প্রিয় বেগম সিজন ৩ পর্ব ১৯+২০

প্রিয় বেগম সিজন ৩ পর্ব ১৯+২০
পুষ্পিতা প্রিমা

কাশিফ কৌতূহলী হয়ে জানতে চাইলো।
– কে ইনি?
নাদির ফোঁস করে দম ছেড়ে পেছনে হাত ভাঁজ করে দাঁড়িয়ে বলল,
– শেরহাম সুলতান যার কথা তোকে বলেছিলাম।
কাশিফ তার দিকে বিস্ময় নিয়ে তাকালো। নাদির মৃদুমন্দ মাথা নেড়ে জানালো, এটাই সত্যি।
কাশিফ বলল,

– হায় আল্লাহ! আমি সামনাসামনি দেখবো কখনো ভাবিনি।
কাশিফ আর নাদির দুজনেই সেখানে দাঁড়িয়ে রইলো। ভাই-বোনের আবেগঘন মুহূর্তে তারা বাঁধ সাধতে চায় না। কাশিফ এখনে আশ্চর্য হয়ে চেয়ে রয়েছে শেরহামের দিকে। এই সেই পুরুষ মানুষ, যার প্রত্যাবর্তনের গল্প নাদিরের মুখে শুনেই উত্তেজিত হয়ে পড়েছিল সে। কি এক ভয়ানক সাহসী পুরুষ তিনি, এখানে উনার স্বয়ং উপস্থিতিই তা জানান দিচ্ছে। এতদূর অব্দি কি করে চলে এলেন তিনি? অবশ্য নাদিরের মুখে যা শুনেছে এর চাইতে ভয়ংকর জগতের রাজা ছিলেন তিনি।
শবনমের চেহারা, শরীর সব শুকিয়েছে এ কয়েকদিনে। মুখে অসংখ্য আঁচড়ের দাগ, ক্ষতচিহ্ন দেখে শেরহাম জানতে চাইলো,

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

” এসব কি করে হলো? এতদিন কোথায় ছিলি? ”
শবনম নাদির আর কাশিফের দিকে আঙুল তাক করে বলল,
” উনাদের কাছে। তাঁবুতে। ”
ফোঁপানি থেমে আসছে তার। নাক টানতে টানতে বলল,
” আমরা এখন বাড়ি যাব ভাইজান? ”
শেরহাম নাদির আর কাশিফের দিকে চেয়ে উত্তর দিল,
” হ্যা। ওরা এখানে কি করছিলো? ”
নাদির এগিয়ে এল ধীরপায়ে। শেরহাম বলল,
” ক্যাপ্টেন মেহমাদ? ”
নাদির মৃদু মাথা ঝাঁকিয়ে হাতে হাত মিলিয়ে বলল,

” জ্বি। আপনাকে এখানে দেখে এত আনন্দ হচ্ছে বলার বাইরে। বড় বিপদে ছিলাম আমরা। ”
” আমি আপনাদের এখানে দেখে বেশি খুশি হয়েছি। আপনারা না থাকলে শবনম হয়ত..
কাশিফ হাত বাড়িয়ে দিয়ে হেসে বলল,
” আমি ওর বন্ধু। কাশিফ জুবায়ের। গত সতেরদিন যাবত আটকে গেছি ঘুরতে এসে। চলুন, ওখানে যাই। ”
শেরহাম তাদের সঙ্গে যেতে যেতে বলল,
” এখানে ঘুরতে আসা? জংলীরা তো কিছুক্ষণ আগে সব লুটপাট করে গেল। ”
” হ্যা, এত জোরে জোরে ভাঙচুর করছিলো ভয়ে আপনার বোনের জ্বর চলে এসেছে। ”
মানিক বলল,
” হুজুর, ওরা যদি আমাদের জাহাজও ভাঙচুর করতে চলে আসে? ”
নাদির বলল,

” তার আগে আমরা রওনা দেব। এই সবাই গোছগাছ করে নে। ”
অল্পবয়সী ছেলেপেলেগুলোকে দেখা গেল এবার। শেরহাম বলল,
” এরাও এখানে! ওদের মা বাবা কান্নাকাটি করছে তাদের জন্য। ”
কাশিফ বলল,
” আপনি কখন রওনা দিয়েছেন? ”
শেরহাম একটা পাথরের উপর বসলো। বলল,
” দুপুরে। ”
” অনেকটা সময়। এখন নিশ্চয়ই মধ্যরাত। আচ্ছা আপনারা খাওয়াদাওয়া করেছেন? ”
শেরহাম মানিক আর আনোয়ারের দিকে তাকালো। ওরা সন্ধ্যায় খেয়েছে তাও ডালপুরি। নিশ্চয়ই এতক্ষণে তাদের ক্ষিধে পেয়েছে। নাদির তা বুঝতে পেরে কাশিফকে ইশারায় কিছু বললো। কাশিফ বলল,
” আমাদের কাছে খাবার আছে। আমরা এখনো খাওয়াদাওয়া করিনি। আপনারা আমাদের সাথে খান।
শেরহাম জানতে চাইলো,

” এতরাত করে রাতের খাবার! ”
নাদির বলল,
” আসলে আমাদের উপর বাঘ হামলা করেছিলো। ওটাকে গুলি করার পর মারা যাওয়ায় মাটিতে পুঁতেছি। তাই দেরী হয়ে গেল। ”
শেরহামের কপালে ভাঁজ। কাশিফ তাঁবু খুলে ফেলায় শবনম তার পরামর্শে গোছগাছ করছে। শেরহাম তাকে একপলক দেখে ভাবলো, মেয়েটা এই বনজঙ্গলে এতটা সুস্থ এইতো বেশি। এসব তো সে জীবনে দেখেনি।
মানিক ভয় পেয়ে বলল,

” বাবাগো বাঘ! তাড়াতাড়ি করেন। আবার যদি বাঘ আসে? ”
শবনম আর ছেলেগুলো তার কথা শুনে হেসে ফেললো। নাদির অভয় দিয়ে বলল,
” আসবে না। নিশ্চিন্তে থাকুন। ”
কাশিফ সবার জন্য খাবার প্রস্তুত করছে। শবনম তার উদ্দেশ্যে বলল,
” আপনাদের এই যন্ত্রপাতিগুলো কোথায় নেব ভাইয়া? একটা বস্তা লাগবে। ”
কাশিফ বলল,
” নাদিরকে বলো বস্তা দিতে। ”

নাদির একটা বস্তা বের করলো। শবনমের মুখোমুখি বসে যন্ত্রপাতিগুলো ভরে নিতে লাগলো। চোখাচোখি হতে না হতেই দুজনেই চোখ নামিয়ে নিল। শবনমের গায়ে আজ তার নাদিরের দেয়া ফতুয়া, পায়জামা আর চাদর পড়া। নাদির ছোট্ট করে বলল,
” আপনার জামা আমি নিয়ে যাব? ”
শবনম চোখ তুললো কিন্তু নাদির তুললো না। সে জিনিস ভরতে থাকলো। শবনম জানতে চাইলো,
” কারণ? ”
” আপনি যেহেতু আমার জামা নিয়ে যাচ্ছেন, আপনার জামা আমার নিয়ে যাওয়ার কথা না? ”
শবনম ভৎসনা করে বলল,
” আমার পোশাক আপনি পড়বেন? ”
নাদির হাসলো। জিনিসপত্রগুলো ভরা শেষ করে রশি থেকে শবনমের ওড়নায় হাত দিতেই শবনম ওড়নাটা টান দিয়ে বলল,

” আমার কাপড় দেব না আপনাকে। ”
দুজনের হাতেই ওড়নাটা। শবনমের কন্ঠস্বর খানিকটা উঁচু হওয়ায় পানি পান করতে থাকা শেরহামের চোখ পড়লো সেদিকে। শেরহামকে তাকাতে দেখে ইতস্তত করে শবনম আর নাদির দুজনেই সরে পড়লো। শবনম কাপড়গুলো নিয়ে ভাঁজ করে একটা ব্যাগে নিয়ে নিল। কাশিফকে বলল,
” ভাইয়া ব্যাগটা আমি নিচ্ছি। ”
কাশিফ বলল, ” ওটা ওর। ”
নাদির ব্যাগটার দিকে তাকালো। শবনম চোখ সরিয়ে বলল,
” নিয়ে নিলাম। ”
গরম গরম খাবার চলে এল। থানকুনির ভর্তা, বকের কালাভুনা, আমড়া দিয়ে টকপাতা। শেরহাম আর তার লোকের জন্য শবনম থালায় করে নিয়ে এল। বলল,

” ভাইজান খেতে আসুন। ঠান্ডা হয়ে গেলে ভালো লাগবে না খেতে। ”
শেরহাম বলল,
” সবাই একসাথে খেয়ে বেরিয়ে পড়বো। আগে গোছগাছ করে নে। ”
কাশিফ বলল,
” আমরাও বসে যাব আপনাদের সাথে। আসুন আসুন। আপনারা না খেয়ে আছেন। আমাদের এই জগাখিচুরি খেয়ে পেট ভরিয়ে নিন। ”
গোছগাছ শেষে সবাই একসাথে খেতে বসলো। মানিক বলল,
” উফফ ভর্তা আর আমড়ার তরকারিটা এত মজা হয়েছে। গরম গরম ভাত হলে পুরাই জমে যেত। ভাই রে ভাই এখানে এত ভালো রান্না করো কিভাবে? ”
কাশিফ বলল,

” ভাগ্য ভালো এখানে অনেককিছু পাওয়া যায়। সেবার একটা বনে আমাদের চারদিন থাকতে হয়েছিলো। সেখানে ঘাসপাতা ছাড়া কিছুই পাওয়া যায় না। শেষমেশ পাতা সেদ্ধ করে মরিচ ভর্তা করে পেট ভরিয়েছি। যদিও সেইরকম মজাদার ছিলো দিনগুলো।”
শবনম অবাক চোখে চেয়ে বলল,
” গরু-ছাগলও বোধহয় অত ঘাসপাতা খায়না। ”
সবাই হেসে উঠলো একসাথে। আর খেতে খেতে গল্পগুজব চললো, কিভাবে শবনম এখানে পৌঁছেছে, দিনগুলো কিভাবে কেটেছে, এই সেই নিয়ে। বাড়ির সবার দুশ্চিন্তার কথা শুনে শবনমের মন চাইলো সব ছেড়েছুড়ে আগে বাড়ি ফিরতে।
খাওয়াদাওয়া শেষ হলো। গল্প চলতে চলতে সবাই প্রস্তুতি নিল যাওয়ার জন্য। হরিণছানাটাকেও সাথে নিয়েছে নাদির। শবনম সব জিনিসপত্র নিয়েছে কিনা দেখে শেরহামকে বলল,

” আমরা জয়পুরে ফিরবো ভাইজান?”
” তোকে জয়পুরে পাঠিয়ে দেব। আমি রূপনগর যাব। আর সুলতান মহলে আপনাদের দাওয়াত। যেতেই হবে।”
কাশিফ বলল,
” আমি না করব না। সুলতান মহল দেখবো। ”
শেরহাম মৃদু হাসলো। কাশিফ বলল,
” আমাদেরকে তুমি সম্বোধন করলে আরও ভালো হয়। আপনি আমাদের কতবড় উপকার করলেন আপনি নিজেও জানেন না। ”
শেরহাম তার কাঁধ চাপড়ে বলল,
” যাওয়া যাক। শবনম আয়। ”
শবনম হরিণছানাটিকে নাদিরের হাতে দেখে শেরহামের পাশাপাশি হাঁটতে লাগলো। বলল,

” ভাইজান ওই মেয়েগুলোর খোঁজ পাইনি এখনো। ওদের খোঁজ না নিয়েই চলে যাব? ”
শেরহাম বলল, ” মেয়েগুলোকে কোথায় খুঁজবো? ”
কাশিফ আর কোনো ঝামেলা চাইলো না কিন্তু তারপরও মেয়েগুলোর কথা মনে করে খারাপ লাগলো। মেয়েগুলো কি জীবিত আছে নাকি মারা গিয়েছে? শবনমের মন খারাপ হয়ে এল। উঁচুনিচু ঢিবিতে হাঁটতে তার অসুবিধা হচ্ছে। পায়ে ব্যাথা করছে। শেরহাম জিজ্ঞেস করলো,
” হাঁটতে অসুবিধে হচ্ছে। ”
” না না তেমন কিছু নয় ভাইজান। মেয়েগুলোর কথা ভেবে খারাপ লাগছে। ওরা আমার ছোট। ”
নাদির বলল,
” আমার মনে হয় তারা জংলীদের হাতে পড়েছে। নইলে আমরা তো তাদের দেখতে পেতাম। একজনকেও তো চোখে পড়েনি। ”

শবনমের বুক ভার হয়ে এল। মানুষ এভাবে হারিয়ে যায়? অল্পকিছুক্ষণের আলাপে কত আপন হয়ে গিয়েছিল তারা! আর সেই সাহসী মেয়েটা! সেও জংলীদের থাবায় পড়ে নিঃশেষ হয়ে গেল? গভীর একটা দীর্ঘশ্বাস বের হলো বুক ছিঁড়ে। তারা বালুচরে চলে এল। জাহাজ দেখে সকলেই আনন্দিত। শবনম তো ছেলেগুলোর সাথে চিক্কুর দিয়ে লজ্জায় পড়ে গিয়েছে। নাদিরকে ঠোঁট কামড়ে হাসতে দেখে অপমানিত বোধ করলো। তারপর গম্ভীর হয়ে এল। বিড়বিড়িয়ে বলল,
” আমারও দিন আসবে। ”
শেরহাম তাকে নিয়ে জাহাজে উঠে এল। বাকি সবাই একএক করে জাহাজে উঠলো। বন্দী দস্যুদের দেখে শবনম ভয়ে চেঁচিয়ে উঠলো। শেরহাম অভয় দিয়ে তাকে সেখান থেকে নিয়ে গেল অন্য জায়গায়। বলল,
” ওদের জন্য ওই মেয়েগুলো মারা গিয়েছে। তাই এদের আমি ছাড়বো না। ”
একজন বলে উঠলো,

” মাফ করুন হুজুর। আমাদের দলের তিনজন আর ওই মেয়েগুলোকে জংলীরা মেরেছে। আমরা মারিনি হুজুর।”
শবনমের মনটা আবারও খারাপ হয়ে এল। জাহাজ ছাড়ার সাথে সাথে বুকের ভেতরটা কেমন যেন করে উঠলো তার। যথাস্থানে চুপচাপ বসে আনমনা হতেই খেয়াল হলো হরিণছানাটিকে। হরিণ ছানাটি এখন তাকে চেনে। তাকে দেখামাত্র সেটি তার কাছে আসার জন্য লাফাচ্ছিলো। নাদির রশি ধরে রাখলো। শবনম রাগত দৃষ্টিতে নাদিরের দিকে চেয়ে আছে। নাদিরও মজা নিচ্ছে। সে কিছুতেই ছানাটিকে শবনমের কাছে যেতে দেবে না। শবনম শেরহাম আছে তাই শব্দও করতে পারছে না আবার নাদিরকে ছাড়ও দিচ্ছে না।
তাদের ইশারায় এই রাগারাগি, হম্বিতম্বি, খুনসুটি গম্ভীর হয়ে দেখছিলো একজোড়া জহুরি চোখ।

জাহাজ যখন থামলো তখন ভোরের আলো ফুটে গেছে। ঘাটে প্রচুর কোলাহল, ভীড়। সূর্য মাথাচাড়া দিয়ে উঠছে ধীরেধীরে। চারপাশে মানুষের হৈহৈ শব্দ শুনে সবার চোখ ছুটে গিয়েছিল। আর পরিচিত দেশ, দেশের মানুষ দেখে শবনম খুশিতে আত্মহারা। জাহাজ থেকে নেমে পড়ার ডাক পড়লো। বোঝাগুলি নামিয়ে নাদির ছেলেগুলোকে নামিয়ে দিল। শবনমকে নিয়ে নামলো শেরহাম। শবনম জিজ্ঞেস করলো,
” আমরা এখন কোথায় যাচ্ছি ভাইজান?”
” তোদের বাড়ি। ”
” আপনি যাবেন না কেন? ”
শেরহাম কিছু বলল না। শবনম বুঝতে পারলো নিশ্চয়ই কিছু একটা হয়েছে। সবাই মিলে কি ভাইজানকে দোষারোপ করেছে?

ঘাটে প্রচুর মানুষের মধ্যে শেরহাম শেহজাদ আর সাফায়াতকে খুঁজছিলো। তারা এত সকাল সকাল এখানে কি করবে? তারপরও সে খুঁজছিলো। শবনমের হঠাৎ মনে হলো সে হরিণছানাটাকে রেখে এসেছে। শেরহাম পাশ থেকে সে ছুটতে ছুটতে জাহাজে চলে এল । ব্যাগপত্র নিয়ে নাদির বের হচ্ছিলো। শবনম এসে হাঁপাতে হাঁপাতে বলল,
” হরিণ ছানাটা? ”
নাদির বলল,
” সেটা তো আপনি আর পাচ্ছেন জনাবা।”
” কেন? আপনি তো আমাকে দিয়ে দিয়েছেন। আবার অস্বীকার করছেন কেন? ”
” কারণ আপনি শর্ত ভঙ্গ করেছেন। ”
বলেই হেসে নাদির বেরিয়ে গেল। শবনম তার পিছু পিছু যেতে যেতে বলল,
” আপনি আপনার ছেলেগুলোকে দিয়ে দিলেন ছানাটাকে? ওটা আমার। ”
শবনমের কন্ঠে বেজায় রাগ। নাদির তার সাথে মজা করে আনন্দ পাচ্ছে। পিঠে ব্যাগ চেপে, বন্দুক হাতে সে যেতে লাগলো। শবনম যেতে যেতে হঠাৎ থমকালো। অবাক হয়ে দেখলো একটা কালো রঙের চাদর মাথার উপর অব্দি দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে ইমরান। এদিকওদিক উঁকি দিচ্ছে সে। শবনম অবাক হলো এটা ভেবে ইমরান এখানে কি করছে? সে ধীরপায়ে হেঁটে ইমরানের কিছুটা পেছনে গিয়ে দাঁড়ালো। ডাকলো,

” ইমরান? ”
নামের সম্বোধন শুনে তৎক্ষনাৎ ঘাড় ঘুরালো ইমরান। শবনমকে দেখে তার চক্ষু চড়কগাছ। দুজনেই বলে উঠলো,
” আপনি এখানে?”
শবনম তাকে সবটা বলতে বলতে ততক্ষণে শেরহাম ডাক দিয়েছে তাকে। আর তক্ষুণি ইমরানকে চোখে পড়লো তার। ইমরান মুখ ঢাকা দিল। সে সকাল সকাল পালিয়ে যাচ্ছিলো অন্যত্র। কিন্তু কথায় আছে না, যেখানে বাঘের ভয় সেখানে সন্ধ্যে হয়। সে পালাবে তৎক্ষণাৎ শেরহাম পিস্তল তাক করে বলল,
” আরেক পা যদি এগোস তোকে শেষ করে দেব। এখানেই থাম। ”
চারপাশের মানুষ তব্দা খেয়ে গেল। শবনমও হা করে রইলো। ভাইজান ইমরানকে এমন বলছে কেন? নাদির শবনমের কিছুটা দূরে। সে একবার ইমরানকে আরেকবার শেরহামকে দেখছে। শেরহাম সতর্কতা সহিত এগিয়ে আসতে লাগলো। শবনমকে বলল,

” সরে যাহ সেখান থেকে। এখানে চলে আয়। ”
ভাইজান নিশ্চয়ই ভালোর জন্য বলছে তাই শবনম পা বাড়াবে তার আগেই ইমরান চাদরের নীচ থেকে ধারালো চকচকে চাকু বের করে শবনমের একহাত চেপে ধরে গলার কাছে চাকু ধরলো। শবনম আর্তস্বরে ডাকলো,
” ভাইজান। ”
আশেপাশে যারা ছিল তারা হায়হায় করে বলে উঠলো, ” দিনদুপুরে একি কান্ড! হায়হায়। ”
যদিও জয়পুরে এসব কোনো ব্যাপার ছিল না কয়েক মাস আগেও কিন্তু এখন সেইসবের পুনরাবৃত্তি ঘটতেই অনেকেই ভয়ে পালিয়েছে। নাদির স্তব্ধ। কাশিফ ছেলেগুলোকে নিয়ে অনেক দূরে ছিল। সে ছুটে এসে নাদিরের পাশে দাঁড়িয়ে বলল,

” আরেহ আরেহ কি করছেন? উনার গলায় চাকু ধরেছেন কেন? গলায় লেগে যাবে। ছেড়ে দিন। ”
শবনম ভয়ে কেঁদে ফেলেছে। নাদিরের হাতে বন্দুক ছিল। সে সহসা বন্দুক তাক করলো ইমরানের দিকে। বলল,
” সাহস কত? দিনের বেলায় সন্ত্রাসগিরি দেখাচ্ছিস। ছাড় ওকে। ”
ইমরান শবনমকে নিয়ে পিছু পিছু হাঁটতে হাঁটতে বলল,
” একপা যদি কেউ এগোস তবে ওর লাশ পড়বে। ”

শবনম, ভাইজান ভাইজান ডেকে কাঁদতে কাঁদতে আচমকা অন্য হাত দিয়ে ইমরানের পেটে কনুই দিয়ে জোরে ঘুষি দিল। ইমরান খানিকটা দুর্বল হতেই শেরহাম এসে হামলে পড়লো তার উপর। নাদির শবনমকে টেনে নিয়ে এল। ইমরানকে ইচ্ছেমতো মারতে লাগলো শেরহাম। ঘুষি, লাথি দিতে দিতে যতক্ষণ না ইমরান ধরাশায়ী হয়ে পড়লো ততক্ষণ মারতে লাগলো। ইমরান হঠাৎ মুখ থুবড়ে পড়লো নাদির আর শবনমের সামনে। নীচে পড়ে যাওয়া চাকু তুলে দাঁড়িয়ে পড়লো দ্রুত। চাকু দ্বারা শবনমকে আঘাত করতে যেতেই নাদির শবনমকে অন্যদিকে সরিয়ে ইমরানের মুখ বরাবর লাথি মারলো, আর তার আগেই চাকুর আঘাত খেয়ে বসলো। শেরহাম টেনে নিয়ে গেল ইমরানকে।
শবনম নাদিরের হাতে রক্ত দেখে চিৎকার দিয়ে উঠলো। নাদির হাত চেপে ধরে তার দিকে ফিরে কর্কশ গলায় বলল,
” আরেহ এখানে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে নাটক দেখছেন? যান দূরে গিয়ে দাঁড়ান। ”
শবনম তার হাত দেখে বলল,

” হাত। ”
নাদির বিরক্ত হলো। কাশিফ নাদিরকে নিয়ে গেল। ওদিকে শেরহাম ইমরানকে মারতে ঘাটের দিকে নিয়ে যেতে লাগলো। ইমরান এবার নিজের প্রাণ বাঁচানোর তাগিদে উত্তাল ঢেউয়ের মধ্যে ঝাঁপ দিল। তার চোখদুটো ছোটখাটো ওই নৌকাটার দিকে।
শেরহাম লাথি দিয়ে পায়ের কাছে পাথর সরিয়ে দিয়ে বলল,” মর শালা। ”
তারপর বা-হাত দিয়ে মুখ মুছে নাদিরের দিকে চোখ যেতেই ছুটে গেল। আনোয়ারকে বলল, শবনমকে যেন তার বাড়ি পৌঁছে দেয়। নাদিরকে নিয়ে সে হাসপাতালে যাবে। শবনম কিছুতেই যেতে চাইলো না। কিন্তু শেরহামের মেজাজ দেখে ভয়ে বাড়াবাড়ি করলো না। বারংবার পিছু ফিরে তাকাতে তাকাতে ঘোড়ার গাড়িতে উঠে গেল সে। কাশিফের বেঁধে দেয়া পট্টির উপর হাত চেপে ধরে নাদির কপাল কুঞ্চন করে তার যাওয়া দেখলো।

সকলেই ভূত দেখার মতো চমকে উঠেছে শবনমকে দেখে। শাহানা পাগলের মতো ছুটে এসে জড়িয়ে ধরলো শবনমকে। শবনম বহুদিন পর মা, বাবা, পরিবারকে পেয়ে কাঁদলো। শাহানা তার মুখে হাত বুলাতে বুলাতে বলল,
” এসব কি করে হলো? কে করেছে এসব? কি হয়েছে তোমার? বলো আমাকে। ”
শবনম জবাব দিতে পারলো না। সাফায়াত এসে বোনকে জড়িয়ে ধরলো শক্ত করে। বলল,
” ভাইজান নিয়ে এসেছে? আমি বলেছিলাম না ভাইজান? দেখেছেন আমার কথা সত্যি হলো। ”
শেহজাদ বলল,

” কান্নাকাটি বন্ধ, এখন ওকে বিশ্রাম নিতে দিন ফুপু। ওকে রুগ্ন দেখাচ্ছে। ”
শাহানা মেয়েকে জড়িয়ে ধরে গালে, কপালে অসংখ্য চুমা দিয়ে হু হু করে কেঁদে উঠলো। তটিনী এসে বলল,
” বোন আমার। ”
শবনম তাকে ঝাপটে জড়িয়ে ধরলো। আয়শাও এসে দুবোনকে জড়িয়ে ধরে কাঁদতে লাগলো। সায়রা সোহিনীও তাদের দেখাদেখি কেঁদে সারা হলো। শেহজাদ বলল,
” শবনম ভাইজান এল না কেন? ”
শবনম বলল,
” ইমরান আমাদের উপর হামলা করেছে। ক্যাপ্টেন হাতে আঘাত পেয়েছেন। ভাইজান উনাকে হাসপাতালে নিয়ে গিয়েছেন। ইমরান কেন এমন করলো আম্মা?”
তার প্রশ্নের জবাবের বিপরীতে শেহজাদ জিজ্ঞেস করলো,

” ক্যাপ্টেন? ”
উপস্থিত সকলেই শবনমের উত্তরের অপেক্ষায় রইলো। শবনম কান্না চেপে উত্তর দিল,
” জ্বি। ক্যাপ্টেন নাদির মেহমাদ। ”
সেখানে উপস্থিত তাঈফ নাদিরের নাম শুনে বাকরুদ্ধ। শেহজাদ শবনমের একহাতে জড়িয়ে সান্ত্বনা দিতে দিতে বলল,
” শান্ত হও। আর কোনো ভয় নেই। ফুপুআব্বা আপনার মেয়ে ফিরে এসেছে। আমরা এক্ষুণি রূপনগরে রওনা দেব। ”
সোলেমান মাহমুদের কাছে গেল শবনম। উনি একদৃষ্টে মেয়ের মুখপানে চেয়ে রয়েছেন। বাবার শুকনো মুখখানা দেখে শবনমের কান্না উতলে উঠলো। সে বাবার বুকে ঝাঁপিয়ে পড়ে কেঁদে উঠলো সশব্দে।
তটিনী আনোয়ারকে বলল,

” শোহরাবের আব্বা ঠিক আছে?”
” জ্বি বেগম। ”
বুকে হাত চেপে মনে মনে কি যেন বিড়বিড়িয়ে বললো তটিনী। তারপর শোহরাবকে কোলে তুলে গালে চুমু দিয়ে বলল,
” সোনা, তোমার আব্বার কাছে যাব আমরা। ”
শোহরাব খুব খুশি তার আব্বার কথা শুনে। সকাল থেকে আব্বা আব্বা করে সে তটিনীকে বিরক্ত করছিলো। তটিনীর গালে গাল ঠেকিয়ে সে বলল,
” আব্বা কাচি যাবো। ”

বাড়ির জিনিসপত্র গোছগাছ করে হুট করে রূপনগর যাওয়া সম্ভব হলো না শাহানার পক্ষে। তারউপর শবনমের জ্বর বেড়ে গেছে। এমনিতেই সে অনেকক্ষণ জাহাজে ছিল তাই সোলেমান মাহমুদ জানালেন, সবাই আগামীকাল সকালে রওনা দেবে।
শেহজাদ ভেবেছে শেরহাম জয়পুর আছে কিন্তু জয়পুরের স্থানীয় হাসপাতালে গিয়ে জানতে পারলো তারা নাকি সবাই রূপনগরে চলে গিয়েছে। ভাইজানের ঘাড়ত্যাড়ামো দেখে শেহজাদ খানিকটা হতাশ হলেও যখন তখনকার কথাগুলো মনে পড়লো তখন মনে হলো ভাইজান এই কাজটা না করলেই বরঞ্চ সে অবাক হতো। ফুপুআব্বার কথাগুলো ভাইজানকে আঘাত করেছে। শবনম যেহেতু ফিরে এসেছে এবার ফুপুআব্বার ভুল ভাঙবে। তিনি বুঝতে পারবেন, এই শেরহাম সুলতান গত পনের বছর পূর্বের সেই শেরহাম সুলতান যার মনে কোনো প্রতিহিংসার দানা ছিল না, রাজত্বের লোভ ছিল না, আপনবিরুদ্ধ ছিল না।
শেহজাদ, সাফায়াত আর তাঈফ বাড়ি ফিরতেই শাহানা বলল,

” ওমা, তোমরা একা এলে কেন? তাঈফ কি নাদিরকে দেখেনি? ”
তাঈফ মাথা নেড়ে বলল,
” না। ওরা রূপনগরে চলে গিয়েছে। আমরা কখন রওনা দেব রূপনগরে? ”
শাহানা বলল, ” আজ তো যাওয়া হচ্ছে না। শবনমের জ্বর বেড়ে গেছে। মাথা তুলতে পারছেনা বিছানা থেকে। কতগুলো রাত ভালো করে ঘুমাতে পারেনি মেয়েটা। আর আমাদের গোছগাছ করতেও তো রাতটা লাগবে। ”
তাঈফ বলল, ” সমস্যা নেই। নাদিরের কথা শুনে ছুটে গিয়েছিলাম। ”

শেহজাদ তার পিঠে হাত বুলিয়ে বলল, ” আমি জানি তোমার ওকে দেখার জন্য তর সইছেনা। তুমি চাইলে সাফায়াতকে নিয়ে রওনা দিতে পারো। আমি সবাইকে নিয়ে কাল সকালে রওনা দেব। ”
তাঈফ সাফায়াতের দিকে তাকালো তক্ষুণি। সাফায়াত বলল, ” হ্যা চলো। তাছাড়া মহলে মতিবানু ছাড়া কেউ নেই। ওদের অ্যাপ্যায়নের ব্যবস্থা ওর একাহাতে করতে পারবে না। ভাইজানের সামনে যায় না ও। আমি গেলে বাজার-সদাই করে দিতে পারবো। ”
তাঈফ মৃদু হেসে বলল, ” আচ্ছা। ”
সাফায়াত বলল, ” আম্মা, খেতে দিন রওনা দেব? শবনম কোথায়? ”
শাহানা উত্তর দিল, ” ঘুম এসেছে। ডাকাডাকি করছিনা।”
শেহজাদ জিজ্ঞেস করলো, ” জ্বর কি বেশি এসেছে? ”
তাঈফ বলল, ” আমি ঔষধ দিয়েছি, চিন্তার কিছু নেই। ”

বাড়ির অন্দরমহলে কথা বলতে বলতে প্রবেশ করলো সবাই। তটিনী শোহরাবকে নিয়ে এল তখন। বলল,
” ভাইজান আমিও আপনাদের সাথে যাব। ”
শাহানা বলল, ” তুমি একা একা গিয়ে কি করবে? ”
তটিনী আমতাআমতা করে বলল,
” কি আর করব? রান্না-বান্না কে করবে। ভাইজানরা যাচ্ছে, তারউপর মেহমান আছে। আমি যাই, আপনারা কাল সকালে ধীরেসুস্থে আসুন। ”
সকলেই খানিকটা অবাক হলো। তটিনী তাদের বিস্ময় দেখে বলল,

” মতিআপা কেটেকুটে দেবে, আর আমি রান্না করব। অত অবাক হওয়ার কি আছে? ”
হামিদা আর শাহানা মুচকি হাসলো। হামিদা বলল,
” আচ্ছা আচ্ছা বেশ বেশ। সাবধানে রেঁধো কেমন? অন্যদের কথা বাদ দাও, তোমার সাহেব তো সুলতান মহল মাথায় করবে খেতে না পারলে। ”
তটিনী বেজায় রেগে বলল, ” মানেটা কি? আমি কি অতটা খারাপ রাঁধি। যাব না আমি। যাও তোমরা। ”
বলেই হনহনিয়ে চলে যেতে লাগলো সে। হামিদা হেসে উঠলো। তার পিছু যেতে যেতে বলল,
” আরেহ রাগ করে না বোকা মেয়ে। যাও যাও, তোমার রান্না যেমনই হোক আর কেউ না খেলেও শোহরাবের আব্বা খাবে। যাও। ”
তটিনী ঝামটি মেরে বলল,
” যাব না। ”

সাফায়াত, তাঈফ আর তটিনী যখন শোহরাবকে নিয়ে বাড়ি থেকে বের হলো তখন আলিজার মন খারাপ। অপরূপাকে জিজ্ঞেস করলো,
” কালু ভাইচান চলি যাচে কেন? ”
অপরূপা উত্তর দিল, ” মহলে যাচ্ছে। টা টা দিন। ”
আলিজা টা টা দিল না। বরঞ্চ চেঁচিয়ে চেঁচিয়ে বলল,
” অ্যাই কালু ভাইচান আল কুখন আচবে? ”
তটিনী তার কথা শুনে হেসে ফেললো। বলল,
” কালুভাইজান আর আসবে না এখানে। ”
শোহরাব শোইয়াবকে ভাই বলে ডাকলো। তারপর হাত নেড়ে টা টা দিল। শোইয়াব শেহজাদের কোলে। সেও হাত নাড়লো। আলিজা হাত নেড়ে ফোঁপাতে ফোঁপাতে বলল,

” তা তা কালুভাইচান। তা তা কালু ভাইচানেল আম্মা। ”
অপরূপা তার কথা শুনে হেসে গালে ঠেঁসে চুমু দিয়ে বলল,
” আহারে কত দুঃখ আমার পাখির। ”
তটিনীরা সবাই চোখের আড়াল হয়ে যেতেই আলিজার কান্না শুরু হলো। কান্নার মূল কারণ, কালু ভাইচান তাকে ছেড়ে চলে গিয়েছে। শোইয়াব তার কান্না দেখে হেসে লুটোপুটি। হাসতে হাসতে তার সামনে গিয়ে জিজ্ঞেস করলো,
” অ্যাই ফুচা মেয়ে, তুমি কালু ভাইচানেল জুন্য কানচো?”
আলিজা তার মুখ বরাবর ঠাস করে চড় বসিয়ে বলল,
” ভেইয়া সুপ। আবাল ডুক্কু দিচচো?”
শোইয়াব তার মার খেয়ে আরও জোরে হাসতে লাগলো। অপরূপা শোইয়াবকে কোলে তুলে নিয়ে যেতে যেতে বলল,
” ওকে রাগাতে বারণ করেছি না? সকাল থেকে বাঁদড়ামি করছে পাজি মেয়ে। ”

তটিনীদের ঘোড়ার গাড়ি যখন সুলতান মহলের সিংহদুয়ারে পৌঁছালো তখন মহল প্রাঙ্গনে শেরহাম নাদির আর কাশিফকে নিয়ে বসা ছিলো। তাদের সামনের ছোট টেবিলে কিছু আঙুর আর আপেল রাখা। হাতে সাদা পট্টি বাঁধা নাদির গা এলিয়ে বসে কাশিফ আর শেরহামের সাথে হেসেমেতে গল্প করছে। আশেপাশে মানিক, লাট্টু আর আনোয়ার ঘুরঘুর করছিলো।
সবাইকে গাড়ি থেকে নামতে দেখে নাদির আর কাশিফ দাঁড়িয়ে পড়লো। শেরহাম বসে কপাল কুঞ্চন করে গাড়ির দিকে চাইলো। তাঈফ গাড়ি থেকে নামার সাথে নাদিরকে দেখে কিছুক্ষণ তব্দা খেয়ে দাঁড়িয়ে রইলো। অবিশ্বাস্য দৃষ্টিজোড়া তার চকচক করছে। ছুটে এসে বুক বরাবর হাত দিয়ে ধাক্কা দিয়ে বলল,
” মানুষ বাঁচামরা নিয়ে মজা করে হারামির বাচ্চা?”
নাদির পিছিয়ে গেল। হেসে বলল,

” পাগল হয়ে গেলি নাকি? আমি মজা কবে করলাম? অনেকদিন পর দেখা হলো আর তুই মারছিস? ”
তাঈফ তার কলার চেপে ধরে বলল,
” আর আমরা কি না ভেবেছি। এতদিন কোথায় ছিলি? আমরা কেউ না তোর? একবারও দেখা দিতে ইচ্ছে হয়নি? ”
নাদির বলল, ” তোরা এতকিছু ভেবে আছিস তা’কি আমি জানি? শবনম না বললে তো জানতে পারতাম না। ”
তাঈফ তাকে টেনে শক্ত করে বুকে জড়ালো।
সাফায়াত আর কাশিফ হাসলো তাদের কান্ড দেখে। শেরহাম বলল,
” তোমরা হঠাৎ? ”
সাফায়াত বলল, ” শবনমের জ্বর আর আম্মাদের নাকি গোছগাছ হয়নি তাই কাল সকালে আসবে। নাদির সাহেব ঠিক আছেন আপনি? ইমরান কি করে হামলা করলো? ওকে তো আপনি অনেক খুঁজেছিলেন। ”
শেরহাম বলল, ” হ্যা, হুট করে দেখলাম ঘাটে। মনে হয় পালাচ্ছিলো। আচ্ছা সেসব কথা পরে হবে। ওদের নিয়ে ভেতরে যাহ। ”

সাফায়াত আর তাঈফের সাথে কাশিফের পরিচয় করিয়ে দিল নাদির। তাদের কথাবার্তার একফাঁকে
শেরহামকে জোরেশোরে “আব্বা” বলে ডাকলো শোহরাব। শেরহাম কিছু বুঝে উঠার আগেই সে ছুটে এল। শেরহাম হাত বাড়িয়ে তাকে কোলে নিয়ে হেসে বলল,
” তুমিও চলে এসেছ? ”
” হা, আম্মাও আচচে। ”
শেরহাম তার দুগালে অসংখ্য আদর দিল, উপরে তুলে পেটে বুকে মুখ দিয়ে সুড়সুড়ি দিতেই শোহরাব খিকখিক হাসিতে ফেটে পড়লো। তটিনী দূরে দাঁড়িয়ে হাসলো।

তটিনী বোরকা খুলে রসাইঘরে যেতেই দেখলো মতিআপা একা একা বসে মাছ-মাংস কাটাকুটি করছে। তটিনী তার জন্য খাবার-দাবার, ফলমূল এনেছে। সেগুলো এনে তার সামনে রেখে বলল,
” কেমন আছ মতিআপা? ”
” ভালা নাই। একাহাতে কি কাজ ফুরোয়? আপনার বইন নাকি ফিরছে! বাবাগো শুইনা কইলজ্যা ঠান্ডা হয়ছে। ”
তটিনী মৃদু হাসলো। বলল,
” আমাকে কি করতে হবে দাও। মেহমানদের কি খেতে দিয়েছ? ”
” দিছি অনেক নাশতা পানি। ”
” শোহরাবের আব্বা খেয়েছে? ”
” জানিনা বাপু। আমি টেবিলে রাইখা চইলা আইছি। আপনার জামাই থাকলে সেইখানে আমি নাই। আমার ডর লাগে। কখন না জানি খ্যাঁক করে উঠে। আমার এমনি হাজারটা ভুল হয়। ”
তটিনী বলল,

” ভয়ের কি আছে? ও কি মানুষ না? শোনো তুমি ওকে চেনো না তাই ভয় পাও। আলিজা বুড়িকে দেখেছ? ওর মাথায় উঠে নাচে। ”
মতিবানু বলল,
” মাফ কইরেন। আমি খারাপ কিছু বলতে চাইনাই। আমার এমনি ডর লাগে উনারে। ”
তটিনী বলল,
” বেশ। দেখি আমাকে কি করতে হবে বলো। ”
” মাছটা কাটছি। একটু ধুইয়া দেন। ”
তটিনী মাছ-মাংস, তরিতরকারি, চাল-ডাল সব ধুয়ে দিল। তারপর চুলায় আগুন ধরিয়ে দিল। মতিবানুকে বলল
” তুমি অন্য কাজ করে নাও। আমি রাঁধতে পারবো।”
মাছ-মাংস গুলো কষিয়ে রাঁধার সময় হঠাৎ একদৌড়ে মতিবানু রসাইঘরের কোণায় গিয়ে দাঁড়িয়ে কপালের উপর ওড়না টেনে দিল। তটিনী কপাল কুঁচকে চাইলো। দেখলো রসাইঘরে শোহরাব এসেছে। শোহরাবের পিছুপিছু শেরহাম। কলস থেকে গ্লাসে পানি ঢেলে শোহরাবকে দিয়েছে শেরহাম। শোহরাব ঢকঢক করে পানি খেয়ে হাত দিয়ে গাল মুছে ঢেঁকুর তুললো। শেরহাম হাসলো তার সাথে। মতিবানু আর তটিনীর উদ্দেশ্যে বলল,
” সদরকাছাড়ির জগগুলো সব খালি পড়ে আছে কেন? পানি খাওয়ার জন্য এখানে চলে আসতে হলো।”
মতিবানু মিহিস্বরে জবাব দিল,

” এক্ষুণি রাখতাছি সাহেব। ”
তটিনী শোহরাবকে জিজ্ঞেস করলো,
” কি খেয়েছ শোহরাব?”
শোহরাব শেরহামের কোলে উঠে শক্ত করে গলা জড়িয়ে, গালে গাল চেপে ধরে উত্তর দিল,
” মোজা মোজা। ”
শেরহাম হেসে তার মুখ মুছে দিতে দিতে বেরিয়ে পড়লো রসাইঘর থেকে।
রান্না-বান্না প্রায়ই শেষ। তটিনী গোসল সেড়ে এসে নামাজ শেষ করে রসাইঘরে গেল। সাফায়াত এসে বলল,
” রান্না হয়েছে? ”
তটিনী ভাত বাড়তে বাড়তে বলল,
” হ্যা ভাইজান। একটু নিয়ে যান। ”
সাফায়াত টেবিলে ভাত তরকারি নিয়ে গেল। শেরহাম এসে মাছ মাংসের বাটি নিয়ে যাওয়ার সময় বলল, ” লবণ ঠিকঠাক দেখেছিস? ”
মতিবানু উত্তর দিল, ” জ্বি সাহেব। সব ঠিকঠাক আছে। বেগম রান্না করছে। ”
শেরহাম কপাল কুঞ্চন করে একপলক তাকালো। তারপর চলে গেল। তটিনী বলল,

” তুমি খেতে বসো মতিআপা। আমারও খিদে পেয়ে গেছে। ”
তারা দুইজন বসে খেয়ে নিল। দেশী মুরগীর রান্নাটা একটু ঝাল হয়েছে, বাদবাকি সব মজা হয়েছে। তারা ভাত খাওয়া শেষ করে উঠার আগেই শোহরাবকে নিয়ে ফের রসাইঘরে এল শেরহাম। শোহরাবের চোখমুখ লাল হয়ে এসেছে। শেরহাম কর্কশ গলায় বলল,
” মধুর কৌটো দে। মাংসে এত ঝাল দিয়েছিস কেন? বাচ্চাটা খেতে পারছে? ”
মতিবানু মধুর কৌটো বাড়িয়ে দিয়ে তটিনীর দিকে ভীতু চোখে চাইলো। তটিনী বসা থেকে দাঁড়িয়ে পড়লো। শোহরাবের কাছে গিয়ে ওড়নার কোণা দিয়ে মুখের ঘাম মুছে দিতে দিতে বলল,
” বেশি ঝাল লেগেছে সোনা? কক্ষে মিষ্টি কমলা আছে। চলো খাবে। ”
সে শোহরাবকে নিয়ে গেল। শেরহাম পকেট থেকে পয়সা বের করে রসাইঘরের টেবিলের উপর রেখে চলে গেল। বলে গেল, এগুলো রাখ।
মতিবানু বসা থেকে উঠে দেখলো অনেকগুলো পয়সা। তটিনী আসতেই হেসে পয়সাগুলি দেখিয়ে বলল,

” বখশিশ পাইছি বেগম। ”
তটিনী হাসলো। বলল, ” এটা তোমার প্রাপ্য। ”
খাওয়া-দাওয়া শেষে রসাইঘর গুছিয়ে তটিনী ভাবলো, একটু ঘুম দেবে। ক্লান্ত লাগছে। তটিনী চুল হতে গামছা ছাড়িয়ে শুকোতে দিয়ে কক্ষে চলে এল। তক্ষুণি সাফায়াত তাকে ডেকে বলল, তারা ঘুরতে যাচ্ছে সবাই। শোহরাবও যাচ্ছে সাথে। সে যেন চিন্তা না করে। তটিনী ভাবলো, যেখানে তার আব্বা থাকবে সেখানে চিন্তা কিসের? কিন্তু বিছানায় শুয়ে চোখ বুঁজার আগেই বাইরে শেরহামের গলা শোনা যেতেই সে উঠে গেল। শেরহাম শোহরাব কোথায় মতিবানুকে জিজ্ঞেস করতে করতে কক্ষে এসে পড়লো। মহলের বাইরে যাওয়ার জন্য যে জুতোজোড়া সে পড়ে তা খুঁজতে লাগলো। তটিনী বিছানা থেকে নেমে জুতোজোড়া খুঁজে দিল। শেরহাম তার দিকে ভুরু কুঁচকে তাকালো। শেরহাম জুতোজোড়া পড়ে চাদর নিয়ে বেরিয়ে যাওয়ার সময় তটিনী তার সামনে এসে জড়িয়ে ধরে বুকে থুঁতনি ঠেকিয়ে মুখটা তুলে চাইলো শেরহামের দিকে। শেরহাম চোখ নামিয়ে তার দিকে চেয়ে জিজ্ঞেস করলো,

” কি চায়? ”
তটিনী আপনাআপনি হাসলো। শেরহাম কপাল কুঞ্চন করে বলল,
” ছাড়। ”
তটিনী আরও শক্ত করে ধরে বুকে মুখ গুঁজতেই শেরহাম পিছু হেঁটে কর্কশ গলায় বলল,
” তনীর বাচ্চা ছাড়। ”
তটিনী মুখ তুলে হাসলো। গলা জড়িয়ে ধরে শেরহামের থুঁতনিতে চুম্বন করে বলল,
” না ছাড়লে কি করবে? ”
” ধাক্কা মেরে ফেল দেব। ”
” দাও। ”
” সোজা কথায় বলছি, ছাড়। যেতে দে। ”
তটিনী বলল,
” দেখো, আমি দোষ করেছি, তাই সবাই আমাকে বকেছে সারাক্ষণ। অনেক কথা শুনিয়েছে। আমি আমার দোষটা মাথা পেতে নিয়েছি। আমার কারণে তোমাকে কথা শুনতে হয়েছে। কিন্তু আমি কি তোমাকে কথা শোনানার জন্য সত্যিটা আড়াল করেছি? ”

শেরহাম ওই ব্যাপার নিয়ে কথা বলতে চাইলো না। তটিনী শক্ত করে জড়িয়ে ধরে বলল,
” সবার কথা সহ্য করেছি। তোমারও শোনানোর থাকলে শোনাতে পারো। সবার কথা যখন সহ্য করেছি তখন তোমার কথাও সহ্য করতে পারব। ”
শেরহাম বলল, ” তনী ছাড়। আমাকে বেরোতে হবে। ”
” তুমি আমার উপর রেগে আছ কেন? আমি কি তোমার ক্ষতি চেয়েছি কখনো? তোমার অসম্মান চেয়েছি? তুমি আমার উপর রেগে থাকলে আমার কিছু ভালো লাগে না। ”
শেরহাম নরমগলায় বলল,
” রেগে নেই। ছাড়। ”
তটিনী বলল,
” সত্যি? ”
” হ্যা। ”

খুশিতে পায়ের আঙুলে ভর দিয়ে ধারালো গালে ঠোঁট চেপে চুমু খেল সে। শেরহাম বলল,
” ছাড়বি এবার? ”
তটিনী তার গলা শক্ত টেনে জড়িয়ে ধরে চোখাচোখি চেয়ে হেসে বলল,
” আমার পাওনা না দিলে ছাড়ছিনা। মতিআপাকে বখশিশ দিয়েছ। ও তো কাটাকুটি করেছে। আমি সব রেঁধেছি। আমার বখশিশ কই?”
শেরহাম নির্লিপ্ত কণ্ঠে বলল, নেই, ছাড়।
তটিনী জোর গলায় বলল,
” আমার বখশিশ না দিলে ছাড়বো না। ”

শেরহাম তাকে জোর করে সরিয়ে দিতেই সে টাল সামলাতে না পারে কেদারার কোণায় গিয়ে পড়াতেই আর্তস্বরে ডাক দিল। শেরহাম চট করে টেনে নিয়ে পায়ের দিকে নীচু হতেই তটিনী ফুঁপিয়ে উঠলো। ধাক্কা দিতেই শেরহাম তাকে পেছন থেকে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে ধরে ভেজাচুলের উপর কানের কাছে নাকমুখ ঘষে আলতো করে ঠোঁট ছুঁয়ে বলল,

প্রিয় বেগম সিজন ৩ পর্ব ১৭+১৮

” আল্লাহর ওয়াস্তে যেতে দে আমাকে। বড্ড জ্বালাচ্ছিস আমাকে। ”
তটিনী শিউরে উঠলো সাথেসাথে। চুম্বনের উষ্ণতা পাওয়ামাত্রই লাজুক হেসে উঠলো। শেরহাম অবাক! সামনে ফিরে শেরহামকে অবাক হতে দেখে আরও জোরে হেসে উঠলো সে। দুহাত বাড়িয়ে জড়িয়ে ধরে বুকে চুমু খেয়ে মুখ তুলে চেয়ে বলল,
” আমার সিংহ। ”

প্রিয় বেগম সিজন ৩ পর্ব ২১+২২