প্রিয় বেগম সিজন ৩ পর্ব ৭+৮

প্রিয় বেগম সিজন ৩ পর্ব ৭+৮
পুষ্পিতা প্রিমা

কেদারার পায়ার সাথে পা দুটো বাঁধা, পিছমোড়া করে হাত বাঁধা, কাপড় দিয়ে মুখ বাঁধা ইমরান গোঁ গোঁ শব্দ ছাড়া কিছুই করতে পারলো না। তার সামনে বসা লাট্টু, আনোয়ার আর মানিক। সুলতান মহল থেকে অদূরে একটি পরিত্যক্ত কুটিরে ইমরানকে বেঁধে নিয়ে আসা হয়েছে শেরহামের আদেশে। আগেরকার মতো মহলের বাইরে নিরাপত্তারক্ষী রাখা হয় না। বড় সড়কের কাজে বেশিরভাগ সৈন্য নিয়োজিত থাকায় মহল প্রাঙ্গনে শেহজাদের কোনো সৈন্য উপস্থিত ছিল না। আর রাতও বেড়েছে। সেই সুযোগে ইমরানকে বন্দি করা সহজ হয়েছে মানিক আর আনোয়ারের। তারা সুযোগের অপেক্ষায় ছিল কখন ইমরানকে বাগে পায়।

ক্রোধের তাড়নায় ইমরানের চোখদুটো জ্বলছে। তার শরীরের উত্তরোত্তর ঝাঁকুনিতে কেদারাটাও দুলছে। মানিক তেড়ে এসে কেদারায় ধপাস করে লাথি বসিয়ে ইমরানের টুটি চেপে ধরে বলল,
” শেরহাম সুলতানের সাথে লাগতে গেছিলি? আসতেছে তোরে কো*পা*ইতে। শালা। ”
ইমরান একনাগাড়ে গোঁ গোঁ শব্দ করতে লাগলো। দপদপ পায়ের শব্দ শুনতে পেয়ে মানিক ঘাড় ঘুরালো তৎক্ষনাৎ। আনোয়ার দাঁড়িয়ে আছে। তাদের সবার মুখ বাঁধা। মানিক জিজ্ঞেস করলো,
” সাহেব আইসা পড়ছে? ”
আনোয়ার বলল,

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

” না। মনে হয় মহল থেকে বের হতে পারতেছে না। এখন বের হতে দেখলে সবাই সন্দেহ করবে। মহলে একবার যাব? কি বলিস? ”
মানিক অস্থির হয়ে বলল,
” না না কাউরে এইখান থেকে সরতে বারণ করছে। অপেক্ষা করি আর কিছুক্ষণ। এই মালটার ব্যবস্থা করতে হবে। ”
লাট্টু কুটিরে প্রবেশ করে দরজা বন্ধ দাঁড়ালো। বলল,
” সম্রাটের সৈন্যরা এই বেটার খোঁজে বেরিয়ে পড়েছে। ঘোড়া ছুটতে দেখলাম। যদি এদিকে এসে পড়ে? ”
ইমরান চোখ তুলে চাইলো। তাকে খুঁজছে শুনতে পেয়ে সে পুনরায় গোঁ গোঁ শব্দ করতে লাগলো। মানিক বলল,
” আলো নিভাইয়া দে। তাড়াতাড়ি কর। এদিকে আলো জ্বলতেছে দেখলে সন্দেহ করতে পারে। তাড়াতাড়ি নিভায় দে।

লাট্টু আর আনোয়ার একএক করে হারিকেন দুটো নিভিয়ে ফেললো। কিন্তু মনের ভয় দূর হলো না। ঠিকই ঘোড়ার দল এদিকেই এগিয়ে আসতে লাগলো। মানিক বলল,
” সাহেব বলছে, সৈন্যরা কাছাকাছি চলে এলে পালাতে। এখন কি করব? এদিকেই আসতেছে সবাই। ”
লাট্টু বেড়ার ফাঁক দিয়ে দেখলো, দলেদলে সৈন্যরা এদিকে এল ঠিক কিন্তু কেউ থামলো। ঝোপঝাড়, গাছপালার মধ্যে এই ছোট্ট পরিত্যক্ত কুটিরটি কারো নজরে পড়লো না। তাই সকলেই সামনের দিকে ছুটে গেল। সবাই চিন্তামু্ক্ত হলো আর ঠিক তক্ষুণি সবার মধ্যিখান হতে একজন অশ্বারোহী পিছু হটতে হটতে সবার পেছনে চলে এল। তারা চেঁচিয়ে একে অপরকে কি বলছে তা বুঝতে পারছেনা মানিক আনোয়ার কেউ। তবে এটুকু বুঝে গেল সেই অশ্বারোহী এদিকেই আসছে। তারা একজোট হয়ে দাঁড়ালো। সম্রাটের হাতে ধরা পড়লে নির্ঘাত মৃত্যু। উনি ছাড় দেবেন না। তারা বড় সাহেবের কথাও বলতে পারবে না। বড় সাহেবকে সবাই ভুল বুঝবে। কেউ উনাকে বিশ্বাস করতে চাইবে না কেন তিনি একাজটা করলেন। এখন উপায়? তিনজনই কুলকুল করে ঘামতে লাগলো।

ইমরান চালাকি করে যতটা সম্ভব জোরে গোঙাতে লাগলো। লাট্টু দৌড়ে গিয়ে তার মুখ সর্বশক্তি দিয়ে চেপে ধরতেই দরজার উপর হঠাৎ লাতি পড়লো। আর ঠিক তক্ষুণি ঘুণেপোকাখাওয়া দরজাটা সরে গেল। আর মশালের আলো কুটিরের মেঝেতে এসে পড়লো। ইমরান আলোর তীব্রতায় চোখ বন্ধ করে ফেললো। লাট্টু, আনোয়ার, মানিক তিনজনই হাঁটুগেড়ে মেঝেতে বসে করজোড়ে বিড়বিড়িয়ে বলল,

” মাফ করুন সম্রাট। আমাদের ভুল হয়ে গেছে। মাফ করুন এবারের মতো। ”
মশালটা ছুঁড়ে মারতেই সেটি নরম স্যাঁতসেঁতে মেঝেতে গেঁথে গেল। কেঁপে উঠলো তারা তিনজনই।
কাঁপতে কাঁপতে উর্ধ্বমস্তকে তাকালো। আচমকা তিনজনের চোখ চকচক করে উঠলো খুশিতে। একলাফে দাঁড়িয়ে পড়ে চিৎকার দিতে যাবে ঠিক তখুনি শেরহাম হাত দেখিয়ে থামিয়ে দিল।
ইমরান ধীরেধীরে চোখ খুললো। দেখলো তার সামনে বলিষ্ঠদেহী একজন পুরুষ দাঁড়িয়ে। ধীরহস্তে পাগড়ি খুলে কেদারা টেনে বসলো সেই পুরুষ অবয়বটি। আর ঠিক তখুনিই তার সামনে উদ্ভাসিত হলো সেই কঠিন মুখ, সেই শাণিত দৃষ্টি। যা দেখে ইমরানের বুকে রক্ত জমাট বাঁধতে শুরু করলো। শেরহাম পায়ের উপর পা তুলে বসে বিড়ির মাথায় আগুন ধরিয়ে বলল,

” মুখ খুলে দে। ”
লাট্টু তৎক্ষনাৎ ইমরানের মুখ খুলে দিল। ছাড়া পেয়ে ইমরান কাশতে শুরু করলো। কাশতে কাশতে শেরহামের দিকে চোখ পড়তেই সারা শরীর হিম হয়ে এল তার। শেরহাম ধোঁয়া উড়িয়ে ইমরানের মুখ বরাবর ধোঁয়া ছাড়তেই, ইমরান গা ঝাঁকিয়ে বলল,
” তুই আমার বাপকে মেরেছিস। আমি তোকে মারতে এসেছি। ওদের চাইতে জঘন্য মৃত্যু তোর প্রাপ্য। তুই একটা বিশ্বাসঘাতক। তুই বিশ্বাসঘাতকতা করেছিস। তোকে মারব, সাথে তোর বউ, বাচ্চা, আপনজন সব কটাকে। ছাড় আমাকে । ”

বলতে বলতে শেরহামের দিকে থুতু ছুঁড়ে মারলো সে। থুতু ছুটে আসার পূর্বেই মানিক লাথি বসালো ইমরানের বুক বরাবর। কেদারাসহ পড়ে গেল সে। শেরহাম দাঁড়িয়ে পড়লো এবার। হাতের বিড়ি ফেলে দিয়ে কেদারাসহ তুুললো ইমরানকে। মানিক ধারালো চাকু ছুঁড়ে দিল শেরহামের দিকে। শেরহাম সেটি খপ করে ধরে ইমরানের গলা চেপে ধরলো। রক্তচোখে চেয়ে বলল,
” আমার সাথে পেরে ওঠ। তারপর আমার বউ বাচ্চার কথা বলবি। আমি শেরহাম সুলতানের সাথে পেরে উঠলে তবেই শেরহাম সুলতানের বাচ্চার কথা মুখে আনবি। আমার হাতে মরতে না চাইলে যাদের নিয়ে এসেছিস তাদের সবাইকে নিয়ে এক্ষুণি চলে যাহ। ভুলেও শবনমের দিকে চোখ তুলে তাকাবি না। ”
গলা চেপে ধরায় শ্বাসরোধ হয়ে ইমরানের চোখ উল্টে আসছিলো। শেরহাম গলা ছেড়ে দিতেই ইমরানের প্রাণ ফিরে এল যেন। প্রাণপণে শ্বাস ফেললো সে । শেরহামের হাতের চকচকে চাকুটার দিকে ভয়ার্ত চোখে তাকিয়ে হাঁপাতে হাঁপাতে বলল,

” আমাকে ছাড়। আমি তোকে শেষ করতে এসেছি। শেষ করেই ফিরবো বিশ্বাসঘাতক। ”
শেরহাম ফের গলা চেপে ধরে চাকুটা তার চোখের সামনে ঘুরাতে ঘুরাতে বলল,
” চল খেলা শুরু করি। ভয় পাস না আবার। ”
ভয়ে জমে গেল লাট্টু। সে সবার চাইতে খানিকটা ভীতু। বড় সাহেবকে তো আরও বেশি ভয় পায় সে। চোখবুঁজে ভীতকন্ঠে বলল,
” সাহেব আমি বাইরে যাই? আপনি তারপর কাটাকুটি করেন। ”
শেরহাম ঘাড় ফিরিয়ে তাকাতেই লাট্টুর প্রাণ যায়যায় অবস্থা। হাতের চকচকে চাকুটার দিকে তাকিয়ে একদৌড়ে বেরিয়ে গেল সে।

শেরহাম পুকুরঘাটে নেমে হাত-মুখ ধুঁয়ে ঘাটে উঠে আসতেই মানিক বলল,
” বেগম দেখেননি আপনি এসেছেন? ”
” ও ছাড়া সবাই দেখেছে। তোদের বেগম ঘুম। তোর কি মনে হয় ওর ভয়ে আমি আসতে পারতা না? ”
আর কাউকে কৈফিয়ত না দিলেও বেগমের কাছে যে শেরহাম সুলতানকে কৈফিয়ত দিতে হয় সেকথা ওরা ছাড়া ভালো কে জানে? তারপরও মানিক শেরহামের কথায় হ্যা তে হ্যা মিলিয়ে বলল,
” না এমনি জানতে চাইলাম। উনি তো হাজারটা প্রশ্ন করতো। বাকিরা কিছু বলেনি? ”
” তোর কি মনে হয় আমি বোকার মতো একা একা এখানে চলে এসেছি? আমি সৈন্যদের সাথে বেরিয়েছি। তাই কেউ কিছু বলেনি। ”

” সম্রাট কোথায়? ”
” সে বোধহয় সমুদ্রের পাড়ে গিয়েছে। জাহাজ ধরবে। ”
” যদি উনি সত্যিটা জানতে পারেন?”
শেরহাম চোখ ঘুরিয়ে মানিকের দিকে তাকালো।
” কোন সত্যিটার কথা বলছিস? ”
মানিক ইতস্তত করে বলল,
” ইয়ে মানে, আসল সত্যিটা জানতে পারলে তো ভালোই হবে। কিন্তু আপাতত যে সত্যিটা আমরা লুকিয়েছি সেটা জানতে পারলে উনি নিশ্চয়ই ক্ষেপে যাবেন। ”

” গেলে যাক। কালো দুনিয়ার ও কি চেনে? ওর সামনে যা থাকে তা ফকফকা পরিষ্কার। ও আমার মতো কঠোর, পাশবিক, নির্মম পশুগুলোকে কাছ থেকে দেখেনি। আমার মতো অভিজ্ঞতা ওর নেই। আর আমি যা করি তা নিয়ে আমি কাউকেই কৈফিয়ত দিই না। আমি জানি কোনটা ঠিক কোনটা বেঠিক। মহলে যাব। সৈন্যদের পৌঁছানোর আগে পৌঁছাতে হবে। ”
আনোয়ার গলা হাঁকিয়ে বলল,
” সাহেব চলে আসুন। অশ্ব প্রস্তুত। ”
শেরহাম হাতের বাহুতে মুখ মুছতে মুছতে এগিয়ে গেল। লাট্টুকে বলল, যেভাবে বলেছি সবটা সেভাবে করবি। হেরফের যেন না হয়।

তটিনী শোহরাবকে কোলে নিয়ে বসে আছে। চোখ ছোটার পর সে বিছানায় শেরহামকে দেখেনি। শেরহাম কোথায় গেল তা জানতে সে বিছানা থেকে নামতে যাবে, ঠিক তখনি শোহরাবও জেগে উঠেছে। কাঁচা ঘুম ছুটে গেলে শোহরাব বিরক্ত হয়। কান্নাকাটি জুড়ে দেয়। তটিনী তাকে বুকে নিয়ে পুনরায় ঘুম পাড়ালো। শুয়ে দিতে যাবে দেখলো শোহরাব তার ওড়না মুঠোয় ধরে আছে। সে শোহরাবকে কোলে নিয়েই কক্ষ থেকে বেরিয়ে গেল। বুকের ভেতরে একপ্রকার অস্থিরতা কাজ করছে তার। ওই ছেলেটাকে বন্দি করে কোথায় নিয়ে গেল সে? কম্পিত পায়ে হাঁটতে হাঁটতে আসরকক্ষের দিকে এগুতেই দেখতে পেল মহলের কেউই ঘুমোয়নি। বাচ্চাগুলোও জেগে। আলিজা খোদেজার কোলে বসে খোদেজার তজবী হাতে নিয়ে খেলছে। তটিনীকে দেখামাত্রই বলল,

” কালু ভাইচানের আম্মা, কালু ভাইচান ঘুমম? ”
তটিনী তার কথায় মৃদু হেসে ফেললো। বলল,
” হুমম। ”
আলিজা বলল,
” কালু ভাইচানের আব্বাও নাই। আমাল আব্বাও নাই। ”
তটিনী শাহানার দিকে তাকালো। শাহানার চোখেমুখে লেপ্টে আছে চিন্তা, বিষাদ, অস্থিরতা। কি থেকে কি হয়ে গেল? কোনো শুভ কাজই ভালোই ভালোই হয় না এই মহলে। শবনমের নিকাহ প্রসঙ্গ তোলার পরপরই কত চিন্তায় ছিলেন উনি। যে বিপদের আশঙ্কা করে চিন্তায় একাকার, ঠিক সেই বিপদ এসে নিকাহে বাঁধা পড়লোই। এক মেয়ের সংসারটা বহুকষ্ট, বহুধৈর্য, বহু বাঁধা-বিপত্তির পর একটু একটু করে মজবুত হয়ে উঠেছে। অনেক আঁধার পেরিয়ে জীবনটা রঙের দেখা পেয়েছে। এখন আবার আরেক মেয়ের জীবনে বিপত্তি শুরু হয়েছে। শাহানাকে দেখে তটিনীর মায়া হলো। শাহানা বলল,

” শেরহাম সবটা শুনে সৈন্যদের সাথে বেরিয়েছে। চিন্তার কিছু নেই। সৈন্যদের সাথে ফিরবে। ”
শবনম এগিয়ে এসে বলল,
” আব্বু খালামণির কোলে আসো। ”
শোহরাব ঘুমঘুম চোখে শবনমের কোলে গেল। শবনম ওকে কোলে নিয়ে গালে কয়েকটা আদর দিল। আলিজাকে বলল,
” ভাইজানরা ঘুমিয়ে পড়েছে। আর আপনি এত রাতে বসে বসে পাকনামি করছেন? ঘুম নেই চোখে?”
” ঘুম নেই চুকে?”
শবনমের প্রশ্নকে ব্যঙ্গ করে খিকখিক করে হাসতে লাগলো সে। অপরূপা বলল,
” দিনের বেলা ঢুসে ঢুসে ঘুমাবে। রাতে ঘুম নেই। অসভ্য মেয়ে। ”
আলিজা আঙুল দেখিয়ে বলল,

” লুপা সুপ সুপ । আমাল আব্বাকে বুলে দিবো। ”
আয়শা, হুমায়রা ফিক করে হেসে উঠে আবার হাসি ধামাচাপা দিল। তটিনী শোহরাবকে শবনমের কোলে দিয়ে সদরকক্ষের কাছাকাছি চলে এল। সেখানে শেরতাজ সাহেব, শাহজাহান সাহেব আর সোলেমান মাহমুদসহ ইমরানের সাথে আসা তার মামা খালুরা বসে আছেন চিন্তিত মুখে। তটিনী ভালো করে মাথা ঢেকে আড়ালে দাঁড়ালো তাদের সবাইকে দেখে। সদর দরজা খোলা থাকায় সে মহলের সিংহদুয়ার দেখতে পাচ্ছে। কোনো সৈন্যকে ঘুরাঘুরি করতে দেখা যাচ্ছে না। লাট্টু, মানিকদেরও দেখা যাচ্ছে না। ওরাও কি বেরিয়েছে ওর সাথে? কি করতে চাচ্ছে সে কে জানে? অস্থিরতায় ঘামতে লাগলো সে।
তার অস্থিরতা কমে এল যখন বাদশাহর ডাক শুনতে পেল। ঘোড়ার হ্রেষাধ্বনি শুনতে পেয়ে সবাই চমকে উঠলো। মেয়ে বউরা দ্বিতল চত্বরে এসে দাঁড়ালো পর্দার পেছনে। তটিনীও উঁকিঝুঁকি দিল। শুধু শেরহামকে দেখলো। শেরহাম মহলে প্রবেশ করামাত্রই শাহজাহান সাহেব ছুটে গিয়ে বললেন,

” কোনো খোঁজ পেলে? ”
শেরহাম বলল,
” আমি বেশিদূর যাইনি। ফিরে এসেছি। সৈন্যরা ফিরলে আসল খবর জানা যাবে। ”
কেন সে বেশিদূর যায়নি সে প্রশ্ন সবার মনে এলেও মনেই থেকে গেল। কেউ জিজ্ঞেস করার চেষ্টাও করেনি। উত্তর শুনে তারা সন্তুষ্ট হতেন না এটা বোধহয় জানতেন। তটিনী দ্রুত সরে গেল। শেরহাম লম্বা লম্বা পা ফেলে কক্ষের দিকে পা বাড়ালো। হঠাৎই তটিনীর সামনে পড়লো। জিজ্ঞেস করলো,

” তুই? ”
পেছনে মা বোনেরা আছে জেনে তটিনী বলল,
” না এমনি ঘুম ছুটে গিয়েছিল। তাই। ”
” ওহহ। ”
শেরহাম কক্ষপথে হেঁটে চলে গেল। আলিজা তার পথ আটকে বলল,
” অ্যাই আ্যাই কালু আব্বা আমাল আব্বা কুথায়? আব্বাল জন্যি বুসে আচি। ”
শেরহাম ঠোঁট উল্টে বলল,
” মাথায়। ”
আলিজা তার মাথায় হাত দিয়ে ভ্যাঁবাছ্যাঁকা খেয়ে দাঁড়িয়ে থাকলো। অপরূপাকে গিয়ে জিজ্ঞেস করলো,
” আমাল আব্বা মাথায়? ”
অপরূপা তাকে কোলে টেনে নিয়ে বলল,

” চুপ। ঘুমান। আর কোনো কথা নয়। ”
আলিজা মিছিমিছি চোখ বন্ধ করে রেখে বিড়বিড়িয়ে বলল,
” কালু ভাইচান, কালু ভাইচান। ”
অপরূপা হেসে ফেলে বলল,
” এটা কি গান যে সারাক্ষণ গেয়ে বেড়ান? ”
আলিজা মাথা দুলিয়ে বলল,
” কালু আব্বাল মাথা। ”

কক্ষে হুড়মুড়িয়ে প্রবেশ করে তটিনী দরজা বন্ধ করে বলল,
” কোথায় গিয়েছ তুমি? ”
শেরহাম পাঞ্জাবির বোতাম খুলতে খুলতে বলল,
” নাচতে গিয়েছি। ”
তটিনী ক্ষেপে তাকাতেই শেরহাম বলল,
” সবাই ওকে খুঁজতে বেরিয়েছে। আর আমি ঢুসে ঢুসে ঘুমালে সন্দেহ করবে না? সর। ”
তটিনীকে সামনে থেকে সরিয়ে দিল। তটিনী খপ করে তার পাঞ্জাবি টেনে ধরে বলল,
” দাঁড়াও। হাতা ভেজা কেন? ”
বলতে বলতে চুলে হাত দিল। প্রশ্ন করলো,
” চুল ভেজা কেন? ”

শেরহাম বিরক্ত হয়ে “চ” কারান্ত শব্দ করে বলল,
” ফালতু বকিস না তো। আমার ছেলেকে নিয়ে আয়। ঘুমাবো। যাহ। ”
তটিনীর চোখ তখন নিবদ্ধ শেরহামের কাঁধে। রক্তের ছোপ ছোপ দাগ দেখে সে স্তম্ভিত চোখে চেয়ে ধীরেধীরে হাত তুলে কাঁধের পোশাক ছুঁয়ে বলল,
” তুমি ওকে মেরে ফেলেছ? কিভাবে মেরেছ? আবারও খুন-খারাপি করে বেড়াচ্ছ রাত-বিরেতে? আবারও? ”
শেরহাম কিছু বলতে যাবে তার আগেই তটিনী পিছু হটলো। বলল,
” একদম ছুঁবে না। সে যতই খারাপ হোক। ওকে মারাটা উচিত হয়নি। ”
” তুই কি চেঁচিয়ে চেঁচিয়ে সবাইকে শোনাচ্ছিস? ”
” কেন ভয় হচ্ছে? ”

শেরহাম তেড়ে এসে বলল,
” ভয়? আমাকে ভয় দেখাতে আসবি না। ভয়ের বাপও আমাকে ভয় পায়। ”
তটিনী তাকে ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে দিয়ে বলল,
” তুই আমাকে ছুঁবি না ওই হাতে। ”
শেরহাম তার হাতের দিকে একবার তাকালো। চোয়াল শক্ত করে বলল,
” চিল্লাবি না খবরদার। ”
তটিনী দ্বিগুণ রাগত স্বরে বলল,
” একদম ধমক দেবে না আমাকে। আমাকে ঘুমিয়ে রেখে রাত-বিরেতে খুন-খারাবি করে বেড়াচ্ছ। আর আমি সেই তোমাকে নিয়েই গান গেয়ে বেড়ায় সবার কাছে। ”
শেরহাম বলল,

” যাহ সবাইকে বলে আয় তোর বোনের হবু বরকে আমি খুন করেছি। যাহ বলে আয়। দাঁড়িয়ে আছিস কেন?”
তটিনী আবারও ধাক্কা দিল শেরহামকে। বলল,
” একশোবার বলব। ”
” যা যা। বের হ। ”
তটিনী লাথি দিয়ে কেদারাটা সরিয়ে দিয়ে বলল,
” তোর ঘরে আমি আর আসবো না শয়তান। তুই থাক তোর খুন-খারাবি নিয়ে। আমার ছেলেকেও ধরবি না ওই হাতে।”
শয়তান শব্দটা কানে আসতেই শেরহাম চোখ তুলে তাকালো। জানতে চাইলো,
” কি বললি? ”
তটিনী রাগে ফোঁসফোঁস করলো। কেদারায় আরও একটা লাথি বসাতেই পায়ে আঘাত পেয়ে পা ধরে বসে গেল। শেরহাম এগুতেই আঙুল দেখিয়ে বলল,
” একদম দরদ দেখাবে না। এসব ন্যাকামিপনা দেখিয়ে আমাকে বশ করছো? শয়তানিগিরি এখনো যায়নি না?”
শেরহাম রক্তাক্ত চোখে চেয়ে রইলো নির্বাক। তটিনী আঙুলের ব্যাথা সহ্য করে দাঁড়িয়ে পড়লো। চোখ মুছতে মুছতে বেরিয়ে গেল।

শাহানা, শবনম সকলেই তার চোখেমুখের এমন হঠাৎ পরিবর্তন দেখে হতভম্ব। চেঁচামেচি কেন হচ্ছিলো? হঠাৎ কি হলো? সবই তো ঠিক ছিল। শাহানা কিছু জিজ্ঞেস করতে যাবে ঠিক তখুনি নীচ থেকে হৈচৈ চেঁচামেচির শব্দ কানে এল। সবাই সেদিকে দৌড় লাগালো। তটিনীও তাদের পিছুপিছু ছুটলো। নিশ্চয়ই লাশ এনেছে!!
দ্বিতল চত্বরে দাঁড়িয়ে তার মাথার উপর বাঁজ পড়লো ইমরানকে জ্যন্ত দেখে। তার হাতে একটা পট্টি ছাড়া সে পুরোপুরি সুস্থ। কেমন স্বাভাবিক হয়ে কথা বলছে।

সাফায়াত এসে মা বোনদের সবটা খুলে বলল। ইমরানের ভাষ্যমতে সে হাঁটতে বেরিয়েছিল মহলের বাইরে। লাট্টু তাকে ঘোড়াশালের ঘোড়া দিয়ে বলেছে ঘোড়ার পিঠে চড়ে ঘুরে আসুন। ঘুরতে বেরিয়েছিল এই মনে করে যে কিছুদূর গিয়ে ফিরে আসবে কিন্তু ঘোড়াটা ছুটতে ছুটতে এমন জায়গায় গিয়ে থেমেছে যেখান থেকে ফেরার রাস্তা খুঁজে পাচ্ছিলেন না উনি। তারউপর ঘোড়ার লাগাম ছুটে যাওয়ায় হাতে ব্যাথাও পেয়েছে। বহুকষ্টে উনাকে সবাই উদ্ধার করতে পেরেছে। কাল সকালে উনি রওনা দেবেন। চিঠিতে জানিয়ে দেবেন উনার বাড়ির মহিলারা কবে শবনমকে দেখতে আসছেন।

শাহানার বুকের উপর হতে যেন পাথর সরে গেল। সবাই বুক ফুলিয়ে শ্বাস ফেললো। তটিনী স্থির দাঁড়িয়ে রইলো। লোকটা মিথ্যে বললো কেন? কেন শেরহামের নাম নেয়নি? ভয়ে? শেরহামও তার কোনো ক্ষতি না করে ছেড়ে দিয়েছে? আর সে তো না জেনে গালাগালি করে ফেলেছে। এখন কি হবে?
তটিনীর চমক ভাঙলো শেরহামকে দেখে। ঘুমন্ত শোহরাবকে শবনমের কোল থেকে নিয়ে কক্ষের দিকে হেঁটে চলে গেল সে। তটিনীর দিকে একপলকও তাকালো না। তটিনী চুপিসারে হেঁটে গেল কক্ষের দিকে। শেরহাম শোহরাবকে বিছানায় শুয়ে দিয়ে এল। তারপর দরজা বন্ধ করে দিল তটিনীর মুখের উপর। তটিনী কেঁপে উঠলো। দরজা ধাক্কা দিয়ে বলল,

” দরজা খোলো। আমি থাকবো কোথায়? ”
” আমার ঘরে এরকম অবিশ্বাসী মেয়েমানুষের জায়গা নেই। ”
তটিনী দরজায় মাথা ঠুকে বলল,
” আর জীবনেও অবিশ্বাস করব না। ”
” শয়তানের সাথে থাকতে হবে না তোকে। ”
” আমি ভুল করে বলে ফেলেছি। ”
শেরহামের উত্তর এল না আর।
তটিনী অনেকক্ষণ দাঁড়িয়েছিল। তারপর আর না পেরে নিঃশব্দে চুপিসারে শবনম আর আয়শার কক্ষে গিয়ে ঘুমিয়ে পড়লো। আয়শা আর শবনম ড্যাবড্যাব করে বোনের দিকে তাকিয়েছিল শুধু।

সকাল সকাল ইমরান তার লোকবলকে নিয়ে মহল ছেড়েছে। শেরহাম তাকে প্রাণে শেষ করতে পারতো। কিন্তু জীবন যেভাবে নতুন সুযোগ দিয়েছে সেও চায় সবাই নিজের অপকর্ম ছেড়ে বেরিয়ে আসার একটা সুযোগ অন্তত পাক। ইমরান তার পায়ে না পড়লে, প্রাণভিক্ষা না চাইলে সে ছেড়ে দিত না। তবে ইমরান এত সহজে শোধরাবে এমনও সে ভাবেনি। ইমরান তাকে কথা দিয়েছিল সে নিকাহ করতে অসম্মতি জানাবে। এবং তার বাড়ির মহিলারা আর আসবে না। রূপনগরে পাও রাখবে না সে। ভবিষ্যতে কোনোপ্রকার হাঙ্গামায় জড়াবে না শেরহাম সুলতানের সাথে। শবনমকে নিকাহ করার কথা স্বপ্নেও ভাববে না। কিন্তু শেরহামকে বোকা বানিয়ে সে সন্ধ্যা নাগাদ ঠিকই একজন লোককে পাঠালো সুলতান মহলে। আর চিঠিতে জানালো, আগামীকালই নিকাহ’র দিন পাকা করতে আসছেন পাত্রের মা বোনেরা। অবশ্যই তাদের নিরাপত্তার দিকে বিশেষ নজর দিতে বলেছেন শেহজাদ সুলতানকে। সম্ভব হলে নিকাহ”র তারিখ এই সপ্তাহের মধ্যেই দেয়া হবে যদি উভয়পক্ষের সম্মতি থাকে।

শেরহাম বুঝতে পারলো সবই ইমরানের চাল। তবে শেরহাম এবার তাকে আর ছাড়বে না।
সে সারাদিন মহলে ছিল না। দুপুরে মহলে খায়নি। সকালেও না খেয়ে বেরিয়ে গিয়েছে।
মানিকের মুখে সবটা শুনে তটিনীর অনুশোচনা হচ্ছে, কেন সে অল্পতে রেগে গেল?
আরেকটু শোনা উচিত ছিল তার। নিজের ভুলে অনুশোচনায় দগ্ধ হয়ে সেও সারাদিন মনমরা ছিল। ভালো করে খাওয়াদাওয়া করেনি।
শেরহাম ফিরলো তারউপর ইমরানের চিঠিও এল। সবটা জানার পর তটিনীর বুঝার বাকি রইলো না ইমরান লোকটা আসলেই খারাপ। শেরহাম তাকে সুযোগ দিয়েছিল যার অপব্যবহার করছে সে। কিন্তু এখন কি করবে সে? আব্বার আনন্দের শেষ নেই মেয়ের বিয়ে নিয়ে । ইতোমধ্যে সবাই বাজারের তালিকা করতে বসে গেছে। যদিও শেহজাদের মুখে এখনো কিছু শুনেনি সে।
শেরহামকে কক্ষে যেতে দেখে আয়শাকে দিয়ে কিছু খাবারদাবার পাঠিয়ে দিল সে। আয়শা খাবারগুলো নিয়ে ফিরে এল। বলল,

” ভাইজান খাবে না বলছেন। কক্ষেও না রাখতে বলছেন। তাই নিয়ে এসেছি। ”
তটিনী জোরপূর্বক টুনুকে পাঠালো। টুনু এসে হাঁপাতে হাঁপাতে বলল,
” আমার সাহস হয় নাই বেগম। আপনার জামাই চোখ বন্ধ কইরা কেদারায় বসে আছে। আমার বুকডা এখনো কাঁপতাছে দেইখেন। ”
তটিনী শবনমকে বলল,
” তুমি যাও। ”
শাহানা বলল,
” তুমি নিয়ে যাও। এতক্ষণ পর ঘরে ফিরলো আর তুমি যাচ্ছ না কেন? ”
খোদেজা বলল,
” নিজেদের ভেতরকার সমস্যা নিজেদের মিটিয়ে নিতে হয় তনী। ”

সবার জোরাজোরিতে তটিনী রাজি হলো ঠিক। কিন্তু সে কক্ষে প্রবেশ করতেই কেদারা হতে দাঁড়িয়ে পড়লো শেরহাম। চাদর টেনে নিয়ে ঝেড়ে গায়ে জড়াতে জড়াতে বেরিয়ে পড়লো। তটিনী তার পেছন পেছন দৌড়ে গেল। শেরহাম আলিজার সামনে গিয়ে থমকালো। আলিজা মেঝেতে বসে খেলছে। শেরহামকে দেখে ছুটে এসে বলল,
” অ্যাই কালু আব্বা কালু ভাইচান আমাল সাথি কথা বুলেনা। ”
তটিনী ইশারায় তাকে বলল, ঝাপটে জড়িয়ে ধরতে। আলিজা ছুটে এসে শেরহামের পা দুটো জড়িয়ে ধরে বলল,
” কুলে কুলে। ”
শেরহাম কোলে নিল। গালে আদরও করলো। আলিজা তটিনীর সাথে হাসছে। শেরহাম তা খেয়াল করে পেছনে ফিরে তাকাতেই তটিনীকে দেখামাত্র চোখমুখ কঠিন করে ফেললো। তটিনীর হাসিহাসি মুখ অন্ধকার হয়ে এল। ছুটে এসে বলল,

” দেখো খাওয়ার উপরে রাগ দেখানো ঠিক না। আমিও…
তটিনীকে কিছু বলতে না দিয়ে আলিজাকে কোল থেকে নামিয়ে দিয়ে গটগট পায়ে হেঁটে বেরিয়ে গেল শেরহাম। তটিনী রাগে দুঃখে ঠাঁই দাঁড়িয়ে রইলো। শবনম এসে বলল,
” আপু আব্বা বলছেন ঘুরতে যাবেন আমাদের নিয়ে। শোহরাবকে নিয়ে চলো। খুব মজা হবে। ”
শাহানা তার পিছুপিছু এসে বলল,
” ওরও নিকাহ হয়ে যাবে। তাই তোমার আব্বা চাচ্ছে একটা বনভোজন হোক। যাও ঘুরে এসো সবার সাথে। সোহিনী কি আসছে? ওকে না গত সপ্তাহে চিঠি লিখেছিলে? ”
তটিনীর গলায় কান্নার দলা তাই সে জবাব দিতে পারলো না। এত চিন্তার মধ্যে সে বনভোজনে কিভাবে যাবে?

নিজের বাসভূমিতে যাওয়ার জন্য সোলোমান মাহমুদ ছটপট করছিলেন দেশে আসার পর থেকে। শেহজাদ আশ্বস্ত করেছে যে শবনমও সেই সুযোগে ঘুরে আসবে তার দাদার ভিটেবাড়িতে গিয়ে। বিয়ের পর কখন আর যাওয়া হয়।
তাছাড়া সামির জন্মের পর তার দাদার ভিটেবাড়িতে যায়নি। তাই সাফায়াত ভেবেছে সায়রা আর সামিরকেও নিয়ে যাবে। সবাই যখন যাচ্ছে শাহানা তখন বললো, সবাই যাক। অপরূপাও যায়নি কখনো। যেহেতু জয়পুরে তাদের বাসভবনে কেউ থাকেনা সেহেতু তাদেরকেই রেঁধেবেড়ে খেতে হবে। তাই সবাই শেষমেশ সিদ্ধান্তে উপনীত হলো যে তারা বনভোজনে যাবে।

যেহেতু তাদের ভিটেবাড়ির পাশেই পাহাড় আছে, অদূরেই সমুদ্র। বাসভবনের সামনে খোলা পরিবেশে দারুণ একটা ভোজন হবে। সবকিছুর আগাম পরিকল্পনা করে সবাই প্রস্তুত হচ্ছিলো। ফিরে এসে নিকাহ’র তারিখ পাকা করবেন বলে জানিয়ে দিয়েছেন সোলেমান মাহমুদ।
তটিনী প্রথমেই যেতে চাইলো না। কারণ সে জানে শেরহাম কিছুতেই যেতে চাইবে না। তারপর সে তটিনীর উপর চটে আছে। কোনোকথা শুনবে না। তটিনী তাই শাহানাকে বলেও দিল সে যেতে পারবে না। মহলে থাকবে। সবার মন খারাপ হয়ে গিয়েছিল তা শুনে। সবাই ওখানে আনন্দ করবে আর সে এখানে একা একা কি করবে? শেরহামও সারাদিন মহলে থাকে না। শাহানা কিছুতেই একথা মানতে পারছিলনা। বলল, “আমি শেরহামকে রাজী করাবে। ও আমার কথা ফেলতে পারবে না। আমি ওকে অনুরোধ করব। দেখো ও রাজী হবে। ”

তটিনী আর কিছু বলেনি। শাহানার সাথে শেরহামের কি কথা হয়েছে তটিনী জানেনা। তবে শাহানা শুধু বলেছে, সে যাচ্ছে। এ নিয়ে ওর সাথে কোনো কথা বলো না। কিছু বলেনি মানে যাবে। তুমি আপাতত কোনো ঝামেলা করো না।
ঝামেলা তো দূর। তটিনী কাছও ঘেঁষতে পারছেনা। তার আগেই লাপাত্তা। বনভোজনে একবার যাক।
ভোজনের সমস্ত কিছু যোগাড়যন্ত্র করছিলো মতিবানু, ফুলকলিরা সবাই মিলে। বাকিরা তাদের জামাকাপড় গোছাচ্ছে। তটিনী তার শোহরাবের কাপড়চোপড় গুছিয়ে ফেলেছে সন্ধ্যায়। শেরহামের কয়েকটা পাঞ্জাবি পায়জামা আর দুটো চাদর নিয়েছে। সবকিছু গুছিয়ে নিয়ে বাকিদের সাথে বনভোজনের খাওয়াদাওয়ার তালিকা করতে যোগ দিল। কিন্তু মন বসলো না। সারাদিন কোথায় খাওয়াদাওয়া করেছে ওই অসভ্য লোক? নাকি খায়নি কে জানে? তার উপর হম্বিতম্বি দেখিয়ে ক’দিন না খেয়ে থাকবে?

শাহানা এসে বলল, ” আচ্ছা সবাই রাতের খাবারটা খেয়ে নাও। তারপর এসব করে নিও। অনেক রাত তো পড়ে আছে। তনী আমার নানুভাই ঘুমিয়ে পড়বে। ওকে খাইয়ে দাও। কাল সারারাত চিন্তায় কেউ ঘুমোতে পারেনি। তাড়াতাড়ি এসব শেষ করে ঘুমিয়ে পড়ো সবাই। আর হ্যা শেরহাম বেরিয়ে গেল এখনো এল না? সারাদিন তার নাওয়াখাওয়ার খবর নেই। ”
তটিনীর মুখটা চুপসে গেল। টুনু বলল,

” বেগম এখনো কি আপনের জামাই আপনের উপর রাগ কইরা আছে?”
তটিনী ধমকে বলল,
” চুপ থাকো। ”
শাহানা বলল,
” কি হচ্ছে তনী? ওকে ধমক দিচ্ছ কেন?”
” দেখছেন না ও কাঁটা গায়ে নুনের ছিটে দিচ্ছে। ”
খোদেজা বলল, ” কি নিয়ে এমন ঝগড়া হলো তোমাদের? ঝগড়াও হয়? বাবাহ! আমি তো জানতাম। ”
তটিনী লজ্জা পেয়ে বলল, ” আম্মা আমি একটু ঘরে যাই। ”
সে দ্রুত প্রস্থান করতেই সবাই হেসে উঠলো।
তটিনী কক্ষে এসে দেখলো অনেক রাত হচ্ছে। এই লোক তাকে জ্বালিয়ে মারবে দেখছি। সেও সহজে ছেড়ে কথা বলবে না।

রাত আরও গভীর হতেই শেরহাম মহলে ফিরলো। তবে মহল প্রাঙ্গনে বসে রইলো। লাট্টু মানিকরা সকলেই ওখানে আছে। তটিনী তার আসার খোঁজ পেয়ে সেখানে গেল। তাকে দেখে মানিক হিসহিসিয়ে বলল,
” বেগম এসেছে। ”
শেরহাম ঘাড় ফিরিয়ে দেখলো, পুনরায় সামনে ফিরে গেল। কেদারায় গা ছেড়ে বসে রইলো। টুকটাক কথা বলতে লাগলো আনোয়ারের সাথে। তটিনী পেছনে বুকে দু-হাত ভাঁজ করে দাঁড়িয়ে বলল,
” মানিক ভাই!”
” জ্বি বেগম। ”
” তাকে জিজ্ঞেস করো খাবে কি খাবে না? অন্য মানুষরাও তো না খেয়ে বসে আছে নাকি। ”
লাট্টু হেসে ফেলে বলল,
” কিন্তু বেগম আমরা তো খাওয়াদাওয়া কইরা লইছি। ”
তটিনী আচমকা চেঁচিয়ে উঠে বলল,
” কি?”

সকলেই ভড়কে গেল। শুধু একজনই নির্বিকার, নিরুত্তর। নিরুত্তেজ ভঙ্গিতে মানিককে বলল,
” যাহ ঘুমিয়ে পড়। কাল সকাল সকাল কাজ আছে। ”
” জ্বি সাহেব যাচ্ছি। ”
তিনজনই মাথা নামিয়ে চলে গেল। শেরহাম কেদারায় মাথা এলিয়ে বসে রইলো।
তটিনী শান্ত, দৃঢ় গলায় বলল,
” ভালো। খুব ভালো। ”
বলেই হনহনিয়ে চলে গেল। তটিনীকে রেগেমেগে কক্ষের দিকে যেতে দেখে আলিজা উঁকি দিয়ে বলল,
” কালু ভাইচানের আম্মা লাগ কলছে?”
অপরূপা বলল, ” আপনি জেনে কি করবেন? ”
আলিজা বলল, ” কালু ভাইচানও আমাল সাথি লাগ কলচে। ”
” খুব ভালো হয়েছে। ”

বলেই অপরূপা হাসলো। আলিজা ঠোঁট ফুলিয়ে বলল,
” আমিও কালু ভাইচানের সাথি লাগ কচচি। ”
অপরূপা হাসতে হাসতে বলল,
” ওমা আপনার রাগও আছে? এত রাগ কোথায় রাখেন? ”
” কালু আব্বাল মাথায়। ”
অপরূপা কপাল চাপড়ে বলল, ” আমাকে মাফ করেন। যান ঘুমিয়ে পড়ুন। ভাইজান ঘুম না? ”
আলিজা একলাফে বিছানায় উঠলো। শোইয়াবের মুখের উপর ঝুঁকে কানের কাছে মুখ নিয়ে গিয়ে বলল,
” অ্যাই কালু ভাইচানের বুন্ধু, আমি তুমাল সাথিও লাগ কচচি। ”
অপরূপা ধমকে বলল, ” আলিজা খুব মারবো। ভাইয়াকে ডাকবে না। নিজে ঘুমাবেনা কাউকেও ঘুমাতে দেবে না। উফফ, এই মেয়েকে নিয়ে আমি কই যাই? ”
আলিজা শোইয়াবকে জড়িয়ে ধরে চোখ বন্ধ করে ঘুমের ভান ধরে বলল,

” আলিচা ঘুম। ”
অপরূপা তার গায়ে কাঁথা জড়িয়ে দিয়ে বলল,
” ঘুম ঘুম, বুড়ি ঘুম। ”
শেহজাদের গলা শোনা গেল ঠিক তক্ষুনি। আলিজার আর ঘুম! চট করে চোখ মেললো সে। বিছানা থেকে তড়িঘড়ি করে নেমে গেল। অপরদিকে শেহজাদ দরজা মেলে দাঁড়াতেই আলিজা খুশিতে হাত বাড়িয়ে দৌড়ে গেল। শেহজাদ কোলে তুলে আদরে আদরে ভরিয়ে দিয়ে বলল,
” আমার বুড়ি কেন রোজ এত রাতঅব্ধি জেগে থাকে? ঘুম নেই? ”
আলিজা বাবার গালে মুখ লাগিয়ে রেখে বলল,
” চুকে ঘুম নাই। ”

শেহজাদ হেসে উঠলো তার কথায়। আলিজাও হাসতে লাগলো। বাবাকে সারাদিনের সমস্ত জমানো অভিযোগ শোনালো বিছানায় বসে বসে। শেহজাদ পোশাক পাল্টে আরাম পোশাক গায়ে দিতে দিতে জানতে চাইলো, তারপর?”
আলিজা পা টেনে বসে বলল,
” কালু ভাইচান লাগ কচচে।”
” তারপর?”
” ভাইয়ে, ডাডুউ বুকা দিচে।”
” তাই? তারপর?”
” চায়রা ফুপ্পী বাবুকে কুলে দেনি। ”
অপরূপা ভেঙচি কেটে বলল,
” সে নিজে এখনো কোলে চড়ে, আর সে নেবে বাবুকে। হুহ। ”
শেহজাদ বলল,
” সায়রাকে খুব মারবো। তারপর?”
” তাপোল, লুপাও বুকা দিচে।”

শেহজাদ রূপার দিকে তাকালো। রূপা হেসে উঠে শোইয়াবকে তার বুকে টেনে নিয়ে চোখ বুঁজে বলল,
” একশোবার বকা দেব। ”
আলিজা অপরূপাকে আঙুল দেখিয়ে বলল, ” আমাল আব্বা তুমাল সাথি কুথা বুলেনা। ”
অপরূপা বলল, ” মেয়ে কিন্তু আপনার হয়ে রায় দিচ্ছে! ”
” দিতেই পারে। ”
” বেশ। আমিও আপনাল আব্বাল সাথে কথা বলার জন্য বসে নেই।”
শেহজাদ এসে আলিজাকে কোলে নিয়ে বুকে জড়িয়ে ঘুমিয়ে পড়লো। ঘুম পাড়িয়ে দিতে দিতে বলল,
” কাল সকালে আপনি ঘুম থেকে উঠার আগেই সবাইকে শাস্তি দেব। খুব বকা দেব। খুব মার দেব।”
আলিজা হাসলো। কি আনন্দ তার!

শেহজাদ তাকে বুকের উপর শুইয়ে মাথায় হাত বুলাতে বুলাতে ঘুম পাড়িয়ে দিল। ন্যায়বিচার পাওয়ার আনন্দে আলিজা বকবক করতে করতে ঘুমিয়ে পড়লো।
দরজায় ঠকঠক শব্দ হলো। তটিনী শোয়া থেকে মাথা তুলে বলল,
” বাইরে খেয়েছ এবার বাইরে ঘুমাও। দরজা খুলবো না। মগের মুল্লুক পেয়েছ আমাকে? নিজে হাজারটা দোষ করবে তা কিছুনা। আমার পান থেকে চুন খসলেই হয়েছে। দরজা খুলবো না আমি। যাও। ”
আরও জোরে জোরে দরজা ধাক্কাচ্ছে শেরহাম। তটিনী বলল,
” খুলবো না দরজা। ”

শেরহাম অনবরত দরজা ধাক্কা দিয়ে গেল। তটিনী দরজা খুললো না।
দরজা ধাক্কানো বন্ধ হয়ে গেল একসময়। তটিনী মাথা তুলে ভাবলো, চলে গেল নাকি?
না, তাকে ভুল প্রমাণ করে আবারও দরজায় ঠোকা পড়লো। তটিনী বলল,
” দরজা খুলবো না খুলবো না খুলবো না। কথা বলো। নইলে খুলবো না। শুনেছ? ”
শাহানা কথা বলে উঠলো, দরজা খোলো তনী। ”
তটিনী চমকে উঠলো। দ্রুতপায়ে হেঁটে গিয়ে দরজা খুলতেই দেখলো মা রেগে তাকিয়ে আছেন।
” শেরহামকে তাড়িয়ে দিয়েছ কেন? আমি তো দেখছি সব দোষ তোমার। ”
তটিনী আমতাআমতা করে বলল,

” আম্মা আমি আসলে…
” ওকে ডেকে নিয়ে এসো। যাও। ”
তটিনী চুপসে যাওয়া মুখে বলল, ” আচ্ছা। ”
বেরোনোর আগে শোহরাবের দিকে তাকালো সে। ঘুমন্ত শোহরাবকে কোলে নিয়ে নীচে চলে গেল। প্রাঙ্গনে শেরহামকে দেখা গেল না। মানিক এসে জানালো, সাহেব আমাদের পাশের কক্ষে ঘুমিয়ে পড়েছেন। আজ অনেক খেটেছে তাই হয়ত ঘুম চলে এসেছে। তটিনীর মায়া হলো। ধুরর তার অত বকরবকর করার কি ছিল? আবারও ভুল করে বসলো। এখন কি করবে সে?
অতিথিশালার কক্ষে গিয়ে দরজায় কড়া নাড়লো তটিনী। অনেকক্ষণপর ঘুমজড়ানো কন্ঠ ভেসে এল,
” কি হলো? ”
তটিনী নিজের গাল চেপে ধরলো। মানিককে বলতে বললো। মানিক বলল,

” ইয়ে মানে, দরজাটা যদি খুলতেন সাহেব। ”
” কেন?”
তটিনী ঘামতে লাগলো। মানিক বলল,
” একটা কথা ছিল। জরুরি। ”
শেরহামের সাড়াশব্দ পাওয়া গেল না আর।
হঠাৎ করে দরজা খুলে বসলো সে। তটিনী হুড়মুড়িয়ে ঢুকে পড়লো কক্ষে। মানিক ভয়ে পালালো। তটিনী কাষ্ঠ হেসে বলল,

প্রিয় বেগম সিজন ৩ পর্ব ৫+৬

” আমি বলেছি ওকে দরজা খুলতে। শোহরাব কাঁদছিল তো তাই নিয়ে এসেছি ওকে। ”
শেরহাম আড়চোখে তাকিয়ে দেখলো শোহরাব ঘুম। শোহরাবকে কোলে নিতেই তটিনী ভাবলো রাগ টাগ গলে ফুঁস। সে হাসলো। কিন্তু তার হাসিও ফুঁস হয়ে গেল যখন দেখলো শেরহাম তাকে বের করে দিয়ে মুখের উপর দরজা বন্ধ করে দিল।
তটিনী হতচকিত, হতভম্ব। দরজায় মাথা ঠুকে বলল,
” ও আল্লাহ তুমি আমার ছেলেকে নিয়ে নিলে কেন? দরজা খোলো। ওকে দিয়ে দাও। ”

প্রিয় বেগম সিজন ৩ পর্ব ৯+১০