প্রিয় প্রণয়িনী ২ পর্ব ৩১

প্রিয় প্রণয়িনী ২ পর্ব ৩১
জান্নাত নুসরাত

নাছির মঞ্জিলের উঠোন জুড়ে বিস্তর এক কাঁঠাল গাছ। যার ডাল-পালা, শাখা প্রশাখা এত বিস্তর যে বাড়িটার একাংশ জুড়েই শুধু এই গাছ। গাছে বড়সড় মূল বের হয়ে চারিদিকে ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়েছে। যেখানে অনায়াসে বসতে পারবে চার-পাঁচেক মানুষ। বড় গাছটি সদর্পে মাথা উচিয়ে দাঁড়িয়ে আছে বাড়ির মাঝ বরাবর। গাছের মোটা ঢালের সাথে উল্টো অবস্থায় ঝুলন্ত বাঁধা তিন শয়তানের উস্তাদ। সামনের বেতের চেয়ারে হাতে চ্যালাকাঠ নিয়ে পায়ের উপর পা তুলে বসে রয়েছে আরশ। চোখে দৃষ্টি অগ্নিময়। নিষ্প্রাণ কালো বলয়ের সুনশান দৃষ্টি চোখ দিয়ে নিষেধাজ্ঞা জারী করছে কোনো কিছু না বলার জন্য। নুসরাত সেসবের তোয়াক্কা করল না। আরশের চোখের কঠিন দৃষ্টির পরোয়া না করে, নির্লজ্জের মতো আরশকে স্টক আউট করল। তারপর পার্ভাটের মতো সুর টেনে আরশকে ভেঙ্গিয়ে গেয়ে উঠল,”আমি নষ্ট মনে,,নষ্ট চোখে
দেখি তোমাকে,
মন আমার কি চাই
বুঝাই কেমনে!

আরশ নুসরাতের দিকে ওইভাবে ত্যাড়া চোখে তাকিয়ে রইল। নুসরাতকে কিছুক্ষণ দেখে নিয়ে আড়ম্বরপূর্ণ শক্ত কন্ঠে বলে ওঠল,”বেডরুমে চলুন নুসরাত নাছির, আপনার মন কী চায় ভালো করে প্রাকটিক্যালি বুঝিয়ে দিব।
নুসরাত ঠোঁট এলিয়ে হাসল। চোখের দৃষ্টিতে নমনীয়তা। আরশের ক্ষোভপূর্ণ কন্ঠে কোনো হেলদোল হলো না তার। আহান ঠোঁট চোখা করে কিছু বলতে যাবে তার আগেই চ্যালাকাঠের শক্ত বারি খেয়ে মুখ দিয়ে বের হওয়া টু শব্দখানি ভেতরে ঢুকে গেল। নুসরাত খিটমিট করে হেসে উঠতেই তার পিঠে বারি পড়ল। মুখে ফুটে উঠা হাসি মিলিয়ে গেল নিমেষে। ঝুলন্ত অবস্থায় থাকতে থাকতে মনে পড়ে গেল সেদিনকার কথা। যেখানে তারা সবাই মিলে বেচারা মন্টুকে উল্টো করে বেঁধে রেখেছিল গাছের সাথে। দুঃখে নাকের ডগা পিটপিট করে উঠল। ভেতরে ভেতরে মর্মাহত হয়ে নুসরাত ডেকে উঠল করুণ সুরে,”আরশ ভাই!
আরশ উত্তর দিল না নুসরাতের ডাকের। শুধু এগিয়ে আসলো তার দিকে দু-পা। নুসরাত বলে ওঠল,”নাক পরিস্কার করব।

আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন

আরশ পকেট হাতড়ে টিস্যু বের করে নুসরাতের হাতে ধরিয়ে দিতে যাবে নুসরাত চোয়াল শক্ত করে ক্রোধপূর্ণ কন্ঠে বলে ওঠে,”আপনি পড়ন্ত বস্তুর সূত্র জানেন না?
আরশ কথা বলল না। আলগোছে হাত বাড়িয়ে নুসরাতের নাকের ডগা টিস্যুর সাহায্যে পরিস্কার করে দিতে যাবে নুসরাত খুশি মনে আবার বাঁধা দিল। ইশারা করল আরশের কাপড়ের দিকে। বলল,”আপনার কাপড় দিয়ে নাক মুছে দেন। টিস্যু দিয়ে নাক মুছলে এলার্জি হয়ে যায়।
আরশ নুসরাতের কথা কানেই তুলল না। টিস্যু দিয়ে চেপে নাক পরিস্কার করে দিল। আহান আর ইরহাম চোখ উল্টে নুসরাত আর আরশের ডং দেখল। আহান মুখ বাঁকিয়ে বলল,”নিজের বাড়িতেই এইচ-ডি মানের সিনেমা দেখা যায়, আর আমরা হলে যাই সিনেমা দেখতে।

কথা শেষ করে ঠোঁট বাঁকাতেই ধুপ করে আওয়াজ হলো। কারোর বুঝতে বাকি রইল না আহানের পায়ে শক্ত বারি পড়েছে চ্যালাকাঠের। নুসরাত শুধাল,”আরশ ভাই আপনি পাগল হয়ে গিয়েছেন?
আরশ নিষ্প্রাণ চোখ ঘুরিয়ে শীতল মুখে দেখল নুসরাতকে। রক্ত শূন্য ফ্যাকাসে গলায়, রগরগে কন্ঠে বলল,”শাট-আপ নুসরাত নাছির।
নুসরাত নিজেও আরশকে ভেঙ্গিয়ে বলে ওঠল,
“ইউ শাট আপ আরশ হেলাল!
“মার খাবেন আপনি? একটা ও মাটিতে পড়বে না।
নুসরাত মুখ বাঁকাল। মুখ ঘুরিয়ে অন্যপাশে তাকিয়ে অলস ভঙ্গিতে মিনমিন করে বলল,”আমি নুসরাত নাছির একটা খেলে দশটা দিতে জানি।
আরশ রাগে হিসহিস করে উঠল। এই বেয়াদব, ভন্ড মহিলার মুখ বন্ধ করা তার কাছে দূর্বেধ্য ঠেকল। চিৎকার করে উঠে বলে,”শাট দ্যা ফাক আপ নুসরাত নাছির।

আরশের নিষ্প্রভ চোখের চাহনি আর বাড়ি কাঁপানো চিৎকারে সবাই চুপ হয়ে গেল। পরের মুহুর্ত গুলো খুব তাড়াতাড়ি চলে গেল। দক্ষিণে হাওয়া বইল মৃদু গতিতে। আলো মিইয়ে গেল মাঝ আকাশে। গাড়ির হর্ণের শব্দ হলো নাছির মঞ্জিলের বাহিরে। গাড়ি থেকে বের হয়ে গেট আনলক দেখতেই নাজমিন বেগমের মাথা গরম হলো তড়িৎওতার সাথে। বাড়ির বাহিরে অবস্থান রত অবস্থায় পা থেকে জুতো খুলে হাতে নিতে দেরি হলো না। ওখানে দাঁড়িয়ে থেকে কীভাবে উত্তম মাধ্যম দিবেন তিনটাকে ধরে তার চিন্তাভাবনা পর্যন্ত শেষ করে নিলেন। প্রবল দাবদাহে হেঁটে আসতে আসতে জ্বলে পুড়ে কঠিন কন্ঠে ডেকে উঠলেন,” নুসরাতের বাচ্চা।
নুসরাত গাছের উপর ঝুলে থেকে জবাব দিল,

“জ্বি আম্মা!
নাজমিন বেগমের মাথা দেখা গেল, সাথে কন্ঠে স্বরে উপস্থিতি বোঝা গেল কাঠিন্যত্বের,” বেয়াদবের বাচ্চা, গেট খোলা রেখে কোথায় মরেছিস? তোর জামাই এসে গেট লাগাবে?
কথা শেষ করতেই দৃশ্যমান হলো নুসরাতের ভেটকানো মার্কা মুখ। আহানের আর ইরহামের ও একই অবস্থা মুখের। সবকটাকে এভাবে ঝুলে থাকতে দেখে হায় হায় করে উঠতে যাবেন তার পূর্বেই নজর কাড়ল আরশ। বেতের সোফার উপর আরাম করে চোখ বুজে শুয়ে আছে সে। ছোটো সেন্টার টেবিলে রাখা চ্যালাকাঠ। বুঝতে দেরি হলো না কোনো না কোনো ঘটিয়েছে এই তিনজন মিলে। চোখ পাকিয়ে রাগে হিসহিস করে উঠলেন। খুবই ধীর ভঙ্গিমায় রাগে ফুসফুস করে শুধালেন,”কুত্তার দল কী করেছিস সবগুলো মিলে?

সবাই ঠোঁট উল্টে বোঝাল কিছু করেনি তারা। নাজমিন বেগম একটার কথা ও বিশ্বাস করলেন না। এক হাতে জায়গা করে নেওয়া জুতো জোড়া দেখিয়ে বলে ওঠলেন,”জুতোর বারি একটা ও মাটিতে পড়বে না!
তবুও তারা অস্বীকার করল তারা কিছু করেনি। চোখ মুখে ফুটিয়ে তুলল অসহায়ত্ব, মর্মানিত মনোভাব। যে কেউ দেখলে বুঝবে বাচ্চাগুলো ভাজা মাছটি উলটে খেতে পারে না। কুটিলতা চোখের ভেতর আড়াল করে আসহায় কন্ঠে কিছু বলতে নিবে তার আগেই নড়েচড়ে উঠল আরশ। চোখ খুলতেই দর্শন হলো নাজমিন বেগমের ঠোঁটে ঝুলানো হাসির বহরে রঞ্জিত মুখখানা। আরশ অবাক চোখে চেয়ে শুধাল, “কখন এসেছেন মেঝ মা?
নাজমিন বেগম খুশিতে গদগদ করে উঠে বললেন,

“এই তো এক্ষুণি!
আরশ কিছু বলবার পূর্বেই নাজমিন বেগম বলে ওঠলেন,”তোমাকে কোনো কৈফিয়ত দিতে হবে না বাবা, আমি বুঝতে পারছি এরা মিলে কিছু একটা করেছে।। এদের আগামী চব্বিশ ঘণ্টা এভাবে বেঁধে রাখলেও আমার কোনো সমস্যা নেই।
নাজমিন বেগমের কথা শুনে সবগুলো একসাথে চোয়াল ঝুলিয়ে বলে ওঠল,” এ্যাঁ!
নাজমিন বেগমের কথায় আরশ মাথা নাড়াল। নাজমিন বেগম আর বেশি ঘাটালেন না তাদের। চোখ দিয়ে নুসরাতকে ঝামটা মেরে তিরস্কার ভঙ্গিতে চলে গেলেন। আর কাঁঠাল গাছের সাথে ঝুলন্ত অবস্থায় বাঁধা রইল নুসরাত। আরশের পানে এতক্ষণ যে মুগ্ধতা, আকর্ষণ, নিয়ে চেয়ে ছিল সে সব কমে গিয়ে ভর করল ক্ষোভ।

সময় গড়িয়ে সন্ধ্যা হলো। সূর্য পশ্চিম আকাশে ঢলে পড়ল। তখনো গাছের সাথে বাঁধা সবাই। আধঘন্টা শাস্তি হিসেবে উল্টো করে বাঁধা ছিল সৈয়দ বাড়ির গুণোধর ব্যক্তিরা তারপর আরশ তাদের সোজা করে বেঁধে রেখেছে। আগে পা ছিল গাছের ডালের সাথে বাঁধা আর এখন সোজা ভাবে হাত বাঁধা। ঝুলন্ত অবস্থায় থেকে আরশকে গালি দিচ্ছে নুসরাত। নুসরাতের আজগুবি গালি গুলো আরশ কানেই তুলল না৷ এক কান দিয়ে ঢোকাল তো অন্য কান দিয়ে সুরসুর করে বের করে দিল। বেতের সোফায় শক্ত ভঙ্গিমায় বসে থাকল সে। বাঁ-হাতের মধ্যে ধরা মোবাইলে কিছু একটা করল ওভাবে বসে থেকে অনেকক্ষণ। রাত বাড়ল। ঘড়ির কাটায় দশটায় গিয়ে থামতেই নাছির সাহেব আর বাড়ির ভেতর থাকতে পারলেন না।

বাটি থেকে বের হয়ে আরশের নিকট জোর আর্জি করলেন গাছের উপর থেকে নামানোর জন্য। এরপর নাছির সাহেবের কথায় তিনজনকে গাছের উপর থেকে নামানো হলো। হাত বাঁধা থাকায় কালসিটে দাগ পড়েছে সবার সেখানে। সবার হাতে স্পষ্ট দেখা গেলেও নুসরাতের হাতে খুব একটা দেখা গেল না। নুসরাত হাত নিচের দিকে নামাতেই ঝিনঝিন করে উঠল। অসাড়তা ভর করল সারা শরীরে। চোখ উল্টে পড়ে যাওয়ার ভান করল, তার আগেই নাছির সাহেব দৌড়ে এসে নিজের সাথে জড়িয়ে নিলেন তাকে। নুসরাত নাছির সাহেবের সাথে লেগে থেকে হেসে উঠল শব্দ করে। বাদরামি করে আরশকে ভেঙচিয়ে ভেঙচিয়ে সুর টেনে গান গাইল,”যৌবনে লাগাইছো আমায় এই দেহে আগুন,

পরের দোয়াই আসে আমার অঙ্গেতে ফাগুন।
আরশ চোখ পাকিয়ে বলে ওঠল,
“শাট আপ নুসরাত নাছির!।
নুসরাত নাছির সাহেবকে ভর দিয়ে বাড়ির ভেতর যেতে যেতে গানটা বিড়বিড় করল। আরশ হা করে তাকিয়ে রইল নুসরাতের যাওয়ার দিকে। মাথায় ঘুরপাক খেল কোন মাটি দিয়ে এই মাথামোটাকে আল্লাহ তৈরি করেছেন যে, আটঘন্টা গাছের সাথে বেঁধে রাখার পরও এভাবে গান গাচ্ছে। ঠোঁট দিয়ে অস্ফুটে সুরে উচ্চারণ হলো,”অসভ্য!

সকাল ছয়টার সময় নুসরাতের শখ জাগল টাটকা টাটকা মধু খেতে। এত ক্রেভিং জাগল যে কোমড়ে হাত রেখে বাড়ি থেকে একা একা বের হয়ে গেল মধুর খুঁজে। সৈয়দ বাড়িতে যখন যখন বিয়ে হয় তখন তখন একটা না একটা গাছে মৌমাছি বাসা বাঁধে। তাই নতুন উদ্যোমে নুসরাত মৌমাছির চাক খুঁজতে লাগল। তার চিন্তা মতোই খুঁজতে খুঁজতে কাঁঠাল গাছের একদম নিচু ডালে দেখল মৌমাছির চাক। লোভে চকচক করে উঠল তার চোখখানি। লোভাতুর চোখে চেয়ে মাথামোটার মতো লাঠি দিয়ে মৌমাছির চাকে ধাক্কা দিতেই মৌমাছি ভনভন করে বের হয়ে আসলো। দল বেঁধে কিছুক্ষণ নুসরাতের দিকে চেয়ে রাগী ভঙ্গিমায় এসে কামড় বসিয়ে দিল গালে, নাকে, ঠোঁটে, থুতনিতে, কপালে। নুসরাত পালানোর আগেই তেড়ে আসা সকল মৌমাছি ইচ্ছে মতো কামড় মেরে দিল তাকে। রাগ কমে যেতেই আবারো তারা দলবল বেঁধে নিজেদের আস্তানায় ফিরে গেল। নুসরাত যখন মুখ ফুলিয়ে বাড়ি ফিরল নাজমিন বেগম আঙুলে তসবিহ পড়ছিলেন তখন। তাকে দেখতেই হা হা করে হেসে উঠে জানতে চাইলেন,”কী মুরব্বিয়ানা করতে গিয়ে এই অবস্থা করেছ?

নুসরাত নাক টেনে কাঁদো সুরে বলে ওঠল,
“আম্মা মৌমাছি কামড় মেরেছে, সামান্য মধু চুরি করতে যাওয়ায়।
নাজমিন বেগম হা হা করে হেসে উঠলেন। নুসরাতের ধীরে ধীরে ফুলে যাওয়া মুখের দিকে চেয়ে আবারো হাসলেন। নুসরাত কপাল কুঞ্চিত করে ব্যথা নিয়ে মুখ নাড়িয়ে বলে ওঠল,”আম্মা হাসবে না তুমি।
নাজমিন বেগম হাসতে হাসতে বললেন,
“আর হাসব না..! হা হা!

সকাল দশটার সময়। সৈয়দ বাড়ি থেকে বিয়ের জিনিস পত্র নিয়ে আসলো আরশ, আহান, ইরহাম, অনিকা আর ভিক্টর। ভিক্টর সবসময়ের মতো হাতে একটা মেয়েলি ব্যাগ নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকল অনিকার পেছনে। নুসরাত ঘুম থেকে উঠে নিচে যখন নামল তখন সকলের চোখ ছানাবড়া হয়ে গেল। মুখ ফুলে আলুর বস্তার মতো হয়ে গিয়েছে নুসরাতের। আরশ তখনো লক্ষ করেনি তাকে। মুখের চারিদিকে বেন্ডেজ করে রাখা তার। অনিকা উৎফুল্ল কন্ঠে জিজ্ঞেস করল,” এটা কী তোমার নতুন কোনো স্কিন কেয়ার?
নুসরাত খেপাটে নয়নে দেখল অনিকাকে। অত্যন্ত কঠিন সুরে বলল,”আমি মজার মুডে নেই।
ইরহাম নুসরাতকে উপর নিচ দেখল অনেকক্ষণ। ইসরাতকে তাদের দিকে আসতে দেখেই শুধাল,”বড় আপার মুখের এ অবস্থা কেন?

ইসরাত নুসরাতের মুখের দিকে চেয়ে না চাইতেও হেসে দিল শব্দ করে। ঠোঁটের উপর হাত রেখে হাসি আটকে বলে ওঠল,”কাঁঠাল গাছে মৌমাছি চাক বেঁধেছে। আমাদের ঘরের বিশিষ্ট সাহসী আপা টাটকা টাটকা মধু চাক থেকে আনতে গিয়ে সকাল সকাল মৌমাছির কামড় খেয়ে এসেছেন মুখে। মুখ ফুলে ডাবের মতো হয়ে যাওয়ায় দাদু ওর মুখে মধু মাখিয়ে বেন্ডেজ করে দিয়েছেন যাতে ব্যথা কমে যায়। এজন্য মুখের এই অবস্থা!

ইসরাতের কথা শেষ হতেই এতক্ষণ আটকে রাখা ইরহাম নিজের হাসি নুসরাতের পানে চেয়ে হা হা করে হেসে উগড়ে বের করে দিল। চোখ ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে তার ফোলা মুখ দেখল আর আঙুল তুলে ইশারা করে হাসল। আহান এসব দেখল না। সে তার ক্যামেরা দিয়ে নুসরাতের ঠাস ঠাস করে ছবি ক্যাপচার করছে সবদিক থেকে। আরশ ভাইয়ের কাছে নুসরাতের এইসব ছবি বিক্রি করবে একটা পাঁচশত টাকা দিয়ে। আর সাথে নুসরাতকে আবার ভাইরাল করে দিবে সব জায়গায়। ক্যাপশন ও সে ভেবে রেখেছে, তরুণ যুবতী এক যুবক মধু ওয়ালার কাছ থেকে মধু চুরি করতে গিয়ে, মধুর মালিকের কাছে কামড় খেয়ে ফিরে এসেছেন। মানুষ তো আর বুঝবে না সে মৌমাছির কথা লিখেছে মনে করবে ডিপ কোনো কাহিনি এতে। মনে মনে একটা শয়তানি হাসি দিয়েও দিল।

অনিকা নুসরাতের মৌমাছির কাছ থেকে কামড় খাওয়া সম্বন্ধে কোনো কিছু জানল না। সে নুসরাত কী স্কিন কেয়ার করছে তার জানার জন্য উৎফুল্ল, উদগ্রীব হয়ে ওঠল। ভিক্টরকে কাজে লাগাল সব জেনে এসে তাকে জানাতে। এর মধ্যে নাছির মঞ্জিলের অন্দরে প্রবেশ ঘটল আরশের। ঢুকেই তার চোখগুলো সূক্ষ্মভাবে ঘুরল পুরো ড্রয়িং রুমে। তীক্ষ্ণ চোখে চারিপাশে দেখতেই দেখল এক কোণায় বসে আছে নুসরাত। ঠোঁট চেপে বসে কিছু একটা করছে। আরশ এগিয়ে যেতেই পুরো মুখ দৃশ্যমান হলো। মুখে বেন্ডেজ করা দেখে মন উদগ্রীব হলো কী হয়েছে জানার জন্য! তবুও নিজেকে স্বাভাবিক রাখল, কোনো তৎপরতা নিজের উপরে দৃশ্যমান হতে দিল না। আলগোছে নুসরাতের পাশ ঘেঁষে বসে হাত বাড়িয়ে থাবা মেরে মুখের দু-পাশ নিজের সৌষ্ঠব হাত দিয়ে চেপে ধরল। নুসরাত লাফ মেরে সরে যেতে নিয়ে থেমে গেল আরশকে দেখে। আরশ কতক্ষণ নুসরাতের মুখ চুপচাপ নীরবে দেখল। তারপর রাশভারী, অধিকার বিস্তারকারী সুরে বলল,”মুখে কী হয়েছে?

নুসরাত ঠোঁট টিপে উদাসীন কন্ঠে বলল,
“মৌমাছি কামড় দিয়েছে।
এইটুকু কথা শুনে আরশ আর বসল না। দ্রুত পায়ে যেভাবে এসেছিল, সেভাবে বেরিয়ে গেল নাছির মঞ্জিল থেকে। এরপর আরশের টিকিটিও দেখা গেল না।
অনিকা যখন দেখল আরশ নুসরাতের সাথে কথা বলছে তখন রাগে ফুলে উঠল। এত ভালোবাসা সে দেখতে পারল না। হিংসায় মেয়েলি মনে দাউদাউ করে আগুন জ্বলে উঠল। নিজের জায়গা থেকে এক প্রকার উড়ে এসে নুসরাতের পাশে বসতে বসতে হিসহিসিয়ে জানতে চাইল,”আরশের সাথে তোমার এত কথা কীসের?
নুসরাত ঘাড় বাঁকিয়ে তাকাল। অনিকার প্রশ্ন তার কাছে মোটেও যুতসই লাগল না। এটা তাদের পার্সোনাল বিষয়। অনিকা কেন নাক গলাবে এখানে! কপাল কুঞ্চন করে দেখল অনিকার সুন্দর মুখ। মেয়েটা ফর্সা, সুন্দর হলেও কঠিন লেভেলের ছ্যাচড়া। এক ভ্রু সামান্য উচিয়ে দম্ভ ভরা কন্ঠে শুধাল,”আপনি কে?
অনিকা বিস্ময়ে যেন আকাশ থেকে উল্টে পড়ে গেল৷ অক্ষিকোটর থেকে গোলক বের হওয়া শুধু বাকি। চোখ বড় বড় করে বলল,” আমি আরশের উড-বি।

নুসরাত ঠাট্টা করে হেসে উড়িয়ে দিল যেন অনিকার কথা বাতাসে। আরশের উপর কঠোর অধিকার বোধ ছাপিয়ে বলে ওঠল,”সে আমার স্বামী, পুরো পৃথিবী জানে সৈয়দ আরশ হেলাল নুসরাত নাছিরের স্বামী, শুধু নুসরাত নাছিরের স্বামী, আর কারোর নয়। কে আপনি, যে আমার স্বামীকে নিজের উড বি হিসেবে দাবি করছেন? আমার কথা লিখে নেন মিস অনিকা, আমি নুসরাত নাছির বেঁচে থাকতে ওই ব্যাটাকে কখনো দ্বিতীয় বিয়ে করতে দেব না। আর যদি ওই ব্যাটার আগে আমি মরেও যাই তাহলে পেত্নী হয়ে এসে আমার সাথে নিয়ে যাব। তারপর দু-জনে মিলে কবরে শুয়ে বসে লেইট নাইট ডেটিং করব। এবার ভালোয় ভালোয় নিজের খালুর চোখে দেখুন আরশ ভাইকে।

অনিকা কিছু বলার পূর্বেই ইরহাম আর আহান এসে হাজির হলো কাপড় নিয়ে সেখানে। অনিকার হাত পা মুখে কাপড় বেঁধে দিল ঝটপট সবাই মিলে। আহান নিজের ক্যামেরা দিয়ে ভিডিও করছে সাথে ফটো ও ক্যাপচার করছে। অনিকাকে বেঁধে রাখল সবাই শক্ত করে। সেখানে এসে উপস্থিত হলো ইসরাত ও। নুসরাতকে বেন্ডেজ বেঁধে বসে থাকতে দেখে হা হা করে হেসে উঠল। অনিকা মনে করল ইসরাত তাকে বাঁধা দেখে হাসছে। ইসরাত হাসতে হাসতে ঢলে পড়ল সোফায়। অনিকাকে এর মধ্যে মুরগীর মতো বাঁধা অবস্থায় দেখে আবারো হেসে উঠল। ইসরাতের কান নুসরাতের কথায় ভেদ করল,নুসরাত বলছে,”না না খালুর চোখে দেখবি না, তুই আব্বার চোখে দেখবি আরশ ভাইকে, আর মনে প্রাণে আব্বা মনে করবি। তুই তো আবার খারাপের খারাপ, খালুর চোখে দেখলি আর মনে মনে জামাই ভেবে বসে থাকলি, কোনো রিস্ক নেওয়া যাবে না এই বিষয়ে। আব্বা ডাকবি, আর এক্ষুণি ডাকবি আমাদের সামনে।

ইরহামকে নুসরাত ইশারা করল মুখ খুলে দিতে, তারপর আবার হাত তুলে থামিয়ে দিল। বলল,” একমিনিট দাদা!
ইরহামের থেমে গেল। নুসরাত অনিকাকে শুধাল,
“আগে বল চিৎকার করবি, চিৎকার করলে বেশি কিছু করব না, গুলি করে উড়িয়ে দিব। বুঝেছিস?
অনিকা গোল গোল চোখে চেয়ে রইল। নুসরাত ধমকে উঠে জানতে চাইল,”বুঝেছিস?
অনিকা উপর নিচ মাথা নাড়াল। ইরহাম ধীরে স্থীরে মুখে খুলে দিল অনিকার। অনিকা সবার পানে চেয়ে নাকি সুরে কান্না ধরতেই নুসরাত চোখ পাকিয়ে ধমকাল। ঠোঁটে হাত রেখে ফিসফিস করে বলল,” চুপ একদম চুপ। গুল্লি মেরে উড়াই ফেলব। চপ বলছি না!

অনিকার কান্নার আওয়াজ ভারী হতে দেখে নুসরাত ইরহামকে বলল,”ইরহাম যা তো আব্বার লাইসেন্স বিশিষ্ট রিভলবার নিয়ে আয়, এটাকে আজ কবরে চালান করে দিব। ন্যাকামি করে, ন্যাককা, চু”দ্দা!
অনিকা মুখ বন্ধ করে নিল। ঠোঁট টিপে ভয়ার্ত চোখে দেখল নুসরাতকে। আহান খুবই ভদ্রলোকের মতো ভিডিও বানাচ্ছে। অনিকাকে নুসরাত শাসিয়ে নিয়ে বলে ওঠল,”আব্বা না ডাকলে আজ তোকে বন্দুক দিয়ে চুদলিং পং করে দিব। তাড়াতাড়ি আব্বা ডাক আরশ ভাইকে। আর আমাকে আম্মা ডাক।
অনিকা অসহায় চোখে চেয়ে রইল সবার দিকে সাহায্যের আশায়। কিন্তু একটাও তাকে সাহায্য করল না। ইরহাম নুসরাতকে দেখিয়ে বলে ওঠল,”আম্মা ডাকো নুসরাতকে।
অনিকা অনেক কষ্টে ভরা চক্ষু জল নিয়ে ডেকে উঠল,

“আম্মা!
নুসরাত বিরক্ত হয়ে কপাল কুঞ্চিত করল। অনিহা নিয়ে অনিকার মাথায় সামান্য গাট্টা মেরে শুধরে দিয়ে বলল,” ঠিক ফিল পাচ্ছি না আম্মা আম্মা, নুসরাত আম্মা ডাকো তো বাচ্চা!
অনিকা ক্ষোভে চোখ লাল করে ডেকে উঠল,
“নুসরাত আম্মা..!
আরশকে বাড়ির ভেতর আহান ঢুকতে দেখে বলল,
“মেঝ ভাইয়া আসছে এদিকে!
নুসরাত ঝটপট আরশের দিকে আঙুল তুলে বলল,
“পুরো ড্রয়িং রুম ফাটিয়ে যদি আজ তুই আরশ ভাইকে আব্বা না ডাকিস তাহলে আমি নুসরাত নাছির তোকে ফাটিয়ে ফেলব। ডাক আরশ ভাইকে আব্বা, বেয়াদব..!

অনিকা ঠোঁট চেপে বসে রইল। ইরহাম আপেল কাটার ভোতা একখানা ছুরি বের করে বলল,”গলা কেটে ফেলব, আরশ আব্বা ডাকো!
অনিকা অসহায় মুখ বানিয়ে বসে রইল। চোখে টলটলে পানি নিয়ে গলার সুর উচিয়ে ডেকে উঠল,”আরশ আব্বা।
আহান হেসে উঠল। অনিকার ডাক আরশের কান পর্যন্ত পৌঁছায়নি তাই এদিকে ফিরেও চাইল না। চলে গেল অন্যদিকে। ইরহাম নুসরাতকে ইশারা করে বলল,” ও তোমার আম্মা..!
আরশকে ইশারা করে বলল,

“ছোট ভাইয়া তোমার আব্বা..! এবার আম্মা আব্বা একসাথে ডাকো তো বাবু।
অনিকা অসহায় চোখে চেয়ে নুসরাতকে ডাকল,
” আম্মা!

প্রিয় প্রণয়িনী ২ পর্ব ৩০

নুসরাত হাসিমুখে হাত বাড়িয়ে অনিকাকে কোলে তুলে নেওয়ার ভঙ্গি করে বলে ওঠল, “নাও পারফেক্ট। আসো আমার ধামড়ি বাচ্চা তোমাকে কোলে তুলে নিই, আব্বা আম্মার থেকে এতদিন এত দূরে ছিল কেন! ওলে ওলে..

প্রিয় প্রণয়িনী ২ পর্ব ৩২

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here