প্রিয় প্রণয়িনী ২ পর্ব ২২

প্রিয় প্রণয়িনী ২ পর্ব ২২
জান্নাত নুসরাত

নাছির সাহেব আর ইসরাত বাড়ির বাহিরে বের হয়েছেন। সামনেরই গ্রোসারি শপে যাওয়ার জন্য। ইসরাত রেডি হয়ে আসতে আসতে নাছির সাহেব তার দৃষ্টিসীমার বাহিরে চলে গেলেন। ইসরাত দীর্ঘ শ্বাস ফেলে ধীরে ধীরে হাঁটতে শুরু করল। সৈয়দ বাড়ির ফটক পাড় করে যেতে নিবে জায়িন পেছন থেকে গম্ভীর গলায় বলে ওঠল,”দাঁড়ান!
ইসরাত পিছু ফিরে তাকানোর আগে জায়িন দ্রুত পায়ে এগিয়ে আসলো। কোনো কথা ছাড়া একহাতে দিয়ে চেপে ধরল মেয়েলি নরম হাত। ইসরাত থমকে দাঁড়াল। চোখ উপরে তুলতেই, জায়িন ইশারা করল সামনে পা বাড়ানোর জন্য। ইসরাত কতক্ষণ নিজের জায়গায় স্থির দাঁড়িয়ে থেকে নিজেকে স্বাভাবিক করল। ঢোক গিলে অগ্রসর হলো সামনের দিকে। জায়িন কোনো কথা বলল না। চুপচাপ মাথা নিচু করে চলা ইসরাতের মিষ্টি মুখের দিকে এক ধ্যানে তাকিয়ে রইল।

নুসরাতের কথা শেষ হওয়ার আগেই তার গালে পরপর বাজিয়ে দুটো থাপ্পড় পড়ল। তারপর থেকেই পিনপতন নীরবতা। বদ্ধ রুমে চুপচাপ দাঁড়িয়ে ইরহাম, মাহাদি। কোনো শব্দ ব্যয় করেনি দু-জন। বুঝেছে কথা বললেই তাদের উপর নুসরাতের রাগ ঝাড়বে এই লোক। তাই চুপ থাকাই শ্রেয় মনে হয়েছে দু-জনের নিকট।
আরশ এখনো নিজের জায়গায় চুপচাপ বসে সামনের ভদ্র মহিলাকে এক মনে দেখছে। নুসরাত থাপ্পড় খাওয়ার পর থেকে মুখে কুলুপ এঁটেছে। গালি দিতে চায়নি সে, আসলে দিতে চাইছিল কিন্তু মনে মনে। সেটা স্লিপ অফ ঠ্যাং হয়ে মনে মনে না হয়ে, জোরে বের হয়ে গেছে। এতে তার বেচারির দোষ কী! দোষ তো মুখের তাই না? তাহলে এই বেটা তাকে এত জোরে মারল কেন! তাই আবারো মুখ ফসকে ভুল কিছু বের হওয়ার ভয়ে ঠোঁট চেপে ধরে বসে আছে। তার নাজুক গালে আর থাপ্পড় খেতে চাচ্ছে না এই মুহুর্তে। জন্মের পরে এই প্রথম এত থাপ্পড় খেয়েছে মনে হয় সে। কীভাবে তার মতো একটা মেয়েকে এই লোক ধুমধাম করে মারছে। জামাই হয়েছে তো কী মাথা কিনে নিয়েছে নাকি! এই আরশ বেটাকে একটা শিক্ষা না দিলে, সে নুসরাত নাছির না! এই নিয়ে গণে গণে তাকে এই বেটা পনেরোটা থাপ্পড় মেরেছে। সব ফিরিয়ে দিবে সে!

আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন

গালি গালাজ শব্দটাই পছন্দ না আরশের। সে নিজেও গালি দেয় না আবার তার সামনে কেউ গালি দিক সেটাও সে পছন্দ করে না। এতে রাগ হয় প্রচুর! বর্তমানে তার চোখের সামনে নিস্তব্ধ হয়ে বসা নুসরাতের কিৎকাল পূর্বের গালি শুনে রাগ, বিরক্তি দুটোর একটাই হচ্ছে না। এতেও সে মহা বিরক্ত! কেন রাগ হচ্ছে না? কেন বিরক্তি আসছে না এই বেয়াদব মহিলার ওপর? সূক্ষ্ম গলা ভেজানোর জন্য ঢোক গিলে নিল। তাতে গলার এডামস অ্যাপলস উপর-নিচ বিট হলো। নিষ্প্রাণ চোখে স্থির চেয়ে থাকল বাজপাখির ন্যায় মেয়েলি মুখখানার দিকে। থাপ্পড় খাওয়ার জন্য গালে কিছুটা দাগ পড়েছে, সেদিকেই তার চোখ বারবার ঘুরে গিয়ে দৃষ্টিবদ্ধ হলো।
নুসরাত বসে থাকতে থাকতে বিরক্ত হলো। এতক্ষণ ধরে চুপচাপ বসে আছে এর মানে এই না আজ সারাদিন এভাবে বসে থাকবে সে। তাই নিজের বন্ধ রাখা মুখ খুলল কষ্ট করে। গাল দুটো অসাড় হয়ে আছে। নিজের রাগ ভেতরে চেপে সোজসুজি বসে প্রশ্ন ছুঁড়ল,”এই ভাই আপনার সমস্যা কী?

আরশ কথা বলল না। স্থির নিজের জায়গায় থাকল। কিন্তু চোখের মণি মুখ থেকে সরে এসে তা নাকে গালে স্থির হলো। নুসরাত অদম্য রাগ দাঁতের নিচে চাপা দিয়ে দাঁতে দাঁত চেপে কোনো রকম জিজ্ঞেস করল,”কী? সমস্যা কী আপনার? এমন করে বসে আছেন কেন? আচ্ছা বাদ দিন, আপনি বসে থাকেন এভাবে, আমাকে যেতে দিন! আমার তো একটা মান-সম্মান আছে, সারাদিন এভাবে বাহিরে থাকলে মানুষ ভালো বলবে না।
সামনা সামনি এই কথা বললেও মনে মনে নুসরাত তার উল্টো বিড়বিড় করল,”যার যা ভাবার ভাবুক, আমি নুসরাত নাছির এসবের পরোয়া করিনা।
আরশ নুসরাতের কথায় হয়তো একটু বিরক্ত হলো। তাই মুখের শান্ত ভঙ্গিমায় একটু বিরক্তি ফুটিয়ে তুলে ইরহামের উদ্দেশ্যে বলে ওঠল,”ওই বেয়াদ্দব মহিলার মুখ ভালো করে বেঁধে রাখ। কখন থেকে স্বামী সমান অবিভাবকের ওপর চিৎকার করতেই আছে।

ইরহাম নুসরাতের মুখে কাপড় বাঁধতে নিবে আরশ চোখ রাঙাল। গম্ভীর গলায় সর্তকতা জারী করে বলল,”মোলায়েম করে বাঁধবি, যাতে আমার মিসেস একদম ব্যথা না পায়। যদি সামান্য ব্যথা পায়, তাহলে…
ইরহামকে আর বলতে হলো না, সে মাথা ঝাঁকিয়ে বোঝাল বুঝে গেছে। নুসরাতের মুখে কাপড় বাঁধার আগেই আরশ তা থাবা মেরে নিয়ে নিল। ফুস করে ওঠে ইরহামকে ধমকাল,”তোকে বলেছি আমি কাপড় বাঁধতে?
ইরহাম আরশের দু-কথায় তব্ধুল হয়ে দাঁড়িয়ে রইল। মাহাদি কোনো কথা না বলে আরেকটা চেয়ের টেনে নুসরাতের সামনাসামনি বসতে যাবে আরশ ঠেলে দূরে সরিয়ে দিল। ইশারায় কোণোর একটা জায়গা দেখিয়ে বলে ওঠল,”ওইখানে গিয়ে বস। এদিকে কী মধু লাগানো আছে?
নুসরাত বারবার বিরক্তের উপর বিরক্ত হলো। কিন্তু তা বহিঃপ্রকাশ ঘটানোর সুযোগ না পেয়ে দাঁত কামড়ে বসে থাকতে হলো। একে হাত নাড়াতে পারছে না তার ওপর এই আপদ। আরশ এবার কিছু বলতে নিবে নুসরাত পুরুষালি ঠোঁটের দিকে চোখ স্থির রেখে জিজ্ঞেস করল,”সিগারেট খান?
আরশ নির্দ্বিধায় স্বীকারক্তি দিল,

“হু!
নুসরাত চোখ সরু করে আবারো শুধাল,
” মদ খান?
“না, কিন্তু বগলের নিচে নিয়ে ঘুরি।
নুসরাত মুখ দিয়ে বাহ বাহ দিল। হাত নাড়াতে না পারায়, হাত তালি দিতে না পেরে প্রচুর ব্যথিত হলো। আবারো প্রশ্ন করল,”আর কী কী বগলের নিচে নিয়ে ঘুরেন আপনি?
“মেয়ে মানুষও বগলের নিচে নিয়ে ঘুরি।
নুসরাত কিৎকাল আরশকে অবলোকন করল। অতঃপর মৃদু স্বরে মিষ্টতায় পরিপূর্ণ কন্ঠে আওড়াল,
” হাতে ব্যথা পাচ্ছি, খুলে দিন।
আরশ ইরহামকে ভ্রু দিয়ে ইশারা করে গম্ভীর কন্ঠে বলে ওঠল, “খুলে দেয়!
ইরহাম অবাক কন্ঠে জিজ্ঞেস করল,

” খুলে দিব?
আরশ শব্দ করে শ্বাস ফেলল। চোখের ইশারায় বলল খুলে দিতে। ইরহাম হাতের বাঁধনে হাত দিতেই আরশ থামিয়ে দিল। অবজ্ঞার সাথে দু-হাত তুলে আড়মোড়া ভেঙে বলল,”হাত খুলে দিস না।
ইরহামের দড়ির কাছে থাকা হাত থমকাল কিছুক্ষণের জন্য। সোজা হয় দাঁড়িয়ে অবাক কন্ঠে জিজ্ঞেস করল,
“কেন?
আরশ নিজের ক্লিনসেভ ধারালো চোয়ালে হাত বুলিয়ে গম্ভীর আওয়াজে আওড়াল,” খুলে দিলেই ফড়িং এর মতো তিড়িংতিড়িং করবে। এরচেয়ে ভালো এভাবেই বাঁধা থাকুক। শান্ত-শিষ্ট করুণ দেখতে ভালোই লাগছে, আমার মিসেসকে।
নুসরাত গলা ফাটিয়ে চিৎকার করে ওঠল। আরশকে তাচ্ছিল্য নিতে না পেরে, দাঁতে দাঁত চেপে কটমট করে বলে ওঠল,”আমি করুণ না।

কথা শেষ করতেই ধপাস করে দরজা খুলে গেল। মাহাদি, নুসরাত আর ইরহামের চোখ দরজার দিকে ঘুরে গেল। আরশ নিজের চেয়ারে পায়ের ওপর পা তুলে বসে থাকল। পেছন ফিরে দেখার প্রয়োজন বোধ করল না কে এসেছে ।
আরশ সঠান হয়ে সামনা সামনি বসায় নুসরাতের দৃষ্টি তাকে ভেদ করে দরজার কাছে গেল না। উঁকি ঝুঁকি মারল কে এসেছে দেখার জন্য, কিন্তু অক্ষিপট সে অবদি পৌঁছাল না। একবার পা বাঁধা ভুলে গিয়ে ওঠে দাঁড়াতে গিয়েও থেমে গেল। টনক নড়ল পা তো বাঁধা। তাই আরশের দিকে করুণ চোখে তাকিয়ে বলে ওঠল,”আরশ ভাই, দেখব!
আরশ বুকে আড়াআড়ি হাত বেঁধে চোয়াল শক্ত করে জিজ্ঞেস করল,”কী দেখবি?
নুসরাত সামন্য কপাল কুঞ্চিত করে বলে ওঠল,

“কে এসেছে তা!
আরশ গম্ভীর কন্ঠে বলল,
“দেখার দরকার নেই, আমাকে দেখ।
নুসরাতও তৎপর গতিতে কথার পিঠে কথা ফিরিয়ে দিল,”আপনাকে দেখার কিছু নেই। গত একঘন্টা যাবত অনেক দেখেছি! দেখার মতো বিশেষ কিছু খুঁজে পাইনি।
আরশ চোখ বড় বড় করে ধমকে কিছু বলতে নিবে পেছনের কথায় থেমে গেল। ঘাড় ঘুরিয়ে সামান্য পেছনে তাকাল। আবিরকে এমন হতবিহ্বল হয়ে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে কপালে ভাঁজ পড়ল আরশের।
আবির নুসরাতকে চেয়ারের সাথে বসা দেখে অবাক হলো। না চাইতেও মুখ দিয়ে বের হয়ে আসলো,” তুমি?
আরশ ঝটপট আবিরকে শুধরে দিয়ে বলে ওঠল,

“What are you? call her mam!
আবির মাথা নিচু রেখে আরশের কথার প্রতিত্তোর করল,” কিন্তু স্যার..
আরশ কথা কেটে দিয়ে বলে ওঠে,
“কোনো কিন্তু না, ম্যাম বলবে ও’কে।
নুসরাত আবিরের চুপসানো মুখের দিকে তাকাতেই হে হে করে হেসে ওঠল। নুসরাতের এমন হাসির মানে আরশ খুঁজে পেল না। আবির নুসরাতের দিকে চোখ তুলে তাকাতে নিবে আরশ ধমকে ওঠল,” ওর দিকে চোখ তুলে তাকাচ্ছ কেন? চোখ নিচের দিকে রাখো!
আবির মিনমিন করে বলে ওঠল,
“ওকে স্যার!
নুসরাতকে হাসতে দেখে আরশ বিরক্ত হলো। ইরহামকে ডেকে ওঠে,” ইরহাম!
ইরহাম জি ভাই বলতেই আরশ বলল,
“যা একটা লাঠি নিয়ে আয়, এই মহিলাকে দু ঘা মনে হচ্ছে দিতে হবে। দাঁতগুলো ঢুকছেই না ঠোঁটের ভেতরে।
নুসরাত আরশের কথায় থামল না। দ্বিগুণ শব্দে হেসে ওঠল। আবিরের বেচারা মার্কা মুখ দেখে নুসরাতের ইচ্ছে করছে মাটিতে গড়াগড়ি খেয়ে হাসতে। শুধুমাত্র হাত পা বাঁধার জন্য পারছে না। নাহলে এখানেই শুয়ে পড়ত সে।

নিজাম শিকদার আর সুফি খাতুনের ঝগড়া লেগেছে জম্বেশ। একপ্রকার সেটা জমে ক্ষীর হওয়ার মতো। ঝগড়া লাগার কারণ কেউ জানে না। সৌরভি ঝগড়া থামানোর চেষ্টা করছে কিন্তু তা থামাতে গিয়ে দু-জনের কথার তোপে পড়তে হচ্ছে সৌরভিকে। আহান সুফি খাতুনের পাশে দাঁড়িয়ে ঠোঁটে হাত চেপে হাসছে মুচকি মুচকি। ঝগড়া দেখতে ভালোই লাগছে তার নিকট। সুফি খাতুনের সাথে কথায় কোনোভাবে পেরে ওঠলেন না নিজাম শিকদার। তবুও হার মানতে রাজী নন তিনি। শয়তান ভদ্র মহিলাকে আজ একটা উচিত শিক্ষা না দিলে এই মহিলা মাথায় ওঠে বসবে। গতবার ও তার গাছের ফুল চুরি করেছে আর এবারো।

একটা হেস্তনেস্ত করেই ছাড়বেন নিজাম শিকদার। তাই নতুন উদ্যোগে ঝগড়া করতে ব্যস্ত হলেন উনারা। সৌরভি নিজের দাদাকে থামানোর চেষ্টা করলেও আহানের মধ্যে সেই মনোভাব পরিলক্ষিত নয়। আহান বাড়ির বাহিরে বসার জন্য চেয়ার পাতা ওখান থেকে একটা চেয়ার এনে বসে গেল আরাম করে। গালে হাত দিয়ে দেখতে মনোযোগী হলো টানটান এই ঝগড়া। মাঝে মাঝে মুখ দিয়ে শব্দ বের করে চিয়ার আপ ও করল। সৌরভি বুঝে গেল আজ আর এই ঝগড়া থামবে না। এই দু-জনের থামাতে গিয়ে বিনা কারণে নিজের এনার্জি নষ্ট করার কোনো মানে হয় না, তার চেয়ে ভালো বসে দু-জনের হাড্ডা-হাড্ডির লড়াই দেখা। সৌরভি ও আরাম করে ঝগড়া দেখার জন্য চেয়ার টেনে বসল। আহানের মতো গালে হাত দিয়ে মনোযোগী হলো ঝগড়া দেখায়।
নিজাম শিকদার রাগে চিৎকার করে বলছেন,

প্রিয় প্রণয়িনী ২ পর্ব ২১

“আপনাকে না করার পর কেন আপনি আমার গাছে হাত দিয়েছেন?
সুফি খাতুন তার থেকে দ্বিগুণ জোরে চিৎকার করে বলছেন,” দিয়েছি বেশ করেছি। গাছগুলো বাহিরে রাখলেই তো আমরা হাত দিব।
নিজাম শিকদার ক্ষুভে হিতাহিত জ্ঞান শূন্য হয়ে বললেন,”তো কী গাছগুলো বাড়িতে ঢুকিয়ে রেখে দেব?
” হ্যাঁ রাখুন, আমরা কী না করেছি !
সুফি খাতুন মুখ ঝামটা দিয়ে চলে গেলেন। আহান নিজেও পাতা চেয়ার হাতে তুলে নিয়ে নানির পেছনে যেতে যেতে নিজাম শিকদারের মুখের উপর গট করে দরজা লাগাতে ভুলল না।

প্রিয় প্রণয়িনী ২ পর্ব ২২ (২)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here