প্রেমতৃষা পর্ব ২৩

প্রেমতৃষা পর্ব ২৩
ইশরাত জাহান জেরিন

জিনজিরার নেওয়াজ কুঠিরের ছাদে দাঁড়ালে বোঝা যায়, এই পুরোনো দালানের প্রতিটি ইট শত বছরের কাহিনি বয়ে বেড়াচ্ছে। ইটের গায়ে শ্যাওলা, কোথাও কোথাও পুরোনো রেলিংয়ে মরচে ধরেছে, তবু তার মধ্যেই রাজকীয়তার ছাপ। চারদিক জুড়ে বুড়িগঙ্গার বাতাস এসে ছুঁয়ে যাচ্ছে। বিকেলের আলো ধীরে ধীরে নরম হয়ে এসেছে। সূর্য পশ্চিমে হেলে পড়েছে, তার লালচে আভা মিশে গেছে আকাশের বেগুনি আর নীলের সাথে। দূরে নদীর ওপারে ছায়া নেমে আসছে, পাখিরা ঝাঁক বেঁধে ঘরে ফিরছে। এই ছাদের কার্নিশেই বসে আছে তৃষা আর প্রেমা। নিচে তাকালে দেখা যায়, সরু গলিঘুঁজি, টিনের চাল, আর ধোঁয়া ওঠা চায়ের দোকান। ওপরে কিন্তু অন্য জগৎ। একটা শান্ত, স্নিগ্ধ, গভীর আবহ।

তৃষার খোলা চুল বাতাসের সঙ্গে দোল খাচ্ছে। প্রেমা তার পাশেই দাঁড়িয়ে আছে। সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে নাচ দিবে প্রেমা। তৃষাকে বলার পর সে সাহায্য করবে বলেছে। ছাদে নাচের অনুশীলন করেছে একটু আগেও। এখন একটু বিরতি। দু’জনেই মোটামুটি ক্লান্ত। আজকে প্রেমা বড়দের মতো কথা বলছে। সদ্য শেষ করা কোরিয়ান ড্রামার এমন হৃদয় বিদারক সমাপ্তি তার মেনে নিতে বেশ কষ্ট হচ্ছে। প্রেমা তৃষাকে বলল, ” দেখো, সূর্যটা কেমন ডুবে যাচ্ছে। সূর্য ঠিক ভালোবাসার মতোন। কখনো আলো দিয়ে যায়, উষ্ণতা দিয়ে যায়, তারপর হারিয়ে যায় অন্ধকারের ভেতর।”

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

‘কিন্তু তুমি কি খেয়াল করছো না, সূর্য ডুবলেও আবার ভোরে ফিরে আসে? ভালোবাসাও তাই… হারালেও ফের জন্ম নেয়। হয়তো অন্য রূপে, অন্য মানুষের মাঝে।”
প্রেমা কিছুটা থেমে, গভীর দৃষ্টিতে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করল, ” তাহলে কি তুমি বলতে চাইছো ভালোবাসা কখনো শেষ হয় না?”
“হয় না। মানুষ শেষ হয়, সম্পর্ক শেষ হয়, সময়ও বদলায়, কিন্তু ভালোবাসার ওই অনুভূতি… সেটা থেকে যায়, একধরনের অমর হয়ে। যেমন এই কুঠিরটা—জরাজীর্ণ হলেও কত যুগের গল্প বাঁচিয়ে রেখেছে।”
প্রেমা মৃদু কণ্ঠে বলল, “কখনো কখনো মনে হয়, ভালোবাসা মানেই কেবল ব্যথা। যতটুকু পাই, তার চেয়ে বেশি হারাই।”

তৃষা আকাশের দিকে তাকিয়ে বলল, ‘ না। ভালোবাসা মানেই দেওয়া। ব্যথাটা আসে কারণ আমরা প্রতিদান চাই, আমরা চাই সেটা আমাদের মতো করেই টিকে থাকুক। কিন্তু ভালোবাসা তো স্বাধীন… ওকে বাঁধা যায় না।”
প্রেমা চোখ নামিয়ে ফিসফিস করে বলল, “তুমি কি মনে করো কেউ আমাকে ঠিক ততটাই ভালোবাসতে পারে, যতটা আমি পারি?”
তৃষা কিছুক্ষণ চুপ থেকে চোখ আকাশের দিকে তুলে জবাব দিলো, “হয়তো না। আবার হয়তো হ্যাঁ। ভালোবাসার হিসাব হয় না, প্রেমা। তুমি যতটা দিবে, সেটা তোমার। কেউ যদি কম দেয়, সেটা তার। কিন্তু ভালোবাসার সত্যিটা হলো, যতটুকুই হোক, যদি তা সত্যি হয়, তাহলে সেটাই যথেষ্ট।”
“তাহলে তুমি বলছো অসম্পূর্ণ ভালোবাসাই পূর্ণ?”

“হয়তো। যেমন এই আকাশটা। পুরোটা দেখা যায় না কখনো, তবু আমরা তার সৌন্দর্যে মুগ্ধ হই। ভালোবাসাও তেমনই, প্রেমা… অসম্পূর্ণতার ভেতরেই পূর্ণতা লুকিয়ে থাকে।”
হাওয়া আরও জোরে বয়ে যায়, তাদের দুজনার চুল দুলে ওঠে। ছাদের বাতাস তখন একটু শীতল হয়ে এসেছে। সূর্য প্রায় অস্ত গেছে। বুড়িগঙ্গার ওপার থেকে ঘন অন্ধকার ধীরে ধীরে ভেসে আসছে। প্রেমা তখনো কার্নিশে বসে আঙুল দিয়ে শ্যাওলা ধরা ইট খুঁটছে। তৃষার দিকে চেয়ে কিছুক্ষণ চুপ করে রইল। তারপর হঠাৎ নরম স্বরে বলল, “একটা প্রশ্ন করব?”

“করো, শুনছি।”
“তুমি কি কাউকে ভালোবাসো? মানে, কারো জন্য কখনো বুক ধড়ফড় করেছে? কারো নাম শুনলেই চোখ ঝলমল করে উঠেছে?”
তৃষা মুহূর্তেই থমকে যায়, তারপর চোখ সরিয়ে নেয়, “এইসব প্রশ্ন কেন হঠাৎ? ভালোবাসা… মানে… সেটা তো সহজে বলা যায় না।”
প্রেমা হাসি চেপে রেখে বলল, “কেন? ভালোবাসা তো একটা সত্যি অনুভূতি। সত্যিটা লুকিয়ে রাখলে তো সেটা মরেও যেতে পারে। বলো আছে কি তোমার জীবনে কেউ?”
তৃষা গভীর নিশ্বাস ফেলে বলল, “আছে কি নেই… সেটা বলা মুশকিল। কখনো মনে হয় আছে, আবার কখনো মনে হয় শুধু কল্পনা। আমি ভয় পাই, যদি বলে দিই, হয়তো হারিয়ে ফেলব।”
প্রেমা কাছাকাছি সরে এসে বলল, “ভালোবাসা বলে ফেলার জন্য নয়, বেঁচে থাকার জন্য। তুমি যদি চুপ করে থাকো, তোমার অনুভূতি কি মরে যাবে না? তুমি কি চাইবে ভালোবাসা তোমাকে কষ্ট দিক, অথচ যার জন্য, সে কিছুই না জানুক?”

তৃষা চোখ নামিয়ে ফিসফিস করে বলল, “কিছু ভালোবাসা আছে, যেগুলো বলা যায় না। বলা মানেই ভেঙে যাবে।”
প্রেমা চোখ স্থির করল, “তা হলে কি তুমি নিজের ভেতরটা কবর দিতে চাও? তুমি কি মনে করো ভালোবাসা লুকিয়ে রাখা মানেই সেটা রক্ষা করা?”
তৃষা একটু থেমে, হালকা অভিমান নিয়ে বলল, “হয়তো। হয়তো কিছু ভালোবাসা প্রকাশ না করলেই সে বেশি সুন্দর থাকে। বলা মাত্রই তার জাদু ফুরিয়ে যায়।”
প্রেমা মৃদু হেসে বলল, “তুমি ভুল করছো গো। ভালোবাসা প্রকাশ করলে তা ভাঙে না, বরং আরও শক্ত হয়। ভালোবাসা হলো নদীর মতো। যতই আটকে রাখো না কেন, সে পথ খুঁজে নেবে। তবে তুমি যদি ভেতরে ভেতরে চাপা দাও, একদিন তোমার ভেতরেই বন্যা হবে। তলিয়ে যাবে তুমি, ডুবে মরবে।”
তৃষা কিছুক্ষণ নীরব থাকে। বাতাসে তার চুল উড়ছে। প্রেমা তার দিকে তাকিয়ে থাকে। ধীর কণ্ঠ বলে, “আপু বাকি নাচটা।”

“ওহ হ্যাঁ। আসো শিখিয়ে দেই।”
নেওয়াজ কুঠিরের ছাদে বাতাস তখন কিছুটা ঠাণ্ডা। পশ্চিম আকাশে রোদ প্রায় নিভে এসেছে, আকাশের গায়ে মিশে আছে কমলা, বেগুনি আর সোনালি রেখা।কার্নিশের কাছে দু’টো লণ্ঠন টিমটিম করছে। তৃষা আর প্রেমা দাঁড়িয়ে আছে মাঝখানে। নাচের শেষ অনুশীলন শুরু করার জন্য তৃষা এক হাত তুলে ধরল, আঙুলের ভঙ্গিতে গল্প আঁকতে লাগল।
তৃষা নরম কণ্ঠে বলল, “দেখো প্রেমা, হাতের মুদ্রাটা এভাবে তুলবে। কাঁধ সোজা, চোখ সামনের দিকে… নাচ মানেই শুধু শরীর না, মনে মনে একটা আবেশ তৈরি করা।”

সে একপাশে ঘুরে দাঁড়াল, পায়ের তালু ধীরে ধীরে মেঝেতে ঠুকে দিল। কানের পাশে দুল ঝিকমিক করল, চুল উড়ে এসে গাল ছুঁয়ে গেল। প্রেমা মুগ্ধ হয়ে তাকিয়ে রইল। তৃষার গায়ে কালো রঙের শাড়ি। গাঢ় কালো। যেন আকাশের অন্ধকারকে টেনে এনেছে তার চারপাশে। শাড়ির আঁচল বাতাসে উড়ছে। কখনো তার কাঁধ ছুঁয়ে যাচ্ছে, কখনো পেছনে ভেসে উঠছে। কোমরে শাড়ির ভাঁজ এমনভাবে পড়েছে যে তার সরু দেহরেখা স্পষ্ট হয়ে উঠছে। কার্নিশের আলোয় তৃষার সেই সরু কোমর এক মুহূর্তে যেন চোখ আটকে রাখছে। প্রেমাটাকেও লাল শাড়িটিতে দারুণ লাগছে। নাচের সময় তো শাড়িই পড়তে হবে। তাই শাড়ি পড়ে আগেই অনুশীলন করলে স্টেজে নাচতে কোনো সমস্যা হবে না।

কিন্তু পাশের ছাদে অন্য চিত্র। সেখানে পাঁচ-ছয়জন ছেলে জুয়ার তাস মেলে বসে আছে। ঠোঁটে বিড়ির ধোঁয়া, পাশে রাখা টিনের মগে চা আর চুরুট। খেলা থেমে থেমে তাদের চোখ গিয়ে পড়ছে নেওয়াজ কুঠিরের ছাদের দিকে। একজন ছেলে গলায় হাসি চাপতে না পেরে বলল, “আরে দেখ দেখ… দুইজন হুরপরি নাচছে। কি যুগ এলোরে টাকা না বিলিয়েই নাচ দেখা যায়। কত্তো ভঙ্গি করে!”
অন্যজন বলল, “ওই কালো শাড়িওয়ালীটা একেবারে বাজিমাত! শরীরের বাঁক দেখেছিস? সোনার মতো জ্বলতেছে।”
তৃতীয়জনও হেসে বলল, “ওইটারে যদি একদিন কাছে পাই… নাচ কারে কয় দেখাইতাম।”

তাদের অশ্লীল হাসি ছড়িয়ে পড়েছে বাতাসের সঙ্গে। ধোঁয়ার সাথে মিশে যাচ্ছে সেই শব্দ। সকলের দৃষ্টি তৃষার সরু কোমটার দিকে। শাড়ি ভেদ করা সেই পেটদেশের পদ্মকোষের দিকে। তারা তৃষা-প্রেমার শরীর নিয়ে বাজে মন্তব্যে মেতে ওঠে। তৃষা-প্রেমা তখন নাচের অনুশীলনও ব্যস্ত। ফোনে গান বাজছে তো আশপাশে কি হচ্ছে খবর নেই। ঠিক তখনই ছাদের দরজা খুলে একটা ঝাপসা আলো ভেসে এল। হাতে ঘুড়ির রিল নিয়ে উপরে উঠে এল প্রেম নেওয়াজ আর তার বেস্ট ফ্রেন্ড অংকুর। দু’জনের কাঁধে ঘুড়ির লাঠি, বাতাসে ওড়ানো সুতোয় আঙুলে কাটা দাগ। প্রেমের চোখ পেছন থেকে তৃষার কোমরের ওপর যায়। কেবল যায় না বরং কানে আসে পাশের ছাদের ছেলেগুলোর বিশ্রী সব কথা। প্রেম একটা ঢোক গিলে।ঘাড় ঘুরিয়ে পাশের ছাদের দিকে তাকায়। চোখ মুহূর্তেই কঠিন হয়ে যায়। ছেলেগুলো তখনো হাসছে, কিন্তু প্রেম নেওয়াজের দৃষ্টি পড়তেই অস্বস্তি ছড়িয়ে পড়ে। তৃষা আর প্রেমা তখনো খেয়াল করেনি প্রেমকে। হঠাৎ প্রেম এগিয়ে এসে ফোনের গানটা বন্ধ করে গর্জে উঠল, ‘তোর ম্যাডামকে নিয়ে ঘরে যাহ প্রেমা।”
তৃষা চমকে উঠে পেছনে ফিরতেই প্রেমকে দেখল। কিছু বলতে যাবে তার আগেই প্রেম পুনরায় বলল,” প্রেমা! কানে কথা ঢুকে না?”

প্রেমা জলদি তৃষাকে বলল,”আপু জলদি চলো।”
দুজনে নিচে নামতেই ছেলেগুলোও ভয়ে চোখ অন্যদিকে সরিয়ে নিলো। যেন তারা কিছুই করেনি। প্রেম সম্পর্কে তাদের আইডিয়া আছে। কিন্তু হুট করে যে সে এখানে চলে আসবে তা কেমন করে বুজবে? প্রেম সিগারেট ধরিয়ে ধোঁয়া ছেড়ে অংকুরের পিঠে মৃদু চাপড় দিয়ে বলল, ‘পাশের বাড়ির জুয়াখোরদের সঙ্গে একটু চা-নাস্তার ব্যবস্থা কর তো ভাই।’

তখন সন্ধ্যা। আকাশটা আজকে অন্যরকম সুন্দর। তৃষা রুমে এসে মুখটা ভালো করে দেখে নিলো। ভয় করছে তার। নিজের জন্য তো করছেই সঙ্গে ওই ছেলে গুলোর জন্যও। প্রেম লোকটা আসলেই সাইকো আর জঘন্য ধরনের একজন মানুষ। নেশা করে, মারামারি করে। নিজের যা ইচ্ছে করে। এমন ছেলে কল্পনায় মানায়। সিনেমা, উপন্যাসেই ঠিক আছে। বাস্তবে এদের সঙ্গে অন্তত পক্ষে বসবাস করা যায় না। এই যে প্রেম নামক ব্যক্তিকে নিয়ে যদি একটা গল্প লেখা হতো তাহলে তার জন্য মেয়েলোক এতক্ষণে দেওয়ানা হয়ে যেত। তবে বাস্তব রূপে ওদের ধরে যদি প্রেম ডিম থেরাপি দিতো, জোর করে সবটা হাসিল করে নিতো। ক্ষতর জায়গায় ক্ষত দিতো। সিগারেট দিয়ে কাটা যায়গাটা পুড়িয়ে দিতো বুঝত প্রেম নেওয়াজের উন্মাদনা কতখানি ভয়ঙ্কর!

তবুও সমস্যা একটা আছেই। তুই উন্মাদ থাকবি উন্মাদের মতো। তুই কেন এত হ্যান্ডসাম হবি? তোর থাকবে ভুড়ি তোর কেন সিক্সপ্যাক থাকবে? তুই কেন এত গুনি হবি? পাবলিক ভার্সিটিতে কেন পড়বি? এত বড়লোক কেন হবি? এমন উন্মাদ হলে মেয়ে মানুষের চরিত্র তো নয়ছয় হবে। তখন সব দোষ মেয়ে মানুষের। তৃষার মাথাটাই গরম হয়ে গেল। হঠাৎ দরজায় কে যেন কড়া নাড়ল। প্রেম ভাই নাকি? সে এত সুন্দর করে নক করার মানুষ? সে তো দরজা ভেঙে এসে গালে দু’টো চড় বসিয়ে বলবে, ‘হাই বিটরহার্ট চড়টা খুব আস্তে হয়ে গেল নাকি? আরো দু’টো কষে দেই?’ তৃষা ভেতরে আসতে বললেই প্রত্যুষ তার রুমের মধ্যে প্রবেশ করে দরজা লাগিয়ে বলল, ‘ওমা কোথাও যাওয়া হচ্ছে নাকি? তোমায় তো দারুণ লাগছে।’ তৃষার কেন জানি আজকে আর লজ্জা লজ্জা পেল না। মনটা আজকাল কেমন যেন উশখুশ করে। মনের বোধ-হয় অসুখ করেছে।

“চলো বাইরে ঘুরতে যাই।”
‘এখন?”
‘হ্যাঁ কেন তুমি ব্যস্ত নাকি?”
‘না তো।”
“তাহলে চলো। শাড়িটা বদলাবে না। এটায় তোমায় কিন্তু দারুণ লাগছে।”
তৃষা কিছু বলল না। যেতে ইচ্ছে করছে না তবুও রাজি হয়ে গেল। নইলে মহাজন যদি মুখ বেজার করে? পুরুষ মানুষের মন তো! বোঝা দায়।

গেটের বাইরে তখন তৃষা প্রত্যুষের সঙ্গে করে বাইরে যাচ্ছিলো। তখন বিষয়টা মোখলেস প্রমাণ হিসেবে কয়টা ছবি তুলে রাখে। নইলে হেতিজাকে বলবে কি করে এদের বিয়ে করিয়ে দেওয়া উচিত জলদি। যাক ভেবেছিল বাড়ির ছেলের বউ খুঁজতে কষ্ট হবে। না একজনের সঙ্গী সে নিজেই খুঁজে নিয়েছে। এখন বাকি এই বাড়ির আসল বংশধর। সেই রোমিওর গলায় বউ নামক গোবরের মালাটা পরিয়ে দিতে পারলেই মোখলেসের বড় একটা দায়িত্ব শেষ হবে। ওদিকে দেখো তার বউ নার্গিস রেখে গেছে বাঁদর একটা ছেলেকে। কোথায় থাকে, কি করে আল্লাহ জানে। একেও এইবার একটা বিয়ে না করালেই নয়। এমন অকামের ছেলে না থেকে বউ নার্গিস থাকলে দু’জনে মিলে রাতে লুকোচুরি তো অন্তত খেলতে পারত। বউ ছাড়া বেঁচে থাকার কষ্ট কেবল পুরুষ মানুষই জানে। জুটিহীনা করে খোদা এই মনে এত রসকষ না দিলেও তো পারত। ছ্যাহ!

সূর্য ডুবে গেছে। আকাশে হালকা কমলা আভা মিলিয়ে গিয়ে গাঢ় নীল অন্ধকার নেমে আসছে। পুরান ঢাকার সরু গলিগুলোতে লণ্ঠনের আলো। সাইনবোর্ডের ঝিকিমিকি বাতি, আর চায়ের দোকান থেকে ভেসে আসা ধোঁয়া মিলেমিশে এক অন্যরকম পরিবেশ তৈরি করেছে। প্রত্যুষ আর তৃষা হাঁটছে শাঁখারীবাজারের গলি ধরে। চারদিকে কোলাহল, ছোট ছোট দোকানের ভিড়, মিষ্টির গন্ধ, আর পথের ধারে ভাজা-বোন্দার শব্দ।
তৃষা এদিকসেদিকে তাকাতে তাকাতে বলল, “পুরান ঢাকা একেবারে ছবির মতো লাগে। কত ভিড়, কত আলো। যদিও আমাদের চট্টগ্রাম কম কিসে?

প্রত্যুষ মৃদু গলায় বলল, হ্যাঁ, কিন্তু ভিড়ের ভেতরে কত মানুষ আছে যারা আসলে বাঁচতে পারছে না? কারও স্বপ্ন গলির মতো সরু হয়ে যাচ্ছে, কারও জীবন অন্ধকারে মিলিয়ে যাচ্ছে।”
তৃষা একটু থেমে যায়। তার চোখ চকচক করে উঠছে সিক কাবাবের দোকানের আগুনের আলোয়। তৃষা উচ্ছ্বসিতভাবে বলল, চলুন, কাবাব খাই। এত গন্ধ পেয়ে না খেলে অন্যায় হবে।
প্রত্যুষ হেসে বলল, “ঠিক আছে।”
তারা এক প্লেট সিক কাবাব আর এক প্লেট শামী কাবাব নিয়ে রাস্তার পাশেই বসে পড়ল। চারপাশে হৈ-চৈ, কেউ দরাদরি করছে, কেউ আবার মশলা মাখছে।

তৃষা কাবাবের টুকরো মুখে দিতেই স্বাদে চোখ দু’টো আপনাআপনি বন্ধ হয়ে এলো “আহা! দারুণ স্বাদ।”
প্রত্যুষ চোখ মেলে তাকিয়ে বলল, “স্বাদ আছে, কিন্তু দেখো, আগুনে ঝলসাতে ঝলসাতে কাবাবের ভেতরেও দাগ পড়ে গেছে। ঠিক কিছু মানুষের জীবনের মতো, বাইরে রঙিন, ভেতরে পোড়া দাগ।
তৃষা কিছুক্ষণ চুপ করে থাকে। তারপর হাসির ভান করে বলল, আপনি না থাকলে, হয়তো আমি এসব গভীর কথা ভাবতাম না। আমি শুধু এই আলো-ঝলমল করা পুরান ঢাকাটাকেই তখন উপভোগ করতাম।
প্রত্যুষ গম্ভীর কণ্ঠে বলল, “আলোর আসল সৌন্দর্য তখনই বোঝা যায়, যখন কেউ অন্ধকার দেখে আসে।”
খাওয়া শেষে তারা রিকশা নিয়ে সদরঘাটে যায়। নদীর ধারে বসে দু’জনেই হাওয়ায় চুল উড়িয়ে দেয়। দূরে লঞ্চের সাইরেন বাজে, আলো পানিতে প্রতিফলিত হয়।

তৃষা নদীর দিকে তাকিয়ে বলল, ” নদীটা অন্তত বিচার করে না। শুধু বয়ে চলে।”
প্রত্যুষ চোখ মেলে বলল, “ঠিক বলেছ। জীবনকেও নদীর মতো হতে হয় জানো? নানারকম কোলাহল, দুঃখ, সুখ বয়ে নিয়ে যাওয়া, থেমে না থাকা কত মিল বলো?”
তৃষা মৃদু হাসি দিয়ে বলল, “তাহলে আজ আমরা জীবনটাকে একটু হলেও নদীর মতো করে উপভোগ করলাম, তাই না?”
প্রত্যুষ মাথা নেড়ে বলল,” হ্যাঁ, তবে মনে রেখো—নদীরও গন্তব্য আছে, সমুদ্র। আর আমাদেরও। শুধু পথটা আমরা কেউ জানি না। খুঁজলেই হয়তো পাওয়া যাবে।”

তৃষা বাসায় ফিরতে ফিরতে রাত সারে দশটার কাছাকাছি আনুমানিক বেজে যায়। প্রত্যুষের আজকে নাইট শিফট আছে। সে বাড়ির গেটের কাছে তৃষাকে নামিয়ে বিদায় দিয়ে সরাসরি কাজে চলে যায়। গাড়ি চোখের সামনে থেকে যাওয়া পর্যন্ত তৃষা দাঁড়িয়ে থাকে। প্রত্যুষ চলে গেলে সে পেছন ফিরতেই আচমকা একটা প্রস্তুর বুকের সঙ্গে ধাক্কা খায়। নিজেকে সামলে নিয়ে সামনে তাকাতেই দেখলো প্রেম নেওয়াজ দাঁড়িয়ে আছে। প্যান্টের পকেটে হাত গুঁজে। কি মাতাল করা তার চাহনি। কি তার সুঠাম দেহ। বাদামী রঙের চোখ দু’টো গায়েল করার মতো। উজ্জ্বল শ্যামর্বণের পুরুষটা একটু কম আকর্ষনীয় হলেও পারত। প্রেম তৃষার দিকে তাকিয়ে বলল, ‘তোমার ওয়াটার প্রুফ লিপস্টিকটা খেয়েছে কে?’

‘আমিই আর কে?’
‘অন্যকেউ। ‘
‘সরুন রুমে যাব। ঘুম পাচ্ছে আমার।’ তৃষার কানে তখন এয়ারপডস। সে গান শুনছে। প্রেম ভ্রু কুঁচকে তাকে জিজ্ঞেস করল, ‘সারাদিন গান শুনো। খেয়ে কাজ নেই? দেখি কি এমন গান শুনো।’ প্রেম জোর করে টেনে এয়ারপডস খুলে নিজের কানের কাছে ধরতেই কেমন যেন চুপ হয়ে গেল। পরক্ষণেই এয়ারপডস তৃষার কানে লাগিয়ে দিয়ে বলল, ‘এই গান সবসময় শুনো নাকি?’
‘এই গানই কেন শুনব? আঁধারের গাওয়া আরো অনেক গান আছে। ওর সোলো ব্রান্ড প্রিজরোজের নাম শুনেন নি?’
‘শুনিনি।’
‘প্রাচীন কালের মানুষ দেখি।’

‘তুমি আমার রুমে যাও। আমি দুই মিনিটের মধ্যে আসছি।’
‘আপনার রুমে কেন যাব? আমার কি থাকার মতো জায়গার এতই অভাব পরছে?’
তৃষা আরো কিছু বলতে যাবে তার আগেই প্রেম তার দিকে সরু চোখে একবার তাকায়। সেই চাহনি দেখে তৃষা বলল, ‘আরে বাবা চোখ রাঙান কেনো? আমাদের মনে হয় চোখ নাই? আচ্ছা ঢং করবেন না। যাচ্ছি তো।’ মনে মনে তৃষা দোয়া ইউনূস পড়তে লাগল। না জানি কপালে কোন শনি ঘুরছে। তৃষা যেতেই প্রেম ফোনটা বের করে অংকুরকে একটা কল করে বলল, ‘তৃষা নুজায়াতের সম্পর্কে ডিটেইলস চাই আমার বুজলি? রাতের মধ্যেই জোগাড় করে দিবি। ‘ বলেই ফোনটা রেখে বাড়ির দিকে হাঁটা শুরু করল। রুমে গিয়ে দেখল তৃষা নিচ তলায় নেই। মানে কি?

এই তৃষা আজকাল বেশিই কথার অবাধ্য হয়ে যাচ্ছে না? প্রেম এসব আচরণ একেবারেই অপছন্দ করে। সে সিঁড়ি বেয়ে দোতলায় যেতেই দেখল তৃষা কর্নারের রুমের দরজা ধরে টানাটানি করছে। বিরক্ত হলো প্রেম। তার ঘরে তৃষাকে সে আসতে দিয়েছে এটাই তো অনেক। এমন হাতাহাতি তো পছন্দ হচ্ছে না। সে তৃষাকে টেনে নিজের কাছে এনে বলল, ‘এটা আমার বাড়ি। তোমার ভাতারের না। তাই এখানে ভদ্র মানুষের মতো শান্তশিষ্ট ভাবে থাকবে।’
‘নিজে তো অভদ্র একটা! বলেই তৃষা নিজের মুখ নিচে চেপে ধরল। মুখ ফসকে খালি ভুলভাল বের হয়।
“যাও রুমে যাও আমার। অভদ্রতার সঙ্গে পরিচয় করাবো তোমায়।” তৃষা মুখ ভেংচি কেটে ভেতরে চলে যায়। প্রেম দরজার হাতল ধরে টানতেই দেখল তালা মারা। পাসওয়ার্ড দেওয়া। বদ্ধ দরজার আড়ালে যা আছে তা আড়ালেই থাক।

প্রেম রুমের কাছে আসতেই দেখল তৃষা একটার পর একটা পাসওয়ার্ড দিয়েই যাচ্ছে তার বেডরুমের লকে। প্রেম আসতেই বলল, ‘হ্যা গো প্রেম ভাই আপনি অনেক বড়লোক তাই না? রুমে পাসওয়ার্ড ব্যবহার করেন?’
‘তো তোমার মতো ফকিন্নি নাকি? যাও উল্টো ঘুরো। পাসওয়ার্ড দেখে যদি চোর রুমে ঢুকে কিছু চুরি করে নিয়ে যায়? তার চেয়েও বড় কথা প্রেম নেওয়াজের বেড রুমে চাইলেই সবার যাওয়ার সৌভাগ্য হয়না।’
‘তাহলে আমাকে কেন আনলেন?’

‘উফফ সোনা বেশি বকো তুমি।’ তৃষা উল্টো দিকে ঘুরতেই প্রেম দরজা খুলল। ভেতরে ঢুকে তৃষা তো অবাক। এত ইউনিক ডেকোরেশন। আর এত বিরাট রুম। তার ঘরটা যেন বিশাল অন্দরমহল। প্রচলিত শোবার ঘরের চাইতেও অনেক বড়, প্রশস্ত। পুরো ঘরজুড়ে কালো রঙের আধিপত্য। দেয়ালে গাঢ় কালো ওয়ালপেপার, যার উপর ঝলমলে সোনালি কারুকাজ আঁকা। মেঝেতে গাঢ় কাঠের ফ্লোরিং, তার উপর বিশাল এক কালো কার্পেট বিছানো, যেখানে পা দিলেই নরমে ডুবে যাওয়া নিশ্চিত। ঘরের মাঝখানে রাখা একটি কিং-সাইজ খাট। কালো পালিশ করা কাঠের তৈরি, মাথার দিকটা উঁচু। চামড়ার কারুকাজ করা। খাটের পাশের জানালার গায়ে ঝুলছে গাঢ় ধূসর সিল্কের পর্দা। খাটের পাশে লম্বা নাইটল্যাম্প, নরম হলুদ আলো ছড়িয়ে ঘরটাকে অর্ধেক অন্ধকারে ডুবিয়ে রেখেছে।

ঘরের ভেতরেই আরেকটা বিশেষ এডজাস্ট রুম যাকে ওয়াক-ইন ক্লোজেট বলে। ওটা যেন আলাদা এক জগৎ। সেখানকার সব আলমারি, তাক আর হ্যাঙ্গার কালো কাঠের তৈরি। সুশৃঙ্খলভাবে ঝুলছে তার অসংখ্য জামা-কাপড়, জুতা৷ আশি পার্সেন্ট পোশাকও কালো রঙের। ঘরের এক পাশে কালো পালিশ করা বুকশেলফে সাজানো বই আর কিছু বিরল সিগনেচার আইটেম। প্রাচীন ঘড়ি, শো-পিস আর পুরোনো জিনিসপত্র। অন্য পাশে গাঢ় ধূসর৷ কালো সোফাসেট। মাঝখানে কাচের টেবিলের উপর কালো ক্রিস্টালের ফুলদানিতে নীল প্রিমরোজ ফুল সাজানো। তৃষাকে খাটের ওপর বসিয়ে দেখে প্রেম সাওয়ার নিতে গেল। তৃষা একটু বেশিই অবাক। কারণ আজকের মতো ভন্ডামি আর পাপ সে বিগত এত দিনে কখনোই করেনি। তবে আজকে প্রেম ভাই তাকে বকছেও না মারছেও না। আল্লাহ জ্বীনে ধরল না তো? কবিরাজ কিংবা হুজুরকে ডেকে আনবে কি? তৃষা নিজের পরিহিত কালো রঙের শাড়িটির দিকে তাকালো। এই ঘরের একটা অংশ মনে হচ্ছে এখন তাকেও।

বেশ কিছুক্ষণ সময় দিয়ে প্রেম গোসল খানা থেকে বের হলো। কালো রঙের একটা তোয়ালে প্যাচানো তার নিচে। সুঠাম দেহের ভাঁজ গলে ভেজা চুল থেকে টুপটাপ করে জল বিন্দু গড়িয়ে পড়ছে। প্রেম বিছানার দিকে তাকালো। তৃষা সেখানে গুটিগুটি মেরে ঘুমিয়ে আছে। পেটের কাছ থেকে শাড়ি সরে গেছে। প্রেম তৃষার নাভি কঞ্জের দিকে তাকিয়ে চোখ বন্ধ করে একটা নিশ্বাস ছাড়ল। তারপর এক পা দুই পা করে এগিয়ে এসে ঠিক তৃষার সামনে এলো। ড্রয়ার থেকে একটা ইনজেকশন বের করে নিজের হাতে পুশ করল কোনো ভয় দ্বিধাহীনভাবে। এই মেয়ের কাছে গেলে এলার্জির পরিমানটা আরো বেগ পায়। এলার্জির ইনজেকশন তো এখন মাস্ট হয়ে দাঁড়িয়েছে। প্রেম তৃষার নাভির দিকে তাকিয়ে মনে মনে সুধালো, ‘আমি যা ছুঁই একবার তাতে অন্যকারো স্পর্শ তো দূরে থাক দৃষ্টিও আমার সহ্য হয় না। তুমি তৃষা বার বার ওই ভুলগুলো করো যা আমার অপছন্দ।’

বলেই সে ড্রয়ার থেকে সরু ছোট্ট এন্টিকাটার টি বের করে তৃষার পেট বরাবর ধরে। মুচকি হেসে একটা মৃদু টান দিতেই ব্যথায় ঘুম ভেঙে চিৎকার করতেই প্রেম চোখ গরম করে মুখ চেপে ধরে তার। সামান্য একটু খানিই কেটেছে। তাতেই গরম রক্ত গড়িয়ে পড়ছে। তৃষার চোখের অশ্রু টলটল করছে। সে আর্তনাদ করেও করতে পারছে না। মুখটা যে চেপে ধরেছে পুরষালী সকল শক্তি খাটিয়ে এই প্রেম নেওয়াজ। প্রেম তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে রুক্ষ কণ্ঠে তৃষাকে বলল,’তোকে না বলেছিলাম আমার স্পর্শ করা জিনিসে কারো দৃষ্টি আমার পছন্দ না? সেখানে আরেক বাড়ির পুরুষ তোর শরীর দেখে গায়ের জ্বালা কেমন করে মিটায় রে?

প্রেমতৃষা পর্ব ২২

আর প্রত্যুষের সঙ্গে তোর এত কিসের ঘষাঘষি? ওহ ইন্টেলিজেন্স ব্রাঞ্চের অফিসার, সাদা চামড়া তাই তোর খুব ভালো লাগে? তো ওকে খুশি করে আজকে কত কামালি জানোয়ার? তোর মশারীর মতো শাড়ি পড়ে রংডং করা তাই না? তুই তৃষা প্রেমকে দেখেছিস তার ডার্ক সাইড এখনো দেখা বাকি। প্রেমের জীবনে দুইটা দরজা। যেখানে আছিস সেখানেই ভালোয় ভালোয় থাক। বদ্ধ দরজার ওপারে গেলে মৃত্যু তোর নিশ্চিত। মরণ কাছে আসলে ফিরে যাবে না। মৃত্যু ভাববেও না তুই কে, অপরাধের পাল্লা কতখানি ভারী। মাইন্ড ইট।”

প্রেমতৃষা পর্ব ২৪

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here