প্রিয় বেগম পর্ব ২৬

প্রিয় বেগম পর্ব ২৬
পুষ্পিতা প্রিমা

সোহিনীকে ছেড়ে দিল সায়রা আর শবনম মিলে। ছাড়া পাওয়ামাত্রই সায়রার গালে কষে একটা চড় বসালো সে। চেঁচিয়ে উঠে বলল,
‘তোর সাহস কি করে হয় আমাকে কক্ষে বন্দি করার? রূপাকে কোথায় পাঠিয়ে দিয়েছিস? ‘
সায়রা ওর মুখপানে ছলছল নেত্রে চেয়ে রইলো। আয়শা বলল,
‘ তুমি সায়রা আপুকে ভুল বুঝছো। রূপা এমনিতেই পালাতে চাচ্ছিলো। ‘
‘একদম চুপ। আমি ভাইজানকে গিয়ে বলছি তোরা রূপাকে পালাতে সাহায্য করেছিস। ‘

সায়রা ওর হাত ধরে আটকে বলল,
‘আগে সিভানকে সুস্থ হতে দে। ‘
সোহিনী কপাল ভাঁজ করলো। হাত ছাড়িয়ে নিয়ে বলল,
‘কি হয়েছে সিভানের?’
শবনম বলল,
‘কেউ জানেনা কি হয়েছে? ও অজ্ঞান হয়ে ছিল অনেকক্ষণ। হুশ ফেরার পরেও কোনো কথা বলছেনা।’
সোহিনী ত্রস্ত পায়ে হেঁটে চলে গেল। দেখলো হামিদা কাঁদছে। খোদেজার বুকে সিভান। তার চোখ দুটো নিভুনিভু। সোহিনী গিয়ে ওর সামনে বসে বলল,

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

‘কি হয়েছে ভাইজান? কি হয়েছে তোমার?’
খোদেজা কান্না চেপে বলল,
‘ ওর সামনে কেঁদোনা। ও ভয় পাচ্ছে।’
‘বাবু এই বাবু চোখ খোলো। দেখো বড়মা ডাকছে তোমায়। শেহজাদ ভাইজান এসেছে। ওঠো।’
সিভান অনেকক্ষণ পর বিড়বিড়িয়ে বলল,
‘এটা সুন্দর বউ দিয়েছে। ‘
খোদেজা বলল,
‘কি?’
হামিদা ওর মুখ ধরে বলল,

‘কি বলছো এসব? সুন্দর বউ কি দিয়েছে? তোমাকে কিছু দিয়েছে? ‘
সিভান পুনরায় বলল,
‘এটা শেহজাদ ভাইজান দিয়েছে’।
কেউ কিছু বুঝে উঠতে পারলো না। শাহাজাহান সাহেব আর শেরতাজ সাহেব কক্ষে প্রবেশ করে বললেন,
‘কথা ফুটেছে? ‘
সোহিনী বলল,
‘হ্যা কথা বলছে। ভাইজান তোমার কোথায় খারাপ লাগছে?’
সিভান মাথায় আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিল। খোদেজা তার মাথায় চুমু খেয়ে বলল,
‘কিছু খাবে তুমি?’

সিভান বলল,
‘শেহজাদ ভাইজানের কাছে যাব। ‘
খোদেজা তাকে বুকের সাথে জড়িয়ে ধরে কেঁদে উঠলো। ওড়নার আঁচলে মুখ মুছতে মুছতে বলল,
‘তোমার শেহজাদ ভাইজান বিরতি নিয়েছে এই ঝঞ্জাট থেকে। তার জন্য দোয়া করা ছাড়া আর কোনো উপায় নেই। ‘
তন্মধ্যে বিকট শব্দে কি যেন ঝনঝন শব্দ করে উঠলো। শেরহাম খাবারঘরের সমস্ত বাসনকোসন, জগ গ্লাস ফেলে দিয়েছে। তুমুল ভাংচুর করছে। সকলেই কেঁপে উঠলো। সোহিনী ছুটে গেল। সায়রা তটিনীরা সবাই আতঙ্কে চুপসে গিয়েছে।

‘অপা কোথায়? কোথায় ও? সোহিনী! ‘
সোহিনী তার সম্মুখে এসে মাথা নত করে বলল,
‘ ও শৌচাগারে যাবে বলেছিল ভাইজান। তারপর আর দেখা নেই। ‘
মেহেদী দিতে থাকা মেয়েগুলো বলল,
‘ওই পৌঢ়া মহিলা হাত ধরে টেনে নিয়ে গেছেন আপনার ভাবী বেগমকে। উনি ভালো জানবেন। ‘
শেরহাম দাঁত কটমট করে হিংস্র জন্তুর মতো গর্জে খোদেজার উদ্দেশ্যে হেঁটে গেল। সবাই তার পিছু পিছু ছুটলো। পথিমধ্যে পথ আটকে দাঁড়ালেন শেরতাজ সাহেব। বললেন,
‘আর নীচে নেমো না। যথেষ্ট হয়েছে শেরহাম। মায়ের কুশিক্ষায় তোমার কতটা অধঃপতন হয়েছে দেখেছ? তোমার মায়ের পেটের অন্য একটি সন্তান কিন্তু আমরা মানুষ করেছি। সোহিনীকে দেখো আর নিজেকে দেখো। তোমার পাশে কেউ নেই দিনশেষে। ‘

শেরতাজ সাহেবের কথাগুলোকে গ্রাহ্য করলো না শেরহাম। মুখ ঝামটা মেরে খ্যাঁক করে বলে উঠলো,
‘এইসব ফালতু কথাবার্তা শোনার সময় নেই আমার। অপা কোথায়? কোথায় লুকিয়েছ তাকে?’
সোহিনী পথরুদ্ধ করে দাঁড়ায়। ভীতু গলায় বলে,
‘ ও পালিয়েছে ভাইজান। ‘
কথা বলা শেষ করে উঠতে পারলো না সোহিনী। তার আগেই শক্তপোক্ত হাতের চড় খেয়ে টাল সামলাতে না পেরে মুখ থুবড়ে পড়ে গেল। সকলেই আঁতকে উঠলো। সায়রা গিয়ে ধরলো তাকে। শেরতাজ সাহেব পাল্টা চড় বসালেন শেরহামকে। শেরহাম উনাকে কিছু বলতে দিলেন না। উনার গায়ের পাঞ্জাবির কলার চেপে ধরে ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে দিতেই উনি পড়ে যাবেন তখুনি সাফায়াত এসে ধরলো। বলল,
‘অনেক সহ্য করেছি আপনার এসব বেয়াড়াপনা। বেশি বাড়াবাড়ি করলে এই পা নিয়ে আর বেরুতে পারবেন না। ‘
শেরহাম ওর দিকে এগুতেই সায়রা এসে পথরুদ্ধ করে হাতজোড় করে বলল,
‘ভাইজান আপনার যদি এতই দরকার হয় তাহলে রূপার খোঁজ করুন। রূপা নিজেই পালানোর পথ খুঁজছিলো। ‘
শেরতাজ সাহেব বললেন,

‘খুঁজবেই তো। আমরা ওর আপন মানুষ হয়ে ওর কাছ থেকে নিস্তার চাইছি আর পরের মেয়েটা তো অবশ্যই চাইবে। ওই মেয়েকে আমরা ভুল বুঝেছিলাম। আসল ষড়যন্ত্রকারী ছিলে তুমি। ধিক্কার তোমাকে। তুমি একদিন সবার ঘৃণা পেতে পেতে অতিষ্ঠ হয়ে যাবে। তোমাকে ভালোবাসার মতো কেউ থাকবে না। একটা জীবও না। ‘
শেরহাম রক্তচক্ষু নিক্ষেপ করে বলল,
‘এবার লা*শ ফেলবো। আর সবাইকে পথে টেনে নিয়ে ছুঁড়ে ফেলবো। অনেক বাড় বেড়েছে সবার। ‘
‘যাও যাও। যা ইচ্ছে করো। যাকে দেখে হিংসেয় জ্বলেপুড়ে মরছিলে সে তোমাকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে মহল ছেড়েছে। এবার নাচো তুমি তোমার রাজত্ব নিয়ে। ‘
শেরহাম তেড়ে গিয়ে বলল,
‘অ্যাই শেরতাজ সুলতান..
তটিনী এসে ওর কলার চেপে ধরে বলল,

‘আপনার এসব অনেক সহ্য করেছি। আপনার কারণে ‘ও’ মহল ছেড়েছে। জানে মে*রে ফেলবো ।’
শেরহাম ওর গলা চেপে ধরে ছুঁড়ে ফেলতেই সাফায়াত চিৎকার দিয়ে বলল,
‘ভাইজান এবার রক্তারক্তি শুরু হবে কিন্তু । ‘
শেরহাম সকলের উদ্দেশ্যে আঙুল তুলে বলল,
‘আমি যদি অপাকে না পাই। তাহলে এখানে কাউকেই জীবিত রাখবো না বলে দিলাম। এই চল সবাই। ‘
নিজের দলবল নিয়ে মহল ত্যাগ করলো সে।
এমন দুঃসময়ে সবার দরকার ছিল শেহজাদকে। সে সবার শক্তি ছিল । তার এক কথায় সকলেই পুনরুজ্জীবিত হয়ে উঠতো। কোনো ভয়ভীতি তাদের ছুঁতে পারতো না। কিন্তু তার অনুপস্থিতি সকলকে আরও অসহায়, দুর্বল, ভীত, শঙ্কিত করে তুলেছে। এমন পরিস্থিতি হবে জানলে ও কখনোই মহল ছাড়তো না।
সাফায়াত সবাইকে ভরসা যুগিয়ে বলল,

ভাইজান কালপরশু নিশ্চয়ই চিঠি পাঠাবেন। আমাদের সবুর করতে হবে।
সোহিনী হাঁটুতে মুখ গুঁজে কাঁদতে লাগলো। এতদিন পর ভাইকে পেয়ে সে সব ভুলে ভাইয়ের আপন হতে চেয়েছিল। কিন্তু ভাইজান কেন এতটা পাষাণ?
শেরতাজ সাহেব ওর সামনে গিয়ে বসে হাত বুলিয়ে দিয়ে বলল,
‘তোমার ভাইয়ের জন্য তো অনেক কিছু করলে। দেখলে সে তোমার গায়ে হাত তুলতেও পিছপা হলো না। এমনই পাষাণ সে। আজ অব্দি একটুও পরিবর্তন ঘটেনি। ‘
সোহিনী আরও জোরে কাঁদতে লাগলো। সাফায়াত ওর মাথায় হাত বুলিয়ে বলল,
‘আর কেঁদোনা। শান্ত হও। ‘

ঘোড়ার গাড়ি এসে থামলো একটি বিশাল মসজিদের সামনে। মসজিদের পাশেই মাজারের দিকটাতে আলোকবাতি জ্বলছে। দলেদলে লোকজন আসা যাওয়া করছে। মসজিদের মাইকে
খতমে গাউসিয়া শরীফ পাঠ হচ্ছে।
চিঁহি চিঁহি শব্দ করে ঘোড়াগুলো শূন্যে পা তুলে শান্ত হয়ে দাঁড়ালো। অপরূপা মেয়েগুলোর সাথে গাড়ি থেকে নামলো। গাড়ি চালক বলল
‘ওদের সাথে সাথে যাও। ‘
মেয়েগুলো হি হি করে হেসে বলল,
‘তুমি তো ভয় পেয়ে আছ দেখছি। ভয় পেওনা। আমাদের সাথে আসো। ‘

অপরপা বিনয়ী ভঙ্গিতে মাথা দুলিয়ে ওদের পিছু পিছু গেল।
মেয়েগুলো নিজেদের সাথে কথা বলছে। অপরূপাকে কোনোরূপ প্রশ্ন করছে না কিংবা কথা বলছে না। অপরূপার ভয় হলো। সে কোনো বিপদে পড়বে না তো? পরক্ষণে এখানকার পরিবেশ দেখে মনটা আনন্দে আত্মহারা হলো। বাতাসে পবিত্র খুশবু। আগরবাতি আর গোলাপজলের তীব্র সুঘ্রাণ।
চাদরটা ভালো করে গায়ে জড়িয়ে সে দেখলো অসংখ্য বোরকা পরিহিত হিজাবী যুবতী, মহিলা আর বাচ্চা মেয়ের আনাগোনা।
গাউসিয়া শরীফ পাঠ শেষে এশার আজান পড়লো। ‘আল্লাহু আকবর’ প্রতিধ্বনি কানে আসতেই অপরূপার সমস্ত ভয়ভীতি কেটে গেল।

ঘোড়ার হ্রেষাধ্বনি আর লোকজনের সমাগম, বাচ্চাদের ছোটাছুটিতে হৈচৈ মেতে আছে চারিপাশ। আবাল বৃদ্ধ-বণিতারা পায়েপায়ে হাঁটছে। মসজিদ থেকে কয়েক পথ দূরে নানান ধরণের অস্থায়ী দোকানপাটের মেলা বসেছে। বাচ্চারা সেসব দোকানের আশপাশে ছোটাছুটি করছে। অপরূপার ঠোঁটের কোণায় কিঞ্চিৎ হাসির রেখা ফুটে উঠলো। সত্যি এটা সুন্দরপুর! রূপনগরের একটি অংশ।
শান বাঁধালো প্রকান্ড দিঘীর মতো একটি পুকুর। দুপাশে দুটি ঘাট। মহিলা আর পুরুষের জন্য আলাদা ঘাট। আজানের ডাকে সকলেই দলে দলে অযু করার জন্য ঘাটের দিকে নেমে গেল।
অপরূপা সবকিছু মুগ্ধ চোখে দেখতে দেখতে হঠাৎ করে হারিয়ে ফেললো মেয়েগুলোকে। প্রথমেই ভয় হলো। খুঁজে দেখলো। অনেকক্ষণ খোঁজাখুঁজির পর মনে হলো তারা আশেপাশেই আছে। সে ওই মহিলাগুলোর সাথে অযু করে নামাজ পড়ে নিতে পারবে। খোদার অশেষ মেহেরবান শেরহাম সুলতানের হাত থেকে রক্ষা পেয়েছে সে। এবার তার মুক্তি। দুর্ঘটনা ভেবে ভুলে যাবে সুলতান মহলের সবাইকে। ভাগ্য তাকে যেদিকে নিয়ে যায় সেদিকে যাবে।
মুখ থেকে পর্দা সরিয়ে অযু করে নিল সে। যুবতী,মহিলাগুলোর পেছনে নামাজঘরের দিকে যেতে যেতে কেউ একজন খপ করে তার হাত ধরে বলল,

তুমি পালাচ্ছ কোথায়?
অপরূপা দেখলো ওই মেয়েগুলোর একজন। দেখতে চিকনচাকন সুন্দর চেহারার অধিকারিণী। অপরূপা ম্লানমুখে বলল,
‘নামাজ আদায় করব।’
‘আচ্ছা। ঠিক আছে। আমরা পেছনে সারিতে থাকবো। ‘
আনন্দে অপরূপার মুখশ্রী জ্বলজ্বল করে উঠলো।
‘আমার সাথে আসুন না।’
‘আমার সইরা এখনো ঘাটে। তুমি যাও।’
অপরূপা ঘাড় হেলিয়ে বলল, ‘জ্বি’।
কয়েকজন মেয়েদের সাথে একসারিতে দাঁড়িয়ে নামাজ আদায় করলো অপরূপা। দুটো বাচ্চা মেয়ে তার পাশে এসে বসলো। বলল,
‘এই এই তুমি কি বউ?’
অপরূপা চমকিত হলো। মোনাজাত শেষ করে মেয়ে দুটির দিকে তাকাতেই মেয়েগুলো হাসলো। অপরূপা মিষ্টি হেসে বলল,
‘আমাকে বউয়ের মতো লাগছে?’
‘হ্যা।’
‘তাহলে বউ।’

মেয়েদুটি হাসলো। তাদের মায়ের সাথে টুকটাক কথা হলো অপরূপার। সে সবার কাছ থেকে নিজের নাম গোপন করছে যদি শেরহাম সুলতান এখানে অব্দি চলে আসে? সবাইকে নাম বলেছে হুমায়রা।
মহিলাটির কাছ থেকে অপরূপা জানতে পারলো আজকে এখানে ছোটখাটো একটা মাহফিল হয়েছে। সুন্দরপুরের সবচাইতে বড় মাজার শরীফ আর বড় মসজিদ এটি। বেশিরভাগ সময় এটি লোকসমাগমে মেতে থাকে। প্রায়সময়ই এখানে আসেন তিনি। বাড়িও বেশিদূরে নয়। কিছু মানত ছিল তা দিতে তিনি আজ মাজারে এসেছেন। অপরূপার সময়গুলি চমৎকার কাটলো।

নামাজ কক্ষ থেকে বের হতেই দূরে কয়েকটা ঘোড়ার গাড়ি আর ঘোড়ার দেখা মিললো। মেয়েগুলোকে খুঁজলো সে। হঠাৎ করে এত এত ভীড় হয়ে গেল মেয়েগুলোকে সে খুঁজে পেল না। কোথায় গেল তারা? সে কোথায় খুঁজবে তাদের?
নামাজ আদায় করে মসজিদের ভেতর হতে পুরুষেরা বের হতে লাগলো দলে দলে। সকলের গায়ে পাঞ্জাবি। মাথায় সাদা টুপি। কি সুন্দর দৃশ্য! অপরূপা মসজিদের ভেতরে চোখ দিতেই আচম্বিত বেখেয়ালে চোখ পড়ার পর চোখ সরিয়ে নিয়ে পুনরায় চমকিত হয়ে সামনে তাকাতেই হৃৎস্পন্দন থেমে গেল তার। শ্বাস পড়লো না। না চোখের পলক।
মাথায় রুমাল জড়ানো, সাদা পাঞ্জাবির উপর কালো চাদর পরিহিত সুদর্শন পুরুষটির দিকে চোখ আটকে গেল। পুরুষটির সুস্থির বদনখানিতে লেপ্টে আছে প্রচন্ড গাম্ভীর্যতা। চোখের দৃষ্টি নিরুত্তাপ।

ভয়ে, আতঙ্কে গলার পানি শুকিয়ে এল অপরূপার। নামাজ পড়া শেষে মসজিদ থেকে বের হয়ে চারপাশে চোখ বুলিয়ে কালো চাদর দুকাঁধে জড়িয়ে পেছনে হাত রেখে ডানে-বামে তাকাতে হেঁটে বেরিয়ে এল শেহজাদ। অপরূপা সাদা চাদর তুলে নিজেকে ঢাকলো। মুখের পর্দা নামিয়ে দিল। বুকটা ধুকপুক করে কাঁপছে। হাত পা শীতল হয়ে এসেছে। উনি এখানে কেন? তার খোঁজে এসেছে? না এ হতে পারেনা। সে এমন কেউ নয় যাকে খুঁজতে উনি মহল ছেড়ে সুন্দরপুরে চলে আসবেন। তার জন্য অতটা দরদীও নন উনি। তাহলে এখানে কি?
শেহজাদের পাশে দুজন ইমাম সাহেব এসে দাঁড়ালেন। উনারা বিনয়ী ভঙ্গিতে শেহজাদের সাথে কথা বলতে বলতে হাঁটছেন।

এদিকে শিরনী দেয়া হচ্ছে। তাই সারিতে দাঁড়িয়েছে মানুষ। অপরূপার হাত ধরে সেই বাচ্চা মেয়ে দুটির মা সারিতে তাকে দাঁড় করিয়ে দিল। অপরূপার অন্য কোনো দিকে মন নেই। শেহজাদের দিকে তার চোখদুটো। কিছুতেই চোখে পড়া যাবে না। উনি কি তাকে মহলে ফিরিয়ে নিয়ে যাওয়ার জন্য খুঁজতে বেরিয়েছেন?
অপরূপা কলাপাতায় শিরনী হাতে দাঁড়িয়ে থাকলো। হুট করে কোথায় হাওয়া হয়ে গেল শেহজাদ। অপরূপা ডানে-বামে সামনে পেছনে তাকাতেই দেখতে পেল কলাপাতায় করে ইমাম সাহেবদের সাথে দাঁড়িয়ে শিরনী খাচ্ছে শেহজাদ। এমন পরিস্থিতিতেও অপরূপার কেমন যেন হাসি পেয়ে গেল! সাথে অদ্ভুতও লাগলো। রূপনগরের সম্রাট কলাপাতায় শিরনী খাচ্ছেন?

অপরূপার খিদে পেয়েছে এমনিতেও। সে পর্দা তুলে মাথায় চাদর টেনে শিরনীটুকু খেতেই দেখলো শেহজাদ সে জায়গায় নেই। খাওয়া শেষে আবারও ডানেবামে হাঁটলো। দৌড়ালো। শেহজাদকে দেখতে পেল ঘোড়ার পাশে দাঁড়িয়ে আছে। তাকে ঘিরে দাঁড়িয়েছে অসংখ্য মানুষ। মেয়ে দুটির মা এসে অপরূপাকে বলল,
‘ওই দেখো রূপনগরের সম্রাট এসেছেন। সুলতান মহলের নাম শুনেছ? অনেকদিন কাছ থেকে দেখার ইচ্ছে উনাকে। আজ সত্যিই অন্যরকম একটা দিন। দেখা পেয়ে গেলাম। কি সৌভাগ্য আমাদের!’
অপরূপার জবাব না পেয়ে মহিলাটি বললেন,
‘ তুমিও আজ প্রথম দেখছো না? আমি উনার অনেক নাম শুনেছি। শুনেছি উনার কাছে সবকিছুরই উত্তম ফায়সালা পাওয়া যায়, যা পরে সত্যি সত্যি মঙ্গলময় হয়। ‘

অপরূপা মহিলাটির প্যানপ্যানানিতে বিরক্ত হলো। সে আছে অন্য চিন্তায়। ওই মেয়েগুলো কোথায়? ঘোড়ার গাড়ি কখন ছাড়বে? তারা কোথায় যাবে? নাকি এখানে আশেপাশে থাকবে? যদি এখানে শেহজাদ সুলতানও থাকে? ওই মানুষগুলোকে কি তাকে খুঁজে দেয়ার কথা বলছে? অপরূপা কিছুই বুঝে উঠতে পারলো না। এ আবার কোন বিপদ! শেহজাদের উদ্দেশ্য না জানা অব্দি তার শান্তি নেই। মহিলাটির বাচ্চা মেয়েদুটোকে শেহজাদের পাশে দেখা গেল। তারা শেহজাদের সামনে গিয়ে দাঁড়াতেই শেহজাদ তাদের মাথায় হাত বুলিয়ে দিল। তা দেখে মহিলাটি আনন্দে আত্মহারা, পাগলপারা। তার দুচোখ চিকচিক করে উঠলো। মহিলাটির চোখ অনুসরণ করে অপরূপাও শেহজাদের দিকে তাকালো।

শেহজাদ মাথা থেকে রুমাল খুলে তাতে কয়েকটা পয়সা দিয়ে মেয়ে দুটোর হাতে দিয়ে মাথায় হাত বুলিয়ে দিতেই মেয়ে দুটো হেসে দৌড়ে দৌড়ে মায়ের কাছে এসে বলল,
‘আম্মা সম্রাট পয়সা দিয়েছে। একটা রুমাল।’
মহিলাটি আবেগে আপ্লুত হয়ে রুমালটা নিয়ে সম্মানের সহিত কপালে ছুঁয়ে বলল, এটা তোমার আব্বাজানকে দেবে। সম্রাটের দেয়া রুমাল।’
বাচ্চা মেয়েদুটো ভীষণ খুশি হয়ে বলল,
‘কাল মেলায় যাব আম্মা।’
‘হ্যা যাব। এখন চলো। ‘

মহিলাটি পুনরায় অপরূপার দিকে চেয়ে বলল,
‘আসি কেমন? তুমি কোথায় যাবে?’
‘আমার সঙ্গী আছে। তারা আসবে। ‘
‘আচ্ছা। আসি তাহলে। আল্লাহ হাফেজ। ‘
মহিলাটি চলে যেতেই অপরূপা পুনরায় শেহজাদের দিকে ফিরলো। ঘোড়ার লাগাম ধরে হাঁটতে হাঁটতে শেহজাদ ইমাম সাহেবের কথা বলছেন। সে যেদিকে হাঁটছে সেদিকের লোকজন সরে দাঁড়াচ্ছে। অপরূপা মনে সাহস পেল। তারমানে উনি চলে যাচ্ছেন। একমনে বলল উনি তাকে খুঁজতে আসেননি, অন্য মন বলল উনি তাকে মহলে ফিরিয়ে নিয়ে যেতে এসেছে।

প্রিয় বেগম পর্ব ২৫

শেহজাদ ঘোড়ার উপর উঠে গেল। অপরূপা লম্বা একটি দম ফেললো। শেহজাদের ঘোড়া যেদিকে গেল সেদিকে ছুটলো সেও। মনে হলো শেহজাদ সুলতান আশেপাশে থাকলে সে নিরাপদ। উনি কি চলে যাচ্ছেন? কিন্তু তার পরিণতি কি হবে? কোথায় গেলে তার একটু শান্তি মিলবে? উনি তো উনার ভাইয়ের অপকর্ম সম্পর্কে অবগত থেকেও ভাইয়ের হাতে তাকে ছেড়ে দিয়েছে। অথচ শেরহাম সুলতান বলেছে শেহজাদ সুলতানের কারণেই রূপাকে সে হাতিয়ার বানিয়েছে। তারমানে রূপার আজকের এই পরিস্থিতির জন্য কি শেহজাদ সুলতান দায়ী নন? কি করে ভাইয়ের হাতে থেকে ছেড়ে দিলেন নিশ্চিন্তে? চাপা রাগে, ক্ষোভে শেহজাদকে ভুলতে চাইলো সে। সুলতান মহলের কাউকেই সে আর স্মরণ করবে না। কিছুতেই না। কান্নারা এসে তার গলায় আটকে রইলো। যার কাছে নিজের আশ্রয় খুঁজে সে-ই তার ভাবনাকে পাল্টে দিয়ে অচেনা এক রূপে ধরা দেয়।

প্রিয় বেগম পর্ব ২৭