিয়া তোলে নিলেন নাছির সাহেব নিজের কাঁধে। সামনে হেলাল সাহেব আর নাছির সাহেব ধরেছেন, পেছনে শোহেব আর সোহেদ সাহেব ধরেছেন। পাঞ্জাবিতে বারবার চোখ মুছছেন সোহেদ। হেলাল সাহেবের চোখে পানি জমা হলেও তা বাহিরে বের হচ্ছে না। ইসরাত পেছন থেকে চিৎকার করছে,”আমার দাদিকে রেখে যাও, নিয়ে যেও না। আমার দাদি আমার দাদি। কবর দিও না, নিশ্চিহ্ন হয়ে যাবে। আরো একটু সময় থাকুক। আরো কিছুক্ষণ আমি দেখতে চাই শেষবারের মতো। ভালো করে দেখতে চাই শেষবার। আর তো দেখতে পারব না। রেখে যাও আমার দাদিকে। রেখে যাও দাদিকে, নিয়ে যেও না। আব্বু দয়া করে রেখে দাও আরো কিছুক্ষণ। আমি দেখতে চাই দাদির মুখ। আরো ভালো করে, শেষবারের মতো করে দেখতে দাও।

নুসরাত ডুকরে কেঁদে উঠল। সৌরভি নুসরাতের কাছে এসে পাশ ঘেঁষে বসল। দু-হাতে নুসরাতকে আগলে নিয়ে বলে ওঠল,”কেঁদে যদি মৃত মানুষকে আটকানো যেত, তাহলে এত বছরে হাজারো মানুষকে দাফন করা হতো না। সবাই সর্বোচ্চ কান্না করে নিজেদের প্রিয় মানুষকে রেখে দিত নিজেদের কাছে।

সৌরভি কথায় কান্না থামে না নুসরাতের। চোখ বেয়ে পড়ে জল একই ধারায়। নিভু নিভু চোখ তুলে চেয়ে থাকল সামনের দিকে। মানুষটা চলে যাচ্ছে আল্লাহর নিকট। যে মাটি দিয়ে তাকে তৈরি করা হয়েছে সেই মাটির কাছে। সেই মাটির নিচে একসময় তার দেহ পচে মিশে যাবে। মেহেরুন নেছার সামনে সামনে চলে যাচ্ছে জীবনে করা সকল পাপ পূর্ণ। মানুষকে নিয়ে মাটিতে দাফন করার আগে তার পাপ পূর্ণ গুলো আগে আগে চলে যায় সেই জায়গায়। ঝিরিঝিরি বৃষ্টি নেমেছে। মানুষের গা তা স্পর্শ করছে। নুসরাত ইসরাত মমো সবাই নির্মিশেষ দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল সামনের দিকে যতক্ষণ না, খাটিয়া নিয়ে দৃষ্টি সীমার বাহিরে অদৃশ্য হলেন সবাই। তবুও চোখের তৃষ্ণা মিটল না। বুকে চিনচিনে ব্যথা উঠল সবার। একেকজন একেকপাশে দেয়ালের সাথে ঠেস দিয়ে বসে রইল। বাড়ির ভিতরে যাওয়ার কারোর মনোবল নেই। কোনো ইচ্ছা নেই। যেন হাজার যোগ এখানে বসে তারা কাটিয়ে দিতে পারবে।

ইসরাত খোলা হা করে রাখা গেটের দিকে পানিতে টইটম্বুর করা চোখ নিয়ে তাকিয়ে রইল অনেকক্ষণ। করুণ স্বরে শুধু চেয়ে কাঁদা ছাড়া আর কিছু করতে পারল না। নিভু নিভু চোখে চেয়ে থেকে ধুপ করে মাটিতে পড়ে গেল। অসাড়তা, ক্লান্তিতে, শরীর ঝিমিয়ে আসলো। নিজেও চোখ বন্ধ করে নিল আরামের একটা ঘুম দেওয়ার জন্য। যেন এটা নিছকই স্বপ্নমাত্র। এতক্ষণ যা হয়েছিল তা স্বপ্ন ভেবে ভুলে যেতে চাইল। ইসরাত ভাবল ঘুম ভাঙলে হয়তো সব নতুনভাবে শুরু হবে। নতুন এক ভোরের সূচনা হবে। নতুন এক ক্লান্তিহীন সকালের সূচনা যেখানে থাকবে না কোনো বিষাদ, কোনো কষ্ট, কোনো দুঃখ। মৃত্যুর ভয় যেখানে গ্রাস করতে পারবে না।

হারানোর ভয়ে কখনো আর তটস্থ হতে হবে না। নতুন ভোর কী ইসরাতের ভাবনার মতো বিষাদহীন হবে না-কী আরো বেশি বিষাদীয় হবে তা আগামীকাল নতুন সূর্য উদয় হওয়ার সাথে দেখা যাবে, জানা যাবে। ধীরে ধীরে মেয়েটা আরামের সাথে চোখ বুজল। এই তো এখানে নেই কোনো কষ্ট। নেই দুঃখ। শুধু এতক্ষণের ক্লান্তি কাটার আবহ্। চারিদিকে সুখ আর সুখ। বাস্তবতা থেকে পুরোই আলাদা। স্বপ্নের রাজত্ব্য চলে এখানে। ইসরাতের ইচ্ছে অনুযায়ী চলে। কেউ কষ্ট দিতে পারে না এখানে কাউকে। নিজের মনের মতো স্বপ্ন বোনা যায় এই জায়গায়। কেউ কষ্ট দিয়ে চলে যেতে পারবে না। সে চাইলেই রেখে দিতে পারে। নিজের ইচ্ছে অনুযায়ী সব করতে পারবে, একজন মুক্ত পাখির ন্যায়।

মানুষ চলে যাবে। সেসব মেনে নিয়ে আমাদের এগিয়ে যেতে হবে আগাম ভবিষ্যতের দিকে। থেমে যাওয়া যাবে না। পৃথিবী এক রণক্ষেত্র। যেখানে চলার পথে হারাতে হবে অনেক কাছের মানুষজন। স্বীকার হতে হবে নিজের অতি প্রিয় কিছু মানুষের কাছ থেকে ধোঁকা, বর্বরতার। আমাদের সবকিছু পেছনে ফেলে এগিয়ে যেতে হবে আগাম ভবিষ্যতের দিকে। থেমে গেলে চলে না। নিজেদের শেষ নিঃশ্বাস পর্যন্ত লড়ে যেতে হয় এইখানে টিকে থাকতে হলে।

মেহেরুন নেছার চলে যাওয়ার প্রায় এক সপ্তাহ হয়ে গিয়েছে। সৈয়দ বাড়ির পরিবেশ আগের তুলনায় অনেকটা স্বাভাবিক। সবাই ধীরে ধীরে শোক কাটিয়ে উঠতে শুরু করেছে। নিজ নিজ কাজে ব্যস্ত হচ্ছে। কেউই থেমে নেই। স্মৃতি পাতায় সঃযত্নে তুলে রেখেছে সবাই মেহেরুন নেছাকে।

প্রিয় প্রণয়িনী ২ পর্ব ১১ (২)

এখন মেহেরুন নেছা স্মৃতিমাত্র। মৃত ব্যক্তির কথা ভেবে নিজেদের কষ্ট না বাড়ানোই ভালো তাই সবাই যথাসম্ভব মেহেরুন নেছার কথা বলা এড়িয়ে চলছে। জীবন চলছে সবার আগের ন্যায়। সেই জীবনে হঠাৎ একদিন ধমকা হাওয়ার ন্যায় এসে উপস্থিত হলো এক লোকের। সেকেন্ডে লণ্ডভণ্ড করে দিল জায়িনের এতদিনে গুছিয়ে তোলা নিজেকে। কয়েক নিমেষের জন্য নিজের কাছে মনে হলো সে মরে যাবে। শ্বাস আটকে যাবে গলার কাছে।

প্রিয় প্রণয়িনী ২ পর্ব ১২

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here