প্রেমপিপাসা পর্ব ২

প্রেমপিপাসা পর্ব ২
সুমাইয়া সুলতানা

ঘড়ির কাঁটা সেকেন্ড, মিনিট পাড় করে করে ঘন্টাখানিক পৌঁছালো। এরই মধ্যে সকল যোগাড়যন্ত্র হয়ে গিয়েছে। জাঁকজমকপূর্ণ সাজসজ্জায় বধূ সেজে বসে আছে অরু। গা ভর্তি তার বাইশ ক্যারেটের স্বরণের অলংকার। মুখশ্রীতে ভারী মেকআপ, তবে আনন্দের ছাপ নেই। তার পাশেই বর বেসে নির্লিপ্ত ভঙ্গিতে বসে আছে হ্যাভেন তালুকদার। মুখবিবর বাংলার প্যাঁচের মতো করে রেখেছে, যেন ভালোয় ভালোয় বিয়েটা করে এখান থেকে যেতে পারলেই বাঁচে!
হ্যাভেনের সাথে এসেছে তার ছোট চাচা আর চাচার ছেলে। বাবা-মা মারা যাওয়ার পর চাচা-চাচির কাছে মানুষ হয়েছে হ্যাভেন। হ্যাভেন’কে যথেষ্ট ভালোবাসেন তারা।

দোয়া পাঠ করে তিন কবুল বলে ইসলামিক ভাবে বিয়ের বন্ধনে আবদ্ধ হয়ে গিয়েছে অরু, হ্যাভেন। কাবীননামার কাগজে হ্যাভেন ব্যস্ত হাতে সাইন করলেও অরুর সময় আসলে সে বেঁকে বসলো। সাইন করাতো দূরে থাক, নীল রঙের বল পয়েন্ট কলম টা পর্যন্ত স্পর্শ করেনি। হ্যাভেন ভ্রু কুঁচকে চেয়ে আছে। আড়চোখে জামশেদের দিকে দৃষ্টি তাক করতেই তিনি বিরক্ত মুখভঙ্গিতে এগিয়ে আসেন।
গম্ভীর কণ্ঠে জামশেদ বলে উঠলেন,
” সাইন করছো না কেন অরু? ”
অরু চোখ তুলে চায়। থমথমে মুখে উত্তর দেয়,
” আমার একটা শর্ত আছে। ”
” কিসের শর্ত? ”

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

অরু একপলক তাকায় হ্যাভেনের দিকে। হ্যাভেন তাকিয়ে ছিল বলে দুজনের চোখাচোখি হয়ে যায়। অরু চট করে নজর নামিয়ে নিলো। গমগমে গলায় অবান্তর ধারালো বাক্য ছুড়ল,
” আমার বিয়ে উপলক্ষে, হ্যাভেন তালুকদার বড়ো চাচাকে লোন পরিশোধ করার জন্য যে টাকাগুলো দিয়েছে, সেগুলো ফেরত দিতে হবে। ”
চমকে উঠল সকলে, শুধু হ্যাভেন বাদে। জহির ক্ষেপা স্বরে তেড়ে এসে বললেন,
” এটা কেমন কথা বলছিস অরু? মাথা ঠিক আছে? ”
অরু ভাবলেশহীন ভঙ্গিতে ত্যাড়া কন্ঠে উত্তর দিল,
” এতদিন মাথা খারাপ ছিল, কিন্তু আজকে ঠিক আছে। ”
অরুর বড়ো চাচি কটমট করে দাঁতে দাঁত চেপে বললেন,
” তুই কিন্তু বেশি বেশি করছিস! তুই জানলি কিভাবে আমাদের হ্যাভেন বাবা টাকা দিয়েছে? বাড়াবাড়ি না করে চুপচাপ সাইনটা করে দে! ”
অরু শক্ত গলায় জবাব দেয়,

” শর্ত পূরণ না হলে সাইন করবো না। ”
হ্যাভেন তাকায় জহিরের দিকে। রাশভারী কন্ঠে ছোট করে বলল,
” টাকাগুলো নিয়ে এসে আমার অর্ধেক হওয়া বউয়ের হাতে তুলে দিন। ”
জহির ভোঁতা মুখে স্ত্রীকে চোখের ইশারায় টাকা নিয়ে আসতে বললেন। বড়ো চাচি সাপের মতো ফুঁসতে ফুঁসতে টাকা নিয়ে আসলেন। অরুর নিকট এগিয়ে যান। অরু বাঁকা হেসে মেহেদী-বিহীন সাদা কোমল ফর্সা হাত দুটো বাড়িয়ে দিল। চাচি র’ক্তিম চোখে চেয়ে টাকাগুলো অরুর হাতে তুলে দিলেন। সরে আসতেই চাচির হাত ধরে, মুখটা একটু এগিয়ে অরু কন্ঠ খাদে এনে হিসহিসিয়ে বলে,

” বলেছিলাম না? এমন পরিবর্তন হবো, যে তখনকার অরু আর এখনকার অরুর মধ্যে অনেক তফাৎ থাকবে! আরেকটা কথা, খোঁটা দিয়েছিলে না? তো শোনো, আমার আব্বু পঙ্গু হওয়ার আগে যত টাকা রোজগার করতো সেটা দিয়ে তুমি পুরো সংসার চালাতে। আর এখন পঙ্গু হয়েও নিজের খরচ নিজে চালায়। হোক সেটা হ্যাভেন তালুকদার দিক! তবে তোমাদের তো আর টাকা দিতে হচ্ছে না! এমনকি এই বাড়ির অর্ধেক ভাগ আমার আব্বু একা পাবে। তোমরা তো তোমাদের ভাগেরটা লোন পরিশোধ করার জন্য বিক্রি করে দিয়েছো! আর বাকি টুকু ছোট চাচ্চুর৷ সেই হিসেবে আব্বুর পঙ্গু হওয়ার পর কয়েকবছর শুধু আমার খাবারের খরচ দিয়েছো মাত্র! সেটা অনেক কম! বাকি সব খরচ কষ্ট হলেও আমার আব্বু নিজে দিতো। ”
বলেই চোখ টিপল! চাচি থমথমে মুখে সরে আসে। অরুর কথাগুলো অল্প অল্প হ্যাভেনের কর্ণধার হয়েছে। মিটিমিটি হাসা অরুর মুখের দিকে চেয়ে হ্যাভেন আপন মনে বিড়বিড় করলো,
” আমার বউ বলে কথা! তেজ থাকা মাস্ট! আমি যেমন নিজেরটা ছাড়া বুঝিনা, আমার বউও নিজেরটা ছাড়া বোঝেনা! একদম পারফেক্ট ম্যাচিং! ”

হালকা শীতের সন্ধ্যাবেলা একটি বিশেষ মাধুর্য নিয়ে আসে। চারপাশে দিনের আলো ম্লান হয়ে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে এক ধরনের নরম হিমেল হাওয়া বয়ে যায়। রাস্তাঘাটে গাড়ির হেডলাইট আর দোকানের আলো মিলে এক স্বপ্নময় পরিবেশ তৈরি করে। গাড়িতে যাতায়াত করার সময় জানালার কাচ নামিয়ে দিলে ঠান্ডা বাতাসের শীতল স্পর্শ গায়ে এসে লাগে। রাস্তার ধারে চায়ের দোকান থেকে ভাপ ওঠা চায়ের সুবাস আর মাঝে মাঝে ভাজা পিঠার ঘ্রাণ মনটাকে আরও উৎফুল্ল করে দেয়। শহরের রাস্তাগুলোতে হালকা ট্রাফিকের শব্দ আর মানুষের চলাচল এক মৃদু কোলাহল তৈরি করে। আর গ্রামের দিকে গেলে, সন্ধ্যার নীরবতায় মাঝে মাঝে শেয়ালের ডাক কিংবা ঝিঁঝি পোকার আওয়াজ শুনতে পাওয়া যায়। এই সময়টা প্রকৃতি যেমন শান্ত, তেমনি যাতায়াতও আরামদায়ক হয়। ঠান্ডা পরিবেশে একটি শাল জড়িয়ে, গাড়ির জানালার পাশে বসে আলোর মেলা দেখতে দেখতে গন্তব্যে পৌঁছানোর অনুভূতি সত্যিই অনন্য।

বড়সড় একটা প্রাইভেট গাড়ির ভেতর হাঁসফাঁস বিমূঢ় অনুভূতি মেশানো অবস্থায় নির্লিপ্ত, নিরুৎসাহিত ভঙ্গিতে বসে আছে অরু। তার অস্বস্তি লাগার প্রধান কারণ, তার পাশে হ্যাভেন বসা। হ্যাভেন ভ্রু কুঁচকে ফোনে ক্রিকেট খেলা দেখছে। একদম অরুর গা ঘেঁষে বসেছে সে। অরুর মেজাজ খারাপ হচ্ছে! চেয়েও কিছু বলতে পারছে না। গাড়িতে হ্যাভেনের চাচ্চু, চাচাতো ভাই রয়েছে। আনমনে হ্যাভেন তার বলিষ্ঠ একটা হাত অরুর কোলের উপর রাখল। অরু তৎক্ষনাৎ চোখমুখ শক্ত করে ঝাড়া মেরে হাতটা সরিয়ে দিল। ফোন থেকে নজর ফিরিয়ে অরুর আদলে নজর রাখল হ্যাভেন। শান্ত দৃষ্টিতে কিছুক্ষণ চেয়ে ঝট করে অরুর কোমর প্যাঁচিয়ে একদম নিজের সঙ্গে মিশিয়ে নিলো। পুরুষালী মাতাল করা ঘ্রাণ মুহূর্তে অরুর নাসারন্ধ্র প্রবেশ করল। অরুর তনুমন দুলে উঠল! অবাক হয়ে ফ্যালফ্যাল করে চেয়ে রইল কিয়ৎকাল। চক্ষুদ্বয় কোটর ছেড়ে বেড়িয়ে আসার উপক্রম। গাড়ির বাকি সদস্যদের দিকে তাকিয়ে দেখল, তারা নিজের মতো বসে আছে। ওদের খেয়াল করেনি।
অরু আলগোছা হাত ছাড়িয়ে নিতে চাইল, পারলো না। হ্যাভেনের হাতে চিমটি কাটল, বিশেষ লাভ হলো না! এমনিতেই লোকটাকে দেখে অরুর বিরক্ত লাগছে, তারউপর লোকটা ওর কোমর জড়িয়ে রেখেছে। আস্তে করে বলে উঠলো,

” আপনার মাথায় কি বুদ্ধি নেই? ”
হ্যাভেন ভাবলেশহীন ভাবে একই ভঙ্গিতে নিচের ঠোঁট কামড়ে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে চেয়ে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে অরুর মুখবিবর পর্যবেক্ষণ করছে। কিয়ৎপরিমাণ পর ভাবুকতা গলায় এক ভ্রু উঁচিয়ে জিজ্ঞেস করে,
” কেমন মেয়ে তুমি? তোমার কি কোনো অনুভূতি নেই? শুনেছি বাবার বাড়ি ত্যাগ করে শ্বশুর বাড়ি আসার সময় মেয়েরা নাকের জলে চোখের জলে এক করে ফেলে, আর তুমি! তুমি একটুও কান্না করলে না? এটা কি ঠিক? লোকে শুনলে কি ভাববে? ”
একটু থেমে লম্বা শ্বাস টেনে পুনরায় ফ্যাসফ্যাসে গলায় বলল,

” ওহ্! বুঝতে পেরেছি। কত সুন্দর করে সেজেছো। কান্না করলে মেকআপ নষ্ট হয়ে যাবে, সেজন্য কাঁদোনি, তাই তো? আরে কোনো সমস্যা ছিল না। তোমার বরের টাকার অভাব নেই। মেকআপ নষ্ট হলে আবার মেকআপ করতে। তবুও মিছেমিছি হলেও সামান্যতম কান্না করার দরকার ছিল। ”
হ্যাভেনের গা জ্বালানো কথায় অরু তেতে উঠল। ইচ্ছে করছে হ্যাভেনের পরিপাটি করা সুন্দর চুল গুলো টেনে সব ছিঁড়ে নিতে। মাড়ি কামড়ে চুপ করে বসে থাকল। হ্যাভেন কোমর থেকে হাত সরিয়ে নেয়।
কিছু মনে পড়তেই অরু গ্রীবা উঁচু করে ধীর গলায় হ্যাভেন’কে প্রশ্ন করে,

” আপনি আমাকে বিয়ে করেছেন কেন? আপনার উদ্দেশ্য কি? ”
হ্যাভেন ফটাফট অরুর কানের নিকট মুখ নিয়ে আসে। অরু ভড়কে যায়। মাথা সিটের সাথে ঠেসে যায়। হ্যাভেনের উষ্ণ ওষ্ঠপুট অরুর কানের লতি স্পর্শ করল। অরু খানিকটা কেঁপে ওঠে।
হ্যাভেন স্মিথ হেসে ব্যগ্র কন্ঠে বলল,
” আদর করার জন্য, ভালোবাসার জন্য। ”

বাড়িতে পৌঁছে গাড়ি হতে নেমে, হ্যাভেন কাউকে পরোয়া না করে, কারো দিকে না তাকিয়ে অরু’কে সযত্নে কোলে তুলে নিলো। অরু আঁখি যুগল বড়ো বড়ো করে চেয়ে রইল। নামার জন্য ছটফট করেও লাভ হয়নি৷ দরজার সামনে এসে হ্যাভেন কোল থেকে নামিয়ে দেয়। কলিং বেল চাপতেই হ্যাভেনের বাড়ির কাজের মহিলা রুবিনা দরজা খুলে দিলেন। হ্যাভেন’কে দেখে চওড়া হাসি উপহার দিলেন। অরু ঘাড় ঘুরিয়ে আশেপাশে ভালো মতো নজর বুলাতে পারেনি, হ্যাভেন পুনরায় ওকে কোলে তুলে বেডরুমের দিকে পা বাড়াল। রুমে এসে আস্তে করে নরম তুলতুলে খাটে বসিয়ে দিল। এতক্ষণ অরু শুধু চুপচাপ হ্যাভেনের কাজকর্ম দেখছিল।
খাট থেকে নেমে ঝাঁঝালো কণ্ঠে অরু বলে ওঠে,

” নির্লজ্জের মতো সকলের সামনে কোলে তুলে কেন নিয়ে এসেছেন? আমার কি পা নেই? আমি কি হাঁটতে পারি না? ”
হ্যাভেনের শান্ত জবাব,
” আমি থাকতে আমার বউ’কে কষ্ট করতে দিবো কেন? ”
” কি ভেবেছেন, এত রসে-রঙ্গের কথা বলে আমার মন গলাতে পারবেন? জীবনেও সেটা পারবেন না! ”
হ্যাভেন গায়ের পাঞ্জাবি খোলার প্রস্তুতি নিচ্ছিল, অরুর কথায় থেমে যায়। তড়িৎ বেগে ছুটে এসে অরুর চোয়াল চেপে ধরল। চিবিয়ে চিবিয়ে বলল,
” শাড়ি পড়ে হাঁটতে অসুবিধা হতো, তাই কোলে নিয়ে ছিলাম। আমার কি ঠেকা পড়েছে, তোমার মন গলানোর জন্য? মন দিয়ে কি করবো আমি? তোমাকে পেলেই হবে। ”
অরু ছলছল চোখে চেয়ে তাচ্ছিল্য হেসে বলে,

” জানতাম! শরীরের চাহিদা মেটানোর জন্যই বিয়ে করেছেন। ”
হ্যাভেন আঙুলের জোর বাড়িয়ে দিল। ক্রোধান্বিত কন্ঠে বলে,
” শরীরের চাহিদা মেটানোর জন্য তোমাকে বিয়ে করার প্রয়োজন হতো না, এই হ্যাভেন তালুকদারের জন্য! তোমার সাথে রাত কাটিয়ে টিস্যুর মতো ব্যবহার করে ডাস্টবিনে ফেলে দিতাম! ”
অরু ব্যথা পাচ্ছে। ফুপিয়ে কেঁদে উঠল। হ্যাভেন তৎক্ষনাৎ হাত গুটিয়ে নেয়। অরুর কোমল ফর্সা গাল লাল হয়ে গিয়েছে। হ্যাভেনের খারাপ লাগলো। কেন যে রাগটা কন্ট্রোল করতে পারে না! আর মেয়েটাও কি সব কথা বলে রাগিয়ে দিচ্ছিল!

অরুর মুখশ্রী অঞ্জলিপুটে তুলে নিলো হ্যাভেন। নত স্বরে শীতল হুমকি স্বরুপ আওড়াল,
” আর এধরণের কথা বলবে না, আমি রেগে গেলে সেটা তোমার জন্য খুব একটা ভালো হবে না! ”
” আব্বু! ”
পেছন থেকে আধো আধো বুলি কর্ণগোচর হতেই সহসা ঘাড় ঘুরিয়ে তাকায় হ্যাভেন। তার ছেলে টুটুল হাসি মুখে গুটিগুটি কদমে এগিয়ে আসছে। হ্যাভেন হাত বাড়িয়ে দিল। টুটুল লাফ দিয়ে বাবার কোলে উঠে গেল। টুটুলের দু গালে ঠোঁট ডুবিয়ে চুমু খেল হ্যাভেন। আদুরে সহিত বলে,

” আমার সোনা এতক্ষণ কি করছিল? ”
হ্যাভেনের কপালে চুমু দিয়ে টুটুল পোকায় ধরা দন্তপাটি বের করে হেসে বলে,
” কার্টুন দেখছিলাম। ”
অরু ভ্রু কুঁচকে চেয়ে আছে টুটুলের দিকে। বুঝতে পারলো এটা হ্যাভেনের ছেলে। অরু নাক ছিটকায়! রুপে গুণে অরু সবদিক দিয়েই ভালো। ভালো হয়ে কি লাভ হলো? শেষে কিনা ভাগ্য এক বাচ্চার বাবার সঙ্গে জুড়ে দিলো?
টুটুল গোল গোল চোখে অরুর দিকে তাকায়। ড্যাবড্যাব করে কিছুক্ষণ চেয়ে ভুবন ভুলানো হাসি দিল। হাত তালি দিতে দিতে মিহি কন্ঠে বলল,
” আব্বু বউ এনেছে। সুন্দর বউ। আমার পছন্দ হয়েছে। সুন্দর বউ’কে আমি আম্মু বলে ডাকবো, কি মজা! কি মজা! ”
হ্যাভেনের কোল থেকে নেমে টুটুল অরুর নিকট গিয়ে পা জড়িয়ে ধরল। অর্থাৎ তাকে কোলে নিতে বলছে। অরু কোনো প্রতিক্রিয়া দেখাল না। চুপ করে ভারাক্রান্ত মনে দাঁড়িয়ে রইল।
অরু কোলে নিচ্ছে না দেখে টুটুল জোর গলায় বলল,

” আম্মু কোলে নাও, তোমায় ভালো ভাবে দেখবো। ”
অরু বাচ্চাটাকে নিজের থেকে ছাড়িয়ে নেয়। গম্ভীর কণ্ঠে বলে ওঠে,
” কে তোমার আম্মু? আমি তোমার আম্মু না! আমাকে একদম আম্মু ডাকবে না! ”
টুটুলের হাসিটা ধপাস করে নিভে গেল। শিশুসুলভ অক্ষিকোটরে জলে টইটম্বুর হয়ে গিয়েছে। ছলছল চোখে হ্যাভেনের দিকে চেয়ে ঠোঁট ফুলিয়ে বলে,
” এটা আমার আম্মু নয়? তুমি না বলেছো, আম্মু এনে দিবে? ”
দাঁতে দাঁত পিষে কটমট করে অরুর দিকে কঠিন দৃষ্টি নিক্ষেপ করল হ্যাভেন। কিন্তু কিছু বলল না। ধমক দিলে টুটুল ভয় পাবে!
হ্যাভেন হাটু গেড়ে ফ্লোরে বসে পড়ল। ছেলেকে কাছে এনে কপালে দৃঢ় চুম্বন করল। চোখ মুছে দিয়ে শান্ত কন্ঠে বলল,

” এটা তোমার আম্মুই সোনা। আসলে সে এখানে নতুন তো! তাই তোমাকে চিনতে পারেনি। দেখবে, পরে তোমাকে ঠিক কাছে টেনে নিবে, আদর করবে। ”
” সত্যি? ”
” সত্যি কলিজা। ”
টুটুল খুশি হলো। আলতো করে বাবার গাল ছুঁয়ে দিল।
” আমার সোনা খেয়েছে? ”
” খেয়েছে। ”
” ওকে। এখন জলদি জলদি ঘুমিয়ে পড়ো তো আব্বু। ”
” চাচ্চুর সঙ্গে ঘুমাবো। ”
হ্যাভেন ভ্রু উঁচিয়ে জিজ্ঞেস করলো,
” আব্বুর সাথে ঘুমাবে না? ”
টুটুল চোরাচোখে বলল,
” আজকে চাচ্চুর সঙ্গে ঘুমাবো। ”
হ্যাভেন দীর্ঘশ্বাস ছাড়ল। মাথা নেড়ে সম্মতি প্রকাশ করল। টুটুলের হাস্যোজ্জ্বল মুখখানা ঝলমলিয়ে উঠল। হ্যাভেন’কে বিদায় জানিয়ে চলে গেল। সায়র বলেছে আজকে তার সাথে ঘুমালে সে টুটুলকে চকলেট খেতে দিবে। দাঁতে পোকা হয়েছে বলে হ্যাভেন তাকে চকলেট খেতে দেয় না। স্বামী স্ত্রীর প্রথম রাতে প্রাইভেসির জন্য সায়র আড়ালে কাজটা করল। টুটুল এমনিতেও সায়রের কাছে ঘুমায়, তবে হ্যাভেন টুটুলকে কাছ ছাড়া করে না। ছেলেকে বুকে না নিলে ঘুমোই আসে না!

টুটুল চলে যেতেই দরজা আটকে হ্যাভেন অরুর নিকট এগিয়ে আসে ক্ষিপ্ত মেজাজে। চোখ দুটোতে রাগের বহিঃপ্রকাশ। অরুর বক্ষস্থল ছ্বলাত করে উঠল। এই লোকটা কি এখন অরু’কে মারবে? ভয়ে দু পা পিছিয়ে গেল। হ্যাভেন আলতো করে অরুর হাত ধরল৷ অরুর তনুমন থরথর করে কেঁপে ওঠে। খাটে বসিয়ে নিজে পাশে বসলো। অত্যন্ত নরম গলায় বলল,
” তোমার যদি কোনো রাগ থেকে থাকে, তাহলে সেটা আমার উপর দেখাও। টুটুলের সঙ্গে খারাপ ব্যবহার করো না, প্লিজ! বাচ্চাটার কষ্ট আমি সহ্য করতে পারি না। ভীষণ যন্ত্রণা হয় এই বুকে। সুন্দর করে বুঝালাম। নেক্সট টাইম বোঝানোর মনমানসিকতা না-ও থাকতে পারে। ”
অরু মাথা নিচু করে নিলো। ও টুটুলের সঙ্গে খারাপ ব্যবহার করতে চায়নি। এই ব’জ্জাত লোকটা জন্য রেগে এমনটা করে ফেলেছে।

” দ্রুত চেঞ্জ করে ওযু করে আসো। নফল নামাজ আদায় করতে হবে। ”
অরু বাধ্য মেয়ের মতো বিনা বাক্যে ফ্রেশ হতে চলে গেল। ফ্রেশ হয়ে দুজন নামাজ পড়ে নিলো। অরু’কে খেতে বললে অরু খায়নি! হ্যাভেন জোর করল না। নিজেও ঠিকঠাক খেতে পারলো না। এক লোকমা খেয়ে হাত ধুয়ে ফেলেছে।

হালকা শীতের রাত মানেই এক ধরনের প্রশান্তি। রাতটা যেন নীরবতার চাদরে মোড়া। হালকা ঠান্ডা বাতাস গায়ে এসে লাগে, একটা স্নিগ্ধ অনুভূতি জাগায়। দূরে কোথাও কুয়াশার আবরণ মিশে আছে, যেন প্রকৃতি একটা সাদা চাদর গায়ে জড়িয়েছে। আকাশটা মেঘমুক্ত, তারাভরা, আর মাঝখানে জ্বলজ্বল করছে চাঁদ। চারপাশে ঝিঁঝি পোকার ডাক শোনা যায়, যা রাতের সৌন্দর্যকে আরও গভীর করে তোলে।
হালকা গরম কাপড় জড়িয়ে বারান্দায় বসে কফির কাপ হাতে নিয়ে এই রাতের শীতল আবেশ উপভোগ করছে হ্যাভেন। অরু রুমে ঘুমাচ্ছে। দূরের কোন ঘরে হয়তো গানের মৃদু সুর ভেসে আসে, আর কোথাও আলোর মিটমিটে ঝলকানি। এই হালকা শীতের রাত যেন নিজের মাঝে ডুব দিয়ে প্রকৃতির নীরবতাকে অনুভব করার এক অসাধারণ সময়।

কফি শেষ করে রুমে চলে আসে হ্যাভেন। অরুর ঘন পাপড়ি যুক্ত নয়ন জোড়া নড়বড় করছে। জেগে আছে কি? বোঝা যাচ্ছে না। ডিম লাইট জ্বালিয়ে অরুর পাশে এসে শুয়ে পড়ল। তৎক্ষনাৎ লাফিয়ে বসে পড়ল অরু। অরুর কান্ডে হকচকিয়ে যায় হ্যাভেন। রেগে মৃদুস্বরে চেঁচিয়ে উঠল,
” বানরের মতো লাফাচ্ছো কেন? ঘুমাও নি? ”
অরুর কন্ঠ বুঁজে এলো,
” আ…আপনি এখানে কেন? ”
হ্যাভেন ভ্রু কুঁচকে জানতে চাইল,
” তো কোথায় থাকার কথা বলছো? ”

অরু কি বলবে বুঝতে পারলো না। ভোঁতা মুখে বসে রইল। মনে মনে দোয়া পাঠ করছে, যেন লোকটা ওর সাথে উল্টাপাল্টা কিছু না করে! যতই তেজ দেখাক! হ্যাভেন পুরুষ মানুষ! তার সঙ্গে শক্তি প্রয়োগ করে পেরে উঠবে না!
হ্যাভেন কিছুক্ষণ শান্ত চোখে চেয়ে অরুর বাহু টেনে বালিশে শুইয়ে দিল। পায়ের নিচে থাকা কম্বল টেনে দুজনকে ঢেকে নিলো। অরু হতবাক হয়ে নির্লিপ্ত ভঙ্গিতে চেয়ে থাকল। যখন বুঝতে পারলো, তখন ছোটার জন্য ছটফট করতে লাগলো! হাত, পা ছোড়াছুড়ি করছে। হ্যাভেন বিরক্ত হলো। তৎক্ষনাৎ অরুর ঘাড়ে মুখ ডুবিয়ে দিল। অরুর ছটফটে ভাব নিমিষেই ধূলিসাৎ হয়ে কাঁপা-কাঁপিতে রূপ নেয়। হাত দিয়ে হ্যাভেন’কে দূরে ঠেলছে। তবে বিন্দু পরিমাণ সরাতে পারলো না।
অরুকে এক হাতে জড়িয়ে ধরে শান্ত গলায় হ্যাভেন জানালো,

” বাইন মাছের মতো মোচড়ামুচড়ি করছো কেন? চুপচাপ শান্ত হয়ে শুয়ে থাকো। বেশি নড়াচড়া করলে বাসরের প্রিপারেইশন শুরু করবো। যা আমি তোমার ইচ্ছার বিরুদ্ধে চাইছি না! ”
অরু কেঁদে উঠল। ভাঙা গলায় বলল,
” আমার ভালো লাগছে না। দূরে থাকুন। ”
” দূরে থাকার জন্য তোমাকে বিয়ে করিনি, অরু পাখি! ”

শীতল নিরেট কণ্ঠে অরু পাখি সম্বোধনে অরুর হৃৎপিণ্ড অস্বাভাবিক গতিতে লাফাচ্ছে। মনগহীনে দ্বিধা, ভালো লাগা দুয়ের সংমিশ্রণ লড়াই চলছে! ফ্যাসফ্যাসে কান্নার তোপে হ্যাভেন মাথা তুলে চায় নববধূর দিকে। ডিম লাইটের আলোতে বউয়ের মুখবিবর নজরে আসছে। হ্যাভেন চোখের জল মুছে দিল না। খোঁচা মেরে বলল,
” বাহ্! দারুণ তো! মেকআপ নষ্ট হবে বলে বাড়ি ছেড়ে আসার সময় কান্না করোনি! আর এখন কান্না করছো? ”
অরুর কান্না থেমে যায়। মেজাজ খারাপ হলো। কনুই দিয়ে হ্যাভেনের চওড়া বুকে আঘাত করল। তেজি গলায় বলল,
” আপনার এসব ফা’লতু কথাবার্তা বন্ধ করুন। আপনাকে আমার সহ্য হচ্ছে না। ”
হ্যাভেন চো চো শব্দ তুলল মুখে। আফসোসের সুরে বলে,
” কিছু করার নেই তোমার আমাকে সহ্য করা ছাড়া। ”
অরু ঠোঁট বাঁকায়। পেট হতে হ্যাভের হাত সরিয়ে দিতে চায়। হ্যাভেন ততই হাতের বন্ধন দৃঢ় করে। অরু হাল ছেড়ে দেয়।
অরুর কানে মুখ নিয়ে ফিসফিস করে হ্যাভেন উচ্চারণ করলো,

প্রেমপিপাসা পর্ব ১

” এখন কোন ঋতু চলছে, বলোতো? ”
অরুর কথা বলতে ভালো লাগছে না। হ্যাভেনের প্রশ্নে অটোমেটিক মুখ থেকে উত্তর বেরিয়ে আসে,
” শীত। তবে শেষের পথে। ”
হ্যাভেন ঠোঁট টিপে হাসল। দুষ্টু হেসে বলে,
” এই ঋতুতে তোমাকে বিয়ে করেছি কেন, বলোতো? ”
অরু বিরক্ত ভঙ্গিতে বলল,
” আমি কিভাবে জানবো? ”
” আমি বলছি। শরীর গরম করার জন্য! ”

প্রেমপিপাসা পর্ব ৩