প্রেমতৃষা পর্ব ৩৪
ইশরাত জাহান জেরিন
রুমের চারদিকে নরম হলুদ আলো। জানালার পর্দার ফাঁক গলে অন্ধকার-গাঢ় নীল আকাশের একচিলতে রেখা দেখা যাচ্ছে। বাইরে যেন বৃষ্টি আর হাওয়া একসঙ্গে ষড়যন্ত্র করছে। শিস দিয়ে, ছাদে ধুপধুপ করে আঘাত করছে। একটানা মেঘের গর্জন আর বজ্রের শব্দে মনে হয় চারদিকের পাহাড়গুলোও নিঃশ্বাস আটকে আছে। বাতাসে কাঁচা মাটির গন্ধ, ভেজা ঘাসের তাজা গন্ধ মিশে আছে। হালকা ঠান্ডা হাওয়া এসে পর্দা উড়িয়ে দিচ্ছে। ভেতরে উষ্ণতার সঙ্গে মিশে তৈরি করেছে নিস্তব্ধতা।
বিছানার চাদরও সামান্য ভিজে আছে তৃষার শরীরের ভেজা ছোঁয়ায়। প্রেমের চুলের ডগা থেকেও টুপটুপ করে জল পড়ছে। লেদারের জ্যাকেট থেকে ঘামের সঙ্গে বৃষ্টির গন্ধ। প্রেম তৃষার দিকে এগিয়ে এসে তাকে বুকে টেনে নেওয়ার চেষ্টা করল। কিন্তু তৃষা মৃদু ধাক্কা দিয়ে সরে গেল৷ প্রেমও এক মুহূর্তে থমকে গেল। আচ্ছা সে তৃষার সঙ্গে জোর করছে না তো? তৃষার কি বিষয়গুলো পছন্দ হচ্ছে না? প্রেমের চোখে একরাশ অনিশ্চয়তা, ঠোঁটে কাঁপা কাঁপা প্রশ্ন। “প্রত্যুষকে ভালোবাসো তুমি?” এহেন প্রশ্ন করার যথেষ্ট কারণ আছে। না থাকলে অবশ্যই তৃষা প্রতিবার স্পর্শের সময় এমন দূরে দূরে সরে যেত না। তৃষা নিচু গলায় নিচের দিকে চেয়ে বলল, “সেই কথা আবার কখন বললাম?”
আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন
বজ্রপাতের আলো ঘরের অন্ধকার কেটে মুহূর্তের জন্য দু’জনের মুখ স্পষ্ট করে তুলল। বাইরে বৃষ্টি আরেক দফা জোরে নেমে এল। প্রেম কয়েক ধাপ এগোল। তৃষা এক পা পিছিয়ে গেল। প্রেম থেমে গিয়ে বলল, “আমার স্পর্শ তোমার জন্য ভয়ের? বলে দাও। দায় থেকে আমি মুক্তি পাবো, তুমি-ও আর আমি-ও।”
তৃষা হঠাৎ গুঙিয়ে উঠল, যেন বুকের ভেতর জমে থাকা কোনো ব্যথা শব্দ হয়ে বেরোল। প্রেম ধীরে ধীরে তার কাছে গিয়ে তাকে বিছানায় বসাল। লেদারের ভেজা জ্যাকেট খুলে বলল, “শরীরটা একেবারে ভিজে গেছে। এই পোশাকে বসে থাকলে ঠান্ডা লেগে যাবে। আচ্ছা, আমি রিসোর্টের লোকদের দেখি কোনো শুকনো জামাকাপড় আছে কিনা।” প্রেমের চোখ ততক্ষণে আপনাআপনি ভিজে একাকার। তবুও প্রসঙ্গ বদলাতে হবে যে। সে উঠে দাঁড়াতেই তৃষা হঠাৎ হাত বাড়িয়ে তার কব্জি ধরে ফেলল। ভেজা আঙুলের স্পর্শে প্রেম থেমে গেল। তৃষার চোখে অদ্ভুত এক অস্থিরতা, আবার আকুলতা। “বসুন। যাবেন না এখন।”
প্রেম ধীরে ধীরে আবার বসে পড়ল তার পাশে।
বৃষ্টির শব্দ যেন আরও তীব্র হয়ে উঠল।
প্রেম নরম গলায় বলল,”কথা দিচ্ছি, তোমার অনুমতি ছাড়া আর কখনো তোমায় স্পর্শ করব না। তবু কেঁদো না প্লিজ। এমনিতেই আমি খারাপ মানুষটা তোমায় কল্পনার থেকেও বেশি কষ্ট দিয়ে ফেলেছি।”
তৃষার চোখ ভিজে উঠল। সে নরম গলায় বলল,
“আপনি বলুন তো, আপনি কি আসলেই আমাকে ভালোবাসেন?”
প্রেম কিছুক্ষণ চুপ করে থাকল। বাইরে বৃষ্টি, ঘরের নীরবতা, দুজনের নিঃশ্বাস, সব যেন একসঙ্গে কাঁপতে লাগল। তারপর সে নিচু স্বরে বলল, “একটু অনুভব করলেই তো পারো।”
তৃষার চোখে হঠাৎ এক চিলতে রাগ আর কষ্টের মিশ্রণ, “অনুভব করেছিলাম তো একবার। বিনিময়ে আমায় নরকে ফেলে আপনি হারিয়ে গেলেন।”
প্রেমের মুখে একরাশ ক্লান্ত হাসি। “আমরা কেউ হারাতে চাই না। আমাদের হারিয়ে দেয় পরিস্থিতি, নিয়তি।”
তৃষা নিঃশব্দে জানালার বাইরে তাকিয়ে থাকে।
ভেজা পাহাড়ের বুক থেকে ধোঁয়ার মতো কুয়াশা উঠছে।
দু’জনের মাঝখানে ঝুলে থাকে অদৃশ্য এক প্রশ্ন,
এবার কি সত্যি তারা একে-অপরকে খুঁজে পাবে, নাকি নিয়তিই আবার তাদের আলাদা করে দেবে? তৃষার বুক
উঠানামা করছে দ্রুত, যেন শ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছে। জানালার কাচ বেয়ে জল গড়িয়ে পড়ছে। প্রতিটি ফোঁটা যেন তার বুকের ভেতরের অশ্রুর প্রতিধ্বনি। সে হঠাৎ ঘুরে প্রেমের দিকে তাকাল। চোখ দুটো লালচে, কণ্ঠ ভাঙা। “আপনি জানেন, আমি কেন ভয় পাই? কারণ আপনার আসা-যাওয়া সবকিছুই অনিশ্চিত। একদিন ভালোবাসেন, পরদিন হারিয়ে যান। আমার কাছে ভালোবাসা মানেই নিরাপত্তা, নিশ্চয়তা… অথচ আপনার কাছে ভালোবাসা শুধু আবেগের ঝড়।”
প্রেম চোখ নামিয়ে ফেলে, হাত দুটো মুঠো করে রাখে হাঁটুর ওপর। বাইরে বজ্রপাতের আলো আবার ঝলসে ওঠে, তার মুখে কষ্টের ছাপ স্পষ্ট হয়। “আমি হারিয়ে যায়নি তৃষা। আমায় হারিয়ে দেয় সময়, মানুষ আর সেই অভিশপ্ত পরিস্থিতি। বিশ্বাস করো, প্রতিটি মুহূর্তে তোমার জন্য বুকটা ভেঙে গেছে।”
তৃষা মাথা নেড়ে ফেলে, চোখের পানি চেপে রাখতে না পেরে বলে ওঠে, “ভালোবাসা কি শুধু বুক ভাঙার গল্প? আমি চাইনি এত দুঃখ, আমি চাইনি এত কষ্ট। আমি শুধু চাইছিলাম আপনার হাতটা আমায় শক্ত করে ধরে থাকুক।”
প্রেম তার হাত ধরতে চাইলে তৃষা প্রথমে সরে যায়, কিন্তু পরক্ষণেই আঙুলগুলো ধরা পড়েই যায়।
প্রেমের কণ্ঠ কেঁপে ওঠে, “তুমি জানো, আমি পারলে তোমাকে পৃথিবীর সব কষ্ট থেকে বাঁচিয়ে রাখতাম। কিন্তু আমি নিজেই তো ভাঙাচোরা মানুষ। তবু একটা কথা শোনো তৃষা আমি যতোই ভুল করি না কেন, আমার ভালোবাসার সত্যিটা নিয়ে কোনো প্রশ্ন রেখো না।”
তৃষা তার চোখের দিকে তাকিয়ে থাকে, ভেতরে রাগ আর টান একসঙ্গে জ্বলে ওঠে। “তাহলে কেন প্রত্যুষের নাম নিলেন? কেন বারবার আমার বিশ্বাসে ফাটল ধরাতে চান?”
প্রেমের ঠোঁট শক্ত হয়ে ওঠে, “কারণ আমি হিংসে করি। তোমাকে অন্য কারও ছায়াতেও কল্পনা করতে পারি না। আমি চাই তুমি শুধু আমার হও। আমি তোমায় ভালোবাসি এর মানে কি জানো?”
‘ কি?’
“জগতের সকল পুরুষ তোমার জন্য নিষিদ্ধ, হারাম।”
ঘরটা নীরব হয়ে যায়। শুধু বৃষ্টির শব্দ আর দুজনের নিঃশ্বাস মিলেমিশে চলতে থাকে।
তৃষার চোখে আবারও জল গড়ায়, কিন্তু এবার তা একেবারে ভিন্ন রকম—মিশে আছে অভিমান, আবার অস্বীকার করতে না পারা ভালোবাসা।
সে ধীরে ধীরে বলে, “প্রেম, আপনি যদি আমার ভেতরের ভয়টুকু মুছে দিতে পারেন… তবে হয়তো আমি আবার বিশ্বাস করতে পারব।”
প্রেম তার মুখের ভিজে চুল সরিয়ে দেয়, নিঃশব্দে ফিসফিস করে বলে, “তাহলে আমাকে সময় দাও। আমি প্রমাণ করব, এইবার আর কোনো ঝড় তোমাকে আমার কাছ থেকে কেড়ে নিতে পারবে না।”
জানালার বাইরে ভোরের আলো ফুটতে শুরু করেছে। কিন্তু ভেতরের এই দুজনের রাত এখনো শেষ হয়নি।বাইরে বৃষ্টির শব্দ ধীরে ধীরে কমে এসেছে। পাহাড়ের বুক থেকে কুয়াশা গড়িয়ে পড়ছে নিচে। আকাশে ফিকে আলো ফোটার ইঙ্গিত। রাতের কালো রঙে মিশে গেছে ভোরের হালকা সোনালি আভা। রুমের ভেতর যেন এক অদ্ভুত শান্তি নেমে এসেছে। কিন্তু সেই শান্তির নিচে জমাট বেঁধে আছে অজস্র না-বলা কথা।
তৃষা বিছানায় বসে আছে, তার ভেজা জামা এখনো গায়ে। দৃষ্টিতে আরেক রকম নরমতা। প্রেম ধীরে ধীরে তার কাছে এগিয়ে আসে। নিঃশব্দে মেঝের ওপর হাঁটুর ভাঁজ ফেলে বসে পড়ে। তার চোখ সরাসরি তৃষার চোখে আটকে যায়। “তুমি ভয় পেও না, তৃষা। আমি যদি আবারও তোমার হাত ছাড়ি… তবে সেটাই হবে আমার জীবনের শেষ ভুল।”
তৃষা থমকে তাকায় তার দিকে। ঠোঁট কাঁপে, কিন্তু কথা বেরোয় না। চোখে জমে থাকা জল গড়িয়ে গালে পড়ে যায়। “আমি জানি না আপনাকে আবার বিশ্বাস করা ঠিক হবে কিনা। কিন্তু আমার ভেতরে… সব রাগ, সব ভয় পেরিয়েও আমি আপনাকে ছাড়া কিছু ভাবতে পারি না।”
প্রেম হাত বাড়িয়ে তার অশ্রু মুছিয়ে দেয়। হাতটা ধরা পড়েই তৃষা আর ছাড়ায় না। ঘরটা যেন নিঃশ্বাস বন্ধ করে শোনে তাদের কথোপকথন। বাইরে ভোরের আলো একটু একটু করে বেড়ে উঠছে। পাখিরা ডাকতে শুরু করেছে। তবু এই দুজনের ভেতরের অন্ধকার এখনো কাটেনি পুরোপুরি। প্রেম নিচু স্বরে বলে, “তৃষা, আমি যদি তোমার কাছে আবারও সুযোগ চাই… তুমি কি আমায় ফিরিয়ে দেবে?”
তৃষা চোখ নামিয়ে দীর্ঘক্ষণ চুপ করে থাকে। তারপর কাঁপা গলায় বলে, “সুযোগ চাইছেন, তাই তো? তবে শর্ত আছে, আমার হাত ছাড়বেন না আর কখনো।”
প্রেমের চোখ চকচক করে ওঠে। সে নিঃশব্দে মাথা ঝুঁকিয়ে তৃষার কপালে ঠোঁট ছোঁয়ায়। বাইরে ভোরের প্রথম সূর্যের আলো জানালা ভেদ করে ঘরে এসে পড়ে। তবে স্পর্শের দরজাটা এখনো দুই দেশের মধ্যকার বর্ডারের মতো দাঁড়িয়ে আছে। প্রেমের চোখের কোণে তখন জল। তবে ভেতরকার কষ্ট সে আর প্রকাশ করতে চাইছে না। ওঠে যেতেই এবার যেন তৃষা আরো শক্ত করে জাপ্টে ধরল তাকে। এক মুহূর্তে তৃষা প্রেমের লেদারের জ্যাকেটটা খামচে ধরে ঠোঁটে শক্ত চুমু বুলিয়ে দিলো। মুহূর্তেই যেন অপাশের ভেঙে যাওয়া প্রেম নেওয়াজটা প্রাণ ফিরে পেল।
প্রেমতৃষা পর্ব ৩৩
বিটারহার্টকে আরও শক্ত করে চেপে ধরল বুকে। শরীরের ভেজা পোশাক গুলো শরীরে লেপ্টে থাকার দায়বদ্ধতা গুলো একে একে শেষ হতে লাগল। তৃষার দেহের প্রতিটি ভাঁজে ভাঁজে লুকিয়ে রাখা রহস্যের জট খোলার তাড়নায় মরিয়া হলো প্রেম নেওয়াজ। হাতে প্রতিটি স্পর্শে খুলতে থাকল এক একটি গল্পের পেছনকার রহস্য। দু’জনের নিশ্বাস ভারী হলো ঠিক সেই রাতের আঁধারের মতো। দু’টো হৃদয়ের মিলন থেমে যাওয়া বৃষ্টিকে বাড়িয়ে তুলে তাঁদের অভিমানের পাল্লাকে ভালোসার উষ্ণ চাদরে ঢেকে দিলো।