প্রিয় বেগম সিজন ২ পর্ব ৩৩ (২)

প্রিয় বেগম সিজন ২ পর্ব ৩৩ (২)
পুষ্পিতা প্রিমা

তাঈফের মা বাবা চলে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেন। বিয়ের পর ছেলের বউকে বাড়ি নিয়ে যাবেন এটাই তো স্বতঃসিদ্ধ নিয়ম। কিন্তু ছেলে নাকি কথা দিয়ে রেখেছে বউকে সে এখানেই রাখবে। ছেলের উপর রাগে তিনি আর থাকতে চাইলেন না। তাঈফ সোহিনীকে বলে যাতে, মাকে থাকার জন্য অনুরোধ করে। সোহিনী তাকে জবাব দেয়, আপনার মা আমার কথা শুনবে যেখানে আপনার কথা শুনছেনা? ‘
‘ তাও একবার বলে দেখো। ‘

সোহিনী উনাকে অনুরোধ করলেন কিন্তু উনি ভীষণ খেপে আছেন। কারো কথা শুনবেন না। বললেন, আমি নাদিরের সাথে চলে যাচ্ছি। ও আমাদের নামিয়ে দেবে। তুমি থাকো তোমার বউকে নিয়ে এখানে। মা বাবাকে দরকার নেই। ‘
তাঈফ মহাসংকটে পড়ে গেল। সোহিনী কিছুতেই যেতে রাজী নয়। ডাক্তার বলেছে তটিনী আর অপরূপার প্রসব বেদনা উঠতে পারে যেকোনো সময়। তাকে তার ভাইপো ভাইঝির দেখভাল করতে হবে। শেহজাদ ভাইজান বলেছেন ডাকতরা হামলা করার জন্য ওঁৎ পেতে বসে আছে। চারিদিকে বিপদ আর বিপদ। সেখানে সে শ্বশুরবাড়িতে গিয়ে রঙ্গ করতে পারবে না। তাইয়্যেবা বেগম আর আফজাল সাহেব নাদিরের সাথে রওনা দিলেন। নাদিরের মা ফজল সাহেবের বোন। গত চার বছর পূর্বে বোন আর বোন জামাতা মারা যান।

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

নাদিরের বড় বোন বিবাহিত। তার বেশিরভাগ সময়ই কেটে যায় জাহাজে। মাঝেমধ্যে তো নিরুদ্দেশ হয়ে যায়। কেউ খোঁজও পায় না। মামাদের সাথে তার সম্পর্ক খুব ভালো। কিন্তু তারপরও তাকে মামার বাড়িতে কেউ নিয়ে যেতে পারেনা। সে একলা একা থাকতে ভীষণ পছন্দ করে। অথৈ সমুদ্রে ঝড়-তুফান, আর জলদস্যুদের সাথে লড়াই করে জয়ী হয়ে ফিরে আসার মাঝেই সে আনন্দ খুঁজে পায়। নিজ মায়ের পিতৃভিটায় যাকে কেউ শত অনুরোধ স্বত্বেও নিয়ে যেতে পারেনা সে দিব্যি সুলতান মহলের আতিথেয়তা সানন্দে গ্রহণ করে নিয়েছে। এটা তাঈফের কাছে বেশ বিস্ময়কর হলেও নাদিরের কাছে খুবই সামান্য। সুলতান মহলের আতিথেয়তা তার ভালো লেগেছে বিধায় থেকেছে। তার চাইতে বেশি কিছু নয়। ফজল সাহেব চিন্তিত বোনের এই পুত্রের জন্য।

তাই একবার বিয়ের কথাটাও পেড়ে দেখেছে তার সামনে। সে সরাসরি নাকচ করে দিয়েছে। যেখানে তার জীবনের দু সেকেন্ডের বিশ্বাস নেই, যেকোনো সময় অতল সমুদ্রের গহবরে হারিয়ে যেতে পারে, ভয়ংকর জলদস্যুদের হাতে মরতে পারে সেখানে অন্য একটা প্রাণ নিজের সাথে জড়িয়ে ফেলা অসম্ভব। নিজের প্রাণের মায়া না থাকলেও অপরের প্রাণের মায়া তার আছে। যে মেয়েটির কথা মামু তাকে বলেছে সে নিজেও নিকাহ নামক সম্পর্কের বন্ধনে জড়াতে চায় না। তাহলে কেন এসব কথা উঠছে? ফজল সাহেব আর কিছু বললেন না। শাহানা সাফায়াতের কথায় শুরুর দিকে মন ঘামালেও যখন জানতে পারলেন ছেলের অভিভাবক বলতে তেমন কেউ নেই, মাঝসমুদ্রে তার দিনরাত কাটে তখন তিনি বেঁকে বসলেন।

সেসব কথা ছড়াছড়ি হওয়ার পূর্বেই তিমি ধামাচাপা দিলেন তবে সে কথা শবনমের কানে পৌঁছায়নি এমন না। দুদিন আগেও যে কোনো পুরুষ মানুষকে ভাবতেও চায়নি, এখন তার ভাবনায় শ্যামবর্ণের গোমড়ামুখো একটা মুখ ভেসে উঠে। ভাবতেই খারাপ লাগে মানুষটার সব থেকেও কেউ নেই। জীবনটা এমন অদ্ভুত কেন? লোকটার সাথে তার একবারই কথাবার্তা হয়েছে। সামনাসামনি পরে গেলেও কখনো চোখাচোখি হয়নি অথচ কথাটা শোনার পর কেমন মন খারাপে ছেয়ে গেছে তার। আপুর কষ্ট দেখার পর আম্মা কখনো এমন পাত্রের কাছে তাকে সম্প্রদান করবে না। সেও চায় এমন না, তার ও একটা সুরক্ষিত জীবন দরকার। আপুর মতো দুঃখের ভেলায় ভাসার শক্তি, সাহস তার নেই। কিন্তু খারাপ লাগা কমছেনা।

নানাজান চলে যাওয়ার তোড়জোড় শুরু করলেন। বেজায় রেগে আছেন উনি। উনার ভৃত্য দু’জনের সাথে চেঁচামেচি করছেন।
শেরতাজ সাহেব, শেহজাদ, সাফায়াত সকলেই চুপচাপ দাঁড়িয়ে আছে। কেউ কোনো কথা বলছেনা। রাগে রক্তবর্ণ হয়ে উঠেছে নানাজানের হলুদাভ মুখমণ্ডল। চোখদুটো দিয়ে রক্ত ঝড়ছে। চোখে জলও দেখা যাচ্ছে। কেউ কথা বলার সাহস করে উঠতে পারছেনা। নানাজান গাট্টি বোচকা বাঁধছেন। পড়নের শালে ঘনঘন চোখ মুছছেন। তটিনী অপরূপা খোদেজা শাহানা সকলেই চত্বরে এসে দাঁড়ালো চেঁচামেচি শুনে। তিনি এভাবে চোখ মুছে যাচ্ছেন কেন? কেন কাঁদছেন? তটিনীর বুক ধড়ফড়িয়ে উঠলো। ও কি নানাজানের সাথে বেয়াদবি করেছে? হায় আল্লাহ নানাজানের যদি অভিশাপ পড়ে? তার হাঁটুজোড়া কেঁপে উঠলো। শেরহাম বেরিয়েছে। বলেছে মাগরিবের আগে ফিরবে। অনেক কান্নাকাটি করে তটিনী তাকে রাতটা থাকার জন্য রাজী করিয়েছে। পরিস্থিতি অস্বাভাবিক দেখলে সে রাজী হতো না। স্বাভাবিক থাকায় রাজী হয়েছে। কিন্তু কি এমন ঘটলো যার জন্য নানাজান এভাবে কাঁদছেন? তটিনী নেমে গেল কাঁপা-কাঁপা পায়ে বহুকষ্টে। সোহিনী শবনম তাকে নিয়ে এল নানাজানের কাছে। সে আসামাত্রই নানাজান চোখ সরিয়ে নিলেন। তটিনী হাঁটুর কাছে গিয়ে বসলো। বলল,

‘ ও তোমার সাথে খারাপ ব্যবহার করেছে নানাজান? আমাকে বলো। ‘
নানাজান চেঁচিয়ে বললেন,
‘ আমাকে কিছু জিজ্ঞেস করিস না। চলে যাচ্ছি আমি। ওরা মা ছেলে শেষ করে দিল আমার সব আশা-ভরসা। কত আবদার করে বললাম আমার সাথে একটাবার মসজিদে চল। গেল না। আমাকে যা তা বলে গেল। বলল, আমাকে দুর্বল করে দিচ্ছ, আমি জাদুবিদ্যা ছাড়া ওদের সাথে লড়তে পারব না, এসব ছাড়তে পারব না, তোমার খোদার সাধ্যি আছে এতবড় পাপীর পাপ ক্ষমা করার? কতবড় কথা। আরও বললো আমি নাকি মহলে পড়ে আছি। চলে যাচ্ছিনা কেন? আমি নাকি ওর খারাপ চায়। ওকে মারতে চায়।

ওকে দুর্বল করে দিচ্ছি। ওর শক্তি কি দিল ওকে জিজ্ঞেস কর কেউ। কি দিল ওকে? সব কেড়ে নিয়েছে সেই অপয়াশক্তি। বাচ্চাটার উপর বালামুসিবত না আসার জন্য আমি ওকে সুপথে আহ্বান করেছি। একজন সন্তানের জন্য মা খোদার দরবারে দু-হাত তুললে বাবা তুলবে না কেন? নিজের ভালো চায়নি, বউয়ের ভালো চায়নি, এখন সন্তানের ভালো চাইছেনা। আমি জিজ্ঞেস করলাম বাচ্চাটাকেও ওসব কাজে জড়াবি নাকি? মুখের উপর বলে দিল, হ্যা জড়াবো। ওকে জাদুনগরীর বাদশাহ বানাবো। তুমি কি করবে? যা করার করো। আমি বললাম তোর বউ জানে এসব? বলল, ওকে কিছু বললে জানে মেরে ফেলবো। গুম করে ফেলবো বুড়ো। আমার জীবনটায় বৃথা। কাউকে পথ দেখাতে পারলাম না। খোদার কাছে গিয়ে কি জবাব দেব আমি? মেয়েকে না বাঁচাতে পারলাম এই অপয়াশক্তির হাত থেকে না নাতিকে। কিভাবে এই মুখ দেখাবো আমি? ‘

বলতে বলতে এবার কান্নায় ভেঙে পড়লেন উনি। উপস্থিত সকলেই ভারাক্রান্ত মনে চেয়ে থাকলো। তটিনী গাল মুছে বলে,
‘ ওসব মিথ্যে কথা বলেছে ও। আমি আমার বাচ্চাকে দেব না কাউকে। আমি ওকে হাফেজ বানাবো। তুমি ওকে অভিশাপ দিওনা। তোমার চোখের জল ওরজন্য অভিশাপ নানাজান। দিওনা অভিশাপ।’
নানাজানের ভৃত্যদুজন বলল, ‘ আমরা প্রস্তুত হুজুর। চলুন রওনা দিই। ‘
তটিনী নানাজানের পা ধরে রাখলো। বলল,
‘ না না যেওনা এভাবে। মুখ ফিরিয়ে নিওনা। আমি ওকে ধ্বংসের দ্বারপ্রান্ত থেকে টেনে এতদূর নিয়ে এসেছি। ওকে অভিশাপ দিওনা। মরে যাবে। ‘

নানাজান কথা শুনলেন না। সোহিনীও কত জোরাজোরি করলো আটকানোর। নানাজান কাঁদতে কাঁদতে বেরিয়ে গেলেন মহল থেকে। শেহজাদ, সাফায়াত, শেরতাজ সাহেব, শাহজাহান সাহেব অনেক আগে থেকেই বুঝিয়ে যাচ্ছিলেন। নানাজানের চোখের পানি দেখে সকলেই স্তব্ধ হয়ে গিয়েছেন।
মাগরিবের সময় শেরহাম মহলে ফিরে এল। কক্ষে এসে দেখলো তটিনী একটা মোড়ায় বসে সালাত আদায় করছে। সালাম ফিরিয়ে মোনাজাত শেষে শেরহামের দিকে চোখ ফিরিয়ে তাকালো। তটিনীর চোখমুখ দেখে বিষম খেল সে। পরপর দু-তিনটে বন্দুক রাখলো বিছানায়। তটিনী সেগুলি নিয়ে দূরে ছুঁড়ে ফেলে দিল। বলল,

‘ আমার বাচ্চাকে জাদুনগরীর বাদশাহ বানাবে? এজন্য ভুলিয়ে ভালিয়ে রাখছো আমাকে? ‘
শেরহাম হতভম্ব। বন্দুক তুলে নিয়ে বলল,
‘ কাঁদছিস কেন আজব? কি করেছি আমি? ‘
‘ কি করোনি সেটা বলো। নানাজানকে বলোনি এসব? নিজের সন্তানের ভালো যদি চাও নানাজানকে ফিরিয়ে আনো। ‘
শেরহাম এগিয়ে এসে তাকে জড়িয়ে ধরে। তটিনী তার বুকে পড়ে কাঁদতে থাকে। শেরহাম জিজ্ঞেস করে,
‘ নানা তো মসজিদে আছে। আমি নিয়ে আসছি। তুই কাঁদিস না। ওই বুড়ো পাগল হয়ে গেছে। ‘
তটিনী বলল,

‘ না। এতে সব সমাধান হবে না। তুমি আমার বাচ্চার জন্য একবারও দোয়া করেছ আল্লাহর কাছে? ওকে কেউ কাফেরের সন্তান বলুক তা চাই না আমি। আমার কষ্টে বুক ফেটে যায় তোমাকে কেউ অমানুষ, কাফের বললে।
আমাকে নিয়ে চলো মসজিদে। আমি নানাজানকে ফিরিয়ে আনবো। ‘
‘ তুই শান্ত হ। আমি নিয়ে যাচ্ছি তোকে নানার কাছে। ওই বুড়ো বেশি ভার বেড়েছে। ‘
তটিনী আরও জোরো চেঁচিয়ে বলল,
‘ বুড়ো বলবে না। ভাষা ঠিক করো। আমাকে কেন শান্তি দিচ্ছ না তুমি? তোমার জন্য কি করিনি আমি? কেন খুঁজে খুঁজে অভিশাপ নিচ্ছ? পাপ বাপকে ছাড়েনা কথাটা কি মনে নেই তোমার? ‘
শেরহাম তার দুগাল আঁকড়ে ধরে বলে,

‘ আমি এজন্যই আসতে চায়নি এখানে। এজন্যই আমার ছায়া পড়তে দিতে চায়নি এখানে। চল, নানাকে ফিরিয়ে নিয়ে আয়। আমি চলে যাব। তোর সন্তানকে কেউ কাফেরের বাচ্চা বলবে না। তোর পরিচয়ে বড় করবি। ‘
তটিনী তার বুকে পড়ে কাঁদতে থাকে। পেটে হালকা হালকা যন্ত্রণা শুরু হয়।
তটিনীকে নিয়ে মসজিদে পাড়ি দেয় শেরহাম। খুব বেশি দূরে নয় মসজিদটি। ঘোড়ার গাড়িতে করে যায় তারা। সকালে যেভাব এসেছিল ঠিক সেভাবেই শেরহাম তাকে কোলে বসিয়ে এনেছে। নানাজান মসজিদের একপাশে বসে কাঁদছিলেন। উনার ভৃত্য দুজন উনার পেছনে বসে আছেন। হুজুরকে এই প্রথম এমন আকুল হয়ে কাঁদতে দেখেছে তারা। তাদের চোখেও জল। শেরহাম বাইরে দাঁড়িয়ে থাকে। বলে, মসজিদে প্রবেশ করে নানাজানকে নিয়ে আসো।
শেরহাম বলে, ‘ আমি পা দেব না। ‘

তটিনী বলে, ‘ অযু করে এসো। তাহলে প্রবেশ করতে পারবে। আল্লাহর দরবার সবার জন্য খোলা। যাও। অযুখানায় চলো। আমি শিখিয়ে দেব। ‘
শেরহামের মুখ কঠিন হয়ে আসে। তটিনীর হাত সরিয়ে দিয়ে বলে,
‘ পারব না। ওখানে কেন যাব আমি? যেতে পারব না। আমি পাপী। ‘
তটিনী টলটলে চোখে চেয়ে রইলো। তার গাল বেয়ে অবিরাম গড়িয়ে পড়ছে নোনাজল। শেরহাম বোধহয় জীবনে এই প্রথমবার এতটা অসহায় বোধ করলো। এগিয়ে যেতেই তটিনী চোখ মুছতে মুছতে ধীরপায়ে হেঁটে চলে গেল মহিলাদের নামাজ কক্ষের দিকে। গিয়ে বসে পড়লো নীচে। কান্নায় ভেঙে পড়ে বলল,
‘ তুমি ওকে কেন হেদায়েত দিচ্ছ না আল্লাহ ? কেন? ‘

আশপাশের সকলেই ওকে চেয়ে থাকে। শেরহাম কক্ষের বিশাল জানালার গ্রিল দিয়ে ওকে দেখে। গ্রিল ধরে চেয়ে থাকে। বহুকষ্টে কাঁদছে তটিনী। এদিকে পেটের যন্ত্রণা তীব্রতর হচ্ছে।
শেরহাম চোখবুঁজে উর্ধ্বে তাকায়, বিশালাকৃতির একটা দীর্ঘশ্বাস বুক চিঁড়ে বেরিয়ে আসে। পাঞ্জাবির বাহুতে নিজের ঘর্মাক্ত মুখ মুছে ডাকে, এই তনী!
তটিনী ফিরেনা। শেরহাম মনের চোখ মেলে দেখে সে যেখান থেকে এসেছে সেখানেই তার শেষ ঠাঁই। আর কিছু ভাবেনা সে। ছুটে চলে নিজের মনের ডাক অনুসরণ করে। খোলসে মোড়া নিজের পাপী হৃদয়টা আজ মুক্তি পায়। লুটিয়ে পড়ে খোদার আহৃবানে। এশার আজানের প্রতিধ্বনি ভেসে আসে সাথে সাথে। বহুবছর পর কানে প্রবেশ করে,
‘ আল্লাহু আকবর। ‘

জল বাড়িয়ে দেয়া মহিলাটির হাত থেকে পানির পাত্র হাতে নিয়ে পানি খায় তটিনী। মহিলাটি জিজ্ঞেস করে, ‘ তুমি তো অনেক অসুস্থ দেখছি। কেউ আসেনি সাথে? ‘
‘ এসেছে। চিন্তিত হবেন না। আমি ঠিক আছি। ‘
‘তাহলে কাঁদছো কেন এভাবে? ‘
তটিনী আবারও কাঁদতে থাকে। কাকে বুঝাবে সে কেন কাঁদছে? কাকে বুঝাবে অন্তরজ্বালার কথা। কাকে বুঝাবে সে এমন মানুষকে ভালোবেসেছে যার মুক্তির জন্য সে দিনরাত ছটফটিয়ে মরে। কাকে বুঝাবে সন্তানকে অপবাদের মুখ থেকে বাঁচানোর জন্য দিনরাত্রি এক করে খোদার কাছে আশ্রয় চায় সে। বোরকা পরিহিত মহিলাটি তার মাথায় হাত বুলিয়ে দেয়। বলে, কেঁদোনা। আল্লাহ সব ঠিক করে দেবেন। ‘

তটিনী গাল মুছে। কোনোমতে দাঁড়িয়ে পড়ে। একটা আগরবাতি জ্বালিয়ে দেয়। নানাজানের গলা ভেসে আসে। পিছু ফিরতেই দেখতে পায়। নানাজান দাঁড়িয়ে আছেন। পাশেই সাদা পাঞ্জাবি পরিহিত শেরহাম। তার মুখে বিন্দু বিন্দু জল। কপালের সামনের চুল গুলি ভেজা।
শেরহাম কক্ষে প্রবেশ করে। এগিয়ে এসে বলে,
‘ নানাকে নিয়ে এসেছি। মসজিদে প্রবেশ করেছি। চল এবার। ‘
তটিনী নানাজানের দিকে তাকায়। তারপর মাথায় ওড়না আরও ভালো করে টেনে নিয়ে ধীরপায়ে হেঁটে কোরআন শরীফ নিয়ে আসে বুকের সাথে জড়িয়ে।
শেরহামের সামনে দাঁড়ায়। চোখ তুলে তাকিয়ে দেখে শেরহাম অবাকচোখে চেয়ে আছে। তটিনী তার দিকে ধীরপায়ে এগিয়ে আসে। কেঁদে ওঠে বলে,

‘ আল্লাহ তায়ালার একত্ববাদ স্বীকার করো।
আল্লাহর নামে শপথ করো আজ থেকে তোমার অন্তর আত্মাকে সব কলুষতা থেকে মুক্তি দিয়েছ। আল্লাহ তোমাকে হেদায়েত না করলে আমি তোমার জীবনে আসতাম না। তোমার প্রতি মহব্বত সৃষ্টি হতো না। তোমার চোখে সুরমা পড়ানোর সুযোগ দাও আমাকে। তওবা করো আর মাফ চাও। শপথ করো আর কোনো মন্দকাজে নিজেকে জড়াবে না। ‘
শেরহামের জ্বলজ্বলে দৃষ্টি অন্যত্র ঘুরিয়ে পিছু হাঁটে সে। হাতের কব্জিতে কপাল চোখমুখ মুছে বলে,
‘ এটা হয় না তনী। ‘

‘ হয় । আল্লাহ পাক তোমাকে ক্ষমা করবে। উনি কাউকে ফেরান না। তওবা করো। ‘
শেরহাম তার দিকে চেয়ে থাকে একদৃষ্টে। গাড়ির ঝাঁকুনি লাগায় তটিনীর পেটের ব্যাথা ক্রমশ বেড়েই চলেছে। সে ঠোঁট কামড়ে কেঁদে উঠতেই শেরহাম তার হাতটা হাতের মুঠোয় নিয়ে নেয় । বলে,
‘ করলাম। তুই কান্না বন্ধ কর। ‘

প্রিয় বেগম সিজন ২ পর্ব ৩৩

তটিনী অশ্রুজলে হাসে। ঝাপসা ঝাপসা চোখে দেখে একটা শুদ্ধ মানুষকে।
ক্রমেই ভীষণ অসুস্থ হয়ে পড়ে সে। শেরহামের বুকে ঢলে পড়ে। শেরহাম কোলে করে ওকে বের করে আনে। মসজিদ প্রাঙ্গন ছেড়ে গাড়ির কাছাকাছি এসে বলে, তাড়াতাড়ি গাড়ি ছাড়ো। এই তনী কেমন লাগছে তোর? ‘
তটিনী দু’পাশে মাথা নেড়ে শেরহামের বুক খামচায় অসহ্য যন্ত্রণায়। শেরহাম গাড়িতে উঠে বসে। হঠাৎই হাতে ভেজা অনুভব হতেই হাত তুলে দেখতে পায় রক্ত পানি। কয়েকজন মহিলা পাশ থেকে ছুটে আসে। বলে, তার প্রসববেদনা উঠেছে।

প্রিয় বেগম সিজন ২ পর্ব ৩৪