প্রেম ও অসুখ গল্পের লিংক || নবনীতা শেখ

প্রেম ও অসুখ পর্ব ১
নবনীতা শেখ

“বাবা যার সাথে আমার বিয়ে দিয়েছেন, সেই লোকটা নাকি আমার চেয়ে একুশ বছরের বড়ো। আগের ঘরের বউ-বাচ্চা সবই আছে। আমি কিছু জানতাম না। জানার পর আর সহ্য করতে পারলাম না। তাই বাসর ঘরে পানির গ্লাসে তিনটা ঘুমের ওষুধ মিশিয়ে আমি পালিয়ে এলাম। আমাকে একটু থাকতে দেবে তোমরা?”
অষ্টাদশী সাঁঝের এহেন কথা শুনে চমকে উঠল তার বান্ধবী অদিতি ও অদিতির মা। রুমা বেগম বললেন,
-“এত অল্প বয়সে কেন বিয়ে দিলেন তোর বাবা? তারা তো এমন নন!”
সাঁঝ চোখ-মুখ কুঁচকে বলল,
-“জানি না কিছু। বিয়ে দেওয়ার তো কথা ছিল না। মেয়ে মানুষ ঘরে থাকলে সম্বন্ধ আসেই। তবে এর আগে আব্বা কোনোদিন সেই বিয়ের কথাগুলো আমার কান অবধি আসতে দেননি। এবার কী যে হলো! আমার অনুমতি অবধি নেওয়া হলো না। হুট করেই দেখলাম বাড়িতে অনেক মেহমান এলো। আম্মা আমার রুমে এসে বলল শাড়ি পরতে। একটু অবাক হলাম। তারপর কীভাবে কীভাবে যেন বিয়ে হয়ে গেল। জানো আন্টি? আমাকে কবুল অবধি বলতে বলা হয়নি।”
অবাক হয়ে অদিতি বলল,

-“তাহলে কীভাবে কী?”
সাঁঝ ঠোঁট উলটালো,
-“আমি যে কিছুই বুঝতে পারছিলাম না, তা বললে ভুল হবে।আমার যে বিয়ে হতে যাচ্ছে, বুঝেছি। কিন্তু হুট করেই হওয়ায় কেমন থম মেরে বসে ছিলাম। এরমধ্যে আমাকে কী কী জিজ্ঞেস করা হলো, না বুঝেই হ্যাঁ বলে দিয়েছি। তারপর দোয়াদরুদ পড়া হলো। আর তার কিছুক্ষণ পর সাহস করে আম্মাকে বললাম, বিয়েটা কি আমার আসলেই হচ্ছে? আম্মা বলল, হয়ে গেছে। কী আশ্চর্য! আহাম্মক হয়ে গেলাম।”
অদিতি জানতে চাইল,
-“তারপর কী হলো?”
সাঁঝ গায়ের ভারি শাড়িটা একটু সামলে নিয়ে বলল,
-“আর জিজ্ঞেস করিস না, অদি। আমি এখনো ট্রমা থেকে বের হতে পারিনি। বাকিটা পরে বলব। আমাকে একটু পানি দিবি?”
অদিতি পানির গ্লাস এগিয়ে দিলো। সাঁঝ পুরোটা একবারে খেলো। মনের অশান্তি চোখে-মুখে ফুটে থাকা বিস্ময়ের সাথে পেরে উঠছে না। রুমা সাঁঝের মাথায় হাত বুলিয়ে দিলেন। একহাতে আগলে নিয়ে বললেন,

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

-“কয়টা দিন তোকে দেখি নাই আর এতকিছু হয়ে গেল! আল্লাহ আমার আম্মুটাকে ধৈর্য দিক। তুই এখন থেকে এখানেই থাকবি, আমার সাথে। আমি তোকে কোথাও যেতে দেবো না, মা।”
অদিতি বলল,
-“তোর আব্বু-আম্মু খুঁজবে না?”
-“হয়তো না।”
-“এত শিওর কী করে হচ্ছিস?”
-“আমার দায়ভার সব আমার শ্বশুরবাড়ির এখন। আম্মা বিদায়ের সময় এটাই বলেছে। এখন খুঁজতে আসবে কোন মুখে?”
-“আর তোর জামাই?”
-“দুইদিনে বিছানা থেকে উঠুক আগে। এরপর দেখা যাবে। বালিকাবঁধু পালার শখ কত তার! সামনে আসুক! তারে তো আমি দেখে নেব।”

সাঁঝের কথা বলার ধরনে অদিতি না চাইতেও হেসে ফেলল। রাতে সাঁঝ অদিতির রুমে থাকল। চোখ দুটোতে এক ফোটা ঘুমও নেই। মাথার মধ্যে ঘুরপাক খাচ্ছে বিগত ষোলোটা ঘন্টা। সকালে তারা এলো, দুপুরে বিয়ে, বিকেলে বিদায়, সন্ধ্যায় নতুন বাড়ি, আর রাতে বিয়েবাড়ি থেকে বউ পালালো। জীবনটা কত অদ্ভুত। কত অল্প সময়ে কী থেকে কী হয়ে যায়!
সাঁঝ বারান্দামুখী হয়ে দাঁড়াল। আকাশের দিকে হেলে আছে এক চাঁদ। কিছুক্ষণ আগে আজান হয়েছে। ভোর হতে যাচ্ছে। আকাশ পরিষ্কার হচ্ছে অল্পস্বল্প করে। সাঁঝ এগিয়ে গেল সেদিকে। প্রতিটি কদমে যেন কিছু প্রহর পিছে চলে যেতে লাগল।
বলা নেই, কওয়া নেই.. হুট করেই এভাবে বিয়ে হয়? তারপর আবার শ্বশুরবাড়িও নাকি পাঠিয়ে দেয়! এসব সাঁঝের জানা ছিল না। মস্তিষ্কে আঁটছিল না। এরমধ্যে সে মার কাছে জানতে চাইলো, সে কি সংসার জীবনটা মানিয়ে নেওয়ার মতো বড়ো আসলেই হয়েছে? কীভাবে পারবে?
মা তাকে অনেক বুঝ দিলো। আর সেই বুঝটাতে এক পর্যায়ে সে শ্বশুরবাড়ি যাওয়ার জন্য তৈরিও হয়ে গেল, বুকের ভেতর বুনতে লাগল কিছু নতুন ধরনের স্বপ্ন। একটা ঘর, একটা সংসার, একটা মানুষ, কিছু ভালোবাসা… আচ্ছা, মানুষটাকে সে দেখেনি এখনো। ভালোবাসতে পারবে তো?

সবচেয়ে বিস্ময়কর সত্য এটাই—সে তার স্বামীকে দেখেনি। বিদায়ের সময়ও না, পুরোটা রাস্তায় একবারও না। লজ্জা, জড়তা, অস্বস্তি… অদ্ভুত সব অনুভূতির মিশেলে যেন কিছু অন্যরঙ!
শ্বশুরবাড়িতে পা ফেলার ঘন্টা খানেকের মধ্যেই সে জানতে পারল, তার সাথে স্ক্যাম হয়ে গেছে। স্বামী একুশ বছরের বড়ো, তার বউ-বাচ্চা আছে। চমকে উঠেছিল সাঁঝ, মুখটা গেছিল ফসকে, “সংসারের গুষ্টির তুষ্টি!”
বুকের ভেতরটায় যতরঙের ফুল ফুটেছিল, একত্রে যেন তারা বিষক্রিয়া করতে লাগল। এমনটা তো সে ভাবেনি। এমনটা কেন হলো তার সাথে? আর কী কী চমক সামনে অপেক্ষায় আছে?

এসব ভাবনার মধ্যেই বাসরে বসানো হলো তাকে। কুড়ি মিনিট পর বর এলো। সাঁঝের রুচিই ছিল না লোকটাকে দেখার। হাতের কাছে চাকু রেখেছিল। কাছে এলেই গলা বরাবর দাবিয়ে দেবে। সাইডবক্সে মেডিসিন বক্স পেয়েছে। সেখান থেকে ঘুমের ওষুধ নিয়ে পানির গ্লাসে মিশিয়ে দিয়েছে। লোকটা খেয়ে নিক। খেয়ে মরে যাক!
কিছুক্ষণ পর তার সদ্য বিয়ে করা বর ঠিক তার পাশে এসে পিঠ দেখিয়ে শুয়ে পড়ল। থম মেরে শ্বাস আটকে বসে রইল সাঁঝ, তাকিয়ে রইল সাদা পাঞ্জাবির পিঠটার দিকে। তারপর কেটে গেল অগণিত প্রহর। সাড়া শব্দ পাওয়া গেল না কোনো। সাঁঝ উঠে দাঁড়াল। সাইড বক্সের ড্রয়ারে কিছু নোটপ্যাডও পেয়েছিল। সাঁঝ সেখান থেকে একটা কাগজ ছিঁড়ে ছোট্ট একটা চিঠি লিখল।
“আপনার মতো বিবাহিত কাকুর সাথে আমি সংসার করতে আগ্রহী নই। আমাকে খুঁজতে এলে নারী নির্যাতনের মামলা ঠুকে দেবো ফর শিওর। বোঝা গেল? ফাইন! আল্লাহ যেন আপনাদের মতো পাগল-ছাগলদের আক্কেলজ্ঞান দেন।

– সাঞ্জিনা..”
আর তারপর কালো বোরকা পরে বাসর রাতের বারান্দা হয়ে বউ পালাল। গতরাতে বিয়ে করা নতুন বউ এখনো বারান্দাতেই দাঁড়িয়ে। পার্থক্য কেবল এখানেই যে, তখন ছিল টাঙ্গাইলে আর এখন সাভারে।
ধরণীর বুকে এখন ভোর হতে যাচ্ছে। এতক্ষণে কি তার খোঁজ শুরু হয়েছে? কেউ কি টের পেয়েছে কিছু? আর তারপর কী হবে? এখানে তো বেশিদিন থাকবে না। আচ্ছা.. কই থাকবে?
ভাবতে ভাবতে বন্ধ করে রাখা ফোনটা অল্প সময়ের জন্য অন করল। কিঞ্চিৎ সময়ের ব্যবধানে একটা আননোওন নাম্বার থেকে টেক্সট এলো। কিছু সময়ের জন্য তব্দা খেয়ে গেল সাঁঝ। পরক্ষণে রাগে-দুঃখে প্রায় চেঁচিয়েই উঠল। অদিতি দৌড়ে এসে জিজ্ঞেস করল, “কী হয়েছে?”
সাঁঝ তাকাল, “এই অদি, আমাকে দেখ তো।”

-“দেখলাম!”
-“আমাকে দেখে কী লাগে?”
-“শয়তানের ভাই।”
-“চোপ বেয়াদপ। ভালো করে বল।”
-“ভালো?”
-“হুম।”
-“শয়তানের নানি লাগে। এইবার জেন্ডার ঠিক রাখলাম। এত শিক্ষা-সংস্কৃতি আমার! কাজে লাগানো ফরজ।”
সাঁঝ কাঁদো কাঁদো হয়ে বলল,
-“আমার শত্রুর শালী তুই, তোরে আমি দেখে নেব।”
-“আচ্ছা নিস। এবার বল, কী হইছে?”
সাঁঝ নিজের ফোনটা এগিয়ে দিলো অদিতিকে। সে ফোন হাতে নিয়ে টেক্সটটা পড়ল। ওখানে লেখা –
“প্রিয়তমা স্ত্রী…”
এটুকু পড়েই অদিতি বড়ো বড়ো চোখ করে সাঁঝকে জিজ্ঞেস করল, “প্রিয়তমা স্ত্রী?”

-“আমি।”
-“আচ্ছা।”
অদিতি আবারও পড়তে লাগল,
“প্রিয়তমা স্ত্রী, মাথার ঘিলুটা কোন হাঁটে গিয়ে কয় টাকা দরে বিক্রি করে এসেছেন, কাইন্ডলি বলবেন? ফেরত নিয়ে আসা লাগবে। আফটার অল, বিয়ে করেছি, সংসারটাও করাই লাগবে। স্টুপিড মুরগী কোথাকার!”
ভ্যাবাচেকা খেয়ে তাকাল অদিতি। হতবিহ্বল আওয়াজ তার,
-“এ কে?”
-“আমার একুশ বছরের বড়ো বর মহাশয়!”

প্রেম ও অসুখ পর্ব ২