প্রেমপিপাসা পর্ব ২৬

প্রেমপিপাসা পর্ব ২৬
সুমাইয়া সুলতানা

” অরু থামো, এটা অফিস। ”
কে শুনে কার কথা? হ্যাভেনের অযাচিত নির্লজ্জ মার্কা কথাবার্তায় বিরক্ত হয়ে ক্যাবিনের বারোটা বাজাচ্ছে অরু। টেবিলে থাকা জিনিসপত্র মেঝেতে ছুড়ে ফেলে দিচ্ছে। ফাইলের কাগজপত্র, কলম, কাচের বক্স, পানির বোতল, ছোট ছোট দামী ডিজাইনার শোপিস ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে। নিমিষে তছনছ করে চলেছে হ্যাভেনের পরিপাটি সুন্দর ভাবে গোছানো ক্যাবিনটা।
হ্যাভেন তড়িঘড়ি অরুর কাছে এসে তাকে থামানোর চেষ্টা চালাল। অরু থামছে না দেখে, হাত দুটো মুচড়ে পেছনে নিয়ে পিঠের সঙ্গে আড়াআড়ি ভাবে রেখে শান্ত কন্ঠে বোঝানোর স্বরূপ বলল,
” পাগলামি কেন করছো? শালিক পাখি হতে ইচ্ছে করছে? ”
” পুরুষ শক্তি দেখাচ্ছেন? ”
” তোমার সেটাই মনে হয়? ”
” সেজন্যই নিজের মর্জিতে যা ইচ্ছে তাই করেন। আমার কথার মূল্য কোথায় আপনার নিকট? ”

অরুর রুষ্ট গলার ব্যঙ্গাত্মক বাক্য। হ্যাভেন হার মানল। ছেড়ে দিল হাত। দূরে সরে দাঁড়ায়। টেবিলে থাকা মধ্যম সাইজের একটি মার্বেল আঙুল দ্বারা ঘুরিয়ে কপাল কুঁচকে ভ্রু নাচাল,
” তোমার প্রশ্নের যথাযথ উত্তর দিলে খুশি হবে? ”
অরু চকিতে তাকায়। বিস্মিত হয়। কাছে আসে। কিঞ্চিৎ দূরত্ব ঘোচায়। ঘন পল্লব নয়ন জোড়া চকচক করে উঠল অদৃশ্যের প্রজ্বলিত প্রদীপ দেখে। খুশিতে বিগলিত হলো সত্তা। হাস্যোজ্জ্বল মুখে উৎফুল্ল চিত্তে উল্টো জিজ্ঞেস করে,
” সবটা বলবেন? ”
” বলবো। ”
অরুর কন্ঠে তাড়া,
” জলদি বলুন। ”
” আমার ছেলে এবং বউ দু’টোই আছে। উত্তর পেয়েছো? আশাকরি ডিপ্রেশন নামক শব্দটা আর তোমাকে ছুঁতে পারবে না৷ ”

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

মেজাজ খারাপ হলো অরুর। উচ্ছ্বসিত মুখশ্রী নিমিষেই ঘুটঘুটে অন্ধকারে ধাবিত হয়। ক্রোধে ফুঁসতে থাকল। নাক-মুখ কুঁচকে চিৎকার ছুড়ল সজোরে,
” মিথ্যাবাদী! আমাকে কি ছোট বাচ্চা মনে হয়, যা বুঝিয়ে দিবেন সেটাই বুঝবো? বলতে না চাইলে বলার দরকার নেই। আজকের পর আমিও আর এ বিষয়ে আপনার থেকে কিছু জানতে চাইবো না। তবুও প্লিজ মিথ্যা বলবেন না। মিথ্যুক, ধোঁকাবাজদের আমি চরম ঘৃণা করি। ”
নির্লিপ্ত ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে থাকা হ্যাভেনের অভিব্যক্তি বদলে গেল না। সে সোজাসাপটা আওড়ায়,
” এখন কি আমাকে ছেড়ে চলে যাবে? কিন্তু সেই সুযোগ তুমি পাবে না, তোমাকে দেওয়া হবে না। তুমি যেনে-শুনে বিয়ে করেছো। তাহলে অযথা কৌতূহল কেন দেখাচ্ছো? ”
অরুর ঠোঁটে তাচ্ছিল্যের হাসি। বিভ্রান্তিতে লুটোপুটি খায়। যেভাবে কাছাকাছি এসেছিল, ঠিক সেভাবেই পিছু হটে দূরত্ব বাড়াল। মুখনিঃসৃত ঘটলো রাগান্বিত বাক্য,

” ছেড়ে যাওয়ার কথা বলিনি। যা ভাগ্যে ছিল হয়েছে। ভাগ্য বদলানোর ক্ষমতা আমার নেই৷ বাকি রইল অনাধিকার চর্চা? এমনি এমনি প্রশ্নগুলো করিনি। আপনার বউ, বাচ্চা আছে এতে আমি মাথা ঘামাতাম না, কারণ আমি জেনেই বিয়ে করেছি। হ্যাঁ নিজের মতের বিরুদ্ধে বিয়ে হয়েছে, তবে আপনার সম্পর্কে অবগত ছিলাম। কিন্তু বিশ্বাস করুন, এতদিন যা জানতাম আমার কাছে এখন তা ভুল মনে হচ্ছে। সেটা ভাবতে আপনি বাধ্য করেছেন। আপনার কথাবার্তায় স্পষ্ট প্রকাশ পায়, আপনি আমার থেকে কোনো বড়ো সত্যি লুকাচ্ছেন। শুধু আমার থেকে না, অন্যদের থেকেও। ইদানীং আমার আপনাকে সন্দেহ হয়, রহস্যময় লাগে। আপনার এত শত্রু কেন? বাড়িতে, অফিসে কঠোর সিকিউরিটি কেন রেখেছেন? মানলাম, আপনি সনামধন্য একজন মানুষ, তাই হিংসাত্মক গুটিকয়েক ব্যাবসায়ী শত্রু থাকতেই পারে। কিন্তু আমার মনে হচ্ছে ব্যবসায়ী নয়, বরং আপনার পারিবারিক জীবন নিয়ে টানাটানি করা অনেক শত্রু আছে। নয়তো টুটুল’কে কিডন্যাপ করতে কেন চাইবে? টাকার জন্য? সেটা হলে স্কুল, রাস্তাঘাটে কিংবা যখন সে খেলতে খেলতে হুটহাট বাগানে চলে যায়, তখন সুযোগের সদ-ব্যবহার করতে পারতো তারা। গুরুতর না হলে, রাত-বিরেতে আপনি বাড়িতে থাকা অবস্থায় কিডন্যাপ করার মতো দুঃসাহস দেখাতো না। আপনি কোনো খারাপ কাজের সাথে জড়িত নন তো? ”
হ্যাভেন অত্যন্ত মনোযোগ সহকারে সবটা শুনল। অমনি রাজ্যের শত অস্বস্তি দানা বাঁধে বক্ষপিঞ্জরে। ফোঁস করে ভারিক্কি নিঃশ্বাস ফেলল। তীর্যক চাহনি বর্তায় মেয়েটির মলিন চোখে। অতঃপর কন্ঠনালী ভেদ করে বের হয় ঠান্ডা স্বর,

” অনাধিকার বলছো কেন? আমার উপর তোমার সম্পূর্ণ অধিকার রয়েছে। ”
অরুর কন্ঠে নিপাত অভিমান,
” থাকলে ধোঁয়াশায় রাখতেন না, সঠিকভাবে সবকিছু বলতেন। ”
হ্যাভেন প্রসঙ্গ পাল্টায়। বিষয়টা কৌশলে এড়িয়ে যায়। জিভের ডগায় অধর ভেজায়। আদর মাখা গলায় বলে ওঠে নিভৃতে,
” যতটুকু সম্ভব আমার ব্যাপারে বলি। ভবিষ্যতেও বলবো। অতিরিক্ত টেনশন করে শরীর খারাপ করো না। টেনশনের জন্যই মানসিক ভাবে অসুস্থ ফিল করো। তারপর দোষীর কাটগোঁয়ায় আমাকে দাঁড় করাও। ”
” তেঁতো হলেও সত্যি, আপনাকে বিয়ে করার পর থেকে, যে পরিমাণ ডিপ্রেশনে ভুগে চলেছি আমি, এর আগে তেমনটা আমার সঙ্গে ঘটেনি। নিখিলের ধোঁকা খাওয়ার পরও এমন হয়নি। ”
হ্যাভেন ভ্রু উঁচায়,
” নিখিলের ধোঁকা খেয়েছো আমাদের বিয়ের পর। যাকগে, টেনশন ফ্রী থাকো আর আমাকে ভালোবাসো। ”
অরু আমলে নিলো না। কপাল বেঁকে এলো। ভাবুকতা সমেত আচমকা হুট করে ধনুকের ন্যায় অপ্রত্যাশিত বাক্য ছুড়ল,
” আপনার মনে কি অন্য কেউ রয়েছে? আপনি তাকে ভালোবাসেন? ”

তপ্ত কন্ঠের নিরেট স্বর ছুটে এলো কানে, অমনি হকচকানো দৃষ্টি তাক করল হ্যাভেন। এ আবার কেমন প্রশ্ন? দৃষ্টির এলোমেলো বিচরণ সম্মুখের উদগ্রীব রমণীর উপর। পরপর নিজেকে ধাতস্থ করল। নির্লিপ্ত ভঙ্গিতে উত্তর দেয়,
” অবশ্যই, সে আমার বউ। তাকে আমি জানপ্রাণ দিয়ে ভালোবাসি। সারাজীবন বাসবো। ”
হ্যাভেনের ভাবলেশহীন জবাবে অরু না চাইতেও কষ্ট অনুভব করল। ভেবেছিল সে অন্য মেয়েকে ভালোবাসে, কিন্তু না সে তো আগের বউয়ের কথা বলল। ও জানে হ্যাভেন প্রথম বউকে খুব ভালোবাসে। আচরণে সেটাই প্রকাশ পায়। ভালোবাসা না থাকলে ফসল স্বরূপ টুটুল থাকত না। হটাৎ অরুর অক্ষিপট জলে টইটম্বুর হয়। মুহূর্তের মধ্যে স্তব্ধ হয়ে গেল ক্ষুদ্র সত্তা। স্বামীর কথাগুলো যেন কাঁটার মতো গেঁথে বসলো হৃদয়ে। সামনাসামনি নিঃসংকোচে বাক্যদ্বয় কি সুন্দর উচ্চারণ করল সে! একটি বারের জন্য ভাবল না, কথার রেশ কি পরিমাণ আঘাত হানবে ভগ্নহৃদয়ের রমণীর ছোট বক্ষে। চোখের পলক পড়া থেমে গেল অরুর। কপালের রেখাগুলো খানিকটা কুঁচকে উঠল বিস্ময়ে। তীব্রভাবে শ্বাস আটকে গেল গলায়। দৃষ্টি অস্বাভাবিকভাবে স্থির হয়ে রইল স্বামীর মুখের দিকে। আঁধারে ঢাকা এক অজানা গহ্বরের মতো বিস্ময় ও অবিশ্বাসে ভরা।
আহত চাউনি তুলে তাকাল হ্যাভেনের স্বাভাবিক আদলে। বিরস মুখে অদ্ভুত ভাবে জিজ্ঞেস করে অরু,

” কতদিন যাবত বাসেন। ”
হ্যাভেনের বিলম্বহীন জবাব,
” এক বছর পেরিয়ে কয়েকমাস হলো। প্রায় দেড় বছরের কাছাকাছি। ”
চমকে উঠল অরু। ফ্যালফ্যাল নিষ্প্রভ দৃষ্টি তার। সন্দেহী কন্ঠে অক্ষিপট বড়ো করে শুধায়,
” বিয়েতো পাঁচ-ছয় বছর আগে করেছেন, তাহলে ভালোবাসার জার্নি মাত্র এক বছর কেন? নাকি ভালোবাসার জন্ম হতে সময় লেগেছে? ”
” তোমার যা মনে হয়। তুমি যেটা ভেবে খুশি হও। ”
অরু হতাশার দীর্ঘশ্বাস ছাড়ল। মুখখানা চুপসে ছোট হয়ে গেল। ভোঁতা মুখ ঘুরিয়ে আরও খানিকটা সরে যায়। ফোঁস করে নিঃশ্বাস ছাড়ে। পরমুহূর্তে নিজেকে শূন্যে আবিষ্কার করল। চেঁচিয়ে উঠল সহসা। ভয়ে তটস্থ মেয়েটি হ্যাভেনের গলা জড়িয়ে ধরে। তড়াক করে চাইল হ্যাভেনের দুষ্টু মুখমন্ডলে। দাঁতে দাঁত পিষল তৎক্ষনাৎ,

” আজব! কোলে নিয়েছেন কেন? ”
বড়সড় আলমারির পাশে বিশাল পর্দার দিকে এগিয়ে যেতে যেতে প্রত্যুত্তর করল হ্যাভেন,
” রোমান্স করতে। ”
ক্যাবিনে রেস্ট করার জন্য শোয়ার ব্যবস্থা আছে। হ্যাভেনের ক্যাবিন বাকি রুমের চেয়ে তুলনামূলক বড়ো। আলমারির পেছনে খাট রয়েছে, ক্লান্ত হলে সেখানে গিয়ে রেস্ট করে। সামনে বড়ো পর্দা টানা।
অরু সমান তালে চেঁচামেচি করছে। হাত-পা ছুড়ছে। হ্যাভেন বিরক্ত হয়ে এক প্রকার তুলতুলে বিছানায় ছুড়ে ফেলল অরু’কে। হুড়মুড়িয়ে নিজেও উঠে পড়ল বিছানায়। অরু রাগান্বিত চোখে তাকায়। কাচুমাচু মুখ অথচ ঝাঁঝালো কন্ঠ,
” কাছে আসবেন না৷ ”
বলেই অরু নামতে উদ্যত হয়। হ্যাভেন পাত্তা দিল না। জাপটে জড়িয়ে ধরে মিশিয়ে নেয় বুকে। সেভাবেই শুয়ে পড়ে বালিশে। জানতে চাইল রয়েসয়ে,

” আসলে কি? ”
ভণিতা ছাড়া জানায় অরু,
” আপনার সংস্পর্শে আমার ছোট্ট সত্তা কেঁপে ওঠে। বুকের ভেতর হৃৎপিণ্ডটা তীব্র বেগে লাফালাফি করে। ”
হ্যাভেন ফিচেল হাসে। কথাতে চটপটে রসিকতা ,
” শুধু হৃদপিণ্ডই কাঁপে? আমি তো বেডরুমের বড়সড় শক্তপোক্ত খাটও কাঁপিয়ে তোলার ক্ষমতা রাখি। প্রমাণ দিবো? ”
অনাকাঙ্ক্ষিত কথা শুনে অরুর কান ঝাঁ ঝাঁ করে উঠল। কোটর ফুঁড়ে আসা প্রকট নেত্রযুগল আরো বৃহৎ করে চাইল সে। বলতে থাকল আপন ছন্দে,

” আমি বুঝি না আপনি কোন ধাতু দিয়ে তৈরী! নির্লজ্জ লোক! ”
” একই শব্দ কতবার আওড়াবে? আমি তো আগেই বলেছি তোমার প্রতি আমার বিন্দু মাত্র ইন্টারেস্ট নেই। শুধু ভদ্রতার খাতিরে একটু চুমুটুমু খাই। ভবিষ্যতে ভদ্রতার খাতিরে ঘর ভর্তি বাচ্চাগাচ্চা পয়দা করবো, ইনশা আল্লাহ। ”
অরু তেতে উঠল। তৎক্ষনাৎ নরম হস্তে হ্যাভেনের বুকে থাপ্পড়, ঘুষি মারতে লাগলো। রাগের বহিঃপ্রকাশ হিসেবে ফোঁস ফোঁস শব্দ বের হচ্ছে নিঃশ্বাসের মাধ্যমে। হ্যাভেন বাঁধা দিচ্ছে না দেখে, অবাক হয়ে গেল সে। এক পর্যায়ে নিজে থেকে মারা বন্ধ করে দিল। হ্যাভেন মিটিমিটি হাসছে। অরুর গা জ্বলে উঠে। চলে যেতে চাইলে হ্যাভেন তৎক্ষনাৎ আটকে দেয়। কানের নিকট মুখ নিয়ে ফিসফিস করে বলে,

” বরকে মারতে নেই, অরু পাখি। আদর যত্ন করতে হয়। বেবি দিবো তো। ”
হ্যাভেনের কাঁধে নখ গেঁথে ধরে সে। হ্যাভেন ব্যথা পেয়েও ‘ টু ‘ শব্দ করতে নারাজ। নিজেকে মুক্ত করতে সক্ষম না হয়ে, হাল ছেড়ে দিল। হ্যাভেনের বুকের সঙ্গে মিশে রইল চুপটি করে। হ্যাভেন যেন আশকারা পেলো। হাতের বন্ধন দৃঢ় করল মুহূর্তে। অরুর মাথায় বেঁধে রাখা ঝুঁটি-টা কিঞ্চিৎ আলগা করে, সেথায় নাক-মুখ ডুবিয়ে ঘ্রাণ টেনে নিলো নাসারন্ধ্রে। প্রফুল্ল সমেত চনমনে গলায় জানালো,
” তোমার শরীর এত নরম তুলতুলে কেন, অরু পাখি? গায়ের ঘ্রাণ যে-কোনো পারফিউমকে হার মানায়। এর রহস্য কী? তোমার ছোঁয়ায় থাকে এক অন্যরকম মায়া লুকানো। আহ, কী নেশা! কি শান্তি! ইচ্ছে করে সারাক্ষণ তোমাকে বুকে জড়িয়ে রাখি। মুখ গুঁজে থাকি তোমার কোমল গলদেশর উষ্ণতায়। যেখানে হাত রাখি, তোমার শরীরের চামড়া গর্তের মতো সেখানে দেবে যায়, আমায় আরও গভীরে টেনে নেয়, হারিয়ে ফেলে এক অদ্ভুত ঘোরে। উফ! তোমার এই নরমতা আমাকে পাগল করে দিচ্ছে। ”

ঘড়ির কাঁটা জানান দিচ্ছে, এখন সময়টা দুপুরের। মানবজাতির লাঞ্চ করার সঠিক সময়। হ্যাভেন কত রকমের খাবার এনেছে অথচ অরু চোটপাট দেখিয়ে, না খেয়ে অফিস হতে বেরিয়ে এসেছে। হনহনিয়ে হাঁটছে সে। মনে বিষণ্ণতা লেগে আছে। মস্তিষ্ক ফাঁকা ফাঁকা লাগছে। খুশি মুড নিয়ে ঘুরতে এসে, পাংশুটে মুখে ফিরতে হচ্ছে। হ্যাভেনের কাছে না গেলে হয়তো এমনটা হতো না। চোখ দুটো না চাইতেও বেঈমানী করছে ওর সাথে। বারবার জলে ভিজে ঝাপসা হয়ে আসছে সামনের সকল দৃশ্যপট। কান্নাগুলো গলার মধ্যে দলা পাকিয়ে আছে। ঠকে যাওয়ার একরাশ না পাওয়ার কষ্ট। কি দরকার ছিল বিবাহিত ছেলেকে বিয়ে করার? বাবার চেয়ে এখন নিজের উপর রাগ হচ্ছে। হ্যাভেন খুব নিঁখুত ভাবে ওকে বোকা বানাচ্ছে। ওর ভালো মানুষের মন নিয়ে খেলছে বারংবার।

হ্যাভেনের ড্রাইভারকে কোথাও দেখা যাচ্ছে না। অফিসে আসার পর একবার দেখেছিল। অরু ভাবল, হয়তো খেতে গিয়েছে। তাই ঠিক করল, গাড়িতে উঠে বসে থাকবে। গাড়ির কাছে এসে দরজা খুলতে যাবে তক্ষুনি হাতে টান অনুভব করল। খসখসে শক্তপোক্ত পুরুষালী উষ্ণ একটি হাত ওকে টান মেরে বুকে নিয়ে নিলো। পিছিয়ে আসলো কিছুটা। বিধিবাম! বিপত্তি ঘটাল পায়ের গোড়ালি। ঘুরে চলে আসতে নিবে, বেখেয়াল ভাবে ব্যালান্স রাখতে না পেরে ঠাস করে পড়ে গেল ঝকঝকে পাকাপোক্ত গাড়ি চলার সরু রাস্তায়। এটা হ্যাভেনের অফিসের দরজা থেকে ভেতর পর্যন্ত ঢোকার জন্য বানানো হয়েছে। পাশেই গাড়ি পার্ক করার জায়গা।
অরুর হাত টান দেওয়া লোকটা আর কেউ না, হ্যাভেন। তারা উঠতেও পারলো না, চোখের পলকে হ্যাভেনের বড়সড় প্রাইভেট গাড়িটা নিজের প্রকাণ্ড বাজখাঁই চিৎকার ছুড়ে বোমা ব্লাস্ট হয়ে গেল। শব্দের ঝাঁকুনি তীব্র ছিল। মুহূর্তের মধ্যে ছিন্নভিন্ন হয়ে গেল আস্ত গাড়িটা। গাড়ির দরজা, চাকা, ছাঁদ অল্পস্বল্প টুকরোতে পরিণত হয়েছে। এক মুহূর্তের মধ্যেই আগুনের গোলক হয়ে উঠল, আর গাড়ির ধ্বংসাবশেষ আশেপাশে ছড়িয়ে পড়ল। শোঁ শোঁ করে আগুনে জ্বলেপুড়ে যাচ্ছে গাড়িটা।

অরু’কে যথাসাধ্য আড়াল করে হ্যাভেন বিস্ফোরিত গাড়ির আগুনের তাপ নিজ শরীরে ধারণ করছে। পুরোপুরি লুটিয়ে পড়ল রাস্তায়। ভেতরের অদ্ভুত এক উত্তেজনা অনুভব করছিল সে। এখন তার সামনে আগুনের ভয়ংকর ঢেউ দেখে উদ্বিগ্ন বাড়ছে। গাড়ির উত্তপ্ত ভাঙাচোরা টুকরো অংশ ছিটকে এসে হ্যাভেনের পৃষ্ঠদেশে লেগেছে। জ্বলছে সেখানে। দাঁতে দাঁত চেপে সহ্য করছে।
অরু যখন ক্যাবিন থেকে বেরিয়ে গিয়েছিল, তখন হ্যাভেন ভেবেছিল, সে জামশেদের কাছে যাচ্ছে। তাই মেঝেতে পড়ে থাকা জিনিসপত্র, ফাইলের কাগজপত্র উঠিয়ে গুছিয়ে জায়গা মতো রাখছিল। কিয়ৎক্ষণ পর মৃণাল হন্তদন্ত হয়ে ছুটে এসে জানায়,
” স্যার আপনার গাড়িতে টাইমার বোমা রাখা। সেটা ব্লাস্ট হতে মাত্র দুই মিনিট বাকি। অরু ম্যাম সেখানে দাঁড়িয়ে আছে, হয়তো গাড়িতে উঠবে। ”

শোনা মাত্র এক মুহুর্ত দেরি না করে, হ্যাভেন তড়িঘড়ি করে বেরিয়ে আসে অরু’কে বাঁচাতে। পিছু পিছু মৃণালও বাকিদের ডেকে চলে আসে। ওরা আসতে আসতে ইতোমধ্যে গাড়ি ব্লাস্ট হয়ে গিয়েছে। জামশেদ পুরুষালী গলা ছেড়ে আহাজারি করে ডুকরে কেঁদে উঠেন। দুজন লোক তাকে ধরে রেখেছে। তিনি মেয়ের কাছে যেতে চান। আগুনের তাপমাত্রার প্রখরতা বেশি বলে কেউ সামনে যেতে দিচ্ছে না। আগুন নিভানোর কর্মীরা, খবর পেতেই কিছুক্ষণের মধ্যেই এসে পড়েছে।

হ্যাভেন নিভুনিভু তাকিয়ে, আলগোছে খুব কষ্টে এক হাতের তালুতে ভর দিয়ে উঠে বসে। বুকের মধ্যে ছটফটানো কম্পমান দেহটা আলগা করে নিমিষে। অরুর তেমন ক্ষতি হয়নি। শুধু পড়ে গিয়ে সামান্য হাতে আর কোমরে ব্যথা পেয়েছে। হ্যাভেন নিষ্প্রাণ ব্যাকুল দৃষ্টিতে চেয়ে, অঞ্জলিপুট অরুর মসৃণ কপোল যুগল আবদ্ধ করল। ও সঠিক সময় না আসলে এই শরীরের অবস্থা ভয়াবহ হতে পারতো। শরীরের প্রত্যেকটা অঙ্গ-প্রতঙ্গ টুকরো রূপে ছিন্নভিন্ন হয়ে যেত। হ্যাভেনের কলিজা কাঁপছে। ঝাপসা চোখে সময় নিয়ে অরুর কপালে, গালে পরপর কয়েকটা চুমু খেল।
অরু পিটপিট করে তাকায়। চক্ষু সম্মুখে হ্যাভেনের বিদীর্ণ শরীর, রক্তাক্ত মুখাবয়ব দেখে আঁতকে উঠল তৎক্ষনাৎ। গাড়ির জ্বলন্ত খন্ড ছিটকে হ্যাভেনের গায়ের উপর পড়ায়, শার্ট ঝলসে পিঠের চামড়া এক জায়গায় পুড়ে গিয়েছে। বাহুর শার্টের কাপড় আস্ত নেই। ঠাস করে মুখ থুবড়ে পড়ায়, কপালের নরম চামড়া থেঁতলে গিয়েছে। সেখান থেকেই রক্ত বেরিয়ে পুরো মুখমন্ডল মাখামাখি হয়েছে। শরীর ব্যথায় জর্জরিত। ভাগ্যিস গাড়ি হতে বেশ কিছুটা দূরত্ব বজায় রেখে পড়েছিল, নয়তো আরও গভীরভাবে আঘাতের শিকার হতো। মৃত্যুও হতে পারত।

হ্যাভেন জোরে জোরে শ্বাস টানছে। যন্ত্রণা হচ্ছে। কপাল থেকে প্রচুর রক্তক্ষরণ হচ্ছে, কিন্তু মারা যাওয়ার মতো পরিস্থিতি তৈরী হয়নি। তবে ইমিডিয়েটলি হসপিটালে না গেলে মাত্রাতিরিক্ত রক্ত ক্ষরণে সমস্যা অনিবার্য!
অরুর গালে এক হাত রেখে প্রকম্পিত গলায় শুধাল হ্যাভেন,
” আর ইউ ওকে, অরু পাখি? ”
অরু ছলছল লোচনে অনিমেষ চেয়ে রইল। নিরুৎসাহিত, হয়ে চুপচাপ অশ্রু বিসর্জন দিচ্ছে। উৎকন্ঠিত বক্ষঃস্থল। হ্যাভেনের মুখ, গলায় রক্ত দেখে বুকে চিনচিন ব্যথা অনুভব করল। অরুর নিশ্চুপতা দেখে হ্যাভেনের কাতর হৃদয় ব্যাধিগ্রস্ত হয়। রক্তে ভরা কাঁপা হাতে অরুর পুরো মুখে ছুঁয়ে দিল। পুনরায় ঠোঁট নেড়ে ক্ষীণ স্বরে আওড়াল,
” তোমার কি বেশি কষ্ট হচ্ছে? অ্যাই অরু পাখি, প্লিজ সে সামথিং? ”

হ্যাভেনের কথা অরুর কর্ণগোচর আদতে হয়েছে কি না বোঝা যাচ্ছে না। সে নির্বিকার। অস্থির হয়ে গিয়েছে তার তনুমন। হ্যাভেনের রক্তাক্ত মুখ দেখে মস্তিষ্ক সিগন্যাল দিল তার বড়ো রকমের ক্ষতি হয়ে যাবে। অমনি বুক মুচড়ে উঠল। ধুকপুক বাড়ছে সমান তালে। চোখ দিয়ে টপটপ করে জল পড়ছে। নিজেকে অসহায় লাগলো। অরুর বাবা সহ বেশ কয়েকজন ওদের দিকে এগিয়ে আসছে। এখন গাড়িতে আগুন নেই, শুধু কালো ধোঁয়া উড়ছে।
হ্যাভেন বিচলিত চিত্তে অরু’কে অবলোকন করে মৃদুস্বরে ফের জানতে চাইল,
” কথা বলছো না কেন? ঠিক আছো তুমি? বেশি লেগেছে? কোথায় লেগেছে, দেখাও? কথা শোনো না আমার। এক্ষুনি কি হতে যাচ্ছিল, খেয়াল আছে? ”

হ্যাভেনের মুখে আদুরে আওয়াজ শুনে অভিমানী অরু এবার শব্দ করেই কেঁদে উঠল। ব্যস্ত হাতে হ্যাভেনের কপালে পড়ে থাকা চুল সরিয়ে দেখল, রক্ত বের হওয়ার উৎস। অমনি ফুঁপিয়ে উঠে। ঘাবড়ে গেল স্ত্রী সত্তা। অরু জানে না, কেন তার খারাপ লাগছে হ্যাভেনের এমন অবস্থা দেখে, কিন্তু সে নিজের মনকে মানাতে পারছে না। সে ব্যথিত হচ্ছে স্বীয় পুরুষের জন্য। শোকাহত বক্ষঃস্থল ফেটে চৌচির হয়ে যাচ্ছে।
থেমে থেমে আটকে আসা স্বরে অরু বলে,
” এতটা আঘাত পেলেন কি করে? উঠুন, হসপিটালে যেতে হবে দ্রুত। ”
এতক্ষণে হ্যাভেন স্বস্তি পেলো। এই কন্ঠ-টা শোনার জন্য অতি আগ্রহে ছিল। মুগ্ধতা সমেত তাকিয়ে থাকে উচাটন হৃদয়ের মেয়েটির দিকে। নিজের জন্য অরুর ব্যাকুলতা প্রশান্তি দিচ্ছে তাকে। কথা বলার মতো শক্তি পাচ্ছে না যন্ত্রণায়। পিঠের বিদীর্ণর চেয়ে কপালের আঘাত গুরুতর। তবুও সে ঠোঁট এলিয়ে এক চিলতে হাসে। এমন একটা মুহূর্তে খোঁচা মারতে ভুলল না। শুষ্ক ঢোক গিলে জানালো,
” আমি মারা গেলেই তো তুমি বেঁচে যাও। আমি অসহ্যকর লোক, আর কত কি! আমি না থাকলে তোমার আজও কিছু যায় আসে? ”

আচমকা অরু কান্না থেমে যায়। হতভম্ব হয়ে দৃষ্টি নিক্ষেপ করল হ্যাভেন আদলে। ক্রন্দনরত ঠোঁট দুটো হালকা কাঁপছে। দাঁত কিড়মিড়িয়ে কড়া বাক্য বলতে গিয়েও বলল না। শরীরের সমস্ত শক্তি যেন নিমেষে শুকিয়ে গিয়েছে। খুশির রঙ আতঙ্কে ফ্যাকাশে হয়ে এসেছে। মনের ভেতর ঝড় বয়ে গেলেও বাহ্যিক দেহটা পাথরের মূর্তির মতো স্থবির। অনড় দৃষ্টিতে তাকিয়ে থেকে মাথার মধ্যে শব্দগুলো বারবার প্রতিধ্বনি তুলছে। সত্যি কি হ্যাভেনের ক্ষতি হলে ওর বিন্দু পরিমাণ যায় আসে? উত্তর পেলো না। বুকের ভেতর জমাট বাঁধা এক ধরনের ভারী শূন্যতা হ্যাভেনের জন্য অনুভব করল। সেই শূন্যতার মাঝেও তার চোখ জুড়ে বিস্ময়ের এক ঘূর্ণিঝড় বয়ে চলেছে।
সবকিছু অগ্রাহ্য করে অরু চোখ পাকিয়ে নীরবে শাসায়। নাক ফুলিয়ে ঝাঁঝ নিয়ে চাপা স্বরে বলল,

” একটাও বাড়তি কথা না, উঠুন। ”
হ্যাভেনের হাসি চওড়া হলো। ওর চোখেও দু ফোঁটা গরম অশ্রুপাত ঘটলো। তবে তা দেখা গেল না। রক্তের সঙ্গে মিশে গিয়েছে তা। কেন যেন হঠাৎ করে ওর মায়ের আর বিশেষ আপন একজনের মুখখানা চক্ষু সম্মুখে ভেসে উঠল। খাঁ খাঁ মরুভূমির বক্ষপট অচিরেই ফেটে দুমড়ে মুচড়ে গেল। হাস্যোজ্জ্বল মুখবিবর মলিনতায় ঘিরে ধরল তৎক্ষনাৎ।
হ্যাভেন গাল হতে হাত সরিয়ে নিলো। অরুর দিকে নিষ্প্রভ শান্ত চাউনি তাক করে জরানো গলায় আওড়াল,
” মায়া দেখাচ্ছো? লাগবে না! নিজের কথা ভাবো। যেহেতু আমি তোমার রক্তের কেউ না, সেহেতু আমি তোমার আপন কেউ না, তাই আমাকে ভুলে নিজেকে বাঁচাও। ধুলোবালি সঙ্গে রেখে কি লাভ? তুমি ফুল দিয়ে জীবন সাজাও। ”

হ্যাভেন কাব্যিক বাক্যবাণে থমকে গেল অরু। বিস্মিত হলো ক্ষণে। লালা দ্বারা কন্ঠনালী ভিজিয়ে, পূর্ণ দৃষ্টি স্থির করল ব্যগ্র হয়ে থাকা হ্যাভেনের উপর। কথাটাতে কতটা ভয়ংকর তীব্র যন্ত্রণা লুকিয়ে রয়েছে টের পেলো। কিন্তু সেটা কি?
অরুর উদ্বিগ্ন কন্ঠ করুণ শোনালো,
” এসব কেন বলছেন? চুপ করুন। আপনার কথা বলতে কষ্ট হচ্ছে। ”
হ্যাভেন এবারেও অরুর কথা শুনে নিঃশব্দে হাসে৷ পরমুহুর্তেই টের পায় অরু একটু বেশিই কাঁদছে। টলমল করছে ঘন পল্লব নয়ন জোড়া। এতে হ্যাভেন পুলকিত হয়। হাত এগোয় চোখের পানি মোছার জন্য। শরীর সায় দিচ্ছে না। কপালের আঘাতে মাথা ভনভন করে ঘুরতে লাগলো। তরতাজা বিশুদ্ধ রক্তে মাখো মাখো হয়েছে শরীরের অনেকাংশ। জ্ঞান হারিয়ে ফেলল নিমিষে। সম্পূর্ণ জ্ঞান হারানোর পূর্বে অরুর কাঁধে মাথা ঠেকিয়ে, আকস্মিক অস্ফুটস্বরে বুলি আওড়িয়ে, অরুর মেয়েলি সত্তা অস্বাভাবিক গতিতে কাঁপিয়ে তুলল।
সে ধীম স্বরে বলল,

প্রেমপিপাসা পর্ব ২৫

” দোয়া করো অরু পাখি, আমি যাতে শীঘ্রই মারা যাই। যদিও এই আঘাতে মানুষ মরে না। আমার দ্বারা তুমি অনেক কষ্ট পেয়েছো, তাই না? তোমার ব্যথাতুর মনগহীনের অভিশাপ দিও আমাকে, উপর ওয়ালা শুনলেও শুনতে পারে। আর হ্যাঁ,
যদি আমাকে ভেবে তোমার চোখে একটুও কুয়াশা না নামে, যদি ভুল করেও আমার নাম তোমার হৃদয়ের দরজায় কড়া না নাড়ে, তবে ভেবে নিও, বুঝে নিও, আমি তোমার কেউ ছিলাম না। আমি ছিলাম ট্রেনে কিংবা বাসে পাশাপাশি সিটে বসা ক্ষণিকের এক অপরিচিত মুখ। ”

প্রেমপিপাসা পর্ব ২৭