প্রিয় প্রণয়িনী ২ পর্ব ২০

প্রিয় প্রণয়িনী ২ পর্ব ২০
জান্নাত নুসরাত

পিনপতন নীরবতা বিরাজমান নাছির মঞ্জিলে। সবাই চুপচাপ বসে আছে। সবার মধ্যে বসে আছে জায়িন। বর্তমানে কেন্দ্রবিন্দু সে হলেও বারবার সবার দৃষ্টি অন্য একজনের দিকে চলে যাচ্ছে। না চাইতেও অক্ষিপট সেদিক থেকে ফিরে আসছে না সবার। নুসরাত মুখের মধ্যে আমের টুকরো ঢুকিয়ে সবার দিকে তাকাল। চোখের চশমার ভেতর থেকে উঁকি দেওয়া মেয়েলি চোখ আকারে ছোট ছোট করে কাটখোট্টা কন্ঠে জানতে চাইল,”কী? আমার দিকে এরকম করে তাকিয়ে আছেন কেন? আমি আপনাদের মতো মানুষ, কোনো ভিনগ্রহের প্রাণী না!

লিপি বেগম স্বামীর দিকে আড় চোখে তাকালেন। শুভ্র মুখখানা ইতিমধ্যে রক্তে লাল রঙে রঞ্জিত হয়ে ওঠেছে। আরশকে কিছু একটা ইশারা করলেন। আরশ সেসবে থোড়াই পাত্তা দিল না। চুপচাপ বসে হাতের মোবাইল স্ক্রলে মগ্ন হলো। লিপি বেগম এবার নিজ উদ্যোগে কথা বলতে গেলেন। গলা খাঁকারি দিয়ে ডেকে ওঠলেন,”নুসরাত..!
নুসরাত ভ্রু কুঞ্চিত করল সামান্য। নিজের মুখে আমের টুকরো ঢুকিয়ে লিপি বেগমের দিকে দৃষ্টি নিক্ষেপ করল। মুখ নাড়াতে নাড়াতে উত্তর দিল,”জ্বি বড় আম্মু!
লিপি বেগম মৃদু হেসে বললেন,

আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন

“পা নামিয়ে বসো বাবা। বড়দের মধ্যে পা তুলে বসা অভদ্রতা।
নুসরাত ঠোঁট, জিহ্বা দিয়ে ভিজিয়ে নিল। মৃদু হেসে পায়ের ওপর থেকে পা নামিয়ে নিয়ে বসল। ইসরাতকে নিজের সাথে করে নিয়ে আসলেন রুহিনী বেগম। আরশ জায়িনের পাশ থেকে ওঠে এসে বসল নুসরাতের পাশে। হেলাল সাহেব একবার ত্যাড়া চোখে তাকিয়ে চোখ সরিয়ে নিলেন।
নুসরাতের পাশে নির্দিষ্ট দূরত্ব রেখেই বসেছিল মাহাদি। আরশের তা সহ্য হলো না। মাহাদিকে নুসরাতের পাশ থেকে গা দিয়ে ধাক্কা দিয়ে একপ্রকার অনিহা নিয়ে দূরে সরিয়ে দিল। চোখ সরু সরু করে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে বলল,”ওর সাথে কী মধু লাগানো, যে সবসময় তোর ওর সাথে মৌমাছির মতো লেগে বসতে হয়।

মাহাদি ফ্যালফ্যাল করে চেয়ে রইল। অতঃপর কোনোরুপ শব্দ ব্যয় না করে নিজের চোখ সরিয়ে নিল। গণে গণে দু-সেকেন্ড পার হওয়ার পর কিচেনের দিকে চোখ পড়তেই অক্ষিকোটরে ভাসল পা স্লিপ কেটে ধুপ করে মেঝেতে পড়ে যাওয়া মমোকে। নাদুস নুদুস হওয়ায় নিজের জায়গা থেকে ওঠে দাঁড়াতে পারল না মেয়েটা। সোজা হয়ে ওঠে দাঁড়াতে ইরহামের সাহায্য লাগল। ইরহাম টেনে তুলে দাঁড় করাতেই নাক ফুলিয়ে কিছু একটা বলল মেয়েটা তাকে। মাহাদি সেদিক থেকে চোখ সরিয়ে নিয়ে বিড়বিড়িয়ে আওড়াল,”এই মেয়ের পড়ে যাওয়া ছাড়া আর কোনো কাজ নেই? মেঝেতে, রাস্তায়, কাদায়, সবজায়গায় পড়তে হবে তাও আমার সামনে, স্ট্রেঞ্জ!
ইসরাত সবার উদ্দেশ্যে সালাম দিতেই শোহেব সাহেব ওঠে এসে কপালে চুমু খেয়ে মাথায় হাত বুলিয়ে দিলেন। এক হাজার টাকার নোট দিয়ে মাথার চারপাশে ঘুরিয়ে নিয়ে নজর কাটলেন। ঝর্ণার হাতে টাকা তুলে দিতে দিতে বললেন,”বোয়াকে দিয়ে দিও।

শোহেব সাহেব হেসে বসলেন গিয়ে আবার নিজের জায়গায়। সোহেদ ওঠে এসে ইসরাতের মাথায় হাত বুলিয়ে দিলেন। তারপর কপালে সূক্ষ্ম চুমু খেয়ে মৃদু আওয়াজে বললেন,”প্রিটি লাগছে আপনাকে আম্মা।
ইসরাত মৃদু হাসল। সোহেদ সাহেব নিজের জায়গায় বসার আগে ইসরাতকে জায়িনের কাছে বসিয়ে দিলেন। নাজমিন বেগম কিচেন থেকে ঘাম মুছতে মুছতে এসে বসলেন সোফায়। নুসরাতকে ফিসফিস করে বললেন,” এসির পাওয়ার কমা।
নুসরাত সেন্টার টেবিল থেকে রিমোট নিয়ে এসির পাওয়ার কমিয়ে দিল। ধীরে ধীরে ড্রয়িং রুম ঠান্ডা হয়ে আসলো। হেলাল সাহেব এবার বলে ওঠলেন,”আসল কথায় আসা যাক। যখন সবকিছু নতুনভাবে হচ্ছে তাহলে নতুনভাবে পরিচিত হই?

নাছির সাহেব উপর-নিচ মাথা নাড়ালেন। হেলাল সাহেব ইশারা করলেন শোহেব সাহেব আর সোহেদের দিকে,”ওরা দু-জন আমার ছোট ভাই ওদের স্ত্রী এবং উনি আমার ফুপি। উনি আমার স্ত্রী, ও আমার বড় ছেলে আর ও ছোট ছেলে।
ইরহামের দিকে ইশারা করতেই ইরহাম কথা কেটে দিয়ে বলে ওঠল,”আমি মেয়ে পক্ষ।
হেলাল সাহেব মমো আর আহানের দিকে আঙুল তাক করতেই দু-জন একসাথে বলে ওঠল,”আমরা দু-জন মেয়ে পক্ষ।
নাছির সাহেব সবার দিকে ইশারা করে বললেন,
“উনি আমার স্ত্রী, এই আমার বড় মেয়ে, আমার ছোট মেয়ে, আমার ভাইয়ের ছেলে ওই দু-জন,আর ও আমার বোনের মেয়ে।
হেলাল সাহেব মেকি হাসি ঠোঁটে ঝুলিয়ে বললেন,

” সুন্দর পরিবার আপনাদের।
নাছির সাহেব হাসি মুখে বললেন,
“জি! আপনাদের ও।
“এবার আসা যাক রীতিনীতিতে। একজন মেয়ে যেভাবে দেখা হয় সেভাবে আমরা ও মেয়ে দেখব।
হেলাল সাহেবের কথায় নাছির সাহেব মাথা নাড়লেন। হেলাল সাহেব বললেন,” মেয়েকে বলুন হেঁটে দেখাতে।
নুসরাত ভ্রু যুগল কিঞ্চিৎ কুঁচকে রগচটা কন্ঠে জানতে চাইল,”কেন?
সুফি খাতুন শুধালেন,
“কী, কেন?
নুসরাত তাচ্ছিল্য করে বলে ওঠল,
” মেয়ে কেন হেঁটে দেখাবে?
শোহেব সাহেব নুসরাতের উদ্দেশ্যে বললেন,
“এটাই নিয়ম আম্মু।
নুসরাত চোখ সরু করে জিজ্ঞেস করল,

” কে তৈরি করেছে নিয়ম?
নাজমিন বেগম চোখ রাঙালেন। মৃদু স্বরে ধমকে বললেন,”চুপ একদম চুপ। এত প্রশ্ন কীসের?
নুসরাত সেসবে পাত্তা দিল না। সবার দিকে প্রশ্নাত্মক চোখে তাকিয়ে রইল। হেলাল সাহেব বিরক্তি নিয়ে বলে ওঠেন,”সমাজের তৈরি নিয়ম।
নুসরাত পরপর প্রশ্ন ছুঁড়ল,
“সমাজ কাদের তৈরি?
নাজমিন বেগম দাঁতে দাঁত চেপে ডেকে ওঠলেন,
” নুসরাত!

নুসরাত ফিরে তাকাল না নাজমিন বেগমের দিকে। লিপি বেগম হেসে উত্তর দিলেন,”তুমি জানো না?
নুসরাত কপালে ভাঁজ ফেলে হাসল এক গাল ফুলিয়ে। প্রশ্নাতীত চোখে তখনো তাকিয়ে। ইশারা করছে প্রশ্নের উত্তর দেওয়ার জন্য। পাশ থেকে আরশের গম্ভীর স্বর ভেসে এলো,”আমাদের।
নুসরাত চোখের চশমা ঠিক করে নিয়ে নড়েচড়ে বসল। নাজমিন বেগম নুসরাতের মুখের ভাব দেখেই তার মনোভাব ধরে ফেললেন। তাই নিষেধাজ্ঞা জারী করতে বলে ওঠলেন,”আর একটা কথা না। ইসরাত ওঠে দাঁড়াও!
ইসরাত নিজের জায়গা থেকে নড়ল না। জায়িন ও ইশারা করল চুপ করে বসে থাকতে। হেলাল সাহেব কঠোর স্বরে জিজ্ঞেস করলেন,”ওঠে দাঁড়াচ্ছিস না কেন? শুনতে পাসনি কী বললাম?
ইসরাত দীর্ঘ শ্বাস ফেলে ওঠে দাঁড়াতে যাবে জায়িন হাত চেপে ধরল। গম্ভীর গলায় বলল,”প্রয়োজন নেই, হেঁটে দেখানোর। ও ত্যাড়া হোক, বাঁকা হোক, টাক হোক, লেংড়া হোক, রোগা হোক, ওকে বিয়ে করতে আমার কোনো সমস্যা নেই। তাই হাঁটার ও কোনো প্রয়োজন আমি দেখছি না!
নুসরাত তীক্ষ্ণ কন্ঠে বলে ওঠল,

“প্রয়োজন আছে!
সুফি খাতুন না বুঝে নুসরাতের কথায় সহমত পোষণ করলেন। বলে ওঠেন,” হ্যাঁ, হ্যাঁ প্রয়োজন আছে। ওঠে দাঁড়াও!
নুসরাত হাসল। ইসরাত ওঠে দাঁড়াতে যাবে নুসরাত হাত তোলে বাঁধা দিল। চোখ ছোটো ছোটো করে হেসে ফেলল। তারপর বলল, “তোকে কে বলেছে ওঠে দাঁড়াতে? আমি তো জায়িন ভাইয়াকে হেঁটে দেখাতে বলছি।
নাজমিন বেগম মাথায় হাত চাপড়ালেন। তিনি জানতে এই মেয়ে এই ধান্দা আঁটছে নিজের মস্তিষ্কে। তাই তিনি বাদে সকলে একসাথে প্রশস্থ গলায় চ্যাঁচিয়ে ওঠলেন,” কী?
নুসরাত নির্বিকার চিত্তে চেয়ে রইল। জায়িনকে চোখ দিয়ে ইশারা করল ওঠে দাঁড়ানোর জন্য। হেলাল সাহেব রাগী কন্ঠে বললেন,”মাথা ঠিক আছে তোর?
নুসরাত ঠোঁট চেপে ধরে উপর নিচ মাথা নাড়াল। হেলাল সাহেব কিছু বলতে নিবেন আরশ গমগমে স্বরে বলতে লাগল,”সমস্যা কোথায়? ভাইয়া হেঁটে দেখাক, আর ইসরাত হেঁটে দেখাক একজন দেখালেই হয়। এতে আমি খারাপ কিছু দেখছি না।
লিপি বেগম দ্বিমত পোষণ করে বললেন,

“এরকম হয় না।
নুসরাত ভোলাভালা চেহারা বানিয়ে বলে ওঠল,
“এই তো আপনারা বললেন সমাজের তৈরি নিয়ম, তাহলে এখন কেন বলছেন এরকম হয় না?
হেলাল সাহেব বললেন,
“মেয়েকে বলুন হেঁটে দেখাতে।
নুসরাত হেলাল সাহেবের থেকে বড় গলায় জায়িনকে উদ্দেশ্য করে বলল,”ছেলেকে বলুন হেঁটে দেখাতে।
ইসরাত আর জায়িন দু-জনে ওঠে দাঁড়াল। একজনের আরেকজনের পানে চেয়ে এপাশ থেকে ওপাশ হেঁটে দেখাল।
হেলাল সাহেবের ব্যাপারটা মনমত না হওয়ায় ক্ষিপ্ত চাহনি নিক্ষেপ করে বললেন,”মেয়ের চুল দেখাও।
নুসরাত তাচ্ছিল্যের সুরে বলল,
“আব্বা ছেলের চুল দেখুন। ভালো করে টেনে-টুনে দেখে নিবেন চুলগুলো আসল নাকি নকল। আসল হলে একটু জোরে টান দিবেন কম বয়সে চুল পড়ে গেলে আমাদের ইসরাতকেই টাক জামাই নিয়ে থাকতে হবে।
নাছির সাহেব নুসরাতের কথায় উপর নিচ মাথা নাড়ালেন। নাজমিন বেগম কটমটিয়ে বললেন,” নুসরাত..!
নুসরাত মায়ের দিকে বিরক্তি নিয়ে তাকাল। নাকের পাটা ফুলিয়ে বলে ওঠল,”কী হয়েছে? নুসরাত, নুসরাত বলে চিৎকার করছো কেন? কিছু বললে বলো নাহয় আমার কাজে বাঁধা দিও না।
হেলাল সাহেব এবার তেজি কন্ঠে বললেন,

“মেয়ে রান্না জানে?
নুসরাত মেকি হাসি ঠোঁটে ঝুলিয়ে জিজ্ঞেস করল,
” ছেলে রান্না জানে?
হেলাল সাহেব চোখ উল্টে নিলেন। ক্ষিপ্ত চাহনি নিক্ষেপ করে জিজ্ঞেস করলেন,”ছেলে রান্না জানা, না জানা দিয়ে তোমাদের কাজ কী?
নুসরাত শ্বাস ফেলল। খোপা খুলে যাওয়ায় তা আবার বান করতে করতে উত্তর দিল,”আমাদের মেয়ের রান্না জানা, আর না জানা দিয়ে আপনাদের কাজ কী?
“মেয়ে কী ঘরের কাজ জানে?
“ছেলে কী ঘরের কাজ জানে?
হেলাল সাহেব চুপচাপ নুসরাতকে কিছুক্ষণ লক্ষ করলেন। তারপর শ্বাস ফেলে বলে ওঠলেন,” আমাদের মেয়ে পছন্দ হয়েছে, কিন্তু মেয়ের বোনকে পছন্দ হয়নি। মেয়ে মানুষের মুখ এত লাগামহীন ভালো চোখে মানুষ দেখে না।
নুসরাত হালকা হেসে বলে ওঠল,

“আমাদের ও ছেলে পছন্দ হয়েছে, কিন্তু ছেলের বাপকে পছন্দ হয়নি। পুরুষ মানুষের, মহিলাদের কাজের বিষয়ে এত খুঁতখুঁতে হওয়া আমরা বাপ-মেয়ে ভালো চোখে দেখি না। “ঠিক না আব্বা।”
নাছির সাহেব নুসরাতের সাথে তাল মিলিয়ে হ্যাঁ বললেন।
হেলাল সাহেব নাছির সাহেবের দিকে তাকালেন। ওঠে দাঁড়াতে দাঁড়াতে বললেন,”মেয়েকে একটু মেয়েদের মতো কাপড় পরা আর বসা শিখাবেন।
নুসরাত হাসি হাসি মুখে হেলাল সাহেবের চোখে চোখ রেখে বলল,”আপনার ছোট ছেলেকেও বুঝিয়ে বলবেন, অপরিচিত মানুষের এত কাছ ঘেঁষে বসা ঠিক না। আপনাকে দেখে আদবী মনে হচ্ছে তাই পরেরবার আসার সময় ছেলেকে ও একটু আধব-কায়দা ভালোভাবে শিখিয়ে নিয়ে আসবেন।

শিকদার বাড়ি। নিজাম শিকদারের হাতে মিষ্টির বক্স তুলে দিতেই, ভ্রু কুঁচকালেন পৌড় লোকটা। নুসরাত লোকটাকে এমন করতে দেখে একটা মিষ্টি টুপ করে প্যাকেট থেকে বের করে ঢুকিয়ে দিল নিজাম শিকদারের মুখে। মৃদু কন্ঠে বলল,”আহ, এত চিন্তা করছো কেন তুমি? টুপটাপ খেয়ে নিবে মিষ্টি, তা না করে আমার দিকে অদ্ভুতভাবে তাকিয়ে আছো। একটা কথা শোনো, দু-দিন পর এমনি কবরে চলে যাবে তাই ভালোভাবে খেয়ে দেয়ে কবরে যাও। এক ঠ্যাং তো এমনিতেই কবরে।
নিজাম শিকদার মুখের ভেতরে ঢোকানো মিষ্টিটা খেয়ে ঢোক গিললেন। মুখের বিকৃতি ঘটিয়ে জিজ্ঞেস করলেন,”কী এমন কাজ সম্পাদন করেছো, যে মিষ্টি বিলাচ্ছো তোমরা বাপ মেয়ে?
নুসরাত হাসল। গা দুলিয়ে হেঁটে গিয়ে সোফায় আরাম করে বসল। মৃদু আওয়াজে বলে ওঠল,”আগে হাজার টাকা বের করো, তাহলে বলব। নাহলে সুখবর জানার কোনো দরকার নেই।
নিজাম শিকদার তীক্ষ্ণ চাহনি নিক্ষেপ করে হাজার টাকার নোট বের করে নুসরাতের দিকে এগিয়ে দিলেন। সৌরভি বিরক্তি কন্ঠে বলল,”আমার দাদার থেকে টাকা নিতে তোর লজ্জা লাগছে না?
নুসরাত নির্দ্বিদায় উত্তর দিল,

“না, মোটেও লাগছে না।
সৌরভি শব্দ করে শ্বাস ফেলল। ইশারায় বলল কী হয়েছে বলার জন্য! নুসরাত মৃদু তেজি কন্ঠে বলে ওঠল,” মেহমান আসলে তোমরা খেতে দাও না? আমাকে আগে আপ্পায়ন করো তারপর বলব।
সৌরভি নুসরাতের গোঁড়ামিতে বিরক্ত হলো। রাগী চোখে চেয়ে যখন ওঠতে যাবে, নুসরাত থামিয়ে দিল। হাত দিয়ে ইশারা করল বসে যাওয়ার জন্য। ব্যগ্র স্বরে বলে ওঠল,”আমার জন্য সুখবর, কিন্তু তোর দাদার জন্য শোকখবর। তাই নিজেকে রেডি করে নিতে বল।
নিজাম শিকদার নুসরাতের হেয়ালিতে অস্থির হয়ে ওঠলেন। মৃদু আওয়াজে সৌরভির উদ্দেশ্যে বললেন,”আমার ভিপি হাই হচ্ছে, তাড়াতাড়ি বলতে বল ওকে।
সৌরভি দৌড়ে ওঠে আসলো। হাত দিয়ে নিজাম শিকদারের পিঠে হাত বুলিয়ে দিয়ে, ফ্যাসফ্যাসে কন্ঠে শুধায়,”বলবি তুই?

নুসরাত মাছি তাড়ানোর ভঙ্গিতে উড়িয়ে দিল সৌরভির কথা। সে তার মর্জির মালিক। কেউ তার উপর কতৃক জাহির করতে পারে না। তাই নৈঃশব্দে অনেকক্ষণ বসে থাকল। দেখে বোঝা গেল, বর্তমানে কথা বলার কোনো ইচ্ছে বা আকাঙ্ক্ষা নেই। সৌরভি শক্ত কন্ঠে ডেকে ওঠল,”নুসরাত…!
নুসরাত আরাম করে বসে রইল। হাত বাড়িয়ে এসির পাওয়ার কমিয়ে দিয়ে মৃদু আওয়াজে আওড়ায়,”একটু আগে যে মিষ্টি খেয়েছেন, তা জায়িন আর ইসরাতের বিয়ে ফাইনাল হওয়ার মিষ্টি। আগষ্টের বিশ তারিখ তাদের আনুষ্ঠানিকভাবে বিয়ে।
নিজাম শিকদার মুখ পাংশুটে বানিয়ে চেয়ে রইলেন। নুসরাত মৃদু আওয়াজে বলে ওঠল,”তুমি লেট করে গিয়েছো বুড়ো হ্যান্ডসাম, জায়িন আর ইসরাতের অনেক আগে বিয়ে হয়ে গেছে।
নিজাম শিকদার আনমনে জিজ্ঞেস করলেন,

“কবে?
নুসরাত দীর্ঘ শ্বাস ফেলল। ঈষৎ ঢিলে হওয়া কন্ঠে বলে ওঠল,”সাল-২০১২ মাস-জুলাই, তারিখ-২০, দিন-শুক্রবার
সৌরভি ব্যঙ্গ করে বলে ওঠল,
“তারিখ দেখি খুব ভালো মনে রেখেছিস?
নুসরাতের মুখ ফসকে বের হয়ে আসলো,
“আমার বিয়ের তারিখ আমার মনে থাকবে না, গাধা নাকি!
কথাটা বলেই মুখ চেপে ধরল। এক পলক সৌরভির দিকে চোখ বুলালো। মেয়েটা তার দিকে তেছড়া চোখে চেয়ে আছে। নুসরাত পাত্তা না দিয়ে ওঠে দাঁড়াল। নিজাম শিকদারের শোকাহত মুখের দিকে একবার চোখ বুলিয়ে নিয়ে হাসল। হাত দিয়ে প্লেন ওড়ার মতো দেখিয়ে বলল,”তোমার কোকিলা সুরি ভোঁ হয়ে গিয়েছে। নতুন কাউকে খুঁজে বের করো, কারণ কোকিলা সুরি এখন জায়িনের স্ত্রী। আশা করি আজ রাতে আরামের ঘুম হবে।
তারপর আবার হেসে বলে ওঠল,
” কীভাবে আরামের ঘুম হবে? তোমার ঘুম আজ হারাম হয়ে যাবে। হা হা..!
নিজাম শিকদার নুসরাতের দিকে কিৎকাল চেয়ে মৃদু আওয়াজে শুধান,” ঠাট্টা করছো আমাকে নিয়ে?
নুসরাত হাসতে হাসতে ড্রয়িং রুম থেকে বের হওয়ার আগে পিছু ফিরে আওড়াল,”সে সাহস আছে আমার?

নাছির মঞ্জিলের ড্রয়িং রুমে আসর বসেছে। টেবিলে এখনো তখনকার রেখে যাওয়া নাস্তার জিনিস পত্র। একের পর এক জিনিস তুলে নাছির মঞ্জিলেদ সবাই নিজেদের মুখের ভেতর ঢোকাচ্ছে। ইসরাতকে ইরহাম ইশারা করে, মুখের খাবার গিলে নিয়ে শুধাল,”আপি সালামি কত দিয়েছে?
ইসরাত নিজের হাতের মুঠোয় টাকাগুলো দেখিয়ে হাসল। অনেকগুলো খাম দিয়েছেন সৈয়দ বাড়ির সবাই দেখতে এসে। ঠোঁট কামড়ে হেসে খামগুলো রাখল সবার মাঝখানে। খাম খোলতে খোলতে উত্তর দিল,”এখনো জানি না, খুলে দেখি কত দিয়েছেন সবাই।

সবার খামের ওপর যার যার নাম লিখা। প্রথমে হেলাল সাহেব ও লিপি বেগমের পক্ষের খাম খোলা হলো। সেখান থেকে বের হয়ে আসলো দশ হাজার টাকা। শোহেব সাহেব আর ঝর্ণা বেগমের খাম থেকে বের হয়ে আসলো সাত হাজার টাকা। সোহেদ সাহেব আর রুহিনী বেগমের খাম থেকে বের হয়ে আসলো বারো হাজার টাকা। নুসরাত কিৎকাল বড় বড় চোখে টাকার দিকে চেয়ে আওড়াল,”বড়লোক্স মানুষজন।

সবাই হাসল। টাকাগুলো একত্রিত করল। হঠাৎ জায়িন লেখা একটা খামে আহানের চোখ আটকালো। মমোকে ইশারা করতেই সেই খাম হাতে নিল সে। সেটা তার হাত থেকে হস্তান্তর করার জন্য জন্য হামলে পড়ল সবাই। নুসরাত থাবা মেরে খামটা নিজের কাছে নিয়ে আসলো একপ্রকার উড়িয়ে। ইসরাতের দিকে তাকিয়ে ইশারায় জানতে চাইল খোলবে নাকি খোলবে না? ইসরাত হ্যাঁ ভঙ্গিতে মাথা নাড়াতেই খাম খোলা হলো। সেখান থেকে টাকা বের হয়ে আসলো না। জায়িন লিখা একটা নেকলেস আর একটা চিঠি বের হলো। নুসরাত চিঠিটা ইসরাতের হাতের মুঠোয় দিয়ে দিল। মনে মনে ইচ্ছে জাগল জানার কী লিখেছে বেটা? কিন্তু নিজের ইচ্ছে দাফন করে ঠোঁট চেপে নীরব হয়ে বসে রইল।

ইসরাত চিঠিটা খোলতেই টানা টানা হাতের লিছু লিখা ভাসল অক্ষিকোটরে। প্রথমেই বড় বড় অক্ষরে লিখা,
“প্রিয় সহধর্মিণী….!
আমার লিখার হাত জঘন্য আমি জানি, তাই আমার লিখা নিয়ে হাসাহাসি করবেন না। আমি এই চিঠিটা আপনাকে লিখেছি এই জন্য যে, আমার আব্বু আপনার বাসায় এসে অনেক উল্টো পাল্টা কথা বলবেন তাতে আপনি মন খারাপ করবেন না। আপনাকে দেখতে আসার পর আমি আপনার হয়ে কথা বলতে পারব না। আমি একটা ওয়াদা করেছিলাম আমার আব্বুর সাথে আর তাতে আমি দায়বদ্ধ। আপনার মনে প্রশ্ন জাগছে চাইলেই আমি আপনাকে মেসেজ করে জানাতে পারতাম, কিন্তু এভাবে কেন? হয়তো জাগতেই পারে। আমি লজ্জার সাথে এই স্বীকারক্তি দিচ্ছি যে, আপনার ওয়াটসঅ্যাপ নাম্বার এমনকি মোবাইল নাম্বার দুটোর কোনোটাই আমার কাছে নেই। তাই আমার এই গাফিলতি আপনি নির্দ্বিধায় ক্ষমার চোখে দেখবেন।
ইতি
আপনার প্রিয়।

ইসরাত চিঠি পড়ে মুচকি হাসি দিল। নুসরাত আর ইরহাম চোখাচোখি করল। তারপর দু-জনের শুরু হলো ইসরাতকে নিয়ে ঠাট্টা করা। দু-জনেই ঠোঁটে হাত চেপে হিহি করে হেসে ওঠল। ইরহাম মৃদু আওয়াজে বলল,” আজ একটা চিঠি পাই না বলে এরকম ঠোঁটে হাত চেপে হাসতে পারি না।

প্রিয় প্রণয়িনী ২ পর্ব ১৯

নুসরাত কিছু বলার পূর্বেই ইরহামের মোবাইলে কল আসলো। তর্জনী আঙুল ঠোঁটে চেপে চুপ দেখাল। সবাই চু হতেই কল পিক করে কানে ধরল ইরহাম। ওপাশের কথা শুনেই মুখ কালো করল। শঙ্কিত গলায় বলল,”আসছি ভাই।
ফোনটা পকেটে পুরে নাছির মঞ্জিল থেকে দ্রুত পদক্ষেপে বের হতে হতে সবার কাছ থেকে বিদায় নিল। নুসরাত কিছু বলার পূর্বেই ইরহাম হন্তদন্ত পায়ে ছুটল। বিড়বিড় করে আওড়াল,”আজ মনে হয় আর বাঁচব না।

প্রিয় প্রণয়িনী ২ পর্ব ২১

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here