প্রিয় প্রণয়িনী ২ পর্ব ৩৪

প্রিয় প্রণয়িনী ২ পর্ব ৩৪
জান্নাত নুসরাত

রাত একটা বেজে চল্লিশ মিনিট। নাছির মঞ্জিলে তখনো রমরমে ভাব বিরাজমান। সেই রমরমে ভাব আরেকটু গাঢ় করতে ল্যাভেন্ডার কালার শাড়ি পরিহিত ইসরাতের হাতে জায়িনের শরীর ছুঁয়ে আসা মেহেদি লাগানো হলো। হাতের তালুতে রেখে জোড়া দিয়ে রাখলেন পাঁচেক মিনিট বয়স্ক মহিলারা। যার হাতে পাতা মেহেদি রঙ যত ভালো আসে তার স্বামী নাকি তাকে তত ভালোবাসে। ইসরাত এসবে বিশ্বাসী খুব একটা না। হাত ধোয়ার পর ইসরাতের শুভ্র হাতের তালুতে রঙ দেখা গেল লাল টকটকে হয়ে এসেছে, তখন ভদ্র মহিলাদের খুশি দেখে। ইসরাতের দিকে চেয়ে মিটিমিটি হেসে ইসরাতের নানি ছালিমা বেগম বললেন,”ময়নানুশু, তোর জামাই তো তোকে অনেক আদর দিবে। দেখ, নাতজামাইয়ের হাতে ছুঁয়ে আসা মেহেদির রঙ কত ভালো আসছে।
ইরহাম ইসরাতের মেহেদি হতে নিয়ে হাতে লাগাতে যাবে নুসরাতের নানু বললেন,”নানু ভাই, অবিবাহিত পুরুষরা এসব হাতে দেয় না, দিলে বিবাহ হয় না।
ইরহাম জিজ্ঞেস করল,

“এসব আজগুবি কথা কে বলেছে?
“আগের কালের মানুষ বলেছে।
ইরহাম এই কথা শোনার পর পণ করে বসল সে আর আজ এই মেহেদি খুলবে না। এমন কী এ ও বলল,” দু-হাতে জোড় মেহেদি লাগিয়ে আমি আজ সারারাত বসে থাকব, দেখব বিয়ে হয় নাকি হয় না! যদি হয় তাহলে ওই আগের যুগের মানুষকে কী করব আমি নিজেও জানি না।
এই বলে আশেপাশে চক্কর কাটতে চলে গেল ইরহাম। এর মধ্যে ইসরাতের নানা আসলেন সেখানে। ছালিমা বেগম বললেন,”নাতনীর নজর তুলে দাও।
ইসরাতের নানা টাকা বের করে ইসরাতের মুখের চারপাশে ঘুরালেন। তারপর টাকাগুলো ছালিমা বেগমের কাছে দিবেন, নুসরাত দাঁত কেলিয়ে হাসল। দু-লাফে ব্যাঙের মতো এসে হাজির হলো তাদের সামনে। হেলেদুলে নির্লজ্জের মতো চেয়ে বসল,”নানাভাই টাকাগুলো আমাকে দিয়ে দিন। আমার মতো গরীব এই ঘরে থাকতে, অন্য গরীবকে টাকাগুলো দিয়ে কী হবে? আমার সাথে নাফরমানি হয়ে যাবে না!

আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন

ছালিমা বেগম হেসে স্বামীর হাত থেকে টাকা নিয়ে নিলেন। মৃদু হেসে বললেন,”উঁহু, এমন করে বলতে হয় না।
নুসরাত চোয়াল ঝুলিয়ে চুপসানো মুখে চলে গেল।যেন কষ্টে বুক ফেটে যাচ্ছে তার। আবার দু-সেকেন্ড অতিবাহিত হতেই ফিরে আসলো তাদের মাঝখানে। ইসরাত ততক্ষণে ঘেমে নেয়ে একাকার হয়ে গিয়েছে। ছালিমা বেগম ইসরাতের পানে চেয়ে দেখলেন টিস্যু দিয়ে বারবার নাক মুছে ও তাতে কোনো সুরাহা হচ্ছে না, বারবার ঘামছে নাকটা। ইসরাত আবারো নাক মুছে নিতেই ছালিমা বেগম বললেন,”নাক বেশি ঘামলে জামাই আদর দেয় বেশি।
ইসরাত কিছু বলতে যাবে নুসরাত আবারো দু-লাফে চলে আসলো তাদের কাছে। সতর্ক আওয়াজে জিজ্ঞেস করল,”সত্যি?

ছালিমা বেগম হু হু বলে উপর নিচ মাথা নাড়ালেন। নুসরাত লজ্জাতক ভঙ্গিতে হেসে বলে ওঠল,”তাহলে আজ এবং এখন থেকে কাজে লেগে যেতে হবে।
ইসরাত অবাক কন্ঠে জিজ্ঞেস করল,
“কীসের কাজে?
নুসরাত ভাব নিয়ে চুল পেছনে ঠেলে দিল। নিচু সুরে নানি আর বোনের শোনার মতো করে বেলেহাজের মতো বলে ও,” ফ্যান বন্ধ করে নাক বেশি করে ঘামাব, তাহলে জামাই বেশি আদর দিবে। হি হি হিহি…
ছালিমা বেগম ঠোঁট টিপে হেসে ফেললেন। ইসরাত ও হাসল, তারপর কাপড় বদলানোর জন্য উঠে দাঁড়াল। নানি আর বোনের কাছ থেকে কিছু সময় নিয়ে, আলগোছে মেকি হাসি ঠোঁটে ঝুলিয়ে তাদের আসর থেকে বের হয়ে আসলো। নুসরাত পিছু পিছু আসতে নিবে, ছালিমা বেগম তাকে জিজ্ঞেস করলেন,”তোকে নাকি মৌমাছি কামড় দিয়েছিল?

“আর বলো না নানি, মাদারচু*দের দল একসাথে এসে হামলা করায় কিছু করতে পারিনি, নাহলে নুসরাত নাছির কি চিজ বুঝিয়ে দিতাম।
তারপর তওবা কাটল। বোকা হেসে অদ্ভুত চোখে চেয়ে থাকা নানিকে বলল,”আসলে গালি শিখে ফেলেছি একটু একটু, ইরহাম নামক খবিশটা শিখিয়েছে এইসব। আমি নিজে থেকে কিছু শিখিনি।
নুসরাতের নানি ভ্রু যুগল কিঞ্চিৎ কুঁচকালেন। বললেন,
” তোর ভাই তো ভিন্ন কথা বলছে, তুই নাকি সবগুলোকে গালি শিখিয়েছিস?
নুসরাত খ্যাক করে উঠে বলল,

“কোন মাদা*রচুদ এসব বলেছে! আমি গালি দিব, আমি, এত বড় ইঞ্জাম, এত বড় সম্মানহানি নিজের উপর মেনে নিতে পারছি না নানু। আমি কচু গাছে ফাঁস দিতে যাচ্ছি, তুমি আসতে চাইলে আসো আমার সাথে।
নুসরাতের নানি চোয়াল ঝুলিয়ে চেয়ে রইলেন। তার শুভ্র আননে মেঘ জমেছে অনেক বেশি। নুসরাতের কথা ধরেই ভ্রু উচিয়ে, শক্ত কন্ঠে জানতে চাইলেন,” তাহলে এতক্ষণ দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে তুই গালি দিচ্ছিলি না তো কী করছিলি?
নুসরাত বিস্ময় কন্ঠে প্রকাশ করে। এক মুহুর্ত বিলম্ব না করে, উচ্ছাস ভরা কন্ঠে বলে ওঠে,”আহা নানু এগুলো কী গালি, এগুলো হলো কবিতা। কয়েকদিন পর নিউজ পেপারে দেখবে আমার ছবি ছেপেছে। মোটা মোটা অক্ষরে লিখা দ্যা গ্রেট সৈয়দা নুসরাত নাছির নিজের মায়ের হাতে বিনা কারণে এত মার খেয়েছেন, যে আজ তিনি নিজেকে প্রমাণ করতে একজন সফল কাব্যিক। তার হৃদয় কাঁপানো কবিতা শুনলে আপনার হৃদয় ভেঙে পড়বে, আপনি পুরোপুরি মুষড়ে পড়বেন, হয়তো কাঁনতে কাঁনতে কোমায় পৌঁছে যাবেন। আরো জানতে আমাদের সাথে থাকুন, আমাদের উপর চোখ রাখুন। এখন তুমি বলো নানু, তুমি কী আমার প্রথম কবিতা শুনতে চাও? আগেই বলে দিচ্ছি, পরে কিন্তু আমি সেলিব্রিটি হয়ে গেলে আমার সময় তোমাকে দিতে পারব না, মিনতি করলেও না, কান্না করে মরে গেলেও ও না..!

ছালিমা বেগম তীক্ষ্ণ চোখে দেখলেন বিগড়ে যাওয়া মেয়েটাকে।৷ মানুষ বলে বড়লোক বাপের সন্তানেরা বিগড়ে যায়, তাহলে এটা এত পিটাই খেয়েও বিগড়ানো হলো কেন! দীর্ঘ শ্বাস ফেলে বলে ওঠলেন,”তাহলে বলেই ফেল একটা কবিতা, নিজের যখন এত প্রশংসা করছিস।
নুসরাত কাঁশি দিয়ে গলা পরিস্কার করল। নিজের জায়গা দাঁড়িয়ে একটু গলা খাঁকারি দিল। নিরর্থক দৃষ্টি দূরে নিবিষ্ট করে সিরিয়াস কন্ঠে বলে ওঠল,”বেডা মানুষ বুঝে না কোনো বাল, ছিঁড়তে যায় কলা গাছের ছাল। এক দুই তিন চার, বেডা মানুষকে পেছন মার।
নুসরাত তার নানির পানে নিজের চোখ ফিরিয়ে বলে ওঠল,”ওয়া ওয়া বলো না কেন নানু!
নুসরাতের নানি নীরবে চেয়ে থেকে শুধালেন,
“এই তোমার কবিতা? এটা কোনো কবিতার জাত হলো?
নুসরাত বলল,

” আহা নানু পছন্দ হয়নি, না হলেও কোনো সমস্যা নেই, সবার টেস্ট তো আর আমার মতো উঁচু লেভেলের হবে না।
ছালিমা বেগম উঠে দাঁড়ালেন। গম্ভীর মুখে নুসরাতকে পাশ কাটিয়ে যেতে যেতে কোমল কন্ঠে বললেন,”আল্লাহ তোমায় হেদায়েত দান করুক। আর এসবকে উঁচু লেভেলের টেস্ট বলে না, নিচু লেভেলের টেস্ট বলে। তোমাদের ভাষায় লো-কোয়ালিটির টেস্ট।
দরজা ভেজিয়ে রুমে প্রবেশ করল ইসরাত। বাঙালি স্টাইলে পরা শাড়ির পিন দুটো ছাড়িয়ে নিতেই চোখে পড়ল পায়ের উপর পা তুলে বসে থাকা জায়িনকে৷ সে ইসরাতের দিকে তাকিয়ে আছে। ইসরাত অবাক হলো মনে মনে। অতঃপর জায়িনের পানে চেয়ে ভ্রু নাচিয়ে শুধাল,”কী? কোনো প্রয়োজন মিস্টার জায়িন হেলাল?
জায়িন উঠে দাঁড়াল ধীরে সুস্থে। সুঠাম দেহি শরীরে পরিহিত কালো রঙের পাঞ্জাবীটা ফর্সা রঙের জায়িনের মুখ আরো উজ্জ্বল করে ফেলেছে। জায়িন নিজের চওড়া দেহ নিয়ে এগিয়ে আসলো ইসরাতের দিকে নৈঃশব্দে। কিছুপাল অতিবাহিত হওয়ার পর সে সামান্য ঝুঁকে আসলো। গ্রীবা বাঁকিয়ে ইসরাতের দিকে ঝুঁকে এসে বলে ওঠল,”আমার সব প্রয়োজনি তো আপনার সাথে।

ইসরাত ঘাড় কাত করে জায়িনের দিকে তাকিয়ে রইল। জায়িন ধীরে ধীরে ইসরাতের দিকে আরেকটু ঝুঁকে আসলো। এক ভ্রু উচিয়ে বলল,”আর ইউ কম্ফোটেবল ইসরাত নাছির?
ইসরাত মাথা নাড়াল। মৃদু সুরে বলল,
“ইয়াহ, আই এম!
জায়িন নিজেদের মধ্যে ইঞ্চি পরিমাণ জায়গা দূরত্ব হিসেবে রাখল। হাতের তালু ধীরে ধীরে ইসরাতের গালে স্পর্শ করল। শুধাল,”কম্ফোটেবল আপনি?
ইসরাত মাথা নাড়াল, কিন্তু ভেতর ভেতর চলছে ঠিকই দেনামোনা। জায়িনের পুরুষালি রুক্ষ শীতল হাতের স্পর্শ গালে পেতেই শিহরণ জাগল মনে। ধীরে ধীরে তা অন্য গাল স্পর্শ করল। তারপর নাক, থুতনি, কপাল। জায়িন তখনো ইসরাতের চোখের দিকে তাকিয়ে। জানতে চাইল একই প্রশ্ন,”আর ইউ কম্ফোটেবল?
ইসরাত চোখ তুলে জায়িনের দিকে তাকাল। মাথা নাড়িয়ে উপর নিচ জানাল হ্যাঁ। জায়িন তার হাত গাল থেকে সরিয়ে এনে ইসরাতের শাড়ি আঁচল ভেদ করে বের হওয়া উদরে স্পর্শ করল। নিজস্ব ভঙ্গিমায় আবারো জিজ্ঞেস করল,”ক্যান আই টাচ ইউ?

ইসরাত ঠোঁট টিপে মাথা উপর নিচ নাড়াল। জায়িন ইসরাতের অস্বস্তি বোধ যেন না হয় সে জন্য উদরে আলতো হাতে হলুদ স্পর্শ করল। তখনো তার চোখ ইসরাতের চোখে নিবিষ্ট। কোনো প্রকার কামুকতা ছাড়া পুরুষালি পুরু কন্ঠে, জানতে চাইল,” আপনি অস্বস্তি বোধ করছেন ইসরাত?
ইসরাত না ভঙ্গিতে দু-পাশে মাথা নাড়াল৷ জায়িনের হাত ইসরাতের উদর স্পর্শ করলেও চোখ তখনো মেয়েলি চোখে নিবিষ্ট। একবারের জন্য এদিক সেদিক হলো না। জায়িন ইসরাতের গালের দিকে ঝুঁকে এসে মশ্রিণ গলায় জানতে চাইল,”মে আই টাচ মাই চিক টু ইউ্যেরস?

ইসরাত অনুমতি দিল। জায়িন নিজের গ্রীবা নামিয়ে নিয়ে এসে ইসরাতের মেয়েলি হলুদ মাখা গালে স্পর্শ করল। পুরুষালি গাল উপর নিচের ঘর্ষণে সূক্ষ্ম চাপে দাড়ির খোঁচা অনুভূত হলো মসৃণ মেয়েলি গালে। জায়িন নিজের গালে হলুদ লেগে আসতেই সরে গেল ইসরাতের থেকে নির্সিষ্ট পরিমাণ দূরে। কিছু বলতে যাবে ভেজানো দরজার ফাঁক গলে দেখা মিলল দুটো দুটো করে ছয়টা চোখের। একটার উপর একটা করে মুখ। সবগুলো চেয়ে আছে তাদের দিকে ড্যাবড্যাব করে। জায়িন মনে মনে ভেবে নিল, মুখে হয়তো ইয়া বড় একটা হা ঝুলানো সবগুলোর। জায়িন তীক্ষ্ণ চোখে তাকিয়ে থাকল দরজার ফাঁকে।
নুসরাত জায়িনকে এমন থেমে যেতে দেখে বিড়বিড় করে বলল,”ওই আহাইন্না ছবি তুলেছিস? না ক্যাপচার করলে, তাড়াতাড়ি ক্যাপচার কর, ওদের ব্ল্যাকমেইল করব এসব দেখিয়ে।
আহান ক্যামেরা নিজের চোখের কাছে ধরে এক চোখ বন্ধ করল। বিড়বিড় করে বলে ওঠল,”দাঁড়াও দু-মিনিট, আগে পজিশন করতে দাও।

ইরহাম দরজার দিকে ছোট ছোট নেত্রে চেয়ে রইল৷ খুবই সন্তপর্ণে সতর্কতা সহিত সে বলে ওঠল,”তোর পজিশন করতে করতে ওরাই আগের পজিশনে চলে যাবে।
আহান ক্যামেরা দিয়ে দুয়েকটা ফটো তুলে নিল। অতঃপর হাতে ক্যামেরা ধরে ভুলে লাইট অন করে ফেলল৷ সেটা খেয়াল না করে ইসরাত আর জায়িনের ছবি তুলতে যাবে, তখনই আলো জ্বলে উঠল। আর তা দরজার ফাঁক গলে গিয়ে পড়ল জায়িন আর ইসরাতের সম্মুখে।
জায়িন এতক্ষণ দেখছিল এদের কান্ড চুপচাপ। যখনই শিওর হলো ওখানে সবগুলো বাদর বসে, ধীরে ধীরে এগিয়ে আসলো দরজার কাছে। অপাশের মানুষ কোনো কিছু বুঝে উঠার আগেই ঠাস করে দরজা খুলে ফেলল। অক্ষিপটে ভাসল লিলিপুটেরমুখ করে বাদরের মতো দরজা ধরে ঝুলে আছে সবগুলো। দাঁত কেলিয়ে ভদ্র হাসি হাসছে তিন জন। দু-হাত আড়াআড়ি বুকে বেঁধে জায়িন কাঠখোট্টা কন্ঠে জানতে চাইল,”এখানে কী?
নুসরাত, ইরহাম, আহান তিনজনে নিজেদের পানে চেয়ে ভদ্র ভঙ্গিতে, মুখ বানিয়ে ঠোঁট উল্টালো। এমন ভাব যে মহৎহৃদয় প্রাণ হয়ে একদম জায়িনের চরণে লুটিয়ে পড়বে তারা। তিনজনে বোকা বোকা গলায় একসাথে বলে ওঠল,”কোনো কিছুই তো না, তাই না? হা হা..!

হেসে হেসে তিনজনে বসা থেকে উঠে দাঁড়াল। একটার উপর অন্যটা প্রায় চড়ে বসেছিল। জায়িনকে এমন গম্ভীর হয়ে নিজেদের সামনে দাঁড়াতে দেখে হেসে হেসে মেঝে থেকে একে অন্যকে ঠেলে ধাক্কিয়ে উঠে দাঁড়িয়ে জায়গা করে নিল। দুয়েক মিনিট দাঁড়ানো নিয়ে ও চলল তাদের ঝগড়া। জায়িন গুরু গম্ভীর ভঙ্গিমায় সকলের ভদ্র মুখ অবলোকন করে বলে ওঠল,”তোমাদের দেখে শয়তান ও কনফিউজড হয়ে যাবে।
নুসরাত ইরহাম আর আহান অবাক চোখে মুখে চেয়ে, উত্তেজিত আওয়াজে বলে ওঠল,”কেন?
জায়িন তার উত্তর দিল না। কপালে তীক্ষ্ণ ভাঁজ ফেলে সবগুলোকে দেখল। মুখ দিয়ে ঝড়ে ঝড়ে পড়া প্রশ্নের বাহারে ঠোঁট যেন ছটফট করছে কথা বলার জন্য, শুধু পারছে না এই যা।

নুসরাত জায়িনের দৃষ্টি নিজেদের দিকে ক্ষোভ মিশ্রিত অনুভব করল। সেধে সেধে বলল,”আমরা কিছুই দেখিনি।
জায়িন মনে মনে সামান্য হাসল। মুখের উপর তখন গুরু গম্ভীরতার ছাপ। রুঢ় কন্ঠে জানতে চাইল,”দেখলেই বা কী?
আহান কুটিল হাসল। মিচকে শয়তানি হাসি ঠোঁটে ঝুলিয়ে বলে ওঠল, “আমাদের কাছে আপনাদের ছবি আছে।
জায়িন কিঞ্চিৎ ভ্রু কুঁচকে নিল। ভ্রুক্ষেপহীন কন্ঠে জানতে চাইল,” থাকলেই বা কী!
তারপর তিনজনের একজনকে কথা বলার সুযোগ না দিয়ে রাশভারী গলায় আওড়ায়,”আমি ভেবে পাই না প্রতি বছর ত্রিশদিন করে নেত্রীসহ জেলে থাকার পরও কেন তোমাদের হেদায়েত হয় না!
ইরহাম, আহান, নুসরাত অবাক হয়ে তাকাল নিজেদের দিকে। তারা আবার কখন জেলে গেল। এই জায়িন ভাইয়ের মাথা নির্ঘাত গিয়েছে। না হলে জীবনে জেলে না যাওয়া তাদের কেন বলছে জেলে গিয়েছে! জায়িন সবগুলোর মুখ দেখেই পড়ে নিল ভেতরের কথা। ঠোঁট উচিয়ে সবাইকে তাচ্ছিল্য করে পাশ কাটিয়ে যেতে নিল ইরহাম বলল,”আমরা সবকিছু দেখে নিয়েছি।

জায়িন সামনের দিকে হেঁটে চলে গেল। পুরুষালি পুরু কন্ঠের সুর তখন কানে আসলো, কিছুটা ঠাট্টা মিশ্রিত তাতে। জায়িন বলছে”কিছু দেখো আর না দেখো এতে আমার কোনো কিছুই যায় আসে না।
নুসরাত, আহান, ইরহাম জায়িনের কথায় পাত্তা না দিয়ে ভাবতে থাকল তারা আবার কবে গেল জেলে। যখন তর্জনী আঙুল থুতনিতে রেখে একের পর এক চক্কর কাটল এপাশ থেকে ওপাশে তখন টনক নড়ল সবার। প্রতি বছর রমজান মাসে শয়তানকে আল্লাহ জেলে পাঠান, তার মানে শয়তানকে জেলে পাঠানো মানে তাদেরকেও জেলে পাঠানো। দুইয়ে দুইয়ে চার মিলাতেই তিনজনের চলতে থাকা পা থেমে গেল। বৃহৎ আকৃতির চোখ করে সবাই সবাইকে অবলোকন করল।

এমন সূক্ষ্ম খোঁচা মেরে চলে গেল ওই দুলাভাই নামক লোক তাদের। কত বড় সাহস। তারা শয়তান! ইয়া আল্লাহ! নুসরাত মিনমিনিয়ে দুঃখী সুরে বলল,”আমাদের ইবলিশ শয়তান বলে চলে গিয়েছে। আর আমাকে শয়তানের নেত্রী বানিয়ে দিয়েছে। নাউজুবিল্লাহ, আস্তাগফিরুল্লাহ, লা হাওলা ওয়ালা কুয়াতা ইল্লা বিল্লাহিল আলিউল আজিম। আল্লাহ পাক মাফ করুক, নাউজুবিল্লাহ, নাউজুবিল্লাহ।

ঘড়ির কাটায় তিনটা বেজে চল্লিশ মিনিট। টিকটিক করে চলছে তা। নুসরাত টিঙ্গা লিঙ্গা লিঙ্গা বলে সিঁড়ি বেয়ে নামছে। এর মধ্যে এক দূর সম্পর্কের ফুফু নুসরাতকে থামালেন। ভদ্র মহিলা নাছির সাহেবের ফুফাতো বোন, নাম নায়মা। তিনি হেসে হেসে বললেন,”নেক্সট সিরিয়াল কিন্তু তোমার।
নুসরাত হাসল ভুবন ভুলানো। না জানার ভঙ্গি করে টেনে টেনে জিজ্ঞেস করল,”কীসের সিরিয়াল ফুপি?
ভদ্র মহিলা হাসলেন। বললেন,
“তোমার বিয়ের।
নুসরাত হা হা করে হাসল। নিজেও বলল,
” নেক্সট সিরিয়াল কিন্তু আপনার ও ফুপি?
ভদ্র মহিলা ভ্রু উচিয়ে, অবাকতার সহিত জানতে চাইলেন,”কীসের?
নুসরাত হা হা করে তখনো হাসছে। অত্যাধিক বিনয়ী সুরে বলল,”কবরে যাওয়ার, টিকেট কিন্তু এবার নিশ্চিত ওকে, সু করে গাড়ি একদম ওখানেই গিয়ে থামবে।

ভদ্র মহিলা নির্বাক হয়ে গেলেন। ঠোঁটের ফাঁক গলে এই বড় হা হয়ে আসলো নিজের অজান্তে। নুসরাত নিজের চুলে খোপা বেঁধে সিঁড়ি বেয়ে নিচের দিকে নামলো ভাবের সহিত। গলার কাছে থাকা নিজের পাওয়ার বিশিষ্ট চশমা দু-কানের ভাঁজে গুজতে গুজতে ফু দিয়ে মুখের উপর থেকে চুল সরালো। তর্জনী আঙুলের মধ্যে গাড়ির কী ঘোরাতে ঘোরাতে হেলেদুলে বাড়ির বাহিরে চলে গেল। ভদ্র মহিলা নিজের জায়গা থেকে নড়তে ভুলে গেছেন প্রায়, একপ্রকার স্টেচু হয়ে দাঁড়িয়ে থেকে বিড়বিড়ালেন,”আল্লাহ কাঁচির মতো জিভ দিয়েছেন।

বাহিরে অপেক্ষারত মুখে সৌরভি, আহান, ইরহাম, মমো দাঁড়িয়ে ছিল৷ ইরহাম দুয়েক বার সৌরভির পানে চেয়েছিল আড় চোখে৷ আর এতেই সৌরভির অস্বস্তি বোধ বেড়েছে৷ ইরহামের সাথে তার সম্পর্ক তেমন একটা ভালো নয়৷ নুসরাতের ভাই হওয়ায় একটু ভদ্রতার খাতিরে ফরমালিটি করে কথা বলে, নাহলে ইরহামের সাথে কথা বলার তার কোনো ইচ্ছে বা আকাঙ্ক্ষা নেই। ইরহামের বিষয়ে তার কোনো কিছুই অজানা নয়। অনেকগুলো গার্লফ্রেন্ড আছে। একবার তো নিজের চার নাম্বার গার্লফ্রেন্ডের জন্য নিজের হাত কাটতে বসেছিল। হাই হুতাশ করে কান্না করছিল আর বলছিল,”আমি ওকে ছাড়া বাঁচব না, এবার আত্মহত্যা করব। ও এমন কেন করল আমার সাথে!

এসব বলে বলে ভেউ ভেউ করে কাঁদছিল। কিন্তু নুসরাত এসবে মোটেও পাত্তা দেয়নি। মাছি তাড়ানোর ভঙ্গিতে ইরহামের আত্মহত্যার কথা বাতাসে উড়িয়ে দিয়ে অলস ভঙ্গিতে ইরহামকে একদম নাজেহাল অপমান করল,”এর আগেবার যখন তোর তৃতীয় গার্লফ্রেন্ড তোকে টাকা খুঁজেছিল তখন তুই সে-চ্ছায় ব্রেক-আপ করেছিলি, সাথে তুই বলেছিলি তুই আর বাঁচবি না ওকে ছাড়া, তাছাড়া এ ও বলেছিলি নিজের জান কোরবান করে ফেলবি গলায় ফাঁস দিয়ে, ফ্যানের সাথে ঝুলে পড়বি, কিন্তু এখনো মরিসনি তুই! ফাজলামির একটা লিমিট রাখ ভাই, আমাকে আর হাসাইস না।

ইরহাম তখনো ন্যাকা কান্না কাঁদছে। চোখের পানিতে ভাসিয়ে ফেলবে কলেজ ক্যাম্পাস তার ভাব এমন। ছাগলের মতো ভ্যাঁ ভ্যাঁ করে কেঁদে নাক মুছল। তারপর বলল,”ও আমার সত্যিকারের ভালোবাসা ছিল।
নুসরাত ভেঙ্গিয়ে হু হু করে কাঁদল। ইরহামের কথায় পুরো ইমোশনাল হয়ে বলে ওঠল,”গত পাঁচ বছর যাবত তোর প্রতিদিনই সত্যিকারের ভালোবাসা হয়, এটা কোনো বিষয় না, আজ বিকেলে আবার কাউকে সত্যিকারের ভালোবেসে ফেলিস, আমরা কিছু মনে করব না।

আজকাল সে যা উপলব্ধি করছে ইরহামের চোখ একটু বেশিই ঘুরে ফিরে তার দিকে আসছে। সরাসরি কখনো দেখেনি কিন্তু মানুষ বলে মেয়েদের ষষ্ঠ ইন্দ্রিয় প্রখর হয়, পনেরো মাইল দূর থেকে কেউ তার দিকে নজর দিলেও সে ঠিকই সেটা বুঝে যায়। ইরহাম লুকিয়ে চুরিয়ে যে তার দিকে তাকায়, সেটা হলফ করে বলতে পারবে সৌরভি। এর মধ্যে কয়েকটা দড়ি হাতে নিয়ে নুসরাত আর ইসরাত এসে হাজির হলো। নুসরাত খুবই কোমল হাসি গালে ফুটিয়ে তুলে ভদ্র ভঙ্গিমায় বলে ওঠল,”আজ তোদের জন্য একটা সারপ্রাইজ আছে।
ইরহাম, আহান, মমো সেকেন্ডের ভেতর ধরে ফেলল কী সারপ্রাইজ তাদের জন্য। ইসরাত সবগুলো হাবভাব দেখে নুসরাতের কানে কানে বলে ওঠল,”ভেগে যাবে না তো?
নুসরাত ফিসফিসিয়ে বলে,

“ওদের এতটা সাহস নেই আমাদের এখানে রেখে ভাগার।
তারপর গলা পরিস্কার করল দু-জনে। ইসরাত সবার কাছে জানতে চাইল,”তোরা জানতে চাইবি না, কী সারপ্রাইজ?
ইরহাম দু-পাশে মাথা নাড়াল। নিজের সম্বল হাতে নিয়ে ভেগে যেতে যেতে বলে ওঠল,” না, আমি জানতে চাই ও না কী সারপ্রাইজ! তোদের সারপ্রাইজ তোরা দু-বোন তোদের কাছেই রাখ।
নুসরাত ইরহামের কলার থাবা মেরে চেপে ধরল নিজের সাথে। বোকা হাসি হেসে বলে ওঠল,”বন্ধু কোথায় যাচ্ছো তুমি?
ইরহাম নুসরাতের হাত থেকে নিজেকে ছাড়াতে নিবে নুসরাত হুমকি দিল,”ঘাড়ে একটা থাবা মারব, আল্লাহুম্মা আমিন হয়ে যাবি।

ইসরাত কিটকিট করে হেসে উঠল। সৌরভি একমাত্র ব্যাক্তি যে জানতে চাইল,”কী সারপ্রাইজ?
নুসরাত ইরহামকে সাথে করে টেনে নিয়ে গেল। ফিসফিস করে ইসরাতের কানে কাছে আওড়াল,”এই দেখ একটা মুরগী পেয়েছি, ওটাকে নিয়ে আগে বসা গাড়িতে।
ইরহাম হায় হায় করে উঠল। ইসরাত সৌরভিকে নাছির সাহেবের গাড়ির পেছনের সিটে বসিয়ে দিল। সৌরভি ভদ্র মেয়ের মতো গাড়িতে উঠে বসে রইল। মমো সৌরভিকে কিছু বলতে যাবে নুসরাত বলল,”ইসরাত এই বোকাচো*দাকে তুই আগে গাড়িতে তোল। আমি ওই মালগুলাকে তুলতেছি।
মমোকে টেনে নিয়ে গাড়িতে বসিয়ে দিয়ে ইসরাত গাড়ি লক করে দিল। মমো ছটফট করে উঠল গাড়ি থেকে বের হতে৷। সৌরভি মমোর এমন ছটফটানি দেখে অবাক কন্ঠে জানতে চাইল,”তুমি এমন ছটফট করছ কেন?
মমো অতিরিক্ত কষ্টে হেসে দিল হিহি করে। বলল,”একটু পরই তুমি ও ছটফট করবে গাড়ি থেকে নামার জন্য তখন উপলব্ধি করবে আমি কেন এমন ছটফট করছি।

সৌরভি আর ঘাটাল না মমোকে। সে ধাক্কাচ্ছে অনবরত গ্লাসের মধ্যে। আর সাথে হাই হুতাশ করছে যাবে না বলে। সৌরভি বুঝে পেল না লং ড্রাইভে গেলে সমস্যা কোথায়! মনে প্রশ্ন নিয়ে জানালার বাহিরে তাকাতেই দেখল আহানকে টেনে নিয়ে গাড়ির ভেতরে ঢোকাচ্ছে ইসরাত নুসরাত। আহান নিজের শরীরের ভর ছেড়ে দিয়ে একদম সোজা হয়ে গিয়েছে যেন সে জীবন্ত লাশ। তবুও দু-বোন টেনে টেনে নিয়ে গিয়ে আরেক গাড়িতে বসাল একে। তারপর দড়ির সাহায্যে হাত পা শক্ত করে বেঁধে দিল। ইরহাম দৌড় দিল এই সুযোগে, কিন্তু ইসরাতের সাথে পারল না। ইসরাত পেছন থেকে থাবা মেরে ইরহামের পাঞ্জাবী চেপে ধরল৷ ইরহাম সামনে থেকে নিজের গা টানল আর ইসরাত তাকে আটকানোর জন্য তার পাঞ্জাবী টানল। টিস্যু কাপড়ের পাঞ্জাবী হওয়ায় শক্ত হাতের চাপে ফরফর করে গলার কাছের কাপড় ছিঁড়ে গেল। ইরহাম তখনই থেমে গেল। থমকে যাওয়া চাহনি নিজের নতুন কাপড়ের দিকে প্রথমে দিল তারপর ইসরাতের দিকে ফিরিয়ে দিল। ইন্ডিয়া সিরিয়ালের মতো তিন বার দেখার পর কাঁপাকাঁপা সুরে বলল,”ইন ধনীওনে হামারা ইজ্জাত, হামারা কাপড়ে, হামারা সব কুচ চিনলিয়া। খোদা তুম লোগোছে পুচেগা, গারীব ও কী উপার আত্যাচার কিউ কেয়া ইয়ে বাত।

নুসরাত ইরহামের কথায় পাত্তাই দিল না। টেনে টেনে নিয়ে গেল গাড়ির কাছে। খুবই আত্মবিশ্বাস মনে চেপে রাখল। সে জানে ইরহাম তার সাথে যাবে। তাই বলে ওঠল,”তুই আমাকে বিন্দু পরিমাণ বিশ্বাস করলে আজ আমার সাথে যাবি।
ইরহাম নুসরাতে মনের ভেতর চেপে রাখা সকল আত্মবিশ্বাস গুড়িয়ে চূর্ণ বিচূর্ণ করে দিতে বলল,”খোদার কসম বোন তোর প্রতি আমার বিন্দু পরিমাণ বিশ্বাস নেই। জীবনে যদি আমাকে একবার বলা হয় আমাজন জঙ্গলের বিষাক্ত এনাকোন্ডার উপর বিশ্বাস করার জন্য তাহলে আমি এনাকোন্ডাকে বিশ্বাস করব, কিন্তু তোকে আমি এক সেকেন্ডের জন্য বিশ্বাস করব না।

নুসরাত ভেতরে ভেতরে দু-সেকেন্ডের জন্য অপমানিত বোধ করল। তারপর আবার ঝেড়ে ফেলল কারণ তার মনে পড়ল নুসরাত নাছিরের ডিকশনারীতে ইম্পসিবল, অপমান, বেজ্জতি, আর লজ্জা বলতে কোনো শব্দই নেই। তাই দাঁত কেলিয়ে হেসে বলল,”আজকের জন্য মনে কর আমি এনাকোন্ডা।
ইরহাম মানতে চাইল না নুসরাতের কথা। দু-পাশে মাথা নাড়িয়ে বলল,”বোন আমার, তোর দু-চরণে পড়ে বলছি আমাকে যেতে দে। আমি দোয়া করে দিলাম আল্লাহ তোকে পনেরো বাচ্চার মা বানাবে, তোর জামাইকে বিশ বাচ্চার বাপ বানানোর তৈওফিক দিবে।
নুসরাত চোখের আকার প্রকট করে জানতে চাইল,

“অভিশাপ দিলি, নাকি বদদোয়া দিলি?
ইরহাম এক মুহুর্ত বিলম্ব না করে বলল,
” দোয়া বোন দোয়া।
“তোর মতো এনাকোন্ডা বিশ্বাসী লোকের দোয়া আল্লাহ কবুল করবেন না, আর এমন অভিশাপের মতো বদদোয়া আমার প্রয়োজন নেই। এবার চুপচাপ গাড়িতে উঠে বস নাহলে আমি অন্য পন্থা অবলম্বন করব।
ইসরাত বুকে আড়াআড়ি হাত বেঁধে এদের ঝগড়া দেখছে। ইরহাম অসহায় চোখে নুসরাতের দিকে তাকিয়ে মিনতি করে বলল,”আল্লাহর ওয়াস্তে বোন আমাকে যেতে দে। আমি তোর কাছে হাত জোর করে বলছি। আর তাছাড়া তুই কী পন্থা অবলম্বন করবি? আমি না যেতে চাইলে কীভাবে নিয়ে যাবি আমায়?
নুসরাত হাসল অধরের কোণ উচিয়ে। বলল,

” সোজা পায়ে না গেলে, বাঁকানো পায়ে লাথি মেরে মেরে নিয়ে যাব। তুই যাবি, তোর বাপ যাবে, তোর চৌদ্দ গুষ্টিতে থাকা সব খবিশ গুলা যাবে।
ইসরাত ড্যাবড্যাব করে নুসরাতের দিকে তাকিয়ে চোখের পাতা ফেলল। মাথায় একটা গাট্টা মেরে শুধাল
,”কী বলছিস, বুঝে বলছিস?
নুসরাত ভাব নিয়ে বলে ওঠল,
“আমি পুরো হুঁশ ও জ্ঞানের সাথে নিজেকে এবং নিজের পরিবারের সবাইকে ভুলে গালি দিয়ে দিয়েছি।
ইরহাম মিনতি কন্ঠে আবারো বলল,
“বোন বিশ্বাস কর…..
নুসরাত বলে ওঠল,

” এনাকোন্ডা বিশ্বাস করা মানুষকে আমি বিশ্বাস করিনা। এরা ইউনেক্টিস স্পে এর মতো বিষাক্ত হয়।
ইরহাম দীর্ঘ শ্বাস ফেলল। আহান ব্যাক সিটে শোয়া অবস্থায় বলে ওঠল,”তোমার এই আচরণের জন্য, আরশ ভাই তোমার ভাগ্যে পড়ছে। ভালো আচরণ করলে ভালো লোক পড়ত। দু-জনেই সেম তোমরা। মানুষ বলে না আল্লাহ জোরা মিলিয়ে মানুষ বানায়, যে যেমন তার ভাগ্যে তেমন পড়ে।
নুসরাত চোখ পাকিয়ে গাড়ির ভেতর তাকাল। নিজের পায়ের জুতো হাতে নিয়ে হুশিয়ারি দিয়ে আওড়াল,”জুতো দিয়ে পিটাই করব। চুপ গরু কোথাকার!

ইরহামকে আর কোনো কিছুই বলতে না দিয়ে নুসরাত ইসরাতকে উদ্দেশ্য করে বলল,”এই ইসরাত, মালটাকে গাড়িতে তোল, আর উঠতে না চাইলে ক্যারাটের কালো বেল্টের তিন নাম্বার স্টেপ ইউজ করবি। একদম খাল্লাস হয়ে যাবে, মুখ দিয়ে আওয়াজ বের করার অবস্থায় ও থাকবে না। হয়তো চল্লিশা ও খেয়ে ফেলতে পারি।
ইরহাম শেষ মুহুর্ত পর্যন্ত মিনতি করল না যাওয়ার জন্য, দু-জনের একজন ও শুনল না। গাড়িতে ঠেলে ধাক্কিয়ে বসিয়ে দিয়ে, ইরহামের হাত পায়ে দড়ি বেঁধে ফেলল। এমন কী ইরহাম চিৎকার বা কথা বলতে না পারে সে জন্য মুখে ও টেপ লাগিয়ে দিল। নুসরাত টেপ লাগিয়ে হাত ঝেড়ে ময়লা সাফ করার মতো বলল,”মেয়ে মানুষের মতো প্যানপ্যান বেশি করে।

ইসরাত নুসরাতের কথা সহমত পোষণ করল। পরমুহূর্তে নুসরাতের পানে চেয়ে আদেশ দিয়ে বলল,
“কোনো প্রকার শব্দ না করে গাড়ি নিয়ে বের হো তুই আগে, পিছু পিছু আমি আসছি।
নুসরাত গাড়ির চাবি দিয়ে লক খুলে উঠে বসল ড্রাইভিং সিটে। প্রথমে সিট বেল্ট বাঁধল, তারপর নিজের দু-গুণোধর ভাইয়ের উদ্দেশ্যে বলল,” এই চুথিয়ারা, সিট বেল্টে বেঁধে নেয়।
নুসরাত ভুলেই বসল দু-বোন মিলে বেঁধে এদের গাড়িতে বসিয়েছে। ইরহাম উ উ করে কিছু বলতেই নুসরাতের টনক নড়ল। ফিরে তাকিয়ে মুখ দিয়ে আক্ষেপ মিশ্রিত সুর বের করে, বলে ওঠল,”বলেছিলাম তখন চুপচাপ গাড়িতে উঠ, হয়েছে এবার। আজ সারারাত দুটো এমন বাঁধাই থাকবি।
আহান কিছু বলতে নিবে নুসরাত ড্যাশবোর্ড হতে স্টেপলার বের করে আহানকে দেখিয়ে চোখ রাঙিয়ে বলল,”একদম ঠোঁট স্টেপলার করে দিব। চুপ একদম চুপ..!

আহান মিনমিনিয়ে বলেই ফেলল,
“আজ মনে হচ্ছে তুমি আমার বোন না, কোনো এক খচ্চর ডাইনি।
নুসরাত এসব কানেই তুলল না। ইরহামকে আর আহানকে সিট বেল্ট লাগিয়ে দিয়ে আহানের মুখেও কস্টেপ মেরে দিল। লাউড স্পিকারে ব্লুটু এ গান বাজাল। বাঁ-হাত দিয়ে হুইল চেপে ধরে ডান হাত রাখল উইন্ডো এর কাছে। একহাতে গাড়ি চালিয়ে তা বের করল বাড়ির বাহিরে। ধীরে ধীরে তা উঠে আসলো নির্জন মেইন রোডে। অত্যাধিক সুরে গান বাজছে। চারটা জানালা নামিয়ে দিতেই রাতের ঠান্ডা বাতাস এসে সুরসুর করে প্রবেশ করল। নুসরাত কিছুটা পাশ কাটতেই ইসরাত এসে জায়গা দখল করে নিল। নুসরাত ইসরাতের পানে চেয়ে ইশারা করতেই ইসরাত এক্সেলরেটর আস্তে আস্তে পা দিয়ে চাপ দিল। আর এতেই বৃদ্ধি পেল গাড়ির স্প্রিড। সৌরভি ভয়ে আঁটসাঁট হয়ে লেগে গেল গাড়ির সাথে। ভয়ে ধুরু ধুরু বুক নিয়ে মমোর দিকে চেয়ে আর্তনাদ করল,” ইয়া আল্লাহ, আমাকে আগে বলবে না? এরা পাগলের মতো গাড়ি ড্রাইভিং করে।
মমো গাড়ির সাথে একদম লেগে বসে শুধাল,

“আগে বললেই বা কী করতে তুমি? টেনে এনে তোমাকে বসাতো, না যেতে চাইলে ওদের মতো বেঁধে নিয়ে যেত।
ইসরাত এক হাতে ড্রাইভিং করে গেল। গাড়ির ইঞ্জিনের শব্দ ধীরে ধীরে বৃদ্ধি পাচ্ছে। আশেপাশের গাছ পালা দ্রুতগতিতে সরে যাচ্ছে পেছনের দিকে। দু-জনের গাড়ির মধ্যে গান বাজছে
,”Kaaliyan baariyan ve gaddiyaan nu main lawaan
Speed main 220 di chalaan
Police de samne main, nai, rukda
I’m a night rider.
Ni gaddi sadi behja ni jattiye
Ni door tenu lehja, we adiye
Ni woofer tu meri, meri
Main tera amplifier, fier

নুসরাত আর ইসরাত গানের সাথে চিৎকার করে গলা মিলাচ্ছে। মমো আর সৌরভি গাড়ির সাথে চেপে বসলেও গানের সাথে নিজেরা ও গলা মিলাল। দু-গাড়ি পাশাপাশি চলে গেল একই গতিতে। রাস্তার শুকনো পাতা, বালি উড়িয়ে এগিয়ে গেল সামনে। নুসরাত ততক্ষণে ইরহাম আহান এর মুখ থেকে কস্টেপ খুলে দিয়েছে। হুশিয়ারি দিয়ে বলেছে টু শব্দটি না করে গান গেয়ে যেতে। পুরুষালি গলা আর মেয়েলি মোহনীয় গলার সংমিশ্রণে আলাদা এক পরিবেশের সৃষ্টি হলো। দুটো গাড়ি পাল্লা দিয়ে এগিয়ে চলল অজানা সীমানার উদ্দেশ্যে চিনাজানা রাস্তায়। যখন গান থেমে গিয়ে পরিবেশ ঠান্ডা হলো, তখন সামনে নজরে এলো পুলিশের গাড়ি। নুসরাত ব্রেক চেপে ধীরে ধীরে গাড়ির গতি কমিয়ে নিল। এমন কী ইসরাতকে ও বলে দিল স্প্রিড একদম বিশে নিয়ে যেতে। ভদ্র মুখ বানিয়ে নুসরাত দ্রুত নিজের গলার ওড়না মাথায় পেঁচিয়ে নিল। ইরহাম নুসরাতকে ঠাট্টা করে বলল,”তোকে দেখে তোর সাথের ক্বারিন জীন বলবে, এর সাথে আমাকে দিলে কেন ইবলিশ সরদার!

নুসরাত চোখ পাকাল। রেয়ার মিররে দেখা গেল তা। দু-হাতে হুইল চেপে ধরে পুলিশকে পাশ কাটাতে যাবে দু-গাড়ি থামিয়ে দিল তারা। একজন পুলিশ এসে টর্চলাইট মেরে বসল নুসরাতের মুখ বরাবর। নুসরাত কপালে ভাঁজ ফেলে মিনমিনিয়ে জানতে চাইল,”কোন মাদার*চু*দ বে, চোখে লাইট মারে?
লাইট সরে যেতেই নুসরাত চোখ খিঁচিয়ে তাকাল সামনে। আর পুলিশ অফিসারের মুখখানা দেখতেই নুসরাতের মাথার আগুন দাউ দাউ করে জ্বলে উঠল। এটা আর কেউ না, মৃন্ময় তুষার। বিতৃষ্ণা মিশ্রিত আওয়াজে গলা ফেড়ে না চাইতেও টুপ করে বেরিয়ে আসলো,”আপনি?
মৃন্ময় তুষার হাসল ঠোঁট উচিয়ে। বলল,

“দেখা হয়ে ভালো লাগল মিসেস আরশ।
নুসরাত মেকি হাসি ঠোঁটে ঝুলিয়ে বলল,
” কিন্তু আপনার সাথে দেখা হয়ে মোটেও আমার ভালো লাগেনি। এতক্ষণের ভালো থাকা মুডের একদম রফাদফা হয়ে গিয়েছে।
মৃন্ময় তুষার বুকের বাঁ-পাশ চেপে ধরে বলল,
“অহ ইটস মাই প্লেজার। তা এত রাতে কোথা থেকে আসা হচ্ছে শুনি?
নুসরাত ত্যাড়া চোখে তাকিয়ে থাকল মৃন্ময়ের দিকে। হাত দিয়ে ভ্রু চুলকে নিয়ে বলে ওঠল,” মাল সাপ্লাই দিতে গিয়েছিলাম, কয়েক কোটি টাকার ওখান থেকেই ফিরছি। একটু আগেই আসলে হাতে নাতে ধরতে পারতেন।
“তাহলে তো আজ বড় সড় দান মেরে এসেছেন?
নুসরাত দম্ভ ভরা কন্ঠে বলে ওঠল,

” আমি সবসময় বড় বড় দানই মেরে আসি। জন্মগত ইন্টেলিজেন্ট তো তাই।
মৃন্ময় শ্বাস ফেলে বলল,
“তা আপনার লাইসেন্স আছে?
নুসরাত কোনো বাক্য ছাড়াই ড্যাশবোর্ড থেকে লাইসেন্স বের করে মৃন্ময়ের সামনে তুলে ধরল। মৃন্ময় ভালো করে চোখ ডুবিয়ে দেখে নিল কাগজ পত্রগুলো। নুসরাত মৃন্ময়কে চোখ দাবিয়ে কাগজগুলো দেখতে দেখে বলল,”আপনার ব্যবহার দেখে মনে হচ্ছে না কোনো গাড়ির কাগজ দেখছেন, মনে হচ্ছে আপনার মরা দাদার সম্পত্তির খুঁটি নাটি খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখছেন।

“আমার মরার দাদার সম্পত্তির কাগজ ও আমি এত খুঁটিয়ে দেখব না মিসেস নুসরাত, যতটা এই কাগজ গুলো দেখেছি। বাই দ্যা ওয়ে এজন্য একটা থ্যাংক্স তো ডিজার্ভ করি।
নুসরাত এক ভ্রু উচিয়ে হাসল। মৃন্ময়ের হাত থেকে কাগজ পত্রগুলো নিয়ে ড্যাশবোর্ডে রেখে দিতে দিতে বলল,”আমি কাউকে থ্যাংক্সস বলিনা, কারণ অপাত্রে পানি ঢালা খুবই জঘন্য বিষয়, আর আমি তা ঘৃণা করি।
নুসরাত গাড়ি টান দিয়ে নিয়ে যেতে যাবে মৃন্ময় থামিয়ে দিল। নুসরাত মাথা উচিয়ে বাহিরে তাকাতেই মৃন্ময়, আহান আর ইরহামের দিকে ইশারা করে জানতে চাইল,” ওদের এমন বেঁধে রেখেছেন কেন?
নুসরাত ইশারা করল মৃন্ময়কে নিচের দিকে ঝুঁকে আসতে। মৃন্ময় একটু এগিয়ে আসতেই নুসরাত কানের কাছে ফিসফিসিয়ে বলে ওঠল,”এদের মাথা গিয়েছে পুরো, তাই সাইকোলজিস্টের কাছে যেতে চাইছিল না, তাই বেঁধে নিয়ে গিয়েছি।

মৃন্ময় ঠোঁট চেপে হেসে দিল। অন্ধকারে তা বোঝা গেল না। নুসরাতের শোনার মতো করে বলল,”আমার মনে হয় ওদের তুলনায় সাইকোলজিস্ট এর প্রয়োজন আপনার বেশি। সর্বপ্রথম আপনাকে ওখানে পাঠানো উচিত।
নুসরাত হাসল। গাড়ি ব্রেক চেপে গিয়ার D তে রাখল। ব্রেক ধীরে ধীরে ছেড়ে আস্তে আস্তে এক্সেলরেট্র এর চাপ দিল। গাড়ি মৃন্ময়ের পাশ কাটিয়ে যেতে যেতে হাওয়ার গতিতে তার কথা কানে নুসরাতের ভাসল,”আপনাকে আজ হাজতে চালান করার খুবই ইচ্ছে ছিল। মিস হয়ে গেল মিসেস নুসরাত নাছির!
নুসরাত সামান্য এগিয়ে চলতেই মৃন্ময় ইসরাতের গাড়ির কাছে গিয়ে গ্লাসে খটখট করল। আসলো শুভ্র, গোলাকার ঘেমে যাওয়া ইসরাতের মুখ। মৃন্ময় তুষারের দৃষ্টি কিছুক্ষণ থমকাল। পরমুহূর্তেই নিজেকে সামলে নিয়ে ইসরাতকে জিজ্ঞেস করল,”কেমন আছেন?

ইসরাত এক গাল ফুলিয়ে হাসল। খুবই ধীর ভঙ্গিমায় ড্যাশবোর্ড হতে লাইসেন্স এর কাগজ বের করে মৃন্ময়ের হাতে তুলে দিল। প্রশ্নের উত্তর হিসেবে দিল,”এতক্ষণ একদম ফ্রেশ ছিলাম,আপনার সাথে দেখা হওয়ার পর ফ্রেশ মনটাই আবারো ডিপ্রেশনে পড়ে গিয়েছে।
মৃন্ময় কাগজ পত্রগুলো ইসরাতের হাতে তুলে দিয়ে পেছনে টর্চ লাইট মারল। শুধাল,” এরা কারা?
ইসরাত ঠোঁটের কোণ উচিয়ে তাচ্ছিল্য সুরে বলে ওঠল,
“চোখ দিয়ে দেখছেন না, জীবন্ত লাশ এরা।
মৃন্ময় হেসে ইসরাতের দিকে তাকাল। জিজ্ঞেস করল,
” দু-বোনই কী অপমানে খুবই পারদর্শী, আই লাই ইট!

ইসরাত শান্ত চোখে মৃন্ময়ের দিকে চেয়ে গাড়ি স্টার্ট করল। বলল,”আপনার পছন্দে আর না পছন্দে আমাদের কোনো কিছুই যাবেও না আসবেও না! তাই পছন্দ করে লাভ নেই, ভাত পাবেন না।
মৃন্ময় ইসরাতকে গাড়ি স্টার্ট করতে না দিয়ে দাঁড় করালো। ভ্রু উচিয়ে স্পাইয়ের মতো জানতে চাইল,”লাস্ট কুয়েশ্চন মিসেস ইসরাত, কোথা থেকে ফিরছেন আপনারা?
ইসরাত হেসে ফেলল। ঠোঁট টিপে হাসি সংবরণ করে বলল,”মর্গ থেকে পেছনের দুটো জীবন্ত লাশ নিয়ে ফিরছি। এবার আমি যাই, আপনার প্রশ্নের উত্তর দেওয়া শেষ হলে।
ইসরাত গাড়ি স্টার্ট করে চলে গেল সামনে। দুটো গাড়ি কয়েক সেকেন্ডের ভেতর অদৃশ্য হয়ে গেল অন্ধকারে। মৃন্ময় নিজের জিপে উঠে বসে নিজের সাথে থাকা হাবিলদারকে বলল,”ফলো করো ওদের।

তারা যতক্ষণে পৌঁছাল গিয়ে ওদের সংস্পর্শে ততক্ষণে অনেক দেরি হয়ে গিয়েছে। অভার স্প্রিডের কারণে একটা গাড়ি ল্যাম্পপোস্টের সাথে লেগে পুরো ড্যামেজ হয়ে পড়ে আছে ওই স্পটে। পেছনের কালো গাড়ি থেকে তিনজন মেয়ে উদভ্রান্তের মতো দৌড়ে দিয়ে বের হতে দেখা গেল। একটা মেয়ে তো গাড়ি পর্যন্ত যাওয়ার আগে হাউমাউ করে কেঁদে ফেলল। ল্যাম্পপোস্টে গাড়ি ধাক্কা খাওয়ায় তা নাজুক হয়ে ছিল। ধীরে ধীরে ভেঙে পড়ে যেতে নিল কাঁদতে থাকা মেয়েটার উপর তখনই মৃন্ময় টেনে সরিয়ে আনলো তাকে সেখান থেকে। শব্দ করে ল্যাম্পপোস্ট ভেঙে পড়ল রাস্তার মাঝ বরাবর। যেখানে বল প্রয়োগ বেশি হলো মসৃণ রাস্তার সেখান থেকে পাথর উঠে ভেঙে গুড়িয়ে গেল। মৃন্ময় যথা সম্ভব পা চালিয়ে এগিয়ে গেল গাড়ির কাছে। টেনে দরজা খোলার চেষ্টা করল।

অন্ধকারে ভেতরের অবস্থা কোনো কিছুই বোঝা গেল না। নৈঃশব্দে সামনে চোখ ফেলতেই দেখল গ্লাস ভেঙে গিয়েছে। মৃন্ময় পাথর তুলে আঘাত করল ফ্রন্ট সিটে পাশের গ্লাসে। পাথরের আঘাতে কাচ শব্দ করে ভেঙে নিচে পড়ে গেল। টর্চ পকেট থেকে বের করে জ্বালাতেই সর্বপ্রথম চোখ পড়ল উপরের দিকে তুলে রাখা বনেটের দিকে। তখনই পেছন থেকে কেঁদে একাকার হয়ে যাওয়া ইসরাত দৌড়ে দৌড়ে এগিয়ে আসলো এদিকেই। মৃন্ময় সবল হাতে দরজা টেনে খুলতে ব্যর্থ হলো। টর্চ লাইট আবারো ইঞ্চিন বক্সের দিকে মারল সে,পরপর সেই স্থান পরিত্যাগ করে উল্টো পথে ফিরে গেল দ্রুতপায়ে। পাগলের মতো চিৎকার করা ইসরাতকে দু-হাতে ঝাপটে ধরে আটকাল গাড়ি হতে পাঁচ ফিট দূরে । ইসরাত নিজের বাহু মৃন্ময়ের হাত থেকে ছাড়িয়ে নিতে নিতে চিৎকার করে বলল,”আল্লাহর দোহাই লাগে আমার ভাই বোন গাড়ির ভেতর, আমাকে ছাড়ুন আপনি, ওদের বাঁচাতে হবে। মৃন্ময় তুষার ছাড়ুন আমার হাত, আমার বোনটা ভেতরে, আমার ভাই দুটো ভেতরে।

মমো বাচ্চাদের মতো কাঁদছে মাটিতে বসে। সামনে এগিয়ে গিয়ে যে গাড়ি থেকে ওদের বের করবে সেই সামর্থ নেই তার। হাত পা থেকে শুরু করে পুরো শরীর কেঁপে প্যানিক অ্যাটাক করে বসল। সৌরভি নিজেকে সামলে নিয়ে পা বাড়াল সামনে। ধুরু ধুরু বুকে আল্লাহ, আল্লাহ করে এক পা দু-পা গেল। ইসরাত তখনো আর্তনাদ করছে,”ওরা কেউ আমায় ক্ষমা করবে না, আমি আম্মাকে কী জবাব দিব, আমি আব্বাকে কী জবাব দিব, আমি চাচ্চুকে কী জবাব দেব, ছোট আম্মুকে কী জবাব দিব। আল্লাহর ওয়াস্তে আমাকে ছেড়ে দিন, এমন সারাজীবন ধুকে ধুকে মরার চেয়ে ভালো ওদের সাথে আমি ও মরে যাব। ছেড়ে দিন মৃন্ময়, আমায় ছাড়ুন। আল্লাহর দোহাই লাগেএএএ..! আমি কেমন করে আয়নায় মুখ দেখব! আমার মা বাবাকে আমি মুখ দেখাব কী করে! ওদের কথা জিজ্ঞেস করলে আমি কী উত্তর দিব? ওরা কোথায়!

মৃন্ময় ইসরাতের বাহু ছাড়ল না। ইসরাত গা ছেড়ে দিল। সৌরভি গাড়ি হতে দু-ফুট দূরত্বে আসতেই শব্দ করে ইঞ্চিন ফেটে গিয়ে দাউদাউ করে আগুন ধরে বসল। সেই সাথে শোনা গেল ইসরাতের, সৌরভির, মমোর কাঁদার আর আত্মচিৎকারের আওয়াজ। সৌরভি দু-পা ছাড়িয়ে বসে পড়ল কংক্রিটের রাস্তায়। বাচ্চাদের মতো আহাজারি করল। বলল,”ইয়া আল্লাহ, আমি হাশরের ময়দানে তোমার কাছে কী ভাবে জবাব দেব, আমার তৈওফিক থাকা সত্ত্বেও কেন আমি ওদের বাঁচাইনি। আমাকে মাফ করে দিও আল্লাহ আমি ওদের বাঁচাতে পারিনি।

ইসরাত মৃন্ময়ের থেকে নিজের গা ছাড়িয়ে নিয়ে আসলো। পাগলের মতো আহাজারি করে সামনে এগোলো, আর বিড়বিড় করল,”ইয়া আল্লাহ ওরা আমাকে ক্ষমা করবে না। আমার একটামাত্র বোন, তুমি কেড়ে নিলে আল্লাহ। আমরা কী নিয়ে বাঁচব! আমার ভাইগুলোকে কেন কেড়ে নিলে আল্লাহ! আল্লাহ, ওদের একা তোমার কাছে ডেকে নিলে আমাকে নিতে পারলে না তুমি! আমার ভুল, আমার ভুল ছিল, ওদের নিয়ে এত রাতে বের হওয়ার জন্য দোষী আমি। আমি ওদের দোষী! আমি আজ না বের হলে, নুসরাতের পাগলামিতে শামিল না হলে এটা হতো না। আমার ভুল, আমার ভুল ছিল এটা।

ইসরাত দু-হাতে নিজের মুখ স্পর্শ করে চিৎকার করে উঠল। বলল,”ইয়া আল্লাহ কেড়ে নিলে কেন তুমি, দিলে যখন কেড়ে নিলে কেন! আমি কেমন করে মুখ দেখাব আমার মা বাবাকে!
দাউদাউ করে জ্বলে যেতে লাগল আগুনের তাপে গাড়ির অংশ। ধীরে ধীরে তা জ্বলে পুড়ে রাখ হয়ে পড়ে গেল ধসে ধসে। ইসরাত তখনো চিৎকার করে কাঁদছে। নাক মুখ প্রায় ফুলিয়ে ফেলেছে।মৃন্ময় একপাশে অপরাধী ভঙ্গিতে মুখ বানিয়ে দাঁড়িয়ে। ইসরাতের আহাজারিতে পুরুষালি মনে কষ্টের সঞ্চার হলো। মমো নিজের গা ছেড়ে দিল নির্জন, বিরান এই রাস্তার মধ্যে। অতিরিক্ত টেনশনে বুকে চাপ অনুভূত হলো। এক হাতে চেপে ধরল বুকের ধুকপুক করতে থাকা বাঁ-পাশ। চিনচিনে ব্যথা বুক থেকে শুরু করে পুরো পিঠ পর্যন্ত ছেয়ে গেল। চোখ বন্ধ করার আগে চোখে ভাসল বৃষ্টির ফোটা নামছে আকাশ হতে জমিনে। গর্জন করে কাঁপিয়ে, বিদুৎ চমকে কোনো আগাম বার্তা ছাড়াই ভারী বর্ষণের শুরু হলো। বাতাসের তীব্রতা আর বর্ষণের ঝংকারে দাউ দাউ করে জ্বলতে থাকা গাড়ির লেলিহান শিখা নিভে এলো প্রায়।। নিভু নিভু আগুন গাড়ি হতে মিটে যেতে যেতে চারিদিক থেকে ভেসে আসলো ফজরের আজানের ধ্বনি। মিষ্টি সুরেলা সুরে মুয়াজ্জিন মাইকে বলছেন,

“আল্লাহু আকবার, আল্লাহু আকবার, আল্লাহু আকবার, আল্লাহু আকবার
আশহাদু আল্লা ইলা-হা ইল্লাল্লাহ
আশহাদু আল্লা ইলা-হা ইল্লাল্লাহ
আশহাদু আন্না মুহাম্মাদার রাসূলুল্লাহ
আশহাদু আন্না মুহাম্মাদার রাসূলুল্লাহ
হাইয়া ‘আলাস সালাহ
হাইয়া ‘আলাস সালাহ
হাইয়া ‘আলাল ফালাহ
হাইয়া ‘আলাল ফালাহ
আস-সালাতু খাইরুম মিনান নাউম
আস-সালাতু খাইরুম মিনান নাউম
আল্লাহু আকবার, আল্লাহু আকবার
লা ইলা-হা ইল্লাল্লাহ।

প্রিয় প্রণয়িনী ২ পর্ব ৩৩

আজানের ধ্বনির শেষ হওয়ার সাথে সাথে আগুন ও নিভে গেল বৃষ্টির পানিতে। ইসরাতে আর্তনাদ আজানের জন্য থেমে গেলে ও তা আবার বাড়ল সময়ের সাথে। ঝুমঝুম বর্ষণের সুরের সাথে মিলিয়ে কাঁদল সে। ভোরের টিমটিমে আলো ফুটে আসলো, তবুও ইসরাত, মমো, সৌরভি এই ঝড়ো হাওয়া আর বর্ষণের মধ্যে রাস্তায় পড়ে রইল নিস্তেজ দেহ নিয়ে। সৈয়দ বাড়ির উচ্ছল, সবসময় লাফালাফি করা, মাতিয়ে রাখা মানুষগুলোর হারিয়ে যাওয়ায় ইসরাতের সাথে হয়তো প্রকৃতিতে ও কষ্ট নেমেছে। একদিকে প্রকৃতি নিজের মনোরমতায় ভেজাল পৃথিবী অন্যদিকে তিন রমনীর গুমোট কান্নায় ভেজল পিচ্ছল,পিচের তৈরি কালো ইট পাথরের রাস্তা।

প্রিয় প্রণয়িনী ২ পর্ব ৩৫

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here