প্রেম ও অসুখ পর্ব ২৩
নবনীতা শেখ
যাও পাখি বলো, হাওয়া ছলো ছলো
আবছায়া জানালার কাঁচ।
আমি কি আমাকে, ভুলিয়েছি বাঁকে
রূপকথার আনাচে কানাচ…
সাঁঝের গলার স্বর বেশ অন্যরকম। সে উচ্চস্বরে চিৎকার চেঁচামেচি করলেও রুমের অপরপ্রান্তের মানুষটি শুনতে পারে না। আর ফিসফিস করে কথা বললে তো বিছানার পাশের মানুষটিও হা হয়ে থাকবে। মাঝেমধ্যে হৃদের মনে হয়, মেয়েটা বকাঝকা করলেও যেন গলা দিয়ে মধু বের হয়। এমনই মধু নিয়ে গান গাইছে সাঁঝ।
শ্যামগায়ে ল্যাভেন্ডার রঙের তাঁতের শাড়ি। হাতে দুটো সোনার কাঁকন। একটু আগেই এই বৃষ্টিতে ভিজে গোসল করেছে সে। ভেজা চুলগুলো শাড়ি ভিজিয়ে দিচ্ছে। খামখেয়ালি সাঁঝের সেদিকে খবর নেই।
সে নির্নিমেষ চোখে সামনে তাকিয়ে রইল, ডান হাতটিও এগিয়ে দিলো ঠিক সামনে। বৃষ্টির বড়ো বড়ো ফোটাতে হাতের মুঠো ভরে এলো। তার দুইচোখে ভেসে উঠল প্রবল উচ্ছ্বাস।
আচমকা একটি হাত তার পাশ ঘেঁষে সামনে এগিয়ে গেল, তার হাতের নিচে সেই হাতটা.. পরিমাপে বড়ো, অনেকটা ব-ড়ো। সাঁঝ ভোখ বন্ধ করে ফেলল। বাতাসের সাথে ভেসে বেড়াচ্ছে সোঁদা মাটির গন্ধের সাথে প্রিয় পুরুষের নেশা ধরিয়ে দেওয়া ঝাঁজালো সুঘ্রাণ। সাঁঝ মিহি হেসে ঢলে পড়ল তার বুকের ’পরে,
-“আপনাকে এত আমার আমার লাগে..”
বিপরীতে গম্ভীর পুরুষটি স্মিত হেসে আরেকটু কাছে এগোল, কানের কাছে ছোট্ট একটা চুমু খেয়ে বলল,
-“আ’ম অল ইওয়োর্স…”
বৃষ্টির ছিঁটে দিক পরিবর্তন করে মুহূর্তেই ভিজিয়ে দিলো তাদের দুইজনকে। হৃদ তার নীরস আওয়াজে বলল,
-“রুমে চলো।”
সাঁঝ মাথা নাড়ল,
আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন
-“উঁহু। এখানে ভালো লাগছে।”
-“আচ্ছা।”
-“আপনি রুমে যেতে পারেন।”
-“আপনার সাথে ভালো লাগছে।”
সাঁঝের হাসি প্রশস্ত হলো। সে ডাকল,
-“হৃদ?”
-“শুনছি।”
-“ধরো, কেউ তোমাকে খুব খুব খু-ব ভালোবাসল। আর সেই কেউটা আমি নই। তুমি কী করবে তখন?”
হৃদ বুঝতে পারল সাঁঝ কী বলতে চাইছে। সে থুতনিটা ঠেকিয়ে রেখেছে সাঁঝের মাথার ওপর। তার হাতের ওপর রাখা হাতটার দিকে তাকিয়ে থেকে নির্দিষ্ট মানবীর নামটা উল্লেখ না করেই বলল,
-“যেমনটা এতদিন করেছি, তেমনটাই করে যাব। ভালোবাসা ব্যাপারটা বড়ো দ্বিপক্ষীয়। এখানে তৃতীয় কারো স্থান নেই। যদি আসে, তার কষ্ট পাওয়াটা প্রকৃতির অলিখিত ও নির্ধারিত নিয়ম।”
সাঁঝ চোখ দুটো খুলল৷ হাসি মিলিয়ে এসেছে তার, আওয়াজে বেশ মলিনতা,
-“পরে তো আমি এসেছি…”
হৃদ তার অসম্পূর্ণ কথার মাঝেই বলে উঠল,
-“উঁহু.. ভুলেও তা ভাববে না। আমি স্ট্রেইট এন্ড স্ট্রিক্টলি তোমার। আমার ত্রিশ বছরের লাইফে তুমি ছাড়া কেউ ছিল না, আসবেও না। আই সয়্যার। ট্রাস্ট মি।”
সাঁঝের বুকের ভেতরের গুমোট ভাবটা কোথায় যেন গায়েব হয়ে গেল। আর ঊর্মি? তারা প্রথমে ভালোবেসেও তৃতীয়পক্ষ কেন যে হয়ে যায়! মনে যে জায়গা করে নেয়, কপালে সে কেন থাকে না?
অন্যমনস্ক সাঁঝকে ফিসফিসিয়ে ডাকা হলো,
-“সন্ধ্যা?”
চকিতে সাড়া নিল সাঁঝ,
-“হুঁ?”
-“ভালোবাসি।”
পর পর আঁচলের ফাঁক গলিয়ে তার পেটে এক ভেজা হাত আলতোভাবে ছুঁয়ে গেল। পুরো শরীর ঝনঝন শব্দে বেজে উঠল তার। চোখ খুলে এদিক-ওদিক তাকাল। হৃদ ততক্ষণে দৃষ্টির অলক্ষ্যে। সাঁঝের পা মেঝের সাথে জমে গেছে। সে নড়াচড়া করতেও পারছে না..
অদিতি তখন সদ্য কিশোরী, বয়স তেরো, বিন্দুবাসিনী গার্লস স্কুলের অষ্টম শ্রেণীর ছাত্রী। গায়ের রংয়ে উপচে পড়া লজ্জা, দুই চোখে ইতস্ততভাব। ঠোঁট লেপটানো অদম্য হাসিতে সংকোচ, জড়তা, ধরা পড়ে যাওয়ার ভয়। কারণে, অকারণে বারংবার ছুঁটে আসে প্রিয় সখীর আঙিনায়। বুকের ভেতরটার ধুকপুকানি উচ্ছ্বাসে ব্যস্ত থাকে। লুকিয়ে-চুরিয়ে দেখতে থাকে এক যুবককে। অর্ণব! সাঈদুজ্জামান অর্ণব।
অর্ণব লোকটা বড়ো সুপুরুষ। গায়ের রঙ উজ্জ্বল শ্যামলা, উচ্চতায় পাঁচ ফুট এগারো, চোখদুটো সরু, ঠোঁটে সর্বদা ভেসে থাকে স্বভাবজনিত ভদ্রতাসূচক হাসি। অজ্ঞাত কারণবশত অদিতিকে দেখলেই সেই হাসিটা কমে বিলীন হয়ে যায়। অদিতির তখন বুকফেটে কান্না পায়। কেন সে তার হাসির কারণ হতে পারে না? কেন কেন কেন?
সব কেন এর উত্তর থাকে না। ঠিক যেমনটা উত্তর নেই কেন অর্ণব অদিতিকে ফেলে উপমাকে বেছে নিল। ঠিক যেমনটা উত্তর নেই, কেন উপমা অর্ণবকে ফেলে বাবা-মায়ের পছন্দ করা ছেলেকে হুট করেই বিয়ে করে ফেলল!
অদিতি দীর্ঘশ্বাস ফেলল। কিছুক্ষণ আগেই সাঁঝ উচ্ছ্বসিত হয়ে লাফাতে লাফাতে তিনতলা থেকে দোতলায় এসে অদিতিকে বলে,
-“বন্ধু অদি, আমাদের জন্য একটা খবর আছে। আমার জন্য সুখবর আর তোমার জন্য দুঃখখবর। তুমি কি শুনতে চাও?”
প্রথমত অদিতি ভেবে পেল না, কী এমন খবর হবে! প্রতিক্রিয়াহীন চোখ সে সামান্য কুঁচকে শুধায়,
-“কী? তোর ফুপু শ্বাশুড়ির ইন্না-লিল্লাহ হইছে?”
থতমত খেয়ে সাঁঝ বলে,
-“কী অদ্ভুত! তোর এমন কথা কেন মনে হলো? এটা আমার জন্য সুখবর? আচ্ছা.. মানলাম সুখবর। কিন্তু তোর জন্য দুঃখের কেমনে? কানেকশন কী?”
অদিতি দম ফেলে বলল,
-“আমি আবার লোকের মৃত্যু নিতে পারি না। তাই কষ্ট পাব।”
সাঁঝ মাথা ঝাপটে ওর সব কথাগুলো একপাশে ফেলে এবার সরাসরি প্রসঙ্গে চলে এলো,
-“টপিকটা আসলে উপমাকে নিয়ে।”
অকস্মাৎ উন্মাদনায় অদিতির বুকের ভেতরটা ধক করে উঠল। অবিশ্বাস্য চোখে তাকিয়ে বলল,
-“বিয়ে করে ফেলেছে?”
সাঁঝ মাথা নাড়ল,
-“হ্যাঁ। গতরাতে বাসরও ডান।”
প্রথমদিকে বিষয়টাকে খুব স্বাভাবিকভাবে গ্রহণ করলেও পরক্ষণে তার মনে হলো, কেউ তার বুকের ওপর দশ মণ ওজনের পাথর চাপা দিলো মাত্র। নিঃশ্বাস নিতে এত কষ্ট হলো! তার কিশোরী আবেগে ভাটা পড়ল। তার মনে হলো, এরচেয়ে মৃত্যু ভালো ছিল। প্রিয় বন্ধুর সাথে প্রিয়তম! এমন অদ্ভুত মেলবন্ধন কি খুব জরুরি ছিল? অন্য কারো ছায়াও যার ওপর মানতে নারাজ ছিল অদিতি…
তার ধারণা সাঁঝের পরবর্তী কথাটাতে একশত আশি ডিগ্রি এঙ্গেলে উলটে গেল, সাঁঝ বলল,
-“উপমার ফুপাতো ভাই, বুঝলি! ওর ফুপু নাকি আগেই প্রস্তাব দিয়ে রেখেছিল। আংটিও পরিয়ে রেখেছিল একসপ্তাহ আগে। বিয়ে হলো আগামীকাল।”
অদিতি একটু আগে যতটা না চমকেছিল, তার চেয়েও কয়েকগুণ বেশি চমক নিয়ে শুধাল,
-“তুই উপমার কেমন বোন হস? ফুপাতো না?”
-“আরেহ নাহ! মামাতো। আম্মু-আব্বুর সাথে ফুপির একটু ঝামেলা আছে, বুঝলি। এজন্য বিয়েতে ইনভাইট তো দূরের কথা, বলেওনি। কিন্তু উপমা যে কেন বলল না! যাই হোক, আমার জন্য সুখবর হলো, আমার সার্কেলে আগে একমাত্র ম্যারিড আমি ছিলাম, এখন পাল্লা ভারি হলো। আর তুই একাই সিঙ্গেল রয়ে গেলি। অদি? একটা প্রেম করিয়ে দেই তোরে? আমার ফ্রেন্ড রাঈন আছে না? ওর অনেকগুলো হ্যান্ডসাম ছেলেফ্রেন্ড আছে। কথা বলবি? শোন ওরা…”
সাঁঝ আরও অনেক কথা বলে গেল, যার একটিও অদিতির কানে গেল না। সে বসে পড়ল বিছানার ওপর। অন্যমনস্কভাবে বলতে থাকা সাঁঝের কথার মাঝখানেই শুধিয়ে উঠল,
-“তোর ভাই কই?”
সাঁঝ ঠিক বুঝতে পারেনি, তাই জিজ্ঞেস করল,
-“কী?”
-“তোর ভাই..”
-“হ্যাঁ, ভাই। কী হয়েছে ভাইয়ার?”
-“সে কই?”
-“কীজানি! আমি বাপ রেগে আছি। কথা বলি না।”
-“কল দে।”
-“কেন?”
-“দিতে বলেছি, দে।”
সাঁঝ লক্ষ করল, অদিতির ফরসা মুখটা কেমন লাল হয়ে এসেছে, চোখ দুটোও রক্তাভ! তার হাত-পা কাঁপছে। একটু আগে তো অদিতির ভালোবাসার মানুষকে হারানোর কষ্ট হচ্ছিল, এখন মরন যন্ত্রণা হচ্ছে। তার ভালোবাসা ভালো নেই। অথচ সাঁঝ এসবের কিছু বুঝতে পারল না। একতরফাভাবে কাউকে ভালো না বাসলে এই যন্ত্রণার একাংশও টের পাওয়া যায় না।
সাঁঝ প্রশ্ন করতে করতে কল লাগাল,
-“তুই ঠিক আছিস, অদি? কী হয়েছে? আমাকে বল। ভাইয়া কী করেছে? কিছু বুঝতে পারছি না।”
অদিতি ছলছল চোখে তাকিয়ে থাকল, প্রশ্নের উত্তরে অন্য কথা বলল,
-“আল্লাহর ওয়াস্তে আমাকে কোনো প্রশ্ন করিস না, সাঞ্জি। কল রিসিভ করলে তোর ভাই কোথায় আছে, কী করছে এসব জিজ্ঞেস কর।”
-“হু? হু.. আচ্ছা।”
সাঁঝের সব কেমন গোলমেলে লাগছে। অর্ণব রিসিভ করল শেষ রিংয়ে, ছোট্ট করে বলল,
-“হু, সাঞ্জি.. বল।”
অর্ণবের আওয়াজে অসম্ভব নমনীয়তা, মলিনতা। সাঁঝ নরম স্বরে শুধাল,
-“ভাইয়া? ভালো আছিস?”
-“হু। তুই?”
-“আমিও ভালো। কী করিস?”
-“কিছু না। বসে আছি।”
-“বাড়িতে?”
-“না।”
-“কোথায়?”
-“গাজিপুর।”
-“গাজিপুরে? তোর বন্ধুর বাড়িতে?”
-“হ্যাঁ।”
-“ওমা! ওখানে কী করিস?”
-“ঘুরতে এসেছি।”
-“ওও! আচ্ছা, খবর পেয়েছিস?”
অদিতি হতবিহ্বল হয়ে তাকাল, মেয়েটা এভাবে কী খবর পাওয়ার কথা জিজ্ঞেস করছে তা বুঝতে সময় লাগেনি। তবে অর্ণব কি কষ্ট পাবে না এটা শুনে? সে দম আটকে অর্ণবের জবাবের অপেক্ষায় রইল।
সে বলল,
-“কোনটা?”
-“তোর ফুপাতো বোনের বিয়ের?”
-“ওহ! হ্যাঁ।”
ওহ! তারমানে ইতোমধ্যে কষ্টটা পেয়ে গেছে। এখন বিষ হজম করতে না পারার কষ্টে কাতরাচ্ছে। সাঁঝ বলল,
-“ওর বিয়ের অনুষ্ঠান হয়নি তো। রিসিপশন হবে আগামীকাল। ও ইনভাইট করেছে। ভাবছি, যাব। তুই যাবি?”
-“না।”
-“এহ! কেন?”
অর্ণব প্রসঙ্গ পালটে ফেলল,
-“সাঞ্জি, আমি একটু কাজ করব। তোকে পরে কল দেই?”
-“আচ্ছা.. ভাইয়া! শোন না।”
-“হু?”
সাঁঝ মিনমিনে স্বরে শুধাল,
-“তোর কি মন খারাপ?”
-“হুঁ।”
-“খুব বেশি?”
-“অল্প।”
-“তোর মন খারাপ দ্রুত কেটে যাক।”
তারপর কলটা কেটে দিয়ে অদিতির পাশে বসে পড়ল। কিছুক্ষণ বাদে যখন অদিতি যখন সাঁঝের দিকে তাকাল, দেখতে পেল মেয়েটার চোখ দিয়ে অঝোরে জল গড়িয়ে পড়ছে। অদিতি নিজেও কাঁদছে। কান্নাভেজা গলায় জিজ্ঞেস করল,
-“তুই কাঁদছিস কেন?”
সাঁঝ ওর দিকে তাকিয়ে বলল,
-“তুই জানতিস, ভাইয়া উপমাকে পছন্দ করত?”
ওপর-নিচ মাথা নাড়ল অদিতি,
-“হ্যাঁ।”
-“আর উপমা? সে-ও করত?”
-“হ্যাঁ।”
-“আমাকে বলিসনি কেন?”
-“সরি!”
অদিতির কান্নার বেগ বাড়তে লাগল। সাঁঝ ওর মাথায় হাত বুলিয়ে বলল,
প্রেম ও অসুখ পর্ব ২২
-“কাঁদিস না। এখন আমাদের হাতে কিছু নেই। আমি যদি আগে জানতাম, যেভাবেই হোক, ওদের বিয়ে দিতাম।”
সাঁঝ অর্ণবের দুটো দীর্ঘশ্বাস আর মলিন স্বরে তার ভালোবাসাটা বুঝে ফেলল। অথচ অদিতিকে তার চোখের সামনে দিনের পর দিন কষ্ট পেতে দেখেও, তার সামনে বসে তারই ভাইয়ের জন্য কাঁদতে দেখেও, কেন অদিতির ভালোবাসা টের পেল না? কী জানি, কেন! হয়তো প্রকৃতি কারো কারো ক্ষেত্রে অবিচার করতেই ভালোবাসে ভীষণ।