প্রিয় প্রণয়িনী ২ পর্ব ৪

প্রিয় প্রণয়িনী ২ পর্ব ৪
জান্নাত নুসরাত

সকাল দশটা। ঘুমে ঢুলুঢুলু হয়ে নিচে নেমে আসলো ইসরাত। রান্না ঘরে মাছ তৈলে ভাজার জন্য দেওয়ায় ছি আকারে শব্দ আসছে। ইসরাত ধীরে ধীরে হেঁটে গেল টেবিলের দিকে। টু শব্দ করল না মুখ দিয়ে, শব্দ করে চেয়ার টেনে বসে পড়ল। নাজমিন বেগম গ্যাসের চুলার আঁচ কমিয়ে দিয়ে কেবিনেটের দিকে এগিয়ে যান কফি পাউডার বের করার জন্য।

ইসরাতের ঘুমের ঘোর এখনো কাটেনি তাই মাথায় হাত দিয়ে টেবিলে কব্জি ঠেকিয়ে বসে রইল। বসে বসে অনেকক্ষণ ঝিমালো। ঝিমানো শেষে, তর্জনী আর মধ্যমা আঙুল দিয়ে কপালর মধ্যিখানে হালকা হাতে চাপ প্রয়োগ করল, যাতে মাথা ব্যথা কমে। মুখে রা নেই তার!
কিছু সময় অতিবাহিত হওয়ার পর বাড়ির ভিতর প্রবেশ ঘটল ধুপধাপ করে হেঁটে আসা ঘূর্ণিঝড়ের। ইসরাত টেবিলে বসে থেকে মৃদু হাসল। তখনো পিছনে দাঁড়ানো মেয়েটাকে সে বুঝতে দেয়নি,তার উপস্থিতি সে টের পেয়েছে। গলার আওয়াজ বাড়িয়ে কিচেনে থাকা নাজমিন বেগমের উদ্দেশ্যে ইসরাত বলল,”আম্মু বাড়ি আজ ঠান্ডা ঠান্ডা লাগছে না?
এই প্রশ্ন সে করেছে নুসরাতকে জ্বালানোর জন্য। আর ঠিক তাই হলো, নুসরাত জ্বলে উঠল ধুপ করে। তবু্ও মুখ বন্ধ করে কোমরে দু-হাত রেখে দাঁড়িয়ে রইল স্থির নিজ জায়গায়, ইসরাতের পরবর্তী কথা শোনার আশায়।
অজ্ঞ নাজমিন বেগম পানির পাত্র চুলায় বসিয়ে অপেক্ষা করতে লাগলেন পানি গরম হওয়ার। পানি গরম হওয়ার পর পানিতে চামচের সামনা দিয়ে এক চিমটি কফি পাউডার পাত্রে দিয়ে উত্তর করলেন, “কেন?

আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন

ইসরাত ঠোঁট চেপে হাসি আটকানোর প্রাণপন চেষ্টা করল। সে না চেয়ে বুঝতে পারছে নুসরাত অজগর সাপের মতো ফুলছে ভিতর ভিতর। তবুও ধৈর্য ধারণ করে অপেক্ষা করছে তার উত্তর শোনার আশায়। ইসরাত আর কাউকে অপেক্ষা করালো না, মুখে হাত চেপে ধরে হাসি আটকিয়ে রেখে বলল,”কারণ তুফান আজ বাড়িতে নেই।
ইসরাতের কথা শেষ হওয়ার আগেই ধুপ করে শব্দ হলো। ধুপধাপ শব্দ শুনে নাজমিন বেগম আতঙ্কিত হয়ে কিচেন থেকে দৌড়ে বের হয়ে আসলেন। ড্রয়িং রুমে এসে তিনি হতাশ হলেন। দুই মেয়ের দিকে হতাশ দৃষ্টিতে তাকিয়ে থেকে রাগী গলায় বললেন,”এক একজন গন্ডারের মতো বড় হয়ে গেছেন, আর এখনো কুকুরের মতো কামড়া-কামড়ি করছেন। নুসরাত ছাড় ইসরাতকে,নাহলে পিঠে আজ তোর দু-ঘা পড়বে।

নুসরাত শেষ বারের মতো ইসরাতের চুল টান দিয়ে দৌড় দিল। দূরে দাঁড়িয়ে মা-বোনকে জিহ্বা বের করে ভেঙ্গিয়ে বাড়ি থেকে বের হয়ে যেতে নিবে, নাছির সাহেব ডেকে উঠলেন,”দাঁড়াও, নাস্তা করে বের হও!
বাবার আদেশ পেয়ে নুসরাত আর বাহিরে পা বাড়াল না। সে বাবার প্রতি একটু বেশিই দূর্বল! বাবার প্রতি তার যতটা ভালোবাসা, মায়ের প্রতি তার ততটুক ভালোবাসা আসে না। সে জানে না এর কারণ কি! যেই কারণ হোক, বাবাকে সে বেশি ভালোবাসে।
নুসরাত বাড়ানো পা ফিরিয়ে নিয়ে আসে। ইসরাত তখনো টেবিলের উপর বসে ঘুমে ঢুলে পড়া চোখগুলো খুলে রাখার চেষ্টা করছে।
চেয়ার টানার শব্দে শুনে সে এবার নড়েচড়ে বসল। মাথা নিজের চেয়ারের পিছন দিকে এলিয়ে দিয়ে চোখ বন্ধ করে নিল।

নাছির সাহেব চেয়ার টেনে বসে ইসরাতের দিকে তাকালেন। শুভ্র মুখটা পাংশুটে বর্ণ ধারণ করেছে, ঠোঁট গুলো শুকিয়ে গিয়েছে, আর চোখের নিচে আবার ও মোটা আস্তরণ পড়েছে। চাঁদের গায়ে যেমন কলঙ্ক তাকে এ যেন সেই কলঙ্ক, তার শুভ্র দাগহীন মেয়ের মুখে ভেসে উঠছে।
নাছির সাহেব জুসের জগ নিজের কাছে টেনে নেন। গ্লাসে জুস ঢালতে ঢালতে রয়েসয়ে জিজ্ঞেস করেন,”আবার দুঃস্বপ্ন দেখেছ?
ইসরাত চোখ খুলে তাকায়। কিন্তু চোখগুলো উপরে তুলে না, নিচের দিকে স্থির রেখে স্বল্প উচ্চ গলায় উত্তর দেয়,”জি আব্বু!

নাছির সাহেব নুসরাতের দিকে একটা জুসের গ্লাস আর ইসরাতের দিকে আরেকটা জুসের গ্লাস ঠেলে দিয়ে বলেন,”এটা নিয়ে এতো ভাবার কিছু নেই, দুঃস্বপ্ন ভেবে ভুলে যাও। অতিরিক্ত স্ট্রেস যাচ্ছে তাই এসব স্বপ্নে দেখছ।
নাছির সাহেব স্বাভাবিক গলায় কথা বলে জুসের গ্লাসে চুমুক দিলেন। হঠাৎ নুসরাত হে হে করে হেসে উঠল। নাছির সাহেব গ্লাস রেখে নুসরাতের দিকে তাকান। জিজ্ঞেস করেন,” কি হয়েছে, হাসছ কেন?
নুসরাত দু-পাশে কিছু না ভঙ্গিতে মাথা নাড়ায়। নাছির সাহেব জুসের গ্লাসে আরেক চুমুক দিতেই নুসরাত ঠোঁট চোখা করে শুধায়,”আব্বা সত্যি কি ওটা স্বপ্ন নাকি…
কথা শেষ করতে পারে না, তার আগেই কুহ কুহ শব্দ করে কেঁশে উঠেন নাছির সাহেব। ইসরাত দৌড়ে নিজের জায়গা ছেড়ে উঠে দাঁড়ায়। বাবার দিকে এগিয়ে গিয়ে পিঠে হাত বুলিয়ে দেয়। নাছির সাহেব একটু ধাতস্ত হতেই ইসরাত সরে আসে। নিজ স্থানে বসে পড়তেই বাবার ধমক কানে যায়, যা তিনি নুসরাতের উদ্দেশ্যে ছুঁড়ে দিচ্ছেন।
“তুমি কি বলছিলে আবার বলো? এভাবে খাবার খাওয়ার সময় কেউ কথা বলে? জান আটকে মেরে ফেলতে চাও কি?

নুসরাত রহস্যময়ী হাসে। ঠোঁট উল্টে, চোখ ঝাপটায়। তারপর গাল ফুলিয়ে দু-হাত আড়াআড়ি বুকে বেঁধে বলে,” আব্বা আমি কিন্তু পড়ে নিয়েছি!
নাছির সাহেব বিস্ময় নিয়ে জিজ্ঞেস করলেন,
“কি পড়ে নিয়েছ তুমি?
নুসরাত শুধু হাসে। একবার ঠোঁট চোখা করে তো একবার উল্টে। নাছির সাহেব টেনশন নিতে পারলেন না আর,এই মেয়ে তাকে টেনশন দিতে দিতে মেরে ফেলবে। দাঁতে দাঁত চেপে ছোট ধমক দিয়ে বললেন,”তুমি কি পড়ে নিয়েছ, বললে, বলে ফেলো, এভাবে সাসপেন্স দিচ্ছ কেন?
নুসরাত দু-চোখ ছোট ছোট করে ভ্রু নাচায়। এক পেশে ভ্রু করে গর্বে ফুলে উঠা বুক নিয়ে উত্তর দেয়, “আমাদের লাইব্রেরি রুমে যে ডাইরি আছে ওইটা।
নাছির সাহেব এবার কিছুটা ভয়ার্ত হলেন। নুসরাতের দিকে সিরিয়াস হয়ে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করলেন,”কোন ডাইরি পড়ে নিয়েছ তুমি?

নুসরাত কথা বলে না,শব্দ তুলে শু শু ডাকিয়ে জুসের গ্লাস থেকে জুস পান করে। জুস খাওয়া শেষে গ্লাস রেখে সামনে তাকাতেই দেখে ইসরাত আর নাছির সাহেব এখনো তার দিকে তাকিয়ে আছেন প্রশ্নাত্মক চোখে। নুসরাত শুধু হাসে, তারপর বাবাকে জ্বালাতে বলে,”ওই যে গোলাপি ডাইরিটা, যেটা আপনি আমাকে আর ইসরাতকে স্পর্শ করতে না করেছিলেন, ওইটা।
নাছির সাহেব বুকে হাত চেপে ধরলেন। চেয়ারে সারা শরীর ছেড়ে দিয়ে, চোখ বন্ধ করে জিজ্ঞেস করলেন, “না করা সত্ত্বেও, ওই ডাইরি তুমি পড়েছ কেন?
নুসরাত এক পা তুলে চেয়ারে বসে। নির্লিপ্ত চোখ আশেপাশে বুলিয়ে নিয়ে উত্তর করে,”আপনি তো জানেন আব্বা, নিষিদ্ধ জিনিস জানার প্রতি আমার একটু বেশি ঝোঁক! আর তাই নিজের ঝোঁক সামলাতে না পেরে ওই ডাইরি পড়ে নিয়েছি।

নাছির সাহেবের বুকে কিছু একটা কামড়ে উঠল। এক-হাত দিয়ে বুকের বাঁ-পাশ চেপে ধরে রেখে জিজ্ঞেস করলেন,”কতটুকু পড়েছ তুমি?
ইসরাত দু-জনের মাঝখানে বসে একবার বাবার দিকে গোল গোল চোখে তাকায় তো একবার বোনের দিকে তাকায়। সে বেচারা নুসরাতের ভাষায় দুই বিজ্ঞ মানুষের মধ্যে ফেসে গিয়েছে। চুপচাপ বসে থাকা ছাড়া এখন তার কোনো কিছু করার নেই।
নাছির সাহেবের চেতনা হারানোর পর্যায়। নুসরাত ধীরে ধীরে অবিচল কন্ঠে বলে,”সব পড়ে নি,,য়ে,,ছি আব্বা।
শেষের কথা টেনে টেনে বলে বাবাকে আরেকটু টেনশন দেওয়ার জন্য। কারণ সে ভালোবাসে তার প্রিয় মানুষদের টেনশন দিতে।
নাছির সাহেব এলোমেলো তাকান। চোখের মণিতে স্পষ্ট তার উদ্বীপণা। নুসরাত বাবার অতিরিক্ত রিয়েক্ট করা দেখে আবার ভিলেনদের মতো হাসে।

“ইসরাতকে কিছু বলেছ? আর কি কি জানতে পেরেছ ডাইরি পড়ে।
নুসরাত এক মুহুর্ত বিলম্ব করে না। বিরক্ত হওয়ার ভান করে কপালে ভাঁজ ফেলল। ব্যগ্র কন্ঠে বলল,” ইসরাত কে আর কি বলব আব্বা? জানেন কি হইছে? আমি না বললে, জানবেন কিভাবে! দাঁড়ান বলতাছি, কি হইছে গোলাপি ডাইরিটা হাতে নিয়ে পড়তে গিয়ে মনে হলো কোনো মাইয়ার ডাইরি, পরে দেখি ওমা এডা তো কোনো আজমল আলীর ডাইরি আইই মিন আপনার আব্বা, আমার দাদার ডাইরি। আমি কিছুটা বিরক্ত হলাম, পুরুষ মানুষ আবার কেন গোলাপি ডাইরি ব্যবহার করে, আই মিন লিখে৷ নিজের এই কৌতূহল এক পাশে ফেলে যখনই ডাইরির প্রথম পৃষ্টায় লিখা দেখলাম, তা পড়তে নিলাম, লিখা পড়তে গিয়ে দাঁত ভেঙে যাওয়ার জোগাড় হলো। এতটুকু পড়েছি আমি, আমার নাম সৈয়দ আজমল আলী, আমার অনুমতি ছাড়া আমার গোলাপি ডাইরি কেউ স্পর্শ করবেন না। এইটুকু পড়ে মনে হলো লোকটা যখন নিজে বলছে তার ডাইরি স্পর্শ না করার কথা তাই আমি আর অসামাজিকতা দেখিয়ে ডাইরিটা পড়িনি, পরে পড়ব ভেবে রেখে এসেছি।

নাছির সাহেবের কাছে নুসরাতের একটা কথা বিশ্বাসযোগ্য মনে হলো না। ইসরাতের দিকে তাকাতেই দেখলেন ইসরাত স্বাভাবিক, তাই না চাইতে ও বিশ্বাস করতে হলো যে, নুসরাত ডাইরিটা পড়েনি। পড়লে এতক্ষণে ইসরাতের কাছে সব খোলাসা করে ফেলত, আর ইসরাত নিজের স্বপ্ন ভাবা জিনিসটা আসলে কি দু-স্বপ্ন নাকি বাস্তব তা জেনে যেত।
নাছির সাহেব নুসরাতের সবকিছু বলার পর রাগী চোখ তুলে তাকান তার দিকে। আখিঁযুগল প্রশস্ত করে দ্বিধাহীনভাবে নুসরাতকে জিজ্ঞেস করেন,”তাহলে আমাকে এতক্ষণ ভয় দেখাচ্ছিলে কেন?

নুসরাত অবাক হওয়ার ভান করে। ভড়কে গিয়েছে এমন করে লাফ মেরে উঠে দাঁড়ায় চেয়ারের উপর৷ দু-হাত সামনে এনে ভয় পাওয়ার মতো করে থরথর করে কাঁপতে কাঁপতে বলে,”আমাকে মাফ করে দিন সৈয়দ সাহেব, আপনাকে আমি যা সত্যি তাই বললাম, কিন্তু আপনি এখন বলছেন আমি আপনাকে ভয় দেখাচ্ছিলাম।
নুসরাত হঠাৎ সিরিয়াস হয়ে গেল। চোখ দুটো ছোট ছোট করে শুধালো,”সত্যি কি কিছু আছে ওই ডাইরিতে আব্বা, তাহলে তো আজ একবার ওই ডাইরি পড়ে দেখতে হবে। কি এমন আছে যার জন্য, আব্বা আপনি ভয় পেয়ে বুক চেপে ধরে ছিলেন।

নাছির সাহেবের বুক থেকে নেমে যাওয়া ভারী পাথর আবার এসে যেন বুকে চাপা পড়ল। নুসরাতের দিকে অবিচল চোখে থেকে আওড়ান,”তুমি এরকম কেন নুসরাত?
নুসরাতের ঠোঁটের আগায় যেন উত্তর থাকে সব প্রশ্নের। সে মেয়েলি ঠোঁট নাড়িয়ে উত্তর করে,”আমি আপনার মেয়ে তাই, আমি এরকম। আর আপনি এরকম বলেই আমি এরকম। আমি এরকম বলেই আমি এরকম। আর এজন্যই আমি এরকম। আর তার জন্যই আমি এরকম।
নাছির সাহেব বিরশ মুখে তাকিয়ে রইলেন নুসরাতের দিকে। ব্যগ্র কন্ঠে জিজ্ঞেস করলেন,”তুমি কি পণ করে নিয়েছ নুসরাত, কাউকে শান্তিতে থাকতে দেবে না?
নুসরাত দু-পাশে মাথা নাড়ায়। তারপর আবার উপর নিচ মাথা নাড়িয়ে মৃদু স্বরে আওড়ায়,”আব্বা আমি আবার কি করলাম? আমি তো শুধু…
নুসরাতের কথা নাছির সাহেব পূর্ণ করতে দিলেন না। হাত তুলে মাঝপথে থামিয়ে দিলেন। নিজেই নুসরাতের পরবর্তী কথা পূর্ণ করে দিলেন, তার কথা দ্বারা।
“তুমি বলবে আমি তো শুধু আপনাকে বলছিলাম।

নুসরাত উপর নিচ মাথা নাড়ায়। নাছির সাহেব দীর্ঘ শ্বাস ফেলে বললেন,” দেখিয়ো এরকম আমি শুধু বলছিলাম বলতে বলতে, আমাকে একদিন বলে বলে হার্ট অ্যাটাক করিয়ে ফেলবে।
নুসরাতের চোখ মুখে উদ্বেগ ফুটে উঠল। নাছির সাহেবের চোখের দিকে তাকিয়ে চিন্তিত গলায় জিজ্ঞেস করল,”আজরাইল কি আপনার টিকিট ওকে করে ফেলেছেন আব্বা?
নাছির সাহেব কিছুক্ষণ নুসরাতের দিকে বাকরুদ্ধ হয়ে তাকিয়ে রইলেন। ফিকে হয়ে যাওয়া কন্ঠে জিজ্ঞেস করলেন,”তুমি আমাকে হার্ট অ্যাটাক করিয়ে তবেই আমার পিছু ছাড়বে?
নুসরাত কারোর না শোনার মতো করে নিজ মনে আওড়াল,”আপনাকে কেন আমি হার্ট অ্যাটাক করাব, করালে তো করাব আপনার বড় ভাইকে।

নিজ মনে কথাটা শেষ করে ছবির ভিলেনদের মতো মনে মনে নুসরাত একটা হাসি দিল। বাবার দিকে তাকিয়ে মুখ খুলতে যাবে তখুনি নাছির সাহেব দ্রুত পায়ে সামনের দিকে এগিয়ে যেতে যেতে বললেন,”আর কোনো কথা নয়, তোমার সাথে কথা বললেই কথা বাড়বে আমার।
নুসরাত পিছন থেকে উদাস চোখে দাঁড়িয়ে বাবার দ্রুত পায়ে প্রস্থান দেখল। তারপর হতাশ হয়ে লাফ মেরে বসে গেল চেয়ারে। টেবিলের উপর দু-হাতের কব্জি ভর দিয়ে রেখে নিজের মুখ হাতের তালুতে রাখল। ইসরাতের দিকে এক পলক চাইতে দেখে মেয়েটা টেবিলে বসে বসে ঘুমাচ্ছে। তখন নাছির সাহেবের উপরের রুম থেকে কন্ঠ ভেসে আসে,”নাজমিন নাস্তা টেবিলে দাও, আমি আসছি।

ফ্রান্স সিটি হসপিটাল। জায়িন একটু আগেই নিজের কেবিনে এসেছে। টিফিন বক্স খুলে পরোটা এক টুকরো করে মুখের সামনে নিতেই রুমের কোথাও থেকে একটা মহিলা কন্ঠে ভেসে আসলো।
“পেইজিং চৈয়াড ফারহাড, প্লিজ কাম ইমারজেন্সি ওয়ার্ড কুইকলি। আই রিপিট ডাঃ চৈয়াড ফারহাড প্লিজ কাম ইমারজেন্সি ওয়ার্ড কুইকলি।
মুখের সামনে নেওয়া খাবার জায়িন টেবিলে রেখে দিল। টেবিলের উপর রাখা স্টেথোস্কোপ বাঁ-হাতে এক প্রকার ছু মেরে টেবিলের উপর থেকে নিয়ে এগিয়ে গেল কেবিনের দরজার দিকে।
রুমের বাহিরে বের হওয়ার আগে খোলা টিফিনের বক্সের দিকে তাকিয়ে দীর্ঘ শ্বাস ফেলল। রুম থেকে বের হতে হতে নিরাস কন্ঠে বিড়বিড়ায়,” এ-জীবনে তোর আর লাঞ্চ করা হবে না। তুই যা তোর ডিউটিতে ভাই।

নাছির সাহেব কিছু কাজে মেইন ফেক্টরিতে গিয়েছেন। ইসরাত এখনো টেবিলে পড়ে পড়ে ঘুমাচ্ছে। নুসরাত বসে বসে নখ খুঁটছে আর ইসরাত কে লক্ষ করছে। তার সন্দেহ যদি বিন্দুমাত্র সত্যি হয় তাহলে ইসরাতের বুকে একটা জোরকা ধাক্কা লাগবে। তারপর ইসরাত আর সে মিলে গান গাইবে,”জোর কা ধাক্কা হায় জোরোছে লাগা, শাদি বান গায়ি উমার কেদ কি সাজা!
ইসরাতের এই ভর দুপুর বেলা ঘুমানো নুসরাতের সহ্য হলো না। বাজ পাখির মতো গিয়ে খাঁমচে ধরল ইসরাতের সুতি কাপড়ের কামিজ।
কারোর প্রবল হাতের তাবায় ইসরাত ধড়ফড় করে উঠে বসল ঘুম থেকে। টেবিলে ঘুমানোর জন্য কাঁধে ব্যথা হয়ে গিয়েছে তার। হাত উপরে তুলে আড়মোড়া ভাঙতে লাগল। চোখ-মুখে এখনো ঘুমের রেশ। চোখ কুঁচকে রেখে বিরক্ত কন্ঠে জিজ্ঞেস করল,”কি হয়েছে?

নুসরাত দু-হাতে ইসরাতের ডাগর ডাগর চোখ গুলোর নিচের দিকে চামড়া টেনে ধরল। দাঁত কেলিয়ে ইসরাতের দিকে তাকিয়ে অবসন্নতা নিয়ে বলে,”তুই শালি এতো ঘুমাস কেন? মা আমার, তোকে যদি এখন কোনো বেডা এসে তুলে নিয়ে চলে যায়, তাহলে তুই তো ঘুমের চক্করে কিছুই বুঝবি না। এতো ঘুম কই থেকে আসে তোর?
নুসরাতের হাত ইসরাত নিজের চোখের নিচ থেকে সরিয়ে দিয়ে নুসরাতের হাতে থাপ্পড় মারে। আবার চোখ বন্ধ করে শুয়ে পড়ে ঘুম ঘুম অবসন্ন কন্ঠে বলে,”আল্লাহর বাড়ি থেকে আসে ঘুম। এবার সর বাপ আমার!
নুসরাত সরার পাত্রি না। ইসরাতের হাত তাবা মেরে ধরে টান মারতেই ইসরাতসহ চেয়ার উল্টে চলে আসলো।
মেঝেতে পড়ার ভয়ে ইসরাতের চোখ ভর্তি ঘুম শুরশুর করে সরে গেল। মুখ থেকে বের হয়ে আসলো অতর্কিত শব্দ।
ইসরাত মেঝেতে পড়ে গেছে ভেবে ভয়ার্ত চোখে আশে-পাশে চোখ বুলালো। ধড়ফড় করা কম্পিত বুক নিয়ে নুসরাতের দিকে ভ্রু কুঞ্চিত করে তাকায়। রাগী চোখে তাকিয়ে শাসানো গলায় কিছুটা চিৎকার করে বলে,”কি হইছে তোর? এরকম গরুর মতো টানছিস কেন?

নুসরাত নির্লিপ্ত দাঁড়িয়ে রইল নিজ জায়গায়। প্যান্টের পকেটে দু-হাত পুরে রেখে নির্বিকার কন্ঠে বলে,”গরুকে গরুর মতো টানতে হয়।
ইসরাত ভ্রু যুগল এক পেশে করে তীক্ষ্ণ কন্ঠে জিজ্ঞেস করে,”তুই কি আমাকে ইনডায়রেক্টলি গরু বললি?
নুসরাত এক মুহুর্ত বিলম্ব করল না। গা জ্বালানো হাসি দিয়ে উপর নিচ মাথা নাড়িয়ে বলল,”আমি তোকে ডায়রেক্টলি গরু বলছি। তো তুই কি করবি?
ইসরাত চোয়াল শক্ত করে নেয়। তারপর পুরো ডায়নিং রুম কাঁপিয়ে চিৎকার করে ওঠে। নুসরাত ইসরাতকে চিৎকার করতে দেখে সে ও ভেঙ্গিয়ে হেসে ওঠে উচ্চ শব্দে। দাঁত কেলিয়ে ইসরাতের হাত চেপে ধরে এক প্রকার টেনে হেচড়ে নিয়ে যেতে লাগল উপরে লাইব্রেরি রুমে।
ইসরাত পিছন থেকে চিৎকার করছে কোথায় নিয়ে যাচ্ছিস? নুসরাত উত্তর করার প্রয়োজন বোধ করে না। দ্রুত পদক্ষেপে উপরে উঠে। লাইব্রেরি রুমে ঢুকে ইসরাতের হাত ছেড়ে দেয়। ইসরাতকে আদেশ দিয়ে বলে,”গোলাপি ডাইরি খোঁজে বের করতে সাহায্য কর।

ইসরাত বাক্য ব্যয় করতে চাইল তার আগেই নুসরাত তর্জনী আঙুল ঠোঁটে চেপে রেখে চুপ দেখাল। ইশারায় বলল চুপচাপ খোঁজ করতে। ইসরাত কথা বাড়াল না, বিনা বাক্যে খোঁজ করতে লাগল গোলাপি ডাইরিটার। পুরো লাইব্রেরি তন্নতন্ন করে খোঁজার পর ও ডাইরিটা পাওয়া গেল না।
ইসরাত ক্লান্ত ভঙ্গিতে এগিয়ে এসে নুসরাতের কাঁধে ভর দিয়ে দাঁড়ায়। মৃদু কন্ঠে জিজ্ঞেস করল,”গোলাপি ডাইরি দিয়ে তুই কি করবি?
নুসরাত নিরুদ্ধেগ গলায় জিজ্ঞেস করে,
“খুঁজে পাসনি ডাইরি?

সে জেনো জানত গোলাপি ডাইরি খুঁজে পাওয়া যাবে না। নিজের ভাবনা সত্যি হতেই নুসরাত উচ্চ শব্দে হেসে উঠল হা হা করে। ইসরাত অবাক চোখে তাকিয়ে দেখে নুসরাতের কোনো কারণ ছাড়া হাসি। গা দুলিয়ে এতো হাসির মানে খুঁজে পায় না সে।
ইসরাতকে ওই রকম অবাক রেখে হাসতে হাসতে রুম থেকে বের হওয়ার প্রস্তুতি নেয় নুসরাত, প্রতিমধ্যে কানে ভেসে আসে সতর্কতা মিশ্রিত ইরহামের গলার স্বর। নুসরাত ভ্রু যুগল কুঞ্চিত করে ফিরে তাকায়। ইরহামকে চোরের মতো উঁকি মারতে দেখে ফাটা গলায় জিজ্ঞেস করে,” তোর কি হইছে? চোরের মতো বিহেভিয়ার করছিস কেন?
নুসরাত কথা বলতে বলতে সামনে এগিয়ে যায় দু-পা। জানালার ওপাশ থেকে মাথা বের করে লটকে চেয়ে আছে ইরহাম। নুসরাত নিজেদের জানালার কাছে দাঁড়িয়েই ইরহামের কপালে পড়ে থাকা অগোছালো চুলগুলো খাঁমচে ধরে জিজ্ঞেস করে,”কি হইছে?

ইসরাত ততক্ষণে ভ্রু কুঁচকে এসে দাঁড়িয়েছে জানালার কাছে। তার মাথার ভিতর এখনো চলছে গোলাপি ডাইরি বিষয়ক কথা। নুসরাত কোনো কারণ ছাড়া ওই ডাইরি নিয়ে কথা তুলবে না,তারপর আবার সকালে বলছিল স্বপ্ন নাকি বাস্তব, এখন আবার ডাইরি উধাও, ইসরাত একে একে সব মিলাতে গিয়ে গন্ডগোল পাঁকিয়ে দিল মগজে। নিজের অতর্কিত চিন্তায় ব্যাঘাত ঘটল ইরহামের সতর্কতা মিশ্রিত গলার আওয়াজে।
“এই শোন, দাদি আবার কান্না করছে, সে নাকি আর বেশি দিন বাঁচবে না। শেষ বারের মতো দেখা করতে চায় বড় বাবার সাথে সামনা-সামনি। হাত দিয়ে ছুঁয়ে দেখতে চায় সবাইকে, নিজের শান্তির জন্য। এসব বলে বলে আমার মাথা খেয়ে ফেলছে, কানের পোকা কান থেকে ভাগিয়ে দিয়েছে,এখন তুই বোন একটা আইডিয়া দে এদের দেশে আনব কিভাবে?
নুসরাত ঠোঁট টিপে হাসে। ইরহামের দিকে স্থির দৃষ্টি রেখে দু-হাত তুলে আড়মোড়া ভাঙে। হেয়ালি করে বলে,” কি দিবি আমাকে, যদি আইডিয়া দেই?

ইরহাম তৎক্ষণাৎ উত্তর দেয়,
“যা চাইবি, দাদি তাই তোকে দিবে।
ইসরাতের দিকে নুসরাত একবার তাকিয়ে চোখাচোখি করে নিল। দু-বোন ইশারায় নিজেদের সলাপরামর্শ শেষ করে নেয়। ইরহামকে উদ্দেশ্য করে ইসরাত আর নুসরাত এক সাথে বলে ওঠে,” দাদিকে শেষ পর্যায়ে পাঠিয়ে দেয়।
ইরহাম আঁতকে উঠে। বিস্ময়ে তার চোখ কোটর থেকে বের হওয়ার পালা। দু-পা পিছিয়ে গিয়ে মৃদু স্বরে চিৎকার করে বলে,”মানে!
ইসরাত দু-হাত ডাউন করে দেখায় কুল কুল। ইরহাম কুল হতে পারে না, শুভ্র আননে নেমে আসে গাঢ় কালো মেঘ। সামান্য আইডিয়া চাওয়ায় দু-বোন একজন জিন্দা মানুষকে বলে মেরে ফেলার কথা। কি ডেঞ্জারাস ভাই এরা!
ইসরাত মোলায়েম কন্ঠে বলে,
“দাদিকে শেষ পর্যায়ে পাঠাবি আই মিন অভিনয় করাবি দাদির মৃত্যাুর লাস্ট স্টেজ চলছে। এই জান, যায় যায় ভাব! বুঝেছিস?
ইরহাম উপর নিচ মাথা নাড়ায়। স্বস্থির নিশ্বাস ফেলতেই নুসরাত তীক্ষ্ণ চোখে তাকিয়ে কর্কশ গলায় শুধায়,” তুই কি মনে করেছিস বাল?

ইরহাম ঢোক গিলে। জানালা থেকে আরো দু-পা পিছনে সরে যায়। নুসরাত হাতের কাছে পেলে তাকে যে বর্তা তৈরি করবে তা সে জানে। নির্দিষ্ট দূরত্ব বজায় রেখে দাঁত কেলিয়ে হেসে উত্তর করে,”আমি মনে করেছিলাম তুই আর আপু দু-জনে মিলে দাদিকে গাড়ির নিচে চাপা মেরে এক্সিডেন্ট করিয়ে দেওয়ার কথা বলছিস।
নুসরাত মাথা নাড়ায় উপর নিচ, গালে তর্জনী আঙুল ঠেকিয়ে। মাথা নাড়াতে নাড়াতে বলে,”এটা ও ঠিক বলেছিস। গাড়ির নিচে চাপা মেরে দিলে আরো বেশি রিয়েলস্টিক লাগবে। তাহলে তোদের গুণধর চাচা বুঝতে পারবে তার মা অসুস্থ আর চাচাতো ভাইয়েরা ও বুঝতে পারবে তাদের দাদি অসুস্থ।
নুসরাতের কথা শেষ হওয়ার আগেই মাথায় গাট্টা পড়ল। গাট্টা মেরেছে ইসরাত। মাথায় হাত চেপে নুসরাত ইসরাতের দিকে বিরক্তি নিয়ে তাকায়। নাক ফুলিয়ে জিজ্ঞেস করে,”মারলি কেন?
ইসরাত নির্বিকার কন্ঠে জানায়,
“কথা বলার স্টাইল বদলা। এরকম কথা বললে মানুষের খারাপ লাগবে আর ওর চাচা হলে তোর কি! তোর কি কিছু লাগে না।

ইসরাতের প্রশ্ন শুনতেই ধুপ করে বুকের ভিতর আগুন জ্বলে ওঠে নুসরাতের। তাচ্ছিল্যের হাসি হেসে ব্যগ্র কন্ঠে উত্তর দেয়,” না, আমার কিছু লাগে না।
ইসরাত ইরহামের দিকে তাকায়। নুসরাতের কথায় ধ্যান না দিয়ে জিজ্ঞেস করল,”দাদির শরীর এখন কেমন?
ইরহাম মুখ হাসি-হাসি করে বলে,
“জি ভালো আপু।
নুসরাত দাঁতে দাঁত চেপে কটমট করে বলল,
“তোর এই ঠোঁটের নিচের মেলানো দাঁতগুলো ভেঙে দেই,বিচ্ছিরি লাগছে তোর এই মেলানি।
তারপর লেগে গেল দু-জনের মধ্যে ঝগড়া। কার দাঁত কেমন? কার নাক কেমন? উল্টো নাকি ত্যাড়া, দাঁত বাঁকা, লম্বা নাকি বড় বড়। ঠোঁট কেমন? কেউ কারোর কথা মাটিতে ফেলতে দেয় না, একজন এক কথা বলে আরেকজন আরেক কথা বলে। নুসরাত নিজের জায়গায় আর স্থির দাঁড়িয়ে থাকতে পারল না। দু-হাত সামনের দিকে তুলে তেড়ে গেল ইরহামের চুল ধরার জন্য। ইরহাম জানালা থেকে পাঁচ হাত দূরত্বে সরে গিয়ে দাঁড়ায়। ওখান থেকে দাঁড়িয়ে জিহ্বা বের করে নুসরাতকে ভেঙ্গায়। তারপর ভেংচি কেটে হেলেদুলে চলে গেল রুম থেকে বের হয়ে।

রেস্টুরেন্টে মাঝ বরাবর একটি সিট বুক করে বসে আছে আবির। চোখ মুখে স্পষ্ট বিরক্তি ফুটে আছে তার। হাতের ঘড়ি চেক করে দেখে নিল সময়। কাঙ্কিত ব্যক্তিটির আসার কথা ছিল চারটার সময় এখন বাজে চারটা ত্রিশ মিনিট,তার এখনো কোনো পাত্তা নেই। বিরক্তির চরম শিখড়ে পৌঁছে দিয়ে তাকে আরো পনেরো মিনিটের মতো অপেক্ষা করিয়ে কাঙ্কিত ব্যক্তি টি আসলো।
কাঙ্কিত ব্যক্তিটির উচ্চতা পাঁচ ফিট ছয় ইঞ্চি। দেখে বোঝার উপায় নেই যে, এ ছেলে নাকি মেয়ে। মাথায় ক্যাপ, মুখে কালো ওয়ান টাইম মাস্ক, চুলগুলো কি করে রেখেছে, এক আল্লাহ ভালো জানে। দ্রুত পদক্ষেপ ফেলে সামনে আগায় মেয়েটা। চোখ বুলায় চারিদিকে, যখন আবির অক্ষিকোটরের মধ্যে আবদ্ধ হয় তখন বড় বড় পা ফেলে এগিয়ে যায় মেয়েটা আবিরের টেবিলের দিকে।

মেয়েটার হাঁটার স্টাইল দেখে ও আবির বিরক্ত হয়। নাক কুঁচকে ছে্হ বিশিষ্ট কিছু শব্দ ব্যয় করে। যা দূর থেকে হেঁটে আসা মেয়েটা, ছেলেটার মুখের অভিব্যক্তি দেখে বুঝে নেয়,কি বলছে! তার একটা দারুণ ক্ষমতা আছে, মানুষের ঠোঁট নাড়ানো দেখলেই তার মুখের কথা পড়ে নিতে পারে। মেয়েটা হাসে। পায়ের গতি বাড়িয়ে এগিয়ে যায় টেবিলের সামনে। কোনো প্রকার হায় হ্যালো করে না, শব্দ তুলে একটা চেয়ার টেনে বসে পড়ে।
ক্যাপটা মাথা থেকে খুলে না, ওইভাবে থাকে। শুধু ওয়ান টাইম মাস্কটা খুলে নেয়। টেবিলের উপর অবেহেলা নিয়ে ফেলে দেয় মাস্ক। নিজের কাঁধের ব্যাগ পাশের চেয়ারে নামিয়ে রেখে পানির পট বের করে। ঢকঢক করে পানি পান করা শেষে পানির পট আবার ঢুকিয়ে রাখে ব্যাগে। এরপর তাকায় সামনে বসা আবিরের দিকে। যে নাক তুলে বিরক্তি নিয়ে তার দিকে তাকিয়ে আছে।

“কি বলার জন্য ডেকে পাঠিয়েছ বলো?
নুসরাত শীতল কন্ঠে কথাটা বলে। আবির নুসরাতের মুখের দিকে তাকাতেই এতক্ষণের গরম হওয়া মেজাজ শীতিল হয়ে আসে। ঠান্ডা গলায় জিজ্ঞেস করে,” কিছু খাবে?
নুসরাত না ভঙ্গিতে মাথা নাড়ায়। প্রশ্নাত্মক চাহনি নিক্ষেপ করে আবিরের দিকে। কিছুটা শ্লেষ মিশিয়ে কটাক্ষের সহিত বলে,”এতো জরুরি ভঙ্গিতে ডাকলে,কি বলার জন্য? এখন না বলে বসে রয়েছ কেন? বলো কি বলবে?
আবির কিছু বলতে নিবে নুসরাত হাত তুলে কথা থামিয়ে দেয়। শীতল, শান্ত দৃষ্টি অবিচল স্থির রাখে সামনে বসা পুরুষটার দিকে। আরো একবার ঠেস মেরে টেনে টেনে বলে,”তোমার অফিস কলিগ, তোমাকে দেখে নেবে না, আমার সাথে, আরে আরে, মাস্ক পরো আগে না হলে তো তোমার চাকরি চলে যাবে।

নুসরাতের কন্ঠে স্পষ্ট কটাক্ষ। আবির বুঝল নুসরাত খুব সূক্ষ্মভাবে তাকে অপমান করছে। আবির নুসরাতের দিকে তাকাতেই দেখল মেয়েটার তার দিকে তাকিয়ে নেই, সে মনযোগ সহকারে নিজের হাতের নখ দেখছে। মনে হচ্ছে এখন নখ দেখা ছাড়া তার কোনো কাজ নেই। নুসরাত নখের দিকে তাকিয়ে থেকে আবিরকে জিজ্ঞেস করে,”কি বলবে বলো? এভাবে হা করে মুখের দিকে তাকিয়ে থাকবে না, ছাগলের মতো লাগে তোমাকে?

আবিরের শীতিল হয়ে আসা মেজাজ আবার গরম হয়ে যায় নুসরাতের খোঁচা মেরে মেরে বলা কথায়। মনে ভিতর নাড়া দেয় কিছু অহংকার মূলক প্রশ্ন। নিজমনে ভাবে, এই মেয়ের এতো ভাব কিসের,একে থাকে তো বস্তিতে,তার উপর পরে আবার হকার্স মার্কেটের কাপড়, জুতো পরে ও স্লিপার, যা রিলেশনে যাওয়ার পর থেকে দেখছে পরে। এ কেন এতো ভাব নেয়, আসে কোথা থেকে এতো ভাব আর এটিটিউড এর। মনে ভিতর ফুটে উঠা চাপা ক্ষোভ এবার তিরতির করে বাহিরে বেরিয়ে আসে। দাঁতে দাঁত চেপে শ্লেষ মিশিয়ে জিজ্ঞেস করে,”তোমার এতো এটিটিউড মেনে নেওয়া যায় না নুসরাত, কারণ তুমি থাকো তো একে বস্তিতে তার উপর পরো আবার লোকাল বাজারের কাপড়,আমার ফ্যামেলি স্ট্যাটাস কত হাই জানো তুমি? আর তোমার ফ্যামিলি স্ট্যাটাস কত লো এটা একবার ভেবে দেখেছ? তুমি আবার স্বপ্ন দেখো আমাকে বিয়ে করার। বস্তির মেয়ের এতো ভাব কিসের আমি বোঝে পাই না!
নুসরাত আবিরের কথা না শোনার মতো করে হাতের নখ দেখতে থাকল। নখের দিকে তাকিয়ে থেকে উত্তর করল,”আমার কোনো ইচ্ছে নেই, তোমার ফ্যামেলি স্ট্যাটাস কত হাই লেভেলের তা জানার।

নুসরাতের কাছ থেকে কোনো পাত্তা না পেয়ে আবির অজগর সাপের মতো ফুলে ওঠে। নুসরাতের হাত চেপে ধরতেই যাবে, নুসরাত নিজের হাত সরিয়ে নেয়। মাথা দু-পাশে নাড়িয়ে সাবধান করে দিয়ে বলে,”উহু, একদম না! আমি তোমাকে এই অধিকার দেইনি, আমার শরীর স্পর্শ করার।
আবির নিজের হাত গুটিয়ে নিল, কিন্তু চাপা ক্লেশে শরীর মন দুটোই পিষ্ট হলো। দাঁত কটমট করে নুসরাতের দিকে তাকিয়ে বলল,”তুমি জানো তোমাকে দেখলে কেউ বলবে না তোমার বয়স ঊনিশ। এই বয়সে যে হাল করেছ, যে কেউ তোমাকে দেখলে বলবে পঞ্চাশ বছরের বুড়ি।

নুসরাত হা হা করে হেসে উঠল। কথাগুলো মাছি তাড়ানোর ভঙ্গিতে বাতাসে উড়িয়ে দিয়ে আবিরকে শুধরে দিয়ে বলে,”তাহলে তো কম লাগে আমাকে দেখতে। আমার বয়সের সাথে আরো প্লাস ফাইভ এড করো, তাহলে যে বয়স আসবে ওইটা আমার বয়স। এতো কম বয়সী আমাকে দেখা যায়, তা তো আমি জানতাম না। নিজের বয়স থেকে আরো পাঁচ বছর কম লাগে, যুবতি দেখা যায় আমাকে কিভাবে!
আবির আর নিজেকে দমিয়ে রাখতে পারল না। কোনো বাক্য ব্যয় ছাড়া কথা তুলল,”আমার ফ্যামেলি তোমাকে মেনে নিবে না। তারা ঘরের জন্য বউ চায় যে তাদের খেয়াল রাখবে, আমার সাথে সংসার করবে, তোমার মতো ডিঙি মেয়ে চায় না তারা, যে সারাদিন বাহিরে ঘুরে বেড়াবে ছেলেদের মতো করে, তাই তোমার সাথে আমার সম্পর্কের ইতি এখানেই ঘটাতে আসলাম। আমার বাবা-মা আমার জন্য মেয়ে চয়েস করে নিয়েছে মেয়েটি যেমন ভদ্র তেমন সুন্দর, তার ব্যবহার দেখলে তো যে কেউ বলবে মারহাবা। আর বাড়ির সকল কাজ সে একা হাতে সামলাতে পারে, মেয়েটা সর্বগুণে সম্পন্ন। তার দিক থেকে তো, তুমি একজন অকর্মার ডেকি, যে সারাদিন হাতে একটা মোবাইল নিয়ে গলির মোড়ে দাঁড়িয়ে বাচ্চাদের সাথে ক্রিকেট খেলো। কাজ কি পারো তুমি যে, তোমাকে আমি বিয়ে করব এ স্বপ্ন তুমি দেখো?

নুসরাত দু-হাত তুলে আড়াআড়ি বুকে বাঁধল। চোখে মুখে নেই কোনো দুঃখ। যেন একে পিছন ছাড়াতে পেরে সে খুব খুশি। নিজের পেটে খিল মেরে খুশি আটকে রেখে জিজ্ঞেস করল,”বাড়ির জন্য বউ আনছো না, কাজের বুয়া নিয়া আসছ? কোনটা?
আবির মৃদু গলায় চিৎকার করে ওঠে,
“হোয়াট?
নুসরাত অবিচল কন্ঠে ভয়ার্তহীন ভাবে জিজ্ঞেস করে,
” কাজের বুয়া আনছ নাকি বাড়ির বউ আনছ? আচ্ছা এটা বলো, তোমার বউয়ের বয়স কত? ষোল, সতেরো নাকি পনেরো?
নুসরাত নিজে প্রশ্ন করে নিজে আবার প্রশ্নের উত্তর দেয়। তর্জনী আঙুল গালে ঠেকিয়ে ভাবার মতো করে বসে রয়।
আবির চোখ মুখ কঠিন রেখে উত্তর দেয়,
“ষোল।
নুসরাত হা হা করে পুরো রেস্টুরেন্ট কাঁপিয়ে হেসে ওঠে এবার। আবিরকে তার কাছে জোকারের মতো লাগছে। দাঁত কেলিয়ে হেসে বলে,”কুল ব্রো কুল! উত্তেজিত হচ্ছো কেন? বুঝতে পারছি এস-এ-সি ক্যান্ডিডেট কোনো মেয়ে বিয়ে করছ তাই না? একদম কচি খুকি! আবির একটা কথা জানো কি, ওই কচি খুকি তুমি যদি বলো হাঁটো, ওই খুকি হাঁটবে, বসো বললে বসবে, শুয়ে পরো বললে শুয়ে পরবে,এখান থেকে নড়বে না বললে নড়বে না, আবার আমার সামনে হাগো বললে, হাগবে। মেয়েটা প্রথমে একটু লজ্জা পাবে তারপর রাঙা মুখ নিয়ে স্বামীর কথা শুনে ওখানেই বসে হেগে স্বামীর কথা রাখবে।

নুসরাত কথা বলতে বলতে হাসল। আবিরের মুখ ততক্ষণে রাগে লাল বর্ণ ধারণ করেছে। নুসরাত তাকে কোনো কথা বলার সুযোগ দেয় না। ঢোক গিলে সূক্ষ্ম গলা ভিজিয়ে নিয়ে বলতে লাগল,”তরতাজা মাল নিয়ে আসছ তাই না? এই বাচ্চা মেয়েটার জীবনটা অকালে ঝড়ে যাবে, আহ বড় কষ্ট পাইলাম মেয়েটার জন্য। আমার পক্ষ থেকে এক বুক ভরা সমবেদনা দিয়ো তোমার হবু বুয়াকে, আই মিন হবু বউকে। মেয়েটাকে শাড়ি পরিয়ে এনে তোমার মা-বাপ পুতুল বানিয়ে রাখবে। বেচারি!
নুসরাত ঠোঁট উল্টে মুখ দুঃখি বানিয়ে ফেলল। তারপর হাতের কাছে থাকা টিস্যু বক্স থেকে টিস্যু নিয়ে থু করে থুথু ফেলল। আবির উঠে দাঁড়াল। এক আঙুল তুলে নুসরাতকে শাসাতে নেবে নুসরাত বসা থেকেই তাবা মেরে আবিরের আঙুল নিজের হাতের তালুর মধ্যে চেপে মোচড় মারল। তারপর দু-পাশে ঠোঁট চেপে হেসে, দাঁতে দাঁত চেপে নিচু গলায় বলল,”একদম আমার দিকে আঙুল তোলার চেষ্টা করবে না। আঙুল ভেঙে, গলার লকেট বানিয়ে পরিয়ে দিব।
নুসরাতের কথা শেষ হতেই আবির নুসরাতকে তিরস্কার করে বলে ওঠে,”তুমি যে ছোটলোক তার প্রমাণ এই। কথা বলার ভাষা এমন কেন তোমার? একটা হাই কোয়ালিটির রেস্টুরেন্টে বসে তুমি কি ভাষা ইউজ করছ। লজ্জায় আমার মাথা কাটা যাচ্ছে। কোন দুঃখে, তোমার মতো বস্তি, থেকে উঠে আসা একটা মেয়ের পিছনে আমি আবির পড়েছিলাম আল্লাহ ভালো জানে?

নুসরাত হাত দিয়ে চুটকি বাজায়। নিজের দিকে আবিরের দৃষ্টি ফিরিয়ে নিয়ে বলে,” ও হ্যালো মিস্টার! এদিকে,,
আবির নুসরাতের দিকে অনিহা নিয়ে তাকাতেই কাঁধ সমান মেয়েটি হাত ঘুরিয়ে এনে ঠাস ঠাস করে দুটো থাপ্পড় মারে। থাপ্পড়ের উঁচালো শব্দে রেস্টুরেন্টে বসা লোকেরা ফিরে ফিরে তাকাল তাদের দিকে। অনেকে নিজেদের মোবাইল পকেট থেকে বের করে ভিডিও করা শুরু করল। নুসরাত উল্টো দিকে ঘুরে দাঁড়ানো তে ক্যামেরায় শুধু তার পিছনের অংশ দেখা গেল।
আবিরকে এক আঙুল তুলে শাসিয়ে বলল,
“তুই কি? আমাকে বলছিস বস্তি থেকে উঠে এসেছি, তুই তো নিজেই লো কোয়ালিটির। একটা হাই স্কুলে পড়া কচি মেয়েকে বিয়ে করছিস,তা আবার গর্বে বুক ফুলিয়ে এসে আমাকে বলছিস। তোদের মতো পুরুষদের ধিক্কার। যারা বাচ্চা,বাচ্চা মেয়েগুলোকে পড়াশোনার বয়সে বিয়ে করিস, আর ঐসব পুরুষদের ও ধিক্কার যারা নিজেদের মেয়ের পড়ার বয়সে তোদের মতো বুড়ো,নিচ মানুসিকতার ছেলেদের সাথে ধরে বিয়ে দেয়। শালা কুত্তা..! থু তোকে, তোর ওই বউয়ের বাপকে ও থু!

আবির কিছু বুঝে ওঠার আগেই আরো একটা দাঁত নাড়ানো থাপ্পড় পড়ল তার গালে। চিনচিনে ব্যথায় পুরো গাল অসাড় হয়ে গেল আবিরের। গালে হাত চেপে কিছু বলতে নিবে, নুসরাত পাত্তা দিল না। অবহেলা নিয়ে ফেলা মাস্ক তাবা মেরে হাতে তুলে নেয়। চেয়ারের উপর রাখা ব্যাগ কাঁধে তুলে নেয়। মাস্ক মুখে পরে নিয়ে দ্রুত পায়ে পিছন ঘুরে। এই লম্পটের মুখ দেখার আর কোনো আগ্রহ জাগছে না তার। রেস্টুরেন্টে থাকা মানুষ গুলো এতক্ষণে জমাট বেঁধে ফেলেছে তাদের টেবিলের আশে-পাশে। জমা হওয়া সবাইকে এক প্রকার অনিহা নিয়ে পাশ কাটিয়ে বের হয়ে যায় নুসরাত রেস্টুরেন্টের বাহিরে।

প্রিয় প্রণয়িনী ২ পর্ব ৩

আবির এখনো হতবিহ্বল চেহারা নিয়ে তাকিয়ে আছে নুসরাতের যাওয়ার দিকে। তার ডান-হাত এখনো গাল চেপে ধরে রেখেছে । মেয়েদের হাতে এতো শক্তি থাকে, আজ এই থাপ্পড় না খেলে সে জানতেই পারত না। এটা মেয়ের হাত নাকি কোনো ইস্পাত, রড? অন্তকরণে বয়ে চলা প্রশ্নের বাহার, অন্তকরণে রয়ে গেল। আবির গালে হাত দিয়ে জিম মেরে দাঁড়িয়ে রইল এক জায়গায় অনেকক্ষণ। ততক্ষণে ভিডিওটা ফেসবুক, ইন্সট্রাগ্রাম, টিকটিক, বিভিন্ন সোসাল সাইটে ঝড় তুলেছে। সবাই মেয়েটার সাহসিকতার দেখে অবাক হচ্ছে, সাথে প্রশংসা ও করছে।

প্রিয় প্রণয়িনী ২ পর্ব ৫

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here