প্রেমপিপাসা পর্ব ১৭
সুমাইয়া সুলতানা
হ্যাভেন নিজের অফিসের কেবিনে বসে আছে। দৃঢ় চিবুকে আঙুল ঠেকিয়ে কাঁচের জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে আছে। সুগভীর চোখের দৃষ্টি বহু দূরের একটা বিল্ডিংয়ের ছাদে নিবদ্ধ। সেখানে ছোট্ট ছেলেকে কোলে বসিয়ে তার মা আদর করছে। হেসে হেসে হাত নেড়ে কিছু বলছেন। মায়ের কথা শুনে বাচ্চাটা খিলখিল শব্দের প্রতিধ্বনি তুলে প্রাণজুড়নো হাসি উপহার দিচ্ছে। এসব নিগূঢ় দর্শনে দেখে চলেছে হ্যাভেন। অনেক অজানা প্রশ্নের গভীরে হারিয়ে কোনো কিছুর উত্তর খোঁজার চেষ্টা চালাচ্ছে। পুরো কেবিনটা নীরব। শুধু ঘড়ির কাঁটার একঘেয়ে টিকটিক শব্দ আর মাঝেমধ্যে বাতাসে দুলতে থাকা পর্দার মৃদু সরসরানি।
ডেস্কের উপর একটা খোলা নোটবুক পড়ে আছে। পাশে রাখা কালো কালির একটা পেন, যা সে হাতে নিয়েও ব্যবহার করেনি। হয়তো কিছু লেখার ইচ্ছে ছিল, কিন্তু শব্দগুলো মনের ভেতর আটকে গিয়েছে, কন্ঠ ফুঁড়ে বেরিয়ে আসতে চাইছে না। চিন্তাগুলো এলোমেলো হয়ে মাথায় ঘুরছে, ঠিক কোথা থেকে শুরু করবে সেই সিদ্ধান্তেই পৌঁছাতে পারছে না।
হ্যাভেনের ললাটের ভাঁজ গভীর হয়েছে। কখনো চোখ বন্ধ করে দীর্ঘশ্বাস নিচ্ছে, কখনো আবার চেয়ারের হাতলে আঙুলের অস্থির নাচন। কী যেন একটা অজানা ভাবনা তাকে গ্রাস করে ফেলেছে। একটা অসমাপ্ত অনুভূতির জালে জড়িয়ে যাচ্ছে সে। হয়তো কোনো পুরনো স্মৃতি, না বলা কোনো কথা, কিংবা আসন্ন কোনো সিদ্ধান্তের বোঝা তাকে স্থির হতে দিচ্ছে না।
বাইরের আকাশ কিঞ্চিৎ মেঘলা ভাব। রোদের আভা নেই। প্রকৃতিও নিজ মনের মতোই ভারী হয়ে আছে। হ্যাভেন উপলব্ধি করতে পারছে, বিশাল বড়ো রকমের একটা ঝড় দ্রুত আসতে চলেছে জীবনে। নিজেকে নিয়ে ভাবনার কোনো কারণ নেই। কিন্তু সে ভয় পাচ্ছে পরিবার, নিজের আবেগ, পরিস্থিতির বাস্তবতা, আর ভবিষ্যতের অনিশ্চয়তার কাছে।
আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন
প্রকট দৃষ্টি ধীরে ধীরে ডেস্কের উপর পড়ে থাকা নোটবুকের দিকে ফিরে আসে। হ্যাভেনের কেবিনের নীরবতা হঠাৎই ভেঙে গেল, যখন তার ফোনটা মেসেজের রিংটোনের স্লোগান শুরু করে বেজে উঠল।
হ্যাভেন ভ্রু কুঞ্চিত করে মেসেজে দেখল। তড়িৎ গতিতে কল করল মেসেজ পাঠানো মানুষের নিকট। মুহুর্তে কল রিসিভ হয়। ফোনটা কানে তুলল সে। চোয়াল শক্ত করে দাঁতে দাঁত চেপে বলে উঠলো,
” লিসেন টু মি ভেরি কেয়ারফুলি। বিকজ আই ওউন্ট রিপিট মাইসেল্ফ! তুমি যদি ভাবো যে আমাকে বোকা বানানো এত সহজ, তাহলে ভুল করছো। আই নো একজ্যাক্টলি হোয়াট ইউ ডিড। অ্যান্ড ট্রাস্ট মি। বিশ্বাসঘাতকতা আমি একেবারেই হালকাভাবে নেই না। ”
ফোনের ওপর পাশের লোকটা নড়েচড়ে শুষ্ক ঢোক গিলল। জিভ দ্বারা ঠোঁট ভিজিয়ে মিনমিন করে জানালো,
” স্যার, বিলীভ মি। ব্যাগে তেমন কিছু পাই নি। ”
রাগান্বিত হয়ে ধমকে উঠল হ্যাভেন। তিরিক্ষি মেজাজ সহিত কন্ঠনালী ভেদ করে ধ্বনিত হলো উচ্চস্বর,
” নো এক্সকিউজ, ননসেন্স! আমার শ্বশুর বাড়ি যাওয়ার সময় তার হাতে ব্যাগ দেখেছিলাম। স্পষ্ট তীক্ষ্ণ গন্ধ নাসারন্ধ্রে ভেসে এসেছিল আমার। আ’ম শিওর যা ডাউট করছি, তাই ছিল ব্যাগে। মিস্টেক আমার হতেই পারে না। তুমি পাশের দোকানে বসে চা পান করছিলে। এমন তো নয়, তুমি ইচ্ছে করে তার উপর থেকে নজর সরিয়ে তাকে জিনিসগুলো লুকানোর যথাসাধ্য সুযোগ করে দিয়েছো? পরে কোনোরকম চ্যাক করে প্রমাণ করতে চাইছো, তুমি কাজটা সঠিকভাবে পালন করেছো! এখন আমাকে ভুলভাল বুঝাতে এসেছ?”
লোকটা ভীতিকর কন্ঠে তুরন্ত প্রত্যুত্তর করে,
” মিথ্যা বলছি না স্যার। আপনি যা ভাবছেন এরকম কিছু করিনি। ”
হ্যাভেনের চোখে ঝলসে উঠছে ক্রোধে। গলার স্বর নিঃশব্দ ঝড়ের মতো। লম্বা শ্বাস টেনে নিজেকে শান্ত করার প্রয়াস চালাল। কাঠিন্য চিবুক আরো কঠিন হয়ে উঠে। ধ্বংসাত্মক লেলিহান রাগটুকু গিলল সবেগে। শাসানোর ভঙ্গিতে বলে ওঠে,
” আমার ধৈর্যের পরীক্ষা কোরো না। কারণ যদি আমাকে নিজের হাতে ব্যবস্থা নিতে হয়, বুঝতে পারছো কি হাল করবো তোমার? একে একে দু’বার ভুল করেছো। উভয় বার বলেছো কাজ কমপ্লিট হয়নি। এত ভুল হয় কিভাবে? স্বাভাবিক ভাবে তোমাকে বিশ্বাসঘাতক ভাবতেই পারি, রাইট? তোমাকে সন্দেহের তালিকায় রাখতেই পারি। আর টাকা কি গাছে ধরে? দু-হাত পেতে টাকা নেওয়ার সময় তো ঠিকই নিতো পারো। কাজের ক্ষেত্রে অষ্টরম্ভা! ”
লোকটা নত সুরে থমথমে মুখে উত্তর দেয়,
” এবারের মতো ক্ষমা করে দেন, স্যার। আ…. ”
হ্যাভেন কথা কেড়ে নিলো। শব্দ তুলল বাজখাঁই গলায়,
” তোমাকে আর কিছু করতে হবে না। জাস্ট নজর রাখো। এবার যা করার আমি করবো। ”
তৎক্ষনাৎ কল কেটে পুনরায় স্বীয় মনে বিড়বিড়ায় হ্যাভেন,
” টিমের লোক রেখে ভাড়া করা বালের লোকদের দিয়ে কান চুলকায়! যে এই অকর্মের ঢেঁকি’কে ভাড়া করেছে, তার সাথে বোঝাপড়া করা দরকার! ”
বিরক্তিকর গুমোট পরিস্থিতিতে, দরজার পাশে ছোট একটা মৃদু আওয়াজ হলো। তক্ষুণি নরম সাবলীল কন্ঠে বাক্য কর্ণকুহরে পৌঁছাল,
” মে আই কাম ইন, স্যার? ”
সহসা হ্যাভেন নিগূঢ় চাউনীতে নেত্রদ্বয় ঘুরে তাকাল। তীক্ষ্ণ, শীতল দৃষ্টি পড়ল দরজার ফ্রেমে দাঁড়িয়ে থাকা অ্যাসিস্ট্যান্ট মৃণালের উপর। মৃণাল বেশ সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। অভিব্যক্তিতে কোনো ভয় নেই, বরং এক ধরনের দৃঢ়তা।
হ্যাভেন ভারিক্কি নিঃশ্বাস ছাড়ল। কোনো এক ছন্দময়, শীতল ক্ষোভে ফোনটা টেবিলে ছুঁড়ে রেখে দেয়। গম্ভীর কণ্ঠে বলল,
” কাম ইন, মৃণাল। অ্যান্ড ক্লোজ দ্য ডোর। ”
মৃণাল এক মুহূর্তও দেরি করল না। ধীর কদমে ভেতরে প্রবেশ করে। হাতে থাকা ফাইলটা হ্যাভেনের নিকট এগিয়ে দিল।
” জামশেদ ডেকেছিলি আমায়? ”
বড়ো ভাইয়ের ডাক শুনে ঘাড় ঘুরায় জামশেদ। মাথা নেড়ে হ্যাঁ বোঝালেন। ড্রয়ার থেকে হ্যাভেনের পাঠানো নীল রঙের কাপড়ে আবৃত ট্রে-টা বের করে জহিরের হাতে দিলেন। জহির প্রশ্নবিদ্ধ দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছেন। জামশেদ ইশারায় বোঝালেন খুলে দেখতে।
জহির কপাল কুঞ্চিত করে কাপড় সরিয়ে দেখলেন, ট্রেতে টাকা রয়েছে। অবাক হলেন তিনি। বোধগম্য হলো না কিসের টাকা! জামশেদের দিকে তাকালেন সরল দৃষ্টিতে। বুঝতে না পেরে ভাবুকতা সমেত অবুজ গলায় শুধালেন,
” এতগুলো টাকা কোথা থেকে এলো? কে দিয়েছে? ”
জামশেদ শীতল চাউনীতে চেয়ে শান্ত কন্ঠে জানালেন,
” হ্যাভেন পাঠিয়েছে তোমার জন্য। ”
জহিরের চোখ দুটো চকচক করে উঠল। টাকাগুলো বুকে চেপে, তুরন্ত কাছে এসে জামশেদ’কে আলিঙ্গন করলেন। কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করে ধীম স্বরে বললেন,
” ধন্যবাদ জামশেদ। তুই না থাকলে ঋণ পরিশোধ নিয়ে মুশকিলে পড়তাম। ”
জামশেদ আলতো হাসলেন। শূন্য চক্ষুদ্বয় টাকার ট্রে-তে স্থির রেখে নিস্প্রভ গলায় প্রত্যুত্তর করলেন,
” আমি কিছু বলিনি। হ্যাভেন নিজে থেকেই পাঠিয়েছে। তোমাদের মস্তিষ্কের ভেতর কিলবিল করা অসৎ ভাবনাগুলো সম্পর্কে অব্যাহত সে। শুনতে খারাপ শোনা গেলেও অরুর খাতিরে হ্যাভেন তোমাদের টাকাগুলো দিচ্ছে। ভাবীকে বলো আমার মেয়ের উপর যেন কোনো রাগ না থাকে। তাকে আড়ালে কিংবা সম্মুখে কটুকথা যেন আর না শোনায়। বদদোয়া যেন না করে। আজকেও মেয়েটাকে যা নয় তাই বলে কথা শুনিয়েছে। সাথে তোমার মেয়ে শানায়াও ছিল। আমার মেয়েটা থাকত কতক্ষণ? আজকে অন্তত কোনো কথা না বললে হতো না? আমি পারতাম ভাবীকে অপমান করতে। কিন্তু আমার রুচি এতটাও নীচে নেমে যায়নি, মায়ের মতো বড়ো ভাবীকে খারাপ কথা বলবো! সেজন্য চুপ থেকেছি। প্রার্থনা করো, অরু যেন আজকের ঘটনা হ্যাভেন’কে না জানায়।
সে জানলে তোমার মেয়ে আর ভাবীর দু’জনের কপালে দুঃখ আছে। যদিও আমার বিশ্বাস বাবার বাড়ির কথা অরু হ্যাভেন’কে কিছু জানাবে না। তবে রেগে মুখ ফসকে বলে দিলেও দিতে পারে। রাগের উপর ভরসা করা যায় না। মা মরা মেয়েটা কোনো কষ্ট পেলে বাবা হয়ে আমি সেটা সহ্য করতে পারবো না। অরু ভীষণ জেদি। সে ভেবেছিল তোমরা ওকে টাকার লোভে হ্যাভেনের সাথে বিয়ে হতে দিচ্ছো। বিয়েতে বাঁধা দেওয়ার চেষ্টা করোনি। অরু’কে বিয়ে দিয়ে হ্যাভেন থেকে মোটা টাকা হাতাতে চেয়েছো। অরুর ধারণা ভুল নয়। সেটা তুমিও জানো। কিন্তু মেয়ে আমার অবুঝ উড়নচণ্ডী তরুণী। সেজন্য বিয়ের দিন টাকাগুলো বুদ্ধি খাঁটিয়ে, জেদ, রাগ, অভিমানের বশিভূত হয়ে ফেরত নিয়েছে। একটু ধৈর্য্য ধরতে। আমি টাকা ম্যানেজ করার ব্যবস্থা করতাম।
কিন্তু না, ধৈর্য্য শব্দটা তোমাদের সঙ্গে যায় না। সেই কারণে বড়ো ভাবী আমার মেয়েকে অপয়া, স্বার্থপর, কালনাগিনী, মায়ের মতো নিজেরটা বোঝে আরও কত কি বলেছে। সেসব কথা শুনেও তুমি একটি বারের জন্য ভাবীকে কিছু বলোনি। নির্নিমেষ বউয়ের কটুবাক্য শ্রবণ করেছো আর সিগারেটের ধোঁয়া উড়িয়েছো। প্রতিবাদ না করে চুপচাপ বসে শুনেছো শুধু। সত্যি করে বলোতো, আমার মেয়ে হ্যাভেন’কে বিয়ে করে কি নিজের কোনো স্বার্থ হাসিল করেছে? নাকি অরিজিনালি তোমাদের কার্যসিদ্ধি হয়েছে? ”
আরেক দফায় চমকে হতভম্ব হয়ে গেলেন জহির। বিস্মিত হলো ফাটা অক্ষিপট! মুখবিবর হয়ে উঠল চরম থমথমে। লজ্জায় মাথা নিচু করে নিলেন। অনুতপ্ত হলো ভগ্নহৃদয়। কন্ঠ ফুঁড়ে শব্দ গুছিয়ে বলার মতো কথা খুঁজে পেলেন না। পরিস্থিতি অস্বস্তিকর। মস্তিষ্কের ভেতর দাপাদাপি করছে খারাপ লাগার গুমোট রেশ। ভাইয়ের চোখে চোখ রাখার সাহস পাচ্ছেন না।
জামশেদ তাচ্ছিল্য হাসলেন। ভারিক্কি নিঃশ্বাস ছাড়লেন ঠোঁট গোল করে। প্রকট চাহনি নিক্ষেপ করলেন ভাইয়ের অনুতাপসূচক মুখমন্ডলের দিকে চেয়ে। তাকে চুপ থাকতে দেখে নিজে থেকে রাশভারি কন্ঠে ফের বললেন,
” ভেবোনা আড়ালে লুকিয়ে, দরজায় কান পেতে কিছুদিন আগে বলা তোমাদের কথাবার্তা শুনেছি। ফোনে নেটওয়ার্ক প্রবলেম ছিল। তাই বেরিয়ে ছিলাম রুম থেকে। ঘুরতে ঘুরতে তোমাদের রুমের কাছাকাছি আসতেই নেটওয়ার্ক পেয়ে গিয়েছিলাম। তক্ষুণি তোমাদের অরু’কে নিয়ে এত সুন্দর চিন্তাভাবনা, কথাগুলো আমার কর্ণগোচরে এসে পৌঁছায়। ”
জহির আধ্যাত্মিক লজ্জিতবোধ করলেন। আত্মগ্লানিতে মুখটা শুকিয়ে গিয়েছে। হাতের করতল ঘামতে শুরু করেছে। বারবার হতাশামূলক ঢোক গিলছেন। মস্তকাবরণ নিচু রেখে সচেতন হয়ে বিরস মুখে উত্তর দিলেন,
” জামশেদ আমি আস…..”
শুনতে চাইলেন না জামশেদ ভাইয়ের ইনিয়েবিনিয়ে নিজেকে নির্দোষ করা বাক্য। হাত উঠিয়ে তাকে থামতে বলে, নজর ফিরিয়ে নিলেন। নয়ন জোড়াতে ঠাঁই পেলো দেয়ালে থাকা অরুর হাস্যোজ্জ্বল স্নিগ্ধ পুলকিত মুখশ্রী।
অরুর ছবিতে মুগ্ধ দৃষ্টিতে চেয়ে, নদীর টলমলে জলের ন্যায় ঠান্ডা কন্ঠে বলে উঠলেন জামশেদ,
” আমি কিছুক্ষণ রেস্ট করবো। এখন তুমি যেতে পারো। ”
হাভেনের গাড়ি কালো ধোঁয়া ছাড়তে ছাড়তে রাস্তার মোড়ে এসে থামল। অরু দরজা খুলে এক ঝটকায় উঠে বসলো। পেছনের আসনে নিজেকে গুটিয়ে নিলো সে। বুকের মধ্যে এক শীতল পাথর চেপে বসেছে। নিঃশ্বাস নিতে গেলেই কেমন গলা বুঁজে আসছে। জলে টইটম্বুর নয়ন দুটো কেবল সামনের দিকে, জানলার কাঁচের ওপারে অপসৃয়মাণ শহরের চেনা-অচেনা দৃশ্য। অথচ মন যেন বন্দি এক ভিন্ন জগতে। যেখানে শুধু অস্থিরতা, দহন আর গুমোট এক দুঃসহ অনুভূতি।
হ্যাভেন ড্রাইভার সহ গাড়ি পাঠিয়ে দিয়েছে অরু’কে বাড়িতে ফিরে আসার জন্য। কাজ থাকায় সে আসতে পারবে না বলে জানিয়েছে। বাবার বাড়িতে অরুর সময়টা ততক্ষণ পর্যন্ত ভালো কেটেছে, যতক্ষণ পর্যন্ত বড়ো চাচির সঙ্গে দেখা না হয়েছে। শাহানা অরু’কে মুখ ঝামটি মেরে নানান কটুকথা শুনিয়ে দিয়েছেন। অরু স্পষ্টভাষী মেয়ে। চঞ্চলতা, দস্যিপনা রক্তে মিশে আছে। মুখের উপর কড়া জবাব হড়বড়িয়ে খুব ভালো করেই দিতে জানে। ভেবেছিল থাকবে ঘন্টাখানেক, এরমধ্যে কোনোরকম ঝুট-ঝামেলায় জড়াবে না। কিন্তু বড়ে চাচির গা জ্বালানো চ্যাটাং চ্যাটাং বিতৃষ্ণা বাক্যবাণ সহ্য করা মুশকিল হয়ে পড়েছিল। সেজন্য ফুঁসে উঠে, তর্জনী উঁচিয়ে ক্ষুব্ধ কঠিন গলায় বিষাক্ত বাক্য সেও বলেছে। এটাকে কাটকাট উত্তর না, বরং উচিত জবাব বলা চলে। শাহানাও কম যাননি! চওড়া হয়ে উঠেছিলেন অরুর প্রতি। মনে হয়েছিল বহুদিনের চাপা রাগ ঝাড়ছিলেন। একপর্যায়ে এক কথায় দুই কথায় অরুর মাকে টেনে ভীষণ বাজে কথা শুনিয়ে দিয়েছিলেন। এক বাচ্চার বাবার সঙ্গে অরুর বিয়ে নিয়েও অগ্নিশিখার মতো খোঁটা দিয়েছেন। ক্ষেপে গিয়ে অরু ক্ষীর খায়নি। তৎক্ষনাৎ হ্যাভেন’কে কল করে আসতে বলেছে। সে গুরুত্বপূর্ণ কাজ থাকায় গাড়ি পাঠিয়ে দিয়েছে। জামশেদ স্বচক্ষে পরিস্থিতির সকল কিছু অবলোকন করেছেন, তবে তেমন কোনো প্রতিক্রিয়া দেখালেন না। একদম শান্ত, স্থির থেকেছেন। কাছে এসে মেয়ের মাথায় হাত বুলিয়ে মানানোর চেষ্টাও করেন নি। আহত চোখে মেয়েকে বুকে জড়িয়ে ব্যাকুল চিত্তে শুধু বলেছেন,
” স্বামীর নীড়ে ফিরে যাও মা। ”
গাড়ি এগিয়ে চলল। বিষণ্ণতায় ঘেরা মুখশ্রীতে অরু নির্লিপ্ত ভঙ্গিতে বসে। অনুভূতি শুন্য রিক্ত দৃষ্টি গাড়ির জানালার কাঁচ ভেদ করে বাইরে নিমজ্জিত। কিয়ৎকাল পর হঠাৎই চোখে পড়ল না দেখতে চাওয়া অপ্রত্যাশিত ঘৃণিত মুখাবয়ব! নিখিল রাস্তায় অন্য এক মেয়ের সাথে শরীর ঘেঁষে দাঁড়িয়ে। হাত ধরাধরি করে হাসছে, আলতো করে মেয়েটির চুল সরিয়ে দিচ্ছে, চোখে মিশে আছে এক অ’শ্লী’ল অন্তরঙ্গতা। অরুর গা গুলিয়ে উঠল। এক মুহূর্তের জন্য সমস্ত অস্তিত্ব থমকে গেল। নিঃশ্বাস ভারী হলো সহসা। শ্বাস আটকে গেল বুকে। রক্ত জমাট বাঁধার মতো ভারী হয়ে উঠল চারপাশ। ঘৃণার তীব্র ঢেউ এসে আছড়ে পড়ল অন্তঃকরণ সত্তায়। বিষাক্ত ধোঁয়া জমে যাচ্ছে মনের কোণে। এক সেকেন্ডও সেখানে তাকিয়ে থাকতে পারলো না। দৃষ্টি ঘুরিয়ে নিলো দ্রুত। মন, মস্তিষ্ককে কড়া ভাবে বোঝালো এবং ভাবল,
” এই পৃথিবীতে নিখিলের অস্তিত্ব এক কলঙ্কিত দাগ, এক ভয়ানক দুঃস্বপ্ন। অরু এই দুঃস্বপ্নকে পেছনে ফেলে বহুদূর উজ্জ্বল ভবিষ্যতের দিকে এগিয়ে যাবে। ”
বাইরে আকাশ থমথমে। হালকা কিন্তু বেদনাদায়ক হাওয়া বইছে। অরুর চোখ জ্বলছে। আফসোসের তোপে বেগবান করে তুলছে শীর্ণকায়। বক্ষঃস্থল মৃদু ব্যথাতুর ক্ষততে ছটফট করছে। শিরায় শিরায় ছড়িয়ে পড়ছে শীতল যন্ত্রণা। গাড়ির ছোট জানলা দিয়ে ভেতরে ঢুকে আসছে এক অজানা অস্বস্তি। অজান্তেই স্মৃতিতে স্মরণ হতে লাগল, হ্যাভেনের সঙ্গে বিয়ে থেকে শুরু করে এ পর্যন্ত প্রত্যেক মুহূর্তে। অক্ষিকোটর ছাপিয়ে টুপ করে মসৃণ কপোল বেয়ে গড়িয়ে পড়ল ফোঁটায় ফোঁটায় তপ্ত নোনাজল। প্রকৃতিও আজ নির্দয়, বিরক্ত, তিক্ততায় পূর্ণ। হৃদগহীনের নিস্তব্ধতা আরো ভয়ংকর হয়ে নেমে আসছে। ধীরে ধীরে চারপাশের শব্দগুলোও ফ্যাকাসে হয়ে যাচ্ছে। দূর থেকে ভেসে আসছে ক্লান্ত কিছু গাড়ির হর্ন, ক্লান্ত কিছু মানুষের কণ্ঠ। তাতে প্রাণ নেই, অনুভূতি নেই, শুধুই এক ঘূর্ণায়মান ক্লান্তি।
অরুর চোখের সামনে ঝাপসা হয়ে আসছে সবকিছু। যন্ত্রণায় কপালের একপাশে চাপা ব্যথা অনুভব করছে। হৃৎপিণ্ডের প্রতিটি স্পন্দনের সাথে সেই যন্ত্রণা বেড়ে চলেছে। গলার কাছে একটা দলা পাকিয়ে উঠছে। অরু সেই দমচাপা কষ্টটাকে গিলে ফেলতে চায়। ঠোঁট যুগল শক্ত করে বন্ধ করে রাখে, যেন কোনো অনুভূতি ফাঁস হয়ে বেরিয়ে না আসে।
গাড়ির ভেতর শীতল বাতাস বইছে, অথচ অরুর লতানো শরীর ঘামে ভিজে একরকম চিপচিপে হয়ে উঠেছে। অসহ্যকর কষ্টের তাড়নার স্রোতে সে প্রায় নিমজ্জিত হয়ে যাচ্ছে। হৃদয়ের গভীরে কেউ এক বিশাল পাথর বসিয়ে দিয়েছে এমন কাঁটার মতো অনুভূতি হচ্ছে, যা ধীরে ধীরে তাকে চূর্ণ-বিচূর্ণ করে ফেলছে। উৎকণ্ঠা, নিস্প্রভতা, এক অসহ্য ব্যগ্রতা সব মিলিয়ে সে আজ বড্ড অস্থির, বিপর্যস্ত, বিধ্বস্ত।
প্রেমপিপাসা পর্ব ১৬
গাড়ির জানলা ঘেঁষে একফোঁটা জল এসে হাতের উল্টো পিঠে পড়ে। অরু তাকায়। সেই বিন্দুটি অল্পস্বল্প কদমে গড়িয়ে নিচে নামে, তারপর মিলিয়ে যায় কাঁচের গায়ে। অরু ব্যাকুলতা নিয়ে তাচ্ছিল্য হাসে। জলকণার বিন্দু যেন ওর ভেতরে জমে থাকা এক দুঃসহ দীর্ঘশ্বাস। প্রকৃতিও বুঝতে পারলো, সেই নোনাজল হয়তো কোনো এক মানবির অস্পষ্ট বেদনার আকাশ থেকে ঝরে পড়ল। হারিয়ে গেল ধূসর অতলে।