প্রিয় প্রণয়িনী ২ পর্ব ৩০
জান্নাত নুসরাত
নুসরাতকে এসে যে ছেলে পানি সেধেছিল ওর নাম আয়ান। আয়ান এর সাথে এসে জুটেছে আরো কয়েকটা ছেলে পেলে। সবগুলোই ভাবী আম্মা, ভাবী আম্মা, ডেকে মুখে ফেনা তুলে ফেলছে। আরশ শুধু চুপচাপ লক্ষ করছে নুসরাতকে। তার সাথে ভাব নেয় এই বেয়াদব মহিলা। তখন জিজ্ঞেস করেছিল, এগুলো ভাবী আম্মা বলে তোকে ডাকছে কেন! তার দিকে না ফিরে চুল উড়িয়ে চলে আসছে। সাথে ছেলেগুলোকে ও নিয়ে আসছে। আরশের কাছে কোনো কিছুই ভালো ঠেকছে না। তার বউকে ওসব ছোকরা পোলাপান ভাবী ডাকবে কেন! আরশ মনে মনে কিছু একটা ভেবে গলা খাঁকারি দিল ছেলেগুলোকে তার দিকে ফেরানোর জন্য, কিন্তু একটা ছেলে আরশের দিকে ফিরেও তাকাল না। রাগে হিসহিস করে আরশ গলা ফাটিয়ে জানতে চাইল,”ও তোমাদের কী?
ছেলেগুলো ফিরে স্বমসুরে বলে ওঠল,
“ভাবী আম্মা!
আরশ নিজের ক্লিন-সেভ ধারালো চোয়ালে হাত বুলালো। ইচ্ছে করল নিজের চুল নিজে টেনে ছিঁড়ে ফেলতে। রাগ সামলে নিতে প্রখর গরম নিঃশ্বাস মুখ দিয়ে ফুস করে ত্যাগ করল। তারপর নুসরাতের দিকে ভ্রু দিয়ে ইশারা করে বলল,” নানী ডাকবে, বুঝেছ?
আয়ান কপালে ভাঁজ ফেলল। বয়স বেশি না সতেরো, আঠারো হবে। তাদের ভাবী আম্মা বলে দিয়েছে ভাবী আম্মা ডাকতে তাহলে উনি কে,যে বলবে নানী ডাকবে। সে শক্ত কন্ঠে বলল,”ভাবী আম্মা বলেছে তাকে ভাবী আম্মা ডাকতে, তাই আমরা সবাই ভাবী আম্মাকে ভাবী আম্মা ডাকব। আপনি কে আমাদের এসব বলার?
আরশের মাথা রাগে ভনভন করে উঠল। তার বউ কেন ভাবী হতে যাবে। তার বউ শুধু তার বউ। অন্য সবার নানী, খালা, চাচি হবে, ভাবী হওয়া যাবে না, এটা কোনো ভাবে সম্ভব না! অসম্ভব! বউ নিয়ে সৈয়দ আরশ হেলাল কোনো রিস্ক নিবে না। বউয়ের বিষয়ে সে একদম পাক্কা। কোনো হেরফের হবে না। রাগী কন্ঠে হিসহিসিয়ে বলে ওঠল,”আমার বউ হয় ও!
আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন
নাহিয়ানের ছোকরারা একসাথে হেসে ঠাট্টা করে উড়িয়ে দিল আরশের কথা। আরশের মতো করে ও তারা শক্ত কন্ঠে নিজের জায়গায় পাহাড়ের মতো অটল থেকে বলল,”আপনি ভাবতেই পারেন ভাবী আম্মাকে আপনার বউ, কিন্তু ভাবী আম্মা তো আর আপনাকে জামাই ভাবে না। আচ্ছা ওসব ভাবা-ভাবির মধ্যে যেনো সীমাবদ্ধ থাকে, এর বেশি কিছু যেনো না হয়.
আরশের মাথা থেকে শুরু করে পায়ের পাতা পর্যন্ত থিরথির করে রাগে কেঁপে উঠল। নাক ফুলিয়ে কিছু বলতে যাবে, তৌফ এসে হাজির হলো সেখানে। সে এসে দাঁড়িয়ে প্রথমেই পশ্চাৎদেশ উচিয়ে বায়ূ দূষণ করল। তারপর দু-হাতে নিজের আশপাশ থেকে বাতাস উড়িয়ে দিয়ে বলল,”আপনাগো দু-জনরে দেখতে ভাই বোনের লাখান লাগে।
আরশ চোখের আকার প্রকট করে মৃদু চিৎকার করে বলে ওঠে,”কোনদিক দিয়ে? যত্তসব ছোটলোকি কথা!
তৌফের বলার ভঙ্গিমা দেখলে যেকেউ হেসে গড়াগড়ি খাবে। সে চুল চুলকে নিয়ে খাচ্চোরের মতো বলল,”প্রথমে আসা যাক মুখের কাটিং এ, দুজনের সেইম মুখ। নাক দু-জনের উঁচু, ঠোঁট ও ছোট ছোট একইরকম। কালারটা ও সামান্য এদিক সেদিক। উচ্চতায় ও প্রায় সেম সেম।
আরশ শীতল গলায় বলল,
“নুসরাত নাছির ফাইভ ফিট সিক্স ইঞ্চ, এন্ড আ’ম সিক্স।
তৌফ নাকে খুঁচিয়ে নিল। তারপর আবারো বলল,
“শুধু একদিক দিয়ে আপনাগো মিল নাই,আর সবদিক দিয়ে মিল আছে। পুরাই ভাই-বোন আপনারা। ভাবী আম্মাকে বোনের নজরে দেখেন, এর বেশি দেখার দরকার নেই।
মিনমিন করে বলল,
“এর বেশি দেখতে গেলে ভাবী আম্মা চোখ উড়িয়ে দিবে।
আরশ খুবই কষ্ট করে বসে ছিল। রাগ নিয়ন্ত্রণের বাহিরে চলে যাওয়া হাত মুষ্ঠিবদ্ধ রেখেছিল কিন্তু তৌফের এসব আচরণে রাগের মাত্রা এত বাড়ল কেউ কিছু বুঝে উঠার আগেই নিজের টেবিল থেকে উঠে এসে শক্তি দিয়ে একটা ঘুষি বসিয়ে দিল। তৌফ এমন অতর্কিত হামলা হবে বুঝেনি, আকস্মিক হামলায় নিজের জায়গা থেকে হেলে পড়ে যাচ্ছিল। সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে সে ও সমান শক্তি দিয়ে বসাল আরশের নাক বরাবর ঘুষি। নাকের পর্দা পাতলা হওয়ায় আবারো সেদিনের মতো নাক দিয়ে বেয়ে তরল গড়িয়ে পড়ল। আরশ হাতের তালু দিয়ে নাক মুছে দেখল রক্ত। বিরক্ত হলো, তারপর ওইদিকে দৃষ্টি স্থির রেখে তৌফের পেটের কাছে ঘুষি বসাল। তৌফ উলটে গিয়ে পড়ল মেঝেতে, পেট চেপে ধরে উঠে বসতে যাবে আরশ একহাতে কলার চেপে ধরে শুধাল,”উই লুক লাইক ফাকিং সিভিলিং?
তৌফ দাঁত কেলিয়ে হাসল। মুখে ঘুষি পড়ায় দাঁতের সাথে দাঁত লেগে ঠোঁট কেটেছে। ঠোঁটের রক্ত মুছে নিয়ে বলে ওঠল,”অবশ্যই। দেখলে বোঝা যায়, ভাই বোনের সেরা জুটি!
আরশ রাগে হাত তুলে আরেকটা ঘুষি বসাবে তার পূর্বেই জায়িন সাবধানী স্বরে বলে ওঠল,”স্টপ দিজ ননসেন্স শিট!
শূণ্যে তোলা হাত শূণ্যে রইল আরশের। মাহাদি এসে টেনে তুলল আরশকে মেঝে থেকে। তৌফ দাঁত বের করে হাসছে। আরশকে উস্কানোর সকল চেষ্টা করছে। জায়িন শক্ত কন্ঠে আদেশ দিল,”হাসি বন্ধ করো!
তৌফ ঠোঁট চেপে ধরে হাসি বন্ধ করে নিল। ভদ্র বাচ্চার ন্যায় উঠে দাঁড়াতেই নাহিয়ানের পেছন পেছন ঘোরা সবগুলো ছোকরা এসে চেপে ধরল তৌফকে। আয়ান নুসরাতের দিকে তাকাতেই দেখল সে টেবিলে মাথা হেলিয়ে রেখে চেয়ে আছে এদিকে। এতক্ষণ মারামারি দেখার তালে নুসরাতের দিকে তাকানোর কথা বেমালুম ভুলে বসেছিল সে। নুসরাত ঠোঁট বাঁকিয়ে হেসে ব্যগ্রতার সাথে বলল,”থেমে গেল কেন, ভালোই তো লাগছিল। আরো দু-চার মিনিট ফাইট করতে, এক্ষুণি তো ক্লাইমেক্স শুরু হতো।
মাহাদি আরশকে এনে চেয়ারে বসাল। ভিক্টরকে অনিকা ডেকে পাঠাল। ভিক্টর অনিকার ব্যাগ নিয়ে আসতেই সেখান থেকে ওয়ান টাইম বের করে মাহাদির হাতে তুলে দিল সে। মাহাদি ওয়ান টাইম আরশের যেখান কেটে গেছে সেখানে লাগাতে লাগাতে কানের কাছি ফিসফিসিয়ে টিপ্পনী কাটতে আওড়াল,”ও আমার দায়িত্ব, এর বেশি কিছু না!
আরশ সামান্য ঘাড় বাঁকাতেই মাহাদি মুখ বন্ধ করে নিল। ঠোঁটে মিটিমিটি হাসি এখনো লেগে। নাকে ওয়ানটাইম লাগিয়ে দিয়ে শেষ বারের মতো আবার বলল,”ও আমার দায়িত্ব, এর বেশি কিছু না। দায়িত্ব হা হা..!
জায়িন পরিবেশ সামলে নেওয়ার চেষ্টা করছে। এতক্ষণে দলা পাঁকিয়ে গিয়েছে তাদের টেবিলের আশেপাশে। অনেকে ভিডিও তৈরি করেছে মারামারি করার। জায়িন ভিক্টরকে ইশারা করল কিছু একটা। তারপর ভিক্টর সবার কাছে এগিয়ে গিয়ে নিজের হীম করে দেওয়া শীতল কন্ঠে বলল,”যে বা যারা ভিডিও করেছ ডিলিট করো! নাহলে আইনী ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
তৌফ ঠোঁটের কাছে রক্ত কাপড়ে মুছে নিল। আয়ানকে ভ্রু দিয়ে ইশারা করে হাঁটা শুরু করতেই তার সাথে যাওয়া সবগুলো আরশকে শুনিয়ে শুনিয়ে ভেঙ্গাতক ভাবে বলল,”ভাবী আম্মা আসছি ভাবী আম্মা! ভাবী আম্মা আমরা আপনার বাড়ির আশেপাশে থাকব ভাবী আম্মা, যেকোনো প্রয়োজনে আমাদের জানাবেন ভাবী আম্মা।
ওই ঘটনার পর দেখতে দেখতে চৌদ্দ দিন কেটে গেল। আরশের সাথে নুসরাতের দেখা হয়না। আরশ নিজে সেধে কথা বললেও কথা বলে না নুসরাত। ছয়টা থাপ্পড়ের বদলা সে নিচ্ছে আরশের সাথে কোনো বাক্য বিনিময় না করে। আরশ নুসরাতের এমন বাচ্চামি আচরণে বিরক্ত। গত ষোলোদিন যাবত এই বেয়াদব মহিলা তার সাথে যা তিড়িংতিড়িং করছে তা বলার বাহিরে। মাহাদি তাকে নিয়ে শুধু হাসে, আর আবেগের বসে বলা একটা কথা নিয়ে সারাদিন টিপ্পনী কাটে।
এদিকে ফ্রান্স যাওয়ার সময় যতদিন যাচ্ছে তত দিন আগাচ্ছে। এমন করলে তো চলবে না, নুসরাতের এমন বাচ্চামি আচরণের খেসারত কেন সে দিবে! এদিকে বিয়ের দিন যত কাছে আসছে তত কাজের চাপ ও বাড়ছে। আজ কিছু সময় আরশের হাতে থাকায় নাছির মঞ্জিলের উদ্দেশ্য বের হতে নিল এর মধ্যে জায়িন এসে হাজির তার সামনে। নিজস্ব ভঙ্গিমায় দাঁড়িয়ে কিছুক্ষণ আরশকে দেখল সে। তারপর বলে ওঠল,”ইভেন্ট ম্যানেজমেন্ট এর সাথে আমার কথা হয়েছে ওরা বিয়ের আগের দিন এসে মেহেদী সেট, বিয়ের সেট ঠিক করে নিবে। শুধু এডভান্স দেওয়া বাকি রয়েছে ওগুলো নিয়ে তুই দিয়ে আয়, আর আরেকটা কথা কনভেনশন হল কয়েকটা আমি সিলেক্ট করে রেখেছি আউটডোর ইনডোর দেখে আসিস আসার সময়। মোস্ট ইম্পর্ট্যান্ট থিং, পরিস্কার পরিচ্ছন্নতা ওদের কেমন তা সবার আগে খেয়াল করিস।
জায়িন কয়েকটা বক্তব্য দিয়ে যেমন গতিতে এসেছিল তেমন গতিতে চলে গেল। আরশকে একবার জিজ্ঞেস করল না, সে যাবে নাকি যাবে না। কী এক অবস্থা! আরশ দীর্ঘশ্বাস ফেলে রুম থেকে মানিব্যাগ, চাবি নিয়ে আসলো। থ্রি কোয়াটার প্যান্টের পকেটে ঢুকিয়ে হাঁটা ধরল সামনে। মাহাদি বিয়ের শপিং করতে গিয়েছে, তাই বাসা খালি। ইরহাম আর আহান তো সারাদিন ওই বাড়ি পড়ে থাকে এরা এখনো ওই বাড়ি। আরশ বের হয়ে গেল বড় বড় পায়ে। নুসরাতের সাথে দেখা করে কথা বলার চিন্তাটা বেমালুম ভুলে বসল কাজের চাপে। কনভেনশন হল দেখে সবকিছু সিলেকশন করে আসতে আসতে রাত একটা বাজল। বাসায় আসতেই জায়িন আবার তাকে নিয়ে চলে গেল ওয়েডিং ওয়াড্রবে। সেখানে গিয়ে আরো কিছু কাজ শেষ করে বাড়ি ফিরল ভোর চারটায়। ঘুমাতে যাওয়ার চিন্তা ভাবনা মাথায় থাকলেও একদম গোসল সেরে এসে বিছানায় বসল। চোখ বুলালো পুরো রুমে। নিজের পায়ের কাছে তাকাতেই দেখল শার্ট খুলে ঘুমাচ্ছে মাহাদি। পরণে শুধু শর্ট প্যান্ট। আরশ এসির পাওয়ার ২০ এর ঘরে নামিয়ে দিয়ে ঠাস করে শুয়ে পড়ল বিছানায়। চোখ বন্ধ করতেই ক্লান্তিতে ঘুম এসে ধরা দিল অক্ষিপটে। হাতের ভেজা টাওয়াল বিছানার একপাশে পড়ে রইল ওভাবেই।
সকাল সকাল নুসরাতের মাথা হ্যাং হয়ে আছে। তার বন্দুকজি দেখা পাচ্ছে না সে দু-দিন যাবত। সেদিন তার রুমে লক করে রেখেছিল কিন্তু ব্যাটা বদমাস বন্দুকজি কোথাও নেই। ভালো করে আশপাশ খুঁজল সে, না নেই কোথাও! হঠাৎ মিউ মিউ আকারের শব্দ কানে ভেসে আসতেই থাই গ্লাস বেয়ে উঁকি দিল নুসরাত। ব্যাক ইয়ার্ডে চোখ পড়তেই নুসরাতের চোখ রসগোল্লা হয়ে গেল। বিস্ময়ে দাঁত খিঁচে গেল। বন্দুকজি বিড়াল একটার সাথে বসে ইটিস-পিটিস করছে। সে প্রায় বিশ বছরের একজন যুবতী হয়েও প্রেম করতে পারল না আর এই বন্দুকজি, ছানা থাকতে প্রেম করে। নুসরাত চোখ তীক্ষ্ণ করে দেখল। বন্দুকজির সাথে থাকা বিড়ালটা দেখতে চেনা চেনা ঠেকল তার কাছে। মাথায় চাপ দিতেই বিহ্বলিত হয়ে মুখ দিয়ে বের হয়ে আসলো এহ.. টাইপ শব্দ। তার বিড়াল হয়ে পাশের বাড়ির সজীবের বিড়ালের সাথে প্রেম এটা নুসরাতের কাছে ঘূর অন্যায় ঠেকল। কত্ত বড় সাহস! সজীব তার উপর ডরি ঢালতে পারেনি বলে ওর বিড়াল বদমায়েশ টাকে তার নিষ্পাপ বন্দুকজির পেছনে লেলিয়ে দিবে। নুসরাত দু-পাশে মাথা নাড়াল, অসম্ভব! মাথায় দু-একটা বাজ ও পড়ল ইন্ডিয়ান নাটকের মতো। তারপর নুসরাত আরেকটু চোখ খিঁচিয়ে তাকাতেই দেখল তার বন্দুকজির পেট সামান্য ফোলা। এতেই নুসরাতের চোখ কোটর থেকে বের হয়ে আসলো। বড় বড় চোখ বানিয়ে দৌড় দিল ইসরাতকে সব জানানোর জন্য।
ইসরাত নিজের রুমে বসে বই পড়ছিল। গভীর মনোযোগ বইয়ে। কিন্তু নুসরাতের ডুসডাস করে ভেতরে ঢোকায় মনোযোগ বিক্ষিপ্ত হলো বই থেকে। বই থেকে নজর তুলে উপরে চাইতেই দেখল নুসরাত উল্টে মেঝেতে পড়ে আছে। দু-হাতে মাথায় চেপে ধরে নাটকীয় ভঙ্গিতে বলে ওঠল,”আমার বন্দুকজি, আমার বন্দুকজি!
ইসরাত ভ্রু কুঁচকাতেই নুসরাত এক চোখ তুলে তাকাল, আবারো হাই হুতাশে লিপ্ত হলো। মাথা চাপড়ে চাপড়ে নাকি সুরে কেঁদে কেটে ভাসিয়ে দেওয়ার মতো করে বলল,”বদমায়েশ বন্দুকজি, ধোঁকা করেছে আমার সাথে।
ইসরাত বুঝল না কী ধোঁকা করেছে বিলাইটা নুসরাতের সাথে। বই বিছানার উপর রেখে বিরক্ত ভঙ্গিমায় শুধাল,”কী ধোঁকা করেছে বন্দুকজি তোর সাথে?
নুসরাত হাই হুতাশ করে মাথায় চাপড়াল। নাটকীয় ভঙ্গিতে চোখের পানি মুছে নিয়ে, অস্বাভাবিক ধাবানলে ক্ষিপ্ততা পরিপূর্ণ কন্ঠে বলে,”বদমায়েশ বন্দুকজি, সজীবের বিড়ালের সাথে ইটিসপিটিস করে পেট বাধিয়ে ফেলেছে।
ইসরাত বিকট জোরে চিৎকার করে জিজ্ঞেস করল,
“কী?
নুসরাত খিটখিটে কন্ঠে, চ্যাঁচানো সুরে বলল,
“বোঝো না শালী, বদমায়েশ বিড়াল পেট বাধিয়েছে ফষ্টিনষ্টি করে।
” সামান্য এই কথা..!
নুসরাত যেন ইসরাতের কথায় আকাশ থেকে ধুপ করে পড়ে গেল। মানে কী বলে এই মেয়ে সামান্য এই কথা এটা। সে এখনো কুমারি, সুশীল, সুশ্রী, ভদ্র একটা মেয়ে আর তার বিড়াল পেট বাধিয়েছে। এটা তার কাছে বিষ পান করার মতো একটা কঠিন বিষয়। ইসরাতের কথায় নুসরাত বলল,”এটা সহজ, সরল, সামান্য, একটু, ক্ষীণ বিষয় নয়, এটা পৃথিবী ফেটে যাওয়ার মতো বিষয়। বিশ্ব ব্রহ্মাণ্ডের সকল মানুষ বিষ পান করে মরে যাওয়ার মতো কঠিন বিষয়। এ মানিতে পারিলাম না আমি।
ইসরাত শান্ত চোখে চেয়ে বলে ওঠল,
“তাহলে তুই ও পেট বাধিয়ে আয়, তারপর তুই আর তোর বিড়াল একসাথে বসে বাচ্চা দিবি, না হয় বিষ খেয়ে নিবি।
নুসরাত ইসরাতের এত কঠিন কথা মেনে নিতে পারল না। চিৎকার করে কান চেপে ধরল। দু-দিকে মাথা নাড়িয়ে বলল,” এসব বলার আগে তোর মরণ হলো না কেন,কেন,কেন!
ইসরাত ও নাটকীয় ভঙ্গিমায় বলল,
“কারণ, কারণ, কারণ কোনো কিছুই নেই। যা সর, তোর বিড়ালের কাছে যা।
নুসরাত এক আঙুল তুলে সতর্কীরণ ভঙ্গিমায় শাসাল ইসরাতকে। বলে ওঠল,” বিড়াল বলবি না, ওর নাম বন্দুকজি! সম্মান দে আমার বিড়ালের বাচ্চাকে..!
ইসরাত থোড়াই পাত্তা দিল না নুসরাতকে। আরাম করে বসে বই খুলে মনোযোগী হলো। নুসরাত পাত্তা না পেয়ে বিরক্ত হলো, মেঝেতে উল্টে পড়ে রইল অশালীন ভঙ্গিতে।
নাজমিন বেগম নিজের বোনের বাড়ি গিয়েছেন বিয়ের কার্ড নিয়ে দাওয়াত দিতে। খালি বাড়ি শয়তানের আস্তানা বলে মানুষজন, নাজমিন বেগমের যেতেই বাড়ি খালি হয়ে গেল। ইসরাতকে ঠেলে ধাক্কিয়ে পার্লারে জায়িন ট্রিটমেন্ট নিতে পাঠিয়েছে। ইসরাত যাওয়ার পর বাড়ি নুসরাতের হাতে। নাছির সাহেব ও বাড়িতে নেই! ইরহাম আহান এসে ঝুটল তার মধ্যে। সবাই মিলে স্টোর রুম থেকে সাউন্ডসিস্টেম তুলে নিয়ে আসলো। তা বয়ে টেনে হিঁচড়ে নিয়ে গেল ছাদে। একটায় তাদের হলো না খুঁজে খুঁজে আরো দুটো বের করল। বাটন প্রেস করল। তারপর সাউন্ডসিস্টেমের পুরো সাউন্ড বাড়িয়ে দিল। বিয়ে বাড়ি একটু তো ভাইব আনা প্রয়োজন। তাই তারা এই ব্যবস্থা করেছে। বাটন প্রেস করতেই তার স্বরে গেয়ে উঠল,
“বরিশালের লঞ্চে উইঠা
লইবো কেবিন রুম–আহ,
বন্ধুরে মোর বুকে
লইয়া দিবো একটা ঘুম
ঠাইসা দিবো একটা ঘুম।
নুসরাত আর ইরহাম সাউন্ড বক্সের পাশে দাঁড়িয়ে চিৎকার করে করে গানটা গাইল। আহান উড়াধুড়া পাশে নাচতে ব্যস্ত। এই গানটা শেষ হওয়ার পর আবারো আরেকটা গান দিল,”এসেছে এসেছে আবারো ইলেকশন,
জিতবে নৌকা নেই কোনো টেনশন।
ষোলো কোটি মানুষের একটাই ডিসিশান,
জিতবে নৌকা নেই কোনো টেনশন।
জয় বাংলা, জিতবে আমার নৌকা।
এখানে সবাই এসে চিৎকার করে গেয়ে উঠল,
“জয় বাংলা হারবে আমার নৌকা
জয় বাংলা, লুঙ্গি সামলা।
ষোলো কোটি মানুষের একটাই ডিসিশান
পরবে লুঙ্গি নেই কোনো টেনশন।
নাছির মঞ্জিলে গানের ধমকে ফেটে যাবে এমন ভাব। তিনটা সাউন্ড বক্সের আওয়াজ এত জোরালো যে নাছির মঞ্জিল ভেদ করে তা, সৈয়দ বাড়ি, শিকদার বাড়ি পার করে ফেলেছে৷ এতক্ষণে সোসাইটির ভেতর থাকা অনেক বাড়ির মানুষ এসে দলা পাকিয়েছে নাছির মঞ্জিলের সামনে। সমান তালে কলিং বেল বাজাচ্ছে তারা। গানের উচ্চ সুরে কলিং বেলের আওয়াজ ডাকা পড়ছে।
সৈয়দ বাড়ির জানালার গ্লাস খোলা থাকায় তা দিয়ে সুরসুর করে প্রবেশ করল শব্দ যুক্ত গানগুলো। প্রথম প্রথম আওয়াজে এত পাত্তা না দিলেও এখন তা বেড়ে দ্বিগুণ হয়ে গিয়েছে। একটা সাউন্ড বক্সের এত আওয়াজ হওয়া কোনোভাবেই সম্ভব নয়। সবাই ধরে নিয়েছে একসাথে তিনটা চারটা এরা চালু করে রেখেছে।
ভোর বেলা ঘুমানো তে এখনো ঘুম কাচা রয়েছে আরশের। অতিরিক্ত আওয়াজে ঘুমে ভাটা পড়ল। একহাতে বালিশ কানে চেপে ঘুমানোর বৃথা প্রচেষ্টা করল, কোনোভাবেই কোনো কিছু সম্ভব হলো না। রাগে হিসহিস করে উঠে বসল ঘুম থেকে। গানের তালে সৈয়দ বাড়ির প্রতিটা ইট পর্যন্ত কাঁপছে। আরশ রাগে লাল হয়ে সামনে যা পেল তা গায়ে চড়াল। সামনের দিকে ফিতাগুলো ঝুলে রইল ওভাবেই,লাগানোর কথা বেমালুম ভুলে গেল। চওড়া পিঠ ঘুরিয়ে পায়ে স্লিপার ঢোকাল। রুম থেকে বের হতে হতে হাতের কাছে যা পেল তা নিল। চোখের শিরা উপশিরা ঘুমের অভাবে লাল হয়ে আছে। আঁখিযুগলের অগ্নিকাণ্ড রাগ দেখলে যে কেউরই শরীরের লুম-কোপ শিউরে উঠবে। ভয়ে খাড়া হয়ে যাবে থরথর করে। ধুপধাপ পায়ে নিচে নামতেই লিপি বেগম বাঁধা দেওয়ার চেষ্টা করলেন। রাগের বসে কী না কী করে বসে ছেলেটা। উনার বড় ছেলেটা যতটা দায়িত্বশীল, বুদ্ধিমান, শান্ত মেজাজের, ছোটটাই ততটা বিগড়ানো। এখন ছেলেটাকে কী বলবেন, তার শ্বশুর মশাই শান্ত এর সাথে শান্ত আর রাগী এর সাথে রাগী এর বিয়ে দিয়ে দিয়েছেন। আগে এমন হবে জানলে নিজে দাঁড়িয়ে বিয়ে হতে দিতেন না। আরশকে নরম সুরে বোঝানোর জন্য বললেন,”বাচ্চা মানুষ একটু খুশি মজা করছে করে নিক, রাগের বশে কিছু করিস না বাবা। দেখ ছোট মানুষ ওরা আরশ..! বড় হলে এমন করবে না।
আরশ শুনল না। নিজের গা থেকে লিপি বেগমের হাত ছাড়িয়ে নিয়ে শক্ত পায়ে বের হলো। যেতে যেতে চিৎকার করে গেল,”আমার শান্তি একটাও দেখতে পারে না, সারারাত ঘুমাইনি ভোরে এসে ঘুমালাম তা ও শান্তি মতে ঘুমাতে দিল না। আজ এদের একটা হ্যাস্তন্যাস্ত করেই আসবো।
লিপি বেগম পেছন পেছন দৌড়ে এসে অনেকবার আটকালেন আরশকে, আরশ ততবার রাগী চোখ মুখে উনার দিকে তাকিয়ে গা থেকে হাত ছিটকে সরিয়ে দিল।
সুফি খাতুন কোমড়ে একহাত দিয়ে দাঁড়িয়ে আছেন সৈয়দ বাড়ির ফটকে। অন্যহাতে চ্যালাকাঠ ধরে। আরশকে রেগে মেগে যেতে দেখে হাতে চ্যালাকাঠ ধরিয়ে দিয়ে বললেন,”যাও এদের কয়েকটা দিয়ে আসো।
আরশ শক্ত হাতে চ্যালাকাঠ চেপে ধরে ধুপধাপ পায়ে চলে গেল নাছির মঞ্জিলের দিকে। সেখানে গিয়ে গেটের সামনে মানুষের হাউমাউ কাউ দেখল। এসব ক্যাচক্যাচ সে নিতে পারল না। সবাইকে সরিয়ে দিয়ে গেটের মধ্যে শক্ত পায়ে লাথি মারল। উচ্চ শব্দে নড়ে উঠে তা আবার অটল নিজের জায়গায় দাঁড়িয়ে পড়ল।আরশ গলার রগ ছিঁড়ে যাওয়ার মতো ভিবৎস চিৎকার করল,”বেয়াদবের বাচ্চা, একটাকে ও আস্তো রাখব না।
লিপি বেগম হন্তদন্ত পায়ে ছুটলেন রুমের দিকে। রাগের বশে আবার কিছু করে না বসে। অনেক খুঁজে খুঁজে মোবাইলটা হাতের মধ্যে পেলেন। দ্রুত হাতে নুসরাতকে কল মিলাতে গিয়ে হাত পা অসাড় হয়ে আসলো। শঙ্কিত মুখে ঢোক গিলে নিয়ে কল মিলালেন। না ধরল না, বাজতে বাজতে কেটে গেল। পরপর আরো কয়েকটা কল দিলেন, শেষবার রিং হওয়ার পর পনেরোতম কল নুসরাত পিক করল। গানের উচ্চ আওয়াজ ভেসে আসছে মোবাইলের ওপাশ থেকে।
‘বেগুন ওয়ালায় ধইরা আমায়
বইরা দিল বেগুন আমার তলিতে,
আর যাব না বেগুন তলিতে। ‘
লিপি বেগম বললেন,
“নুসরাত দূরে যাও..!
নুসরাত দূরে সরে গেল হ্যালো হ্যালো বলে। ফোন স্পিকারে দিতেই ক্ষীণ স্বরে ভেসে এলো লিপি বেগমের আওয়াজ,” তোমার জম আসছে, তাড়াতাড়ি…
কথা শেষ হওয়ার পূর্বেই কেউ একজন লাথি মেরে বসল ছাদের দরজায়। নুসরাত কেঁপে উঠে পিছু ঘুরল। ভয়ার্ত নয়নে দেখল স্টিলের তৈরি দরজা কেঁপে কেঁপে সরে যাওয়া। দরজা সরে যেতেই ওপাশে প্রদর্শিত হলো আরশের চাঁদ মুখ। নুসরাতের মুখ দিয়ে অস্পষ্ট সুরে ধ্বনিত হলো,”জম এসে গেছে, হায়..!
নুসরাত গোল গোল চোখে চেয়ে রইল সামনে। পাতলা সাদা স্লিভ বিশিষ্ট ফতুয়া টাইপ কিছু আরশের পরণে। গলা থেকে বুক পর্যন্ত ফিতে বাঁধা হয়নি, তাই গলা থেকে বুক পর্যন্ত বের হয়ে আছে। সুঠাম দেহি শরীরে আঁটসাঁট হয়ে লেগে তা। রাগের তোপে গলার কাছের এডাম অ্যাপলস উপর নিচে বিট হচ্ছে৷ নুসরাতের কানের কাছ বয়ে ভেসে গেল,”স্টপ দিজ ফাকিং বুলশিট..!
নুসরাত ঘাড় কাত করে শুধু তাকিয়ে থাকল, দেখল, আর শুধু দেখল। আরশ যে তাকে কোমড় চেপে ধরে কাঁধে তুলে নিয়েছে, সে শূণ্যে ভাসছে তা খেয়াল করল না। ভুবন ভুলানো চিন্তায় ডুবে গেল সে। নির্লজ্জ চিন্তায়, দিন রাত ভুলে দিবাস্বপ্ন দেখতে ব্যস্ত হলো। হা করে চেয়ে চেয়ে শুধু দেখল পাতলা কাপড়ের অভ্যন্তরে পুরুষালি শক্ত, সামর্থ, সৌষ্ঠব বলিষ্ট শরীরের রেখা। দেখতেই থাকল শুধু৷ নাকের ভেতর দিয়ে বয়ে চলল কড়া কুস্তুরীর ঘ্রাণ। পুরুষালি শরীরের মাস্কি, কড়া, সেদ ঘ্রাণে দিবানা হয়ে যাওয়ার মতো অনুভূতি হলো। কানে ভেসে আসলো সাউন্ড সিস্টেম থেকে ভেসে আসা হালকা শব্দ রঞ্জিত গান,
প্রিয় প্রণয়িনী ২ পর্ব ২৯
“দেওয়ানা বানাইছে রে,
কী জাদু করিয়া বন্দে মায়া লাগাইছে।