প্রেমতৃষা পর্ব ৩
ইশরাত জাহান জেরিন
তৃষাকে হলের রুমে এনে দরজাটা ভেতর থেকে বন্ধ করল প্রেম। ধাক্কা দিয়ে বিছানায় ফেলতে যাবার আগেই তৃষা গলা উঁচু করে বলল, ‘এই ভাই ওয়েট। মুখে অনেক দামি মেকাপ করেছি। এভাবে ধাক্কা দিয়ে ফেললে তো সব মেকাপ বিছানার চাদরে গিয়ে লাগবে। আমি নিজ থেকেই যাচ্ছি, দেখি আপনি আপনার কোন ক্যালমা দেখান।’
প্রেম একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে ঠোঁট বাঁকিয়ে বলল, ‘আজকেও বাঁদরমুখি দেখছি ঠোঁটে লিপস্টিক দিয়েছো? তাও কড়া লাল! অনেক সুন্দর লাগছে। আসলেই তোমার মতো সুন্দরী মেয়ে পৃথিবীর বুকে একপিসই। ওয়েট একটা ছবি তুলে রুহুটাকে শান্ত করি।’
তৃষা প্রথমে মুখ বাঁকিয়ে রাগ দেখালেও ভেতরে ভেতরে হাসি চেপে রাখল। মনে মনে ভাবল, অবশেষে এই ছেলেও তার রূপের খাঁচায় বন্দী হয়েছে। সে বলল,
‘মাফ করে দিয়েছি। গাধা পড়ে হলেও আমার মর্ম বুঝতে পেরেছেন এটাই অনেক সিনিয়র ভাইয়া। নেন আপনার তো আইফোন। তুলেন, তুলেন একটা কড়া ছবি তুলেন।’
প্রেম উৎসাহ নিয়ে বলল, ‘সুন্দরী আপু একটু পাউট করেন। আপনাকে পাউট করলে বেবিডল লাগবে।’
প্রশংসা শুনে তৃষার মাথা আরও উঁচু হলো। গর্বভরে ঠোঁট বাঁকিয়ে পোজ দিতেই প্রেম ক্লিক করে ছবি তুলল। তারপর গম্ভীর ভঙ্গিতে বলল, ‘হয়ে গেছে। নাম্বারটা যদি দিতেন পাঠিয়ে দিতাম।’
তৃষা ভ্রু উঁচিয়ে বলল, ‘যে-সে মানুষকে তৃষা নুজায়াত নাম্বার দেয় না ভাইয়া।’
প্রেম গম্ভীর হয়ে উত্তর দিল, ‘হ্যাঁ ঠিক বলেছেন আপু। কষ্ট পেলাম। বুক ভরা ব্যথা নিয়ে না হয় আপনাকে আপনার ছবিটাই দেখাই?’
আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন
‘ফাস্ট রাবিশ ভাইয়া।’
প্রেম এক মুহূর্তে কাছে এসে ফোনটা সামনে ধরে ছবিটা দেখায় তৃষাকে। তারপর বলে, ‘দেখ খবিশ মাইয়া তোর ছবি।’
তৃষার সেই ছবি দেখে প্রেমের চুল ছিঁড়ে ফেলতে হচ্ছে করছে। এটা কী দেখালো? একটা বানর লাল লিপস্টিক ঠোঁটে ঘষে, মুখটা পাউট করে রেখেছে? তৃষার রূপ নিয়ে মজা নেওয়া?
‘আপনি নিজের থোমা খানা আয়নায় দেখেছেন? গরিলার মতো দেখতে।’
প্রেম ভ্রু কুঁচকে ঝাঁঝালো গলায় বলল, ‘এই মেয়ে দেব নাকি ডিম থেরাপি?’
তৃষা মুচকি হেসে জবাব দিল, ‘আপনার ওপর ট্রাই করে দেখান। ভালো লাগলে পরে আমি সার্ভিস নিয়ে দেখব।’
‘মুখে মুখে তর্ক ছাড়া আর কিছু পারো না?’
‘আরো অনেক কিছু পারি। কিন্তু এই মুহূর্তে পারব না। আমার একটা ডিমান্ড আছে না?’
‘তোমার রিমান্ড আমি লাথি মেরে জানালা দিয়ে ফেলব।’
‘কখন ফেলবেন একটু আগে ভাবে জানিয়ে দিয়েন। আমার বান্ধুবী শিমলা মরিচকে বলব নিচে থেকে ক্যাচ ধরতে। আমার ডিমান্ডের সেই দাম। বিক্রি করলে মালামাল হয়ে যাবেন।’
প্রেম নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারল না। তেড়ে এসে তৃষার চুল মুঠি করে ধরতেই তৃষা চেঁচিয়ে উঠল, ‘আরে ছাড় বেডা চুল ছাড়। চুল সব এমনিতেই পড়ে যাচ্ছে। ছাড় কইলাম।’
এত চেঁচামেচিতে প্রেম খানিকটা থমকে গেল। ভাবল, এভাবে চিৎকার করলে বাইরে থেকে কেউ কিছু ভেবে বসতে পারে। তাড়াতাড়ি চুল ছেড়ে দিয়ে তার মুখ চেপে ধরে বলল, ‘আরে কিছু করেছি নাকি? এমন ভাবে চেঁচানোর মানে কী?’
তৃষা মুখ ছাড়িয়েই আরও জোরে চেঁচিয়ে উঠল, ‘ ও মোর খোদা, মরে গেলুম রে প্রেম। প্রেম তুই আর প্রেম দিস না।’
প্রেম স্তব্ধ হয়ে বলল, ‘নাউজুবিল্লাহ। মেয়ে তোমার ভয় নেই?’
তৃষা গম্ভীর গলায় বলল, ‘ভয়কে রোজ আমি কিনি বেঁচি। এখন, ধাক্কা দিব নাকি সাইট দিবেন? উফস ছেলে-পুলেদের জন্য পড়ালেখা করতে পারছি না ঠিক মতো।’
‘এই যাচ্ছো কোথা?’
‘চুপ করেন ব্যাটা। আপনার মুখ করে দেব ভোঁতা।’
‘চুপ থাক। যে কারণে এখানে তোকে আনা তা তো এখনো বাকি।’
‘কী?’
প্রেম গভীর দৃষ্টি মেলে কাছে এগিয়ে এলো। হাতা গুটিয়ে শার্টের বোতাম খোলা শুরু করতেই তৃষার বুক ধকধক করতে লাগল। এ কী! সত্যিই কি ছেলের উদ্দেশ্য খারাপ? এক পা করে কাছে আসতেই তৃষা চোখ-মুখ শক্ত করে দাঁড়িয়ে গেল।
ঠিক তখনই প্রেম পাশ কাটিয়ে তার পেছন থেকে ইয়ারফোনটা তুলে নিল। হেসে বলল, ‘চোখ খুল বাঁদরমুখি। ইমরান হাশমির সিনেমা চলছে না এখানে।’
বিছানায় শুয়ে ইয়ারফোন কানে গুঁজে আবার বলল, ‘পাক্কা দশ মিনিটের মধ্যে ঘরটা ঝাড়–পোঁছ দিয়ে কফি নিয়ে আসবে। বুঝেলে বাঁদরমুখি?
তৃষা দাঁত কামড়ে ভেতরে ভেতরে গজরাল, ‘এখানে এনে আদিখ্যেতা দেখাবে ভেবেছিলাম, আরে গিন্নিপনা করাচ্ছে! এখানে এনে রেগ দেওয়া হচ্ছে? দেব নাকি ঝাঁটা দিয়ে মাথায় একটা ৪০০ বোল্ডের বারি?শালা একেবারে হাইব্রিড করলা—খেতে তিতা, কিন্তু পুষ্টিকর!
লাশের সামনে বসে আছে প্রত্যুষ। এই নিয়ে দু’টো লাশ পেলো। দু’টোই মেয়ে। দু’টোর মাথার চুল কেটে নেওয়া হয়েছে। খুনে চুল কেটে নিয়ে হয়তো বুঝিয়ে রেখে যায় তার খুনের প্যার্টান কেমন? লাশের ময়নাতদন্তের ব্যবস্থা করতে বলে প্রত্যুষ চোখের সানগ্লাসটা ঠিকঠাক মতো লাগিয়ে উঠে দাঁড়ায়। সঙ্গে সঙ্গে একদল সাংবাদিক তাকে ঘিরে ধরে, ‘স্যার এই নিয়ে এমন ভাবে দুটো মেয়ে খুন হলো। আপনারা এখনো কিছু করতে পারলেন না যে? তাহলে কী এভাবেই একটার পর একটা খুন হবে? আর আমাদের মেয়ে মানুষকে এভাবে ভয়ের মধ্যে দিয়ে বেঁচে থাকতে হবে?’
‘ তদন্ত আর বাদাম ভাজা কিন্তু এক জিনিস নয়। যে চাইলেই ভেজে খেয়ে ফেললাম। সাইট প্লিজ।’
প্রত্যুষ মিডিয়ার মাঝ থেকে কোনোমতে বের হয়ে গাড়িতে গিয়ে বসল। মাথাটা নষ্ট করে দিবে এবারের বিষয়। পুলিশ সামাল দিতে পারছে না বলে এমন ঠুনকো একটা লেইম বিষয় তার মতো কর্মকার্তাদের প্রশাসন ধরিয়ে দিয়েছে। এখন সরকারের ওপর তো যাওয়া যাবে না। গেলে চাকরি থাকবে কী? প্রত্যুষ গাড়িতে বসতেই বাসা থেকে প্রেমান্তুির কল এলো। সে তড়িঘড়ি করে বলল, ‘ভাইয়ারে মা তোমার জন্য আবারও পাত্রী দেখতে গেছে। এবার মনে হয় ভাবি ঘরে আসবেই?’
‘হোয়াট ননসেন্স! আবার?
যুবরাজ সরকারের মেজাজ তুঙ্গে। সকাল থেকেই মাথা নষ্ট। হেডলাইনে বড় বড় করে ছাপা হয়েছে এমপি সাহেবের হবু বউ বিয়ের আগের দিন রাতে পালিয়েছে। কী লজ্জা! কী লজ্জা! জীবনে বিয়ে করবে না করবে না বলে ধ্যান ধরে বসে থাকা মানুষটা এত বছর পর একটা বিচ্ছুকে কিনা শেষে মন দিল? ব্যাটি হতচ্ছাড়ি পালিয়েছে তো পালিয়েছে সঙ্গে এমপির মনটাও সঙ্গে নিয়ে গেছে। ফেরত দিয়ে যেতে পারত অন্তত। কিন্তু আর নয় ওই ধানিলঙ্কাকে খুঁজে বের করতেই হবে। ইতিমধ্যে খোঁজাখুঁজি শুরু হয়ে গেছে। ওকে না পেলে ওর মাকে তুলে আনবে যুবরাজ। যুবরাজ দাঁত চেপে বলল, ‘শুনো তৃষাকে না পেলে ওর মাকে তুলে আনবে?’
পাশে দাঁড়ানো এসিস্ট্যান্ট রাফসান অবাক হয়ে বলল, ‘ছি স্যার মেয়ে না পেয়ে মেয়ের মাকে?’
যুবরাজ গর্জে উঠল, ‘আরে বিয়ে করব বলেছি? ওনাকে জিম্মি করে ওনার মেয়েকে হুমকি দেব।’
রাফসান ধীর স্বরে জবাব দিল, ‘হুমকি যে দিবেন? তার আগে তো ওনার মেয়েকে খুঁজে বের করেন।’
‘তুমি চুপ থাকো গবেট কোথাকার।’ যুবরাজ ধমক দিল।
কিছুক্ষণ চুপ থেকে রাফসান হঠাৎ বলে উঠল, ‘স্যার আপনি চাইলে কিন্তু মাথা ঠাণ্ডার করার একটা টোটকা বলতে পারি।’
যুবরাজ ভ্রু কুঁচকে জিজ্ঞেস করল, ‘কী?’
‘আগে বলুন আপনার ঠিক মাথাটাই তো গরম হয়েছে তাই না?’
‘হ্যাঁ তো?’
রাফসান নির্লিপ্ত ভঙ্গিতে বলল, ‘তাহলে মাথাটা কেটে হিমবাহে রেখে আসি? বিশ্বাস করেন স্যার আপনার মাথা আর কখনো গরম হবে না। কত জনকে এই বুদ্ধি দিলাম।’
যুবরাজ বিস্মিত হয়ে জিজ্ঞেস করল, ওরা এখন কই?’
রাফসান বত্রিশটা দাঁত বের করে হেসে জবাব দিল, ‘ইয়ে মানে কবরে।’
সন্ধ্যা তখন নেমে এসেছে পুরান ঢাকার আদি মহল্লা নাজিরাবাদে। এলাকার প্রকৃত চেহারাটাই আলাদা। নাজিরাবাদকে সময়ের গহ্বরে আটকে থাকা এক মহল্লা বললে ভুল হবে না। সরু সরু আঁকাবাঁকা গলি, ইটের দেওয়ালে খসে পড়া চুনকাম, কোথাও কোথাও শ্যাওলা জমে সবুজ হয়ে আছে। পুরনো নকশার কাঠের বারান্দা দুলতে দুলতে ঝুলে থাকে, তার নিচে দোকানপাটে ভিড় লেগেই আছে। এক পাশে ভাঙাচোরা টিনের চালা থেকে টুপটাপ করে পানি ঝরে, অন্য পাশে কড়াইতে ভাজার শব্দের সঙ্গে মিশে আসছে পুরান ঢাকার বিশেষ গন্ধ। কাবাব, বুটের ঝাল ভর্তা, চটপটির তীব্র মশলা, আবার কোথাও কোথাও আগরবাতির ধোঁয়া। এমন গলির ভেতরেই সন্ধ্যাবেলায় একা ঘুরতে বের হয়েছিল তৃষা। বান্ধবী শিমলা আসেনি, তাই একা একাই ঘুরবে বলে ঠিক করে সে। প্রথমে মনে হয়েছিল একটু হাঁটাহাঁটি করবে, পুরান ঢাকার আসল গলি দেখবে। সরু গলির মাথায় ম্লান কানা বাতি, দালানের চালে ঝুলে থাকা বৈদ্যুতিক তারের ফাঁক দিয়ে আলো ছিটকে আসছে।কিন্তু নাজিরাবাদের গলি তো কোনো সাধারণ রাস্তা নয়। এ এক গোলকধাঁধা। বাঁক পেরোলেই আরেক বাঁক, একটা গলি গিয়ে মিলেছে তিনটে নতুন গলির সঙ্গে। কোনটা ধরে বেরোতে হবে—এ সিদ্ধান্ত নেওয়া মুশকিল। তৃষা অজান্তেই পথ হারিয়ে ফেলল। তৃষার ফোনে ডাটাও নেই। গুগল ম্যাপ দেখবে কেমন করে? কী অভাব চলে এলো রে। হঠাৎ সামনের গলিটায় ঢুকতেই সাত-আটটা কুকুরকে বসে থাকতে দেখল। মহল্লায় নতুন মানুষ এসেছে তা কী তাদের বুঝতে বাকি? একসঙ্গে সবগুলো কুকুর উঠে দাঁড়ায়। ঘেউ ঘেউ করতে করতে এগিয়ে আসে।
একটা জরুরী কাজে প্রত্যুষ তদন্ত করতে গলির সাত নাম্বার বিল্ডিংটায় এসেছিল ঘন্টাখানেক আগে। একাই এসেছে আজকে। এই গলিতে গাড়ি ঢুকালে মানুষের দম নেওয়ার জায়গা নেই। তাই বাইক নিয়ে এসেছে। কাজ শেষে নিচে এসে বাইক চালু করতেই প্রত্যুষ আঁতকে উঠল। থেমে দাঁড়িয়ে কান খাড়া করল। আবারও শোনা গেল চিৎকার, সঙ্গে প্রচণ্ড ঘেউ ঘেউ। সে এক মুহূর্তও দেরি করল না। দৌড়ে ছুটল গলির সেই দিকে। কারণ প্রত্যুষের বোঝার বাকি রইল না কোনো মেয়ে যে বিপদে পড়েছে। এখানে কুকুরের কামড় খাওয়া সাধারণ বিষয়! তাও আবার মেয়ে মানুষ। প্রত্যুষ দৌড়ে সামনের দিকে এগোতেই মাথায় ধপ করে আকাশ ভেঙে পড়ল। গোলাপি সালোয়ার-কামিজ পরা, খোলা চুলে একটা মেয়েকে আবিষ্কার করল। তবে ওই কুকুরগুলো মেয়েটিকে নয় বরং মেয়েটি কুকুরগুলোকে তাড়া করছে। ইট হাতে তুলে দৌড়ানি দিতে দিতে চেঁচিয়ে বলছে, ‘শালার গরীব কুকুরের বংশধর। মানুষ চিনিস তোরা? তৃষার পথ আটকে তার সঙ্গে বিরোধিতা করা? আজ খাইছে তোদের।’
প্রেমতৃষা পর্ব ২
কুকুরগুলো প্রাণ বাঁচানোর জন্য ছুটে প্রত্যুষের পাশ হাঁতরে ছুটে পালালো। এখানে এসেছিল মেয়েটাকে সাহায্য করতে কিন্তু এখন তো দেখছে কুকুরগুলোর সাহায্য লাগবে। কুকুর বলে কী তারা মানুষ না? তৃষা দৌড়ে এসে প্রত্যুষকে ডিঙিয়ে কুকুরগুলোর পেছনে যাওয়ার আগেই ম্যানহোলের সঙ্গে পড়ে থাকা ইটের টুকরোর সঙ্গে ধাক্কা খেয়ে গিয়ে পড়ে প্রত্যুষের ওপর। দু’জনে পড়তে পড়তে শেষ রক্ষা হয়। তৃষা ততক্ষণে প্রত্যুষের দিকে তাকায়। চোখে চোখ রাখতেই কোথায় যেন একটা গান বেজে উঠে,
~তুমহে দেখা তো ইয়ে জানা সানাম। পিয়ার হোতা হে দিবানা সানাম। আব ইয়াছে কাহা যায়ে হাম। তেরি বাহোমে মার যায়ে হামমমমমম।~