প্রিয়তে তুমি প্রাণ পর্ব ৩২
মিমি মুসকান
ঠান্ডা বাতাসে হৃদয় জুড়ানোর সাথে সাথে শরীরও কেঁপে উঠে। আলতো করে তার বাহু চেপে গায়ে ঘেসে রয় একটু উষ্ণতার আশায়। সন্ধ্যে গড়িয়েছে বেশ অনেকক্ষণ আগে। রাত্রি যত গভীর হয় উপরের খোলা আকাশ ততো বিস্তৃত মনে হয়। চারদিক আঁধারে ঢেকে গেলেও পাশের মানুষটির বাহু আঁকড়ে ধরে বাঁচার তৃষ্টা পায় আজীবন। জীবন কি এখানেই সুন্দর! একজন জীবনসঙ্গীকে নিজের জীবনের অবিচ্ছেদ্য অংশ করতে কতোটুকু সময় লাগে? কেমনি করে বা একজনকে হৃদয়জুড়ে ভালোবাসা যায়। কেবল একজনকেই? দুজনে হাঁটছে থেমস নদীর পাশেই। খোলা জায়গায় তাদের মতো অনেক মানুষ! তারাও হাঁটছে কিংবা বসে গল্প। ভালোবাসার আদান প্রদানের কি শেষ আছে?
সারাটে দিন কেটেছে রোমাঞ্চকর ভাবে। পুরো দিনটি দুজনে একসঙ্গে ঘুরেছে, লাঞ্চ করেছে, খোলা জায়গায় ঘাসের উপর ছোটাছুটি করেছে এরপর দিনের শেষে সূর্য যখন পশ্চিমে ঢুবে যায় তখন এসেছে থেমস নদীর কাছে। নদীর উপর ঝুলন্ত ব্রিজের চমকদার দৃশ্য দুজনকে বিস্ময় করে তুলে। খোলা জায়গায় বাতাসের তীব্রতা যেন আরো প্রচন্ড!
আচমকা প্রান্তিক চৌধুরী তার হাত দুটো চেপে ধরে। ফিরোয় তার দিকে। গালে ঠান্ডা হাত দুটো বসিয়ে চোখ দুটো স্থির করে। যেন চোখাচোখি হয় ঠিক করে। অতঃপর গভীর কণ্ঠে বলে উঠে,
“বউ! আমি একটা কাজ করতে যাচ্ছি। আই নো ইউ উইল বি ভেরি শাই বাট আই ওয়ান্ট টু ডু দ্যাট।”
গভীর দৃষ্টিতে দৃষ্টি মিলিয়ে হৃদয়ের কথা টের পেয়েছে বহু আগেই। তবুও মনকে শান্ত করার জন্য শুধায়, “কি?”
প্রান্তিক চৌধুরী মৃদু হাসে। বলে উঠে, “আই ওয়ান্ট টু কিস ইউ, আই মিন রাইট নাও!”
আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন
সে চমকে উঠে। কয়েক পলক এদিক ওদিক চেয়ে জিহ্ব ভেজায় ঠোঁটে। সে হাসি অতি কিঞ্চিত। মিলিয়ে যায় দ্রুত। বুক ধকধক করছে এখনই। ধীরে সুস্থে এগিয়ে এসে চুমু খায় ওই গোলাপী নরম কোমল ওষ্ঠরেখা। যতই সময় যায় আগলে ধরে আরো তীব্র ভাবে। আলিঙ্গনে ঘনিষ্ঠতা বাড়ে ততোই। হাত একটা গাল ছেড়ে কোমর চেপেছে আরো আগেই। শক্ত পেশিবহুল হাত দুটো মালিশ করছে তার সরু কোমরে। বহুক্ষণ পর মুক্তি পায় সে। ঠান্ডায় জমে যাচ্ছে পুরো দেহ। তবু লজ্জায় লাল হতে বাধা ঠেকল না গাল দুটিতে। প্রান্তিক চেয়ে রয় রক্তিম মুখশ্রীর পানে। সদ্য লাল করা অধর দুটোয়। আবারো এগিয়ে এসে ক্ষুদ্র চুমু আঁকে সেখানে। দুজন দম নেয় দ্রুতবেগে। লজ্জায় প্রিয়তা কথা বলতেই ভুলে গেছে যেন। শব্দহীন ভাবে চেয়ে রয়। তার কেবল মনে হচ্ছিল লোকেরা তাকে দেখছে। কিন্তু আশ্চর্য! কেউ তাদের দেখছে না। তারা নিজেরাই নিজেদের মধ্যে ব্যতিব্যস্ত!
প্রান্তিক তার ঘাড় চেপে এগিয়ে আনে। ললাটে লালট ঠেকায় শক্ত করে। তীব্র কণ্ঠে বলে উঠে, “বউ! তোমায় কথা দিচ্ছি, তুমি ছাড়া আর কেউ না। বাকিটা জীবন কেবল তোমার জন্য আর তুমি শুধুই আমার। ছেড়ে যাওয়ার কথা বলো না। আমি ছাড়ছি না। প্রান্তিক চৌধুরী তোমায় ছাড়বে না। ম*রে যাওয়ার আগে তো কখনোই না!”
প্রিয়তা কেবল শুনে আর ঘনে ঘনে দম ছাড়ে। পুরো শরীর অবশ হয়ে আসছে তার। ঠান্ডা বাতাস যেন থামার নামই নিচ্ছে না। ইচ্ছে করছে প্রান্তিকের বুকের মধ্যে লুটোপুটি খেতে। এতে যদি ঠান্ডা একটু কমে!
রাতের অন্ধকারে কেবল সোনালী আলোর ঝলক। নদীর তীরে তীব্র বাতাসে ক্ষুদ্র ঢেউ খেলছে একটু পর পরই। দুজন কপোত কপোতীর দাঁড়িয়ে সেখানে ভালোবাসার প্রতিজ্ঞা নিচ্ছে। দিনের শেষে এরচেয়ে ভারী সুন্দর আর কি হতে পারে?
তারা ফিরে এসেছে রাত করেই। দুজনে কক্ষে ঢোকার সাথে সাথে খাবার চলে এসেছে। ফ্রেশ হয়ে দুজনে একসাথে খেতে বসেছে। কিন্তু প্রিয়তা ফোন হাতেই ব্যস্ত। সারাদিনে একটিবারও কেউ কল করেনি। কি আজব! দেশে নেই বলে কেউ একবার খোঁজ ও নিবে না নাকি? তাদের সাথে ফোনে কথা বলছে। পাশের চেয়ারে বসে প্রান্তিক তাই খাইয়ে দিচ্ছে। মা বাবার সাথে কথা বলা শেষে দাদাজানকেও কল করল। খোঁজখবর নিল সারাটে দিনের। অতঃপর ক্লান্ত দেহ নিয়ে বিছানায় লুটিয়ে পড়ল। প্রান্তিক চেয়ে রয় অবলীলায়। সে মোটেও এতো ক্লান্ত হয়ে পড়ে নি অথচ প্রিয়তা বেশ ক্লান্ত। বহু বছর পর যেন এতো ঘোরাঘুরি করল তারা। পরনে সাদা শার্ট টা খুলে রাখল সোফার উপর। উন্মুক্ত শরীর নিয়ে ঢুকে গেল কম্বলের মধ্যে। ঠান্ডা শরীরটাকে উষ্ণ করবার আশায় অর্ধাঙ্গিনীকে জড়িয়ে নিলে বক্ষে। ঠোঁট ছুঁইয়ে গেল তার অধরপুটে। সে ততোক্ষণে ঘুমের মধ্যে তলিয়ে গেছে। তার ঘুমন্ত মুখস্রী কি আর জানে? কিভাবে একটা হৃদয় ক্ষনে ক্ষনে ত্রাসিত করে ফেলছে। মন্থর গতিতে চলছে মস্তিষ্ক। হস্তযূগলের আদলে ছোট খাটো একটা শরীর লেপ্টে আছে অবলীলায়। উন্মুক্ত ঠান্ডা শরীরে তাণ্ডব চালানোর জন্য ঘুমের মধ্যেই ব্যাকুল হয়ে উঠল। নখের আঁ*চড় সুনিপুণ কারুকাজ হলো বক্ষে। ঠোঁট চেপে আরেকজন কেবল সহ্য করে নিল। ভালোবাসায় এতোটুকু অত্যা*চার যেন করাই যায় আরকি!
পুরো দুদিন কেটে গেল। অথচ ঘোরাঘুরির এখনো অনেক কিছু বাকি। ভোর সকালে আজ বরফের টুকরোর দেখা পেয়েছিল। উচ্ছ্বাস, উৎসাহে হাতড়ে ধরেছিল সবটুকু। বাচ্চাদের মতো খেলা করেছিলো বেশ অনেকক্ষণ। কিন্তু সময় যত বাড়তে লাগল আদিত্যের সাধনায় এসে বরফ গলে জল হয়ে গেল।
প্রান্তিক গতকালই নতুন একটা রেঞ্জ রোভার নিয়েছে। বিলাসবহুল কালো গাড়ি। প্রিয়তমার হাত ধরে বসাল সামনের সিটে। ড্রাইভিং সিটে সে। গাড়ি স্টার্ট দিয়ে বেরুলো দুজন। গাড়ির গতি দেখে তাজ্জব বনে গেল প্রিয়তা। শখের গাড়ি চালিয়ে খুশিতে প্রান্তিক বাকরুদ্ধ। কিন্তু তার প্রতিটা উন্মাদনা দেখতে পারছে আরেকজন।
এখন যাচ্ছে রিচমণ্ড পার্কে। দুপুরে হোটেলে লাঞ্চ সেরেই বেড়িয়েছে তারা। দীর্ঘ পথে কেবল গাছগাছালি ছাড়া আর কিছু নজরে পড়ছে না কারো। গাড়ির সংখ্যাও নেহাত কম। জানালা দিয়ে মুখ বের করে দিল সে। হাওয়াতে কেশ উড়তে লাগল ইচ্ছেমতো। বেখেয়ালি হয়ে রইল সে। এলোমেলো হয়ে গেল সমস্ত অলক। কি দরকার ঠিক করার।
হুট করেই গাড়ি থামিয়ে দিল প্রান্তিক। প্রিয়তাও থমকে গেল। তারা কি এসে পড়েছে। মুখখানি ভেতরে নিয়ে ডান দিকে ফিরল। একজন ভদ্রমহিলা কে দেখা যাচ্ছে। অব্যবস্থিতমনা তিনি। গরগর করে ইংরেজি বলছে। এতো দ্রুতই বলছে যে প্রিয়তার বুঝতে একটু সমস্যা হইছে।
অতঃপর প্রিয়তা বুঝল। ভদ্রলোক বিদেশিনী! তার ছেলে সামনেই এক্সি*ডেন্ট করেছে। তিনি সাহায্য চাইছেন। হাউমাউ করে কাঁদতে কাঁদতে হাঁটু গেড়ে রাস্তায় বসে পড়লেন। প্রান্তিক হম্বিতম্বি করে গাড়ি ছেড়ে নামল। প্রিয়তাও অনুসরণ করল তাকে। প্রান্তিক জানাল সে হেল্প করলে। ভদ্রমহিলা তৎক্ষণাৎ উঠে দাঁড়ালেন। ছুটে গেলেন সামনের দিকে। প্রিয়তা এসে দাঁড়াল প্রান্তিকের পাশে। সামনে তাকিয়ে খেয়াল করল সামনেই একটি গাড়ি দাঁড়িয়ে। মর্মান্তিক অবস্থা! গাড়ি একটা গাছের সাথে ঠেসে দাঁড়িয়ে। বোধহয় ধাক্কা খেয়েছে। সামনের বাম্পার টা একপাশে চেপে ঢুকে গেছে, হুডের কোণা একটু উঁচু হয়ে আছে। ধোঁয়া উড়ছে সামনে থেকে।
ওই ভদ্রমহিলা সহ আরেক ভদ্রলোক ১২ কি ১৩ বছর বয়সী অচেতন একটা ছেলেকে বাহুবন্ধে তুলে নিয়ে ছুটে আসছেন। ছেলেটার কপাল চুঁইয়ে র*ক্ত গড়িয়ে পড়ছে। প্রান্তিক নিজে গাড়ির পিছনের সিটের দরজা খুলে দিল। তারা তিনজন হুল*স্থুল করে উঠে বসল। প্রিয়তাও সিটে বসে পড়ল। পানির বোতল বের করে এগিয়ে দিল তাদের। প্রান্তিক গাড়ি স্টার্ট দিল। কি সাং*ঘাতিক পরিস্থিতির স্বীকার তারা দু’জন!
হাসপাতালে আসতে বেশিক্ষণ সময় লাগলো না। প্রান্তিক গাড়ি নিয়ে ঝড়ে*র বেগে হাসপাতালে এসে পৌঁছাল। ভদ্রমহিলা বেরিয়ে চিৎকার করে ওয়ার্ড বয় কে ডাকছে। ভদ্রলোক একাই ছেলেকে কোলে তুলে এগিয়ে গেলেন। এরই মধ্যে তারা বেড নিয়ে হাজির। বোধহয় ইমার্জেন্সিতে নিয়ে যাওয়া হবে। সন্তানের জন্য মা বাবার হৃদয় কতোটা ব্যাকুল হয়ে গেছে। প্রিয়তা পা বাড়াল ছেলেটার অবস্থা জানার জন্য। যেন বেঁচে যায়! ছোট একটা বাচ্চা! সৃষ্টিকর্তার কাছে বার বার আকুল আবেদন করছে সে।
প্রান্তিক তৎক্ষণাৎ তার হাত চেপে ধরল। বলল,
“চলো!”
“ছেলেটিকে দেখব না।”
“না!”
“কেন? চলুন না দেখে আসি। ছেলেটা কেমন আছে? বাঁচবে তো?”
“বেঁচে যাবে, তোমার চিন্তা করতে হবে না। চলো আমার সাথে!”
প্রান্তিক সোজা এসে বসল গাড়িতে। প্রিয়তা যেন একটু অবাকই হলো। প্রান্তিকের এমন আচরণ তার কাছে ভালো ঠেকছে না। এতোক্ষণ তো সে নিজেই ছেলেটিকে বাঁচানোর জন্য ঝড়ে*র বেগে গাড়ি চালিয়ে হাসপাতালে নিয়ে এলো। অচেনা, অজানা লোকদের সাহায্য করল। আর এখন এমন আচরণ! বোধগম্য হচ্ছে না। প্রিয়তা উঠে এসে বসল। বার বার তাকাচ্ছে পিছনের হাসপাতালের দিকে!
গাড়ি এখনো চলছে দ্রুতবেগে! প্রান্তিক নিষ্প্রাণ, নিশ্চুপ! তার দৃষ্টি কেবল সামনের দিকে। পাথরের মূর্তির মতো চুপসে গেছে যেন। প্রিয়তা কয়েকবার ডাকলেও সাড়া দিল না। হঠাৎ এমন কি হলো?
গাড়ি এসে থামল শুনশান নিরব জায়গায়। জঙ্গল নাকি! রাতের অন্ধকারে প্রিয়তা ঠিক বুঝল না। এখন এখানেই বা আসার কি দরকার ছিল?
প্রান্তিক গাড়ি ছেড়ে নেমে প্রিয়তাকে নামাল। হাত শক্ত করে ধরে প্রায় টেনে হি*ছড়ে নামাল। কি অদ্ভুত আচরণ! ব্যাথায় হাতে যন্ত্রণা শুরু হয়ে গেছে। পিছন ফিরে রাফিকে দেখে তাজ্জব বনে গেল।
লোচনে কেমন বিস্ময় আর হতাশা। শখের এতো টাকার গাড়িটিকে চোখের সামনে পু*ড়িয়ে ফেলল প্রান্তিক চৌধুরী! প্রিয়তা হা হয়ে চেয়ে আছে। একবার গাড়ির দিকে তাকাচ্ছে তো একবার প্রান্তিকের দিকে। এসবের কি দরকার ছিল? গতকালই তো কিনল! প্রিয়তার দৃষ্টিতে হাজারো প্রশ্ন। প্রান্তিকের বাহু চেপে তার দিকে চেয়ে আছে অপলক দৃষ্টিতে। জোয়ার ভাটা এসেছে নদীতে। চোখের অশ্রুরেখা পড়ছে গড়াগড়িয়ে। দাঁতে দাঁত চেপে শুধাল,
“এমনটা কেন করলেন?”
অগ্নি*র তেজ বাড়লো। প্রিয়তা ভয় পেয়ে আঁকড়ে ধরল শক্ত করে। প্রান্তিক প্রিয়তার হাতটা ধরে এক পা পিছিয়ে গেল। দাউ দাউ করে জ্ব*লে উঠা আগু*নে দৃষ্টি রেখে বলে উঠলো,
“কখনো শুনেছো, মায়েরা সন্তান কে ভুলে যায়?”
“কি বলছেন এসব? আপনি কি…
থেমে গেল। শব্দ করে শ্বাস প্রশ্বাস নিতে লাগল। দু সেকেন্ড পৃথিবীর সমস্ত কথা ভুলে গেলো। মস্তিষ্কে বার্তা যাচ্ছে। এ কথার মানে কি? প্রান্তিক মৃদু হাসল। প্রিয়তার মুখের দিকে তাকিয়ে মৃদু স্বরে বলল, “আমার মা আমায় ভুলে গেছে প্রিয়তা!”
প্রিয়তে তুমি প্রাণ পর্ব ৩১
কথাটা বলতে একবারও বাঁধল না। কষ্টে প্রিয়তার বু*কটা ফেটে যাচ্ছে। বাহু চেপে ধরল শক্ত করে। গা ঘেঁষে দাঁড়িয়ে রইল। ঠোঁট চেপে নিঃশব্দে কেঁদে উঠল সে। পারল না। তার কান্নার আওয়াজ শুনল পিছনের দু তিনজন লোক। রাফি মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে আছে। অথচ প্রান্তিক এখনো নিশ্চুপ। চোয়াল শক্ত! নিষ্পলক আঁখি জোড়ায় কেবল জ্ব*লন্ত আ*গুনের প্রতিচ্ছবি। ভেতরখান পুঁ*ড়ে ছারখার হয়ে গেছে। প্রিয়তার কান্নার শব্দ তার কানের কাছে পৌঁছেছে। মেয়েটা কেন কাঁদছে প্রান্তিক বুঝতে পারছে না। এখানে তো কান্নার কিছু নেই?