প্রিয় বেগম সিজন ৩ পর্ব ১১+১২

প্রিয় বেগম সিজন ৩ পর্ব ১১+১২
পুষ্পিতা প্রিমা

জয়পুরের বাজার দেখতে গিয়েছিল শেরহাম। ফিরতে ফিরতে বেলা গড়িয়ে গিয়েছে। মোহকুঞ্জে ফিরেই দেখতে পেল তাঈফ শ্বশুর আর চাচা শ্বশুরের সাথে বসে চা খাচ্ছে। শেরহামকে দেখামাত্র সে বসা থেকে দাঁড়িয়ে পড়লো। নিজ দায়িত্বে এগিয়ে গিয়ে হাতে হাত মিলিয়ে জড়িয়ে ধরে বলল,
” আপনার অপেক্ষায় ছিলাম ভাইজান। কেমন আছেন?”
শেরহাম বাবা চাচার দিকে একঝলক তাকালো। তারপর মৃদু হেসে উত্তর দিল।
” ভালো। তোমাদের কি অবস্থা?”
” আমরা ভালোই। আপনি কোথাও গিয়েছিলেন বোধহয়। ”
” হ্যা, একটু বাজারে দিকে গিয়েছিলাম। আচ্ছা বসো। আমি আছি এখানে। ”
” জ্বি। ”

এটুকুই! আর কোনো বাক্যব্যয় না করে শেরহাম চলে গেল সেখান থেকে। যেতে যেতে হঠাৎই শবনমদের কক্ষ হতে ভেসে আসা সোহিনীর কন্ঠস্বর শুনতে পেল সে। একটু থামতেই তার পথ আটকে দাঁড়ালো আলিজা। কোলে তার পুতুলটি। শেরহামকে দেখামাত্র কপাল ভাঁজ করে বলল,
” অ্যাই কালু আব্বা, আঙুল কুথায়?”
শেরহাম বলল,
” আজ তো আনিনি। কি হবে এখন?”
” কান ধলো। তাপোল গালে তাচতাচ মালো। ”
শেরহাম বলল,
” আমি?”
আলিজা উপর-নীচ মাথা দুলিয়ে বলল,
” উম। ”
শেরহাম চোখ সরু করে বলল, ” কে শিখিয়েছে এসব? ”

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

” ডাডুউ। ”
” তুমিও কানে ধরে নিজের গালে নিজেই ঠাসঠাস মেরেছ কখনো? ”
আলিজা আঙুল তুলে বলল,
” সুপ সুপ, আমাকে আল ডুক্কু দিলে আমাল আব্বাকে বুলে দিবো। ”
শেরহাম বলল,
” আচ্ছা, বাবাহ ঠিক আছে। আমি যাই। ”
আলিজা তার পথরুদ্ধ করে বলল,
” নাহ, কুলে। ”
শেরহাম তাকে কোলে তুলে নিল। আলিজা তার পুতুলকে দেখিয়ে বলল,
” বাবুকে কুলে। ”
শেরহাম তার হাত থেকে পুতুলটাও নিল। আলিজা হাসলো। কিছুক্ষণ থেমে বলল,
” অ্যাই কালু আব্বা আমি কালু ভাইচান আল ভাইয়েকে কামুল দিচি। ”
বলেই দাঁত দেখিয়ে খিকখিক করে হাসলো। শেরহাম অবাকচোখে চেয়ে বলল,

” কি? ”
আলিজা হাসতেই থাকলো। শেরহাম হা হয়ে তাকাতেই কোল থেকে তড়িঘড়ি করে নেমে ভোঁ দৌড় দিল। কিছুদূরে গিয়ে পিলারের পেছনে আড়াল হয়ে দাঁড়ালো। উঁকি দিয়ে ডাকলো,
” অ্যাই কালু আব্বা!”
শেরহাম তাকালো তখুনি। আলিজা জানতে চাইলো,
” তুমি লাগ কলচো? ”
শেরহাম বেকুবের মতো চেয়ে রইলো শুধু। তটিনী শবনমের কক্ষ থেকে বের হতেই শেরহামকে দেখলো। বলল,
” না খেয়েদেয়ে কোথায় কোথায় ঘুরছো?”
শেরহাম বলল,
” ছিলাম বাজরের দিকে। ওখানে খেয়েছি। ”
“এই সুহি তোমার ভাইজান এসেছে। তোমার কথা বলতে বলতে ওর গলা শুকিয়ে গেছে। ”
সোহিনী কক্ষ হতে বেরিয়ে এল তখুনি। শেরহামকে দেখামাত্র তার চোখদুটো জলে ভরে উঠলো। শেরহাম বলল,
” কি অবস্থা? ”

সোহিনী এগিয়ে এসে ভাইকে জড়িয়ে ধরে কেঁদে উঠে বলল,
” তুমি আমাকে আর দেখতে যাওনি। ”
” আমার কাজের ব্যস্ততা ছিল। ”
” সব অজুহাত। আমার জন্য তোমার কোনো টান নেই।”
শেরহাম তার মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে দিতে বলল,
” যাব। ”
তটিনী বলল, ” নিজে তো যায় না আমাদেরও নিয়ে যায় না। ”
সোহিনীকে উস্কে দিতে দেখে শেরহাম রাগত দৃষ্টিতে শাঁসালো তটিনীকে। সোহিনী ফোঁপাতে ফোঁপাতে বলল,
” অতদূরে যেতে না পারলে সবাই মিলে অতদূরে নিকাহ দিয়েছ কেন? আমি যখন চায় তখন চলে আসতে পারিনা। ”
তটিনী তাকে আরও একটু উষ্কে দিয়ে বলল,

” এবার ছাড় দিয়েছ। এর পরেরবার কোনো ছাড় নেই। ”
শেরহাম তার দিক থেকে দৃষ্টি সরিয়ে সোহিনীকে বলল,
” এখন, কয়েকটা মাস থেকে যাহ। আমি তোকে এবার থেকে নিজে গিয়ে নিয়ে আসবো। ”
সোহিনী খুশি হয়ে বলল,
” সত্যি? ”
” হ্যা। ”

সোহিনী হাসলো চোখ মুছতে মুছতে। তটিনীও হাসলো তার সাথে। শোহরাব এল তখন। শেরহামের কোলে ঝাঁপিয়ে পড়লো। শেরহাম কোলে নিয়ে বলল,
” আলিজা কামড়ে দিয়েছে নাকি? কোথায়?”
শোহরাব হাত দেখালো। তটিনী বলল,
” তুমি কি করে জানলে? ”
” আমাকেই তো বললো। ”
তটিনী বলল, দেখেছ কান্ড। নিজে আবার বলে বেড়াচ্ছে।
শোহরাব বলল, ফুচা বুনেল সাথে কথা বুলিনা আমি।
তটিনী বলল, ” সেজন্যই তো কামড় দিয়েছে। কথা বললে কি হয়? ”
আয়শা কোলে করে আলিজাকে নিয়ে এল। বলল,
” আপু শোনো বাঁদড় দুটো কি করেছে। এমনিএমনি কামড়ায় নি। ওর চুল ধরে নাকি টান দিয়েছিল তাই কামড়ে দিয়েছে। ”

তটিনী অবাক চোখে শোহরাবের দিকে তাকালো। শোহরাব শেরহামের কাঁধে মুখ লুকিয়ে নিল। তটিনী আলিজার গালে আদর করে বলল,
” উফফ কত বকা খেয়েছে আম্মুটা। ”
আলিজা বলল,
” সুপ সুপ, কালু ভাইচানকে মালো। এখুন মালো। ”
সবাই হেসে উঠলো। তটিনী হাসতে হাসতে বলল,
” আচ্ছা মারবো। ”
শেরহাম বলল,
” মারবো না। কি করবে তুমি? ”
আলিজা চোখ রাঙিয়ে তাকালো। আঙুল তুলে বলল,
” কালুআব্বা সুপ। দুচতুমি কলচো কেন আবাল? ”
আয়শা হাসতে হাসতে তার গালে ঠেসে চুমু খেয়ে নিয়ে যেতে যেতে হুমায়রাকে ডেকে বলল,

” এই হুমা বুড়িকে নিয়ে যাহ তো। ”
টুনু বিরক্তির সহিত উত্তর দিল।
” হেতি বাসন মাজে। ডাইকেন না এত।”
আলিজা রেগেমেগে ডাকলো, ” অ্যাই আয়চাফুপ্পী!”
আয়শা বলল, ” জ্বি। ”
” আমি কালু ভাইচানকে আবাল কামুল দিবো। ”
আয়শা বলল, ” ওমা কেন? সোনাপাখি খুব ব্যাথা পেয়েছে?”
আলিজা কাঁদোকাঁদো মুখ করে বলল,
” উম। ”

শেহজাদ আর সাফায়াত বাজার করে নিয়ে এসেছে। টাটকা মাছ আর সদ্য জবাইকৃত হরিণের মাংস। সেগুলো সবাই মিলে কাটাকুটি ধোঁয়াবাছা করতে করতে আর ঘুরতে যাওয়ার কথা বলতেও পারেনি। বাজার থেকে ফিরে সিভান জানালো পাহাড়িদের মেলা বসেছে। সে যাবে শোহরাব আর শোইয়াবকে নিয়ে।
আয়শা শবনম ভেতরে ভেতরে ভীষণ উত্তেজিত মেলায় যাওয়ার জন্য। কিন্তু মুখফুটে কাউকে কিছু বললো না। আম্মা তাদেরকে ছাড়বে না যদি সাথে ভাইজানরা না যায়। সায়রা আর সোহিনীও যেতে ইচ্ছুক। সোহিনী তো প্রায় একপায়ে খাঁড়া। যদিও সে জানেনা সে যেতে পারবে কিনা কিন্তু তারপরও সে মনেমনে আনন্দিত হলো এই ভেবে বহুদিন পর মুক্ত আকাশের নীচে দাঁড়িয়ে সে আগের মতো ঘুরবে, ফিরবে, মেলা দেখবে, কেনাকাটা করবে ।

উফফ কত মজা হবে। নিজের শরীরের অবস্থা না ভেবে সে খুশিমনে তাঈফকে জানাতে চলে গেল সে কথা। তাঈফ গল্পগুজব করছিলো শ্বশুরদের সাথে। বাচ্চাদের সাথেও খুনসুটি করছিলো। সুলতান মহলের মানুষগুলো তার অতিপ্রিয়। মানুষগুলোর সংস্পর্শে এলেই মন ভালো হতে বাধ্য। তার নিজেরই এই মহলটা ছেড়ে যেতে কেমন কেমন লাগে সেখানে তাদের বাড়ির মেয়েটা যে সারাক্ষণ সারামহল দাপিয়ে বেড়াতো সেই মেয়েটার মহল ছেড়ে যেতে কেমন লাগে তা ভেবেই সারা হয় সে। অদ্ভুত মানুষের জীবন!
সিভান এসে বলল, তাঈফ ভাইজান আপনাকে আপু ডাকছে। কিছু বলবে নাকি। ”
তাঈফ শেরতাজ সাহেবের দিকে তাকাতেই উনি বললেন, ” যাও দেখে এসো কি বলছে। ”

” জ্বি। ”
তাঈফ সিভানের চুল ঘেঁটে দিয়ে বলল,” শালাবাবু আমাকে রেখে ঘুরতে চলে যাবেন না কিন্তু। ”
সিভান হেসে বলল, ” শেহজাদ ভাইজানকে বলব জামাইকে পালকিতে করে নিয়ে যেতে। সুলতান মহলের জামাই বলে কথা। ”
হেসে উঠে প্রস্থান করলো তাঈফ। যেতে যেতে পথে আয়শা, সায়রা আর শবনমের সাথে দেখা হলো। তারা নম্রমুখে সালাম দিয়ে বলল, ” কেমন আছেন ভাইয়া? ”
” ভালো। তোমাদের কি অবস্থা? ”
সায়রা বলল, ” আমরাও ভালো। সুহি বোধহয় ডাকছিলো আপনাকে। ”
” হ্যা তাই যাচ্ছি। শাদী মোবারক শবনম। ”
শবনম মিহি স্বরে উত্তর দিল,
” ধন্যবাদ। ”
তাঈফ বলল,

” আয়শাকেও। ”
আয়শা ফিক করে হেসে উঠে বলল,
” অ্যাহ আমি এখন নিকাহ করব না। বললেই হলো। ”
তাঈফ হেসে বলল, ” দেখা যাক। ”
সবাই হাসলো। তাঈফ তাদের সাথে কথা বলা শেষ করে সোহিনী আর তার জন্য বরাদ্দ কক্ষে প্রবেশ করার সাথে সাথে সোহিনী দ্রুতপদে এগিয়ে এল। তাঈফ বলল,
” আস্তে। ছোটাছুটি শুরু হয়ে গিয়েছে? ”
সোহিনী হাস্যমুখে এগিয়ে এসে তার গলা জড়িয়ে ধরে আবদার করে বলল,
” আমাকে মেলায় নিয়ে যান দয়া করে। খুব খুব খুব ইচ্ছে করছে। আব্বা, ফুপু, মা বেগম শুনলে ভীষণ বকা দেবেন। আপনি ওদের রাজী করিয়ে নেবেন। ”

তাঈফ স্ত্রীর এমন অদ্ভুত আবদার শুনে স্তম্ভিত। বলল,
” অসম্ভব। এই অবস্থায় বাইরে যাওয়া যাবেনা মোটেও। মেলায় তো নয়ই। ”
সোহিনী তাকে ছেড়ে দিল পরমুহূর্তেই। রাগে-দুঃখে তার চোখদুটো জ্বলছে। তাঈফ বলল,
” আমি বুঝতে পারছি তোমার যেতে ইচ্ছে করছে কিন্তু….
সোহিনী হাত দেখিয়ে থামিয়ে বলল,
” ব্যস। আর কিছু শুনতে চাই না আমি। যাব না আমি মেলা দেখতে। ”
বলেই দপদপ পায়ে হেঁটে বেরোতে যাচ্ছিলো। তাঈফ হাত ধরে টেনে জড়িয়ে ধরে নিজের মুখোমুখি এনে দাঁড় করিয়ে নাকে নাক মিলিয়ে বলল,

” কসম, বাবু হয়ে যাওয়ার পর তোমাকে অনেক জায়গায় ঘুরতে নিয়ে যাব আমি। কথার হেরফের হবে না। ”
সোহিনী হাতটা ছাড়িয়ে নিয়ে বলল, ” কোনো দরকার নেই এইসব সান্ত্বনা দেয়ার। সব মিথ্যে সান্ত্বনা। আপনার কাছে কোনোদিন কোনোকিছুর আবদার করব না আমি। ”
বলেই ফুঁপিয়ে কেঁদে ওঠে বেরিয়ে গেল। তাঈফ ‘চ’ কারান্ত শব্দ করে কক্ষ থেকে বেরিয়ে গেল। হামিদা সোহিনীকে ফোঁপাতে দেখে ছুটতে ছুটতে এল। বলল,
” ওর আবার কি হয়েছে তাঈফ? চোখমুখের তো বেহাল দশা। ”

তাঈফ বলল, ” আপনাদের মেয়ে অদ্ভুত আবদার করছে। ও মেলায় যেতে চায়। এই অবস্থায় মেলায় যাওয়াটা ওর জন্য নিরাপদ নয় তাছাড়া ফুপুআব্বা বলছিলেন এখানকার মেলায় নাকি অনেক সন্ত্রাস হামলা হয়। আপনাদের মেয়েকে একটু বুঝান। দিনের বেলা হলে মানতে পারতাম কিন্তু রাতের বেলা। নিজের শরীরের কথাও তো ভাবতে হবে। আম্মা কিছুতেই ওকে আসতে দিতে চায়নি ওর অসাবধানতার কারণে। ”
হামিদা বলল, ” আচ্ছা আমরা বুঝিয়ে বলছি। দেখি কি করা যায়। ”
হামিদা রসাইঘরে গিয়ে সবটা বলতেই শাহানা সোহিনীকে ধমকে বলল, ” মায়েদের এত অসতর্ক হলে চলে না সুহি। ঘুরাফেরা করার অনেক সুযোগ আসবে। তাঈফের কথা অবাধ্য হবে না। ও তোমার ভালোই চায়। আজব মেয়ে। ”
খোদেজা, হামিদা তাকে বুঝালো। কিন্তু সোহিনী হ্যা না কিছুই বললো না। অপরূপা তাকে সান্ত্বনা দিয়ে গেল। সোহিনী ভেবেছে তটিনী অন্তত তার পক্ষ নেবে কিন্তু সে শোনামাত্রই বলল,

” কোনো দরকার নেই ওখানে যাওয়ার। ”
সোহিনী বলল” তুমিও এমন বলছো? ”
” তো কি? এখন তোমার কথা সবাইকে শুনতে হবে? তোমাদের দুই ভাইবোনের এই এক অভ্যাস। নিজেরা যা ভালো মনে করে তাই। ”
সোহিনী চেঁচিয়ে বলল,

” তুমি আমার ভাইজানকে টেনে কথা বলছো কেন? ”
” তোমার ভাইজানও কম না। তুমিও না। দুজনেই ঘাড়ত্যাড়া, জেদি। ”
সোহিনী রসাইঘর থেকে বের হয়ে গেল হনহনিয়ে। নাক টানতে টানতে কক্ষের দিকে যাওয়ার পথে শেরহাম তাকে দেখে ডাকলো।
” কিরে কাঁদছিস কেন? ”
সোহিনী হঠাৎই চমকালো। ঘাড় ফিরাতেই ভাইজানকে দেখে চোখদুটো চকচক করে উঠলো। ছুটে গিয়ে বলল,
” ভাইজান আমাকে মেলায় নিয়ে যাও। আমি মেলা দেখবো। আমাকে নিয়ে যাও। ”
শেরহাম হা করে চেয়ে রইলো। পেছন পেছন তটিনী শাহানা, হামিদা সকলেই এসে দাঁড়ালো। শাহানা বলল,
” ও অসুস্থ। তাই তাঈফ ওকে যেতে দিতে চাচ্ছে না। তুমি বোঝাও তোমার বোনকে। ”
সোহিনী শেরহামের মুখের দিকে উত্তরের অপেক্ষায় চেয়ে রইলো। ফোঁপাচ্ছে এখনো। শেরহাম বলল,
” আমি নিয়ে যাব তোকে। ”

উপস্থিত সকলেই হতভম্ব। হা করে চেয়ে রইলো দুই ভাইবোনের দিকে। সোহিনী খুশিতে ভাইজানকে জড়িয়ে ধরে বলল, ” আমার ভাইজান। ”
শবনম, আয়শা দুজনেই হাসলো। শাহানা রেগে তাকাতেই শবনম আর আয়শা চুপসে গেল। সায়রা বলল, ” ওদের ভাইজানকে ওরা রাজী করিয়ে নিয়েছে। ফুপুআব্বাও সায় দিয়েছেন। ”
শাহানা বলল, ” কি? ”
তটিনী বলল, ” তো আমি বাদ যাব কেন? আমিও যাব। অবশ্যই যাব। ”
সোহিনী বলল, ” ভাইজান বলছে তোমাকে নিয়ে যাবে না। ”
তটিনী শেরহামের দিকে তাকালো তখুনি। বলল,

” তোর ভাইজানের বাপ নিয়ে যাবে। ”
সকলেই হি হি করে হেসে উঠলো। আলিজা দৌড়ে দৌড়ে এল হুমায়রার সাথে। তটিনী তাকে ধরে দু-তিনটে চুমু দিয়ে বলল,
” অ্যাই বুড়ি তুইও যাবি? ”
আলিজা বলল,
” উম। ”
তটিনী তাকে ঘুরিয়ে বলল,
” আমরা সব্বাই যাব। ”
আলিজা হাসতে লাগলো।

অপরূপা আলিজার চুল আছড়ে দিয়ে একটা সাদা ফ্রক পড়িয়ে দিল। পায়ে জুতো পড়িয়ে দিয়ে বলল,
” যান ফুপীরা তৈরি হয়েছে কিনা দেখে আসুন। আম্মা চুল বাঁধবো। খবরদার দৌড়াবেন না। হোঁচট খেয়ে কান্নাকাটি করলে কেউ আপনাকে মেলায় নিয়ে যাবে না। ”
আলিজা মাথা নাড়লো। অপরূপার গালের সাথে গাল চেপে আদর খেয়ে বেরিয়ে গেল। বেরোনোর সাথে সাথে শেহজাদকে দেখে কিচিরমিচির শব্দ করে হেসেখেলে কথা বলে চলে গেল ফুপীদের কাছে। শেহজাদ কক্ষে প্রবেশ করার সাথে সাথে অপরূপা ওড়না টেনে মাথা ঢাকলো। অপরূপা তাকে দেখে অপ্রস্তুত হেসে ওড়নাটা রেখে দিয়ে বলল,

” অন্য কেউ ভেবেছি। ”
শেহজাদ তার শাল বের করতে করতে বলল,
” সবাইকে তাড়াতাড়ি বের হতে বলো। ”
অপরূপা দ্রুত চুল আঁচড়াতে আঁচড়াতে বলল,
” হ্যা বলছি। আমি নিজেও এখনো তৈরি হইনি। বাবুরা সিভানের সাথে বেরিয়ে পড়েছে। ওদের খুঁজে নেবেন আগে। ”
” হুম। ”
অপরূপা আলিজা, শোইয়াব আর শেহজাদের বদলে রাখা কাপড়গুলো বালতিতে জমিয়ে রেখে বিছানার উপর ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কাপড়গুলি সরিয়ে নিয়ে আয়নার সামনে দাঁড়ালো হিজাব পড়ার জন্য। শেহজাদ তার পেছনে দাঁড়িয়ে চুলে হাত চালিয়ে চুলগুলি ঠিকঠাক করে নিতে নিতে বলল,

” আমার চিরুনিটা কোথায়? ”
অপরূপা খুঁজে দিল। শেহজাদ চুলে চিরুনি চালাতেই আয়নায় দেখলো অপরূপা হাসছে। সে ভুরু কুঁচকালো। অপরূপা হেসে ফেললো এবার সশব্দে। সামনে ফেরার পূর্বেই শেহজাদের দুহাত তাকে বেষ্টন করে ঘাড়ে মুখ গুঁজতেই অপরূপা কুঁকড়ে উঠলো। শেহজাদ বলল,
” হাসলে কেন? ”
অপরূপা সামনে ফিরে তার চুলগুলো এলোমেলো করে দিতে দিতে বলল, ” আপনাকে এরকম এলোমেলো চুলে দেখতে ভালো লাগে। ”
শেহজাদ কপাল কুঞ্চিত করে বলল,
” এটা কোনো কথা হলো? ”

অপরূপা তার চুলগুলো এলোমেলো করে দিয়ে বুকের দু’পাশে হাত ঠেকিয়ে মুখ বাড়িয়ে বলল,
” হলো হলো। আপনাকে এভাবে দেখতে ভীষণ ভালো লাগে। ”
খুবই নিকটে থাকায় শেহজাদ তার গালটা অপরূপার গালে ঘষে বলল,
” যথাআজ্ঞা। ”
অপরূপা চোখ খিঁচিয়ে বন্ধ করে বলল, ” আমার গালটা ছিঁড়ে দেয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছেন বুঝতে পারছি। উফফ কি ধারালো। ”
শেহজাদ গালে গাল ঘষে চুল সরিয়ে শক্তপোক্ত চুম্বন দিয়ে বলল,
” আমি অসুখ, আমিই জড়িবুটি। ”
অপরূপা হেসে তাকে জড়িয়ে ধরলো। বুকের সাথে লেপ্টে থুতনিটা বুকে ঠেকিয়ে মুখ তুলে চেয়ে বলল,

” আপনি একটা পাগল। ”
” এই উপাধিই বা ক’জন পায়? ”
অপরূপা মৃদু হেসে বুকের মাথা ফেলে রাখলো।
শেহজাদ শক্তহাতে জড়িয়ে ধরে মাথায় থুতনি ঠেকালো।
তাদের প্রগাঢ় অনুভবের মুহূর্ত ভাঁটা পড়লো আলিজার চেঁচামেচিতে। চেঁচিয়ে উঠে কান্না করে তখুনি কক্ষে এল সে। অপরূপা মাথা তুুললো শেহজাদের বুক থেকে। শেহজাদ বলল,
” কি হলো? ”

আলিজা হা করে গাল ছেড়ে কাঁদতে কাঁদতে বলল,
” কালু ভাইচান আল কালু ভাইচানেল বুন্ধু চলি গেচে। ”
শেহজাদ তাকে কোলে তুলে দুগালে চুমু দিয়ে বলল,
” তাতে কি? আমরা তো এখন যাচ্ছি। ”
আলিজা কাঁদতেই লাগলো। শেহজাদ তাকে কোলে নিয়ে বেরিয়ে পড়লো। সায়রা, সোহিনীদের ডেকে বলল,
” এই দেখো সবার আগে আলিজা বুড়ি তৈরি। তোমাদের সবাইকে রেখে ও চলে যাচ্ছে। সবাইকে টা টা দেন আম্মি। ”
আলিজা কাঁদতে কাঁদতে হাত নেড়ে বলল,
” টা টা ফুপ্পী, তুমাদের রাখি চলি যাচচি। ”
শেহজাদ হেসে উঠে তার গালে তুলতুলে গালটা ঠোঁট দ্বারা চেপে ধরে বলল,
” উফ উফ কত কষ্ট তার। সাফায়াত আমি বাইরে আছি। সবাইকে নিয়ে এসো। ”
” জ্বি আসছি ভাইজান। ”

সাফায়াত দ্রুতপায়ে কক্ষে ঢুকলো। ড্রয়ার থেকে আতর বের করে সুগন্ধি ছড়িয়ে সায়রাকে ডেকে বলল,
” সায়রা কোথায় তুমি? তাড়াতাড়ি করো। ”
সায়রা শব্দ করলো না। সাফায়াত ফের ডাকলো,
” এই সায়রা বানু, আপনি কোথায়? ”
কোনো সাড়াশব্দ না পেয়ে সাফায়াত আতর মেখে
পেছনে ফিরতেই দেখলো সায়রা রেগেমেগে তাকিয়ে আছে। সাফায়াত হাসতেই সায়রা পিছিয়ে গিয়ে বলল,
” কতবার বলেছি বানু ডাকবেন না। ডাকছেন, তাও জোরে!”
সাফায়াত দুপা এগিয়ে গিয়ে কোমর টেনে এনে নাকে চুম্বন করে বলল,

” আমার বানু, রাগলে তোমাকে কেমন লাগে কিভাবে বলি? আচ্ছা কবির শ্লীল ভাষায় বলব?”
সায়রা তার মুখ চেপে ধরে বলল, ” আপনি ভদ্রবেশী অসভ্য একটা লোক। আগে জানতাম আপনি আমার ভাইজানের সহজসরল বোকাসোকা একজন সঙ্গী। কিন্তু না আপনি একটা….
” আমি সায়রা বানুর ভদ্রবেশী অসভ্য বর হয়ে ভীষণ গর্বিত। আরেকটা হয়ে যাক। ”
সায়রা তার মুখটা হাত দিয়ে চেপে ধরে হাসতে হাসতে বলল,
” আপনাকে আমি…
সাফায়াত তার হাতটা ধরে পেছনে রেখে সামনে ঝুঁকে ওষ্ঠপুটে চুম্বন করে বলল,

” তাড়াতাড়ি বের হোন বানু। অপেক্ষা করছি। ”
সায়রা বড়বড় চোখ করে তাকিয়ে বলল,
” ধ্যাত.. ”
” দেরী নয় বানু। তাড়াতাড়ি করুন। সবাই অপেক্ষা করছে। ”
সায়রা ধমকে বলল,
” খবরদার বলছি বানু ডাকবেন না সবার সামনে। গতবার ওরা শুনে আমাকে লজ্জা দিয়েছিল। ”
সাফায়াত দরজার বাইরে দাঁড়িয়ে কক্ষে উঁকি দিয়ে এক নিঃশ্বাসে ডাকলো,
” বানু বানু বানু বানু বানু আমার বানু। ”
,,,,,,,..
সোহিনী বোরকা পড়ে ভালো করে গায়ে
শাল জড়িয়ে সদরকক্ষে এসে বসে রইলো শেরতাজ সাহেবের পাশে। শেরতাজ সাহেব মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে দিতে বলল,

” মেলায় গিয়ে কি কিনবি বল। এখনো ছোট মেয়ের মতো আবদার তোর। ”
সোহিনী হাসিমুখে বলল, ” ভাইজান যখন নিয়ে যাবে বলেছে তখন আমাকে কেউ আটকাতে পারবে না। আমি আমার ভাইজানের সাথে যাব আমার ভাইজানের সাথে আসবো। ”
শেরতাজ সাহেব আর কিছু বললেন না। মহল প্রাঙ্গন থেকে সদরকক্ষে পা রাখলো তাঈফ। সোহিনীর দিকে তাকালো না। দূরের আসনে গিয়ে চুপচাপ বসে রইলো। সোহিনী একপলক তাকিয়ে অন্যদিকে মুখ ঘুরিয়ে বসে রইলো। নীরব দর্শকের মতো শেরতাজ সাহেব মেয়ে আর মেয়ের জামাইয়ের রাগ-অভিমান দেখতে লাগলেন। শেরহাম চলে এল তৈরি হয়ে। সোহিনী তাকে দেখে দাঁড়িয়ে পড়লো। হাসিমুখে বলল, ” ভাইজান আমি গাড়িতে করে যেতে পারবো তো। পালকি লাগবে না। ”

” বেহারারা চলে এসেছে। চল। ”
তাঈফ আঁড়চোখে তাকালো। তার দিকে চোখ পড়তেই সোহিনীর হাসিহাসি মুখটা নিভে গেল। অপরূপা,সায়রা, শবনমরা সবাই বের হলো তখন। শাহানা সাফায়াতকে বলল,
” সুহিকে একটু দেখো। দুই ভাইবোন কারো কথা শুনতে চায় না। আর বাবুদের নজরে নজরে রেখো। বেশি রাত করো না। তাড়াতাড়ি ফিরে এসো। ”
সাফায়াত বলল,
” আমরা আছি তো আম্মা। এত চিন্তার কিছু নেই। আমরা দ্রুত ফিরবো। আর বাজারে শুনলাম, এখন অতটা বাজে অবস্থা নেই । আগের চাইতে উন্নত হয়েছে। আর আমরা সবাই আছি। আপনারা চিন্তা করবেন না। ”
” ফি আমানিল্লাহ। সবাই সাবধানে থেকো। তনী কি এখনো বের হয়নি? ”
শবনম বলল, ” বড় ভাইজান তো মাত্রই বের হলো। আপুও চলে আসবে। ”
বলতে বলতে তটিনী হাজির। আসামাত্রই বলল,

” আয়শা তোমার ভাইজান চলে গেল? আমাকে একটা কানাকড়িও দিয়ে যায়নি। তাড়াতাড়ি যাও। থামাও। ”
শাহানা বলল, ” আরেহ ওর পেছনে ছুটছো কেন?”
” পরে কথা বলছি আম্মা। ”
বলতে বলতে সে সদরকক্ষ হতে দৌড়ে বের হয়ে গেল। সোহিনীকে পালকিতে তুলে দিয়ে শেরহাম ঘোড়ার গাড়িতে সবেমাত্র চেপে বসেছে। অদূরে শেহজাদ আলিজার কান্না থামানোর প্রয়াস চালাচ্ছে। আকাশের তারা দেখাচ্ছে, গাড়ির ঘোড়া দেখাচ্ছে। আলিজার কান্না থামছে তো আবার কিছুক্ষণ পর এমনিএমনি কাঁদছে। শেরহাম গাড়িতে বসে শেহজাদকে বলল, ” তাঈফকে বেরোতে বল। আয়শা আর সায়রাকেও আসতে বল। গাড়ি একটা ছেড়ে দিক। ”
শেহজাদ সেকথা বলার পূর্বেই তটিনী ছুটতে ছুটতে এল। শেরহামকে বলল, ” এই এই টাকা দাও। টাকা না দিয়ে কোথায় যাচ্ছ? আমি কেনাকাটা করব না?”
শেরহাম নেমে এল গাড়ি থেকে। পাঞ্জাবির পকেট থেকে তিনশো টাকা বের করে দিয়ে বলল,

” তোর বাপ তো বিদেশ থেকে টাকার বস্তা নিয়ে এসেছে। তাকে গিয়ে ধর। ”
তটিনী ভেঙচি কেটে বলল,
” আমার বাপ যথেষ্ট দিয়েছে। তোমারটা তুমি দাও। আরও দাও। সবার জন্য কিছু না কিছু কিনতে হবে। এ টাকায় পোষাবে না। ”
শাহানা দূরে দাঁড়িয়ে ডাক দিল।
” তনী এদিকে এসো। ”
তটিনী ফিরে চাইলো। মায়ের কাছে যেতেই শাহানা ধমকে বলল,
” এই নাও পাঁচশো। তোমার আব্বা দিতে বলেছে। ওর সাথে টাকা নিয়ে কাড়াকাড়ি করছো কেন? সবে ব্যবসাতে পুঁজি ঢেলেছে। ”

তটিনী হেসে বলল, ” আচ্ছা ওর টাকা ওকে দিয়ে দেব। আপনার জন্য কিছু আনবো আম্মা? ”
” কোনোকিছুর দরকার নেই। সাবধানে যাও, সাবধানে এসো। ”
” জ্বি। ”
তটিনী টাকাটা নিয়ে শেরহামের নিকট চলে এল। তার টাকা তার দিকে বাড়িয়ে দিয়ে বলল,
” নাও। আমার আর লাগবে না। ”
শেরহাম ভুরু কুঁচকে বলল,
” কেন? ”
” আব্বা নাকি পাঁচশো টাকা দিয়েছে আমার জন্য।”
বলেই তটিনী হাসলো।
হাসি হঠাৎই থেমে গেল, যখন খেয়াল করলো শেরহামের চেহারা গম্ভীর আর কঠিন হয়ে এসেছে। চট করে বাড়িয়ে দেয়া টাকাটা তার হাত থেকে কেড়ে নিল শেরহাম। পকেটে রেখে দিয়ে লম্বা লম্বা পা ফেলে যেতে লাগলো গাড়ির কাছে। তটিনী তার পথরুদ্ধ করে বলল,

” তুমি রাগ করলে কেন আবার? আচ্ছা দাও ওই তিনশো টাকা। দাও। ”
শেরহাম দাঁতে দাঁত চেপে বলল, ” এক চড়ে দাঁত ফেলে দেব। সর। ”
তারপর উচ্চস্বরে চেঁচিয়ে বলল,” এই কে যাবি এখনো আসছিস না কেন? নাকি গাড়ি নিয়ে একা চলে যাব? ”
হুড়মুড়িয়ে আয়শা, শবনম আর সায়রা বেরিয়ে এল। গাড়িতে উঠে বসলো। সায়রা সামিরকে শাহানার কাছে রেখে এসেছে। সাফায়াতও চালকের অপরপাশে গিয়ে বসলো। তাদের নিয়ে শেরহাম ঘোড়ার গাড়িটা নিয়ে চলে গেল মেলার উদ্দেশ্যে। সোহিনীর পালকি যেতে লাগলো তাদের পাশাপাশি।

তটিনী মলিন মুখে দাঁড়িয়ে রইলো অনেকক্ষণ । শেহজাদ তাঈফের সাথে কি যেন পরামর্শ করে অপরূপাকে তটিনীকে নিয়ে গাড়িতে উঠে বসতে বললো। তটিনী মুখ কালো করে অপরূপার সাথে গাড়িতে উঠে বসলো। হুমায়রা আলিজাকে কোলে করে নিয়ে এল। আলিজা অপরূপাকে দেখে কোলে ঝাঁপ দিল। গালে আঙুল রেখে মায়ের কোলে বসে রইলো চুপচাপ। শেহজাদ আর তাঈফ গাড়িতে উঠে বসতেই চালক গাড়ি ছেড়ে দিল। শেহজাদ জানতে চাইলো,
” ভাইজান হঠাৎ রেগে গেলেন কেন তনী? ”
তটিনী চমকে উঠলো। মিনমিন করে বলল,
” টাকা ফেরত দিয়েছি তাই। ”
শেহজাদ খানিকটা বিরক্তির সুরে বলল,
” তোমার বুঝা উচিত উনি কিসে রেগে যান। ”
” আমি বুঝতে পারিনি। ”

বিস্তীর্ণ এলাকাজুড়ে অবস্থিত স্থির, ভয়ংকর, সু-উচ্চ আকাশছোঁয়া পাহাড়ের পাদদেশে বিশাল মেলার আয়োজন। পিঁপড়ের মতো মানুষের ভীড়। ভেঁপু বাঁশির সুর, জনপদের কোলাহল, ঢাকঢোলের তীব্র শব্দদূষণ সাথে কাওয়ালী গানও চলছে ধুমচে। জয়পুরের স্থানীয় মানুষ, শিশু-কিশোর কিশোরী, যুবক-যুবতীরা, আবালবৃদ্ধবনিতা রমণী কেউই যেন বাদ পড়েনি। পাহাড়িরা তো রয়েছেই। বেশিরভাগই দোকানি পাহাড়ি মানুষ। পাহাড়ি ঐতিহ্যবাহী খাবার-দাবার, পোশাক-আশাক,তৈজসপত্র, মাটির হাড়ি-পাতিল, বাচ্চাদের খেলনা, জুতো, চাদর আরও অসংখ্য জিনিসপত্র বেচাকেনা হচ্ছে। সারিসারি দোকানের পসরা বসেছে। বাদুড়ের নাচ দেখাচ্ছে এক লোক। তাকে ঘিরে দাঁড়িয়েছে অসংখ্য ছেলেপেলে। একপাশে মোরগ লড়াই। একদিকে রয়েছে সাপুড়ে। মেলার চমৎকার আয়োজন দেখে সোহিনীর আনন্দের শেষ নেই। শেরহামের পাশে দাঁড়িয়ে সে ডালমুট খেয়েই চলেছে। তার সাথে সায়রা, শবনম, সায়রাও আছে। ওরা ডালমুট খাবে বলেছে তাই বোনদের কিনে দিয়ে সে শোহরাব আর শোইয়াবকে খুঁজে চলেছে। এত এত মানুষের মধ্যে কোথায় খুঁজবে তাদের?
দূরের ঘাট থেকে জাহাজ স্টিমারের শব্দ আসছে। শাঁ শাঁ বাতাসে পতপত করে উড়তে থাকা দোকান বাঁধা তেরপালের শব্দও। সবাই ভারী পোশাক পড়েছে। তবুও গায়ের জড়ানো শাল একজায়গায় স্থির হচ্ছে না। সোহিনী দেখলো শেহজাদ অপরূপা আর তটিনীর সাথে সাথে তাঈফও গাড়ি থেকে নামছে। তাঈফের কোলে আলিজা। আলিজার সাথে কথা বলতে বলতে এগিয়ে এল তাঈফ। হুমায়রা তাদের দেখে ছুটে এল। আয়শা বলল,

” আয় ডানামুট খা।”
হুমায়রা ডানামুট নিয়ে বলল,
” ভেতরে যাব না আয়শা বুবু? ”
” হুম যাব। বাবুদের তো কোথাও দেখতে পাচ্ছি না। সিভান ওদের কোথায় নিয়ে গেল? ”
তটিনী অপরূপা তাদের সাথে এসে যোগ দিল। শেরহাম ঘাড় ঘুরিয়ে তাকালো। তটিনী মলিন মুখে হেসে কিছু বলতে যাবে শেরহাম বিরক্ত হয়ে চলে গেল সেখান থেকে। তটিনী মুখ বাঁকালো। সোহিনী বলল,
” ভাইজানের সাথে ঝগড়া করেছ তুমি? ”
” চুপ থাক। তোর ভাইজান কোন কোন কাজে কোন কোন কথায় রাগ করে সেটা আমাকে বসে বসে এখন তালিকা করতে নিতে হবে। আর সেই তালিকা সাথে নিয়ে ঘুরতে হবে। ”
আয়শা মিনমিন করে বলল, ” বড় আপু তুই তুকারি করছো! শেহজাদ ভাইজান আর তাঈফ ভাইজান শুনতে পাচ্ছেন।

তটিনূ মুখবন্ধ করে দাঁড়িয়ে রইলো। আলিজা বাঁশির আর ঢাকঢোলের শব্দ শুনতে পেয়ে খুশিতে হাততালি দিতে দিতে শেরহামকে জোরে জোরে ডাকলো। শেরহাম শুনতে পেল না। সে আরও জোরে ডাকলো। তাঈফ শেরহামের কাছাকাছি যেতেই আলিজা কাঁধ নরম হাত দিয়ে ছুঁতেই শেরহাম চমকে উঠলো। আলিজা খিকখিক করে হেসে বলল,
” কালুআব্বা! ”
তাঈফ হেসে উঠলো। শেরহামকে বলল, ” আপনাকে অনেক ডাকছিলো। ”
শেরহাম ভুরু উঁচিয়ে বলল, ” কেন ডাকছিলে? ”
আলিজা হাত বাড়িয়ে বলল, ” কুলে। ”
বলতে বলতে সে ঝাঁপ দিল। শেরহাম তাকে কোলে নিয়ে মেলায় হারিয়ে গেল। একটা দোকানের সামনে গিয়ে থামলো। দোকানি তাকে দেখামাত্র বলল,

” সাহেব সোনামণির জন্য চুড়ি দিমু? ”
” দাও। ”
আলিজাকে হাত ভর্তি লাল চুড়ি কিনে দিল শেরহাম। ছোট্ট হাতগুলোতে পড়িয়ে দিল। বলল
” কি এগুলো? ”
” নাল নাল চুলি। ”
শেরহাম তাকে শূন্যে ছুঁড়ে আবারও খপ করে ধরে হো হো করে হেসে উঠলো। আলিজা তার গালে গাল ঠেকিয়ে খিকখিক করে হাসতে লাগলো।

মেলায় ঘুরে ঘুরে তটিনী আর অপরূপা সবাইকে নিয়ে অনেক কেনাকাটা করলো। পাহাড়িদের হাতের বানানো নানান রকম জিনিসপত্র কিনে নিল। নানানরকম মিষ্টান্ন খেল একসাথে সবাই মিলে।
আলিজা এল হাত ভর্তি চুড়ি মালাই খেতে খেতে।
শেহজাদ আর সাফায়াত দাঁড়িয়ে কথা বলছিলো। শেহজাদকে দেখে চেঁচিয়ে বলল,
” আব্বা চুলি চুলি। ”
শেহজাদ হেসে এগিয়ে এল। শেরহামের কোল থেকে নিয়ে বলল,
” কি এসব? কে দিয়েছে?”
আলিজা শেরহামকে দেখিয়ে বলল, ” ভালু আব্বা।”
শেহজাদ হাসলো। শেরহাম জিজ্ঞেস করলো, ” ওরা কোথায়? সিভানকে তো কোথাও দেখতে পেলাম না।”
” আছে হয়ত। চোখে পড়ছে না। ”
” সোহিনীরা কোথায়? ”

” ওর বসার ব্যবস্থা করে দিয়েছি। শবনমের শ্বশুরবাড়ির দু’জন লোককে দেখতে পেলাম। তাদের জন্য অপেক্ষা করছি। মনে হয় আরও কেউ এসেছে। ”
শেরহাম আশ্চর্য হয়ে ঘাড় ফিরিয়ে তাকালো। বলল, ” কি? ”
” হ্যা তাদের ব্যবসা নাকি জয়পুরেই ভালো চলে। বরং এখানে তাদের যাতায়াত বেশি। শুনলাম, ঘাটে তাদের জাহাজও আছে। ইমরানের মামাদের পৈতৃক ভিটা নাকি জয়পুরেই। তাই তো ফুপুআব্বা একটু বেশিই প্রাধান্য দিয়েছেন। তুমি কি এটা জানতে না? ”
শেরহামের চোয়াল ফুলে উঠলো। দাঁত কিড়মিড় করতে করতে জিজ্ঞেস করলো,
” ওই ইমরানও এখানে এসেছে? ”
শেহজাদ তার কথা বলার ভঙ্গিমা দেখে অবাককন্ঠে জানতে চাইলো,
” তুমি এত অস্থির হচ্ছ কেন? ”
শেরহাম গর্জে বলল,

” যেটা বলছি সেটার উত্তর দে। ওই ইমরান এখানে এসেছে? নাকি ওর চামচাগুলো? ”
শেহজাদ বলল, ” আমি জানি না। ইমরানের মামা আর উনার এক প্রতিবেশীর সাথে কথা হলো। আমাকে অপেক্ষা করতে বলে মাত্রই গেলেন। কাকে আনতে গেছেন জানিনা। ”
শেরহাম কপালে চুলকে বলল,
” সবার ঘুরাঘুরি শেষ হয়ে গেলে বাড়ি পাঠিয়ে দে। সিভানকে খুঁজে বের কর। ওরা এখানে নিরাপদ না। ”
শেহজাদ তাকে অস্থির হতে দেখে জানতে চাইলো,
” কোনো সমস্যা ভাইজান? ”
” যেটা বলছি সেটা কর। ”
শেহজাদ সাফায়াতকে বলল,
” ওদের হলে গাড়িতে তুলে দে। বাড়ি চলে যাক। সিভানকে খুঁজে পেয়েছ? ”
” হ্যা ওখানে আছে ওরা। শোইয়াব আব্বা বলে ডাক দিল তখুনি। শেহজাদ হাত নেড়ে ডাকলো। শোহরাব শোইয়াব দুজনেই দৌড়াতে দৌড়াতে এল। দুজনেই তাদের আব্বার পা জড়িয়ে ধরলো। শেরহাম শোহরাবকে কোলে তুলে নিয়ে বলল,

” কোথায় গিয়েছ খুঁজে পাচ্ছিলাম না। ”
” চাচ্চুর সাথি। ”
শেহজাদ শোইয়াবের গালে লেগে থাকা গুঁড়া মুছে দিয়ে বলল, ” কিসব খাচ্ছে আল্লাহ জানে। যান আম্মার কাছে যান। আর দৌড়াদৌড়ি নয়। সোজা বাড়ি। ”
তাদের মুখ অন্ধকার হয়ে এল। সাফায়াত নিয়ে গেল ওদের। শেরহাম সোহিনীদের কাছে গিয়ে বলল,
” তোদের হলে বাড়ি যাহ। সুহি পালকিতে উঠে পড়। সায়রা আয়শা শবনমকে নিয়ে গাড়ি যাহ। ”
সায়রা বলল, ” কিন্তু…
শেরহাম খেয়াল করলো শবনম নেই তাদের সাথে। কপাল কুঁচকে জিজ্ঞেস করলো,
” শবনম কোথায়? ”

সায়রা আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিল। শেরহাম সাথে সাথে চোখ ফেরাতেই যা দেখতে পেল তাতে সে হতভম্ব, স্তম্ভিত। ইমরানের স্পর্ধা আর সাহস দেখে সে বিস্ময়ের চরম পর্যায়ে। শবনমের সাথে কথা বলছে সে। পাশেই সোলেমান মাহমুদ দাঁড়ানো, বোরকা পড়া দু-তিনটে মহিলাও আছেন যারা শবনমের সাথে কথা বলছে। সায়রা বলল,
” ওর শ্বশুরবাড়ির লোক। ওর মামী শ্বাশুড়ি আর নিজ শ্বাশুড়ি। ”
শেরহাম সাথে সাথেই তটিনীর দিকে তাকালো। সে অসহায় চোখে চেয়ে রইলো। শেরহাম চোখ বন্ধ করে আবারও চোখ খুলে তটিনীর দিকে তাকাতেই তটিনী তার কাছে এসে মিনমিন করে বলল,
” আমি কি করব বুঝে উঠতে পারছিনা। উনারা হঠাৎ করে চলে এল। আর আমার কি মনে হচ্ছে জানো ইমরানের বাপ চাচা খারাপ কাজে লিপ্ত থাকলেও ইমরান এসব করে না। ”
শেরহাম জিজ্ঞেস করলো, ” তো? ”

তটিনী চুপসে যাওয়া মুখে বলল, ” তুমি এখন আপাতত কিছু বলোনা কাউকে। আমি শেহজাদ ভাইকে বলব সবটা। ”
” কেন? শেহজাদকে বলতে হবে কেন? আমি আমার ঝামেলা ওর উপর চাপাতে যাব কেন? যা আমার জন্য হচ্ছে তা আমি একাই সামলে নেব। ওদের কিভাবে শায়েস্তা করতে হয় আমার বেশ ভালো করেই জানা আছে। ”
শবনমের ইশারায় তটিনী সবাইকে নিয়ে শবনমের কাছে গেল। ইমরানের মা, মামীর সাথে সবাইকে পরিচয় করিয়ে দিল শবনম। তটিনীকে দেখিয়ে বলল,

“ইনি আমার বড় আপু। আর উনারা দুজন ভাইজানদের বেগম। আর এরা বোন। আমার ভাইজানরা ওখানে। ”
ইমরানের মায়ের সাথে তটিনীর অনেক কথা হলো। তটিনীর একমুহূর্তের জন্য মনে হলো না মহিলা কোনোকিছু মিথ্যে বলছেন। বাতাসে সবার পড়নের পোশাক উড়ছে। শীত লাগছে বেশ। শীতের মধ্যে দাঁড়িয়ে তটিনী অপরূপা কথা বলতে লাগলো মহিলাগুলোর সাথে। ইমরান শবনমকে বলল,
” আমরা সামনে এগোই? উনারা কথা বলুক। ”
শবনম মৃদুস্বরে জবাব দিল, ” জ্বি। ”
ইমরান হাঁটতে হাঁটতে জানতে চাইলো, ” একটা কথা বলব, যদি কিছু মনে না করেন। ”

” জ্বি, বলুন। ”
” আমার খারাপ অতীত জেনেও কি আপনি আমাকে নিকাহ করতে রাজী হবেন? ”
শবনম থমকে দাঁড়ালো। তাকে এভাবে থমকাতে দেখে ইমরান হেসে উঠলো। হাসতে হাসতে বলল,
” ভয় পাবেন না। মজা করলাম। ”
” এরকম মজা করবেন না। ”
” দুঃখীত। আর কখনো করব না। আপনি দেখছি সত্যি সত্যি ভয় পেয়ে গেলেন। আরেকটা প্রশ্ন করব?”
” জ্বি। ”
” আপনার কোনো পছন্দের মানুষ ছিল? ”

প্রিয় বেগম সিজন ৩ পর্ব ৯+১০

শবনম অনেক বড় একটা দীর্ঘশ্বাস লুকিয়ে বলল, ” কি যে বলেন। ”
তার এবার শীত করছে বাতাসে। দু’হাতে নিজের দুবাহু গুটিয়ে নিয়ে বলল,
” ঘাটের দিকে কেন যাচ্ছি? চলুন ফিরে যাই। এখানে বড্ড শীত। ”
” জ্বি চলুন। ”

প্রিয় বেগম সিজন ৩ পর্ব 1১৩+১৪