প্রিয়তে তুমি প্রাণ পর্ব ১১

প্রিয়তে তুমি প্রাণ পর্ব ১১
মিমি মুসকান

প্রান্তিকের ভাব সাব ইদানিং অনেক বদলে গেছে। বিয়ের পর তার এমন পরিবর্তন কারো বোধগম্য নয়। সত্যি সত্যি সে এভাবে বদলাতে পারে। এখনো কিছু বন্ধু বান্ধবের মধ্যে আলোচনা হয়। কাছের বন্ধু গুলো স্বীকার করে নিয়েছে, মেনে নিয়েছে। বন্ধুর এমন পরিবর্তনে তাঁরা অবাক আবার একই সাথে খুশি। সপ্তাহে একদিন কেবল প্রান্তিকের দেখা পাওয়া যায়। তাও ডেকে আনতে হয় জোর করে। ব্যাটা আসতে চায় না, ধরে আনতে হয়। এখন আর সামনে মেয়ে দেখলেও পাত্তা দেয় না। এতে ক্লাবের কিছু মেয়েরা মনক্ষুণ্ণ হয়ে আছে। প্রান্তিকের বিয়ের পর যেন সবচেয়ে বেশি লোকসান তাদেরই হলো।

আলফি বিয়ারের বোতলে চুমুক দিল। তার পাশেই বসে মান্নাত একের পর এক সিগারেট টেনে চলছে। কোন বাঁধা নেই। আশিক চুপসে একপাশে বসে আছে। তার গা ঘেঁষে আছে মৌনতা। বন্ধুদের ওসব খেতে দেখে তার তৃষ্ণার্ত মুখ শুকিয়ে গেল। কিছু করার নেই। মৌনতা জানলে মাথার একটা চুল ও থাকবে না। তাঁর জীবনের প্রথম ভালোবাসা হলো মৌনতা। সেই কলেজের প্রথম লাইফের ভালোবাসা। আর আগে কখনো প্রেম করেনি। মেয়েদের সাথে কথা বলতে গেলেই তার বুকের মধ্যে ধিমধিম করে যেন ড্রাম বাজতো। এতোই লাজুক ছিলো সে। অন্যদিকে স্কুল থেকেই মেয়েদের মধ্যে প্রান্তিকের জনপ্রিয়তা অনেক। প্রান্তিক বলতেই তারা পাগল। হবে নাই বা কেন? ছোট থেকেই প্রান্তিক সবদিক থেকে পারফেক্ট। হোক সেটা পড়ালেখা কিংবা গুড লুকিং। টাকাও আছে বেশ। সবাই তাকে চাইতো। কিন্তু স্কুলে থাকা কালে প্রান্তিক মেয়ে’বাজ ছিলো না। তারা কেউই ছিলো না। মেয়েরা কেবল এদের মৌমাছির মতো ঘিরে রাখতো। ব্যাপারটা এই চারজনই বেশ এনজয় করতো।

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

বড়লোকের দিক থেকে প্রান্তিকের অবস্থা তাদের থেকে ভালো। তারা ছেলেবেলার বন্ধু। মৌনতা এসে যোগ হয়েছে কলেজ লাইফে। শুরু থেকেই মৌনতা প্রান্তিককে ভাই ডেকে এসেছে। মেয়েটা তাদের থেকে দুই বছরের ছোট। তবে বন্ধুত্ব হলো কি করে?
তাদের কলেজের পাশেই ছিল একটা গার্লস স্কুল। সেখান থেকে নিত্যনতুন তাদের কাছে চিঠি আসতো। চিঠি আনার কাজ ছিলো মৌনতার। মৌনতা আগে বেশ মৌনই থাকত। কথাও বলতো অনেক লাজুক ভঙ্গিতে। এসব দেখেই তো আশিক পাগল হয়েছিল তার জন্য। প্রণয় জেগেছিল তাঁর জন্য। কিন্তু এই মেয়েটাকে বিগড়ে দিয়েছে প্রান্তিক। তাকে এমন কথা বলা শিখিয়েছে যে এখন প্রান্তিক ও তার সামনে কিছু বলতে ভয় পাই।

এদেশে কলেজ লাইফ শেষ করতে পারিনি প্রান্তিক। দাদাজান কাজের সূত্রে দেশের বাইরে গিয়ে শিফট হলেন। সাথে নিয়ে গেলেন প্রান্তিক কে। তাকে ছাড়া তাঁর দুদণ্ড চলে না। ছেলে ম’রার পর এখন নাতিই তার সব। তার একজীবনে এখন নাতিই একমাত্র সম্বল। শেষবারের মতো এয়ারপোর্টে তাদের বিদায় জানাতে গেল তারা। মৌনতা প্রান্তিক কে জড়িয়ে ধরে সেই কি কান্না। বার বলতে বলতে লাগলো, “ভাইয়া তুমি আমাকে ছেড়ে যেও না!”
যেন সত্যিই তার ভাই চলে যাচ্ছে। কিন্তু প্রান্তিক তার কথা রাখতে পারে না। তারা চলে যাবার পরেও মৌনতা কান্না থামাতে পারেনি। তখন আশিক তাকে বুকে জড়িয়ে ধরল। সেই যে জড়িয়ে ধরল আজ ও ছাড়েনি। প্রান্তিক ও প্রায় বোন বলতে অজ্ঞান। তাদের মধ্যে ঝগড়া হলে প্রান্তিক সবসময় মৌনতার সাইড নিবে, এখন দোষ মৌনতার হলেও তার জন্য মৌনতা সবসময় ঠিক!

এরপর দীর্ঘ সময় কেটে গেল। প্রান্তিক যখন দেশে ফিরল তখন তাকে আর চেনা যায় না। সেই শান্ত, চুপচাপ ছেলেটা আর সে নেই তখন। পড়াশোনা শেষ করে মন দিয়েছে দাদা জানের বিজনেসে। তার সাথে আরেক নেশা ধরল তাকে। মেয়ে’দের নেশা। নিত্যনতুন তাকে দেখা যেত নতুন মেয়েদের সাথে। আশিক এরা অবাক না হয়ে পারল না। তবে মানিয়ে নিল। কারণ বন্ধু হিসেবে প্রান্তিক যেন আগের মতোই আছে। কিন্তু এতো গুলো বছর তার সাথে কি হয়েছিলো, কেন হলো এসব কেউ জানতে চাইলো না। জানতে গেলে যদি পুরনো ক্ষ’ত আবার জেগে উঠে। তবে আবার সেই আগের প্রান্তিক ফিরে এসেছে। তাঁর কলেজ লাইফের সেই বন্ধু। তার নিতান্ত কোনো আগ্রহ নেই মেয়েদের সাথে। কেমন নিরস মুখে কথা বলে তাদের সাথে। কৌতূহল নেই যেন! কারণ কি? তবে কি বউকে ভালোবাসতে শিখে গেছে ব্যাটা!

মান্নাতের কথা বলে লাভ নেই। সে হচ্ছে অন্য লেভেলের মানুষ। তার সব ঠিক হয় শেষে কেবল প্রেমটাই হয়ে উঠে না। প্রেমটা মাখো মাখো হবার আগেই আলাদা হয়ে যায়। এর কারণ আশিক জানে না। জানার ইচ্ছে নেই। দোষটা মান্নাতের মনের। কোনো মেয়েকেই তার ভালো লাগে না। শুরুতে ভালোলাগলেও শেষ অবধি সেই ভালোলাগা টিকিয়ে রাখতে পারে না। ভালোলাগা দিয়ে শুরু আবার ভালোলাগা দিয়েই শেষ। ভালোবাসা অবধি যায় না।
এদের মধ্যে সবচেয়ে ভদ্র হচ্ছে আলফি। তার জীবনে কাদাপানির কোনো চিহ্ন নেই। এর পুরো কারণই তার ফ্যামিলি। একটু বেশিই স্ট্রিক কিনা। এসব থেকে একটু দূরেই যেন থাকতে হয় তাকে। এছাড়া বেচারা অ্যারেঞ্জ ম্যারেজে ভীষণ বিশ্বাসী।
মৌনতা হেলেদুলে বলল, ভাবছি বিয়েটা এবার করেই ফেলি।
আশিক আকাশের চাঁদ হাতে পাবার মতো ফিরে তাকাল। বহুদিন ধরে এটা চাইছিলো সে। কিন্তু মৌনতাকে বলার সাহস হচ্ছিল না। রাজনীতিতে ঢোকার পর মৌনতা কে যেন একটু বেশিই ভয় পেতে শুরু করেছে সে। প্রান্তিক মুচকি হেসে বলল,

– ভেবে নে। বাঁদরের গলায় একবার ঝুলে গেলে কিন্তু আর বের হতে পারবি না।
আশিক মুখ চোখ কালো করে প্রান্তিকের দিকে তাকালো। শয়তা’নটা চাইছে কি? নিজে তো ভালোই বিয়েশাদী করে স্যাটেল হয়ে গেছে। এখন তার সময় এমন শয়তা’নি করছে। আশিকের ভ্রু জোড়া কুঁচকে গেল। মৌনতা কে বাহুডোরে জড়িয়ে নিল সে। জোর গলায় বলে উঠলো,
– তোর মতো বন্ধু যেন আমার শ’ত্রুর ও না হয় শালা। ইত’রামি করিস? জানেমান তুমি বলো। বাবাকে কবে তোমার বাসায় পাঠাবো। তুমি বললেই আমি এক পায়ে রাজী।
মান্নাত বলে উঠলো, কেন? দুই পায়ে কি সমস্যা? লু’লা ছেলেকে কেউ কিন্তু মেয়ে দিবে না বলে দিলাম।
মৌনতা খিলখিলিয়ে হেসে উঠল। আশিক ঠোঁটে ঠোঁট চেপে মান্নাত কে দেখছে। এই হাতে পেলেই খে’য়ে ফেলবে। আলফি সেই কখন থেকে চুপসে আছে। প্রান্তিক এবার না পেরে জিজ্ঞেস করেই উঠল,

“ব্যাপার কি তোর? চুপসে আছিস কেন?”
“আচ্ছা, আমার বিয়ের বয়স কি পেরিয়ে যাচ্ছে?
মৌনতা বলে উঠলো, “কেন? তোর কি মনে হচ্ছে? তোর বয়স কমে যাচ্ছে। শা লা মেয়েলী কথাবার্তা কেন বলিস? ছেলেরা যেকোনো বয়সেই বিয়ে করতে পারে!”
আলফি কিছু বলতে গেলো। কিন্তু পারল না। চুপসে গেলো। তার মনের কথা বেশিরভাগ সময়েই চুপ হয়ে থাকে। সবাইকে বলে না সে। মৌনতার নজর প্রান্তিকের দিকে।
“কিরে? কতোক্ষণ পর পর ফোনে চোখ বুলাচ্ছিস। কারণ কি?”
“বউ কল করবে বোধহয়!”
“কিরে প্রান্তিক? তোর বউকে কি দেখাবি না। ভাবী কে দেখব বললাম সেই কতোদিন আগে। তোর তো কোনো পাত্তাই নাই!”

“আমি সেদিন দেখলাম ভাবীকে।”
“কেমন দেখতে রে? ভীষণ সুন্দরী তাই না বল। নাহলে কি আমার ভাইকে এমন ঠান্ডা করতে পারে। নিশ্চিত মেয়েটা আ’গুন!”
মান্নাত কেবল হাসল। সে বলতে চেয়েছিল, প্রান্তিকের শ্যালিকাও কম না। কিন্তু থেমে গেল। প্রান্তিক এসব শুনলে তাকে আস্ত গি’লে খাবে!”
থমথমে মুখে প্রান্তিক উঠে দাঁড়াল। কাউকে কিছু না বলেই বেরিয়ে গেলো সে। সকলে একটু অবাক হলো। সিরিয়াস কিছু হয়েছে বোধহয়। সচরাচর প্রান্তিকের এমন সিরিয়াস মুখ কেউ দেখে না।

মান্নাতের মন ভীষণ খারাপ। খারাপের কারণ একমাত্র আমরিশা। তিনদিন হলো মেয়েটার কোনো খোঁজ নেই। তার কথা ভেবে সে অস্থির হয়ে উঠেছে। সেদিন বোকার মতো কাজ করল। মেয়েটার নাম্বার নিয়ে রাখবে না। আর মেয়েটাও কি? একবার ফোন করলে কিইবা মহাভারত অশুদ্ধ হয়ে যাবে। ভুল হয়েছে। সেদিন কথাবার্তা বলে বাড়ির এড্রেস নেবার দরকার ছিলো। কি করলে সে? কোনো কাজই তো হলো না। তার পাশেই অন্যমনষ্ক হয়ে আলফি দাঁড়িয়ে। সে একের পর এক বোতল ম’দ গিলেই যাচ্ছে। এদিকে মান্নাত আমরিশার চিন্তায় দশ বারোটা সিগারেট শেষ করেছে। তাঁর কেনো জানি মনে হচ্ছে, তাদের দুই বন্ধুর মনের অশান্তির কারণ একটিই! সেটা হচ্ছে মেয়ে! কিন্তু আলফি কি প্রেমে পড়েছে? কই? সে তো জানে না। কিন্তু চেপে গেল সে। তাঁর নিজের ব্যাপারেও তো আলফি কে কিছু বলতে পারবে না। অতঃপর পাশ বেয়ে চলে গেল।

ফোনটা তার বেজে উঠল। আবার থেমে গেল। মিসকল? ফোনের স্ক্রিনে আননোন নাম্বার দেখে চোখ জ্বলজ্বল করে উঠলো মান্নাতের। তার মন বলছে এটা আমরিশার নাম্বার। সময় নষ্ট না করে কল দিলো সে। অনেকক্ষণ পর ফোনটা রিসিভ করল কেউ। কিন্তু কথা বলছে না। মান্নাত কিছুক্ষণ হ্যালো হ্যালো করার পর কেটে দিল। আবারো ফোন দিল। এবারও কথা বলছে না। মান্নাত রেগে গিয়ে ধমকের সুরে,
– দুটো থাপ্পর দিলে সব ফাতরামি বেরিয়ে যাবে। কথা বলছো না কেন? আমরিশা!
– হ্যাঁ, হুঁ আপনি আমায় চিনলেন কি করে?
– এমন ফাতরামি তুমিই পারো করতে? এতো দিন ধরে লাগে একটা ফোন করতে? তা কি ভাবছিলে এতোদিন ধরে? সময় কেন লাগল এতো?
আমরিশা আমতা আমতা করছে। জবাবে কি বলবে তার জানা নেই। তার কেমন ভয় ভয় লাগছে। বোকার মতো কাজ করেছে সে। ফোন দেওয়াই উচিত হয়নি। পেছন থেকে আফরিন তার গলা জড়িয়ে ধরতেই সাথে সাথে ফোন কেটে দিল সে। মান্নাতের রাগ এবার তু’ঙ্গে। দাঁতে দাঁত চেপে ফোনটাকেই একটা আছাড় মারল সে। আলফি, মৌনতা, আশিক আহম্মক বনে গেল। সবাই আজ চেতছে কেন এমন করে?

প্রিয়তা ফোন নিয়ে বসে আছে সেই কখন থেকে। বর মশাইকে কয়েকবার কল পেরেছে। পাত্তা পায়নি। কোথায় গেলেন তিনি? তার ফোন ধরার সময়টুকু ও হচ্ছে না। এই শেষবার! এরপর আর কল করবে না সে। এবার ফোন বাজতে বাজতে সাথে সাথেই রিসিভ করল ফেলল সে।
প্রিয়তা কিছু জিজ্ঞেস করার আগেই প্রান্তিক থমথমে কণ্ঠে বলল, এসে গেছি!
বলেই কল কেটে গেল। প্রিয়তা তখন শুনতে পেলো বাড়িতে গাড়ি ঢুকছে। কি আশ্চর্য! এখনই বা কি দরকার ছিলো ফোনটা ধরার। অভিমান করে ঘরের মেঝেতে বসে রইল সে। এগিয়ে গেলো না। যাবেও না।
কারো তড়িঘড়ি করে উপরে আসার শব্দ পাচ্ছে সে। প্রিয়তা উঠে দাঁড়াল। তার ব্যাকুল মন বলছে প্রান্তিক উপরে আসছে। কিন্তু তার আসার ধরণ অদ্ভুত লাগছে তার কাছে। ঘরের আলো নিভানো। মাথা ব্যাথা করছিলো বলে আলো নিভিয়ে ছিল। এবার আলো জ্বালানো দরকার। তিনি আসছেন তো!

আলো জ্বালানো হলো না। প্রান্তিক তার আগেই ঘরে ঢুকে গেল। সজোরে দরজা বন্ধের শব্দে প্রিয়তা কেঁপে উঠলো সামান্য। অন্ধকারে কেউ কাউকে দেখছে না। প্রান্তিক কিছু জিজ্ঞেস করছে না। তাঁরা দুজনেই চুপ। প্রিয়তার ভয় লাগছে এবার। হাত বাড়িয়ে বিছানার পাশেই ল্যাম্প শেডের আলো জ্বালালো সে। সাথে সাথে কেউ ছুটে এসে তার হাত চেপে ধরল। প্রিয়তা কিছু বুঝার আগে তাকে দেওয়ালের সাথে ঠেসে দাঁড় করালো সে। অনুভূতি বলছে, এটা প্রান্তিক! কিন্তু আচরণ বলছে যেন অন্যকেউ। প্রিয়তা কুঁকড়ে উঠল ব্যাথায়। প্রান্তিক হাত ছাড়ল না। ল্যাম্প শেডের আধো আধো আলোয় প্রান্তিকের মুখখানা দেখে চমকে উঠল প্রিয়তা।
তাঁর দৃষ্টি থমকে গেল। এই প্রান্তিক কে সে চিনে না। এনি তার বর মশাই নন। এই চোখ যেন অন্যকারো। বিধ্বস্ত, হিংস্র। গলার স্বর ও বদলে যাচ্ছে কেমন। প্রান্তিক গম্ভীর স্বরে শুধালো,
– ভার্সিটিতে গিয়েছিলে আজ?
প্রিয়তা কি বলবে খুঁজে পেলো না। সে তো প্রান্তিক কে বলেই বেরিয়েছিল। তাহলে? প্রান্তিকের স্বর এবার থমথমে শোনাল।

– কথা বলছো না কেনো?
– হ্যাঁ গিয়েছিলাম!
– কেন গিয়েছিলে?
প্রিয়তা ঢোক গিলে বলল, ক্লাস ছিলো তো!
সাথে সাথে তার গাল চেপে ধরল প্রান্তিক। ব্যাথায় ছট’ফট করছে প্রিয়তা। প্রান্তিক ধমকের সুরে বলল, – মিথ্যে কেন বলছো তুমি? ক্লাস করতে গিয়েছিলে? ক্লাস করেছিলে? বলো কি ক্লাস করেছো?
প্রিয়তা জবাব দিতে পারছে না। তার গালে টনটনে ব্যাথা করছে। অশ্রুসিক্ত নয়ন দুটি থেকে যেকোনো সময় অশ্রু গড়িয়ে পড়বে। প্রান্তিকের সেসবে যেন কোনো ধ্যান নেই। মূহুর্তের মধ্যে প্রান্তিক তার গাল ছেড়ে চুল ধরে টেনে ধরল। মুখটা তার সামনে নিয়ে শক্ত গলায় শুধাল,
– কথা বলছো না কেন?

প্রান্তিকের চোখের ভাব দেখে প্রিয়তার প্রাণ যায় যায় অবস্থা। প্রান্তিকের এমন রূপ তার জানা ছিলো না। কেমন ভয়ানক লাগছে না। এই বুঝি তাকে শেষ করে দিবে। তার রাগী কণ্ঠ, চোখের হাবভাবে প্রিয়তার নিঃশ্বাস ভারী হয়ে উঠল। আর্তনাদ করে উঠলো সে।
– লাগছে আমার!
অশ্রু গড়িয়ে পড়ল গাল বেয়ে। প্রান্তিকের যেন হুঁশ ফিরে এলো। চুলের বাঁধন আগলা হয়ে আসছে। এক হাতে তার কোমর চেপে অন্যহাতে তার গালের কাছে
কাছে নিয়ে রাখল সে। শক্ত হাত নরম আর শীতল হয়ে উঠল। কণ্ঠের স্বর ও নরম হয়ে এলো।
– লাগছে? সরি সরি খেয়াল করিনি। খুব লেগেছে বউ!
আদুরে সুরে বলতেই প্রিয়তা ডুকরে কেঁদে উঠল। দু হাতে খামচে ধরে আছে প্রান্তিকের শার্ট খানা। কেঁদে কেঁদেই বলে উঠলো, – না আজ ক্লাস করিনি। আজ আমরা কফি শপে সবাই ছিলাম। কথা বলছিলাম!
– তুমি আর একটা ছেলে ছিলে তাই তো!

কণ্ঠে আবারো রুক্ষ’তার আগমন। প্রিয়তার কান্না থামেনি। সে মাথা দুলাল। প্রান্তিক প্রিয়তাকে বুকে টেনে বলল, এরপর আর ছেলেদের সাথে কথা বলবে না। ক্লাস করতে গেলে সেখানে শুধু ক্লাস করতেই যাবে। আমার কথা কি শুনছো বউ? তোমার সাথে অন্যকে দেখলে আমার বুকটা জ্ব-লে উঠে। আমি নিতে পারি না। তুমি শুনছো!
প্রিয়তা শুনতে পারছে কি না জানা নেই। তবে সে ভীষণ ভয় পেয়েছে। প্রান্তিক তার কান্না থামাতে পারছে না। দুই হাতে আচমকা তাকে কোলে তুলে নিল। প্রিয়তা তাজ্জব বনে হলো। প্রান্তিক তাকে বিছানায় বসিয়ে আলো জ্বালালো। প্রিয়তার মুখখানা এবার স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে। একটু কাঁদতেই পুরো মুখ লাল হয়ে গেছে। লাল হয়ে আছে তার গাল দুটো। একটু আগেই যেখানে চেপে ধরেছিল হাতের ছাপ বসে গেছে সেখানে। প্রান্তিক অবাক হলো। প্রিয়তার কান্না দেখে তার বুকের মধ্যে ব্যাথা শুরু হয়ে গেল। বড়ই অস্থির লাগছে তার। ছুটে এসে মেঝেতে তাকে পায়ের কাছে বসে পড়ল সে। প্রিয়তা চমকে উঠল। প্রান্তিকের মুখখানা দেখে তার কান্না থেমে গেল। চোখ গুলো লালচে হয়ে আছে বেশ। কেঁদে দিবে এমন ভাব। প্রিয়তা তার দোষ খুঁজে পেলো। প্রান্তিক হাঁটু ভেঙ্গে উঠে দাঁড়িয়ে দুই হাতে তার গাল চেপে ধরল। মুখে আজস্র চুমু খেয়ে বলল,

– সরি সরি বউ! সরি। তোমার খুব লেগেছে না। আমি আর করব না। প্লিজ কেঁদো না!
প্রিয়তা নিস্তব্ধ! এই প্রান্তিক কে সে চিনে না। শুরু থেকেই প্রান্তিক তার কাছে অন্যরকম একটা মানুষ ছিলো। তার কাজ কেবল অকাজ করা। কোনো কিছু নিয়েই সিরিয়াস না। সবকিছু তার জন্য মজা যেন। কিন্তু এই প্রান্তিক কে দেখে সে একটু ঘাবড়েই গেল। তার মুখে অসহায়ত্ব ফুটে উঠেছে। প্রিয় জনকে হারিয়ে ফেলার ভয় তার দৃষ্টিতে।
পিন পিন নিরবতা। প্রিয়তার কান্না থেমে আছে। সে গুটিসুটি মেরে বসে আছে প্রান্তিকের কোলে। প্রান্তিক তাকে জড়িয়ে ধরে বসে আছে। কিছু বলছে না। মনে মনে নিজেকে দুষছে সে। ক্লাস বাদ দিয়ে ছেলেটার সাথে কফি শপে যাওয়া তার মোটেও উচিত হয়নি। সে যেতোও না। ছেলেটা তাকে নোটস দিয়ে হেল্প করেছিলো বিধায় গেল। যাবার পর কথা বলে তাকে বসিয়ে রাখল। শুধু শুধু, এভাবেই। প্রিয়তা উঠতে চাইলেও উঠতে পারছিলো না। শেষে প্রিয়তা অধৈর্য হয়ে উঠে পড়ল। ক্লাস আর করা হলো না। সোজা বাড়ি ফিরে এলো। একটা ছেলের সাথে কফি শপে বসে কথা বলেছে বলে আজ কতোকিছু হয়ে গেল। ভাবতেই তার অবাক লাগছে।
প্রান্তিকের কণ্ঠ এমন অন্যরকম লাগছে। ভীষণ অন্যরকম। সে তার কানের কাছে চাঁপা স্বরে বলল,

– তুমি জানো, আমি খুব একটা ভালো ছেলে নই!
– হুঁ?
– হ্যাঁ তো। আমি খুব একটা ভালো না প্রিয়তা। আমি খুবই অবাধ্য আর অগোছালো। আমার জীবনে আমি এতো ভুল করেছি যে তখন সেই ভুল গুলোকে ভুল বলে মনে না হলেও আজ হচ্ছে। আজ ভুল না অপ’রাধ বলে মনে হচ্ছে। আচ্ছা, তুমি কি এই অপরাধীর অপরাধের কথা জেনেও তাকে ভালোবাসবে!
প্রিয়তা হেসে উঠল বোধহয়। নরম স্বরে বলল, – কি করেছেন শুনি? মানুষ খু’ন নাকি?

প্রিয়তে তুমি প্রাণ পর্ব ১০

প্রান্তিক হাসল। প্রিয়তা উঠে বসল। প্রান্তিকের দিকে ফিরে দুই হাতে যত্নে তাকে আগলে ধরল। তার কপালে একটু চুমু খেয়ে বলল, “আপনি যা কিছুই করেন না কেন? আমি তবুও আপনাকে ভালোবাসবো। কখনো ছেড়ে যাবো না!”
প্রান্তিক হাসল ফের। তাকে জড়িয়ে ধরে নিল বুকের মধ্যে। সে খুব জানে প্রিয়তা তাকে ক্ষ’মা করবে না। তাকে ভালোবাসবে না বরং ঘৃণা করবে। নারীরা তাদের প্রিয় পুরুষের সব ভুল ক্ষমা করতে পারেও একটা জিনিসই তো পারে না। সে কখনোই তার পুরুষের ভাগ অন্য কাউকে দিবে না। প্রিয়তার ভাবনায় এখনো সেসব যায়নি। তবে যাবে! প্রান্তিক সত্যকে আটকাতে পারবে না তবে প্রিয়তাকে আটকে রাখতে পারবে। প্রিয়তা যেতে চাইলেও তাকে দিবে না। সে যাই করতে হোক না কেন, প্রিয়তাকে সে দূরে ফেলতে পারবে না। কখনোই না!

প্রিয়তে তুমি প্রাণ পর্ব ১২