প্রেমতৃষা পর্ব ২৮

প্রেমতৃষা পর্ব ২৮
ইশরাত জাহান জেরিন

প্রেম দরজাটা হুড়মুড় করে এমন জোরে ধাক্কা দিল যে পুরো ঘর কেঁপে উঠল। টিশার্টটা হাতে কষে চেপে নিয়ে তৃষাকে শক্ত করে ঠেলে সরিয়ে দিয়ে বেরিয়ে গেল সে। যাওয়ার সময় শুধু একটা জিনিসই হাতে নিল—মদের বোতলটা। আটাশ বছরের গহীন ক্ষত, বুকের গভীরে চাপা দেওয়া দগদগে জখমটা আবার আজ নতুন করে রক্তাক্ত হয়ে উঠল। তৃষা এখনো শ্বাস নিচ্ছে, বেঁচে আছে এটাই যেন তার ভাগ্যের সীমাহীন সৌভাগ্য। প্রেমের ঝড়ের মতো প্রস্থান শেষে, ঘরটায় হঠাৎ মৃত্যু-নেমে আসা নীরবতা ছড়িয়ে পড়ল।

তৃষার বুকের ভেতর তখন তীব্র শূন্যতার চাপা শব্দ। সে ঠাহর করতে পারল কী অমোঘ পাপ করেছে সে! যে মানুষের শিকড় কেটে নেওয়া হয়েছে অনেক আগে, যার মা-বাবা নেই, যার স্মৃতি কেবল ক্ষতের মতো রক্তাক্ত, তাকে সে কীভাবে এত বড় আঘাত দিল? কোন দুঃসাহসে ছিঁড়ে দিল তার পুরোনো দাহকে? চোখের জল তৃষার মুখ ভিজিয়ে দিতে লাগল। কাঁপা হাতে জল মুছে দৌড়ে বেরিয়ে এলো সে। কিন্তু তখন? প্রেম তো ঝড় তুলে বাইক নিয়ে যান্ত্রিক শহরের অতলে মিলিয়ে গেছে। বাড়ির সীমানা অনেক আগেই তার চাকার শব্দকে বিদায় দিয়েছে। এ বিশাল শহরে, পাথরের মতো ঠান্ডা এই নগরে, তৃষা কোথায় খুঁজবে তাকে? কার ভিড়ে, কোন অচেনা রাস্তায়, কোন গহীন অন্ধকারে মিলিয়ে গেছে সেই মানুষ, যার বুকের আগুন সে নিজ হাতে আবার প্রজ্বলিত করেছে?

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

তৃষা বাইরে পা রাখতেই শ্বাস-প্রশ্বাস এলোমেলো হয়ে গেল। হাত কাঁপতে কাঁপতে প্রথমেই তাড়াহুড়োয় অংকুরকে ফোন করল সে। কান্নাজড়ানো গলায় সবটা খুলে বলতেই অংকুর এক নিঃশ্বাসে আশ্বাস দিল,
“চিন্তা করো না, আমি দেখছি।” কিন্তু সেই কথার ভরসাতেও তৃষার বুকের গভীরে জমে থাকা অস্থিরতা একচুল কমল না। এই অস্থিরতা তাকে বারবার মনে করাচ্ছে, প্রেমকে না খুঁজে পাওয়া মানে নিজের অর্ধেক শ্বাস হারিয়ে ফেলা। মাথা কাজ করছে না, দিক-দিশা বোঝা যাচ্ছে না। অবশেষে অস্থিরতায় দগ্ধ হয়ে যখন বাইরের গলিপথে ছুটে যাওয়ার জন্য পদক্ষেপ ফেলল, তখনই সামনে প্রত্যুষ এসে পথ আটকাল। প্রত্যুষ জানে না আসল ঘটনা, জানে না তৃষার বুকের ঝড়টা কেন উঠছে। তবে এক নজরে বুঝে গেছে সে, তৃষার অবস্থা বাইরে যাওয়ার মতো নেই। কেবল এই কারণেই কঠোর হাতে আটকাল তৃষাকে। কিন্তু শুধু প্রত্যুষ?

না। হেতিজাও সামনে এসে বাঁধা হয়ে দাঁড়াল। তার চোখে কোনো দয়া নেই, বরং হিসেবি দৃঢ়তা। সে জানে প্রেম হচ্ছে তৃষার সিনিয়র, সিনিয়র-জুনিয়রের মধ্যে ঝগড়া-ঝাটি নতুন কিছু নয়। এই তুচ্ছ ব্যাপারে এত অস্থির হওয়া, এত পেছন পেছন দৌড়ানো অমূলক।
আর হেতিজার ভেতরে লুকানো আছে আরেকটা প্রবল ইচ্ছা—তৃষাকে সে তার নিজের ছেলের জন্য বেছে নিয়েছে। একজন মায়ের মতো সে তৃষাকে নিজের হাতে বেঁধে রাখতে চায় প্রত্যুষের পাশে। তাই তৃষার চোখ, তৃষার মন, তৃষার প্রতিটি স্পন্দন যেন প্রেমের দিকে না ছুটে যায়—এর জন্য যা কিছু করতে হয়, হেতিজা করতে দ্বিধা করবে না। তৃষার সামনে এখন দাঁড়িয়ে আছে দুটো কঠিন প্রাচীর। একদিকে প্রত্যুষের অবুঝ বাঁধন, আরেক দিকে হেতিজার নির্মম নিয়ন্ত্রণ। এত কিছুর মানে তার জানা নেই। অথচ তৃষার বুকের ভেতর তখনো ফেটে যাচ্ছে একটাই আর্তনাদ, “প্রেম…!”

পার্কের এক নির্জন কোণে, ঝরাপাতার স্তূপে ঢাকা এক বেঞ্চে বসে আছে শিমলা। তার কোল জুড়ে মাথা রেখে শুয়ে আছে অংকুর। যেন পৃথিবীর সমস্ত ঝড়ঝাপটা উপেক্ষা করে এ মুহূর্তে আশ্রয় খুঁজছে কেবল তার চোখের ভেতর। শিমলার চোখদুটি এতক্ষণ অশ্রুধারায় গঙ্গার মতো প্লাবিত হয়েছে। সেই অশ্রুতে বুক ভেসে গিয়েছিল তীব্র হাহাকার আর অদৃশ্য ভয়ের ঢেউয়ে। বহু কষ্টে, অবিচল সান্ত্বনার দৃঢ়তায় অংকুর তার বুকভাঙা কান্নাকে স্তব্ধ করেছে। বাড়ির চাপে শিমলার জন্য পাত্র দেখা হচ্ছে। যেকোনো মুহূর্তে পিতার সিদ্ধান্তে তার হাত বেঁধে দেওয়া হবে অপরিচিত এক বন্ধনে। অথচ এই তো সেদিনের কথা মাত্র কয়েক দিনের পূর্বে তাদের ভালোবাসা অঙ্কুরিত হয়েছে কচি অশোকলতার মতো। এখনই যদি সেই প্রেম ছিন্ন হয়, তবে এ যেন জীবনের নির্মমতম উপহাস।

বিচ্ছেদের আশঙ্কা শিমলার বুকে আগ্নেয়গিরির মতো দগ্ধ যন্ত্রণা ছড়িয়ে দেয়, তাই অশ্রু অবিরাম ঝরে পড়ে। কিন্তু অংকুর শিমলাকে শপথ দিয়েছে। সমস্ত দুনিয়া যদি উল্টে যায়, যদি আকাশ ভেঙে মাটিতে পড়ে, তবুও এই হাত সে ছেড়ে দেবে না। কারণ এ হাত সে ধরেছে কেবল ভালোবাসার শুদ্ধ অঙ্গীকারে, কোনো সামাজিক প্রথা কিংবা জবরদস্তি নয়। এই একবারের ধরা হাতই তার কাছে চিরন্তন, অবিনাশী, শপথে অটল এক প্রেমের মূর্ত প্রতীক। একে ছাড়া মানে নিজেকে ছেড়ে দেওয়া।
হঠাৎ অংকুর আর শিমলার পাশের বেঞ্চে দু’টো মেয়ে এসে বসল। বাদাম খেতে খেতে ফর্সামতো লামিয়া নামক মেয়েটি হেসে পাশের জারা নামক মেয়েটিকে বলল, ‘তো কেমন দিলাম বল?’
‘ভাই তুই একটা চিজই। মানে সাদমানের সঙ্গে পাঁচবছর রিলেশন করে এখন তারই কাজিনের সঙ্গে কাল বিয়ে করে কানাডায় শিফট হচ্ছিস!’

‘তো কি করব? সাদমানের মতো ওই বিশ হাজার টাকা মাইনে পাওয়া পুরুষের সঙ্গে সংসার করে জীবন পার করতাম? দেখ সুখ কিনতেও টাকা লাগে। তাই ফ্যান্টাসীতে বসবাস না করে বাস্তবতায় ফেরা উচিত। আর এমনিতেও সাদমান আমার আবেগ ছিল। আর ওর কথা বাসায় বললে কেউ মেনেও নিত না। শুধু শুধু পরিবারকে বিরক্তিতে ফেলে লাভ আছে?’
‘এখন সাদমানের কি অবস্থা? মানে ভাগ্য দেখ তোর জন্য বিয়ের প্রস্তাব এসেছে তাও আবার সাদমানেরই কাজিনের বাড়ি থেকে। তো ওই মজনুর এখন কি অবস্থা? ‘

‘আত্মহত্যার চেষ্টা করেছিলো। হাসপাতালে আছে।’
‘তুই দেখতে যাবি না।’
‘ভাই মাথা খারাপ হয়েছে? আমি কেন যাব? বিয়ের কত কি কেনা বাকি? মানে কোর্ট ম্যারেজ তো হয়েছেই বেশ কিছুদিন আগে । এখন সবাইকে জানিয়ে অনুষ্ঠান করা। আচ্ছা বাদ দে আর চল তো আমার আরো কিছু কেনাকাটা করতে হবে।’ বলেই লামিয়া উঠে দাঁড়ালো। জারাও তাই করল। দু’জন বসে না থেকে উঠে বের হয়ে গেল। পাশের বেঞ্চের অংকুর তখন শিমলাকে বলল,’ভাগ্যিস আমার কোনো কাজিন নেই।

তৃষার মনটা সকাল থেকেই খারাপ। হেতিজা বলল প্রেমা নাকি রুমে ডাকছে। মুখ ধুয়ে রুমে যাবে বলে একবার ঠিক করল। তারপর কি একটা ভেবে সিঁড়ি বেয়ে নিচে নেমে এলো। বসার রুমে একটা বিরাট টিভি আছে। সকাল সকাল সিদ্দিক নেওয়াজ চা খান আর টিভিতে খবর দেখেন। তৃষা সারা রাত কাল জেগেছে। কান্না করেছে। দরজার সামনে বসে ছিল। কিন্তু প্রেম ফিরেনি। সিম বন্ধ দেখাচ্ছে। তৃষার অনেক ভয় হচ্ছে। প্রেমের কথা ভাবলেই তো দম আঁটকে আসছে। কেবলমাত্র তার ভুলের কারণে এতসব হয়ে গেল। বসার ঘরে নানার সঙ্গে প্রত্যুষও ছিল। কি নিয়ে কথা বলছে। আজকে শুক্রবার। প্রতি শুক্রবার প্রেম এইখানে পরিবারের সঙ্গে খায়।

মানে তার দাদার সঙ্গে টেবিলে খেতে বসে। আজকে সে নেই। কোথাও নেই। একটু পরেই হুলস্থুল কাণ্ড ঘটে যাবে। তৃষাকে দেখতেই সিদ্দিক হাসি মুখে বললেন, ‘আরে দাদু এখানে বসো। চা খাবে? আমার আবার আগে আগে চা খাওয়ার অভ্যাস। এক কাপ আগে খাই অন্যকাপ পরে। বলেই হাসলেন তিনি। তারপর আবার বললেন, ‘প্রত্যুষ নানুভাই এইযে একের পর এক খুন হচ্ছেই এসব কি বন্ধ হবে না?’ প্রত্যুষ কতক্ষণ ধরেই টিভির স্ক্রিনে তাকিয়ে আছে। তৃষা আসার পরও তার দিকে তাকায়নি। স্ক্রিনে বড় বড় করে ব্রেকিং নিউজ লেখা। আজকেই বিয়ের অনুষ্ঠান হওয়ার কথা ছিল লামিয়া নামক নারীর। কিছুদিন আগেই পারিবারিক ভাবে কোর্ট ম্যারেজ হয়েছে। শত্রুবার বিয়ের অনুষ্ঠান হওয়ার কথা ছিল তবে তার আগেই খোঁজ মিলল তার লাশের। তৃষার সেইদিকে খেয়াল নেই। হঠাৎ সে প্রত্যুষকে বলল, ‘একটু শুনবেন?’

দুইবার ডাকার পর প্রত্যুষ তৃষার দিকে তাকালো। হেসে জবাব দিলো,’কিছু বলবে?’
‘মানে একটু কথা ছিল।’
প্রত্যুষ উঠে এসে বলল, ‘তুমি ঠিক আছো?’ প্রত্যুষের চিন্তার শেষ নেই। কাল রাতে প্রেমের বাড়ির দরজার সামনে থেকে তৃষাকে রুমে সেই তো এনেছে। রাতে প্রত্যুষ কেবল জিজ্ঞেস করেছে, ‘কি হয়েছে? যদি মনে হয় আমায় বললে আমি সাহায্য করতে পারব। মন হালকা হবে তাহলে প্লিজ শেয়ার করো।’
শেষে তৃষা শব্দ করে কেঁদে উঠল। সব কিছু খুলে বলল। তবে প্রেমের সঙ্গে তার কেমন সম্পর্ক, কি কি পূর্বে হয়েছে ওইসব কথা তার ভেতরেই চাপা রাখল। বাকিসব কাহিনি সব খুলে বলল। তবে সেইসবেও যেন প্রত্যুষ কত কি বুঝতে পেরে গেছে। মানে যার যতটুকু বোঝার সে তো বুঝবেই!
প্রত্যুষ উঠে আসতেই তৃষা তাকে বলল, ‘আপনি একটু দেখেন না সে কোথায়। একটা মানুষ বাড়িতে নেই আপনারা এত নিশ্চিন্ত কেমন করে হতে পারেন?’

প্রত্যুষ কিছু বলল না। বলার সুযোগ কোথায়? অফিস থেকে কল এসেছে। এই ছুটির দিনেও একটু শান্তি নেই। তারই মাঝে সিদ্দিক নেওয়াজ আবার ঘড়ির কাটা দেখছেন নাস্তার টেবিলো বসে বসে। সময় তো পার হয়ে যাচ্ছে। প্রেম কোথায়? শেষে মোখলেসকে পাঠিয়ে জানতে পারলেন প্রেম বাড়িতে নেই। রাগ লাগল তার। কি করবেন বুঝতে না পেরে মোখলেসকে দিয়ে অংকুরকে কল লাগালেন। অংকুর জানালো,’প্রেম চলে গেছে।’
‘মানে?’

‘মানে আগের মতোই কোথাও একটা চলে গেছে। কোথায় গিয়েছে জানা নেই।’ সেই খবরে সিদ্দিকের প্রেসার লো হয়ে গেলেন। লাস্ট যখন তার প্রেম রাগ করে চলে গিয়েছিলো তখন পাক্কা গুনে ১ বছর জার্মানিতে থেকে তারপর এসেছে। প্রেম বরাবরই এমন। পরিস্থিতির সঙ্গে যখন লড়ে উঠতে পারে না তখন সব ছেড়ে পালায়। এই পালিয়ে বেড়িয়ে রাগ দেখানোর কোনো ফয়দা, কোনো মানে আছে? এবার না জানি কোথায় গেছে, কবে ফিরবে? কি নিয়ে রাগ করেছে।

ডাক্তার এসে সিদ্দিককে দেখে গেছেন। সবাই রুম থেকে বের হতেই তৃষা সেখানে ঢুকে। তাকে দেখে সিদ্দিক নেওয়াজ চোখের জল আটকানোর চেষ্টা করে। তৃষার তো সেসব দেখে অন্তর ফাটল বলে। কারন সব কিছুর জন্যই দায়ী সে। কি করে ফিরিয়ে আনবে প্রেমকে? সে কি আদৌও ফিরবে? তৃষা বৃদ্ধ সিদ্দিক নেওয়াজের হাত ধরে বলল, আপনি কষ্ট পাবেন না। প্রেম ভাই ঠিক ফিরে আসবে।’ সিদ্দিকের চোখের জল, বুকের কষ্ট এবার আর বাঁধ মানল না। সে বলল, ‘প্রেমকে কত কষ্ট করে মানুষ করেছি। প্রথমে মা হারালো। পরে বাবা হারালো।

প্রেমতৃষা পর্ব ২৭ (২)

একটা মানুষ সব হারিয়ে বাঁচতে পারে? তোমার মনে হয় সে বেঁচে আছে? কবেই ভেতর ভেতর শেষ। যেই ভালোবাসা ওকে দেওয়ার কথা ছিল বাবা-মায়ের সেই ভালোবাসা থেকে সে বঞ্চিত হয়েছে। আমি জানি প্রেম কেমন করে বড় হয়েছে। ও বাইরে থেকে এক মানুষ ভেতর থেকে অন্য কেউ। কঠিনের ভেতরও যেমন তরল আছে। প্রেম তেমন। সে কখনো নিজের কষ্ট কাউকে বুঝতে দেয় না। সে তার ইমোশন শেয়ার করতে জানে না। ভেতরের মানুষটিকে রোজ ভেতরে দাফন করে, মাটি দেয়। বলেই সিদ্দিকের চোখে জল চলে এলো। সেই জলে তৃষার চোখের জল উতরিয়ে পরল।

প্রেমতৃষা পর্ব ২৮ (২)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here