প্রিয় বেগম পর্ব ৩১
পুষ্পিতা প্রিমা
প্রায় সপ্তাহ পর শেহজাদের চিঠি পেলেন খোদেজা। চিঠি মেলতেই তাতে শেহজাদের হাতের লেখা দেখতে পেলেন তিনি। শেহজাদ লিখেছে,
‘ আসসালামু আলাইকুম আম্মা। জানি আপনার দোয়া সবসময় আমার মাথার উপরে থাকে তারপরও দোয়া চেয়ে নিচ্ছি। আমার জন্য দোয়া করবেন। শীঘ্রই মহলে ফিরছি আমি। বড়দের সালাম আর ছোটদের ভালোবাসা দেবেন। আপনার পুত্র সম্পূর্ণ ভালো আছে। আপনি শরীরের যত্ন নেবেন। আব্বাজানের খেয়াল রাখবেন। সিভান সোনাকে বলবেন তার ভাইজান দ্রুত ফিরছে। ‘
খোদেজা চিঠি পড়ে একফোঁটা চোখের জল ফেলল। অসুস্থতা, সন্তানের চিন্তায়, শেরহামের কর্মকাণ্ডে গত একমাসের ব্যবধানে তার শরীর শুকিয়ে গেছে। চোখের কোটরে ঘন কালির লালিমা। চোখের জলমুছে খুকখুক করে কেশে উঠে সাফায়াতকে বলল,
‘ আর অপরূপা মেয়েটা? তার এখনো খোঁজ পায়নি?
সাফায়াত বলল,
‘ ভাইজান এইবার রূপার কথা বলেনি। খুঁজে পেয়েছে কিনা তাও বলেনি। আশা করছি ভাইজান নিজেই এসে সবটা বলবেন। ‘
আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন
খোদেজা দীর্ঘশ্বাস ফেললেন। কাশিতে উনার গলা ধরে যাচ্ছে। কোনোমতে বললেন,
‘এই একমাস মেয়েটা কোথায় আছে? তার কিছু হয়ে গেলে আমি নিজেকে ক্ষমা করতে পারব না। ডাকাতরা কি তাকে অক্ষত রেখেছে? হে খোদা তুমি তার হেফাজত করো। ‘
সায়রা কক্ষে প্রবেশ করলো। তার চোখমুখ রুক্ষশুষ্ক। সাফায়াত তার দিকে দৃষ্টি মেলে তাকালো। সায়রা চোখ সরিয়ে নিয়ে খোদেজার সামনে গরম পানির গ্লাস রেখে বলল,
‘ ভাইজানের চিঠি এসেছে শুনলাম। কি লিখেছেন উনি?’
সোহিনী, তটিনী, শবনম আর আয়শাও কক্ষে এল। সিভানও এল সোহিনীর সাথে। এসেই খোদেজার পাশে বসে বলল,
‘ শেহজাদ ভাইজান কবে আসছেন? ভাইজানকে অনেকদিন দেখিনা। ‘
খোদেজা তাকে বুকে টেনে নিয়ে বলল,
‘ ভাইজান তোমার জন্য আদর পাঠিয়েছে। আর সবাইকে ভালোবাসা জানিয়েছে। সে খুব শীঘ্রই ফিরছে। ‘
সিভান খুশি হলো। বলল,
‘ খুব মজা হবে। ভাইজান এলে আস্ত কোরমা খাব। বড় মাছের মাথা। ভাইজান আমাকে কাঁটা বেছে খাওয়াবেন।
সায়রা তার ফুলো গাল টেনে দিয়ে বলল,
‘ হুহ। যেন তাকে সবাই অভুক্ত রেখেছে। ভাইজানের সামনে এমনটা বললে তিনি কি ভাববেন? ভাববেন ছোট বাবুকে কেউই খেতে দেয়নি এতদিন। ‘
সিভান গাল ফুলিয়ে বলল,
‘ এতদিন শেরহাম ভাইজানের বকুনি খেয়েছি তাই খাবারের কথা মনে নেই। ‘
কথাটা সে মজা করে বললেও উপস্থিত সকলের মুখে নেমে এল ঘোর আঁধার। খোদেজা সাফায়াতের উদ্দেশ্য বলল,
‘ সে কোথায় এখন? অপরূপাকে পেলে তো হাতপা ভেঙে বন্দি করবে বলেছে। পেল না?’
‘ ভাইজান পাননি রাতদিন খুঁজে। উনি কি করে পাবেন?’
খোদেজা ভারাক্রান্ত মনে বললেন,
‘ সে না পেলেই ভালো। পেলেও কি মেয়েটাকে শান্তি দেবে? কোথায় যে গেল মেয়েটা!”
সিভান বলল,
‘ শেরহাম ভাইজান বলেছে সুন্দর বউ মরে গিয়েছে। সত্যি মরে গিয়েছে? ‘
সোহিনী বলল,
‘ এসব বলো না ভাইজান। এভাবে বলতে নেই। ‘
খোদেজা বলল,
‘ ডাকাতের হাতে পড়েছে। ওদের মনে কি মায়াদয়া আছে? কে জানে বেঁচে আছে কিনা। শেহজাদ হয়ত তাকে ফিরে না পেয়ে চলে আসবে বলেছে। সে যেখানে থাকুক ভালো থাকুক। ‘
মসজিদ ঘিরে ফেলে শেরহামের সৈন্যরা মৌলবি আর রাঁধুনী গুলোকে বন্দি করলো সত্যিটা জানার জন্য। শেহজাদের সৈন্য অল্প সংখ্যক। শেরহামের সৈন্য অনেক। সম্রাট বারণ করে গেছেন যাতে কারো গায়ে কোনো আঘাত না লাগে। প্রয়োজনে তারা এপথে এসেছে তা বলে দিতে। কারণ তাদের অব্দি পৌঁছাতে পারবে না তারা। কাশীম আর বাকি সৈন্যরা শেরহামের সৈন্যদের উপর আক্রমণ করতেই তার মৌলবি আর রাঁধুনিদের প্রাণে মারবে বলে ভয় দেখালো। কাশীম দেখলো পরিস্থিতি বেশ জটিল। মসজিদ মাঠে কালো ঘোড়ার উপর বসা শেরহাম আদেশ দিল ‘
‘ সব কটাকে মার। যতক্ষন না সত্যিটা বলে। ‘
কাশীম রাঁধুনিকে ইশারায় বলল বলে দিতে। রাঁধুনি পরিস্থিতি স্বাভাবিক করার জন্য বললো, ‘ সম্রাট পশ্চিম পাহাড়ের দিকে গিয়েছেন সেই মেয়েটাকে নিয়ে। নিকাহ’র কথা কাউকে বলতে হলো না। শেরহাম তা বিলক্ষণেও ভাবতে পারলো না। তবে শেহজাদের সাথে অপাকে বেশিক্ষণ থাকতে দেয়া যাবে না। কিছুতেই না।
সবাইকে ধাক্কা দিয়ে ফেলে সৈন্যদল শেরহামের পিছু পিছু পশ্চিম পাহাড়ের দিকে ছুটে গেল।
বৃষ্টির স্বাগসম্ভাষণ বার্তা ছড়িয়ে মেঘমেদুর আকাশে মেঘের আঁচল সরিয়ে হীরেরূপি আলো উঁকি দিচ্ছে ধরণীতলে। সাথে মেঘের গুঞ্জন শোনামাত্রই অপরূপার মসৃণ ললাটে ভাঁজ পড়লো। চোখদুটো সরু করে উর্ধ্বগগনে চোখ মেলতেই শঙ্কিত মনে বলল,
‘ বৃষ্টি চলে এল বলে। এখন কি করব? ‘
শেহজাদ তার ঘোড়াকে কূপ থেকে পানি নিয়ে পানি খাওয়াচ্ছিল। অপরূপার প্রশ্নে ঘাড় ফিরিয়ে তাকানোর পর একবার আকাশ পর্যবেক্ষণ করলো। বলল,
‘ কি আর করবে? ভিজবে। ‘
অপরূপা চুপ করে থাকলো। ঠাঁটবাট বজায় রেখে চলা এতবড় মাপের মানুষ যদি কথায় কথায় মজা উড়ায় তাহলে কিছু বলার নেই।
‘ আমরা প্রস্তুত । চলো রওনা দেই। ‘
অপরূপার চোখে চোখ পড়ার সাথে সাথেই শেহজাদ এগিয়ে এসে খানিকটা ঝুঁকে প্রশ্ন ছুড়লো।
‘ কিছু বলতে চাও? ‘
‘ আপনার ভাই কি মসজিদে আসছিলো যার কারণে আপনি চলে এলেন? ‘
শেহজাদ সে কথা কানে না তুলে বলল,
‘ তুমি কি ভিজতে চাও? আপাতত কোনো পোশাক নেই। ভিজে গেলে ভেজা কাপড়ে এই রাতটা পার করতে হবে। কথা না বলে ওঠো। ‘
শেহজাদ ঘোড়ার পিঠে চেপে বসলো। অপরূপা মন খারাপ করে তার পেছনে গিয়ে বসলো। শেহজাদ ওর মুখের রঙ পরিবর্তন দেখে হতাশ নিঃশ্বাস ছাড়লো। সে আছে মহাচিন্তায়। এই গত একমাস রূপাকে খুঁজতে বেরিয়ে জঙ্গলে বনে বাদাড়ে গাছের নীচে সৈন্যদের সাথে রাত কাটিয়েছে সে। কিন্তু এখন সাথে রূপা আছে। আপাতত একটা মাথার চাউনি দরকার পড়বেই।
ভাবতেই সে অপরূপার দুহাত টেনে এনে বুকের কাছে রাখলো। অপরূপা শক্ত করে দুহাতে বেষ্টনী দ্বারা শেহজাদকে ধরলো। ঘোড়া টগবগিয়ে ছুটে চললো বাদল হওয়ার সাথে পাল্লা দিয়ে। ইলশেগুঁড়ি শুরু হলো ঝমঝমিয়ে। শেহজাদ গতি মন্থর করতেই অপরূপা তাকে ছেড়ে দুহাত মেলে দিয়ে গায়ে বৃষ্টি মাখলো। শেহজাদ ঘাড় ফিরিয়ে তাকাতেই আবারও শেহজাদকে ধরলো। চোখ নত করে নিল লজ্জা পেয়ে। মুখটা আকাশের দিক করে রেখে বৃষ্টির মিষ্টি গন্ধ শুঁষে নিল। কতদিন সে মনভরে বৃষ্টি দেখেনি, ছুঁইনি। বাড়িতে থাকাকালীন দাদীজানের বারণ না শুনে সুভাদের বাড়িতে ছুটে যেত সে। দু’জনে মিলে পদ্মবিলে সাম্পান চড়তে যেত। হালকা ঝিরিঝিরি বৃষ্টির সাথে ঝিলের পানিতে সাম্পানে চড়ার মজাই অন্যরকম। আজ যেন ঠিক সেই আনন্দটাই পাচ্ছে হয়ত তার চাইতেও বেশি। এই পথ আজ না ফুরোক।
অন্ধকার তার ঝাঁপি নামিয়ে দিতেই আকাশ ধীরে ধীরে ঝাপসা হচ্ছে । বৃষ্টির তোড়জোড় বাড়ছে। শেহজাদ উপায়ান্তর না দেখে একটা বটগাছের নীচে গিয়ে অবস্থান করলো। রূপনগর এখনো বহুদূর। তাছাড়া এই অন্ধকারে বৃষ্টি মাথায় ঘোড়া বেশিদূর ছুটতে পারবে না। কিছু ভেবে কূল পেল না সে।
অপরূপা বটতলায় দাঁড়িয়ে বলল,
‘ এখানেও কমবেশি বৃষ্টি পড়ছে। আপনি তো ভিজে গিয়েছেন। ‘
শেহজাদ চিন্তিত হয়ে বলল,
‘ তুমিও ভিজে গিয়েছ। এই পথে আসাটা ঠিক হয়নি। যাবই বা কোনদিকে। বৃষ্টি না এলে এই বটগাছের নীচে থেকে যেতাম। এখন তো সমস্যা। ‘
শেহজাদের চিন্তা দেখে অপরূপার খারাপ লাগলো। বিকট শব্দে বাজ পড়ছে। তা দেখে শেহজাদ অপরূপার পাশে এসে দাঁড়ালো। বলল,
‘ ভয় পেওনা। একটা ব্যবস্থা হবেই। ‘
অপরূপা ভরসা পেল।
তারা কয়েকটা মুহূর্ত দাঁড়ালো সেথায়।
হঠাৎ দূরে পাহাড়ের উপর হতে আলোর মশাল জ্বালিয়ে একদল ডাকাত সৈন্যদের ছুটে আসতে দেখা গেল। আবরক নির্মিত মশাল হওয়ায় বৃষ্টিজল তা নিভিয়ে দিতে পারছেনা। দাউদাউ করে মশালের আগুনের আলোয় পরিষ্কার সব দেখা যাচ্ছে। নিশ্চয়ই ভাইজানের লোকজন! এই মুহূর্তে অপরূপাকে পেলে তুলে নিয়ে যেতে উনি দুবার ভাববেন না। অপরূপা তা দেখে শেহজাদের হাত ঝাঁকিয়ে বলল,
‘ কিছু একটা করুন। এই মুহূর্তে গা ঢাকা দিতে হবে। আমি উনার মুখোমুখি হতে চাইনা এখন। আপনি একা সবার সাথে কি করে লড়বেন? আমার কাছে অস্ত্র নেই। প্রস্তুত হয়ে উনার মুখোমুখি হবো। তার আগে নয়। আমার কথা শুনুন। ‘
শেহজাদ ওর ভীতসন্ত্রস্ত মুখের দিকে তাকিয়ে আশ্বাস দিয়ে বলল,
‘ এত ভয় পাওয়ার কিছু নেই রূপা। ”
অপরূপা শান্ত হলো। শেহজাদ একহাতে ঘোড়া অপরহাতে অপরূপার হাত ধরে দ্রুতপায়ে পাহাড়ের পাদদেশে অবস্থিত একটি গুহার সামনে গিয়ে থামলো। চারিদিকে অন্ধকারে ঢেকে যাচ্ছে। কিছু একটা করতে হবে তার আগে। শেহজাদ দেখলো ছোট ছোট মশাল হাতে দু-জন লোক কথা বলতে বলতে হেঁটে চলে যাচ্ছে । শেহজাদ তাদের ডাক দিল। লোকগুলো ঘাড় ফিরিয়ে তাকালো। পায়ে হেঁটে এল। শেহজাদকে দেখে তারা হতচকিত। সম্রাটের কথা শুনেছে তারা। কোনো একটা মেলায় দেখেছেও। আজ সামনাসামনি দেখে মনে হলো তারা ভুল দেখছে। শেহজাদ তাদেরকে সবকিছু খুলে বলতেই তারা আনন্দের সহিত বলে উঠলো তাদের সাথে যেতে। তারা কাঠুরে। একটা পরিত্যক্ত বাড়িতে কয়েকদিনের জন্য বসতি গেঁড়েছে পাহাড়ে ধস নামায়। পাহাড়ের নীচে তাদের ঘরবাড়ি চাপা পড়েছে। তাই জঙ্গলের মধ্যিখানে সেই পরিত্যক্ত বাড়িতে তারা থাকে স্ত্রী সন্তান নিয়ে। চাইলে সেখানে থাকতে পারেন রাতটা। কষ্ট হবে কিন্তু বৃষ্টি থেকে আশ্রয় তো পাবেন।
অপরূপা শেহজাদকে বললো,রাজী হতে।
শেহজাদের রাজী হতে চাইলো না হঠাৎ একটা কথা মনে পড়ায়। আম্মার বিশ্বাস, নতুন বিবাহিত বধূদের উপর খারাপ জিনিস বেশি আসক্ত হয়ে পড়ে। যদিও সে সেসবে পুরোপুরি বিশ্বাস করেনা কিন্তু মনের ভেতর থেকে খচখচানি পুরোটা গেল না। উপায়ান্তর না দেখে সে রাজী হলো।
বৃষ্টি থেমেছে। মেঘের গুঞ্জন এখনো রয়েছে। বৃষ্টি আরও হবে। ঝিঁঝি পোকার শব্দে কান উড়ে যাওয়ার মতো অবস্থা। অপরূপা আর শেহজাদ ভেজা। বৃষ্টির পানি সপসপ করছে গায়ে। জঙ্গলের ভেতর হাঁটতে হাঁটতে অপরূপার পাদুকায় কখন কাঁটা ঢুকে গিয়ে পা কাটা গেল। সে টেরও পেল না।
যখন সেই বাড়িটার কাছাকাছি গেল দেখলো প্রকান্ড একটি বাড়ি। যার চারপাশে দাউদাউ করে কাঠপোড়া আগুন জ্বলছে। চারপাশটা সেই আলোয় আলোকিত। বাড়িটা অদ্ভুত! দেয়াল ধসে ধসে পড়ছে। মাথার উপরের ছাদ ভেঙে পড়ার দশা। পানি পড়ছে। বাড়ির চারপাশে বন্যলতা, ঝোপঝাড় বেড়ে উঠেছে। মেঝেতেও শ্যাওলা ঝড়াপাতা বিছিয়ে আছে। সেই বাড়ির ভেতরে বাঁকা হয়ে একটা গাছ বেড়ে উঠেছে। গাছটিতে কোনো পাতা নেই। শুধুই ডাল রয়েছে। অপরূপার দৃশ্যটা ভারী সুন্দর লাগলো। বাড়িটার দরজা, জানালা কিছুই অবশিষ্ট নেই। দরজার সামনে কাঠুরে কাটা গাছ জমিয়ে জমিয়ে দেয়ালের মতো বানিয়েছে স্ত্রী সন্তানদের সুরক্ষা কবচ হিসেবে। বাড়িটির সামনের কক্ষের পরের কক্ষটির একটা পাশ পরিষ্কার করে দুই পরিবার থাকার বন্দোবস্ত করেছে। সামনের কক্ষটি হয়ত বসার ঘর ছিল! অনেকটা জায়গা জুড়ে কক্ষটি।
শেহজাদ বলল, ‘এখানে কিভাবে থাকব? বন্য জন্তুজানোয়ার আপনাদের আক্রমণ করেনা? ‘
‘ করে সাহেব। চারপাশে আগুন জ্বালিয়ে রাখি। আগুন দেখলে তারা আর আসেনা। প্রথমদিকে অনেক বেশি জ্বালাতো। এখন আর করেনা। তবে সাপখোপের আঁখড়া বেশি। হাতে টাকা এলেই লোকায়তে চলে যাব এই শীতে। বাচ্চাদের নিয়ে থাকা অনেক কষ্টের। ‘
অপরূপার মায়া হলো। এদিকে পায়ের যন্ত্রণা বাড়তে লাগলো। কি হলো কে জানে! আপাতত একটা ঘুমানোর জায়গা পাওয়াটা মূল লক্ষ্য । সারাদিন যা গেল তার উপর দিয়ে! সেই ভোরে উঠেছে। ক্ষিদেও পেয়েছে বেশ। পুটলিতে খাবার আছে। খেয়ে নেবে।’
কাঠুরেদের স্ত্রী সন্তান ছুটে এল। সম্রাট আর সম্রাটের বেগমকে দেখে তাদের চক্ষু ছানাবড়া। চোখ নত করে সালাম জানাতেই অপরূপা আর শেহজাদ দেখলো দুই কাঠুরের দুই স্ত্রীর সাথে তাদের দুটো সন্তান এসেছে। দুটোই ছেলে। হঠাৎ সিভানের কথা মনে পড়লো শেহজাদের। মনটা কেমন যেন করে উঠলো। সিভানের বুদ্ধি হওয়ার পর থেকে বেশিরভাগ সময় ধমক দিয়ে দিয়ে পাঠে বসাতে হয়েছে শেহজাদকে। সে বললেই সোজা পড়তে বসে। নয়ত মহলের সবাইকে পাগল বানিয়ে ছাড়ে। এইবার ফিরে গিয়ে মনভরে আদর করবে। নিশ্চয়ই সেও শেহজাদ ভাইজানের অনুপস্থিতি অনুভব করছে!
অপরূপা বাচ্চাগুলোকে ডাকলো কিন্তু তারা এল না। মায়ের আঁচলের নীচে লুকিয়ে গেল। তাদের চোখ শেহজাদের ঘোড়া বাদশাহর দিকে। মনভরে দু-চোখ দিয়ে বাদশাহকে দেখছে তারা। মশা কামড়াচ্ছে তাই পা নাচাচ্ছে বাদশাহ।
কাঠুরে তাদের নিয়ে ভেতরে গেল। শেহজাদ বলল,
‘ আমরা তাহলে এখানেই থাকবো। ‘
কাঠুরে বলল,
‘ না সাহেব তা কি করে হয়? আপনার সাথে বেগম আছেন। আমাদের লজ্জা দেবেন না। আমরা একটা রাত এখানে থাকতে পারব। আপনাকে সাহায্য করতে পেরে আমরা ধন্য হবো। ‘
শেহজাদ বলল,
‘ না এ হয় না। আপনারা দুটো পরিবারের মানুষ আমাদের জন্য কষ্ট করবেন তা হয় না। এখানে আমি ব্যবস্থা করে নেব। এত চিন্তার কিছু নেই। ‘
তারা সন্তুষ্ট হলো সম্রাটের ব্যবহারে।
কাঠুরের স্ত্রীদের সাথে ভেতরে চলে গেল অপরূপা। দেখলো তাঁবুর মতো করে পর্দা দিয়ে ঘর বেঁধেছে তারা। চারপাশে দেয়াল আর মাথার চাউনি । মাটির চুলো। আগুন ধরানোর জন্য শুকনো কাঠ। কাপড় শুকানোর জন্য রশি টানা। একটা পানির জলাধার। অপরূপার খুব পছন্দ হলো। পায়ের জুতো খুলতেই দেখলো রক্তে জুতোটা ভিজে উঠেছে প্রায়। তারা আঁতকে উঠে। রক্ত বন্ধ হওয়ার জন্য তরল ঔষধের বোতল এনে পায়ে ঢেলে দিতেই অপরূপার শ্বেতকায় পা সবুজ রঙে মেখে গেল। জ্বলুনি অনুভব হতেই কাঠুরে বউ বাতাস করতে লাগলো। বললো,
‘ সম্রাটকে একথা জানাবো বেগম? ‘
অপরূপা ঔষধগুলো মুছে পাদুকায় পা ঢেকে বলল,
‘ কোনো দরকার নেই। সামান্য ক্ষত। ‘
‘ আপনার পোশাক ভিজে গিয়েছে। আমরা আপনার জন্য কি করতে পারি?’
পোশাক চাইতে অপরূপার লজ্জা লাগলো। তাদের পোশাক আছে কি নেই। না থাকলে তো তারাই লজ্জায় পড়ে যাবে।
বেঁটেখাটো কাঠুরে বউটি তার কক্ষ থেকে বেরিয়ে এল একটা শাড়ি নিয়ে। বাসন্তী রঙের শাড়ি। বলল,
‘ এইটা শুধু আনতে পারছি বাড়ি থেকে। এইটা আপনাকে অনেক সুন্দর লাগবে। ‘
অপরূপার শাড়িটা বেশ পছন্দ হলো। সে বলল,
‘ আচ্ছা। সম্রাটের কাছে যাই। আমরা আজ একসাথে খাব কিন্তু। আগেভাগে খেয়ে নেবেন না। ‘
তারা খানিকটা দ্বন্দ্বে পড়ে গেল। ওইসব শাকপাতা খাবেন সম্রাট আর বেগম? আজ তাদের বিবাহের প্রথম রাত! আহা কি দুদর্শায় না পড়ে এখানে আশ্রয়ে এল। এটা তারা লোকেমুখে বলে বলে শোনাতে পারবে একসময়।
অপরূপা গিয়ে দেখলো শেহজাদ আর কাঠুরে মিলে জায়গাটার শ্যাওলা পরিষ্কার করছে। অপরূপাকে দেখে শেহজাদ ঘাড় ফিরিয়ে তাকালো। তার চুলগুলো কপালের সামনে এসে জড়ো হয়েছে। ভেজা গায়ে পাঞ্জাবিটি লেপ্টে আছে। চোখদুটো লালচে রঙের দেখালো। বৃষ্টিতে ভেজায় হয়ত! অপরূপার কাছে এগিয়ে এসে বলল,
‘ উনাদের কাছ থেকে একটা পোশাক নাও। আর পাল্টে ফেলো। পুটলিতে আমার একটা পায়জামা আর ফতুয়া পেয়েছি। আমার কিছু দরকার নেই। ‘
‘ আমার জন্য কিছু দিল না? ‘
শেহজাদ হাসলো।
‘ দুঃখীত বেগম। ওটা আপনার না আমার পুটলি ছিল। ঠিক আছে? যান দ্রুত পোশাক পাল্টান। ‘
অপরূপা অভিমানী দৃষ্টিতে তাকিয়ে পোশাক পাল্টাতে চলে গেল। শাড়ি পড়ে ভেজা চুলগুলো ছেড়ে দিল। চিকনগোছের কাঠুরে বউটি বলল,
‘চুল খুলে দিন। শুকিয়ে যাবে রাতের মধ্যে।’
অপরূপা চুল খুলে দিল। গলার গয়নাটা পড়লো শুধু। কঙ্কন খুলেনি। বাকিগুলো পুটলিতে রেখে দিল।
শেহজাদের পুটলি হতে খাবারদাবার সবকিছু একে একে বের করলো অপরূপা। মজাদার খাবারের গন্ধে ম ম করে উঠলো চারপাশ। অপরূপা দুটো বাসনে দুই পরিবারের জন্য মোরগ মোসাল্লাম, গোশত, কাবাব, ভাত, ডাল মাখানি ভাগ করে করে দিল। তারপর একটা বাসনে তার আর শেহজাদের জন্য রাখলো। বলল, এটা রিজিকে ছিল বলে অতদূর থেকে এখানে চলে এল। নিকাহ উপলক্ষে এসবের আয়োজন হয়েছে।
কাঠুরে বউ দুটির চোখ চকচক করে উঠলো। কতদিন বাচ্চাগুলো ভালোমন্দ খায় না। বাচ্চা দুটো বাদশাহকে নিয়ে খেলায় ব্যস্ত ছিল । মা তাদের ডেকে নিয়ে এসে খেতে দিল। অপরূপা তাদের পাশে বসে খাওয়া দেখলো। বাচ্চা খাচ্ছে, মা তা নয়নভরে দেখছে। এর চেয়ে সুন্দর দৃশ্য কি হতে পারে? আফসোস মায়ের মহব্বত সে কখনো পায়নি।
অপরূপা উঁকি দিয়ে দেখলো কাজ হয়েছে কিনা। দেখলো তেরপালের ঘর তৈরি হয়ে গিয়েছে। যদিও ভেতরে কেমন তা সে দেখতে পাচ্ছে না।
সব কাজ শেষ করতে করতে অঝোর ধারায় বর্ষণ নেমেছে পুনরায়।
সব গুছিয়ে কাঠুরে দু’জন খেতে চলে গেল। অপরূপা এসেই দেখলো শেহজাদ বৃষ্টির পানিতে হাতমুখ ধুচ্ছে। অপরূপা তার চোখের আড়ালে ঘরের ভেতর ঢুকে গেল। দেখলো কাঠের তক্তা বিছিয়ে ঘুমানোর ব্যবস্থা করা হয়েছে। নরম করার জন্য উপরে শুকনো খড় বিছিয়ে দেয়া হয়েছে। একটা পাতলা কাঁথা তার উপর সুন্দর করে বিছিয়ে দেয়া। দুটো কাপড় দিয়ে বানানো বালিশ সেই কাঁথার নীচে। অপরূপার কাছে স্বপ্নের মতো মনে হলো সবটা। মাথার উপর খোলা। এদিকে ছাদটা তাও খানিকটা অক্ষত আছে। তার পানি গড়িয়ে পাশেই পড়ছে। তাই উপর ছাউনি দেয়ার প্রয়োজন হয়নি। তেরপাল সরানোর আওয়াজ হতেই কেঁপে উঠে পিছু ফিরতেই ঝট করে দ্রুতগতিতে সামনে ফিরে গেল অপরূপা। চোখদুটো খিঁচিয়ে বন্ধ করে ফেললো। শেহজাদ ভেজা পাঞ্জাবি খুলে ভেতরে প্রবেশ করেছে। বাসন্তী রঙে অপরূপাকে দেখে কপাল কুঁচকে কয়েকপল তাকিয়ে তার পুটলিটা খুঁজলো। না পেয়ে বলল,
‘ ওটা তোমার কাছে? ‘
অপরূপা তার দিকে না ফিরে বলল,
‘ কি? ‘
‘ পুটলিটা। ওখানে আমার পোশাক ছিল। ‘
অপরূপার হাতেই ছিল পুটলিটা। সে পিছু হাঁটতে শেহজাদের কাছাকাছি গিয়ে পুটলিটা দিতেই শেহজাদ বলল,
‘ কি হয়েছে? ‘
‘ কিছু হয়নি। পোশাক পড়ে নিন। ‘
শেহজাদ এবার বিষয়টা বুঝতে পারলো। খপ করে শাড়ির আঁচল টেনে মুখ মুছতে মুছতে বলল,
‘ একটা তোয়ালে আনা উচিত ছিল। ‘
অপরূপা দম আটকে দাঁড়িয়ে রইলো। শেহজাদ শাড়ির আঁচল হাতে প্যাঁচাতে প্যাঁচাতে একটান দিল।
অপরূপা পিঠ গিয়ে ঠেকলো তার বুকের সাথে। শিহরিত হয়ে অপরূপা বলল,
‘ হায় আল্লাহ! এভাবে লজ্জায় ফেলবেন না। আমি মারা যা**ব।
শেহজাদ সশব্দে হেসে উঠে তাকে ছেড়ে দিল। অপরূপা প্রাণ নিয়ে পালালো একপ্রকার। বাদশাহর কাছে ছুটে গিয়ে ওর সামনে বসে হাঁপাতে হাঁপাতে বলল,
‘ তোমার মনিব মোটেও সভ্য নয়। ‘
শেহজাদ একটা ধূসর রঙের লম্বা হাতার ফতুয়া আর সাদা পায়জামা পরিধান করে ঘর থেকে বেরিয়ে এল। দেখলো অপরূপা দেয়ালের ফটক দিয়ে হাত বের করে ডান হাতের তালুতে বৃষ্টির ফোঁটা জমাচ্ছে। তা আবার বাম হাতের তালুতে নিচ্ছে। শেহজাদ এসে তার পেছনে দাঁড়িয়ে পড়লো। বলল,
‘ বাসন্তী কন্যা। খেতে আসুন। ‘
অপরূপা পিছু ফিরে বলল,
‘ আগে কথা দিন লজ্জা দেবেন না। ‘
শেহজাদ ঘাড় ফিরিয়ে কপাল উঁচিয়ে বলল,
‘ আমার ন্যূনতম লজ্জা নেই। তোমাকে দেব কি করে? ‘
এরূপ উত্তরে অপরূপার চোয়াল ঝুলে পড়লো। অসহায় দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলল,
‘ লজ্জায় ফেলবেন না। ‘
‘ না না ফেলবো কি করে? আমি মহৎপ্রাণ মানুষ। বেঁধে রাখবো। এসো। ‘
বলেই তেরপালের ঘরে ঢুকে গেল। অপরূপা শ্লথগতিতে কুণ্ঠাবোধ নিয়ে পা বাড়ালো। কক্ষে ঢুকতেই দেখলো শেহজাদ বাসন হাতে বসে আছে।
অপরূপা ওর পাশে গিয়ে বসলো। শেহজাদের ওর হাতের তালুতে বাসন তুলে দিয়ে বলল,
‘ পেটে তো কোকিল ডাকছে। দেখি পোড়া হাতের ভাত কেমন মজা। ‘
অপরূপা ওর হাতের তালুতে দেখলো পোড়া দাগ। মোমবাতি হাতে ঘন্টার পর ঘন্টা শেরহাম সুলতানের জাদুর ধ্যানে বসে থাকার ফল। অপরূপার মন খারাপ করে ভাতের লোকমা মাখতে মাখতে শেহজাদের দিকে এগিয়ে দিল। শেহজাদ খেতে খেতে বলল,
‘ সব খাবার দারুণ হয়েছে। তুমিও খাও। ‘
অপরূপার বাড়িয়ে দেয়া লোকমাটা অপরূপার দিকেই ঠেলে দিল সে। অপরূপা খেতে খেতে অশ্রুজলে হাসলো। বলল,
‘ ওই খাবারগুলোতে অনেকগুলো এতিম বাচ্চার রিজিক ছিল। আর এখানে ছয়জন মানুষের। দারুণ তো হবেই। আমি উনাদের বেশি করে দিয়ে ফেলেছি। আমাদের এতটুকুতে হয়ে গেছে। ‘
‘ খুব ভালো করেছ। ওরা মানুষ ভালো। ‘
অপরূপা স্নিগ্ধ হাসলো । বাসনটা নিয়ে বেরিয়ে গেল। বৃষ্টিজলে সেটি ধুঁয়ে বাদশাহকে খেতে দিয়ে ঘরে চলে এল। শেহজাদ পোশাকগুলি চিপে শুকোতে দিচ্ছে। অপরূপা বলল,
‘ ভেজা পোশাকে বেরিয়ে পড়তে হবে সকালে। অনেক ভারী পোশাক। শুকোবে না। ‘
‘ তখন দেখা যাবে। ‘
অপরূপা বাসন রেখে বলল,
‘ আগুন কমে আসছে। দুটো কাঠ ফেলতে হবে। ‘
শেহজাদ আগুনে কাঠ দিয়ে ফিরে এল। দেখলো অপরূপা হাতের কঙ্কন খোলার চেষ্টা করছে। শেহজাদের ওর পেছনে হেঁটে তেরপাল টেনে কক্ষের দরজা টেনে দিতেই কক্ষের ভেতরটা আবছা হয়ে এল। অপরূপা পেছনে ফিরে তাকাতেই বক্ষঃপঞ্জরে প্রবল তোলপাড় টের পেল।
শান্ত থাকা মুশকিল হয়ে পড়লো। শেহজাদ ওর পেছনে এসে বসে হাতের উপর হাত রেখে কঙ্কণ খুলে নিল ধীরেধীরে। অপরূপা ওর মুখের দিকে তাকিয়ে রইলো নিষ্পলক। শেহজাদ ওর চোখে চোখ রেখে ভুরু উঁচিয়ে বলল,
‘ শেহজাদ সুলতানকে কতটুকু চেনা হয়েছে? ‘
অপরূপার চোখজোড়া শীতল হয়ে এল। চোখের কানায় কানায় ভরে উঠলো জল। একদিনে যদি একটা মানুষকে চেনা যায় কিনা প্রশ্ন করা হয় তাহলে চোখ বন্ধ করে বলে দিতে পারবে, হ্যা চেনা যায় যদি সে শেহজাদ সুলতানের মতো মানুষ হয়। তার বিশ্বাস আজকের শেহজাদ সুলতান আর বিশ বছর পরের শেহজাদ সুলতান ঠিক এমনি থাকবেন। এমনি পুতঃপবিত্র সুপুরুষ।
শেহজাদ ওর চোখে জল দেখে উত্তর পেয়ে গেল।
চুল সরিয়ে গলার গয়নাটা খুলে দিয়ে উষ্ণ ওষ্ঠপুট উন্মুক্ত গ্রীবাদেশে ছোঁয়াতেই সন্তাপে ডুকরে উঠলো অপরূপা। দ্রুত সরে গিয়ে শাড়ির আঁচল হাতের মুঠোয় চেপে ধরলো। সবটা মিথ্যে হয়ে যাক। তার জীবনে রহমানের রূপ ধরে শেরহাম সুলতানের আগমন, মিথ্যে ভালোবাসা, মিথ্যে নাটক, মিথ্যে প্রেম, সব সব সবটা মিথ্যে হয়ে যাক। শুধু সত্যি হয়ে সম্রাট থাকুক। এত পাপিষ্ঠ হয়ে কি করে নিজেকে সমর্পণ করবে সে?
শেহজাদ এসে ওকে পাঁজাখোলা করে তুলে বলল,
প্রিয় বেগম পর্ব ৩০
‘ বাইরে জঙ্গলের বাঘ ভাল্লুক আছে। দিয়ে আসি? ‘
অপরূপা টাল সামলাতে না পেরে ওর গলা জড়িয়ে ধরে চোখের জল ছেড়ে দিয়ে বলল,
‘ শেরহাম সুলতান ছাড়া আপনি যার কাছে যেতে বলবেন চলে যাব। মৃত্যুও হোক। ‘
শেহজাদের চোখের তারায় মুক্তঝরা হাসি। ধীরেধীরে মুখ নামিয়ে অপরূপার কপালের মধ্যিখানে ঠোঁটজোড়া চেপে ধরলো সজোরে।