প্রিয় প্রণয়িনী ২ পর্ব ৩৫
জান্নাত নুসরাত
রাতের তৃতীয় প্রহরে হঠাৎ নাছির মঞ্জিলে এসেছেন সৈয়দ বাড়ির কর্তীরা। সকলেই সুন্দর সাজগোজ করেছেন এ বাড়ি থেকে ওই বাড়িতে আসার পথে। সকল মেহমানদের সাথে কথা বলা শেষে যখন এসে কিচেনে হাজির হলেন তখন দেখলেন একা হাতে সবকিছু সামলাতে হিমশিম খাচ্ছেন নাজমিন বেগম। বাড়ির অর্ধেকের বেশি মানুষ ঘুমিয়ে পড়েছে। নাজমিন বেগম একদিকে রুটি বেলছেন অন্যহাতে রান্না করছেন। কোনোদিকে তাকানোর সময়টুকু নেই যেন তার। লিপি বেগম কাপড়ের হাতা গুটিয়ে নিলেন। সামনে এগিয়ে যেতে যেতে কিছুটা নারাজি স্বরে বললেন,”কী হয়েছে তোর মেঝো?
নাজমিন বেগম আকস্মিক লিপি বেগমের গলার শব্দে লাফিয়ে উঠলেন প্রায়। পরপর নিজেকে সামলে নিয়ে সালাম ঠুকলেন মিহি সুরে। লিপি বেগম দু-হাত মেলে দিলেন। নাজমিন বেগম দ্রুত হাতে চুলোর আগুন কমিয়ে দিয়ে ঘামাক্ত শরীর নিয়ে জড়িয়ে ধরলেন বড় বোন সমান ভাবীকে। অনেকদিন পর দেখা হওয়ায় ওই অবস্থায় থেকে হেসে ফেললেন দু-জনে। ঝর্ণা বেগম পেছন থেকে উঁকি মেরে বললেন,”দু-জন বেয়ান হয়ে আমাকে আর রুহিনীকে ভুলে গেছো? দেট’স নট ফেয়ার।
রুহিনী নিজেও ঝর্ণা বেগমের পেছন থেকে বেরিয়ে আসলেন। লিপি বেগম কিছুটা নিজেদের মধ্যে দূরত্ব তৈরি করে নিজেদের মাঝখানে জায়গা বের করে দিলেন দু-জনকে। রুহিনী প্রায় লাফিয়ে উঠে মাঝখানে জায়গা করে নিলেন। ঝর্ণা বেগম শব্দ করে হেসে ফেললেন। ভদ্রমহিলাদের মধ্যে এমন করে চলল অনেক সময় মিলনমেলা। হঠাৎ নাকে আসলো পোড়া গন্ধ৷ নাজমিন বেগম নিজেকে ছাড়িয়ে এনে দৌড়ে গিয়ে তরকারিতে পানি ঢাললেন। মুখ দিয়ে বিরক্তি মিশ্রিত শব্দ বের হলো,”যাহ শেষ..!
লিপি বেগম জানতে চাইলেন,
আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন
“একা হাতে সব সামলাচ্ছিস, কাউকে রাখলি না কেন?
নাজমিন বেগম তরকারিতে হাত চালাতে চালাতে বললেন,” ওদের কাজ পছন্দ হয় না আমার।
রুহিনী জিজ্ঞেস করলেন,
“তাহলে আমাদের কেন জানালে না মেঝো আপা? আমাদের মধ্যে কেউ একজন চলে আসতো তোমার সাহায্যের জন্য।
নাজমিন বেগম শুধু হাসলেন সামান্য। ঝর্ণা বেগম বললেন,” ওসব কথা ছাড়ো, মহামান্য ব্যক্তিরা কোথায়?
নাজমিন বেগমের টনক নড়ল এতেই। রুহিনীকে উদ্দেশ্য করে কিছুটা তাড়া মিশ্রিত কন্ঠে বললেন,”আমার মোবাইলটা দেখ ফ্রিজের উপর, একটু দে তো ছোট।
লিপি বেগম তখনো রুটি বেলছেন। ঝর্ণা বেগম দাঁড়ানো না থেকে নাজমিন বেগমের হাতে হাত কাজ এগিয়ে দিতে সিঙ্কে রাখা বাটিগুলো ধুয়ে রাখতে শুরু করলেন। এর মধ্যেই রুহিনী মোবাইল এনে হাতে ধরিয়ে দিলেন নাজমিন বেগমের। নাজমিন বেগম তরকারির ডেকচিতে ঢাকনা দিয়ে প্রথমে ডায়াল করলেন ইসরাতের নাম্বারে। রিং হলো হতে হতে তা কেটে গেল। রুহিনী চোখ ফেড়ে শুধালেন,”কল ধরেছে?
নাজমিন বেগম দু-পাশে মাথা নাড়ালেন। চিন্তিত সুরে বললেন,”ইসরাত এমন করে না, প্রথম কলই পিক করে মেয়েটা যতই ব্যস্ত হোক না কেন!
আবারো কল করলেন আবারো তা বাজতে বাজতে কেটে গেল। একে একে সবাইকে কল দিলেন কেউই ফোন ধরল না। ঝর্ণা বেগম জিজ্ঞেস করলেন,”কোথায় গিয়েছে ওরা সবাই?
নাজমিন বেগম লাগাতার কল মিলিয়ে যেতে যেতে অস্পষ্ট সুরে বললেন,”বলল বাহিরে হাঁটতে যাচ্ছে।
রুহিনী বেগম কপালে ভাঁজ ফেলে জিজ্ঞেস করলেন,
“কে বলেছিল এই কথা?
নাজমিন বেগম সামান্য চোখ তুলে রুহিনী বেগমের দিকে চেয়ে বললেন,” ইসরাত বলেছিল, ওইগুলা বললে জীবনেও যেতে দিতাম না।।
লিপি বেগম এমনি জিজ্ঞেস করলেন,
“গ্যারেজে গাড়ি আছে?
নাজমিন বেগম না ভঙ্গিতে মাথা নাড়ালেন তিনি জানেন না বলে। রুহিনী তরকারিতে পানি দিয়ে চুলোর আচ একদম কমিয়ে দিলেন। বললেন,” আসো দেখে আসি।
চিন্তায় চিন্তায় নাজমিন বেগমের মাথা খারাপ হয়ে যাচ্ছে। একহাতে কপাল মুছে নিয়ে ড্রয়িং রুমে আসতেই টিভিতে জোরে জোরে বাজতে দেখলেন গতকাল রাত দশটা এর সময় অভার স্প্রিডের কারণে গাড়ি দূর্ঘটনা হয়েছে। দূর্ঘটনা এর কারণে গাড়িতে থাকা তিনজনের মৃত্যু। শরীর জ্বলে পুড়ে ছাই হয়ে গিয়েছে, তিনজনের কাউকে চিনার উপায় নেই, কার আইডেন্টিটি কী!
এটা দেখার পর নাজমিন বেগমের স্বাভাবিক অবস্থা আরো বেশি নাজুক হয়ে উঠল। রান্না ঘরে থেকে ঘেমে যাওয়া শরীর আরো বেশি ঘেমে গেল তরতর করে। সেখানে আর না দাঁড়িয়ে থেকে সদর দরজার দিকে প্রায় দৌড়ালেন তিনি। নাজমিন বেগমের কাহিল অবস্থা দেখে রুহিনী বেগম, আর ঝর্ণা বেগমের বুক কাঁপতে শুরু করল। দু-জনেই ছুটলেন নাজমিন বেগমের পিছু পিছু। গ্যারেজের সামনে এসেই দেখলেন সাটার খোলা। দুটো গাড়ির একটার ও অস্তিত্ব নেই। শুধু নাছির সাহেব সেদিন যে বাইক কিনে এনে ছিলেন তা পড়ে আছে একপাশে অবহেলিত ভঙ্গিতে। বাড়ির বাহিরের কৃত্রিম আলো ছাড়া প্রতিটা রুমের আলো নিভে গেছে প্রায়।
হাতের মুঠোয় থাকা ফোনটায় ইসরাতের নাম্বার কাঁপা হাতে ডায়াল করে আবারো কানে ফোনটা ধরলেন নাজমিন বেগম্মনে হলো এই ধরবে ইসরাত ফোনটা কিন্তু এবার ও সেম হলো, বাজতে বাজতে এক সময় কেটে গেল। নাজমিন বেগমের অতিরিক্ত চিন্তার কারণে কাপড়ের অভ্যন্তরে থাকা শক্ত সামর্থ শরীরটা থরথর করে কাঁপল। ইসরাতের নাম্বারে আবারো কল মিলালে সেটা রিং হতে হতে কেটে গেল। লিপি বেগম নাজমিন বেগমকে বললেন,”এমন করিস না, হয়তো মোবাইল হাতে নেই, কোথাও ফেলে রেখেছে!
নাজমিন বেগম এই কথায় সহজেই অমত পোষণ করলেন। বললেন,“ইসরাত মোবাইল সবসময় সাথে রাখে বাহিরে গেলে।
রুহিনী বেগম ইরহামের মোবাইলে ফোন দিলেন, কিন্তু ওপাশ থেকে একটা শব্দ বারবার ভেসে আসলো, আপনি যে নাম্বারে কল করেছেন তা এখন বন্ধ আছে, দয়া করে কিছুক্ষণ পর আবারো সংযোগ করুন।
লিপি বেগম সান্ত্বনা দিতে আবারো বললেন,
“হয়তো সাউন্ড অফ!
নাজমিন বেগম তবুও মানতে নারাজ। নিজের জায়গায় মোবাইল হাতে অটল দাঁড়িয়ে থাকতে বেগ পোহাতে হচ্ছে তার। কাঁপা কন্ঠে বললেন,”আমার ইসরাতটা কখনো মোবাইলের সাউন্ড অফ করে না আপা। নির্ঘাত কিছু হয়েছে।
নাজমিন বেগম হয়তো আর দাঁড়িয়ে থাকতে পারলেন না, দু-পা ছড়িয়ে বসে গেলেন কংক্রিটের তৈরি পিচঢালা গ্যারেজের সামনে। রুহিনী বেগম প্রায় কেঁদে ফেলবেন এমন মুখ। লিপি বেগম কোনো রাস্তা না পেয়ে কল দিলেন জায়িনের নাম্বারে। ওপাশ থেকে জায়িনের স্বর ভেসে আসতেই লিপি বেগম বললেন,”একটু তোর মেঝো বাবার বাড়িতে আয়।
জায়িন বিছানা থেকে উঠে দাঁড়িয়ে, পায়ে জুতো জোড়া আলগোছে ঢুকিয়ে শুধাল,”কেন?
লিপি বেগম কিছুটা বিরক্তি প্রকাশ করে বললেন,
“আসো তো, আসলে তবেই তো দেখতে পাবে।।
ফোন কাটতেই দেখলেন পরিস্থিতি প্রায় বিগড়ে গেছে। নাজমিন বেগম মাথায় হাত রেখে হাউমাউ করে কাঁদছেন। রুহিনী আমার আহান, আমার ইরহাম বলে গলা ফাটাচ্ছেন। ঝর্ণা বেগমের শুভ্র মুখ লাল হয়ে আছে। এক্ষুণি একটু লাই পেলে বাচ্চাদের মতো ঠোঁট ভেঙে কেঁদে ফেলবেন। লিপি বেগমের গলার কাছে কান্না পাঁকাল তবুও নিজেকে সামলালেন তিনি। চোখের পানি কোটর থেকে নির্গত হওয়ার পূর্বেই মুছে ফেললেন কাপড়ের হাতায়। এখন যদি উনি ও এদের মতো কাঁদতে বসে যান তাহলে কী কোনো সমাধান হবে! চোয়াল শক্ত করে ভঙুর গলায় সবাইকে ধমকে উঠলেন,”হচ্ছেটা কী?
নাজমিন বেগম এসব কানেই তুললেন না। আরো জোরে কেঁদে উঠলেন। রুহিনী বেগমের গলার আওয়াজ বাড়ছে সময়ের সাথে। বাকি ছিলেন ঝর্ণা বেগম তিনি ও ভ্যা করে কেঁদে ফেললেন। মুখ দিয়ে উচ্চারণ করলেন,”আমার বাচ্চাগুলো, কোথায় গেলি রে তোরা?
টিমটিমে ভোরের আলো ফুটেছে আকাশে। ধীরে ধীরে সূচনা হচ্ছে নতুন দিনের, নতুন এক গল্পের। ইসরাত এখনো রাস্তায় লেপ্টে আছে। কাঁদছে বিরতিহীন। এখান থেকে উঠে বাড়িতে যাবে সেই ধ্যান নেই তার ভেতর। চোখ দুটো ফুলে উঠে লাল লাল হয়ে আছে। পিচঢালা রাস্তার দিকে নিস্তব্ধ চোখে, পাপড়ি না ফেলে চেয়ে আছে। কান্নার গতি থেমে গিয়ে হেচকি উঠল। ভেতরে ভেতরে জমা হলো ক্ষোভ। দাঁতের মাড়ি চেপে অনেকক্ষণ চেয়ে রইল এক দৃষ্টিতে। নড়ল না নিজের জায়গা থেকে। চোখের চাহনি এতটাই তেজালো যে, পাপড়ি ফেলল না। ওভাবে বসে থেকে হাতের মুঠো শক্ত করল। ধীরে ধীরে রাগের পাহাড় এসে গ্রাস করল তাকে। নিজের বাস্তব জ্ঞান হারিয়ে দু-হাতে মুখ চেপে ধরে গলা ফাটিয়ে চিৎকার করে উঠল। চিৎকারের তীক্ষ্ণতা এত বেশি যে কান লেগে গেল মৃন্ময়ের। কিছু বুঝে উঠার আগেই ইসরাত নিজের জায়গা থেকে উঠে দাঁড়াল।
বৃষ্টিতে ভেজা চুলগুলো দলা পাঁকিয়ে পেছনে পড়ে আছে৷ কপালে, গালে,এমনকি চোখের উপর ছোট ছোট চুলগুলো লেপ্টে৷ ধুপধাপ পায়ে নিজের অক্ষত থাকা গাড়ির কাছে গেল। মৃন্ময় চোখ ছোট ছোট শুধু দেখল ইসরাতের কান্ড। কান্নার কারণে মুখ ফুলে গিয়েছে। চোখের চামড়া কিছুটা দু-দিকে সরে যাওয়ায় চোখের সাদা জায়গার মধ্যে জমা হওয়া রক্তের আস্তরণ দেখা গেল।। ইসরাত গাড়ির ডিক্কি টেনে খুলে ফেলল। মৃন্ময় আরেকটু সামনের দিকে এগোতেই দেখল ইসরাত হকিস্টিক হাতে নিচ্ছে। উঁকি দিয়ে গাড়ির ডিক্কির পানে চাইতেই দেখল উল্টাপাল্টা জিনিস রাখা ওখানে। বটি থেকে শুরু করে সবকিছু।
ইসরাত গাড়ির ডিক্কি খোলা রেখে প্রথমে এগিয়ে গেল জ্বলে যাওয়া গাড়ির দিকে। হকিস্টিক শক্ত করে মুঠোয় চেপে ধরে একের পর এক লাগাতার আঘাত হানল বনেটের উপর। রাগ এতে কমল না আরো বাড়ল। সময়ের সাথে দ্বিগুণ থেকে তিনগুণে পৌঁছে গেল। কিছু মুহুর্ত অতিবাহিত হতেই ইসরাতের বড় বড় চোখের দৃষ্টি মৃন্ময়ের দিকে ঘুরে গেল। হকিস্টিক ধরে রাখা হাত ক্ষোভের দংশনে শক্ততা আরো বাড়ল৷ চোখে ভাসল তাকে ধরে রাখার মুহুর্ত টুকু। ক্ষুব্ধ ষাঁড়ের মতো চেয়ে থেকে তেড়ে গেল মৃন্ময়ের দিকে। হাবিলদার এতক্ষণ হাপিত্যেশ করছিলেন ভবিষ্যতের জেনারেশন এভাবে ঝড়ে গেল, যখন চোখ তুলে দেখলেন ইসরাতকে তেড়ে আসছে তখন আঁতকে উঠে জআনতে চাইলেন,”স্যার ভদ্রমহিলা কোনদিকে যাচ্ছেন?
মৃন্ময় নিজের জায়গায় অটল টানটান দাঁড়িয়ে থেকে বলল,”মনে হচ্ছে তো আমাদের দিকে।
হাবিলদার সামান্য হেসে বললেন,
“আমাদের দিকে না স্যার, শুধু আপনার দিকে এগিয়ে আসছেন ভদ্র মহিলা।
মৃন্ময় নিজের শূন্য মস্তিষ্কে, পালানোর কথা প্রায় ভুলে গিয়ে হাবিলদারকে জিজ্ঞেস করল,”এখন আমার কী করা উচিত, বলুন তো?
হাবিলদার সামান্য ধমকে উঠে বললেন,
“গরুর মতো দাঁড়িয়ে ঘাস না কেটে, ভাগুন স্যার, ভাগুন..! ভদ্রমহিলা আপনার দিকে খেপা ষাঁড়ের মতো তেড়ে আসছেন। যেকোনো সময় গুতো টুতো মেরে দিতে পারেন।
ইসরাতকে নিজের সামনে এসে থামতে দেখেই মৃন্ময় উড়ন্ত পাখির মতো লাফ দিয়ে দৌড় দিল। ইসরাত নিজেও পিছু পিছু ছুটল। মানুষিক ভারসাম্যহীন মানুষের মতো ভাঙা গলা ফেড়ে চিৎকার করল,”খুন করব আজ সবগুলোকে।
মৃন্ময় সামনের দিকে চলন্ত পা রেখে ঘাড় ঘুরিয়ে ইসরাতের পানে চেয়ে জানতে চাইল,”আপনি কী পাগল হয়ে গিয়েছেন ইসরাত? এমন করছেন কেন?
ইসরাত কানেই নিল না এসব কথা। মন্ত্রমুগ্ধের মতো হাতের হকিস্টিক উপরে তুলে মৃন্ময়ের দিকে ছুটতেই থাকল। মস্তিষ্ক থেকে একটাই শব্দ প্রতিধ্বনি হলো,”এই লোক তোকে না থামালে আজ তোর ভাই-বোন অক্ষত থাকতো। বেঁচে থাকতো ছোট ছোট প্রাণগুলো..!
ইসরাত এভাবে দৌড়ানো অবস্থায় হ্যালুসেনেশন করল নুসরাত, ইরহাম, আহান আসছে তার দিকে। সে তাদের দু-হাতে জড়িয়ে ধরতে নিবে তার পূর্বেই কেউ একজন পেছন থেকে তাকে টেনে ধরল। সে আর কেউ নয়, মৃন্ময় তুষার! ইসরাত দু-দিকে মাথা নাড়াল, নিজের মস্তিষ্ককে না হওয়া জিনিসগুলো কল্পনা করতে দিল না। রাগে থরথর করে কাঁপল মেয়েলি দেহটা,সাথে নাক, আর ঠোঁট। পায়ের গতি বাড়ল আরো, যে কেউ দেখলে বলবে শরীরটা বাতাসে প্রায় উড়ছে। মৃন্ময় তিন রাস্তার মুখে গোল গোল ঘুরতে ঘুরতে হাপিয়ে উঠল, তবুও ইসরাতের হাপানোর নাম নেই। মৃন্ময় জিরোনার জন্য থমকে দাঁড়াতেই হাবিলদারের করুণ আওয়াজ বাতাসে ভেসে আসলো,”স্যার আপনি আইজ শেষ..!
ইসরাতের শূণ্যে তোলা হকিস্টিক এসে মৃন্ময়ের মাথা স্পর্শ করতে যাবে তখনই মৃদু সুরে গান ভেসে আসলো দূর হতে,”বাংলা মাল ছেড়ে হাতে মুরগী নিয়াছি,
বৈরাগ হইয়া কপালে তিলক লাগাইছি
হাঁসের পিছন ছাইড়া দিয়া মুরগী চোর হইয়াছি
পূর্ণের জন্য একগ্লাস জ্বলে ডুব দিয়াছি
সবকিছু ছাইড়া আমি মুরগী চোর হইয়াছি……
মুরগীর পেছনে আগুন লাগাইছি
ও মুরগীকে দুনিয়া থেকে বিদায় জানাইছি
মুরগীর লেগ খেয়েছি
ও মুরগীর পেছনে আগুন লাগাইছি,
ও মুরগীরে বিদায় জানাইছি।
ইসরাত থমকানো চোখে ফিরে চাইল পেছনে। বিস্ময়ে চোখের কোটর হতে আখিঁদ্বয় বের হবে এমনভাব। ঘন বনের অভ্যন্তর হতে নেচে কুদে কাদায় মাখামাখি শরীর নিয়ে বেরিয়ে আসতে দেখা গেল তিনজনকে। মুখে ও ছাড় নেই কাদার। মুখ দেখে চেনার উপায় নেই কারা এরা। গায়ে ওড়না জড়ানো একজনের। সাদা রঙের কাপড়খানা লেগে আছে গায়ের সাথে। ইরহামের গায়ে শুধু সেন্ডো গেঞ্জি জড়ানো। কালো লুমশ ফর্সা পুরুষালি বুক বেরিয়ে এসেছে। ইসরাত সামান্য চোখ খিঁচিয়ে তাকাতেই দেখল তিনটার হাতেই দুটো দুটো করে মুরগী। এমন করে কোলে ধরে রেখেছে যেন নবজাতক বাচ্চা এগুলো। নিজেদের বাহু থেকে একজন ও ছাড়ছে না। ইসরাতের হাত অবশ হয়ে আসলো। এক পা দু পা করে এগিয়ে গেল ভাই বোনের দিকে।
নিজের চোখদুটোকে যেন বিশ্বাস করতে পারছে না সে। খুশিতে চোখ চকচক করে উঠল। পানিতে টইটম্বুর করল দু নয়নে। নিজের খুশি জাহির করতে পারল না। ঠোঁট ঠেলে বের হলো না কোনো শব্দ। শুধু হা করে সামনে চেয়ে দেখল নিজের ভাই বোনকে। মনে হলো যুগ যুগ কেটে গিয়েছে, প্রিয় মুখগুলো দেখেনি। তিনটার গলার আওয়াজ এগিয়ে আসতে আসতে আরো বাড়ল। তখনো তারা সামনে পড়ে থাকা পোড়া গাড়ি, অর্ধজ্ঞান হওয়া সৌরভি, প্যানিক অ্যাটাকে নাজেহাল অবস্থা হওয়া মমোকে দেখেনি। যখন দেখল গাড়ি পুড়ে পড়ে আছে, তখন এতক্ষণের উচ্ছাস মিশ্রিত কন্ঠে ধীমি হয়ে আসলো। তিনজনে মুখ চাওয়া চাওয়ি করল নিজেদের। একবার দেখল থমকে দাঁড়ানো ইসরাতকে, একবার দেখল পুড়ে যাওয়া গাড়ির শেষাংশ, ঠোঁট ঠেলে শব্দ বের হলো নুসরাতের,”শালী তুই মরা মানুষের মতো দাঁড়িয়ে আছিস কেন?
মুরগীগুলো তখনো আল্লাহর নামে ডাকছে চিৎকার করে। হাত দিয়ে সেগুলো আরো শক্ত করে ধরে নুসরাত ইসরাতকে আবারো জিজ্ঞেস করল,”তুই এমন হা করে দাঁড়িয়ে আছিস কেন?
ইসরাত কথা বলল না। কয়েক মুহুর্ত মুরগী হাতে দাঁড়িয়ে থাকা তিন ভাই বোনকে দেখল। নিঃশব্দে পাড় হলো কয়েক মিনিট, কয়েক সেকেন্ড,কয়েক মুহুর্ত। নিজেকে সামলানো ইসরাতের নিকট দায় হলো। অতি আবেগে বার বার কথা আটকাল গলার কাছে৷ নুসরাত, ইরহাম, আহান পরিবেশ দেখে কিছুটা ঠাওর করতে পারল কী হয়েছে। তাই নুসরাত হা হা করে হেসে পরিস্থিতি স্বাভাবিক করতে বলে ওঠল,”তুই কেঁদেছিস? আরে শালী মরি নাই তো, এতো কাঁদার কী আছে?
ইসরাতের এসব কথায় গা পিত্তি জ্বালিয়ে দিল। এমন এক মুহুর্তে এসে পাগলের মতো হাসানোর চেষ্টা করছে। ইরহাম নিজেও ইসরাতকে স্বাভাবিক করার জন্য বলল,”আমরা তো মনে করেছি তুমি বাসায় চলে গিয়েছ।
আহান অপরাধ বোধ করল।তাই ফিকে হয়ে যাওয়া ধীমি সুরে বলল,”আমরা জানতাম না, গাড়িতে আগুন লেগে যাবে।
তিনজন মুরগী কোলে রেখে মাথা নাড়াল উপর নিচ। ইসরাত একটা কথার উত্তর দিল না। নিজের ফোলা ফোলা চোখগুলো ঘুরিয়ে কড়মড়িয়ে শুধাল,”কোথায় গিয়েছিলি তোরা?
নুসরাত আর ইরহাম একসাথে বলে ওঠল,
“মুরগী চুরি করতে।
ইসরাত গলা ফাটিয়ে গালি দিল,
“ শুয়োরের বাচ্চা, আমি এখানে তোদের জন্য মরতে বসেছি আর তোমরা কুত্তার বাচ্চারা মুরগী চুরি করতে গিয়েছিস। আজ সবগুলোর পা ভাঙব, কত বড় সাহস!
নুসরাত ইসরাতের কন্ডিশন দেখে মুরগী শক্ত হাতে চেপে ধরে উলটো পথে দৌড় দিল। তার মতামতে জান গেলে যাবে, তবুও মুরগী ছাড়া যাবে না। ইরহাম অবাক কন্ঠে জিজ্ঞেস করল,”পালাচ্ছিস কেন?
নুসরাত ইসরাতের থেকে দশহাত দূরে গিয়ে বলে ওঠল,”জরুরী প্রয়োজনে, জরুরী ব্যবস্থা নিচ্ছি পূর্ব থেকে। ইসরাতের মাথা গিয়েছে!
ইসরাত নুসরাতের কথা অনুযায়ী সত্যি সত্যি আহান আর ইরহামকে পিটানোর জন্য খেপাটে নয়নে চেয়ে এগিয়ে গেল। ইরহাম আর আহান নুসরাতের দিকে দৌড় দিয়ে চলে গেল। নুসরাত নিষেধাজ্ঞা জারী করল,”একদম এদিকে আসবি না দু-জন।
দু-জনেই নুসরাতের কথা মাছি তাড়ানোর ভঙ্গিতে উড়িয়ে দিয়ে, নুসরাতের দিকে যেতে যেতে আওড়াল,”সব দোষ তোর। তুই ই তো এই মেয়েকে রাগিয়েছিস! তুই না বললে তো জীবনেও আমরা মুরগী চুরি করতে যেতাম না।
ইসরাত একটার কথা কানে না তুলে হকিস্টিক ছুঁড়ে মারল। ওকটুর জন্য নুসরাতের মাথায় না লেগে পাশ দিয়ে শা করে চলে গেল। তা অক্ষত রাখা গাড়ির গ্লাসে লেগে শব্দ করে ভেঙে চুড়ে চুরমার হয়ে পড়ে গেল নিচে। ইসরাত কিড়মিড়িয়ে বলে ওঠল,”দাঁড়া…! সবগুলোকে আজ আস্তো কুপাবো আমি।
ইসরাতের ঝলসানো কন্ঠে নুসরাত, আহান, ইরহাম আরো বেশি করে পায়ে পা মিলিয়ে পালাল। ততক্ষণে রাস্তায় গাড়ি চলাচল শুরু হয়ে গিয়েছে। দূর দূরান্ত হতে ভেসে আসছে অনবরত চলতে থাকা গাড়ির আওয়াজ। নুসরাতরা গোল গোল দৌড়াতে লাগল সবাই মিলে। তিনজনে খিলখিল করে হেসে উঠল সামনে উড়ন্ত পাখির মতো চলতে চলতে। ইসরাত নিজেও হেসে দিল, পরপর আবার শব্দ করে কান্না করে ফেলল। একহাতের তালু দিয়ে চোখ মুছে অস্পষ্ট সুরে জানতে চাইল,”আমাকে বলে গেলি না কেন?
ইসরাতকে শীতিল হতে দেখে সবাই থামল। মুখ খুলে সান্ত্বনা দিতে যাবে তখনই যেদিক থেকে তিন গুণোধরেরা বেরিয়ে এসেছিল সেই পথে হাতে টর্চ লাইট নিয়ে হুরহুর করে একদল পুরুষ মানুষ বেরিয়ে আসলো, মুখে মুখে উচ্চারিত হলো তাদের চোর চোর। ইসরাত বিস্ময় মুখে চেয়ে রইল ওইদিকে। নুসরাত, ইরহাম, আহান তিনজন মাথা একত্রিত করে ফিসফিসিয়ে চোরের মতো মুখ বানিয়ে কানাঘুষা করল,”এরা এখনো পেছন ছাড়েনি?
নুসরাত বৃহৎআকারে চোখে ওইদিকে চেয়ে থেকে বলে ওঠল,”মাত্র ছয়টা মুরগী চুরি করায় এরা এতক্ষণ যাবত আমাদের পিছু করছিল, কী জামানা এসেছে ভাই! ভালো মানুষির জামানা আর থাকেনি..!
ইরহাম নাক ফুলিয়ে বলল,
“খান*কি*র পোলারা মাত্র দুটো মুরগী চুরি করায় এইসব করছে, এইসব মুরগী আমি বাল দিয়ে ও বারি মারি না। শুধু কাবাব খাব বলে নিয়ে এসেছি..!
আহান সরু চোখে ওইদিকে চেয়ে থেকে, শক্ত হাতে বুকে মুরগী গুলো চেপে ধরল। বলল,
“আমাকে মেরে ফেললেও মুরগী আমি দিব না। আমি এগুলো কাবাব করে খাব।
নুসরাত নিজেও পণ করে ফেলল। আজ তাকে বুলেট মেরে দিলেও মুরগী সে দিবে না। তিনজন মুরগী গুলো নিজেদের বুকের কাছে শক্ত হাতে চেপে দাঁড়িয়ে রইল। তখনই কানে আসলো পুরুষালি গলার শব্দ,”অহ পুলিশ অফিসার আছেন এখানে!
মৃন্ময় সুপুরুষের মতো এগিয়ে গেল তাদের দিকে। জিজ্ঞেস করল,”কী হয়েছে?
একটা লোক তাদের মধ্যে থেকে এগিয়ে আসলো। সবার হাতেই লাঠিচটা। চোর ধরার পর উত্তম মাধ্যম দিবে ভেবে নিয়েছিল হাতে। সবাই হইহই করে উঠল। এতজনের কথার মধ্যে মৃন্ময় কিছু বুঝে উঠল না, তাই সামান্য কড়া কন্ঠে বলে ওঠল,”একজন বলুন।
একজন বয়স্ক লোক সামনে আসলেন সবাইকে পেছনে সরিয়ে। চোরের মতো সেটে দাঁড়ানো নুসরাত, ইরহাম, আহানকে আঙুল তুলে দেখিয়ে বললেন,”আমাদের গ্রামে ঢুকে রাত চারটার সময় মুরগী চুরি করেছে ওরা।
নুসরাত ভেংচি কাটল লোকটাকে। লোকটা এসব দেখল না। আবারো বলে ওঠলেন,”পোশাক আষাক দেখলেই বোঝা যায় ভালো, সভ্রম পরিবারের ছেলে মেয়ে, কিন্তু এমন মুরগী চুরি করার কী প্রয়োজন ছিল ওদের? আমরা কত করে বললাম দাঁড়ানোর জন্য, তবুও দাঁড়াল না এরা।
আহান মুখ ফসকে সত্যি কথা বলেই ফেলল,
“এ্যাঁহ আমরা ওখানে দাঁড়াতাম, আর আপনারা এসে চ্যাং ধোলা করতেন, হাহ! আমাদের দেখে কী বিছি মনে হয়?
মৃন্ময় বিরক্ত হলো আহানের উপর। মনে মনে ভৎসনা জানাল সৈয়দ বাড়ির সবাইকে। ভাবল, এ বাড়ির সবগুলো কী এমন! লোকটা আবার বলল,”এই দেখো এখনো মুরগী গুলা কেমন করে ধরে রেখেছে।
নুসরাত, ইরহাম, আহান ঠাই দাঁড়িয়ে রইল। লোকগুলো পুলিশ অফিসারের সাথে অনেকক্ষণ কথা বলল, যখন কথা শেষ হলো তখন মৃন্ময় সবাইকে কাছে আসার জন্য ডাকল। ইসরাত কোমরে হাত রেখে দাঁড়িয়ে সব দেখল। নুসরাত, আহান, ইরহাম চোরের মতো মুখ বানিয়ে এসে দাঁড়াতেই মৃন্ময় বলল,”মুরগী গুলো ফিরিয়ে দিন।
মা যেমন নিজের সন্তানকে আগলে রাখে তেমনি নুসরাত নিজের দেহের সাথে মুরগীগুলো জড়িয়ে নিল। দু-পাশে মাথা নাড়িয়ে শক্ত কন্ঠে বলল,”দিব না।
মৃন্ময় কঠোর কন্ঠে বলল,
“দিয়ে দিন।
নুসরাত ততোটাই জেদি সুরে বলল,
“ দিব না।
মৃন্ময় বলল,
“দিয়ে দিন মিসেস আরশ!
নুসরাত বলল,
“ দিব না মিস্টার মৃন্ময় তুষার, উরফে ঘুষখোর পুলিশ আফিছেড়।
দু-জনের মধ্যে এভাবেই চলল অনেকক্ষণ যাবত কথা কাটাকাটি। ইসরাত দু-জনকে থামিয়ে দিতে রুক্ষ কন্ঠে, কড়মড় করে ধমকে উঠল,”হচ্ছেটা কী এখানে?
মৃন্ময় কেঁপে উঠে থেমে গেল। ইসরাতের দিকে আড় চোখে চাইতেই সে বলল,”চুপচাপ মুরগী ফিরিয়ে দিতে বলুন।
নুসরাত নিজের কথায় অটল। সে বলল,
“অসম্ভব। আমি দিব না! এগুলোকে আমি নিজের বাচ্চা ভেবে নিয়ে এসেছি, এখন মুরগীর কাবাব না খেয়ে ফিরিয়ে দিলে পাপ হবে পাপ।
আহান ও সহমত নুসরাতের কথায়। সে বলল,
“আমি তো ভেবেছি মুরগী গুলোকে প্রথমে বড় করব নিজের বাচ্চাদের মতো। এমন খাওয়ানো দিব যাতে মুরগী গুলো সেম আমার মতো হয়ে যায়। তারপর…
মৃন্ময় তীক্ষ্ণ চোখে তাকিয়ে শুধাল,
“তারপর কী?
আহান মিহি সুরে কোমলতার সহিত বলল,
“মুরগীর শিক পোড়া, কাবাব, ললিপপ, ফ্রাই করে খেতাম, ভাবতেই জিভে জল এসে যাচ্ছে।
নুসরাত নিজেও আহানের মতো অন্যদিকে চেয়ে কল্পনা করল। তারপর গলা মিলাল,“আমার ও চলে আসছে।
ইরহাম ও একই সুরে বলল,
“আমার ও আসছে।
গ্রামের মানুষগুলো খুবই বিরক্ত হলো এমন আচরণে। নুসরাত, ইরহাম আহানের ভাবনার ভেতর তাদের হাত থেকে মুরগী গুলো টেনে নিয়ে যেতে নিল, তিনজনেই মুরগী শক্ত হাতে চেপে ধরে রাখল তা। মুরগী একদিকে ওরা টানছে একদিকে এরা টানছে। হঠাৎ নুসরাতের টনক নড়তেই সে মুরগী দুটোর শরীর ছেড়ে দিল। যে লোকটা টানছিল সেই লোকটা এবার শক্তি দিয়ে টান মারতে যেতেই উল্টে পড়ে গেল। মুরগী হাত থেকে ছুটে ডাকতে ডাকতে পালাল নিজের জান বাঁচানোর জন্য। নুসরাত লোকটাকে ভৎসনা করে বলল,”কী হেমান আপনি, সামান্য মুরগী নেওয়ার জন্য এমন অত্যাচার করছেন আমাদের মতো বাচ্চাদের উপর, ধর্মে সইবে না এসব।
এসব দেখে মৃন্ময়ের ইচ্ছে করল একগ্লাস হারপিক খেয়ে মরে যেতে। কোন চক্করে পড়েছে সে। তার আটাশ বছরের জীবনে এমন গ্যাচাকলে জীবনে পড়েনি। এই আরশের ফ্যামেলির সাথে দেখা হওয়ার পর থেকে দুনিয়ার গজব, আজাব, এসে পড়েছে তার শান্তিপূর্ণ জীবনে। জীবনের সবথেকে বড় ভুল ছিল ঢাকা থেকে ট্রান্সফার হয়ে সিলেট বিভাগীয় থানায় আসা। মৃন্ময় নিজের ধৈর্য হারিয়ে, বজ্র কন্ঠে, কান লাগিয়ে দেওয়ার মতো চিৎকার করে উঠল,”শাট আপ!
সবার হাতে থাকা মুরগী গুলো একপ্রকার টেনে হিচড়ে নিয়ে লোকগুলোর হাতে ধরিয়ে দিল। নুসরাত টু শব্দটি বের করার আগে মৃন্ময় হাবিলদারকে বলল,”চারটা হ্যান্ডকাফ নিয়ে আসুন।
ইরহাম বাদাইম্মার মতো শুধাল,
“কী জন্য?
ইসরাত গাট্টা বসাল ইরহামের মাথায়। রাগী চোখে চাইল তাদের দিকে। নুসরাত মৃন্ময়কে পাত্তা না দিয়ে মুরগীর জন্য হাপিত্যেশ করে মিনমিনিয়ে তাদের সবার শোনার মতো করে বলে ওঠল,”খান*কির পোলারা সব মাল নিয়ে চলে যাচ্ছে। আমার মুরগী, আমার বাচ্চাগুলো….!
নুসরাত তাদের শোনার মতো করে বললে ও দূরে দাঁড়ানো হাবিলদার পর্যন্ত শুনে ফেলল তার গালি। মৃন্ময় না চাইতেও ঠোঁট চেপে হেসে ফেলল। নিজের হাসি ঢাকতে উল্টোদিকে চেয়ে হাবিলদারকে ধমকে উঠল,”কী সমস্যা কী? এত দেরি করছেন কেন?
হাবিলদার দ্রুত পায়ে এসে হ্যান্ডকাফ ধরিয়ে দিলেন মৃন্ময় তুষারের কাছে। মৃন্ময় হ্যান্ডকাফ সর্বপ্রথম নুসরাতের মুখের সামনে ঝুলিয়ে ধরল। সকালের মনোরম হাওয়ায় দুলে উঠল হ্যান্ডকাফখানা। সে ঠোঁট এলিয়ে হেসে ধীমি সুরে এলিয়ে এলিয়ে বলল,”সৈয়দা নুসরাত নাছির, বেপরোয়া গতিতে গাড়ি চালানোর জন্য বাংলাদেশ দু-হাজার আঠারো এর আইন অনুযায়ী দশ হাজার টাকা জরিমানা দিতে হবে না হয় তিন মাসের জেল। মুরগী চুরির জন্য সেকশন ৩৭৮ অনুযায়ী পাঁচ হাজার টাকা জরিমানা, না দিতে পারলে ছয় মাসের জেল। মোট নয় মাসের জেল। ইউ আর আন্ডার এরেস্ট! আমাদের সামনের যাত্রা মনে হচ্ছে অনেক সুন্দর হবে।
সৈয়দ বাড়িতে তখন শোকের ছায়া। এতক্ষণ শক্ত হয়ে দাঁড়িয়ে থাকা লিপি বেগম ও নিজের শরীর ছেড়ে দিয়েছেন। পড়ে আছেন সবার মতো অবচেতন। সৈয়দ বাড়ির সকল মানুষ এসে তখন হাজির নাছির মঞ্জিলে। আরশ, জায়িন, এমন কী মাহাদি বাকি পড়ে থাকেনি সকলেই খুঁজে ফেলেছে তাদের সোসাইটির ভেতর। চতুর্থবারের মতো পুরো সোসাইটি খুঁজে এসে সোফায় বসল আরশ। মুখে গম্ভীরতা রেখে নিজের ভেতরে চলাচল করা উদ্বীপণা ঢাকতে চাইল, হয়তো সফল হলো। চোখে মুখে গম্ভীরতা এঁটে বসে রইল। তখন ঘড়ির কাটায় চলছে দশটার ঘরে। আজকের দিনে তেমন একটা রোদের দেখা নেই, নির্মল দিন। নিস্তেজতা পুরো প্রকৃতি জুড়ে বয়ে রয়েছে। নাছির মঞ্জিল যেমন তাদের বাচ্চাগুলো ছাড়া নিস্তেজ তেমনি। জায়িনের চিন্তায় চিন্তায় মাথা ফাটছে। ইচ্ছে করছে ইসরাত নামক বেয়াদবটাকে যেখানে পাবে ওখানে ধরে কয়েক ঘা লাগিয়ে দিবে। কিন্তু মস্তিষ্কের এমন সুমতি সে চলতে দিল না। তার হৃদয়ে চলছে অন্যকিছু। মস্তিষ্ক যা বলছে তার থেকে দ্বিগুণ গতিতে চলছে হৃদয়ের ধ্বনি। শ্বাস আটকে বসে রইল নিজের জায়গায়। বুকের কাছে চিনচিনে ব্যথা হলো। এসির ভেতর থেকেও চিন্তায় চিন্তায় ঘামতে লাগল সারা শরীর। একহাতে বুকের বাঁ-পাশ চেপে ধরল। হাত দিয়ে বুকের কাছে ব্যথা উঠা জায়গায় ড্যাবড্যাব করে আঘাত করল ব্যথা কমার জন্য।
সবার এত চিন্তার ভেতর নাছির সাহেব একমাত্র ব্যক্তি যিনি আরাম করে বসে মোবাইল ঘাটছেন। কিছুদিন পূর্বে নুসরাত আর ইসরাতের শেয়ার করা মিমসগুলো দেখলেন আর হাসলেন। হেলাল সাহেব নিজেও চিন্তিত। যতই হোক ছেলের বউ তার! উপরে উপরে নিজেকে কঠিন খোলসে ঢেকে রাখলেন। এমনভাব যেনো যাকগে মরুক সবগুলো, আমার কিছু যায় আসে না, কিন্তু ঠিকই চিন্তা করছেন ভদ্রলোক। পা দিয়ে মেঝেতে বারবার আঘাত করে নিজেকে সামলানোর বৃথা প্রয়াস করলেন। যখন তার কানে নাছির সাহেবের হাসির শব্দ আসলো তখন ক্ষুব্ধ নেত্রে চেয়ে কড়া কন্ঠে বলে ওঠলেন,”কী হয়েছে? এমন দাঁত কেলাচ্ছিস কেন?
নাছির সাহেব মোবাইলটা সবার মুখের সামনে তুলে ধরে বললেন,”সুন্দর না? নুসরাত দিয়েছে এই মিমস!
নাজমিন বেগম নিজের কান্না আটকে স্বামীর দিকে তাকালেন। নিজের মায়ের দিকে চেয়ে হু হু করে আবারো কেঁদে ওঠে বললেন,”দেখেছ আম্মা দেখেছ, আমার বাচ্চাগুলো নেই, আর এই পাষাণ লোক মিমস দেখে হা হা করে দাঁত কেলাচ্ছে। এ কেমন লোকের সাথে তুমি আমার বিয়ে দিলে!
নাছির সাহেব মোবাইল সেন্টার টেবিলে রাখলেন। গলার আওয়াজ কিছুটা উঁচু করে স্ত্রীসহ সবাইকে বলে ওঠেন,”তো কী হয়েছে? তোমরা ভোর চারটা থেকে চিন্তা করছ সবাই এতে তো ওরা আসলো না, এখন কী তোমাদের মতো চিন্তা করে আমি নিজের ভিপি হাই করব? আজব তো! সারারাত ঘুমাতে দাওনি, এখন একটু আরাম করে রিলসগুলো দেখতে দিবে না!
নাছির সাহেবের কথা শেষ হতেই হাওয়ার গতিতে দরজা উড়িয়ে বাতাসের ন্যায় উড়ে এসে মাছির মতো সবার মাঝখানে জায়গা জুড়ে বসলেন সুফি খাতুন। চোখে পানির অস্তিত্ব নেই, তারপরও চোখ শাড়ীর আঁচলে মুছে নিয়ে হাই হুতাশ করলেন৷ মাথায় হাত রেখে নিজের কর্ম জারী রেখে হাহাকার করে বললেন,”নাছির ও নাছির তোর এ কী সর্বনাশ হলো রে!
সোহেদ সাহেবের ইচ্ছে হলো ফুপি নামক ভদ্র মহিলার গলা কিছু দিয়ে বেঁধে ফ্যানের সাথে ঝুলিয়ে দিতে। কী এক গলারে বাবা। এই মহিলা চিৎকারেই তো তার প্রেশারটা হাই হয়ে গিয়েছে। শোহেব সাহেব কানে টিস্যু প্রায় গুজে ফেলতে গেলেন, ভদ্র মহিলার হাই হুতাশে উনার রক্তচাপ বাড়ছে। একদিকে এই মহিলারা হাহাকার অন্যদিকে তার সহধর্মিণীর চিৎকার দুটোই কানে সাইরেনের মতো বাজছে৷ কী ভয়ংকর সেই অনুভূতি!
হেলাল সাহেব ফুপির সম্পর্কের পরোয়া না করে সুফি খাতুনকেই ধমকে উঠলেন,”বস, আর কোনো চিৎকার না!
সুফি খাতুন থোড়াই কানে তুললেন এই কথা! উনি নিজের চিৎকার করা সমান কান্না জারী রাখলেন। নাছির মঞ্জিল হতে শুরু করে আগাম তিন পাড়া জেনে যাবে বিয়ে বাড়ি থেকে কনেসহ তার চার ভাই বোন উধাও। সুফি খাতুন বললেন,”আমি জানতাম, আমি জানতাম….!
নাছির সাহেব থামিয়ে দিলেন সুফি খাতুনকে। এক ভ্রু উচিয়ে জানতে চাইলেন,”কী জানতে তুমি?
সুফি খাতুন বললেন,
“ওই মেয়ে তার লাঙ্গের সাথে পালাবে আজ না হয় কাল।
এইটুকু কথা নাছির মঞ্জিলের তৎকালীন পরিবেশকে নাড়িয়ে দিতে সময় নিল না। নাছির সাহেব ভ্রুক্ষেপহীন কন্ঠে বললেন,”যদি পালিয়ে থাকে তাহলে বেশ করেছে। তোমার কোনো সমস্যা?
সুফি খাতুন সেসব না শুনে আরো বললেন,
“ওই মেয়েকে দেখলেই বোঝা যায় উপরে উপরে ভদ্র সেজে থাকে, ভেতরে ভেতরে ঠিকই মায়ের মতো পলিটিক্স বাজ। আমি আগেই বলেছিলাম একটা ও ভালো হয়নি। দেখ গিয়ে কোন পোলার সাথে মস্তি করছে।
নাছির সাহেব ভদ্র মহিলার কথায় ভ্রক্ষেপ করলেন না। নাজমিন বেগম জ্বলে উঠলেন। রাগী কন্ঠে দু-বাক্য শোনানোর পূর্বেই রুহিনীর গলার আওয়াজ ভেসে আসলো। মায়ের বিরুদ্ধে কঠোর কন্ঠে বলছেন,”আম্মা আর একটা কথা বলবে না তুমি, বললে আগামীকালই নিজের জিনিস নিয়ে ফিরে যাবে আব্বার বাড়িতে। দেখছ ও এই বাড়ির মানুষ চিন্তায় আছে তার উপর তুমি আরো উল্টাপাল্টা কথা বলে টেনশন বাড়াচ্ছো। আগেই বলে দিলাম কেউ কিছু বললে পরে মুখ ফোলিও না।
রুহিনীর কথায় থেমে গেলেন সুফি খাতুন, চোয়াল ঝুলিয়ে বসে রইলেন। কোনোপ্রকার টু শব্দটি করলেন না আর। নাছির সাহেব নিজের মোবাইল ঘাটতে ঘাটতে সবার উদ্দেশ্যে বললেন,”এত চিন্তা করে কোনো লাভ নেই, দেখো গিয়ে গাড়ি কোন প্লটে ঢোকাইছে না হয় ধাক্কা লাগিয়ে আমার গাড়ি ফোস করে দিয়েছে। আমার তো বেচারা জড়বস্তু গাড়িটার জন্য কষ্ট হচ্ছে, হায় আমার গাড়ি..!
দীর্ঘ শ্বাস ফেললেন।পরপর আবারো আরেকটা রিলস দেখে হাসতে হাসতে ঢলে পড়লেন সোফার উপর।
মৃন্ময়ের কথা শেষ হওয়ার পূর্বেই নুসরাত দু-হাত বাড়িয়ে দিল। বলল,“টাকা, পয়সা নাই, আর থাকলেও আমি দিব না। ওগুলো কী গাছে ধরে যে বললাম আর টুপ করে পাতার মতো ঝড়ে পড়ে গেল। তাছাড়া অপাত্রে টাকা ঢালতে আমি ভীষণ অপছন্দ করি। হাজতে যাওয়াই বেস্ট আমার কাছে, তবুও ঘুষখোর পুলিশকে আমি টাকা দিব না। এমনিতেই গরীব, খেতে পাচ্ছি না, আর উনি বলছেন পনেরো হাজার টাকা দিন জরিমানা। মুখ ধোয়ার জন্য সাবান কিনতে পারছি না, আর দিব জরিমানা!।হাসিলিরে পাগলা…!
ইরহাম আহান দু-জনেই মাথা নাড়াল। মৃন্ময় ইরহাম আহানের হাতে হ্যান্ডকাফ পরিয়ে নুসরাতের হাতে দিতে যাবে নুসরাত টেনে নিল সেটা নিজের দিকে। বলল,”আমি ঘুষখোরদের হাত নিজের গায়ে লাগিয়ে নিজেকে নাপাক করতে চাচ্ছি না। ইসরাত পরিয়ে দে তো!
ইসরাত নুসরাতের হাতে হ্যান্ডকাফ পরিয়ে দিল। মৃন্ময়ের মুখ অপমানে থমথমে হয়ে উঠল। নিজেকে সান্ত্বনা দিল, এই মেয়ের মাথার একটা রগ ঢিলে বলে। নিজেকে সামলে নিয়ে ইসরাতের দিকে হ্যান্ডকাফ তুলে ধরল। ইসরাত শীতিল সুরে জিজ্ঞেস করল,”আমার অপরাধ?
মৃন্ময় তুষার ইসরাতের চোখের দিকে তাকাল। সূর্যের তেজাস্রী রশ্মি পূর্ব আকাশে তখনো উদিত হয়ে মাটিতে নেমেছে। আলো এসে চোখে পড়তেই মেয়েলি চোখটা জলমল করে উঠল। কালো চোখের মণি গুলো অগোচরে নিজেদের কালো বর্ণ হারিয়ে পরিণত হলো বাদামি বর্ণে। উজ্জ্বল বাদামি চোখের পানে চেয়ে বলে ওঠল,”একজন পুলিশ অফিসারের দিকে আক্রমণাত্মক ভঙ্গিতে তেড়ে আসায় পাঁচ হাজার টাকা জরিমানা, না হয় দু-মাসের জেল।
ইসরাত হ্যান্ডকাফ নিজের হাতে নিয়ে নিল। আলগোছে সেটা হাতে নিয়ে নিজেই নিজের হাত লক করে দিল। তারপর অধর বাঁকিয়ে সামান্য হেসে বলল,”আপনাকে টাকা দেওয়ার থেকে একটা ইদুরকে টাকা খেতে দেওয়া আমি বেশি এপ্রিশিয়েট করব।
মৃন্ময় এত অপমান চুপচাপ গিলে নিল। সবাইকে বলল,”গাড়িতে উঠুন সবাই।
নুসরাত নেচেকুদে গাড়ির দিকে যেতে যেতে সবাইকে বলল,”নো টেন্স বস, মনে কর শ্বশুর বাড়ি যাচ্ছিস কয়েক দিনের জন্য
ইরহাম নাকের পাটা ফুলিয়ে হাঁটল। নুসরাতের কথায় সামান্য ব্যতিক্রমী ভঙ্গিতে প্রশ্ন জিজ্ঞেস করল,”কয়েক দিনের জন্য নাকি কয়েক মাসের জন্য?
পরপর আহান নাকি সুরে বলে ওঠল,
“আপুউউউউউ..! আমি এই হাজতে যাব না।
নুসরাত পুরো চিল মুডে থাকল। ইসরাত ও এতক্ষণের গম্ভীরতা ছেড়ে নিজেও কিছুটা হাস্যমুখ হয়েছে। দু-বোন জেলে যাচ্ছে সেই চিন্তা না করে হাসল। ইসরাত বলল,”কয়েকদিন পূর্বে তুই একটা কথা বলেছিলি, মনে আছে?
নুসরাত মাথা নাড়াল। তারপর দু-জনেই একসাথে সুর টেনে আহানের উদ্দেশ্যে মিনমিনিয়ে গাইল,”শ্বশুর বাড়ি মধুর হাড়ি, হাজতে গেলে খেতে হবে ডান্ডার বাড়ি, তাই এখান থেকেই নিয়ে নাও নিজেদের প্রস্তুতি।
ইসরাতের গলা হঠাৎ থেমে গেল। চারিদিকে চোখ ঘুরিয়ে তাকিয়ে অবাক কন্ঠে মুখ দিয়ে নিশ্রিত হলো একটা কথা।
“এই মমো আর সৌরভি কোথায়?
ইসরাতের কথায় তিনজনের মনে পড়ল তাদের কথা। এতক্ষণে প্রায় ভুলেই বসেছিল। তিনজন নিজেদের দিকে কিৎকাল তাকিয়ে থেকে উদ্যাত্ব হলো তাদের খুঁজতে। হ্যান্ডকাফে আটকানো হাত নিয়ে আশেপাশে পাগলের মতো চোখ বুলাল। কিছু মুহুর্ত পরে আহানের গলা ভেসে আসলো, সে বলছে,”আপুউউ, মমো আপু, আর সৌরভি আপু এখানে।
তিনজন যে যে জায়গায় ছিল আওয়াজ অনুসরণ করে দৌড়াল। সবার আগে সেখানে পৌঁছাল ইসরাত, এরপর নুসরাত, ইরহাম। মৃন্ময় আর হাবিলদার পৌঁছালেন সবার শেষে। ইসরাতে মমোর দিকে ঝুঁকে হাত দিয়ে স্পর্শ করতে যাবে মনে পড়ল হাত বাঁধা তার। অসহায় চোখে কিছুক্ষণ মাটির দিকে চেয়ে থেকে নিজের হাত তুলে ধরল মৃন্ময়ের সামনে। তেজি কন্ঠে বলল,”হাত খুলে দিন অফিস্যার।
মৃন্ময় কোনো দুরুক্তি ছাড়াই খুলে দিল ইসরাতের হাত। একে একে সবার হাত খুলে দিল, শেষে যখন নুসরাতকে খুলে দিতে যাবে তখন থেমে চোখ তুলে তাকাল। শুধাল,”আমি খুলে দিব?
নুসরাত কোনো কথা না বলে শুধু ভেটকানো দিল। অতঃপর হাত খুলে নিয়ে মমোর সামনে হাঁটু গেড়ে বসতে বসতে বলে ওঠল,” এমন ফিট খেয়ে পড়ে আছে কেন?এদের নাকের কাছে কিছু কী ধরতে হবে?
ইসরাত মমোর দিকে ঝুঁকে তাকিয়ে থেকে রুক্ষ সুরে শুধাল,”কেন?
নুসরাত বলে ওঠল,
“আমি শুনেছি দূর্গন্ধ জাতীয় কিছুর স্মেল নিলে মানুষ তাড়াতাড়ি সজ্ঞানে ফিরে আসে। আমার জুতো পাঁচদিন যাবত ধোয়া হয়নি, তাই ভাবছিলাম এদের নাকের কাছে ধরব।
ইসরাত ধমকে উঠল নুসরাতকে। ইরহাম নীরবে দাঁড়িয়ে রইল। ইসরাতে হঠাৎ বলে ওঠল,” ইরহাম সৌরভিকে তোর কোলে তুলে নেয়!
ইরহাম এমন কথায় সামান্যক্ষণ থমকাল। মুখ চাওয়া চাওয়ি করে নিশ্চিত হতে আবারো জানতে চাইল,”আমি?
ইসরাত ক্রোধান্বিত গলায় বলল,
“না তুই না, তোর রুহকে বলছি।
মমো স্বাস্থ্যের অধিকারী হওয়ায় মাথায় ধরল আহান, দু-পায়ে ধরল নুসরাত আর ইসরাত। সবাই মিলে টেনে টুনে নিয়ে গিয়ে পুলিশের জিপে তুলে ফেলল মমোকে। তখনো স্তব্ধ নয়নে সৌরভির দিকে চেয়ে দাঁড়িয়ে রইল ইরহাম। নুসরাত সামান্য বিরক্ত হলো। ইচ্ছে হলো ইরহামের পেছনে গিয়ে একটা লাথ মেরে উলটে ফেলে দিতে। সময় অতিবাহিত হলো। নুসরাতের আর তর সইল না,এতক্ষণে গলার কাছে দলা পাকানো গালি গুলো বের হয়ে আসলো তড়িৎ গতিতে। তবুও নিজেকে সামলে নিয়ে সামান্য আওয়াজে কিছু গালি দিয়ে পরের কথাগুলো জোরে জোরে বলল,”এই মাঙ্গের নাতি, তাড়াতাড়ি কোলে তুলে নিয়ে আয় সৌরভিকে।
ইরহাম সম্বিত হলো। চোখের পাতা ফেলে হুঁশ জ্ঞান হারিয়ে অবেহেলায় পড়ে থাকা রমনীর দিকে চাইল। নৈঃশব্দে অতিবাহিত হলো সময়। প্রকৃতিতে তখন চলছে বিরম্বনা। একটু একটু বৃষ্টির ভাব। থোকা থোকা মেঘ জমেচহে আকাশে, মেঘের গর্জন চলছে। আকাশ দু-পাশে বিভক্ত হয়ে বজ্রপাত হচ্ছে ক্ষণে ক্ষণে। ইরহাম ঝুঁকে গেল সৌরভির দিকে। মেয়েলি শরীরের অগ্রভাগে অস্বাভাবিক কোনো স্পর্শ না লাগে সেদিকে খেয়াল রাখল সে। পেছন থেকে তখনো হাউকাউ করছে নুসরাত। মনে মনে হয়তো শত গালি দিচ্ছে তাকে। ইসরাত টু শব্দটি না করে জহুরে নজরে চুপচাপ লক্ষ করল ইরহামের গতিবিধি।
ইরহাম সৌরভির হাঁটুর নিচে এক হাত রেখে অন্যহাতে সৌরভির কোমর চেপে ধরল। কিছু মুহূর্তের মধ্যে দেখা গেল সৌরভি ইরহামের বাহুর মধ্যে। অবচেতন শরীরে, পুরুষালি গরম কাদামাক্ত দেহের স্পর্শ পেতেই শিহরণ জাগল। তখনই আকাশ চিড়ে বজ্রিত হলো মেঘের গর্জন। হঠাৎ কেঁপে ওঠা কী বজ্রপাতের জন্য নাকি ইরহামের শরীর সংস্পর্শে আসার জন্য হলো ঠিক বুঝে উঠা গেল না। ইরহাম যখন সযত্নে কোলে তুলে এক পা দু-পা করে সামনে এগিয়ে পুলিশের জিপের দিকে গেল তখন মেঘ তরল হয়ে পতিত হলো মাটিতে। আবারো নতুনভাবে বৃষ্টির সূচনা হলো।। গতরাতের মতো অতো তেজালো বৃষ্টি নয়, ঝিরিঝিরি বৃষ্টি হলো। ইরহাম সৌরভিকে যতক্ষণ নিজের বাহুর বাঁকে রাখল ততক্ষণ পর্যন্ত বুকের মাংস পেশীটা ধুরু ধুরু করে কাঁপল।
প্রিয় প্রণয়িনী ২ পর্ব ৩৪
নিজের এমন অস্বাভাবিক শরীরের পরিবর্তনে নিজেই হতচকিত হলো। তার সৌরভিকে এজ আ মেয়ে ফ্রেন্ড ভালো লাগে কিন্তু এমন অনুভূতি হওয়ার মানে কী! মেয়েটার প্রতি কী তার অনুভূতি জমছে, এটা কীভাবে সম্ভব! আড় চোখে দেখল হলুদাভাব মুখখানা। এতকাছ থেকে হয়তো প্রথম এই মুখ দেখছে, তাই অক্ষিপটে ধরা পড়ল সুন্দর একটা জিনিস। ডান দিকের গাল আর চোকহের মধ্যভাগে কালো চিকচিকে বর্ণের তিল। খুবই সূক্ষ্ম সেটা। চোখ দাবিয়ে না দেখলে দেখা যায় না। ইরহামের মনে হলো ধুকপুক করা হৃৎপিন্ডের গতি আরো বেড়েছে। সে নাজেহাল হলো, মাথা ঝেড়ে ফেলে দিতে চাইল এই অনুভূতি, যতটা ঝেড়ে ফেলার চেষ্টা করল ততটা হয়তো আরো গ্রাস করে নিতে থাকল তাকে সেই অনুভূতি।