প্রেমপিপাসা পর্ব ১৭ (২)
সুমাইয়া সুলতানা
জানালার পাশে দেয়ালে হেলান দিয়ে, উদাস চিত্তে ভগ্নহৃদয়ে দাঁড়িয়ে রয়েছে অরু। অশ্রুসিক্ত আঁখি যুগল নিবদ্ধ লোহার গ্রিলে। জানালার পর্দা মৃদুমন্দ বাতাসের দাপটে হালকা ভাবে উড়ছে। অরু কষ্টের ভারিক্কি নিঃশ্বাস ছাড়ছে। বুকের ভেতরে বয়ে চলা অনুভূতির বিস্ফোরণ এক ভয়ানক ঘূর্ণিঝড়ের মতো। দীর্ঘক্ষণ কান্না করার ফলে, গলা শুকিয়ে খটখটে মরুভূমির চৌচির মাটির মতো ফেটে যাচ্ছে। শ্বাস নিতে গেলে মনে হচ্ছে, ফুসফুসে শুষে নিচ্ছে একরাশ ধুলো আর ছাই। চোখের কোণে জমে রয়েছে যন্ত্রণার নোনাপানি। হৃদয়ের মধ্যে বয়ে চলা আগুনের উৎস গভীর। যেখানে জমে থাকা ঘৃণা, বেদনা আর প্রতারণার দগ্ধ ক্ষত ধিকিধিকি করে জ্বলছে।
স্বামীর বাড়ি ফিরে অরু কারো সাথে তেমন কথা বলেনি। একদম নির্বিকার থেকেছে। এসে থেকে রুমের মধ্যে ঘাপটি মেরে চুপচাপ আছে। রুম থেকে আর বের হয়নি। বুকের ভেতর এক অসহনীয় ভার চাপা পড়ে আছে। অরু অনুভব করল বিশাল কোনো পাহাড় ক্ষুদ্র হৃৎপিণ্ডের ওপর বসে আছে। প্রতিটি শিরা উপশিরায় এক বিষাক্ত, পঁচা-গলা স্রোত বয়ে দিচ্ছে। সে প্রশান্তির নিশ্বাস নিতে চায়, তবে পারে না। হালকা বাতাসও তাকে দগ্ধ করে চলেছে। চারপাশের নিস্তব্ধতা এক মৃত মরুদ্যান, যেখানে কোনো শব্দ নেই, নেই কোনো স্বাচ্ছন্দ্য জীবন। শুধু এক তীব্র শূন্যতা, যা অরুর আত্মাকে খেয়ে নিচ্ছে ধীরে ধীরে।
আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন
অরুর গলা ফাটিয়ে চিৎকার করে কান্না আসছে, লজ্জার ভয়ে তা পারছে না। হঠাৎ করে আসা জলোচ্ছ্বাসের মতো নয়, বরং তা সমুদ্রের অথৈ জলের নিচে চাপা পড়ে থাকা দীর্ঘশ্বাসের মতো ধীরে গিলে খাচ্ছে তাকে। দমচাপা একটা আর্তনাদ জমে আছে বক্ষঃস্থলের গভীরে। বেরোতে চায়, কিন্তু গলায় আটকে গিয়ে এক দহন সৃষ্টি করছে। কাঁদতে হয় একা নিরবে নিভৃতে। কেউ সেই কান্নার সাক্ষী হলে খোঁচা মেরে তরতাজা করে দেয় দুঃখ দ্বিগুণ হারে। অস্তিত্বটাই ভেঙে টুকরো টুকরো হয়ে যায়। ঠিক ভাঙা কাঁচের মতো, যা একবার ভেঙে গেলে আর জোড়া লাগানো সম্ভব নয়।
অরু নিজেকে কারো সামনে দুর্বল করতে চায় না।
যন্ত্রণা তীব্র আন্দোলন শুরু করেছে অন্তরে। প্রিতিটা আপন ভাবা মানুষের কাজকর্ম আর বিষাক্ত বাক্যদ্বয়ের দহন যেন আগ্নেয়গিরির নিষ্পেষিত লাভা। যা খরস্রোতা নদীর মতো প্রবল বেগে বয়ে যাচ্ছে হৃদয়হীনে। অথচ ভঙ্গুর রমণীর মুখ ফুটে প্রকাশ পাচ্ছে না। অরুর অস্থিরতা এখন এক ভয়াবহ সুনামির মতো, যা নিশ্চিহ্ন করে দিতে চায় ওর সমস্ত আবেগ।
অরুর পুরো শরীর অসাড় হয়ে আসছে। মস্তিষ্ক ফাঁকা ফাঁকা লাগছে। কোনো কিছু ভালো লাগছে না। নিজেকে নিজে আঘাত করতে ইচ্ছে করছে। ঠোঁট কাঁপছে, হাত মুষ্টিবদ্ধ হয়ে এসেছে নিজের অজান্তেই। দৃষ্টির সামনে এক ধূসর পর্দা নেমে আসছে, যেখানে নিখিলের প্রতারণা একটা দানবের মতো দাঁড়িয়ে আছে। সেই সাথে বাড়ির লোকদের তিক্ত কথাবার্তা। চোখের পলক ফেললেই যেটা আরও ভয়ানক রূপে স্পষ্ট হয়ে উঠছে নয়ন জোড়াতে। সে চায় না কাঁদতে। বেহায়া নেত্রদ্বয় কথা শুনছে না। ঝর্ণার ন্যায় ঝরঝর করে অশ্রুপাত বিসর্জন ঘটাচ্ছে! মনের প্রকোষ্ঠে জমে থাকা সেই ভয়াবহ যন্ত্রণা তাকে ছিন্নভিন্ন করে দিচ্ছে। ধীরে অল্প নিঃশব্দে, নির্মমভাবে।
এক মুহূর্তে অরু কিয়ৎপরিমাণ নিশ্চুপ থাকল। একদম যন্ত্র মানবের ন্যায়। মন, মস্তিষ্কের সঙ্গে যুদ্ধ চালাল দীর্ঘকালীন সময়। অতঃপর দ্বিধাদ্বন্দে দোনোমোনো টানপোড়া করে ভাবল গভীর এক বিষয়। চোখের জল মুছে নিলো স্বীয় হস্তে। চোখ বুঁজে বারকয়েক লম্বা শ্বাস টানল। মুখশ্রী কাঠিন্য করে আগে পিছে সঠিকভাবে কোনো ভাবনা চিন্তা ছাড়া, নিয়ে নিলো এক কঠিন সিদ্ধান্ত।
হ্যাভেন বাড়িতে ফিরল মোটামুটি রাত দশটার দিকে। ক্লান্ত দেহে দরজার চৌকাঠ পেরোতেই সমস্ত সত্তায় ক্লান্তির দাবানল ছড়িয়ে পড়ল। ভেতরে প্রবেশ করতেই ড্রয়িংরুমে টুটুল’কে দেখতে পেলো। ক্লান্তিতে শরীর ঝিমিয়ে আসছে, কিন্তু টুটুল’কে দেখে অধরে হাসি ফুটল। ধীর কদমে এগিয়ে গেল ছেলের নিকট।
টুটুল মুখমন্ডল নিষ্প্রাণ বানিয়ে রেখেছে। হাসি নেই ছোট্ট ঠোঁটে। হ্যাভেন কাছে এসে বসলো ছেলের পাশে। টুটুলের বেজার মুখ আর এখন ড্রয়িংরুমে থাকতে দেখে হ্যাভেনের ভ্রু সামান্য কুঁচকে এলো। এসময় টুটুল নিজের রুমে বা যার রুমে ঘুমাবে সেখানে থাকে। এই নিষ্পাপ মুখের দিকে তাকিয়ে হ্যাভেন সবকিছু ভুলে যেতে পারে। অথচ সেই মুখে ঘনকালো আঁধার নেমেছে, এটা কি সহ্য করার মতো? এই ছোট্ট প্রাণটা হ্যাভেনের জীবনের অনেকটা জুড়ে রয়েছে। টুটুলের সবচেয়ে কাছের একমাত্র নিরাপদ আশ্রয় সে। তাই টুটুলের সুযোগ সুবিধা সকল কিছু দেখার দায়িত্ব তার।
হ্যাভেন নেতানো শরীরটা সোফায় এলিয়ে দিল। গলার টাই ঢিল করতে করতে টুটুল’কে কাছে টেনে নিয়ে, তার কপালে চুমু খেল। চিন্তিত ভঙ্গিতে মৃদুস্বরে জিজ্ঞেস করলো,
” এখনো ঘুমাওনি কেন? মুখটা শুকনো লাগছে কেন? রাতে খায়নি আমার কলিজা? ”
টুটুল গাল ফুলিয়ে রেখেছে। গোল গোল চোখে চেয়ে ছোট্ট হাত বাবার গাল ছুঁয়ে দিল। গোমড়া মুখে স্বল্প আওয়াজে আধো আধো গলায় অভিযোগ জানালো,
” সুন্দর আম্মু আমাকে ভালোবাসে না। বাড়িতে এসে কথা বলেনি। কাছে ডাকে নি। দরজা খুলছে না। আমি কতবার বললাম, তোমায় বিরক্ত করবো না আম্মু। একদম চুপটি করে থাকবো। আমি তো ভালো ছেলে। তবুও দরজা খুলল না। শুনল না আমার কথা। ”
হ্যাভেন ভ্রু কুঁচকে ফেলল। ললাটে প্রগাঢ় ভাঁজ পড়ল। মনের গহীনে হঠাৎ এক অস্বস্তির ঢেউ হামলে পড়ছে। বিচলিত হলো তৎক্ষনাৎ। অস্থিরতায় মস্তিষ্ক বেগবান হয়ে উঠল। অরু এমন আচরণ কেন করেছে? কোনো উল্টাপাল্টা কিছু করে বসেনি তো? ও বাড়িতে কেউ খারাপ কিছু বলেছি কি? অদৃশ্য এক ছায়া যত ভুলভাল চিন্তা দিয়ে যাচ্ছে। হৃদয়ের ওপর চেপে বসলো ভয়ংকর কাল্পনিক দৃশ্যপট। সর্বনাশের কালো ধোঁয়ার কুণ্ডলী ঘিরে ধরেছে সর্বাঙ্গে।
অস্থির চিত্তে হ্যাভেন উঠে দাঁড়ায়। ছেলের কপালে চুমু দিয়ে নরম কন্ঠে বলল,
” আম্মু ভালোবাসে কলিজা। হয়তো মন খারাপ তোমার আম্মুর। চিন্তা করো না। আমি তাকে বকে দিবো। ”
টুটুল মুখ বিকৃত করল। ঝাড়া মেরে হ্যাভেনের হাত সরিয়ে দিল। হ্যাভেন হকচকিয়ে যায়। টুটুলের নাকের পাটাতন ফুলে উঠল সহসা। আঙুল উঁচু করে তেজি গলায় বলে ওঠে,
” বকুনি দিবে না, সুন্দর আম্মুকে। তাহলে টুটুল তোমাকে পিট্টি দিবে। আদর করবে না। ”
হ্যাভেন হতভম্ব হয়ে, ক্লান্তি মাখা হাসি উপহার দিল। আম্মুর উপর অভিমান করবে, আবার বকাবকি করতেও দিবে না। সত্যি ছেলেটা অরু’কে ভীষণ ভালোবাসে। টুটুলের ছোট হাতের আঙুলে হ্যাভেন চুমু খেল সন্তর্পণে। ছেলের ফুলো ফুলো গাল টিপে হাস্যোজ্জ্বল মুখে উত্তর দিল,
” আমার কলিজার কথা শিরোধার্য। বকুনি দেবো না টুটুলের সুন্দর আম্মুকে। এবার খুশি খুশি ঘুমাতে চলে যাও। নয়তো টুটুলের আব্বু রেগে যাবে। ”
হ্যাভেন বেডরুমের দরজা জোরে ধাক্কা দিল। আশ্চর্য! দরজা চট করে খুলে গেল। ভেতর থেকে আটকানো ছিল না। তবে রুমের লাইট বন্ধ। রুমের মধ্যে আবছা অন্ধকার এক অনির্বচনীয় শূন্যতা সৃষ্টি করে চলেছে পুরো পরিবেশ। রুমের মধ্যকার আসবাবপত্র দ্বারা গঠিত ছায়া, সাদা দেয়ালে দেখা যাচ্ছে। হ্যাভেন ভ্রু যুগল কুঁচকে ফেলল। আবছা আলোতে হাতের ল্যাপটপ ব্যাগ আর কোট খুলে ডিভানে রাখল। শার্টের বোতাম খুলতে খুলতে দ্রুত লাইটের সুইচ টিপল। এক সেকেন্ডের ঝলকানি শেষে রুম আলোকিত হলো। কিন্তু তাতে কি? পুরো রুম নিঃসঙ্গ, নিস্তব্ধ, জনশূন্য। অরু কোথাও নেই!
ললাটে গভীর সুক্ষ্ণ ভাঁজ ফেলে আশেপাশে নজর বোলালো হ্যাভেন। এই মুহূর্তে কক্ষের নিস্তব্ধতা চারপাশে বুনে ফেলছে এক অভেদ্য বেড়াজাল। কোথায় গেল অরু? রুমে না থাকলে সে কি বাইরে গিয়েছে? কাউকে না বলে কোথায় যেতে পারে?
হ্যাভেন স্বীয় ভাবনায় নিমগ্ন হয়ে ওয়াশরুমের দিকে এগোল। পানির শীতল স্পর্শ মুখে লাগলো, কিন্তু তাতে কোনো প্রশান্তি এলো না। উল্টো বুকের ভেতর জমে থাকা অস্বস্তি আরও তীব্র হলো। সে ওয়াশরুমের আয়নার দিকে তাকাল। চোখে এক অদ্ভুত ক্লান্তি। মনে হচ্ছে বোধশক্তি অন্ধকারের অতল গহ্বরে হারিয়ে যাচ্ছে কিছু।
ফ্রেশ হয়ে বেরোতেই হঠাৎ কর্ণকুহরে ভেসে আসে এক নিঃশব্দের ভীড়ে ক্ষুদ্র স্পন্দন। বেলকনি থেকে রেশমি চুড়ির রিনঝিন শব্দ শোনা যাচ্ছে , আর দেখা যাচ্ছে একটা ছায়ামূর্তি! ছায়ামূর্তির শাড়ির আঁচল উড়ছে। নাসারন্ধ্রে চিরচেনা ঘ্রাণ প্রবেশ করতেই হ্যাভেন উপলব্ধি করল এটা আর কেউ না, স্বয়ং তার ধানিলংকা।
হ্যাভেন পিলপিল কদমে সেদিকে পা বাড়াল। অরুর কাছাকাছি পৌঁছাতেই ভাসা ভাসা চক্ষু জোড়া বিস্ফারিত হয়ে গেল। সরু চোখ গিয়ে মেয়েটির ওপর বর্তায়। ধক করে উঠল বক্ষঃস্থল। গগনে গোলাকার চাঁদের দেখা নেই, তবে তাঁরাগুলো মিটমিট করে জ্বলছে। রুমের আলো ছড়িয়ে পড়েছে বেলকনিতে মেঝেতে। চারপাশের বাতাস নিস্তব্ধ, এই নিস্তব্ধতা ভেদ করে তার সামনে দাঁড়িয়ে আছে এক অবর্ণনীয় দৃশ্য। অক্ষিপটে ফুটে রয়েছে অরুর চোখ ধাঁধানো সৌন্দর্য।
অরুর পরনে পাতাল ধূসর রঙের সিল্কি শাড়ি, যা শরীরের প্রতিটি ভাঁজের সঙ্গে মিশে গিয়েছে। সুস্পষ্ট দেখা যাচ্ছে মেয়েলি শরীরের নজরকাঁড়া ভাঁজ। টান টান লম্বা চুল খোলা, কোমরের কিঞ্চিৎ নিচ পর্যন্ত ঝুলে আছে কালো অবিরল ধারায় ঝরনার মতো। সোনালী সিকুইনের কাজ করা ব্লাউজের ভেতর উঁকি দিয়ে জ্বলজ্বল করছে ফর্সা উজ্জ্বল ত্বক। হাতে চিকন চিকন মুঠো ভর্তি চুড়ি, গলায় পাথরের কারুকার্যে শোভিত ছোট চেইন। এসব কিছু ছাপিয়ে যা গভীর চাউনীতে পড়ছে, তা হলো অরুর স্নিগ্ধ মুখশ্রী। চোখে কাজল, ঠোঁট জোড়া রাঙিয়েছে হালকা মিষ্টি রঙের লিপস্টিক দিয়ে। অরু প্রাকৃতিক ভাবে সুন্দর। মেকআপ করার প্রয়োজন পড়ে না। তবে এখন মুখশ্রী জুড়ে কিঞ্চিৎ মেকআপ এর ছিটেফোঁটা বিদ্যমান রয়েছে। তাকে কোনো হুরপরীর মতো লাগছে। অলৌকিক, স্বপ্নাতীত, তবে এই সৌন্দর্যের ভেতরে এক গভীর শূন্যতা। এত জাঁকজমকপূর্ণ সাজসজ্জার মধ্যে মুখবিবর মনমরা হয়ে রয়েছে।
কিয়ৎকাল থমকে গেল হ্যাভেন। দৃষ্টিতে বিস্ময়। শুধু অবাধ্য অনুভূতির নেশালো নেত্রদ্বয়ে স্থান পেয়েছে স্বীয় নারীর মুখাবয়ব। কোনো কিছু বোধগম্য হচ্ছে না। মেয়েটা রাতের বেলা এত সেজেছে কেন? কারণ যাইহোক, এদিকে বউয়ের অপ্রত্যাশিত জ্বলজ্বল রূপে হ্যাভেনের মাথা ঘুরতে শুরু করেছে। নিষিদ্ধ ইচ্ছাগুলো মনগহীনের কপাটে ঠকঠক আওয়াজ তুলে তবলা বাজাচ্ছে। আজ কোনো উল্টাপাল্টা কিছু না ঘটলেই হলো। নিজেকে কন্ট্রোল করা বড্ড কষ্টদায়ক হয়ে গিয়েছে। চোখ বুঁজে জোরে জোরে শ্বাস টানছে সে। জিভ দ্বারা ঠোঁট ভেজায়। বারকয়েক শুষ্ক ঢোক গিলল হ্যাভেন। অতঃপর ফট করে চোখ খুলল। নিগূঢ় লোচনে ক্ষণিকের জন্য তীক্ষ্ণ হয়ে উঠল। এই মেয়ের মাথায় কি চলছে? কি করতে চাইছে?
তব্দা খেয়ে নিজেকে শান্ত করল হ্যাভেন। ঘাড় ঈষৎ বেঁকে এলো। ধাতস্থ হয়ে থেমে থেমে শীতল গলায় ডাকল,
” অরু পাখি? ”
তৎক্ষনাৎ অরু তড়িৎ গতিতে ঘুরে তাকাল। এই আবেগময় ডাকে ওর পুরে সর্বাঙ্গ শিউরে ওঠে। কাজল দেওয়া টানা টানা হরিণী নেত্রদ্বয়ে এক অস্বাভাবিক আলোড়ন। গভীর অন্ধকারে নিমজ্জিত এক দৃষ্টি। মুখশ্রীতে মলিনতার চিহ্ন। ভ্রান্তির আড়ালে লুকিয়ে থাকা যন্ত্রণা। হ্যাভেন সামনে গিয়ে অরুর হাত ধরল। অরু ঈষৎ কেঁপে উঠল। রুমে এনে হাত ছেড়ে দিল। হ্যাভেন দরজা লাগিয়ে বিদ্যুৎ বেগে অরুর নিকট ফিরে আসে।
ভ্রু কুঁচকে অরুর আপাদমস্তক পর্যবেক্ষণ করল হ্যাভেন। খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে তীর্যক চাহনি নিক্ষেপ করে অবলোকন করল সুশীল দেহাঙ্গ। আর দীর্ঘকালীন বোঝার চেষ্টা চালাল অরুর ভাবভঙ্গি। লম্বা শ্বাস টানল। অরুর দিকে তাকিয়ে অত্যন্ত শান্ত গলায় জানতে চাইল,
” ঘুরতে যাবে? নাকি লং ড্রাইভে যেতে চাইছো? ”
অরুর চকিতে তাকায়। হতাশ মেয়েটির সুপ্ত হৃদয়ে দীর্ঘশ্বাস বইল। এরকম কথা সে মোটেও আশা করেনি। বিহ্বলিত লোচনে অনিমেষ ফ্যালফ্যাল করে চেয়ে থাকল। ঘন পল্লব বিন্দু বিন্দু জলকণায় ভরপুর। নিচের ঠোঁটের লিপস্টিক কিঞ্চিৎ লেপ্টে গিয়েছে। মস্তক নিচু করল সে। ভনিতা ছাড়া ভাঙা গলায় মৃদুস্বরে বলে উঠলো,
” কোথাও যেতে চাই না। আপনার জন্য সেজেছি।”
হ্যাভেন পুনরায় হোঁচট খেলো। বিস্ময়ে কিংকর্তব্যবিমুঢ় সে। প্রকট চাহনি কপালে উঠে গেল। হতবিহ্বল হয়ে গিয়েছে অন্তঃকরণ। সমস্ত কিছু ধূসর অন্ধকারে আটকে গেল যেন। এক মুহূর্তের জন্য সব অনুভূতি জাগ্রত হলো সহসা। কিন্তু হ্যাভেন প্রশ্রয় দিল না। অনুভূতি ফুরসৎ পেলো না হ্যাভেনের তীক্ষ্ণ ধারালো গুরুগম্ভীর এ্যাটিটিউডের কাছে।
হ্যাভেন ভারিক্কি নিঃশ্বাস ছাড়ল। হুঁশিয়ার মস্তিষ্ক সচল হয়। গভীর ভাবে কিছু ভাবল। নজর আটকে রয়েছে অরুর পীবর রক্তজবা ঠোঁটে। সেথায় নিগূঢ় দৃষ্টি তাক করে একপল। পরপর নজর ফিরিয়ে নিলো। অতঃপর সাবলীল ভঙ্গিতে তীক্ষ্ণ আদেশ ছুঁড়ল গমগমে আওয়াজে,
” পাঁচ মিনিট সময় দিলাম, দ্রুত চেঞ্জ করে আসো। নয়তো খুব খারাপ হয়ে যাবে। ”
অরু অবাক হলো। পিটপিট করে তাকায়। ভাবুক চিত্ত প্রশমিত হওয়ার পরিবর্তে উৎকন্ঠিত হয়। আঁখি যুগলে চাপা এক দহন, ঠোঁটের কোণে হাহাকার। এই সাজসজ্জা কি আদৌ স্বতঃস্ফূর্ত? নাকি এক অন্তর্লীন যন্ত্রণার রূপ? চিবুক শক্ত হয় সহসা। ও ভেবেছে হ্যাভেন এই সাজে পাগল হয়ে ওকে কাছে টানবে, কিন্তু সেরকম কিছু ঘটলো না। যেন এদিকে আদৌ ফিরে দেখার মত কিছু ঘটছে না! উল্টো চেঞ্জ করতে বলছে সে। কেন? অরু’কে কি দেখতে সুন্দর লাগছে না? কি কমতি রয়েছে? অন্য কেউ এই সাজ দেখলে নির্ঘাত নির্বিঘ্নে পাগল হয়ে যেত। হ্যাভেন কেন উন্মাদ হলো না? সে তো পুরুষ মানুষ! প্রসংশা তো দূর, ভালো করে দেখেছে বলে তো মনে হচ্ছে না।
অপমানে থমথমে হয়ে এলো অরুর দীপ্তিমান থাকা চেহারা। উজ্জ্বল মুখবিবর নিভে গেল। ভীষণ বিরক্ত লাগলো। মেজাজ খারাপ হয়ে গেল। মুহূর্তে কাঠিন্য রূপ ধারণ করল মুখাবয়ব। নিস্তব্ধতার রুদ্ধশ্বাস যুদ্ধের পরিসমাপ্তি ঘটিয়ে হ্যাভেনের মুখোমুখি এসে দাঁড়ায় সে।
অরু আচানক ক্ষেপা বাঘিনীর ন্যায় হ্যাভেনের কাঁধের গেঞ্জির কাপড় পেলব দু’হাতে খামচে ধরল। রক্তিম বর্ণ ছেয়ে আছে নিস্প্রভ চক্ষুদ্বয়। রাগে মুখ দিয়ে হিস হিস শব্দ বের হচ্ছে। ঘনঘন তপ্ত শ্বাস টানছে। স্নিগ্ধ মুখশ্রী পালিয়ে গিয়ে সেথায় ঠাঁই পেয়েছে আগ্নেয়গিরির মতো ভয়ানক দাহ্য বিশেষ। বিস্মিত হয় হ্যাভেন। আকস্মিক ঘটনায় কোনো প্রকার প্রতিক্রিয়া দেখাতে পারলো না। ভাসা ভাসা চক্ষু জোড়া বড়ো বড়ো করে নির্লিপ্ত, হতবিহ্বল হয়ে চেয়ে রয়েছে।
মুখটা একদম হ্যাভেনের সন্নিকটে নিয়ে গেল অরু। পায়ের গোড়ালি উঁচু করে, হ্যাভেনের সরু গোলাকৃতি খাঁড়া নাকের সাথে নিজের নাক মিলিয়ে রাখল। অল্প একটু দূরে রয়েছে চার জোড়া ওষ্ঠপুট। দু’জনের উষ্ণ নিঃশ্বাস একে ওপরের মুখে আছড়ে পড়ছে। অরু ক্ষুব্ধ হওয়া দৃষ্টি তাক করল হ্যাভেনের হতভম্ব হয়ে থাকা সুগভীর অক্ষিপট আর মুখমন্ডলে।
প্রেমপিপাসা পর্ব ১৭
রাগের বশিভূত হয়ে খেই হারিয়ে ফেলল চোখের পলকে অরু। পুরুষের উসকানিমূলক গা জ্বালানো বাক্যবাণ ধনুকের ন্যায় ছুঁড়ল। ভয়ানক চটে গিয়ে বাজখাঁই কন্ঠে শব্দ তুলল,
” চেঞ্জ করবো কেন? করবো না চেঞ্জ! এভাবেই থাকবো আমি। কি করবেন? কি করতে পারেন আপনি? নজর ঘুরিয়ে একটিবারের জন্যও দেখলেন না আমাকে। ভয় পাচ্ছেন আমায় মেনে নিতে? নাকি আমার সৌন্দর্য আপনাকে মুগ্ধ, মাতাল করতে সক্ষম হচ্ছে না? নাকি আপনি নিজের প্রতি আত্মবিশ্বাসী না? ”
অরুর রুষ্ট গলায় কাটকাট কথায়, কক্ষের বাতাস ভারী হয়ে উঠল। জানালার পর্দা হালকা নড়ল, যেন নিঃশব্দ এক হতবিহ্বল মানবের দীর্ঘশ্বাস।