প্রেম ও অসুখ পর্ব ১৩+১৪
নবনীতা শেখ
ক্যাম্পাসের এককোণায় গোল হয়ে বসে আছে সাঁঝ, অদিতি, আয়াত, রাঈন ও প্রহর! সকলের চেহারায় প্রশ্ন। সাঁঝের চোখ-মুখে প্রশান্তি। ব্যাপারটা রহস্যকর। রহস্যের ব্যাখ্যা অদিতির কাছেই আছে। তবে তা বলার অনুমতি পায়নি এখনো। কাজেই চুপ থাকাই শ্রেয়।
আয়াত চাপ দিলো,
-“কী রে ভাই? তোর হইছেটা কী? ক আমাদের। বন্ধুত্বের রুল নাম্বার ১০১, একা একা বিনোদন নেওয়া লাগে না। তুই মুরগা পটাবি, আমাদের সাথে ভাগ করে খাবি। শেয়ারিং ইজ কেয়ারিং। অপু দশ বিশ করে বলে ফ্যাল তো।”
সাঁঝ চোখ-মুখ কুঁচকে ফেলল,
-“হারামি কোথাকার! আমি বিয়াত্তা। জামাই শেয়ার করব নাকি?”
আয়াত ভাবলেশহীনভাবে বলল,
-“করতেই পারিস, মাইন্ড করব না।”
-“জুতা চিনোস?”
-“কেন চিনব না? আমার পায়ের নিচেও আছে। বাটা থেকে আড়াই হাজার ট্যাকা দিয়ে কিনছিলাম। তোর লাগবো?”
সাঁঝ মুখ ভেঙচাল। হেসে কূল পাচ্ছে না অদিতি। রাঈন বলল,
-“অল সর্টেড, বেইব?”
প্রহরের চোখেও একই প্রশ্ন। প্রশ্ন বললে ভুল হবে। সে অনেকটা নিশ্চিত যে এমনটাই হয়েছে। তার ধারণা আজ অবধি কখনো ভুল প্রমাণিত হয়নি। সে যা ভাবে, তাই হয়। সে যা চায়, তা কখনো হয় না। কথাটার প্যাঁচ মারাত্মক।
রাঈনের ইঙ্গিতপূর্ণ প্রশ্নের বিপরীতে সাঁঝ লাজুক হাসল। রাঈন বিস্ময় নিয়ে বলল,
-“সেই মামা! ট্রিট দে। বিল তোমার, ভালোবাসা আমাদের।”
সাঁঝ সত্যি সত্যি জানাল, ট্রিট দেবে। আয়াত অতিষ্ঠ ভঙ্গিতে গাল ফুলিয়ে বসে আছে। তাকে পাত্তা দেওয়া হচ্ছে না। তাকে কিছুই জানানো হচ্ছে না। কষ্টকর। অতি দুঃখে সে কান্নার অভিনয় করে ঠোঁট উলটাল। আশেপাশের পাষাণ শ্রেণীর প্রাণীগুলোর মায়া হওয়া তো দূর, তাকিয়েও দেখল না।
আয়াত অদ্ভুতভাবে লক্ষ করল, তার চোখ গিয়ে বার বার আটকাচ্ছে ওই ছোকরাটার দিকে। সমবয়সী তারা। তবু তার চেয়ে একহাত লম্বা, গায়ে গতরে মাংসও যেন তার দ্বিগুণ। দেখতে কী হ্যান্ডসাম! আয়াতের চোখ দুটোতে স্পষ্ট দুষ্টুমির ছাপ।
আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন
প্রহর একবারও তাকাল না। না তাকিয়ে উঠে অন্যদিকে চলে গেল। আয়াতও উঠে দাঁড়াল। গুটিগুটি পায়ে গিয়ে প্রহরের পিছে হাঁটতে লাগল। গলা খাঁকারি দিয়ে নিজের উপস্থিতির জানানও দিলো। অমন বড়ো বড়ো কদমের সাথে তাল মিলিয়ে হাঁটতে আয়াত হিমশিমই খাচ্ছে। কিন্তু মহারাজ তাকিয়েও দেখলেন না।
এখন যদি আয়াত মুখ থুবড়ে শুকনো ঘাসের ওপর ঠুস শব্দ করে পড়ে যায়, চারিদিকের লোকের সামনে কী বেইজ্জতিই না হবে তার! নিশ্চয়ই কেউ কেউ ফোন বের করে ভিডিয়ো করা শুরু করে দেবে। কেউ তো হেসেই ফেলবে। আয়াত সে হাসি সহ্য করতে পারবে? পারবে না তো। বাটা থেকে কেনা আড়াই হাজার ট্যাকার জুতাটা কোমডে চুবিয়ে এনে মুখ বরাবর ছুঁড়ে মারবে। তারপর কী হবে? ওহ নো নো নো নো! আয়াত ভাবতেই পারল না। ওভারথিংকিংয়ের চূড়ান্তে দাঁড়িয়ে সে। আরেকটু ভাবলে মরেই যাবে। এমন অবস্থায় জনাব দয়ামায়া করে দাঁড়িয়ে পড়ল। আয়াত কোমড়ে হাত গুঁজে ওখানেই দাঁড়াল।
তারপর কেটে গেল গুণে গুণে সাড়ে তেরো সেকেন্ড। গম্ভীর পুরুষটি স্তব্ধতা কাটিয়ে সেভাবে দাঁড়িয়েই জানতে চাইল,
-“কী?”
আয়াত থতমত খেয়ে গেল। আজকেই রাঈন প্রহরকে নিজের বন্ধু হিসেবে সার্কেলে পরিচয় করে দিয়েছে। তাই আহামরি চেনা-পরিচিতি এখনো হয়ে ওঠেনি। এভাবে কথা বলা কি অভদ্রতা? ঠোঁট কামড়ে ভাবতে লাগল আয়াত। আর ভাবতে ভাবতেই বিরবির করে উঠল,
-“ভদ্রতার গুষ্টিরমাথা। আমি তো ভদ্র নই।”
প্রহর কথাটা শুনতে পেয়েছে বোধহয়। নয়তো ঠোঁটের কোণের এই বাঁকটা কী উপলক্ষে? ঠাট্টার হাসি? এতই সূক্ষ্ম? আয়াত পেছন থেকে এবার প্রহরের বাঁ পাশে এসে দাঁড়াল। ঘাড় বাঁকিয়ে প্রহরের দিকে তাকিয়ে বলল,
-“তোমার গার্লফ্রেন্ড আছে?”
নিশ্চয়ই এখন লোকটা ভাববে, আয়াত মেয়েটা ভীষণ ছ্যাচড়া বা গায়ে পড়া! প্রথম কথায় কে-ই বা এমন প্রশ্ন করে? এগুলো আদৌও ভালো প্রশ্ন নাকি? ভাবলে ভাবুক। তার মেরুদণ্ড সোজা, সে সোজা প্রশ্ন করতে ভালোবাসে। জিলেপির প্যাঁচ অন্যসব মেয়েরাও দেখিয়ে বেড়ায়!
আয়াত নির্বিঘ্নে তাকিয়ে রইল প্রহরের দিকে। লম্বাটে মুখ, ঘন আইব্রো, সরু নাক, চোখ যেন তীরের মতো! আর ঠোঁট! ওহ ড্যাম! আয়াত নির্লজ্জতার চরমে পৌঁছে হাভাতের মতো তাকিয়ে রইল। আর সেই তাকিয়ে থাকার মধ্য দিয়েই জনাবের সুদর্শন ও আকর্ষণীয় ঠোঁট দুটো নড়ে উঠল। সে বলল,
-“নেই।”
পুরো মুখ জ্বলজ্বল করে উঠল আয়াতের, চোখ দুটো বড়ো বড়ো করে তাকিয়ে বলল,
-“মিথ্যেবাদী! মিথ্যুক! এমন চেহারার পোলা তুমি, না-হলেও দুইটা ফোন, চারটা সিম, চারটা হোয়াটসঅ্যাপ, দশটা ফেসবুক আইডি ও একাধিক সোশ্যাল প্ল্যাটফর্মে মেয়েদের নাচিয়ে বেড়াবা। ওগুলোর মধ্যে একটা না একটা তো সিরিয়াস হবেই, তাই না?”
প্রহর সামনে তাকিয়েই বলল,
-“আমার ফেসবুক একাউন্ট নেই।”
আয়াত কোমড়ে হাত গুঁজে দাঁড়িয়ে, হতবুদ্ধি হয়ে বলল,
-“সত্যিই নেই? মিথ্যে বলছো কেন? আমি কি তোমার ফেসবুক একাউন্ট চেয়েছি? আর চাইলেই বা কী হতো? ফেসবুক একাউন্টই তো! তোমার ব্যাংক একাউন্টের পিন না।”
প্রহর এবার আয়াতের চোখে চোখ রেখে তাকাল। চাহনি স্থির, নির্দিষ্ট। এতটা সময়ে এই প্রথম তাকাল আর তাকিয়েই রইল। বিচলিত হলো আয়াত। থতমত খেয়েও শক্তচোখে তাকিয়ে রইল। তেজদীপ্ত গলায় বলে উঠল,
-“আসলেই নেই?”
-“না।”
-“লাস্ট টাইম জিজ্ঞেস করছি, নেই?”
-“নেই।”
-“ভাই, আমি তোমারে কাল চাল পড়া খাওয়াব। তোমার এই কথা সত্য হলে চালগুলো মধু হয়ে গলা দিয়ে নামবে। আর মিথ্যা হলে তুমি মুরগী হয়ে যাবা। ব্রয়লার মুরগী। বুঝছো?”
প্রহর অনিমেষ তাকিয়ে রইল। সে অনেককিছু বুঝতে পারছে…
রুমে ফিরতেই সাঁঝ লক্ষ করল, তার সন্ধ্যাবতী একাউন্টে হৃদের টেক্সট এসে জমা হয়েছে। একটা নয়, দুইটা নয়, তিন তিনটা। পড়ার জন্য ইনবক্সে ঢুকতে যাবে, ওমনিই ফোনে কল আসে। আফিয়া বেগমের কল। তার শাশুড়ির!
সাঁঝ রিসিভ করে লম্বা করে সালাম দিয়ে বলল,
-“আম্মা, ভালো আছো?”
আফিয়া বেগম সালামের জবাব দিয়ে বলল,
-“আল্লাহ ভালো রাখছে। তুমি ভালো আছে?”
-“জি, আলহামদুলিল্লাহ।”
-“পড়াশোনা কেমন চলে?”
-“আমার সংসারের চেয়ে ভালোই চলে।”
-“সংসার কেমন চলে?”
-“কচুর মতো চলে, আম্মা। এমনিতে তো ভালো লাগে, মজা আছে। কিন্তু চুলকায় খুব। তাই খাইতে পারি না।”
আফিয়া বেগম হাসলেন,
-“আম্মা আমার, সংসার তো এমনই। একটু মেনে নেওয়া লাগে, একটু মানিয়ে নেওয়া লাগে। আর তারপর যখন সংসারটাকে পুরোপুরি আপন করে নেবে, কারো কোনো কথায় আর তোমার কষ্ট লাগবে না। স্বামী ভালো হলে তো দুনিয়াতেই স্বর্গ পাওয়া যায়। তখন এলার্জির সমস্যাটাও গায়েব হয়ে যাবে। বুঝলে মা?”
সাঁঝ মাথা নাড়ল আনমনে, নরম গলায় জিজ্ঞেস করল,
-“আমি চেষ্টা করব, আম্মা।”
-“আমি জানি, তুমি পারবে।”
-“জি।”
গত সন্ধ্যা থেকে হৃদ একবারও সাঁঝকে কল দেয়নি। সাঁঝ নিজেও দেয়নি অস্বস্তি, জড়তা আর ভয়াবহ লজ্জায়। স্বাভাবিক হতে লাগবে সর্বনিম্ন চব্বিশটা ঘন্টা। এটুকু সময় সাঁঝ এদিক-ওদিক লাফিয়ে বেড়াচ্ছিল। ফিরে নিয়েই কল দিত। কিন্তু দিয়ে কী বলত? উফফ লজ্জা! তার মধ্যেই শাশুড়ি আম্মা কল দিয়েছেন। সাঁঝ মিনমিনে স্বরে বলল,
-“আম্মা, তোমার ছেলের সাথে কথা হয়েছে?”
-“সকালে হয়েছিল। বুয়া গ্রামের বাড়ি গেছে তিনদিন ধরে। তো কল দিয়ে বলল, ওর নাকি ভাজাপোড়া খেতে ইচ্ছে করছে, কিছু রেসিপি যেন দেই।”
সাঁঝ থেমে থেমে শুধাল,
-“বাসায়ই আছে?”
-“হ্যাঁ। আজ হসপিটালে যায়নি। ছুটিতে আছে।”
-“হঠাৎ ছুটি? কী উপলক্ষে?”
আফিয়া বেগমের কণ্ঠে দ্বিধা,
-“তুমি জানো না?”
-“না তো। কী হয়েছে, আম্মা?”
দীর্ঘশ্বাস ফেললেন আফিয়া বেগম। ছেলেটা কাউকে কিছু বলে না। সে তো মা, আওয়াজ শুনেই টের পেয়ে যায় সবটা। আর বাকিদের জানাবেও না, জানবেও না। তার খারাপ লাগল ভীষণ। মলিন গলায় বলল,
-“আর বইলো না আম্মু, ছেলেটা এত বড়ো হয়ে গেল! এখনো নিজের ভালো বুঝে না। ওর গায়ে বৃষ্টি সয় না। কাল নাকি আবার ভিজেছে!”
সাঁঝ আঁতকে উঠল,
-“জ্বর আসছে?”
আফিয়া বেগম মলিন গলায় বললেন,
-“হ্যাঁ রে, মা। তোর যদি সময় হয়, তো একটা কথা বলি..”
আফিয়া বেগমকে বাক্য সম্পূর্ণ করতে দিলো না সাঁঝ। অচিরে বলে উঠল,
-“আমি এক্ষুণি যাচ্ছি।”
-“ভালো হয়..”
সাঁঝ কল কেটে সবার আগে হৃদের টেক্সট পড়ল। তিনটা টেক্সট। ক্রমান্বয়ে লেখা,
“হ্যালো, ভার্চুয়াল বউ!”
“ধরায় ধারা, বুকেতে জ্বলন্ত তাণ্ডব যেন!
দৃষ্টিতে সংঘর্ষ মস্তিষ্কে ঝড়, মন অশান্ত, নৈঃশব্দ্যে ক্ষিপ্ত—
তারপর বলো.. প্রেমাসুখ চেনো?
ভেতরে তীব্র অসুস্থতা, বাহ্যিকতায় সুখে মোড়ানো!”
“মেবি আমার তাকে দেখতে ইচ্ছা করছে।”
লাস্ট টেক্সট ত্রিশ মিনিট আগে করা। সাঁঝ বিছানা থেকে গায়ের ওড়না তুলে সেভাবেই দৌড় লাগাল। হৃদের ফ্ল্যাটের সামনে গিয়ে কিছুক্ষণ কলিং বেল বাজাল। কেউ দরজা খুলল না। সাঁঝ তখন আফিয়া বেগমকে কল লাগাল। কল রিসিভ হতেই ফটাফট বলে উঠল,
-“আম্মা, তোমার ছেলের ফ্ল্যাটের সামনে দাঁড়িয়ে। চাবি নাই। দরজা খুলছে না। আল্লাহ জানে, মরে পড়ে আছে কি না। কেমনটা লাগে! কী করব? তুমি লোক পাঠাও, দরজা ভাঙি। আল্লাহ কীজন্য যে মেয়ে মানুষ বানাইছেন আমারে। গায়ে শক্তি নাই। একা দরজা ভাঙতে পারি না। ধুর!”
সাঁঝের কণ্ঠে উদ্বিগ্নতা। আফিয়া বেগম জানালেন,
-“দেখো, দরজার সামনে দুটো টব আছে না? ডান পাশেরটার পিছে চাবি রাখা।”
সাঁঝ চাবি পেয়ে গেল, দরজা খুলতে খুলতে বলল,
-“থ্যাংক ইউ, আম্মা। চিন্তা কইরো না। আমি আছি ওনার কাছে।”
-“এখন কিছুটা নিশ্চিন্ত, মা। যাও। কল দিয়ে জানিয়ো।”
-“আচ্ছা।”
সাঁঝ কল কেটে ভেতরে প্রবেশ করতে গিয়ে আচমকা থেমে গেল। প্রথম পা ভেতরে রাখতে গিয়ে দেখল, সে কাঁপছে। সবকিছু কেমন নড়বড়ে। শ্বাস টানল বড়ো করে। হৃদের নিজস্ব স্মেল পুরো ফ্ল্যাট জুড়ে ছড়িয়ে আছে। ভেতর থেকে দৌড়ে এলো ইভ। সাঁঝের পা ঘেঁষে আদর খেতে লাগল। সাঁঝ একহাঁটু মুড়ে বসল। ইভকে আদর করে হাসল,
-“তুই আমার ছানা নাকি রে? তাহলে বেশি আদর ডিজার্ভ করিস। কোলে আয়!”
সাঁঝ হাত বাড়িয়ে ওকে উঠিয়ে নিল। মাঝারি আকারের একটা ফ্ল্যাট। দুইটা বেডরুম, একটা ড্রয়িংরুম, একটা ডাইনিং। একদম তাদের ফ্ল্যাটের মতোই। তবে এটাতে ইন্টেরিয়র করা আছে। সাঁঝ প্রথম রুমের দরজা খুলে দেখল, সেখানে অফিশিয়াল সেট-আপের মতো কিছু করে রাখা। মেবি এখানেই হৃদ ভিডিয়ো বানায়!
এদিক-ওদিক দেখতে দেখতে সাঁঝ হৃদের রুম পেয়ে গেল। তবে রুমের ভেতরে ঢুকতে গিয়ে চরম সংকোচ গা জড়িয়ে ধরল। দরজা খুলে একসেকেন্ডে যতটুকু দেখা যায়, ততটুকু দেখে চোখ সরিয়ে নিল। অগোছালো রুম! ফ্লোরে কাপড়-চোপড়সহ টুকটাক অনেককিছু পড়ে আছে। আর বিছানায় পড়ে আছে হৃদ। গায়ে কিছু নেই। কোমর অবধি কম্ফোর্টার। উবু হয়ে শুয়ে আছে সে।
ভেতরে ঢোকা উচিত হবে কি? একা একজন ছেলের রুমে এভাবে ঢুকে পড়া তো চরম বেয়াদবি! সাঁঝ আদব দেখাতেও পারল না। তার দশটা না, পাঁচটা না.. একটা মাত্র বর কি না! লজ্জা সংকোচ সব জানালা দিয়ে ছুঁড়ে ফেলে সে ইভকে নামিয়ে রুমে ঢুকে পড়ল।
হৃদ ঘুমে আছে না-কি অচেতনতায়, ঠিক টের পেল না সাঁঝ। তাকাবে না তাকাবে না করেও তিন কবুল ও রেজিস্ট্রি করা কাবিনের দোহায় দিয়ে কাঁপা কাঁপা হাতটা নিয়ে প্রথমে হৃদের কপালে রাখল, এরপর গলায়। ঘামছে শরীর। জ্বরও আছে।
নড়েচড়ে উঠল হৃদ। আচ্ছা! মরে-টরে যায়নি তারমানে। সাঁঝ বড়ো করে শ্বাস ফেলল। এরপর কোমরে ওড়না গুঁজে ছুট লাগাল রান্নাঘরে। মিনিট পনেরোর মধ্যে স্যুপ বানিয়ে নিয়ে এগিয়ে এলো। হৃদের পাশে বসে তাকে ডাকল,
-“এই? উঠুন! উঠুন না!”
হৃদের ডাকশোনা জবাব এলো,
-“হুউম্ম?”
-“উঠবেন একটু?”
-“উম..”
-“আচ্ছা।”
সাঁঝ নিজেই টেনে-টুনে তাকে আধশোয়া হয়ে বসালো। আর এতে সাঁঝের অন্তরআত্মা চিল্লিয়ে বলতে লাগল,
-“আম্মা খাইতে বলতো না? খাইতি না ক্যা? গতরের অবস্থা কী বানাইছিস? জামাইয়ের ভার নিতে পারো না তুমি কচুর বউ! তোর তো বিবাহ বসারই অধিকার নাই। ছ্যাহ।”
মনের দুঃখের সাথে আপস করে সাঁঝ দীর্ঘশ্বাস ফেলল। এরপর হৃদকে স্যুপটুকু খাইয়ে একটা ওষুধও গিলিয়ে দিলো। তারপর আবার শুইয়ে দিয়ে পুরো বাড়ি সংস্করণের দায় তার সাতচল্লিশ কেজি শরীরের কাঁধে তুলে নিল।
ঘন্টা খানেক পরের ঘটনা। হৃদের জ্বর ছাড়ছে প্রায়। ঘেমে নেয়ে একাকার। গায়ের কম্ফোর্টার কখন যে ফ্লোরে ছুঁড়ে ফেলেছে সে জানেই না। কিছুক্ষণ ওভাবেই তাকিয়ে রইল হৃদ। সামনে দিয়ে কিছু তো ছুটছে। চঞ্চল কিছু। বিরতিহীন কিছু। বুয়া চলে আসছে নাকি? বুয়ার তো সে থাকাকালীন এই রুমে ঢোকা নিষেধ। এ কে?
হৃদ উঠে বসল। আর তারপর কিছুক্ষণ যেন সিনেমা দেখে গেল। অস্পষ্ট চোখ দুটো স্পষ্ট হওয়ার আগ মুহূর্তে তার চির ব্যাচেলর রুমে মেয়েলি ছায়া ঘুরতে দেখে প্রথমত হকচকিয়ে গেল। থমকানো গলায় শুধাল,
-“তুমি?”
সাঁঝ মোটেও বিচলিত হলো না। ফ্লোরে রাখা কাপড়গুলো ভাঁজ করে কাবার্ডে রাখতে রাখতে বলল,
-“হ্যাঁ। উঠেছো?”
সাঁঝ হাতের কাজ সব একপাশে ফেলে রেখে এগিয়ে এলো, হৃদের কাছে এসে বলল,
-“দেখি! জ্বর কমেছে কি না।”
হৃদের জবাবের আশায় যে সে থেকেছি, তা চরম মিথ্যে। নিজ উদ্যোগে নৈকট্য বাড়িয়ে নিল। কপালে ও গলায়, শেষে বুকে! ক্রমান্বয়ে হাতের উলটো পিঠ ছুঁইয়ে জ্বরের পরিমাপ করে একটু শান্ত হলো,
-“হুম্ম, কমেছে। থার্মোমিটারে তাও একটু চেক করি।”
হৃদ শ্বাস আটকে বসে রইল। মস্তিষ্কে ঝড় বইছে তার। বুকের ভেতরটা অশান্ত। নিঃশ্বাসে প্রিয় নারীর সুগন্ধি! মরন সুখ যেন! অসুস্থতার ঘোর বড়োই সাংঘাতিক। মন যা চায়, তা সামনে এনে দেয়, তা দেখতে দেয়, তা অনুভব করতে দেয়। বড়ো আশ্চর্যজনক কথা এ-ই, হৃদ তীব্র ঘ্রাণের সাথে অসহনীয় স্পর্শও পাচ্ছে।
সাঁঝ ওষুধের বক্সেই থার্মোমিটার পেয়ে গেছিল, তা মুছে সরাসরি হৃদের মুখের সামনে তুলে বলল,
-“হা করো।”
হৃদের মুখটা কিঞ্চিৎ হা হয়েই আছে বটে, কিছু করার প্রয়োজন পড়ল না। সাঁঝ থার্মোমিটারটা মুখে ঢুকিয়ে দিয়ে বলল,
-“ধরে রাখো।”
এরপর আবার কাপড় ভাঁজ করায় মনোযোগী হয়ে উঠল। সেদিকে পূর্ণ মনোযোগ রেখে বলল,
-“কাল আমাকে বলতে তোমার বৃষ্টিতে ভিজলেই জ্বর আসে, আমি ক্যাফেতে বসে জ্যোৎস্নায় ভিজে আলোচনা করার প্ল্যান বানাতাম। তুমি আমাকে কিছুই বলো না। আচ্ছা.. আমাকে বলবে না তো কাকে বলবে? বলো? ইশ! কী অবস্থা করেছো নিজের। গতকালই দেখলাম হ্যান্ডসাম থার্টিকে। একরাতের ব্যবধানে আজ সত্যি সত্যি পঞ্চাশের বুড়ো কাকু হয়ে গেছো। এই জানো, তোমার নাম আমার কন্ট্যাক্টে সুগারড্যাডি দিয়ে সেভ করে রেখেছিলাম। কয়েকদিন আগে চেইঞ্জ করে জামাই নাম্বার ওয়ান দিয়েছি। ভালো লাগছে না এখন, আবার চেইঞ্জ করব ভাবছি। কী দিব? বলো?”
সাঁঝ জবাবের আশায় হৃদের দিকে তাকাল। দেখতে পেল থার্মোমিটার মুখে নিয়ে হৃদ কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে বসে আছে। সাঁঝ মুচকি হাসল। এগিয়ে গিয়ে থার্মোমিটার মুখ থেকে খুলে চেক করল। জ্বর ৯৯ এর ঘরে আছে। কমেছে। আরও কমে যাবে। স্বস্তি পেয়ে সাঁঝ বলল,
-“কী যেন বলছিলাম? ওহ! নাম নিয়ে.. গতরাতে ভেবেছিলাম নাম্বার ওয়ান শাকিব খান দেবো। আমি আবার শাকিব খানের ফ্যান। কিন্তু তোমাকে ভালো দেখাচ্ছে না। আসো গোসল করিয়ে দেই।”
হৃদ কী বলবে ভেবে পাচ্ছে না। শব্দ হারাচ্ছে। শুধু তাকিয়ে আছে হাভাতের মতো। তার সাথে কী হচ্ছে এসব? যা হচ্ছে তা আদৌও সত্য না-কি বিভ্রম, কিছুই সে টের পাচ্ছে না। কী একটা অবস্থা! কী আজব অবস্থা! সত্য হওয়ার সম্ভাবনা শূন্যের কোঠায়। এতকাল যা হয়নি, চাওয়া মাত্রই তা পেয়ে যাওয়া মানে যেন মরুভূমিতে মরিচীকা!
হৃদ বিভ্রম ভেবে দীর্ঘশ্বাস ফেলল। সকাল থেকে এ অবধি বহুবার সাঁঝকে তার ঘরে এমন কাজ করতে কল্পনা করা তার হয়ে গেছে। কিন্তু এবার খুব বিশ্লেষণের সাথে ঘটছে, খুব সূক্ষ্মভাবে। অনেক বাস্তবিক!
অতঃপর যা হচ্ছে, তা নেহাত মন্দ নয়; বরঞ্চ হতে থাকুক। হৃদ গালে হাত রেখে তা দেখে যাচ্ছে। তার কল্পনায় সাজানো সংসার এত গোছানো!
সাঁঝ কথা বলে যাচ্ছে,
-“ডাক্তার সাহেব, শোনো। রাতে কী খাবা? ভাত খাবা?”
-“না।”
-“খিচুড়ি? খিচুড়ি আর মাংসের কোনো আইটেম করি?”
-“আচ্ছা, করো।”
-“তোমার নাকি ভাজাপোড়া খেতে ইচ্ছে করছে? বেগুন ভাজা আর মাছ ভাজা করি? এলার্জি আছে?”
-“না, নেই।”
-“ঠিক আছে। আজকে তুমি অমৃত খাবে, বুঝলে। নিশ্চয়ই তোমার পূর্বপুরুষ অনেক পূণ্য করে গেছেন। এজন্য আমার হাতের রান্না খাওয়ার ভাগ্য তোমার হচ্ছে। আমি কিন্তু অনেক ভালো রান্না করি। এখন খেতে না পারলে সেটা লোকের ব্যর্থতা। তবে তোমাকে খেতেই হবে। কারণ আমি বানিয়েছি। আমার মনে হয়, আজকের খাবার সারাজীবন তোমার জীভে লেগে থাকবে। ভুলতেই পারবা না…”
সাঁঝ কথা বলতে বলতে কাবার্ডের নিচে ফেলে রাখা বক্সটা টান দিলো। সেখানেও কিছু কাপড় বের হয়ে এলো। সেগুলো ভাঁজ করতে করতে দেখা মিলল আজব কিছু জিনিসের। এগুলো মেয়েলি জিনিস! হৃদ স্তব্ধ বনে গেল। বিরবির করে বলল,
-“ওহ শিট!”
অবিশ্বাস্য চোখে কিছুক্ষণ নেড়েচেড়ে জিনিসটাকে দেখে, সাঁঝ কাঁদো কাঁদো গলায় বলে উঠল,
-“বাড়িতে মেয়ে আনো?”
সাঁঝের হাতে ঝুলছে লাল রঙের ইনার। হৃদ থতমত খেয়ে পালাক্রমে সাঁঝের মুখের দিকে ও হাতের দিকে তাকাল। কল্পনায় তো সুন্দর সুন্দর জিনিস ঘটে। এত বাস্তবিক কল্পনায় না-হয় মেয়েটা তাকে একটা চুমুই খেতে পারত? অথচ তা না হয়ে এটা কী হচ্ছে? এমন লজ্জাজনক কল্পনা কে করে ভাই?
হৃদের কলিজা ছিঁড়ে যাচ্ছে। পরিস্থিতি সামাল দিতে ভীষণ অসহায় গলায় বলতে লাগল,
-“ট্রাস্ট অন মি, তুমি ছাড়া কেউ নেই আমার লাইফে।”
সাঁঝের গলার স্বর আরও করুণ হয়ে উঠল,
-“তাহলে তুমি পরো এগুলো?”
প্রেম ও অসুখ পর্ব ১২
জ্বরাক্রান্ত অবস্থায় হৃদ লাফিয়ে উঠল। সাঁঝের হাত থেকে ওগুলো নিয়ে লুকোতে গিয়ে দু-বার উষ্টাও খেল। শেষমেষ তা ট্রাউজারের পকেটে লুকিয়ে ফেলে এদিক-ওদিক তাকিয়ে এবার নিজেকে লুকোনোর জায়গা খুঁজতে লাগল। থমথমে মুখে বলল,
-“আমার লাস্ট বার্থডেতে এক হারামি বন্ধু গিফট করেছিল। এভাবে তাকিয়ে আছো কেন আমার দিকে? প্লিজ চোখ সরাও। আমি লজ্জা পাচ্ছি।”