প্রিয় প্রণয়িনী ২ পর্ব ১২

প্রিয় প্রণয়িনী ২ পর্ব ১২
জান্নাত নুসরাত

সকাল দশটা। আজ জায়িনের ঘুম থেকে উঠতে একটু সময় লেগেছে। সকালের নাস্তা শেষে বাহিরে ফুরফুরে মেজাজে হাঁটাহাঁটি করছিল এমন সময় একজন পথচারীর সাথে দেখা তার। সালাম বিনিময় শেষে জায়িন পাশ কাটিয়ে চলে যাবে লোকটা জিজ্ঞেস করল,”নাছির সাহেবের বাড়ি কোনটা?
জায়িন নির্দ্বিধায় হাত তুলে ইশারা করে দেখিয়ে বলে,
“সামনের ডু-প্লেক্স বাড়িটা নাছির সাহেবের।

লোকটা চলে যেতে নিবে জায়িন পিছু ডাকল৷ লোকটা ফিরে তাকিয়ে জায়িনের দিকে প্রশ্নাত্মক দৃষ্টি ছুঁড়ে দিল। অস্বস্তিতে ঘাট হয়ে হাতে হাত ঘষল জায়িন। ঠোঁট চোখা করে শ্বাস ফেলে বলে ওঠল,” আমার প্রশ্নটা করা ঠিক নয় তারপর করছি,আপনি নাছির সাহেবের বাড়িতে কেন এসেছেন? আই মিন খোঁজ কেন করছেন?
জায়িনের প্রশ্নে লোকটা অধর বাঁকিয়ে নির্মল হাসলেন। হাত তুলে জায়িনের হাতের বড় বড় মাসালগুলোতে চাপড় মেরে বলে ওঠেন,”ওহ ইয়াং ম্যান, এই সামান্য প্রশ্ন করতে এত হ্যাজিটেট ফিল করছো?
জায়িন চুপচাপ দাঁড়িয়ে রইল। লোকটা সামনের দিকে জায়িনকে সাথে নিয়ে হাঁটতে হাঁটতে বললেন,”নাছির সাহেবের মেয়েকে দেখতে এসেছি। আমার ছেলে পছন্দ করেছে তাকে!

আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন

জায়িনের চোখ দুটো সেকেন্ডে বড় বড় হয়ে গেল। দাঁতে দাঁত চেপে নিজের জায়গায় স্থির কিছুক্ষণ চুপচাপ দাঁড়িয়ে থেকে ভদ্র লোককে ওখানে ফেলেই ধুপধাপ পায়ে অগ্রসর হলো সৈয়দ বাড়ির উদ্দেশ্যে।
লোকটা বিস্ময় নিয়ে চেয়ে রইল জায়িনের দিকে। মনে প্রশ্ন জাগল, বিষয় কী? এরকম হুট করে ছেলেটার রাগ করার মানে বা কী! এই ছেলে আবার ওই বাড়ির মেয়েকে পছন্দ করে না-তো! ভদ্র লোক নিতান্ত শান্ত মেজাজে জায়িনের রাগে লাফানোর মতো হাঁটা দেখলেন দূরে দাঁড়িয়ে। তারপর কিছু একটা ভেবে নাছির মঞ্জিলের উদ্দেশ্যে না গিয়ে উল্টো পথে হাঁটা ধরলেন নিজের বাসায় যাওয়ার জন্য।

রাগে হিসহিস করতে করতে বাড়িতে প্রবেশ করল জায়িন। যতবার ভাবছে ইসরাতকে ভদ্রলোক দেখতে এসেছেন ততবার রাগে সারা শরীর রি রি করে ওঠছে। দাঁতে দাঁত চেপে রাগ কন্ট্রোল করার চেষ্টা অনেকক্ষণ করল সে। যখন দেখল না হচ্ছে না, তখন ড্রয়িং রুমের এক কোণায় পড়ে থাকা ডাস্টবিন চোখে পড়ল। দ্রুত পায়ে সেদিকে এগিয়ে গিয়ে লাথি মারল বেচারা জড়বস্তুটায়। তারপর কাচের সেন্টার টেবিলে শক্তি দিয়ে পা ছোঁয়াতেই সেটা উল্টে পড়ল শব্দ করে। সেই শব্দে এতক্ষণে মনোযোগ দিয়ে বই পড়া হেলাল সাহেবের বই পড়াতে ভাটা পড়ল।
হেলাল সাহেব বই নিজের পাশে রেখে জায়িনের দিকে পূর্ণ দৃষ্টিতে তাকালেন। দেখলেন, জায়িন পাগলের মতো পায়চারি করছে আর হাতে বারবার পাগলের মতো ঘষছে। মুখে কিছু একটা বিড়বিড় করছে। জায়িনের চিন্তিত মুখখানি দূর্বেধ্য ঠেকল হেলাল সাহেবের নিকট। শূন্য চোখে চুপচাপ চেয়ে রইলেন অনেকক্ষণ। তারপর ধীরে ধীরে ঠাট্টা মিশ্রিত কন্ঠে জিজ্ঞেস করলেন,”কী হয়েছে, এমন ব্যঙের ন্যায় লাফাচ্ছ কেন?

জায়িন সে কথায় উত্তর দিল না। মেঝাতে বিছানো কার্পেটের দিকে শুকুনের নজর দিতেই হেলাল সাহেব বলে ওঠলেন,”যা করার কথা ভাবছ একদম মাথা থেকে ঝেড়ে ফেল। আর ব্যঙের মতো লাফানো বাদ দিয়ে কী হয়েছে সেটা বলো?
জায়িন ধুপ করে সারা শরীর নিয়ে সোফায় বসতেই পুরুষালি শরীরের ভারে গট গট শব্দ করে পেছনে সরে গেল সোফাটা। হেলাল সাহেব তেরছা চোখে তাকিয়ে রইলেন সোফার দিকে। জায়িন সেদিকে না খেয়াল করে এক হাত দিয়ে মাথা চেপে ধরে রগরগে কন্ঠে শুধায়,”আমি ব্যঙের মতো লাফাচ্ছি?
হেলাল সাহেব নির্বিকার কন্ঠে বলেন,

“তাই তো দেখছি।
জায়িন মুখের পেশি সংকুচিত করল, তারপর আবার প্রসারিত করল। পাশে বসে থাকা হেলাল সাহেব জায়িনের দাঁতে দাঁত চেপে কড়মড় করা স্পষ্ট দেখলেন। তারপর ও নির্লিপ্ত মুখ বানিয়ে বসে রইলেন। জায়িনকে এবার জিজ্ঞেস করলেন হেলাল সাহেব,”এত রাগ করছো কেন?
জায়িন উল্টো প্রশ্ন ছুঁড়ে দিল,
” তাহলে কী করব না?
হেলাল সাহেব প্রশ্নের বিপরীতে আবার প্রশ্ন করলেন,
“আমি কী তোমাকে না করেছি রাগ করতে?

দু-জনে দু-জনের দিকে চোখ সরু করে নীরব চাহনি নিক্ষেপ করলেন। হেলাল সাহেব শব্দ করে শ্বাস ফেলে বিরক্তির সহিত বলে ওঠলেন,” কী হয়েছে বলবে না-কী এরকম শকুনের মতো শুধু তাকিয়েই থাকবে?
জায়িন ছ্যাত করে ওঠল। নিজের চোখের চশমাটা নাকের ডগা থেকে ঠেলে উপরে তুলে বলল,”আমি শকুনের মতো তাকিয়ে আছি?
“অবশ্যই। আমার মতো হার্টের রোগীর দিকে এরকম শকুনের নজরে তাকালে আমি যে-কোনো সময় হার্ট অ্যাটাকে মরে যেতে পারি।

হেলাল সাহেব ঠাট্টার সহিত কথা শেষ করলেন। জায়িনকে কথার উত্তর না দিয়ে মুখ এঁটে বসে থাকতে দেখে হেলাল সাহেব বিজয়ী হাসলেন। ঠোঁটে সেই হাসি স্থির ঝুলিয়ে রেখে ব্যাঙ্গাত্মক গলায় আওড়ালেন,” বলো এবার গত দশ মিনিট যাবত কেন ব্যঙের মতো লাফাচ্ছিলে? আমার তো চোখ ধরে গেছে তোমার ব্যঙের মতো লাফানো দেখে।
হেলাল সাহেব চোখ মুখ উল্টে নিলেন কথা বলতে বলতে। জায়িন নিজের রাগ এতক্ষণ যথাসম্ভব ধরে রাখার চেষ্টা করলেও এবার সে বসা থেকে উঠে দাঁড়াল। সোফার উপর ওঠে লাফাতে লাফাতে বলল,”এভাবে ব্যঙ লাফায়।
হেলাল সাহেব ভাষণ দেওয়ার ন্যায় হাত তুলে বললেন,”হ্যাঁ, হ্যাঁ, আমি জানি। এবার আসল কথায় আসো। তোমাকে আমি বলছি না, ব্যঙের মতো লাফ-ঝাপ করে আমায় দেখাও ব্যঙ কীভাবে লাফায়!

জায়িন দাঁড়িয়ে থাকল, এবার আর সোফায় বসল না। রাগী কন্ঠে চোখ মুখে শক্ততা এনে আওড়াল,”আমার বিবাহিতা স্ত্রী-র দ্বিতীয় কোনো বিবাহের সম্বন্ধ আসলে এমন-কী দ্বিতীয়বারের ন্যায় বিবাহের কথা ওঠলে এই বাড়িতে আর ওই বাড়িতে একইদিনে দুটো জানাজা উঠবে। মনে রাখবেন, তার জন্য দায়ী কিন্তু আপনারাই থাকবেন।
হেলাল সাহেব রুঢ় গলায় জিজ্ঞেস করলেন,
“হুমকি দিচ্ছো?
জায়িন নিজের ধারালো চোয়ালে হাত বোলায়। ঠোঁটের কোণে দূর্বেধ্য এক টুকরো হাসি ঝুলিয়ে বলে ওঠে,” আমি হুমকি দিচ্ছি না আব্বু, আমার মতবেধের বিরুদ্ধে আবারো কিছু হলে এখন যা বলেছি তা আমি করে দেখাব আর তা আপনি খুব ভালো করে জানেন।

জায়িন নিজের কথা শেষ করে বড় বড় পদক্ষেপ ফেলে চলে যেতে নিবে হেলাল সাহেব জিজ্ঞেস করলেন,”যার বিয়ের সম্বন্ধ আসার জন্য এত লাফালে, সে কী জানে এসব?
হেলাল সাহেবের কথায় জায়িনের স্থির হওয়া পা আবার গতিশীল হলো। সামনের দিকে হাঁটতে হাঁটতে বলল,”আপনার ভাইয়ের কাছেই যাচ্ছি বিয়ের কথাবার্তা বলতে।
হেলাল সাহেব নাক ফুলিয়ে বিড়বিড় করে আওড়ালেন,
“নিজের বিয়ের কথা নিজে গিয়ে বলতে একটু লজ্জা লাগবে না। চ্যাহ চ্যাহ চ্যাহ! কী যুগ আসলো রে বাবা! নিজের বিয়ের কথা নিজে বলতে যাচ্ছে।

সূর্যের দীপ্তি উৎকণ্ঠিত তেজালো। সুফি খাতুন ইরহাম, ইসরাত, সৌরভি, মমো, নুসরাত ও আহানকে নিয়ে বিশেষ আলোচনায় বসেছেন। আলোচনার শিরোনাম:-এখনকার ছেলে মেয়ে এত নির্লজ্জ, বেহায়া হয় কেন?
সুফি খাতুন সোফায় বসে ভাষণ দিচ্ছেন। কেউই মনোযোগ সহকারে তার কথায় কানে না নিয়ে মনোযোগ সহকারে মোবাইল স্ক্রল করছিল। এমন অবস্থায় তিনি সবার কাছ থেকে সবার মোবাইল আত্মসাৎ করেছেন। আর সবাইকে মেঝেতে বসিয়ে নিজের ন্যায়মূলক কথাগুলো কানে ঢালছেন। কেউই তার কথা শুনতে চাচ্ছে না তারপরও তিনি জোর করে সবাইকে বসিয়ে রেখেছেন। সুফি খাতুন বলতে লাগলেন,”এখনকার ছেলে মেয়েরা এত নির্লজ্জ, বেহায়া যে একজন পুরুষের সাথে মাখনের মতো লেগে থাকে। আর কাপড় ও পরে বেহায়া পুরুষদের মতো।

নুসরাত কাপড়ের কথা আসতেই তড়াক করে চাইল সুফি খাতুনের দিকে। নিজের চিরাচরিত কপালে ভাঁজ ফেলে তীক্ষ্ণ চাহনি ছু্ঁড়ে দিল সুফি খাতুনের দিকে। সুফি খাতুন ভাব নিয়ে বসলেন। নুসরাতের দিকে না তাকানোর ভঙ্গি করে জিহ্বা দিয়ে ঠোঁট ভিজিয়ে নিলেন। এরপর আবার বলতে শুরু করলেন,”এরা এতটা বেপর্দা, বেহায়া যে ঘরে ভাই রেখে বুকে ওড়না দেয় না। আমাদের সময় তো এসব হতোই না। এসব চিন্তা মাথা আসলেই আমরা তওবা করতাম। আর এখনকার যুগে তো ছেলেদের সামনে উলঙ্গ হয়ে ঘুরুতে এদের লজ্জা লাগে না।
নুসরাত শুধু নাক মুখ ফুলালো। কিছু বলতে নিবে ইসরাত ইশারা আহানকে দেখাল। নুসরাত রাগ সামলানোর জন্য বিড়বিড় করে কিছু কথা বলল নিজের শোনার মতো,”বুড়ির বাচ্চি ঠাডা পড়েছে তোর চোখে দেখছিস না, আমদের সবার গায়ে ওড়না আছে।

দু-চারটা অতি বিখ্যাত মানের গালি দিয়ে নিজের মনের ঝাঁঝ মিটাল নুসরাত।
সৌরভি দাঁতে দাঁত চেপে কখন থেকে বলে যাচ্ছে,
“এই মহিলা বোকাচন্দ্রদাস, এই মহিলার কথায় রাগবি না সৌরভি। এই মহিলা লেজবিহীন প্রাণী। এই মহিলা একটা পিউর খাইষ্ঠা। এই মহিলার মাথায় দুটো শিং আছে। এই মহিলা বালপাকনা বেডি, এই মহিলা পিউর জোকার, জোকার, জোকার।
মমো সৌরভির কথা শুনে হেসে বারবার সৌরভির গায়ে ঢলে পড়ছে। মুখে হাত চেপে শুধু হাসছেই সৌরভির অতি উচ্চমাত্রার গালি শুনে। সে মনে করেছিল এই মেয়ে গালি কী তা জানেই না, কিছুই বোঝেই না। এখন দেখে এই মেয়ে গালিতে পি-এইচ-ডি করে রেখেছে। সৌরভি ঠোঁটে অনর্থক হাসি টেনে এনে বসে রইল। গলবিলের নিচ থেকে ঠেলে গালি বের হলে ও সেগুলো যত্ন সহকারে তুলে রাখল পরে ব্যবহারের জন্য।
এবার সুফি খাতুন বললেন,

” আমাদের সময় তো আমরা আমাদের বড় ভাইদের দেখলে ভয়ে থরথর করে কাঁপতাম। বড় ভাইদের সাথে কথা বলতে গেলে একশত বার ভাবতাম আর এখনকার যুগে বড় ভাইয়ের সাথে এভাবে চিপকে থাকে খবিস মেয়েগুলো যেন বড় ভাই না এগুলো হলো ওদের জামাই। কী লেভেলের বেহায়া, নির্লজ্জ, বেলেহাজ হলে বড় ভাইয়ের নাম ধরে ডাকে। আমাদের সময় দু-মিনিটে বড় থাকলে ও আমরা বড় ভাই বলে ডাকতাম আর এখন তেরো চৌদ্দ দিনের বড় ভাইকে নাম ধরে ডাকে। ছি্হ ছি্হ ছি্হ..!
সুফি খাতুন শ্বাস ফেললেন। এক গ্লাস পানি খেয়ে বললেন,”এখন তো লাজ লেহাজ গিয়েছে উচ্ছন্নে। আমরা তো আমাদের স্বামীর দিকে চোখ তুলে তাকাতে পারতাম না, সেখানে পরপুরুষের দিকে চোখ তুলে তাকানো, ঢলাঢলি করা সেটা তো বিলাসিতা ছিল।

নুসরাত মেকি হাসি ঝুলায় ঠোঁটে। ঠোঁট টেনে হাসে। নাছির সাহেব বাড়িতে থাকায় নিজের বাজখাঁই গলা যথাসম্ভব নিচু করে আওড়ায়,”দাদি তুমি ধন্য, তোমার কথা শুনে আমি আবেগে পুরো আপ্লুত হয়ে গিয়েছি। আচ্ছা এটা বলো তোমার মোট কতটা সন্তান?
সুফি খাতুন নির্দ্বিধায় বললেন,
“দশটা। কিন্তু কেন?

” তুমি তো অনেক ভালো একটা কাজ করেছ দাদি। দাদার দিকে চোখ তুলে না তাকিয়েই তোমার দশটা বাচ্চা। আমার ভাবতেই ভয় লাগছে, তুমি যদি চোখ তুলে দাদার দিকে তাকাতে তাহলে তো তোমাদের ঘরময় বাচ্চায় ভরে যেতো। চোখ তুলে না তাকিয়ে এই অবস্থা, আর যদি দাদার সাথে সামান্য একটু ঢলাঢলি করতে তাহলে তোমার এত বাচ্চা, এত বাচ্চা হতো যে এই পৃথিবীতে এদের থাকার ঠাই হতো না। আমি ভাবছি আমাদের কথা, আমাদেরও হয়তোবা এই পৃথিবীতে থাকার ঠাই হতোনা।
নুসরাতের কথা শেষ হতেই পুরো ড্রয়িং রুম জুড়ে সুফি খাতুনকে নিয়ে হাসির রোল পড়ে গেল। সুফি খাতুন রাগী গলায় বললেন,”চুপ একদম চুপ!
আহান মেঝেতে থাপ্পড় মারতে মারতে আওড়ায়,

“আপু একদম জম্বেশ কথা বলেছ। নানিকে একদম চমলক্ক বানিয়ে দিয়েছো তুমি। আপু কিন্তু যা বলছে একদম ডাহা সত্য কথা। নানি যদি চোখ তুলে তাকাত তাহলে আজ আমরা পৃথিবীতে না থেকে মঙ্গলগ্রহে পড়ে থাকতাম।
সুফি খাতুন রাগে ফুসফুস করতে করতে নাছির মঞ্জিল থেকে বের হয়ে গেলেন। যাওয়ার আগে টেবিলে রাখা ফলের বাস্কেট থেকে দুটো আপেল বগলদাবা করতে ভুললেন না।

নাছির মঞ্জিলের সোফায় বসে আছেন একপাশে জায়িন অন্যপাশে নাছির সাহেব। দু-জনেরই মুখ গম্ভীর করে রাখা। বোঝার উপায় নেই কার মনে কী চলছে বর্তমানে। অনেকক্ষণ দু-জন দু-জনকে লক্ষ করার পর নাছির সাহেবের নিকট ঠেকল এই নীরবতা ভাঙা প্রয়োজন। তাই নিজ উদ্বোগে নীরবতা ভেঙে জিজ্ঞেস করলেন,”কেমন আছো?
জায়িন বিনয়ের সহিত বলে ওঠে,

” জি আলহামদুলিল্লাহ। আপনি কেমন আছেন?
নাছির সাহেব ও জায়িনের প্রশ্নের উত্তর বিনয়ের সহিত দিলেন,”আল্লাহর রহমতে অনেক ভালো আছি।
জায়িন মিনমিন করে নিজেকে বলে ওঠে,
” তা-তো দেখতেই পাচ্ছি। আমার বউকে আমার কাছ থেকে দূরে রেখে সবাই ভালো আছে শুধু আমি ভালো মানুষটা অশান্তিতে আছি।
নাছির সাহেব উদ্বেগপূর্ণ কন্ঠে জিজ্ঞেস করলেন,
“কিছু বলছিলে?
” জি না!

জায়িন কথা গুছিয়ে নিল নিজের ভেতর। ঢোক গিলে বলে ওঠল,”আসল কথায় আসি মেজ আব্বু। এত ভনিতা করার কিছু নেই, যা বলতে এসেছি তাই বলে চলে যাব।
নাছির সাহেব নিজেও নড়েচড়ে বসলেন। সিরিয়াস হলেন জায়িনের কথা শোনার আশায়। জায়িন সময় নিয়ে বলতে শুরু করল,”ইসরাত কিন্তু এখনো আমার সাথে বিবাহে-র সম্পর্কে, তাই আপনি চাইলেও ইসরাতের বিয়ে দিতে পারবেন না।
নাছির সাহেব তীক্ত কন্ঠে বললেন,

“পুতুল খেলা ভেবে ভুলে যাও জায়িন।
জায়িন নাছির সাহেবের কথায় নিরর্থক অভিমত পোষণ করে। আলগোছে কথাটা কাটিয়ে দেয়, মাছি তাড়ানোর ভঙ্গিতে।
নাছির সাহেব সূক্ষ্ম চোখে লক্ষ করেন জায়িনের চতুরতা। তার কথাটা কী সুন্দরে ছেলেটা কাটিয়ে দিল। জায়িন আবারো ফিকে হয়ে যাওয়া বিনয়ী স্বরে বলে ওঠে,”আমাদের ধর্মীয় মতে একবার বিয়ে হয়ে গিয়েছে, এবার শুধু রেজিস্ট্রি করতে হবে। আপনার মত থাকলে আমি..
নাছির সাহেব হাত দিয়ে ইশারা করে কথা থামিয়ে দিলেন। অবাক কন্ঠে জিজ্ঞেস করলেন,” আমি অনুমতি দেয়নি তোমাকে, আমার মেয়েকে বিয়ে করার।
জায়িন অবিচল কন্ঠে বলে,

“আমি তো আপনার কাছে পারমিশন নিতে আসিনি মেজ আব্বু, আমি শুধু বলতে এসেছি। পরে বলবেন জানালাম না কেন? তাই জানাতে এসেছি, আপনারা বিয়ের প্রস্তুতি নেওয়া শুরু করুন।
নাছির সাহেবকে আদেশ দিয়ে জায়িন উঠে দাঁড়াল। দু-হাত পকেটে পুরে বলে ওঠে,” প্রথমবার শ্বশুরবাড়ি আসতে হলে না-কী কিছু আনতে হয়, তাই আপনার জন্য আমি এই সুখবর নিয়ে আসছি। আই হোপ আপনি অতি খুশি হয়েছেন আমার এই সুখবরে।
নাছির সাহেবকে তব্ধুল করে দিয়ে জায়িন দো-তলার দিকে অগ্রসর হলো। সেদিকে হাঁটতে হাঁটতে জিজ্ঞেস করল,”আপনার বোকা মেয়ের রুম কোনটা? আচ্ছা বলতে হবে না, আমার এতটুকু এভিলিটি আছে নিজের স্ত্রীর রুম খুঁজে বের করার।

নাছির সাহেবকে নিজের কথা দ্বারা মুখ বন্ধ করে দিয়ে জায়িন নীরব ভঙ্গিতে সোজা হেঁটে চলে গেল উপরের দিকে। সিঁড়ি বেয়ে ওপরে ওঠে সামনের রুমের ভেজানো দরজা হালকা করে ফাঁক করে উঁকি দিতেই ওই রুমে ইসরাতকে পাওয়া গেল। জায়িন দরজা ঠেলে ভিতরে ঢোকতে ঢোকতে জিজ্ঞেস করল,”আসতে পারি ম্যাডাম?

ইসরাত জায়িনের গলার আওয়াজ শুনতেই পিছু ফিরে তাকাল। চোখের ভুল মনে করে একবার আপাদমস্তক তাকিয়ে আবারো চোখ ঝাপ্টাল। যাতে চোখের ভুল হলে প্রতিচ্ছবি চলে যায়। জায়িন হাসতে হাসতে রুমে ঢুকে, পড়ার টেবিলের চেয়ার টেনে বসল। রুমে প্রবেশ করার সাথে সাথেই জায়িনের নাক চিড়ে মেয়েলি অন্যরকম একটা সুবাস এসে লাগছে, এখনো তা আরো জোরালোভাবে লাগছে। জায়িন চোখ ঘোরাল পুরো রুমে। সবকিছু পরিপাটি করে রাখা। বিড়বিড় করে আওড়ায়,”পারফেক্ট।
ইসরাত প্রশ্ন ছুঁড়ে দেয়,
“পারফেক্ট কী?
ইসরাত ভ্রু কুঞ্চিত করে রেখেছে, প্রশ্নের উত্তর জানার আশায়। জায়িনে সেদিকে একবার চেয়ে নির্বিকার কন্ঠে বলে ওঠে,”নাথিং!

তারপর নিজের সুদীর্ঘ শরীর নিয়ে উঠে দাঁড়ায়। সামনাসামনি হয় ইসরাতের। দু-হাত পকেটে পুরে নিয়ে কাম এন্ড কম্পোজড গলায় প্রপোজাল দেয়,” ইসরাত আপনার বাবার অবর্তমানে আমি আপনার সবচেয়ে বিশ্বস্থ ও ভরসার স্থান হতে চাই। আপনি কী দিবেন আমায় সেই অধিকার?
ইসরাত বোকার ন্যায় দু-ঠোঁট ফাঁক করে গোল গোল চোখে তাকিয়ে থাকে উপরের দিকে। জায়িন লম্বা হওয়ার ধরুণ ইসরাতকে জায়িনের সাথে চোখে চোখ রেখে কথা বলতে হলে মাথা উপরে তুলতে হয়। তাই জায়িনের এমন প্রশ্নের মানে কী জানার জন্য চোখ উপরে তুলল। জায়িন ইসরাতের ভড়কানো চাহনি দেখে গ্রীবা বাঁকিয়ে ইসরাতের দিকে সামান্য ঝুঁকে আসলো কপালে টোকা দিয়ে বলে ওঠল,”বোকা ইসরাত!
ইসরাত একগাল হেসে বোকার মতো বলল,

“আল্লাহর কসম জায়িন, আপনি কী বলছেন আমি তার একটুও কিছু বোঝিনি।
ইসরাতের কথায় জায়িন হাসে অধর বাঁকিয়ে। নিজের তথাকথিত গম্ভীরত্বে আবার ফিরে এসে বলে,” সময় দিলাম, আপনি চিন্তা করে উত্তর দিন! আমি জানি, আপনি যথেষ্ট ম্যাচিউর আমার প্রশ্নটা বোঝার জন্য।
জায়িন যেরকম নীরবে এসেছিল সেরকম নীরবে নিজের পুরুষালি লম্বা সুদীর্ঘ শরীর ও গম্ভীর মুখখানা নিয়ে রুমের বাহিরে বেরিয়ে গেল। ইসরাতকে ওইভাবে স্থির দাড় করিয়ে রেখে। জায়িন বেরিয়ে যাওয়ার পর ইসরাতের টনক নড়ল এইমাত্র এই লোক কী তাকে বিবাহের প্রস্তাব দিয়ে গিয়েছে? ইসরাত নিজেকে নিজে প্রশ্ন করল,”মানে কী? এভাবে কে বিয়ের প্রস্তাব দেয়?

নুসরাত এতক্ষণ ওয়াশরুমে থেকে কান খাড়া করে জায়িনের কথা শুনছিল। ইসরাতকে নিজের সাথে কথা বলতে দেখে নিজেকে আর ধরে রাখতে পারল না ওয়াশরুমের ভেতর। দরজার ঠেলে মাথা বাহিরে বের করে চোখ দুটো উল্টে নিয়ে তেরছা স্বরে বলে ওঠে,”দ্যা গ্রেট সৈয়দ জায়িন হেলাল, উরফে সৈয়দা ইসরাত নাছিরের বিশেষজ্ঞ স্বামী, দ্যা গ্রেট কার্ডিওলজিস্ট, ডাক্তার জায়িন এভাবেই বিয়ের প্রস্তাব দেন।
নুসরাত ওয়াশরুম থেকে বের হতে হতে ঠাট্টা করে আবারো বলে,”শিক্ষিত মানুষের শিক্ষিত স্টাইলে বিয়ের প্রপোজাল দেওয়া। হা হা হা..! আজ পর্যন্ত কেউ এভাবে প্রপোজাল দিল না। আজ কোনো প্রিও নেই বলে..!

হেলাল সাহেব খুবই গভীর চিন্তায় আছেন। নিজে নিজের সাথে বসে গভীর আলোচনা করছেন। জায়িনের কথা শুনে যা বুঝেছেন এই ছেলে যা ইচ্ছে তাই করে ফেলতে পারে। মেয়েকে তুলে নিয়েও আসতে পারে। তাই কোনো রিস্ক নেওয়া যাবে না। এখানে মান-সম্মান নিয়ে টানাটানি পড়ে যাবে উনার। তাই শেষ পর্যন্ত হেলাল সাহেব এই সিদ্ধান্তে পৌঁছালেন, রাজি হয়ে যাবেন বিয়ের জন্য। কিন্তু তার আগে মেয়ের বিষয়ে একটু খোঁজ-খবর নিতে হবে। তিনি যতটুকু দেখেছেন মেয়ে অত্যন্ত, বোকা, ঠান্ডা, নরম, ও নির্মল প্রকৃতির। হেলাল সাহেব নিজেকে শুধরে দিয়ে বললেন, হয়তো বোকা সেজে বসে থাকে মানুষের সামনে। খোঁজ নিতে হবে। ভালো মানুষীর মুখোশ পড়ে থাকলে তা টেনে ছিঁড়ে ফেলতে হবে। আর তার জন্য প্রয়োজন খোঁজ নেওয়ার। হয়তোবা মেয়েটা তার ন্যায় সহজ, সরল, ভালো মনের অধিকারী হতেও পারে। হতেই পারে..!

হেলাল সাহেবের অত্যন্ত গভীর চিন্তায় ব্যাঘাত ঘটিয়ে আগমন ঘটে জায়িনের। জায়িনকে দেখতেই হেলাল সাহেব বলে ওঠেন,”আমার কোনো সমস্যা নেই!
জায়িন ভ্রুক্ষেপহীন গলায় জিজ্ঞেস করে,
“কোন বিষয়ে?
“তোমার ওই মেয়েকে বিয়ে করার বিষয়ে। তার আগে আমার একটু খোঁজ-খবর নিতে হবে।

হেলাল সাহেব নির্বিকার কন্ঠে কথা শেষ করেন। ঠোঁটে লেগে আছে কুটিল হাসি। জায়িন গম্ভীর পুরুষালি গলায় আওড়ায়,” যা ইচ্ছে তাই করুন আব্বু, কিন্তু আমি ইসরাতকে বিয়ে করব, এটা আমার প্রথম ও শেষ কথা।
হেলাল সাহেবকে থমকানো দাঁড়ানো রেখে, আর কোনো কথা ব্যয় না করে, হেলাল সাহেবকে আর কোনো কথা বলার সুযোগ না দিয়ে জায়িন দ্রুত পায়ে অগ্রসর হলো দো-তলার দিকে। হেলাল সাহেব জহুরি নজরে ছেলের যাওয়া দেখলেন। দুঃখিত স্বরে বিড়বিড়িয়ে আওড়ালেন,”হেলাল তোমার ভাগ্যটাই খারাপ। একটা ছেলে তোমার মতো ভালো হয়নি।

খড়খড়ে সূর্যের দীপ্তি কমে আসতেই রক্তিম মুখ নিয়ে বাড়ি থেকে বের হয়ে আসলেন নিজাম শিকদার। রাগে তার গা জ্বলে উঠছে বারবার। হাতে বড়সড় একটা লাঠি ধরে রেখেছেন। আধ পড়া চুলে হাত বুলিয়ে নিজের বাড়ির পাশে রোপণ করা নিজের অতি প্রিয় গোলাপ গাছের দিকে তাকিয়ে দীর্ঘশ্বাস ফেললেন। ফুলগুলো রেখেছিলেন কোকিলা সুরি মেয়েটাকে দেওয়ার জন্য, কিন্তু কোন খবিসে তার টকটকে গোলাপ ফুলগুলো তুলে নিয়ে চলে গেছে। নিজাম শিকদার নিজের খিঁচে ওঠা মেজাজ নিয়ে চিড়চিড়ে চাহনি চারিদিকে নিক্ষেপ করলেন চোর আসলে কে সেটা দেখার আশায়? দূর-দূরান্তে চোখ বোলালেন নজরে সন্দেহভাজন কেউ পড়ল না।

বিতৃষ্ণায় জিহ্বার ডগা তিতা হয়ে আছে। আকস্মিক মেয়েলি ঝংকার তোলা হাসির শব্দে আশেপাশে তাকাতেই চোখে পড়লেন সুফি খাতুনকে। সাথে সাথে রাগের ও বিরক্তির উদ্রেক ঘটল। নিগূঢ় চাহনি সুফি খাতুনের দিকে দিতেই দেখলেন কানের পিঠে গোজা নিজের লাল টুকটুকে সুন্দরী ফুলগুলো। রাগে দিশেহারা হয়ে গেলেন নিজাম শিকদার। নিজের অসুস্থতার কথা বেমালুম ভুলে গিয়ে চরা গলায় চেঁচালেন। শক্ত হাতে লাঠি চেপে ধরে ধুপধাপ পায়ে এগিয়ে গেলেন সামনের দিকে। চোর হাতে নাতে ধরার জন্য। সুফি খাতুনের সামনে গিয়ে দাঁড়িয়ে কানের পেছনে গোজা ফুলের দিকে ইশারা করে কিছু বলতে নিবেন সুফি খাতুন আবারো যুবতীদের মতো মুখ চেপে হেসে ওঠলেন। হাসির তালে পুরো শরীর দোলে ওঠল তার। নিজাম শিকদার বমির উদ্রেক হচ্ছে সেরকম মুখ বানিয়ে সুফি খাতুনের হাসিতে ভাটা দিলেন। লাঠির সাহায্যে কানের পেছনে গোজা ফুলগুলোর দিকে ইশারা করে শুধালেন,”কোথায় পেয়েছেন আপনি ফুলগুলো?

সুফি খাতুন কানের পিঠে নিজের পাকা চুলগুলো গুজে নিলেন। রিনরিনে হাসি ঠোঁটে বহাল রেখে বলেন,”ফুলগুলো অনেক সুন্দর না?
নিজাম শিকদার চড়া গলায় একপ্রকার চেঁচিয়ে বললেন,”যুবতির মতো হাসি দেওয়া বন্ধ করুন, আর বলুন ফুলগুলো কোথায় পেয়েছেন? যুবতীদের মতো হাসলেই কী বুড়ি মানুষ যুবতী হয়ে যাবেন?
সুফি খাতুন যখনই শুনলেন তাকে বুড়ি বলে অবজ্ঞা করা হয়েছে তখনই তিনি ছ্যাত করে ওঠলেন। হাত তুলে শাসিয়ে নিয়ে বলেন,”একদম বুড়ি বলবেন না। আপনার মতো বুড়ো আমি এখনো হয়নি, তারপর ও আপনার মতো আমি এত স্টাইল করিনা
নিজাম শিকদার ঠাট্টা করে বলেন,
“আপনি বুড়ি নয়তো কী কচি খুকি? বাচ্চা মেয়েদের মতো তখন থেকে হাসার চেষ্টা করছেন কিন্তু হাসতেই পারছেন না। আপনাকে যুবতী কম জোকার বেশি লাগছে।
আহান পেছন থেকে উঁকি মেরে বলে ওঠে,

” অবশ্যই আমার নানি এখনো যুবতী। আর তার হাসি ও যুবতীদের মতো।
“আহাইন্নার বাচ্চা চুপ কর তুই। তোকে এখানে কেউ কথা বলতে বলেনি।
নিজাম শিকদার আঙুল তুলে শাসান আহানকে। সুফি খাতুন লজ্জা পেয়ে হেসে বললেন,”একদম আমার নাতিকে বকাবকি করবেন না বলে দিচ্ছি।
সুফি খাতুনের ডং-এ কান না দিয়ে নিজাম শিকদার আবারো চেঁচান,”ডং বাদ দিয়ে বলুন এই ফুল আপনি কোথায় পেয়েছেন?
আহান পেছন থেকে বলে ওঠে,
“ওই যে আপনার ওই গাছ থেকে নানি ফুলগুলো ছিঁড়ে নিয়ে আসছে।

আহান কথা শেষ করে আলগোছে পালিয়ে গেল বাড়ির ভেতর। নিজাম শিকদার ক্ষুবে ফুসফুস করে ফুলে ওঠলেন। হাতের লাঠি সুফি খাতুনের দিকে তাক করে ভয় দেখিয়ে রুঢ় গলায় বললেন,” এক্ষুণি ফুল দেন নয়-তো এখানে আপনাকে মেরে বর্তা বানিয়ে রেখে দেব। বুড়ো বয়সে ভীমরতি..! যুবতী হওয়ার শখ জেগেছে।
সুফি খাতুন হিংস্র চোখে তাকিয়ে কানের পেছনে গোজা ফুল হাতে তুলে নিলেন। নিজাম শিকদারের অপমানের বদলা হিসেবে তড়তাজা গোলাপ ফুলগুলো শক্ত হাতে নিজের দু-হাতের তালুতে পিষে ছুঁড়ে ফেললেন রাস্তারধারে। হুহ করে ভেংচি কেটে অহংকার দেখিয়ে চলে গেলেন সৈয়দ বাড়ির ভেতরে। যেতে যেতে নিজাম শিকদারের মুখের উপর গেট লাগিয়ে গেলেন শব্দ করে। উচ্চ শব্দে নিজাম শিকদারের শোনার মতো করে বললেন,”কত্ত বড় সাহস সুফি খাতুনকে বলে না-কী সে ডং করে! আমি, সুফি না-কী জোকার! এবার একটা শিক্ষা হবে ওই বুড়া নিজামের। জীবনে আরো একবার আমাকে বুড়ি বলতে একবার হলেও ভাববে।

মমোর সাথে দ্বিতীয় বারের ন্যায় মাহাদির দেখা তা ও অনাকাঙ্ক্ষিত ভাবে। মমো আজ ও কাদায় মাখামাখি করে আছে। সৈয়দ বাড়ির পিচঢালা রাস্তায় স্লিপ কেটে ঠাস করে হাঁটার রাস্তায় পড়েছে। তার মধ্যে আবার নতুন মেহমান তার দিকে তাকিয়ে দাঁত কেলিয়ে হাসছে। ব্যঙ্গ করে হাসতে হাসতে লোকটা আবার হাত বাড়িয়ে দিয়েছে তার দিকে। এই সাহায্য নেওয়ার থেকে বিষ খেয়ে মরে যাওয়া মমোর নিকট সহজ ঠেকল। রাগে দুঃখে মাহাদির বাড়িয়ে দেওয়া হাত অবজ্ঞা করে নিজের হাতের তালুতে ভর দিয়ে ওঠার চেষ্টা করতেই আবারো পুরো শরীর নিয়ে ধপাস করে পড়ল। তার মতো একজন প্রাপ্তবয়স্ক যুবতী বারবার একজন অচেনা লোকের সামনে পড়ায় অনেকটাই লজ্জায় পড়ল। চোখের কাছে কিৎকালের ভেতর জমা হলো এক রাশি জল।

তা বের হওয়ার আগে হাতের তালুতে ভর দিয়ে উঠতে যাবে বৃষ্টির পানি মাথায় লাগায় হাচ্চি দিতে যাবে, আর তখনই ঘটল দূর্ঘটনা। হাচ্চির সাথে অসাবধান বসোতো সর্দি বের হয়ে আসলো নাকের ডগায় আর তা দেখে হা হা করে গা কাঁপিয়ে হেসে উঠল মাহাদি। মাহাদির হাসি দেখে লজ্জায় অস্বস্তিতে ঝরঝর করে চোখ দিয়ে দু-ফোটা জল গড়িয়ে পড়ল মমোর। লজ্জায় মুখ ঢেকে কোনোরকম নিচ থেকে ওঠার চেষ্টা করতেই তৃতীয়বারের মতো পায়ের সাথে পা বেজে ঠাস করে পড়ল। মাহাদির হাসির ঝংকার তার সাথে আরো বেশি বৃদ্ধি পেল। মমোর রাগে ইচ্ছে করল অভদ্র লোকটার মাথা ফাটিয়ে ফেলতে। হা হা করে হাসা মুখের মধ্যে একদলা কাদা ঢুকিয়ে দিতে। রাগে হিতাহিত জ্ঞানশূন্য মমো কোনোরকম হাতে চাপ দিয়ে ওঠে দাঁড়ায়।

পায়ে হয়তো মোচড় লেগেছে তৃতীয়বার পা বেজে পড়ার জন্য। তাই মমো উঠে সোজা দাঁড়াতেই চিনচিনে ব্যথায় তার সারা শরীর অসাড় হয়ে গেল। এর মধ্যে মাহাদি পুরুষালি গলার উচ্চ শব্দে হাসির আওয়াজ, কানে বিঁধছে অস্বাভাবিকভাবে। মাহাদির হাসি এখনো একইভাবে বহাল। মমো হাতে নেওয়া কাদার দলা মাহাদির হাসির মধ্যে তার মুখের ভেতর তাবা মেরে ফেলে দিল। যা সোজা গিয়ে মাহাদির মুখে লাগল। হাসি হাসি মুখখানা এক নিমেষে পাংশুটে বর্ণের ধারণ করল। হাসি থেমে গেল নিমেষে। মমো বিরক্তি নিয়ে শুধায়,”এবার হাসুন না, হাসুন, হা হা করে! মুখ বন্ধ কেন এখন? ঠোঁট মেলেছে সেগুলো আর জোড়া লাগতে চায় না, তাই না? বিরক্তিকর লোক!

মাহাদি কথা বলার ভাষা হারিয়ে ফেলেছে। ফ্যালফ্যাল করে শুধু মমোর রাগী মুখ অবলোকন করছে। বেমালুম ভুলে গিয়েছে মমো একদলা কাদা তার মুখে ঠেসে দিয়েছে।৷ মাহাদি হতবিহ্বল চেহারা নিয়ে মমোকে অবলোকন করতে করতে ঢোক গিলতে নিবে জিহ্বায় কাদার অস্তিত্ব পেল। আর তখনই খাদ্যনালী ঠেলে বমি নামক ব্জ্র পদার্থের উদ্রেক হলো। চোখ মুখ উল্টে ওয়াক ওয়াক করে মুখের ভেতরের কাদা পরিস্কার করার চেষ্টা শুরু করে মাহাদি। মমো মাহাদির সামনে দাঁড়িয়ে হাত থেকে কাদা ঝাড়তে ঝাড়তে ক্ষেপা দৃষ্টি ছুঁড়ে দিল। গটগট করে পা ফেলে নাছির মঞ্জিলে যাওয়ার উদ্দেশ্যে উল্টো পথে হাঁটা ধরল। মনে মনে নিজেকে বলল,”আর জীবনে এই কুফা বাড়িতে আসব না। যখনই আসি তখনই কাদায় পড়ে গড়াগড়ি খাই।

প্রিয় প্রণয়িনী ২ পর্ব ১১ (৩)

মমোর যাওয়ার দিকে চোখ তুলে একবার তাকিয়ে মাহাদি আবারো থু থু করে মুখের কাদা ফেলার চেষ্টা করে। জিহ্বায় এখনো কাদার ছোটো ছোটো অংশের অস্তিত্ব রয়েছে, সে উপলব্ধি করতে পারছে। মুখ থেকে কাদা পরিস্কার করতে করতে মৃদু কন্ঠে আওড়ায়,”স্ট্রেঞ্জ! আমি কী করলাম? এত রাগ করল কেন?

প্রিয় প্রণয়িনী ২ পর্ব ১৩

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here