প্রিয় বেগম সিজন ৩ পর্ব ১৩+১৪

প্রিয় বেগম সিজন ৩ পর্ব ১৩+১৪
পুষ্পিতা প্রিমা

কয়জনকে তুলে নিয়ে যাওয়া হয়েছে তার হিসেব পুরোপুরি পাওয়া যায়নি এখনো। তবে গোলাগুলি কমে আসতেই শেহজাদ আর সাফায়াত জানতে পারলো প্রায় সাত আটজনের মতো মেয়েকে অপহরণ করা হয়েছে। যদিও সেটা আনুমানিক।
জাহাজের ডাক পাঠানো হয়েছে। এখনো অব্দি ঘাটে জাহাজ এসে পৌঁছায়নি বিধায় তারা কেউই রওনা দিতে পারেনি। শুধু নৌকায় করে জাহাজটার পিছু নিয়েছিল কিন্তু জাহাজটা অনেক আগেই নিরুদ্দেশ। শেরহাম আর শেহজাদ ফিরে এসেছে। জাহাজের অপেক্ষায় ঘাটের কাছাকাছি দাঁড়িয়ে আছে।
শেরহামের মেজাজ তুঙ্গে। শেহজাদকে কোনো কথাই বলতে দিচ্ছে না সে, না তটিনীকে। তার কথার অমান্য করেছে, এটা তো হওয়ারই ছিল।

তটিনী ঘাট থেকে কিছুটা দূরে দাঁড়িয়ে আছে। সে অনুশোচনায় দগ্ধ হচ্ছে, তার উচিত ছিল অন্তত শবনমকে হুশিয়ারি দেয়ার। সে সাবধানে থাকতো। শেরহামের কথাগুলোকে আমলে না নিয়ে আজ এত বড় বিপদে পড়তে হলো তাদের। সে কিছু ভাবতে পারছেনা এখন। ভুল, ঠিক বিচার করার অবস্থায় নেই। শুধু চিন্তা হচ্ছে শবনমকে নিয়ে। তাকে কোথায় নিয়ে যাওয়া হয়েছে। কিভাবে তাকে উদ্ধার করবে? নিজের ভুলের জন্য কপাল ঠুকতে ইচ্ছে করছে তার। সোহিনীকে পালকিতে করে পাঠিয়ে দেয়া হয়েছে। বাচ্চাদের পাঠিয়ে দেয়া হয়েছে বাড়িতে অপরূপার সাথে। বাচ্চাদের সে ভালোমতো নিয়ে যেতে পারবে। তারা বাড়িতে পৌঁছামাত্রই শাহানা সবটা শোনার পর কান্নাজুড়ে দিয়েছে।

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

তটিনীর পাশে সোলেমান মাহমুদ স্থবির হয়ে বসে রয়েছেন। মুখে কথা নেই। উনি তখনই আকাশ থেকে পড়লেন যখন শেহজাদ জানালো এইসব কিছুর পেছনে ইমরানের হাত আছে। কারণ ইমরানের একটা লোকও উপস্থিত নেই তারপর থেকে। না লোকগুলো, না মহিলাগুলো। সবকিছুই তার নিখুঁত পরিকল্পনা। কিন্তু কেন শবনমকে তুলে নিয়ে গিয়েছে, কি তার ধান্ধা কিছুই আপাতত বুঝতে পারছেনা কেউ। আয়শা সোলেমান মাহমুদের কাঁধে মাথা রেখে বসে আছে। জাহাজের অপেক্ষায় দাঁড়িয়ে সবাই। সুলতান মহলে থাকলে আজ এতটা বিপর্যয়ের মধ্যে যেতে হতো না তাদের । জাহাজ পৌঁছুতে বিলম্ব হওয়ায় শেরহাম আরও বিরক্ত। তটিনী গুটিগুটি পায়ে হেঁটে তার পেছনে গিয়ে দাঁড়ালো। জিজ্ঞেস করলো,

” নৌকা নিয়ে যাও। এতক্ষণ তো অনেক দূর অব্দি যেতে পারতে। ”
শেরহাম তার দিকে ফেরামাত্র খ্যাঁক করে উঠে বলল,
” তুই আমাকে বলবি কি করতে হবে না করতে হবে? এখন কাঁদছিস কেন? ওকে মেরে ফেলেছি বলে কত নাটক করলি, এখন কর ওইসব নাটক। এখন কাঁদছিস কেন? ”
শেহজাদ বলল, ” ভাইজান ওর উপর কেন রাগ দেখাচ্ছ? ওর উপর রাগ দেখিয়ে কি হবে? ”
” তুই চুপ থাক। সবাই মিলে আমাকে জ্ঞান দিচ্ছিলি না ওই কু***ত্তার বাচ্চার হয়ে। এখন কোথায় গেল তোদের মাতব্বরি? আর তোর বাপ এখন চুপ করে বসে আছে কেন? যাহ মেয়েকে তুলে দিতে বল ওই জানোয়ারের হাতে। ”
তটিনী বলল, ” আব্বা শুনতে পাচ্ছেন। ”

” শুনুক। ”
সাফায়াত বলল, ” তনী তুমি যাও এখান থেকে। ”
তটিনী গাল মুছে বলল, ” জাহাজ এখনো আসছে না কেন ভাইজান? দেরী হয়ে যাচ্ছে। ”
শেরহাম বলল, ” সেটা আমরা কি করে জানবো? তোর বোনকে তুই সতর্ক করতে পারিসনি? তোকে আগে বলিনি আমি? এসেছে এখন নাটক করতে। যাহ আমার সামনে থেকে। যা। ”
তটিনী কেঁপে উঠলো তার গর্জনে। সাফায়াত বলল,
” তনী তুমি যাও না এখান থেকে। ”
তটিনী সোলেমান মাহমুদের দিকে একপলক তাকালো। উনি চেঁচামেচি শুনে উঠে দাঁড়িয়েছেন। তটিনী ছুটে গিয়ে উনাকে ধরে বললেন,

” আব্বা আপনি এত চিন্তা করবেন না। শবনমের কিচ্ছু হবে না। ”
উনি তটিনীর হাত থেকে নিজেকে ছাড়িয়ে শেরহামের দিকে এগিয়ে এলেন। শেরহাম কঠিন মুখে অন্যদিকে চেয়ে আছে। শেহজাদ একপলক শেরহামের দিকে তাকালো। সোলেমান মাহমুদকে কিছু বলতে যাওয়ার পূর্বেই উনি হাত দেখিয়ে থামিয়ে দিয়ে বললেন,
” শত্রুতা তোমার সাথে। তাই তুমি শবনমকে ফিরিয়ে আনবে। সব দায় তোমার। তোমার কারণে হয়েছে সব। তুমি সব জানার পরও কেন কাউকে কিছু জানাওনি? আমার মেয়েদের জীবন নিয়ে ছিনিমিনি খেলতে তোমার ভালো লাগে? একজনের জীবনটা ছারখার করেছ, ঠকিয়ে নিকাহ করেছ, এখন আরেকজনের জীবনে একটা জানোয়ারকে লেলিয়ে দিয়ে এখন সাধু সাজছো? ”
শেরহাম ঘাড় ফিরিয়ে চাইলো চোখা দৃষ্টিতে। তটিনীর দিকে চরম ক্ষোভ নিয়ে তাকালো তারপরই। তটিনী সাথে সাথেই বলল,

” আমাকে বলেছে আব্বা। দোষ আমার। আমি বলিনি কাউকে। ও আমাকে সবাইকে বলতে বলেছে। ”
সোলেমান মাহমুদ ধমক দিয়ে বলল,
” সাফাই গেয়ো না ওর হয়ে। ভেবে দেখো কেন এই বিপদটা এল। কার জন্য এল? শবনমের কিছু হলে আমি ক্ষমা করব না তোমাকে, না তোমার বরকে। ”
তটিনী কাঁদতে লাগলো। শেরহামের হাতের মুঠো শক্ত হয়ে এল। শেহজাদ বলল,
” ভাইজান আমাকেও বলেছে। আমি..
” আমি তোমার মুখ থেকে তোমার ভাইজানের কোনো গুনগান শুনতে চাইনা শেহজাদ। ”
সাফায়াত বলল, ” আব্বা দোষ তো তনীর। সে কেন কাউকে কিছু বলেনি? তোমার তো ভাইজানের উপর বিশ্বাস রেখে আমাদের জানানো উচিত ছিল তনী। তুমি কি অবুঝ নাকি পাত্তা দাওনি? ”
তটিনী বলল, ” আমি ভাবতে পারিনি বিষয়টা এত জটিল হয়ে যাবে। আমি দুঃখীত ভাইজান। ”
শেরহাম বলল,

” এই চুপ। তুই আমার সামনে থেকে যাহ। একদম ন্যাকা কান্না কাঁদবি না। যেতে বলেছি। ”
সায়রা এসে তটিনীকে নিয়ে গেল। তাঈফ তখুনি বলল,
” ভাইজান জাহাজ আসছে। ওই দেখুন। ”
শেহজাদ বড়সড় একটা দম ফেলে বলল,
” ফুপুআব্বা আপনি তনীদের নিয়ে চলে যান বাড়িতে। আমরা যাচ্ছি। শবনমকে নিয়েই ফিরবো। জাহাজে উঠতে পারলে পলাশপুরে পৌঁছুতে দেরী হবে না। যেতে যেতে নিশ্চয়ই কোনো না কোনো নিশানা পেয়ে যাব যে জাহাজটা কোথায় গিয়ে থেমেছে। আপনারা চিন্তা করবেন না। আমরা সবাই একসাথে ফিরবো। এখন যান। সায়রা শুনতে পেয়েছ কি বলেছি। ”
সায়রা মাথা দুলিয়ে বলল, ” জ্বি ভাইজান। আপু এসো। ”
তটিনী কাঁদতে লাগলো শেরহামের শক্ত করে রাখা মুখের দিকে চেয়ে। তারজন্য মানুষটাকে এত কথা শুনতে হলো।

ভয় কাটিয়ে শবনম নিজের মনোবল শক্ত করলো যখন দেখলো তাদের অপহরণ করা লোকগুলো নিজেরাই বিপদে পড়ে এই চরের উপর আশ্রয় নিয়েছে। এখন তারা কোথায় যাবো তার কোনো হদিস নেই সেখানে বন্দিদের নিয়ে তাদের অবস্থা কাহিল। অদূরেই যে ভাঙা জাহাজটি আছে সেটি বেশ পুরোনো। মনে হয় সেটি ডুবতে ডুবতে এই তীরে এসে আটকেছে আর এখানাকার মানুষ সেই ভাঙা জাহাজ থেকে তাদের প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র যন্ত্রপাতি উদ্ধার করে অপ্রয়োজনীয় অংশটুকু ফেলে রেখে গেছে। বর্ষা এলে চর ডুবে যাবে সাথে এই ভাঙা অংশখানিও। তারা যে জাহাজে করে এসেছে সেটিও কিছুদূরে একজায়গায় থেমে আছে। শবনম তাদের কথা শুনে যতটুকু আন্দাজ করতে পারলো তা হচ্ছে জাহাজটাতে যান্ত্রিক ত্রুটি দেখা দিয়েছে।

রশির শক্ত বাঁধনে ঘষা লেগে শবনমের হাত পা ছিঁড়ে গিয়েছে। সেখানে প্রচন্ড জ্বলুনি অনুভব হচ্ছে। নিজের অজান্তেই চোখ বেয়ে জল গড়াচ্ছে তার। জীবনে এই প্রথম এমন ভয়ানক পরিস্থিতির সাথে তার পরিচয়। কি অদ্ভুত মায়াদয়াহীন মানুষ এরা! এদের বাড়িতে কি মা বোন স্ত্রী মেয়ে সন্তান নেই? কেমন জানোয়ারের মতো ব্যবহার! শবনমের চিন্তা হলো বাড়ির সবার জন্য। আম্মা আব্বা ভাইজানরা নিশ্চয়ই তার চিন্তায় পাগলপারা! নিশ্চয়ই তাকে পাগলের মতো খুঁজে চলেছে। কিন্তু এখানে তারা কি করে আসবে? মুখোশ পরিহিত একজন বলছিলো, তারা যে এখানে আটকা পড়েছে তা তাদের দলবলকে জানানোর কোনো উপায় নেই।
শবনমের হঠাৎ খেয়াল হলো ইমরানের কথা। ইমরান তার সাথেই ছিল, কিন্তু গোলাগুলি শুরু হওয়ার পর তাকে আর দেখেনি সে। তারমানে সে বন্দি হয়নি। শবনমের মাথায় কিছু কাজ করছেনা। ওরা চাইছেটা কি? পাশাপাশি দুটি জাহাজ ছিল। নিশ্চয়ই পরের জাহাজটিতে ইমরানও বন্দি হয়েছে!
শবনমের পাশের মেয়েগুলো শবনমের ছোট। তারা মোট ছয়জন। একজনের মুখের পট্টি সরে যাওয়ায় মেয়েটা শব্দ করে কাঁদছে। মুখোশপড়া লোকগুলো তাকে ধমকাচ্ছে। মেয়েটা তারপরও কেঁদে যাচ্ছে। একজন এসে মুখের দু’পাশে চেপে ধরে বলল,

” আর চেঁচাইলে শ্যাষ কইরা দিমু এখন। চুপ কর মাতারি। ”
মেয়েটা তার মুখ থুতু মেরে বলল,
” গোলামের বাচ্চা হাত খুলে দে। কে কারে শেষ করে দেখি। দূর হ জারজের বাচ্চা। ”
লোকটা সাথে সাথে লাথি মারতে লাগলো মেয়েটাকে। মেয়েটা উল্টেপাল্টে গড়িয়ে পড়লো কিছুদূর। মেয়েটার বুক বরাবর লাথি মারতেই শবনম সহ্য করতে না পেরে চিৎকার দিয়ে উঠলো। বলল,
” ছেড়ে দাও ওকে। আল্লাহর কছম তোমরা এর ভয়ানক শাস্তি পাবে। ওরে আর মেরোনা। ”
লোকটা আরও একটা লাথি বসিয়ে সরে এল। অন্য লোকগুলোকে বলল,
” এইখানে বেশিক্ষণ থাকা যাইবো না এদের নিয়া। আমাগো এইখান থেকে যাওয়ার পথ নাই। ওরা খোঁজও পাইবো না। জাহাজও আইবো না এইদিকে। এখানকার মাইনষ্যে এদের এভাবে দেখলে জানে মাইরা ফ্যালাইবো আমাদের। ”
অন্যজন বলে উঠলো, ” তা কি করবি? এত্তগুলান মাইনষ্যে যামু কই এহন? ডিঙি নৌকা নিয়াও তো যাওয়া যাইবো না। যা ঢেউ মারতাছে। সবাই ডুইব্যা মরুম। ”

একে অপরের সাথে শলাপরামর্শ করতে লাগলো তারা। শবনম আল্লাহকে ডাকতে লাগলো। দস্যুরা একে অপরের সাথে শলাপরামর্শ করে শেষমেশ সিদ্ধান্ত নিল এই মেয়েগুলোকে তারা ছেড়ে দেবে। যেখানে পালায় পালাক অন্তত এখানকার মানুষের হাতের পিটুনি থেকে তো তারা বাঁচবে। সিদ্ধান্ত নিতে দেরী কিন্তু সবার হাত পা মুখ খুলতে দেরী নেই। যে মেয়েটাকে মেরেছে সেই মেয়েটার হাত খোলামাত্রই মেয়েটি দুঃসাহসিক এক কাজ করে বসলো। বন্দুক কেড়ে নিয়ে তাকে লাথি মারা লোকটার মাথায় দিল জোরে এক বাড়ি। উপস্থিত সকলেই হতভম্ব। মাথায় হাত দিয়ে লুটিয়ে পড়লো লোকটি। রক্তে ভেসে গেল সাদা চরের বালিমাটি। মশালের আলোয় মেয়েটির কৃষ্ণবর্ণ গায়ের রঙ আর চোখগুলো ভয়ংকর লাগছিলো। লোকগুলো তার দিকে তেড়ে আসার পূর্বেই মেয়েটি প্রাণপণে বন্দুক বাড়িয়ে বলল,

” একদম এগোবি না কেউ। পিছু যাহ। ”
লোকগুলো সব পিছু হটলো। মেয়েটির সাহসীকতায় অবাক তারা। মেয়েটি একটা মশাল তুলে শবনমের দিকে ছুঁড়ে দিয়ে বলল,
” তোমরা সবাই পালাও। যাও। এই তোরা এক পাও নড়বি না। ”
শবনম জ্বলন্ত মশালটা ধরে অন্য মেয়েগুলোকে নিয়ে দৌড়াতে লাগলো। যতই দৌড়াচ্ছে ততই মনে হচ্ছে তারা উপরে উঠছে। তারমানে চরটা অনেক নীচে। আর উপরেই কোনো লোকালয় থাকতে পারে। তারা সবাই দৌড়াতে লাগলো একসাথে। পেছন পেছন মেয়েটাও এল। মেয়েটির হাতে বন্দুটকটি আছে। শবনম তাকে দেখে হাসলো। মেয়েটি তাদের নিকট পৌঁছাতেই শবনম তাকে ঝাপটে জড়িয়ে ধরলো। কেন ধরলো সে জানে না। জিজ্ঞেস করলো, ” কি নাম তোমার? ”

মেয়েটি উত্তর দিল। ” আমার নাম ময়না। মেলা দেখতে আইছিলাম মারে নিয়া। এই হালারা আমারে তুইলা আনছে। কুত্তার বাচ্চাগোরে আধমরা বানায় আইছি। কয়ডা পালায়ছে। আমাগোরে সাবধানে থাকতে হইবো। হেতারা এইখানেই থাকবো যতদিন না জাহাজ আসে।”
শবনম বলল, ” হ্যা। চলো, আমরা আর কিছুদূর যায়। ওই যে পাড় দেখা যায়। নিশ্চয়ই লোকালয় থাকবে। সাহায্য চাইলে সাহায্য পেতেও পারি। তোমরা ঠিক আছো? ”
মেয়ে চারজন জবাব দিল। ” হ ভালা আছি। ”

বালিমাটি কামড়ে হেঁটে হেঁটে পাড়ে উঠে গেল তারা। ভয় কাটার বদৌলতে ভয় ঝেঁকে ধরলো তাদের। দু’পাশে কাশফুলের মতো লম্বা ঘাসপাতার বন। আর মাঝখান দিয়ে সরু একটা সাদা মাটির রাস্তা। খোলা আকাশের নীচে মুক্তদানার মতো ছড়িয়ে আছে চাঁদের কিরণ। ঝিঁঝিঁ পোকার ডাক, রাতের নৈঃশব্দ্য আর এমন সুনসান নীরব পরিবেশ দেখে মনে হলো বন্দি অবস্থায় চরের বালিতে শুয়ে রাত পার করে দেয়াটা এর চাইতে সহজ ছিল। শবনম পাড়ে উঠে দাঁড়ালো। ক্ষেতের মাঠ যেখানে শেষ ততোদূর অব্দি চোখ রেখে বলল,
” নিশ্চয়ই ওখানে বাড়িঘর আছে। চলো যাই? ”
ময়না বলল, ” বুবু মনে হইতাছে এইখানে কোনো বাড়িঘরও নাই। ”
শবনম ভয় পেয়ে গেল। জিজ্ঞেস করলো,

” যাহ কি বলো? ”
” হ এইরহম লাগতাছে বুবু। ”
শবনম বলল, ” তুমি তো সাহসী মেয়ে। তোমার কি ভয় করছে যেতে? ”
সাহসী মেয়ের তকমা মেখে ময়না দ্বিগুণ সাহসের সাথে জবাব দিল।
” আল্লাহ আছেন। চলেন যাই। ”
একটা মেয়ে জানতে চাইলো, ” যদি কোনো বাড়িঘর না থাকে এখানে তখন কি করব বুবু? ”

শবনম উত্তর দিতে পারলো না। সে ভয়েভয়ে পা বাড়ালো শুধু। হঠাৎই দমকা বাতাসে মশালের আগুন নিভে গেল। চাঁদের আলো ছাড়া তাদের আর কোনো সম্বল রইলো না। শবনমের ভয় করলেও সে আল্লাহকে স্মরণ করতে করতে সবাইকে নিয়ে সাদা মাটির আইল ধরে হাঁটতে শুরু করলো। কিছুদূর যেতে না যেতেই দেখতে পেল সেই আইল ধরে হেঁটে আসছে কালো হলুদ ডোরাকাটা এক চিতাবাঘ। সকলেই আঁতকে উঠতেই শবনম হাত দিয়ে নিজের মুখ চেপে ধরলো। বাঘটি ততক্ষণে এদিকওদিক চাইছে। চাঁদের আলোয় পথ ধরে হাঁটতে থাকা শবনম আর তার বাকিরা দেখতে পেল বাঘটি তাদের দিকে চেয়ে আছে, আর হিংস্র চোখদুটো জ্বলজ্বল করছে। বাঘটি দ্রুত ছুটে এল। সকলেই আইল হতে ছিটকে পড়লো। যে যেদিকে পারলো ছুটতে শুরু করলো শুকিয়ে আসা কাশবনের ভেতর দিয়ে।

শবনমের কাছেপাশে কেউই নেই। মেয়েগুলো কোথায় চলে গিয়েছে সে জানে না। প্রাণ নিয়ে ছুটতে ছুটতো শবনমের মুখ হাত পা সব ছিঁড়ে জ্বলুনি হচ্ছে এবার। মুখে হাত দিয়ে বুঝতো পারলো মুখটা ছিঁড়ে রক্ত ঝড়ছে ধারালো বাঁশপাতার আঁচড়ে। বাঘের গর্জন যতক্ষণ শোনা গেল শবনম ততক্ষণে ছুটলো অচেনা, অজানা গন্তব্যে। কেউই নেই তার আশপাশে। একটা সময় সে আরও একটি আইল খুঁজে পেল। সেই আইল ধরে হাঁটতে হাঁটতে দেখা পেল কয়েকটা তাল গাছের। ততক্ষণে তার নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে আসার উপক্রম। তালগাছটি ধরে দাঁড়িয়ে একনাগাড়ে জোরেশোরে শ্বাস নিতে নিতে কেঁদে উঠলো হঠাৎ। কোথায় যাবে সে এখন? তালগাছের সাথে হেলান দিয়ে বসে পড়লো সে। ওরা সবাই কোথায়? তাদের সাথে কি দেখা হবে না? কোথায় তারা? তালগাছের সাথে চোখ বুঁজে বসো রইলো সে। ভয়ো তার প্রাণ যায় যায় অবস্থা। দূরে কোথাও করুণ সুরে হুতুমপেঁচা ডাকছে। অসহনীয় তীব্র জ্বলুনির কারণে শবনম দু-হাত নিজের মুখে রাখলো।

আর হাত দুটো মুখ নামিয়ে চোখের সামনে রাখতেই রক্ত দেখে বমি পেয়ে গেল তার। কাঁদতে কাঁদতো দাঁড়িয়ে পড়লো সে। পেছনে ফিরে তাকালো। মেয়েগুলোর কোনো খবর নেই। আপাতত লোকালয় খুঁজে নিতে হবে তাকে। তারপর সবাইকে খুঁজে বের করবে সে। তেষ্টায় গলা ফেটে যাচ্ছে তার। পানি না পেলে সে মরে যাবে। পানি পানি আওড়াতে আওড়াতে হঠাৎ টের পেল ওইতো দূরের পাহাড়। কত বিশাল, সুউচ্চ পর্বত বুক ফুলিয়ে দাঁড়িয়ে ভয় দেখাচ্ছে তাকে। রাতের ঝিমঝিম শব্দ ভেসে আসে শবনমের কানে। কি ভয়ানক এক পরিবেশ। কেউ নেই তার পাশে। বাড়ির সবার কথা ভেবে শবনমের বুক ছিঁড়ে কান্না এল। কান্না আটকে সে আল্লাহকে ডাকতে লাগলো। তালগাছ ছেড়ে সে তারপরের বিলে নেমে গেল। বিলটি পার হতেই আবারও উঁচুনিচু একটা জায়গায় উঠে পড়লো। পায়ের নীচে বড়বড় সবুজ ঘাস।

বারকয়েক হোঁচট খেয়েও পড়লো শবনম। লোকালয়ের কোনো আভাস পেল না সে। কোথা হতে যেন শেয়াল ডাকছে। শবনমের গায়ে কাঁটা দিল। উঁচুনিচু একটা ঢালু জায়গায় গিয়ে সে ক্লান্ত হয়ে বসে পড়লো। ভাবলো, এখানে বসো রাতটা কাটিয়ে দেয়া যাবে? সকাল হতে হতো নিশ্চয়ই ময়নাদের দেখা পেয়ে যাবে সে। তারা নিশ্চয়ই কোনো ঝোপঝাড়ের পেছনে লুকিয়ে আছে? শবনম মাথা হেলিয়ে বসে পড়লো। কিন্তু চোখ বুঁজার সাথে সাথেই শেয়ালের ডাক আরও জোরালো হয়ে কানে এসে ধাক্কা খেল। ধড়ফড়িয়ে উঠে পড়লো শবনম। প্রাণের মায়ায় আবার ছোটার জন্য প্রস্তুত হয়ে উঁচু একটা ঢিবির উপর উঠে দাঁড়াতেই হঠাৎ দেখতে পেল পাহাড়ের পাদদেশে কয়েকটা তাঁবু টাঙানো। সেখানে মিটমিট করে আলো জ্বলছে। তারমানে ওখানে নিশ্চয়ই কেউ থাকে? সে আর দেরী করলো না। ছুটতে লাগলো আশপাশ না তাকিয়ে। তাঁবুর কাছাকাছি যেতেই হঠাৎ থেমে গেল এই ভেবে ” তারা জংলী নয়ত? জংলী হলে তো তার বেঁচে ফেরা অসম্ভব। না তাকে বাঁচতে হবে। ”

সে ফিরে আসার জন্য পা বাড়ালো। তাকে কোথায়ও গা ঢাকা দিয়ে থাকতে হবো সকাল অব্দি। দিনের আলোয় সে অনেক পথ খুঁজে নেবে। তাকে বাঁচতেই হবে। কিন্তু পা বাড়াতেই কয়েকটা গলার স্বর একসাথে শুনতে পেল সে। অল্পবয়সী কিছু ছেলেপেলে বন্দুক তাক করতেই শবনম হাতজোড় করে বসে পড়লো নীচে। বলল,
” আমি আশ্রয় চাইতো এসেছি। মেরো না। ”
ছেলেপেলেগুলো কোনো কথাও বলল না। শবনমের দিকে বন্দুক তাক করে শবনমকে তাঁবুর কাছে নিয়ে গেল ঠেলতে ঠেলতে। শবনম তাঁবুর কাছাকাছি যেতেই দেখলো কাঠের আগুন জ্বলছে তাঁবুর পাশে। একপাশে আস্ত হরিণ থেকে চামড়া ছাড়ানো হচ্ছে। শবনম বলল,

” আমাকে ছেড়ে দাও। আমি তোমাদের ক্ষতি করতে আসিনি। ”
তাঁবুর ভেতরে আরও অনেকগুলো গলার স্বর অস্পষ্ট ভেসে আসছে। ছেলেপেলেগুলি তাঁবুতে গিয়ে কি যেন বলাবলি করছিলো। শবনম দেখলো তার দিকে তেমন মনোযোগ নেই। তাই সে পালিয়ে যাচ্ছিলো। কিন্তু তার পূর্বেই তার কানে এল কয়েকটা লোকের হাসির শব্দ। কোনো একটা কারণ নিয়ে তারা একসাথে হো হো করে হেসে চলেছে। ছেলেপেলেগুলোও হাসতে হাসতে তাঁবুর ভেতর থেকে বের হলো। শবনমের দিকে বন্দুক তাক করতেই শবনম ঢলে পড়লো গুলির বিকট শব্দে। চোখ দুটো খুলে রাখার আপ্রাণ চেষ্টা করছিলো শবনম। আর সেই চেষ্টার ফলসরূপ সে দেখতে পেল অদূরে দাঁড়িয়ে তামাশা দেখছে দুইজন বলিষ্ঠ দেহের পুরুষ মানুষ। তারা কৌতূহলী হয়ে এগিয়ে আসতে লাগলো।

পলাশপুরে ঘাটে শুধুমাত্র একটা জাহাজ থেমেছে। আর সেই জাহাজটা ইমরানের। শেরহাম, শেহজাদ জাহাজটা আটক করে ফেললো। জাহাজে ইমরানকে পাওয়া যায়নি। না তার দলবল কাউকে। সে ইমরানের বাড়ি চেনে। সেখানে যাওয়ার পূর্বে সবখানে তল্লাশি করলো। কোনো জাহাজেই শবনমদের খোঁজ পাওয়া গেল না। বহুকষ্টে ইমরানের জাহাজ চালককে আটক করতেই সে জানালো ইমরানের ষড়যন্ত্রে মেয়েগুলোকে আটক করা হয়েছে ঠিক কিন্তু যেই জাহাজটিতে মেয়েগুলি ছিল সেই জাহাজটি ভুলপথে চলে গিয়েছে। আর জাহাজটির হদিস পাওয়া যায়নি এখনো অব্দি। ইমরান কোনো খোঁজ না পেয়ে গা ঢাকা দিয়েছে। জাহাজটি এখন কোথায় কেউ জানে না।
সাফায়াত মুখ চেপে ধরে ধপ করে বসে পড়লো। তাঈফ বলল, ” এভাবে ভেঙে পড়বেন না ভাইয়া। আল্লাহ শবনমের সহায় হবেন। ”

সাফায়াত বলল, ” ও সহজ-সরল ভীতু। কখনো একা কোথাও যায়নি। ”
শেহজাদ তার কাঁধে হাত রেখে বলল, ” সহজ-সরল কিন্তু শবনম আত্মরক্ষার জানে। আল্লাহর উপর ভরসা রাখো সাফায়াত। ভেঙে পড়লে চলবে না। আমরা সব জায়গায় যাব।
শেরহাম বলল, ” তোরা সব ঘাটে ঘাটে গিয়ে জিজ্ঞেস কর। আমি আসছি। ”
শেহজাদ বলল, ” তুমি কোথায় যাচ্ছ?”
” হিসেবনিকেশ আছে। জানে মারবো এবার ওই হারামির বাচ্চাকে। ”
শেহজাদ বলল, কিন্তু এখন আমাদের..
” শবনমকে নিয়েই ফিরবো আমি। ”
শেহজাদ আর কিচ্ছু বললো না। শেরহাম চলে গেল।
এদিকে শবনমের মুখের উপর ঠান্ডা পানি ছিটাতে থাকা লোকটার উপর ভীষণ বিতৃষ্ণা নিয়ে চোখ খুললো শবনম। চোখ খোলামাত্রই যুবকটা হেসে বলে উঠলো,

” চোখ খুলেছেন এতক্ষণে। জনাবা মাহমুদা আপনি একা এই ভিনদেশে কি করে এসে পড়লেন ? ”
শবনম অবাককর সজলনেত্রে চেয়ে রইলো, কান্নাজড়ানো কম্পিত কন্ঠে জানতে চাইলো, ” কে আপনি?”
….
শবনম এতক্ষণে খেয়াল করলো, যে অল্পবয়সী ছেলেপেলেগুলো দেখা গেছে তারা উনুনের পাশে গোল হয়ে বসে আছে। উনুনে শুকনো কাঠখড় ছুঁড়ে ফেলছে। বাতাসে হরিণের তরতাজা মাংসের ঘ্রাণ। উনুনের বিপরীত পাশে বসে কেউ একজন মাংস কেটে যাচ্ছে একনাগাড়ে। খটাখট শব্দ আসছে সেখান থেকে। শবনম লোকটার চেহারা দেখতে পেল না, তবে আগুনের ছ’টায় মুখের একটাপাশ দেখা গেল শুধু। তাতে কিছু বুঝার জোঁ নেই। তার সম্মুখে হাঁটুভেঙ্গে বসা লোকটা শবনমের মুখ থেকে টুকিটাকি অনেক কথা শুনলো। কুটিল হেসে বলল,
” আপনি তো একা আসেননি, সঙ্গে দস্যুদেরও নিয়ে এসেছেন। যাইহোক আমি কাশিফ।আপনার নাম নিশ্চয়ই শবনম মাহমুদা? ”

শবনম ক্ষীণ স্বরে আওয়াজ করলো।
” আপনি আমাকে কিভাবে চেনেন? ”
কাশিফ বলল,
” ওই যে ওখানে কসাই আছে, উনি আপনাকে চেনেন। ”
” কে উনি? ”
” দেখলেই চিনতে পারবেন। ”
শবনম বলল, ” আমার সাথে যে মেয়েগুলি ছিল ওদের একটু খোঁজ নিন। ওরা ছোট। দয়া করে আমাকে আমার বাড়িতে পাঠানোর ব্যবস্থা করে দিন। ”
বলতে বলতে ফোঁপাতে লাগলো সে। কাশিফ তার মুখের অবস্থা দেখে বলল,
” শান্ত হোন। দেখুন আমরা নিজেরাই এখানে আটকে আছি এই ভূতের দ্বীপে। ”
” ভূত! ”

শবনমকে অবিশ্বাস্য দৃষ্টিতে জিজ্ঞাসা করতে দেখে কাশিফ হো হো করে হেসে উঠে বলল,
” তার চাইতেও ভয়ংকর বলা যেতে পারে। জন্তু-জানোয়ারের বাসস্থানে মানুষ বসবাস করা কি চাট্টিখানি কথা? যাইহোক সে কথা পরে হবে। এখন আপনি উঠুন। চলুন হাতমুখ ধুয়েমুছে ঔষধ লাগাবেন। কষ্ট হলেও উঠুন। তারপর দেখি কি করা যায়। ”
শবনমের মনে হাজারো প্রশ্ন কিন্তু সে প্রশ্নগুলো জানতে চাইবে এরূপ অবস্থায় নেই। জলাধারের পানি নিয়ে মুখ ধোয়ার সাথে সাথে তীব্র জ্বলুনির চোটে শবনমের পাগল পাগল লাগলো। কি অসহনীয় যন্ত্রণা। গাল বেয়ে গরম জল গড়ালো যন্ত্রণায়। পায়ের আঙুল পর্যন্ত টনটন করছে ব্যাথায়। মুখে পানি ছিঁটে দেয়ার পর সে স্পষ্ট দেখতে পেল কয়েকটা বড়বড় আয়তকার আকারের পাথর সারি সারি সাজিয়ে তারপর লোহার রড আড়াআড়ি ভাবে রেখে নীচে আগুন জ্বালিয়ে দিয়েছে। আর তার উপর কি কতকগুলি পোড়া হচ্ছে। দেখে মনে হচ্ছে ভুট্টা। শবনম জলাধারের পাশে দাঁড়িয়ে রইলো। কাশিফ একটা শুকনো কাপড় বাড়িয়ে দিয়ে বলল,

” মুখ মুছে নিন। ঔষধ লাগালে ক্ষত শুকিয়ে যাবে আশা করছি। ”
শবনম ধীরেধীরে বহুকষ্টে মুখটা মুছে নিল। কাশিফ বলল,
” দেখুন তো তাকে চিনতে পারেন কিনা। ”
শবনম বলল, ” কার কথা বলছেন?”
” আরেহ কসাইয়ের কথা। যিনি আপনাকে চেনে বলেছে। ওইতো উনি। আমাদের কসাই মাস্টার। একটা আস্ত হরিণ একাই কেটেকুটে সাবাড়। ”

শবনম কাশিফের আঙুলের ইশারা বরাবর তাকাতেই দেখতে পেল উনুনের আলোর সামনে দাঁড়িয়ে খটাখট হাঁড়মাংস কেটে যাওয়া মানুষটাকে। মাংস কাটতে কাটতে নিজের ঘর্মাক্ত মুখ হাতের মাংসল বাহুতে মুছতে আলসে নেই।
শবনম কি এক অদ্ভুত কারণে সরু চোখে তাকিয়ে রইলো। দেখতে লাগলো সুনিপুণ, দক্ষ হাতে মাংস কাটার ধরণ। আর হঠাৎ চোখদুটো অকস্মাৎ বড় হয়ে গেল তার যখন একনাগাড়ে মাংস কাটতে থাকা মানুষটা ঘাড় ফিরিয়ে তার দিকে তাকালো। উনুনের এইপাশ আর ওইপাশে দাঁড়িয়ে দুটি মানুষের অপ্রত্যাশিত অনাকাঙ্ক্ষিত চারচোখের মিলন! শবনম স্তম্ভিত। তার জ্বলজ্বলে ভেজা চক্ষুকোটর হঠাৎই অত্যধিক জ্বলজ্বল করতে লাগলো কোটরভর্তি নোনাজলে। সাথে সাথে চোখ ফিরিয়ে নিল সে। চোখ খিঁচিয়ে বন্ধ করে ভাবলো, ” চোখের ভুল হয়ত, মানুষের চেহারা মানুষের থাকতেই পারে। ”

কিন্তু ভুল ভাঙলো তখন যখন সেই কসাই মাংস কাটা রক্তাক্ত হাতটা ধুঁতে লাগলো তার পাশে এসে। শবনম শুধু চেয়ে রইলো হা করে। তার আশ্চর্যান্বিত চোখদুটো এখনো প্রশ্নবিদ্ধ। মানুষটা হাতমুখ ধুঁয়ে কাশিফকে যখনই গামছা ছুঁড়ে দিতে বললো শবনম তখনিই ডাকলো,
” জনাব মেহমাদ! ”
তার সম্বোধনে মানুষটা ঘাড় ফিরিয়ে তাকালো। উত্তর দিল,
” জ্বি, খাবার প্রস্তুত হচ্ছে। খাওয়াদাওয়া করুন। ভালো লাগবে। ”
শবনম অবাক দৃষ্টিতে চেয়ে থেকে থেমেথেমে বলল,
” মেহমানদারির জন্য কৃতজ্ঞতা। কিন্তু ক্যাপ্টেন থেকে কসাই! এত উন্নতি? ”
নাদির তার দিক থেকে দৃষ্টি আড়াল করলো। মুখ মোছা শেষে গামছাটা কাঁধে রেখে পায়ের কাছের পাথরটাতে পা ঘঁষতে ঘঁষতে দায়সারাভাবে বলল,

” রূপনগরের রাজকন্যা বনেবাদাড়ে! এটাকে কি অবনতি ধরে নেব? ”
আগাপাশতলার সবকিছু, ভয়-ব্যাথা একমুহূর্তের জন্য ভুলে গিয়ে শবনম মৃদু হাসলো কেন যেন! যে আতঙ্ক, ভয়-দুশ্চিন্তা এতক্ষণ ধরে তার মন-মস্তিষ্কে চেপে বসেছে সেটা যেন হালকা হয়ে গেল এক লহমায়।
কয়েকটা বছর পূর্বে স্বল্পদিনের পরিচিত হওয়া এই মানুষটার সান্নিধ্যে যখন আছে তখন নিশ্চয়ই তার আর কোনো বিপদ হতে পারবে না।

কি অদ্ভুত নিজের ভালোর কথা ভাবতে গিয়ে শবনমের খেয়ালই ছিল না যে সে এতদিন যাবত জানতো এই মানুষটা মারা গিয়েছে। সেবার বাবুদের আকীকায় যখন সোহিনী বেড়াতে এল তখন সোহিনীর মুখে শুনেছে, কোনো একটা জাহাজ দূর্ঘটনায় উনি মারা গিয়েছিলেন। মৃতদেহটাও পাওয়া যায়নি। ডাক্তার তাঈফ আর ডাক্তার ফজল মোস্তাফিকে সেবার ভীষণ ভঙ্গুর দেখাচ্ছিল তার শোকে। ডাক্তার বাবু বারবার অনুশোচনায় দগ্ধ হচ্ছিলেন এই ভেবে বোনের রেখে যাওয়া সন্তানটাকে কেন তারা আগলে রাখতে পারেনি নিজেদের স্নেহের বাহুডোরে? কেন সে সর্বহারা, ছন্নছাড়া ছিটগ্রস্তের মতো ঘুরতে ঘুরতে পথেই হারিয়ে গেল? কেন তার জীবনটা অন্যদের মতো গোছালো হলো না? কোনো মায়া কিংবা সম্পর্কের টানে নয়, আপনাআপনিই শবনম তার পরের কয়েকটা রাত ঘুমোতে পারেনি। কেন পারেনি তার কারণটা খুঁজতে গিয়ে বারংবার আঘাত পেয়েছে সে। এই আঘাত খোঁচাতে গেলে সে পুনরায় ক্ষতবিক্ষত হবে জেনে সে সবটা ভুলে থাকার চেষ্টা করেছে। বিবাহবিদ্বেষী সে, আর সংসারবিদ্বেষী নাদির মেহমাদ দুজনেই তাদের সম্বন্ধ শুনে নাকচ করে দিয়েছিল সাথে সাথে। শবনমের এখনো স্পষ্ট মনে আছে সেদিনটার কথা যেদিন তাদের নিকাহর কথা উঠেছিল আর তখন নাদির মেহমাদকে প্রচন্ড বিরক্ত দেখাচ্ছিল। উনি যেন ভুলেও ভাবেন না নিকাহ করার কথা। সংসার তো অনেক দূর।

শবনমের সাথে সাথে শাহানাও রাজী ছিল না। কারণটা ছিল এই, ছেলের নেই ঘর, নেই আপনজন কেউ। এমন ছেলের হাতে মেয়ে তুলে দেবেন শুধুই ছেলে আর তার পেশা দেখে? পেশা, তাও তো সুবিধার নয়। কখন কোন দূর্ঘটনায় সে সমুদ্রের তলদেশে হারিয়ে যাবে তার কোনো নিশ্চয়তা আছে? আর ছেলে! সেও অত সুবিধের কোথায়? দেখে তো মনেই হয় না সংসারী হওয়ার ইচ্ছে আছে তার। শেহজাদ আর সাফায়াতের সামনে একশো একটা কারণ দেখিয়ে শাহানা সেদিন শবনমের পক্ষ নিয়েছিল যদিও শবনমের নাকচে কোনো বিশেষ কারণ ছিল না। সে নাদির মেহমাদকেই নয়, কাউকেই তখন নিকাহ করতে রাজী ছিল না। বড় আপুর ছিন্নভিন্ন জীবনটা এত কাছ থেকে দেখে নিকাহ, ঘর-সংসার এসব থেকে তার মন উঠে গিয়েছিল। তবে এখন সেই বিশ্বাসটা এখন ফিরে এসেছ। ভালোবাসা, ঘর-সংসার, এখানেই মানুষ ভালো থাকে, যদি অপর মানুষটা সঠিক হয়। আপুকে দেখলে বুঝা দায়, জীবন একসময় তাকে কঠিন অন্ধকার কূপে নিমজ্জিত করেছিল। সব আশা-ভরসা, স্বপ্ন সব যখন মিথ্যে হয়ে গিয়েছিল তখন সেই অন্ধকার জীবনটাকে আপন করে নিয়ে নিজের তাকদীরের প্রতি বিশ্বাস রেখে সে অন্ধকারে আলো জ্বালিয়েছে। আজ আপুর মতো সুখী দ্বিতীয় কেউ নেই।

পেশা, পর,ঘর এসবে তার কিছুই যায় আসে না এখন।
এই যে ইমরানের সাথে তার সম্বন্ধ হচ্ছে এসবে সে বিন্দুমাত্র আনন্দ, শান্তি, স্বস্তি খুঁজে পাচ্ছিলো না। মনে হচ্ছিলো ইচ্ছে করেই সে হারিয়ে ফেলছে নিজেকে। অথচ আজ এই নিঝুমপুরীতে দাঁড়িয়ে তার এত শান্তি কেন অনুভব হচ্ছে তার প্রমাণ বোধহয় তার সামনেই দাঁড়িয়ে থাকা পুরুষটি।

এতগুলো মানুষের কাছে মৃত ব্যাক্তিটি তার সামনে সুস্থ সবল দাঁড়িয়ে রয়েছে, শবনমের কাছে এ এক অভূতপূর্ব দৃশ্য! নিজের একটা নিরাপদ আশ্রয় পাওয়ার আনন্দে নয় চোখদুটো এই অত্যাশ্চার্য ঘটনায় তার ছলছল করে উঠেছিল তখন। অন্যদের কাছে এটা স্বস্তির হলেও তার কাছে এই আনন্দের তুলনা হয় না কভুও। সে তো এটা ভেবে অবাক হচ্ছিলো যে, অমন একটা মানুষ অত সহজে হেরে গেল জীবনের কাছে। একেজনের কাছে ঘর সংসার করাটা জীবন হলে, অপরজনের কাছে দেশ-বিদেশ, বনে-বাদাড়ে ঘুরেফিরে হেসেখেলে বেঁচে থাকাটাও তো জীবন। পিছুটান না রেখে শুধুই নিজেকে নিয়ে বাঁচতে পারে ক’টা মানুষ? সমস্ত যাতনা ভুলে শবনম আগুনের সামনে বসে কাঠখড় জ্বালিয়ে মাংস পোড়াতে থাকা মানুষটার দিকে টলটলে চোখে একদৃষ্টে চেয়ে থাকতে থাকতে খেয়াল হলো তার খানিকটা ছেঁড়া জুতোজোড়ায় রক্ত লেগে আছে। পায়েও ব্যাথা টের পেল। সাথে সাথেই সারা শরীরে, হাতে, পায়ে, বাহুতে, মুখে। কি অসম্ভব জ্বলুনি, পোড়ানি।
সিভানের সমবয়সী একা ছেলে এসে বলল,

” তাঁবুতে চলেন আপামণি। ”
শবনম নাদিরের দিকে আরেকপলক তাকালো। নাদিরও তাকাতেই সে দ্রুত চোখ সরিয়ে নিয়ে তাঁবুর দিকে এগিয়ে খুঁড়িয়ে হেঁটে হেঁটে। কোনোপ্রকার উচ্চবাচ্য না করেই ক্লান্ত, অসার শরীরটা টেনেহিঁচড়ে নিয়ে গেল তাঁবুর ভেতর। দেখলো চারপাশে অসংখ্য যন্ত্রপাতি, অস্ত্র-সস্ত্র, পানির কলস, নিভু নিভু জ্বলতে থাকা একটা মোমবাতি, পোশাক, মাথার ক্যাপ,চামড়ার ব্যাগ,লাঠি, জুতো, আরও অনেককিছু। তাঁবুর ভেতরটা এঁটে আছে জিনিসপত্র দিয়ে। আর রয়েছে ঘুমানোর জন্য লম্বা লম্বা শুকনো ঘাসে বস্তা করে বিছানো। তারউপর পাতলা কাঁথার মতো পুরু চাদর বিছানো। শবনম তার উপর বসে পায়ের জুতোজোড়া সর্বশক্তি দিয়ে টেনে খুলতেই রক্তাক্ত পা জোড়া দেখতেই কিঞ্চিৎ আর্তনাদ করে উঠলো। আর সাথে সাথে তাঁবুর বাইরে থেকে কেউ একজন ডেকে বললেন,

” ঠিক আছেন? ”
শবনম হু বলে ওড়না দিয়ে পা জোড়া মুছে ফুঁ দিতে লাগলো। কাশিফ উচুঁস্বরে ডেকে বলল,
” জনাবা আপনার জন্য খাবার দেব? খাবার গরম আছে। ”
” আমি পানি। আর কিচ্ছু খাব না। ”
আর কোনো সাড়াশব্দ রইলো না। শবনম শুয়ে পড়লো বিছানার উপর। পরিবার পরিজনের কথা ভেবে গা কাঁপিয়ে কাঁদলো কিন্তু পরপরই নিজেকে সামলে নিয়ে চোখ বুঁজলো। তার তলপেট ব্যাথা করছে অসম্ভব ভাবে। হাজারো চিন্তা মাথায় ঘুরপাক খাচ্ছে। মেয়েগুলো কোথায় কে জানে? এখান থেকে কি করে তারা উদ্ধার হবে? ক্যাপ্টেন মেহমাদ আর উনার বন্ধু এখানে কিভাবে আটকা পড়েছেন? তাহলে তাদের খোঁজ পাঠাবে কি করে?
তাঁবুর পর্দা সরে যাওয়ায় ভেতরটা আলোকিত হয়ে এল। শবনম ধড়ফড়িয়ে উঠে বসলো লম্বাচওড়া কাউকে ভেতরে প্রবেশ করতে দেখে। কাঁসার ছোট্ট থালায় গরম গরম পোড়া মাংসের সাথে লেবু টুকরো, লেবু পাতা, শিমুল-আলুর শাক সিদ্ধ, ভূট্টা নিয়ে এল নাদির। বিছানার উপর রেখে বলল,

” খেয়ে নিন। আমার কাছে ভেষজ ঔষধ আছে। আপনাকে দেব। ক্ষত শুকিয়ে যাবে। ”
সে বলে থালাটা রেখে বেরিয়ে যাচ্ছিলো। শবনমের কোনো সাড়াশব্দ না পেয়ে ঘাড় ফিরাতেই দেখলো শবনম ফের শুয়ে পড়েছে। কপাল ভাঁজ করে শবনমের ব্যাথাতুর মুখখানা দেখার চেষ্টায় সে আরও একটি মোমবাতি জ্বালিয়ে দিল। হাঁটুমুড়ে বসে ডাকলো,
” মাহমুদা?”

প্রিয় বেগম সিজন ৩ পর্ব ১১+১২

শবনম কথা বলার শক্তি পাচ্ছে না তারপরেও ছোট্র করে আওয়াজ করলো। নাদির মোমবাতির আলোয় দেখতে পেল তার অবস্থা খুবই করুণ। মুখে অসংখ্য ছ্যাঁচা লেগেছে, শুকনো রক্তের দাগ সবখানে। হাত পায়ে অসংখ্য ক্ষত। পায়ের তালুতেও। সে সাথে সাথে বেরিয়ে পড়লো তাঁবু থেকে। বালতি করে পানি এনে পায়ের তালুর ক্ষত পরিষ্কার করতেই শবনম ক্ষীণ শব্দ করে উঠলো। নাদির তার ক্ষত দক্ষ হাতে পরিষ্কার করে ভেষজ ঔষধ লাগিয়ে দিল। আর তারপরপরই জ্বলুনি সইতে না পেরে শবনম ধড়ফড়িয়ে উঠে বসলো। নাদির বলল
” আমি, নাদির। শান্ত হোন। কি অবস্থা করেছেন নিজের? এতটা ক্ষত নিয়ে বসে আছেন, বলা উচিত ছিল। চুপ করে বসুন। ”

প্রিয় বেগম সিজন ৩ পর্ব ১৫+১৬