প্রেমতৃষা পর্ব ৪০ (৩)
ইশরাত জাহান জেরিন
তৃষা পেছানোর চেষ্টা করল। যদিও এই চেষ্টা বৃথা। কারণ শরীরটা অনেক আগেই ছেড়ে দিয়েছে। লোকটা তাকে এবার পেছন থেকে আরো শক্ত করে ধরল। গলা থেকে ছুড়িটা ধীরে ধীরে নেমে এলো তৃষার বাহুতে।
ঠান্ডা, বরফের মতো শীতল তার প্রতিটি স্পর্শ। আচমকা চামড়ার ভেতর দিয়ে ধাতব ফলা ঢুকে গেল মসৃণভাবে। রক্ত প্রথমে ক্ষীণ রেখায় বেরোল, তারপর এক ধাক্কায় গড়িয়ে পড়ল নিচে। তৃষার চোখে ঝাপসা।
শরীর জমে গেছে, চিৎকারের শব্দ তার গলায় আটকে আছে। তার কানে এখন কেবল নিজের হৃদয়ের ধ্বনি, ঠকঠক ঠকঠক করে বাজছে। লোকটা কোনো অনুভূতি ছাড়াই ছুরিটা টেনে বের করল। তারপর ধীরে ধীরে উঠে গেল, পাশের সোফায় গিয়ে বসে পড়ল। সবকিছু যেন স্লো-মোশন হয়ে গেছে। সোফার চামড়ার শব্দ, হুডির ঘর্ষণ, ছুঁড়ির ব্লেডে লেগে থাকা রক্তের চিকচিকে ঝলক সব মিলে ভয়কে বাস্তব করে তুলছে। আশপাশ ঘোলাটে। লোকটার মুখে কোনো কথা নেই।
আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন
সে শুধু একবার মাথা কাত করল, হয়তো তৃষার প্রতিক্রিয়া দেখছে। চোখ দুটো সানগ্লাসের আড়ালে হারিয়ে গেছে। তৃষা বুঝতেই পারছে না, ওর ভেতরে কেউ আছে কিনা, নাকি শুধুই অন্ধকার? হাতের রক্ত গড়িয়ে ঝরছে মেঝেতে। লোকটা সেই মৃত দেহের সামনে কুঠার নিয়ে বসল। বিভৎস শরীরটিকে আঘাত করতেই কুঠারের ভারী আঘাতে মাংস আর হাড়ের ফাঁক দিয়ে ছিটকে পড়ছে গাঢ় রক্ত। প্রতিটি আঘাত ঘরে প্রতিধ্বনিত হচ্ছে, চ্যাঁক্… চেটাং… চেটাং… শব্দ তুলে। তৃষা কোণের দিকে গুটিয়ে বসে আছে। মুখের রং তার ফ্যাকাসে হয়ে গেছে। চোখের সামনে যা দেখছে, সেটা বাস্তব কিনা বুঝতে পারছে না। হঠাৎ লোকটা হাত থামিয়ে তার দিকে তাকাল। মুখে কালো হুড টানা, ঠোঁটে বিকৃত এক হাসি, “এরপর তোমার পালা, তৃষা। দরজা খোলা আছে… পালাও। গো ফাস্ট।”
এক মুহূর্ত স্থবির হয়ে গেল তৃষা। গলার ভেতর থেকে এক ধরনের গা-গোলানো শব্দ বের হলো, উঃ করেই সে বমি করে ফেলল, রক্তে ভেজা মেঝেতে। লোকটা হাসল, অমানুষিক সেই হাসি। তৃষা হেঁচড়ে পিছাতে লাগল, হাত-পা কাঁপছে। ঠান্ডা মেঝেতে গড়াতে গড়াতে একবার দেয়ালে ধাক্কা খেল, তারপর মরিয়া হয়ে উঠল। উঠে দাঁড়াতেই তার পায়ের তলায় পিচ্ছিল রক্ত। একবার পিছলে পড়তে পড়তে সামলে নিল। তারপর, বুক ধড়ফড় করতে করতে, সে ছুটল দরজার দিকে। পেছনে শোনা গেল সেই ভয়ঙ্কর কণ্ঠটা, “দৌড়াও, তৃষা… যতক্ষণ পারো।” তৃষা এক মুহূর্তে ভেঙে পড়ল, তবু বাঁচার প্রবৃত্তি তাকে টেনে তুলল। সে এক ঝটকায় উঠে দরজার দিকে দৌড় দিল। দরজা এবার খোলা।
কিন্তু করিডোরে বের হয়েই সে থমকে গেল। হোটেলটা কি রূপ বদলে ফেলেছে? সব করিডোর একইরকম, আলো নিভে এসেছে, কোথাও কোথাও লাল ইমার্জেন্সি লাইট টিমটিম করছে। তৃষার মাথা পুনরায় ঝিমঝিম করছে। শরীর দুর্বল, তবু সে দৌড়াচ্ছে। ডানদিকে একটা মোড়, তারপর আরেকটা কিন্তু প্রতিবারই সে ফিরে আসছে একই জায়গায়। একই কার্পেট, একই দরজাগুলো, একই নম্বর—১০২। তৃষা থেমে গেল, হাঁপাচ্ছে। রক্তে হাত ভিজে গেছে। এসব কি তার নিজের রক্ত? দেয়ালে ঠেকাতেই রক্তের দাগ ছড়িয়ে পড়ছে।
তার চোখে জল, ভয়, বিভ্রম সব একাকার।
সে ফিসফিস করে বলল, “আমি কোথায়? আমার রুম কোনটা? প্রেম আপনি কই? আমাকে বাঁচান। দম বন্ধ হয়ে আসছে আমার।” কোনো উত্তর নেই।
শুধু বাতাসের ভেতর সেই গান বাজছে কোথাও,
“প্রেম আমার… ওওওও… প্রেম আমার…”
তৃষা করিডোরের দিকে তাকাল।
দূরে দাঁড়িয়ে আছে একটা ছায়া। জলে চোখ ঝাপসা তাই অনুমান করতে পারছে না কে? তবে নিশ্চিত ওই রুমের মধ্যকার মানুষটিই হবে। তাকেও কি ওই মেয়ের মতো ভয়ানক মৃত্যু দেওয়া হবে? কেন? ওই অঘটন দেখে ফেলার চরম অপরাধে? তৃষা দৌড়াতে লাগল উল্টো দিকে, কিন্তু করিডোরটা যেন ঘুরে ঘুরে আবার নিজেই নিজের মধ্যে ঢুকে যাচ্ছে। সে এখন গোলকধাঁধায় বন্দি। সময় নেই, দিক নেই, শুধু ভয় আছে। তার কানে আবার সেই কণ্ঠস্বর, নরম তবে ভো ভো শব্দ নিয়ে কেমন যেন শীতলতা জড়ানো তাতে।
“তুমি যত দৌড়াও, তৃষা… এখানেই ফিরবে… আজ পর্যন্ত আমার টার্গেট মিস হয়নি। দেয়ালে অনেকদিন ধরে তোমার ছবি টাঙানো। এবার তো তা সরাতে হবে?”
তৃষা চিৎকার করল। কিন্তু করিডোরের দেয়াল সেই চিৎকার গিলে ফেলল। লাইটগুলো নিভে গেল একে একে, আর শেষে কেবল জ্বলে রইল, দরজা নাম্বার ১০২। দরজার ভেতর থেকে তখনও শোনা যাচ্ছে সেই গ্রামোফোনের গান,
“প্রেম আমার… প্রেম আমার…”
লোকটা ধীরে ধীরে তার দিকে এগিয়ে এলো। এতটা দূরত্ব। তবে এবার ঠিক তাকে একটা সুগন্ধি অনুভব হলো। এই পারফিউমের গন্ধটা কোথায় অতি পরিচিত? একটু ভেবে পরীক্ষণে তৃষা বিরবির করে আওরালো, ‘প্রেম এটা আপনার পারফিউমের গন্ধ? আমি এই গন্ধটা ভুলতে পারব না প্রেম।’ এগিয়ে আসা ঝাপসা ছায়ার দিকে তাকিয়ে এক মুহূর্তের জন্য চোখ বন্ধ করল। ওই লোকটার হাতে রক্ত ভেজা সেই কুঠার। এই সিজনে কক্সবাজারের হোটেল গুলায় তুলনামূলক ভিড় কম থাকে। তাছাড়া তারা যেই হোটেলে উঠেছে। সে নিতান্ত বড়লোকি হোটেল। সব মানুষ এফোর্ড করতে পারে না। তাই মানুষ ভাবনার থেকেও এখন কম।
আর ঘড়ির কাঁটায় যেই সময়টা উল্লেখ আছে, তাতে বলা যায় এখন সেই হাতেগোনা মানুষ গুলোও চাদের আলোয় সমুদ্রবিলাসে ব্যস্ত। তার মানে কি তৃষাকে কেউ বাঁচাতে আসবে না? কিছুক্ষণ চোখ বন্ধ করে তৃষা ভাবল। তারপর চোখটা মেলতেই দেখল লোকটা আর নেই। ভালো করে সে চারপাশে দেখল। হুম ওই লোকটা আর কোথাও নেই। তবুও ভয় যে কমছে না। প্রেমকে লাগবে। প্রেম কোথায়? কোন রুমে? তৃষার ফোনটা বোধহয় ওই ১০২ এ পড়েছে। কিন্তু সেখানে আর যাওয়া যাবে না। তৃষা আবারও এদিক-ওদিক তাকালো। সাহায্য লাগবে না। শরীরটা এখনি নেতিয়ে পড়বে। হঠাৎ সামনের দিকে দৌড়ে যেতেই একটা রুম নজরে এলো। হলুদাভ বাতির আলো দরজার ফাক গলে বের হচ্ছে। সে দৌড়ে সাহায্যের জন্য সেই রুমের দিকে গেল। রুমের ভেতর গিয়ে বলল, ‘ কেউ আছেন? সাহায্য চাই।’
প্রেমতৃষা পর্ব ৪০ (২)
হঠাৎ ভেতরের রুম থেকে পায়ের শব্দ এলো। তৃষার ভেতরটা আবারও জমে উঠল। কেমন যেন লাগছে। তার চলে যাওয়া উচিত। পেছনে ফিরে দেখল দরজা অটোমেটিক লক। তৃষা দরজা খোলার চেষ্টা করতেই কানে আবারও সেই গান এলো।
‘সেই প্রেম আমার….’ তৃষা সাহস করে পেছন তাকাতেই দেখল একটা কালো হুডি পরহিত লোককে। লোকটার মুখে মাক্স নেই। তবে লোকটাকে দেখা মাত্রই তৃষা কাঁপা গলায় জিজ্ঞেস করল ‘ ফারাজ এলাহী না?’