প্রিয় প্রণয়িনী ২ পর্ব ৭

প্রিয় প্রণয়িনী ২ পর্ব ৭
জান্নাত নুসরাত

রৌদ্ধউজ্জ্বল একটি নতুন দিনের সূচনা। সুন্দর দিনের সূচনা বাহিরে হলেও সিলেট সিটি হসপিটালের ভিতরে থাকা মানুষের জন্য আজকের দিনটা সুন্দর নয়।
সিটি হসপিটাল। সিলেটের সুনামধন্য একটি হসপিটাল। সেই হসপিটালের পোর্চে দাঁড়িয়ে চার মাথা এক সাথে কিছু একটা আলোচনা করছে। এই চার মাথা একসাথে হওয়া মানেই গন্ডগোল একটা পাকবেই,তা হোক ছোট খাটো বা বড়সড়। দূর থেকে দেখলে যে-কেউ ভাববে এখানে কোনো আলোচনা হচ্ছে কিন্তু সামান্য এগিয়ে আসলে বোঝা যাবে আদোও এখানে কোনো আলোচনা নয়, ছোট মাথা ওয়ালারা বড় মাথাকে সান্ত্বনা দিচ্ছে।

ইরহামের এক হাত ইসরাতের কাঁধে। ইসরাত কান্নার দমকে বারবার দোলছে নিজ জায়গা থেকে। যে-কোনো সময় পড়ে যাবে এই জন্য ইরহাম বড় ভাইয়ের মতো নিজের হাত দিয়ে সামলানোর চেষ্টা করছে বড় বোনকে। বারবার সান্ত্বনা দিচ্ছে দাদির কিছুটি হবে না বলে।… ইসরাত নিজের কাজে তবু ও বহাল। সে বিশ্বাস করতে পারছে না দাদি সত্যি হার্ট অ্যাটাক করেছে। গত দু-দিন যাবত মেহেরুন নেছা হসপিটালে আই-সি-ইউ তে ভর্তি। তারা সকলেই প্রথমে মনে করেছিল মেহেরুন নেছা প্ল্যান কার্যকর করছেন তাই ওতো গুরুত্ব দেয়নি কেউ, যখন এসে ডাক্তার দেখানো হলো তখন জানা গেল মেহেরুন নেছা হার্ট অ্যাটাক করেছেন। একে তো সত্যকে মিথ্যে ভেবেছে তার অপরাধ বোধ, দুইয়ে দাদির শরীর গত দু-দিন যাবত যেমন ছিল তেমন রয়েছে। বিন্দুমাত্র ভালো হয়নি। সেই দুঃখে চোখ ফেটে কান্না আসছে।

আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন

নুসরাত অনেকক্ষণ কান্না দেখল ইসরাতের নিস্পৃহ ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে। সান্ত্বনা সূচক বুলি আওড়াল না, উল্টো মুখ শক্ত করে, দু-হাত বুকে আড়াআড়ি বেঁধে দাঁড়িয়ে রইল। কিৎকাল কাটার পর নুসরাত দাঁতের কপাটি চেপে বলে উঠল,”তুই কি আমাকে বাড়িতে যেতে দিবি আপা?
নুসরাত যখন অত্যাধিক পরিমাণ কোনো কিছু নিয়ে স্ট্রেস হয়, বিরক্ত হয়, বা রাগ করে তখনই ইসরাতকে আপা ডাকে। নুসরাতের আপা ডাকতে দেরি ইসরাতের গলার স্বর আরেকটু বেশি বাড়তে দেরি হলো না। হু হু শব্দ তুলে কান্না তুলল। নুসরাত ব্যগ্র চাহনি কিছুক্ষণ ইসরাতের দিকে দিয়ে দাঁতে দাঁত পিষে আওড়াল, “ইসরাত তোকে পিটাতে ইচ্ছে হচ্ছে আমার। দেখ, বোন আমার হাতে কেমন নিশপিশ করছে। এমন এক চড় লাগাব এখন, তুই এই দেশে থাকবি কি না সন্দেহ আছে।
কথাটা শেষ করতে পারল না, প্রথমবারের মতো ইরহামের একটা জোরালো থাপ্পড় এসে লাগল নুসরাতের গালে। ইরহাম তর্জনী আঙুল তুলে শাসাল,

“তোর কোনো ফিলিংস না থাকতে পারে, কোনো কষ্ট না থাকতে পারে, তুই রোবট হতে পারিস, আমরা নয়! আমরা মানুষ তোর মতো ভিনগ্রহের প্রাণী না, যে আমদের ফিলিংস থাকবে না, তো নিজের মুখ বন্ধ কর, আর চুপচাপ বাড়িতে যা। আমি আপুকে সামলে নিব।
নুসরাত ফুস করে শ্বাস ফেলল। নিজের রাগ নিজের ভিতর সমাধি দেওয়ার বিন্দুমাত্র প্রচেষ্টা। রাগ যখন কমলো না মুখে হা করে বাতাস পুরে আবার ফুস করে ছেড়ে দিল। ইরহাম আর আহান নুসরাতের কাছ থেকে ব্যতিক্রমী কোনো মনোভাব না পেয়ে এলোমেলো ইসরাতকে সামলে নিয়ে চলে গেল অন্যদিকে।
সবাই সরে যেতেই ভয়, ডরহীন নুসরাত নিজের হাত নিয়ে গালে রাখল। খুবই হালকা হাতে থাপ্পড় মারার অংশে উপর নিচ স্পর্শ করল। চিনচিনে ব্যথায় গাল অবস হয়ে গিয়েছে। চোখ নিচের দিকে রেখে মেইন গেটের দিকে হাঁটতে হাঁটতে বারবার গালে হাত বুলালো।

হসপিটালের গেটের মধ্যে বিদঘুটে কোলাহল। এক দল পুরুষ দাঁড়িয়ে আছে! দাঁড়িয়ে কি করছে? নুসরাত নিজেকে কৌতূহলী হয়ে প্রশ্ন করে! আবার উত্তর করে, নিজেদের সাংসারিক আলাপ করছে। মেয়েরা যখন সাংসারিক আলাপ করতে পারে পুরুষরা ও করতে পারে। অস্ত যাওয়া সূর্যের মতো বিষন্ন, তেজহীন আলোর মতো ধীরে ধীরে হেঁটে গেল গেটের দিকে। মেয়েরা যেমন হাঁটে তেমন ভাবে হেঁটে গেল।
হঠাৎ সূর্য মেঘের আড়ালে ঢেকে গিয়ে আকাশে আঁধার নামল। নিভৃতে হাঁটা নুসরাতের মুখে আরো বেশি আঁধার নামল। গেটের সামনে পৌঁছাতেই এক দল তাড়াহুড়ো করে গেটের ভিতর ঢোকতে থাকা পুরুষদের সাথে ধাক্কা লাগল নুসরাতের। তেজহীন নুসরাত আজ আর ঝগড়া করল না। ইরহামের হাতের এক থাপ্পড় খেয়ে চিবুক যে গলা গিয়ে ঠেকেছে সেখান থেকে চিবুক উপরে তোলার কোনো ইচ্ছে প্রকাশ করল না। তাই চোখ নিচের দিকে রেখে ভদ্র গলায় স্যরি বলতে যাবে মনে হলো গলার কাছে কিছু আটকে আছে। তার কথা বলার আগেই ও-পাশের পুরুষগণ তাড়াহুড়ো করে ভিতরে চলে গেল।

নুসরাত স্যরি বলতে হবে না ভেবে শব্দ করে শ্বাস ফেলল। ঝিমিয়ে যাওয়া শরীর টেনে নিয়ে মেইন রোডের দিকে পা বাড়াবে পিছন থেকে মহিলা কন্ঠ ভেসে আসলো,”মেজ ভাইয়ের মেয়ে?
নুসরাতের পা আপনা-আপনি থেমে গেল। অতঃপর মনের ভুল ভেবে দ্বিতীয় বারের মতো পা বাড়াতে যাবে পিছন থেকে শব্দ আসলো,”আমি তোমাকে বলছি নুসরাত?
নুসরাতের কপালে ভাঁজ পড়ল দু থেকে তিনটা। সামনের দিকে তাকিয়ে নিজেকে নিজে জিজ্ঞেস করে আমার সাথে আবার কি দরকার হতে পারে এই ভদ্র মহিলার! তারপর নিজেই বলে, পেছন ফিরলে এমনি বুঝবি। নিজের মনে নিজের সাথে বোঝা-পড়া শেষে এক মুহুর্তে বিলম্ব না করে আড়ষ্ট চোখে পেছনে তাকায়। আর তখনই চোখের মণিতে ভেসে ওঠে পয়তাল্লিশ উর্ধ্ব বয়সের ভদ্র মহিলা। ভদ্র মহিলাকে চিনা পরিচিত ঠেকল তার কাছে। আর যখন ঠিকঠাক চিনতে পারল তখন তার ভিতর নড়ে ওঠল তীব্র গতিতে। খুব ভালো ভাবে টের পেল হৃৎপিন্ডের অস্বাভাবিক কম্পন। না চাইতে পায়ের আঙুল শিরশির করে উঠল। নিজের নার্ভাসনেস ঢাকতে বুড়ো আঙুলের সাহায্যে স্লিপারে খুঁচাতে লাগল। মুখের ভিতর মনে হলো কেউ আমের গুঠি ঢুকিয়ে দিয়েছে জোর করে। গলা থেকে কথা বের হলো না বিস্ময়কর ঘটনায়। নিজের অত্যাধিক বিস্ময় সামলানোর জন্য এক পলক চোখ মাটিতে রাখতেই সেখানে ভেসে ওঠল অবাঞ্চিত কিছু দৃশ্য। আর সেই দৃশ্য চোখে ভাসতেই দাঁতে দাঁত চেপে কড়মড় করে শব্দ করল। চায় না সে এই দৃশ্য দেখতে তাহলে বারবার কেন এই দৃশ্য তার চোখের সামনে ভেসে ওঠে।

নিজের এই অত্যাধিক রাগের উপর ও নুসরাতের ক্রোধ। যখন-তখন এসে যায় আবার ফুস করে কখন কোথাও উড়ে যায়। নিজের রাগ সামলানোর জন্য চোখ বন্ধ করে ফুস করে শ্বাস ফেলল। গলায় নেমে আসা চিবুক ঝট করে উপরে তুলে সেকেন্ডের ভিতর নিজের আড়ষ্টতা লুকিয়ে এক নিমেষেই মেকি হাসি ঠোঁটে নিয়ে এসে জিজ্ঞাসার চোখে তাকায় সামনের ভদ্র মহিলার দিকে। ঠোঁটে ঠোঁট চাপতেই থরথর করে কেঁপে ওঠে ঠোঁট। নুসরাত ভিতরে ভিতরে নিজের ঠোঁটের উপর বিরক্ত। এরকম থরথর করে কেঁপে কি বুঝাতে চায় তার ঠোঁট। যা বোঝাতে চায়, বোঝাক! এখন ভদ্রমহিলার কথার উত্তর দেওয়া জরুরি তার কাছে মনে হলো। নুসরাত ঈষৎ হেসে নিস্প্রভ চোখে ভদ্র মহিলার দিকে তাকিয়ে তর্জনী আঙুল নিজের দিকে তুলে জিজ্ঞেস করল,”আপনি আমাকে ডাকছেন আন্টি?
ভদ্র মহিলা অবাক হন। নিজের অবাকতা প্রকাশ করলেন না। সংগোপনে নিজের ভিতর লুকিয়ে নিলেন। নুসরাত সূক্ষ্ম চোখে লক্ষ করে ভদ্র মহিলার অবাকতা লুকিয়ে ফেলা। নিজ মনে হাসে ঈষৎ। ভদ্র মহিলার চোখে দ্বিধা স্পষ্ট ফুটে উঠছে। দু-হাত মেলে নুসরাতকে জড়িয়ে ধরবেন, নুসরাত হাত তুলে থামিয়ে দিল। ভ্রু যুগল হালকা নাড়িয়ে জিজ্ঞেস করে,”আমি কি আপনাকে জানি আন্টি?

ভদ্র মহিলা নুসরাতের নিষেধ মানলেন না। অবজ্ঞার চোখে সেদিকে তাকিয়ে দু-হাতে ঝাপটে জড়িয়ে ধরলেন নুসরাতকে।
অপ্রত্যাশিত এই ঘটনায় নুসরাত বাকরুদ্ধ হয়ে গেল। ক্লান্তিতে ছোট ছোট হয়ে আসা চোখ গুলো এক নিমেষেই প্রশস্থ হয়ে গেল। বিস্ময়ে চোখে কোটর থেকে বের হওয়ার পালা তখন ভদ্র মহিলার মিষ্টি হাসির শব্দ তার কানে গেল। ভদ্র মহিলা বলছেন,”আমি তোমার বড় মা। চিনতে পেরেছ?
নুসরাত মাথা নাড়ায় উপর নিচ। সামনের দিকে নিষ্প্রাণ দৃষ্টি স্থির রেখে মোলায়েম কন্ঠে আওড়ায়,
” জি, চিনতে পেরেছি।
ভদ্র মহিলা নিজের বেষ্টনী থেকে নুসরাতকে বের হতে দিলেন না। নুসরাত ক্লান্তিতে ঝিমিয়ে আসা কন্ঠে বলে,”আমার বাড়িতে যেতে হবে বব…

মুখ দিয়ে আসলো না বড় আম্মু শব্দটা। নিদারুণ অস্বস্থিতে এলোমেলো শব্দ বের হলো। ঠোঁটে ঠোঁট টিপে বাক্য সাজালো নিজ মনে। সেই বাক্য সাজানোতে বিঘ্ন ঘটিয়ে লিপি বেগম জিজ্ঞেস করেন,”হ্যাঁ বলো, কি বলছিলে?
নুসরাত নিজের আড়ষ্ট হয়ে যাওয়া বুলি গুলো টেনে টুনে জিহ্বায় নিয়ে আসে। কন্ঠে বিনয় নিয়ে এসে বলে,”বড় আম্মু আমাকে বাড়িতে যেতে হবে, সারারাত হসপিটালে ছিলাম ফ্রেশ হওয়া প্রয়োজন।
কথাটা শেষ করে নুসরাত দূরে সরে গেল লিপি বেগমকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে। লিপি বেগম তীক্ষ্ণ চোখে শুধু দেখলেন নুসরাতের নিরর্থক অভিমত পোষণ করা। মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বলেন,”যাও বাড়িতে যাও। আমরা একটু পরই আসছি।

তাদের কথার মধ্যেই গেটের কাছ থেকে কেউ ডেকে উঠল মাম্মা বলে। লিপি বেগম এক পলক পিছু ফিরে চেয়ে চেঁচিয়ে বললেন,”কি হয়েছে আরশ?
আরশ ফোনের দিকে তাকিয়ে থেকে নির্লিপ্ত ভরাট পুরুষালি গলায় বলে,”পাপা তোমাকে ডাকছে। তাড়াতাড়ি আসো। আর প্লিজ মাম্মা মুখে মাস্ক লাগিয়ে নিও।
লিপি বেগম বিরক্তিতে কপাল কুঁচকে ফেললেন। নুসরাতের কাছ থেকে বিদায় নিতে গেলেন তার আগেই নুসরাত সালাম দিয়ে বিদায় নিয়ে নিল। দ্রুত পা বাড়াল সামনের দিকে। সেকেন্ডের ভিতর রাস্তা পার হয়ে লিপি বেগমের চোখের সামনে থেকে উধাও হয়ে গেল।

আরশ লিপি বেগমকে আসতে না দেখে মোবাইল থেকে চোখ উপরে তুলে। ভ্রু কুঁচকে বিরক্তি নিয়ে জিজ্ঞেস করে,”ওয়াট মম? কি হয়েছে এখনো দাঁড়িয়ে আছো কেন? বৌমা তো ভিতরে। আর কার সাথে কথা বলছিলে?
আরশের দিকে নাক কুঁচকে তাকালেন লিপি বেগম।আরশ নির্বিকার চোখে দেখে লিপি বেগমের অবিচল চোখে তার দিকে তাকিয়ে থাকা। আরশ ঠাট্টার স্বরে জিজ্ঞেস করে,”এভাবে তাকানোর কি আছে! আমাকে নতুন দেখছ? নাকি আগের তুলনায় বেশি হ্যান্ডসাম হয়ে গেছি? আচ্ছা বলো কার সাথে কথা বলছিলে?
আরশ মোবাইল পকেটে ঢুকিয়ে রাখতে রাখতে জিজ্ঞেস করে। কথা শেষ করে লিপি বেগমের দিকে তাকিয়ে ভ্রু নাচায়। কথার শব্দ গম্ভীর হলেও অত্যাধিক শান্ত। নরম চোখে মায়ের দিকে তাকিয়ে থাকে প্রশ্নের উত্তর পাওয়ার আশায়। লিপি বেগম ক্ষীণ হেসে বললেন”তুই বল কে হতে পারে?
আরশ হাঁটতে হাঁটতে গালে হাত দিয়ে একটু ভাবার মতো অভিনয় করে। দশ সেকেন্ড পরে দু-পাশে মাথা নাড়িয়ে বোঝায় সে জানে না কে! লিপি বেগম আরশকে ঠাট্টা করতে দেখে মিছিমিছি রাগ করে বলতে লাগলেন,”তোর মেজ আব্বুর….

কথা শেষ হওয়ায় আগেই নাছির সাহেবের সাথে দেখা হলো তাদের। নাছির সাহেবকে দেখতেই লিপি বেগম কিছু বলতে যাবেন, নাছির সাহেব সালাম দিলেন। লিপি বেগম সালাম গ্রহণ করে বললেন,”কেমন আছেন মেজ ভাই?
নাছির সাহেব মাথা নাড়ালেন। ক্লান্তিতে ভেঙে আসা কন্ঠে বললেন,”জি ভালো ভাবি! আল্লাহ ভালো রেখেছেন। আপনি কেমন আছেন?

লিপি বেগম মৃদু হাসলেন। উপর নিচ মাথা নাড়িয়ে বললেন,”জি আলহামদুলিল্লাহ।
আরশের দিকে তাকিয়ে চোখ দিয়ে ইশারা করলেন সালাম করার জন্য। আরশ মোলায়েম কন্ঠে নাছির সাহেবকে সালাম দিয়ে লিপি বেগমকে বলে ওঠে,”মাম্মা পাপা তোমাকে যাওয়ার জন্য বলছে।
লিপি হালকা ঠোঁট এলিয়ে হেসে চলে গেলেন হসপিটালের ভিতরে। পোর্চে সামনে দাঁড়িয়ে নাছির সাহেব আর আরশ প্রথমে অপ্রস্তুত ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে রইল। তারপর নাছির সাহেব কথা শুরু করেন এটা সেটা নিয়ে। পড়াশোনা নিয়ে জিজ্ঞেস করেন, কেমন চলছে? কি রকম হচ্ছে? ব্লাহ ব্লাহ….

[নাবিলা সৈয়দ পেইজে এই গল্প পুরো পেয়ে যাবেন।]
ইরহাম অন্যমনস্ক হেঁটে যাচ্ছিল সামনের দিকে। অনাকাঙ্কিত ভাবে লম্বা, চওড়া, পুরুষালি শক্ত শরীরের সাথে ধাক্কা লাগল তার। সেদিকে না তাকিয়ে সে মাথা নিচু করে স্যরি বলে আলগোছে পাশ কাটিয়ে চলে গেল লোকটার। একবার প্রয়োজন বোধ করল না লোকটার মুখ দেখার। দু-পা সামনে এগোনোর আগেই কানে আসলো রাশভারী গম্ভীর গলার স্বর। নিজের অতর্কিত চিন্তাগুলো এক পাশে রেখে ডানে-বামে, সামনে তাকাল, কিন্তু গাধার মতো একবার ও পিছন ফিরে তাকাল না। নিজের আশে-পাশে কাউকে না দেখে পা বাড়াতে যাবে তার আগেই পিঠে পুরুষালি হাতের শক্ত তাবা পড়ল।

ইরহাম এক ঝটকায় ধড়ফড় করে পিছনে তাকায়। আবার ও সামনের লোকটার দিকে তাকাল না। নিজের পিঠে ডান-হাত পেঁচিয়ে পিঠে হাত বুলালো। তখনই কানে আসলো গম্ভীর স্বরে বলা কথা,”এইই ইরহাম।
লোকটা এবার কিছুটা গর্জে ডেকে উঠল। দাঁতে দাঁত চেপে রাগে কটমট করে শব্দ করল।
রাশভারী গলার আওয়াজে ইরহাম চোখ উপরে তুলে তাকাতেই তার অক্ষিকোটরে বিস্ময় উপচে পড়ল। অবাক গলায় বলতে গেল ভাই, তার আগেই দাবাং মার্কা চড়ের বেগে মুখ থেকে বের হওয়া ভা শব্দ ওখানে আটকে গেল।
আরশের হাতের থাপ্পড় গালে পড়তেই ইরহামের গালে চিনচিনে ব্যথা শুরু হলো তার সাথে অসহ্য যন্ত্রণা। থাপ্পড়ের বেগে ইরহামের মুখ একদিকে সরে গিয়েছিল। তাই নিজেকে সামলে নিয়ে নিজের ঝুঁকে যাওয়া চোখ উপরে তুলে। আবার আরশের ঝাঁঝ মিশ্রিত অগ্নি দৃষ্টির শিকার হয়ে নিজের চোখ নামিয়ে নেয় নিচের দিকে। গালে হাত রেখে মিনমিন করে জিজ্ঞেস করে,”ভাই মারলেন কেন? কি করেছি আমি?
কথা শেষ হতেই আরেকটা থাপ্পড় পড়ে গালে। এবার থাপ্পড়ের জোর এতো বেশি ছিল যে, থাপ্পড়ের জোরে ইরহামের ঠোঁটের ছোট এক অংশ ফেটে গেল।

হাত দিয়ে ঠোঁট মুছে নেয় ইরহাম। জিহ্বার মধ্যে নুনতা স্বাদ হতেই থু করে থুথু ফেলল রাস্তায়। এক দলা থুথুর সাথে বের হয়ে আসলো রক্তের কিছু মিশ্রণ। ইরহাম চোখ বন্ধ করে বলে দিতে পারে, তার সামনের একটা দাঁত নড়ে গিয়েছে। নিজের চিন্তার ব্যাঘাত ঘটল লোকটার গম্ভীর গলার আওয়াজে,”বউ কই আমার?
ইরহাম অবাক চোখে দেখে আরশকে। আবার পরমুহূর্তে চোখ নামিয়ে নেয়। মিনমিনে গলায় উত্তর করে,”আমি জানি না।

আরশ বিরক্তিতে চ বর্গীয় শব্দ করে। অত্যাধিক রাগ নিজের ভিতর চেপে রেখে শব্দ করে শ্বাস ফেলে। ঝাঁঝালো স্বরে বলে,”ওইটা তোর সাথে থাকে না?
ইরহাম উপর নিচ মাথা নাড়ায়, যার মানে হ্যাঁ থাকে। আরশ বিরক্ত হয়। তিক্ত বিরক্ত কন্ঠে আওড়ায়,”তাহলে জানিস না কেন? বউ কোথায় আমার?
আরশকে আবার তেড়ে আসতে দেখে ইরহাম উল্টো দিকে দৌড় দেয়। ইরহামকে দৌড় দিতে দেখে আরশ ও দৌড় দেয় তার পিছন পিছন। চিৎকার করে হুমকি স্বরুপ বলে ওঠে,”ইরহাম ভালোয় ভালোয় প্রশ্নের উত্তর দে, নাহলে তোর আজ একদিন কি আমার যতদিন লাগে। এমনিতে ও তোকে সাতাশি প্লাস কল দিয়েছি পিক করিসনি, আর এখন আমাকে দৌড়ানি দেওয়াচ্ছিস। তোদের দুটোকে হাতের কাছে পেয়ে যাই, গাছের সাথে বেঁধে রাখব। চুপচাপ বল ওইটা কই?

ইরহাম সামনের দিকে দৌড়াতে দৌড়াতে কাঁদো কাঁদো গলায় উত্তর দেয়,” ভাই আমি জানি না।
আরশ পিছন থেকে কর্কশ গলায় জিজ্ঞেস করে,
“তুই জানিস না কেন?
ইরহাম সামনের দিকে প্রাণপণে দৌড়াতে দৌড়াতে কল দেয় নুসরাতের মোবাইলে। তখন ও দু-জন হসপিটালের পোর্চে দৌড়াচ্ছে। ইরহামের ফোন নুসরাত পিক করল না রিং হতে হতে কেটে গেল। ইরহাম ঢোক গিলে আবার কল করল এবার প্রথম বারে নুসরাত কল পিক করল। হ্যালো বলতে নিবে তার আগেই ইরহাম তার মুখের কথা থামিয়ে দিয়ে বড় শ্বাস ফেলে জিজ্ঞেস করে,” কোথায় তুই?

নুসরাত মাথার মধ্যে ক্যাপ পড়তে পড়তে উত্তর দেয়,”এই তো আধঘন্টার মতো হয়েছে বাড়িতে এসেছি। এখন….
এতটুকু বলতেই ইরহাম ফোন কেটে দেয়। নুসরাত ফোনের দিকে তাকিয়ে বিড়বিড় করে,”যাহ বাবা কেটে দিল,আরে শুনবি তো পুরো কথা।
ইরহাম ফোন পকেটে রেখে দৌড় থামায়। হাঁটুতে ভর দিয়ে ঝুঁকে দাঁড়ায়। ততক্ষণে আরশ ও হাপিয়ে ওঠে হাঁটুতে ভর দিয়ে ঝুঁকে দাঁড়িয়েছে। ইরহাম আরশকে উদ্দেশ্য করে বলে,”ভাই নুসরাত বাড়িতে আছে। এবার যান আপনার বউয়ের কাছে যান।

আরশ কথা বলে না। ক্রোধে চোয়াল শক্ত করে তাকিয়ে রয়। দু-আঙুলের সাহায্যে কাছে ডাকে। ইরহাম সামনে আগায় না, পাছে যদি আবার থাপ্পড় মারে সেই ভয়ে। এমনিতেই দাঁত নড়ে গিয়েছে। আর এবার থাপ্পড় খেলে এই বয়সে দাঁত পড়ে বুড়ো হয়ে যাবে। এই বয়সে যদি দাঁত পড়ে যায়, তাহলে সে মেয়ে পটাবে কি করে?আর মেয়ে না পটলে তার টাইম পাস হবে কি করে? না, না, ভাবতেই তো গা শিরশির করে উঠছে। ইরহাম নিজের চিন্তা থেকে বের হয়ে দু-পাশে না ভঙ্গিতে মাথা নাড়ায়। আরশ কিছুক্ষণ তীক্ষ্ণ চোখে তাকিয়ে থেকে বলে,”আয় এদিকে, মারব না।
ইরহাম ভরসা করতে পারে না। তবুও এক পা আগায়, আবার দু-পা পিছিয়ে হয়, তখনই রাশভারী গলায় আরশ হুমকি দিয়ে বলে,”আসবি নাকি হাত চালাব? বল কোনটা করব?

ইরহাম নিজের ভয় ফেলে এগিয়ে যায় সামনে। শঙ্কিত গলা নিয়ে জিজ্ঞেস করে,”কি ভাই?
কথা শেষ করার আগেই আরেকটা থাপ্পড় খায়। এবারের থাপ্পড় আগের থাপ্পড়ের তুলনায় কিছুটা কম জোর ছিল, তাই অতোটা ব্যথা পায়নি। আরশ দু-হাত পকেটে পুরে আরাম করে দাঁড়িয়ে বলে,”তোকে ওর ফটো সেন্ড করতে বলেছিলাম সেন্ড করেছিস।
ইরহাম উপর নিচ মাথা নাড়ায়। মোলায়েম কন্ঠে গালে হাত বুলাতে বুলাতে বলে,”জি ভাই।
আরশ চোখে সানগ্লাস পরতে পরতে নির্বিকার গলায় বলে,”যা ভিতরে। আমি আসছি হাফ এন হাউয়ার এর ভিতর।

রান্নার সুগন্ধিতে পুরো নাছির মঞ্জিল মো মো করে উঠেছে। নাজমিন বেগমকে নুসরাত সিঁড়ি বেয়ে নিচে নেমে আসতে আসতে ডাক দিল। নাজমিন বেগম প্রতিউওর করলেন না, সচরাচরের মতো নুসরাতের ডাকে সাড়া না দিয়ে। নুসরাত ভেজা চুলে হাত বুলাতে বুলাতে এসে কিচেনে ঢুকে। অবাক চোখে তাকিয়ে দেখে মায়ের তোড়জোড়। নরম গলায় জিজ্ঞেস করে,”এত আয়োজন কিসের জন্য?
নাজমিন বেগম সিঙ্কে অপরিস্কার বাটিগুলো রাখতে রাখতে উত্তর করেন,”আজ আপারা আসবে। ছোট একা হাতে সব সামলাতে পারবে না, তাই আমাকে বলছে একটু সাহায্যের জন্য।

নুসরাত ত্যাড়া চোখে মায়ের দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করে,”তো তুমি কেন কাজ করবে, ওরা আসলে?
নাজমিন বেগম চোখ রাঙিয়ে নুসরাতের দিকে তাকান। দু-হাত দিয়ে ঠেলে বের করে দেন কিচেন থেকে। তারপর নুসরাতের মুখের উপর কিচেনের স্লাইডিং ডোর লাগিয়ে দিয়ে বলেন,”ভাগ এখান থেকে। একটু আগে তোর বাপ কল করে বলছে সে আসছে, আর তোকে তাড়াতাড়ি হসপিটালে উপস্থিত হওয়ার জন্য। আমার মাথা না খেয়ে ওখানে যা।
নুসরাত কথা বাড়াল না। হাতে ওয়ান টাইম মাস্ক নিয়ে হেলেদুলে বাড়ি থেকে বের হয়ে গেল। বাড়ির বাহিরে বের হতেই সূর্যের তাপ এসে গায়ে লাগল। ঝলসানো তাপে মনে হলো কপাল পুরে যাবে, তাই বাড়িতে আবার ফিরে আসলো উল্টো পায়ে। ড্রয়িংরুমের এক কোণায় অগোছালো ভাবে রাখা কাপড়ের স্তুপ থেকে নিজের ক্যাপটা তুলে নিয়ে মাথায় দিল। মাস্ক ঠিকভাবে পরে নিয়ে আয়নায় নিজেকে এক পলক দেখে নিল। ঠিকঠাক লাগছে! চোখ ছাড়া আর কিছু দেখাই যাচ্ছে না৷ গলা ঝুলানো ওড়না সারা শরীর পেঁচিয়ে পরে নিল। অতঃপর হেলেদুলে বের হয়ে গেল হসপিটালের উদ্দেশ্যে।

বাড়ির বাহির বের হয়ে বেশ কিছু রাস্তার হাঁটার পর একটা কালো রঙের মার্সিডিজ শু করে তার পাশ কাটিয়ে চলে গেল। গাড়ির গতি এত তীব্র ছিল যে নুসরাতের মনে হলো তার উপর শু করে গাড়িটা ওঠে যাবে। দু-পা সামনে বাড়াতেই কিৎকাল আগে সামনে যাওয়া গাড়িটা পিছনে ফিরে আসলো, একদম নুসরাতের সামনে এসে গাড়িটা থামল।

নুসরাতের কপালে ভাঁজ পড়ল। ভ্রু যুগল কুঞ্চিত করে গাড়ির ভিতর উঁকি দিতেই গাড়ির কাচ ধীরে ধীরে নিচে নেমে গেল। বের হয়ে আসে সানগ্লাস পরিহিত এক পুরুষের মুখ। যার আগা গোড়া কালো রঙের কাপড়ে ঢাকা। মুখে ও মাস্ক পরে বসে আছে লোকটা। নুসরাতের লোকটাকে দেখেই বিরক্ত লাগল। এ কিরে বাবা! লোকটা গাড়ির ভিতর কেন মাস্ক পরে বসে আছে। এটাকে দেখেই তো তার গরম লাগছে। ভিতর ভিতর নাক মুখ কুঁচকে বমি করার মতো করল। তখনই লোকটা আমেরিকান এক্সেন্ট ইংরেজিতে বলে ওঠে,”সৈয়দ নাছির উদ্দিনের বাড়ি কোথায়?
নুসরাত চোখ বড় বড় করে তাকায়। এ আবার কোন ইংলিশ এসে দেশে নেমেছে। আর তাদের বাড়ির খোঁজ বা কেনই করছে। নুসরাতকে এক পেশে দাঁড়িয়ে চিন্তা করতে দেখে লোকটা হাত বের করে তার মুখের সামনে চুটকি বাজায়। চোখ থেকে চশমা খুলে আবারো আমেরিকান এক্সেন্টে বলে,”এই যে আপনি জানেন?

নুসরাত দু-পাশে মাথা নাড়ায় সে জানে না। আরশ বিরক্তিতে চ সূচক শব্দ করে। নুসরাতের দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করে,”জানেন না, তাহলে এতক্ষণ বলেননি কেন?
নুসরাত মাস্কের ভিতর মুখটা দুঃখি দুঃখি বানিয়ে ফেলে। অত্যন্ত বিনয়ী কন্ঠে বলে উঠে,”আমি ইংরেজি বুঝি না ভাইয়া।
নুসরাতের কন্ঠ থেকে যেন বিনয় ঝড়ে ঝড়ে পড়ছে।
নুসরাতের কথা শুনে আরশের চোখের একপাশ কুঁচকে যায়। তিক্ততা নিয়ে এবার স্পষ্ট বাংলায় জিজ্ঞেস করে, “তাহলে এতক্ষণ বলেননি কেন?
নুসরাত মৃদু হাসে৷। মোলায়েম কন্ঠে উত্তর করে,
” আপনি জিজ্ঞেস করেননি তাই বলিনি।
নুসরাত কথা শেষ করে সামনের দিকে পা বাড়াতেই আবারো আরশ ডেকে ওঠে। নুসরাত দাঁড়িয়ে পড়ে যেখানে ছিল সেখানে। চোখ কুঁচকে একটা শ্বাস ফেলে, তারপর আবার মিথ্যে হাসি গলায় ঝুলিয়ে টেনে টুনে বিনয়ী কন্ঠে বলে,”কোনো প্রয়োজন ভাইয়া?

আরশ তীক্ষ্ণ চোখে তাকিয়ে থাকে। যেন গাড়ির ভিতর থেকে বসেই নুসরাতের মাস্কে আর ক্যাপে ঢাকা পুরো মুখ দেখে নিচ্ছে। চোখের দৃষ্টি শিকারী বাজ পাখির মতো শীতল৷ এক মুহুর্তের জন্য দৃষ্টি এদিক-ওদিক না করে জিজ্ঞেস করে,”বিবাহিত?
ছোট্ট শব্দ, কিন্তু এই প্রশ্ন জিজ্ঞেস করতেই নুসরাতের মিথ্যে হাসি হাসি মুখ ধুপ করে নিভে যায়। উজ্জ্বল বদনে নেমে আসে গাঢ় অন্ধকার। নিষ্প্রাণ চোখে সামনের দিকে তাকিয়ে দু-পাশে মাথা নাড়ায়, তারপর আবার উপর নিচ মাথা হ্যাঁ ভঙ্গিতে দোলায়। মৃদু গলায় বলে,”জি ভাইয়া। কেন কোনো প্রয়োজন?
আরশ সে কথার উত্তর দেয় না, না শোনার মতো করে আরেকটা প্রশ্ন করে অত্যন্ত শান্ত ও শীতল গলায়,”বেবি আছে?

নুসরাত কি অনায়াসে একটা মিথ্যে বলে দেয়, যেন মিথ্যা কথা গুলো সাজানো ছিল ঠোঁটের আগায়। জোর করে আই স্মাইল দিয়ে বলে ওঠে,” জি ভাইয়া, চারটা বাচ্চা আছে। আরো ছয়টা নেওয়ার প্ল্যান করছি আমি আর আমার হাজবেন্ড মিলে।
কথাটা শেষ করে হিহি করে হেসে ওঠে। আরশ একবার পরণের কাপড় লক্ষ করে মেয়েটার, আর একবার লক্ষ করে মেয়েটার মুখ। আরশ তীক্ষ্ণ চোখে তাকিয়ে থেকে নুসরাতকে উপর থেকে নিচে চেক আউট করে। মুখের দিকে চোখের পলক স্থির রেখে সোজাসাপ্টা পুরুষালি পুরু কন্ঠে জিজ্ঞেস করে,”নাম কি আপনার?
নুসরাত মাস্কের ভিতর থেকে বিশ্রী একটা হাসি দেয়। জিহ্বা দিয়ে ঠোঁট ভিজিয়ে নেয়। কপালের ভাঁজ গুলো শীতিল করে অনায়াসে আরো একটা মিথ্যে বলে দেয়,”জি ভাইয়া আমার নাম ময়না।
আরশ নিরর্থক অভিমত প্রকাশ করে। নুসরাতের দিকে আরো একবার বাজ পাখির মতো শিকারী সেই শীতল দৃষ্টি দিয়ে শু করে গাড়ি নিয়ে চলে যায়। দ্বিতীয় কোনো প্রশ্ন করে না, আর না নুসরাতকে করার সুযোগ দেয়।

দু-দিনের লাগাতার কান্না ইসরাতের চোখ মুখ ফ্যাকাশে বর্ণ ধারণ করেছে। এতক্ষণ সে বসেছিল ওয়েটিং এরিয়ায়। পানির পিপাসা পাওয়ায় উঠে দাঁড়াতেই কান্নার ফলে শরীর দূর্বল হওয়ার জন্য সারা শরীর থরথর করে কেঁপে উঠল। চোখের সামনের সবকিছু ঘোলাটে হয়ে পা উল্টে পড়তে নিবে, শক্ত হাতে কেউ কোমর চেপে ধরল মেয়েটার। ইসরাতের ভয়ার্ত চোখ গুলো বড় বড় হয়ে গেল সেকেন্ডের ভিতর। কোমরে পুরুষালি হাতের বিচরণ পেল দু-সেকেন্ডের জন্য পরপরই তাকে সামলে নিয়ে হাতটা ধীরে ধীরে সরে গেল আলগোছে। যাতে কোনো রকম বিরম্বনায় বা অপ্রস্তুত মুহুর্তে সম্মুখীন হতে না হয় ইসরাতকে।
ইসরাত কথা বলল না, এক জায়গায় ধ্যান মেরে স্তব্ধ হওয়া চোখে সামনে তাকিয়ে রইল। তখনই চোখের সামনে তর্জনী আর বুড়ো আঙুল দিয়ে চুটকি বাজায়, তাকে পড়ার হাত থেকে বাঁচানো লোকটা৷ মৃদু গলায় জিজ্ঞেস করে,”আর ইউ ওকে?

ইসরাত কেঁপে ওঠে, নিজের বাঁ-পাশে হকচকিয়ে তাকাতেই চোখগুলো বৃহৎ আকার গঠন করে। কথার উত্তর না দিয়ে বড় বড় চোখে তাকিয়ে থাকে। লোকটা ইসরাতকে স্থির হতে দেখে গ্রিবা নামিয়ে কাছে আসে ইসরাতের। মোলায়েম কন্ঠে জিজ্ঞেস করে,”আপনি ঠিক আছেন ইসরাত?
ইসরাত লোকটার কথায় এবার সম্বিতে ফিরে। হকচকিয়ে গিয়ে বলে,”জি, জি!
লোকটা পুরুষালি ঠোঁট টিপে একটু হাসে। হা গম্ভীর মুখের আড়ালে ঢেকে যায়। নিজের শার্টের হাতা গুটাতে গুটাতে ইসরাতের দিকে আরেকটু ঝুঁকে এসে বলে,”হ্যালো! আ’ম জায়িন।
জায়িন কথা বলতে বলতে নিজের বাঁকানো গ্রীবা উঁচু করে টান টান হয়ে দাঁড়ায়। এক হাত প্যান্টের পকেটে পুরে নিয়ে বলে উঠে,”আমাকে দেখতেই থাকবেন কি ইসরাত? কথার উত্তর দিন!
ইসরাত স্তম্ভিত হয়ে দাঁড়িয়ে রয়। ড্যাবড্যাব করে সুদর্শন যুবকের দিকে তাকিয়ে থেকে আলুতালু গলায় বলে ওঠে,”জি আমি ইসরাত।

জায়িন ইসরাতের বোকামিতে মুচকি হাসে। হাসির তোড়ে ঠোঁটের ফাঁক গলে বের হয়ে আসে চিকচিক করতে থাকা দন্তের ছোট্ট একটা অংশ। জায়িন গম্ভীর চোখ ইসরাতের দিকে স্থির রেখে বলে,”হ্যাঁ জানি, আপনি ইসরাত। নতুন কিছু বলুন?
জায়িনের কথায় কি উত্তর দিবে ইসরাত খুঁজে পায় না। গুলগুল চোখে হা করে তাকিয়ে থাকতে থাকতেই আবার মাথা ঘুরে উঠে। চোখ অন্ধকার হয়ে পড়ে যেতে নিবে তখনই নুসরাতের চিৎকার আসে কানে। ধুপধাপ শব্দে আসছে। আর বলছে, আরে ভাই ধরছেন না কেন বাচ্চা মেয়েটাকে,পড়ে যাবে তো।
নুসরাতের উচ্চ স্বরের চিৎকারে জায়িন ভ্যাবাচেকা খেয়ে গেল। ইসরাতকে ঝাপটে ধরার জন্য বাড়ানো হাত আবার পিছিয়ে নিল, আর তখনই বাতাসের গতিতে জায়িনের সামনে দিয়ে দৌড়ে এসে নুসরাত দু-হাতে আগলে নিল ইসরাতকে।

নুসরাত ইসরাতকে পাশের বেঞ্চে বসিয়ে কোমরে হাত রেখে তেরছা চোখে তাকায় জায়িনের দিকে। একবার উপরের দিকে তাকায়, একবার নিচের দিকে তাকায়, তারপর মাছির মতো হা করে হাত উপর থেকে নিচে করে। বারবার ঘুরে ঘুরে স্ক্যান করে জায়িনকে। নিজের হা করে নেওয়া মুখটাকে বন্ধ করে নিয়ে ঝাঁঝ মিশ্রিত কন্ঠে বলে উঠে,”মেয়েটা পড়ে যাচ্ছিল ধরেননি কেন?
জায়িন পকেটে হাত পুরে সঠান হয়ে দাঁড়িয়ে রয়। নুসরাতের প্রশ্ন না শোনার ভান করে হাতের কালো ডায়ালের ঘড়িতে চোখ বুলায়।
নুসরাত ঢোক গিলে হজম করে নেয়, কথার উত্তর না দিয়ে জায়িনের সূক্ষ্ম অপমান। ঠান্ডা চোখ একবার জায়িনের দিকে স্থির করে সরিয়ে নেয়, অতঃপর একজন নার্সকে ডেকে উঠে।
“এই যে সিস্টার,,

নার্স একটু দূরে ছিল দাঁড়িয়ে। নুসরাতের ডাকে সাড়া দিয়ে সামনে এগিয়ে আসে। কাছে এসে মৃদু হেসে জিজ্ঞেস করে,” কিভাবে সাহায্য করতে পারি ম্যাম?
নুসরাত কিছু বলার আগেই জায়িন বলে উঠল,
“গ্লুকোজ ইনজেকশন নিয়ে আসুন।
নার্স প্রশ্ন না করে হ্যাঁ ভঙ্গিতে মাথা নাড়িয়ে চলে যায়। কিছুক্ষণ অতিবাহিত হওয়ার পর নার্স গ্লুকোজ ইনজেকশন একটা ট্রে করে নিয়ে আসে। জায়িন সেটা হাত বাড়িয়ে নার্সের কাছ থেকে নিয়ে নেয়। নার্স অবাক চোখে চাইলে জায়িন নার্সের না করা প্রশ্ন বুঝতে পারে। ভরাট পুরুষালি গলায় মৃদু শব্দে বলে,” আমি একজন কার্ডিওলজিস্ট।
নার্স মাথা নাড়িয়ে চলে যায়। জায়িন ইনজেকশন হাতে নিয়ে সেটা পুস করার জন্য ইসরাতের কাছে এগিয়ে যায়। ইসরাতকে উদ্দেশ্য করে গম্ভীর কন্ঠে বলে উঠে,”হাতা গোটাও।

ইসরাত বিনা বাক্যে হাতে গুটিয়ে নিতেই জায়িন ধীরে ধীরে ইনজেকশন পুশ করার অগ্রসর হয় সেদিকে। হাতের চামড়ার কাছাকাছি ইনজেকশন নিতেই জায়িনের হাত থরথর করে কাঁপতে শুরু করে।
নুসরাত আর ইসরাত দু-জন দু-জনের দিকে একই সময় তাকানোতে চোখাচোখি হয় তাদের। ইসরাত বিরক্তির নিঃশ্বাস ফেলে দৃষ্টি অন্যদিকে ফিরাতেই, নুসরাত শক্ত হাতে জায়িনের কাঁপতে থাকা হাত থেকে ইনজেকশন নিয়ে নেয়। বিড়বিড় করে গালি দিতে দিতে বলে,”আসছে আমার কার্ডিওলজিস্ট, বালের কার্ডিওলজিস্ট। সামান্য হেডার ইনজেকশন দিতে গিয়ে কাঁপতে কাঁপতে মরে যাচ্ছে। সাউয়ার ডাক্তার…!

নুসরাতের গালির সাথে মিশিয়ে করা ভৎসনা স্পষ্ট জায়িনের কানে গেল। জায়িনের গম্ভীর চোখে নুসরাত শক্ত চোখ রেখে, ইসরাতের অনুমতির তোয়াক্কা না করে, কাউকে কোনো কিছু বোঝে ওঠার সুযোগ না দিয়ে, ইনজেকশন পুশ করে দিল। তারপর বিড়বিড় করে আওড়াল,”এটাকে কেডা ডাক্তার বানাইছে? আমারে এর লগে পরিচয় করা কেউ? সামান্য ইনজেকশন দিতে পারে না, এ আবার কার্ডিওলজিস্ট। হাসাইলিরে পাগলা…! জীবনে আমি এত বড় জোক কোনোদিন ও শুনিনি! হা হা হা…! এই জোক শোনানোর জন্য আপনাকে দেওয়া হচ্ছে একটা জুতোর তৈরি গলার মালা।

প্রিয় প্রণয়িনী ২ পর্ব ৬

ইসরাত ও নুসরাতের কথায় সমান তাল মিলাল মাথা উপর নিচ নাড়িয়ে। আর তাদের মধ্যে জায়িন চোয়াল শক্ত করে দাঁড়িয়ে রইল। চুপচাপ হজম করল, নুসরাতের করা অপমান গুলো।

প্রিয় প্রণয়িনী ২ পর্ব ৮

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here