প্রেমপিপাসা পর্ব ৪
সুমাইয়া সুলতানা
বড়সড় আকৃতির হ্যাভেনের বেডরুমে একা সমান তালে পায়চারি করে চলেছে অরু। কোনো কিছুই ভালো লাগছে না। আশেপাশের সবকিছু বিষাদে ভরে উঠেছে। ঘরের প্রতিটি কোণ যেন তার মনের মতোই শূন্যতায় ভরা। উঁচু সিলিং থেকে ঝুলে থাকা দৃষ্টিনন্দন ঝাড়বাতির মৃদু আলো তার জন্য কোনো উষ্ণতা বয়ে আনে না। দেয়ালে ঝোলানো শিল্পকর্মগুলোও যেন তাকে বিদ্রূপ করে বলছে,
” বলা নেই, কওয়া নেই, হঠাৎ করেই জীবনের মোড় ঘুরে গিয়েছে! তোর ভবিষ্যৎ কি অরু? কোথায় তার শেষ? ”
পায়ের তলায় নরম কার্পেটের স্পর্শ অনুভব করলেও অরুর মনে মনে কোথাও যেন ধারালো কাঁটার মতো বিধছে। চোখ গেল বিশাল জানালার বাইরে। অগণিত সাদা মেঘ আর সূর্যের আলোয় আলোকিত দিনের আকাশ। কিন্তু এই আলো অরুর মনের অন্ধকার দূর করতে পারছে না। প্রতিটি নিঃশ্বাসে অনুভব হচ্ছে নিজের প্রতি এক ধরনের পরাজয়ের গন্ধ।
বিছানার ওপর ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা ফুলের তোড়া, বিয়ের ঝলমলে সুন্দর শাড়ি, আর সাজানো লাল-সোনালি জুয়েলারি সামনে তাকে তিরস্কারের মতো মনে হচ্ছে। যেন তারা বলে উঠছে,
আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন
” তুই কি এই জীবন চেয়েছিলি? ”
অরু চোখ বন্ধ করে দাঁড়িয়ে থাকে। বুকে জমে থাকা হতাশা আর অজস্র প্রশ্ন তাকে ছিন্নভিন্ন করে দিচ্ছে। সেই মুহূর্তে ফট করে ছোট একটা শব্দ হতেই চমকে চোখ খুলে তাকায়। সহসা ব্যাধিগ্রস্ত হয়ে ঘাড় ঘুরিয়ে শব্দের উৎসের দিকে তীক্ষ্ণ দৃষ্টি তাক করে। টুটুল দাঁড়িয়ে আছে দরজার বাইরে। ফ্লোরে খেলনার একটা সবুজ রঙের গাড়ি উল্টো হয়ে পড়ে আছে। অরুর চাউনীতে টুটুল বিরক্তির ছাপ স্পষ্ট দেখতে পেলো। বাচ্চাসুলভ সরল কোমল মনটা খারাপ হয়ে গেল। ফ্লোর হতে খেলনা গাড়ি তুলে চলে যাওয়ার জন্য পা বাড়ায়। তক্ষুণি পেছন থেকে অপ্রস্তুত অবিশ্বাস্য বাক্য ভেসে আসে,
” অ্যাই পিচ্চি, এদিকে আসো। ”
টুটুল ব্যস্ত ভঙ্গিতে পেছন ফিরে চায়। কিন্তু রুমের ভেতরে ঢুকে না। গোল গোল চোখে অরুর মতিগতি বোঝার ক্ষুদ্র প্রয়াস চালায়। টুটুল কি ঠিক শুনেছে? আম্মু ওকে সত্যি ডেকেছে?
অরু আবার ডেকে ওঠে,
” কি হলো আসছো না কেন? আমার কাছে এসো।”
টুটুল মুখ ভার করে, ধীর কদমে এগিয়ে যায়। অরু টুটুল’কে কোলে তুলে নিলো। টুটুল পিটপিট করে তাকায়। অরু হেসে ফেলল। টুটুলের গাল টিপে দেয়। টুটুল’কে কোলে নিয়ে বিছানায় বসে পড়ল।
টুটুলের মাথার অগোছালো চুলের ভাঁজে হাত চালিয়ে অরু অত্যান্ত নরম কন্ঠে শুধাল,
” আমার কাছে আসতে দ্বিধাবোধ করছিলে কেন?”
টুটুলের গোমড়া মুখের সরল জবাব,
” আব্বু নিষেধ করেছিল। ”
অরু ভ্রু কুঁচকে জিজ্ঞেস করলো,
” নিষেধ কেন করেছে? ”
” বলেছে তোমার কাছে আসলে তুমি বকা দিবে। কেউ বকলে টুটুলের কষ্ট হয়। আব্বু চায় না কেউ টুটুল’কে কষ্ট দিক! ”
টুটুলের আঁখি যুগল ছলছল করে উঠল। আম্মুর ভালোবাসা পাওয়ার জন্য কতদিন ধরে ব্যাকুল হয়ে রয়েছে ছোট্ট হৃদয়াবেগ। এখন আম্মুকে কাছে পেয়েও ভালোবাসা পাচ্ছে না। টুটুলের কষ্ট হবে না?
অরু মুচকি হাসল। টুটুলের কপালে চুমু খেল। টুটুল ভ্যাবলাকান্তের মতো চেয়ে আছে। টুটুলের গালে স্নেহময় আদুরে হাত রেখে বলে,
” মিথ্যা বলেছে তোমার আব্বু! বকা কেন দিবো? তোমার কি আমাকে পঁচা মেয়ে মনে হয়? ”
টুটুল তৎক্ষনাৎ দু দিকে মাথা নাড়লো। টেডি হাসি উপহার দিয়ে চনমনে গলায় বলল,
” পঁচা না, সুন্দর আম্মু। ”
অরু চকচক দন্তপাটি বের করে স্বল্প হাসে। ভাবুক চিত্তে সিরিয়াস গলায় শুধায়,
” তোমার নাম কি শুধু টুটুল? ”
” না। হিয়ান আহমেদ টুটুল। সবাই টুটুল বলে ডাকে। ”
” বাহ্! চমৎকার নাম। ”
প্রশংসা শুনে টুটুল খুশি হলো। অরু পুনরায় একই ভঙ্গিতে জিজ্ঞেস করলো,
” তোমার আব্বুকে সবাই কি নামে ডাকে? ”
টুটুল অকপটে জবাব দেয়,
” হ্যাভেন। ”
” উঁহু! তোমার স্কুলে কিংবা অন্য কোথাও কি নামে ডাকে? ”
” হ্যাভেন তালুকদার। ”
অরুর মনে আশার প্রদীপ জ্বলে উঠল। কৌশলে বিস্তৃত হেসে বলল,
” গুড! ঠিক তেমনি তোমার আব্বুর মতো তোমার নামের পাশে এরকম তালুকদার জাতীয় কিছু নেই? যদি থাকে তাহলে তোমার নামটা আরও অনেক বেশি সুন্দর লাগবে। ”
টুটুল কিছুক্ষণ ভাবলো। মনে করার চেষ্টা করল। কিন্তু তেমন কিছু মনে পড়ছে না। মন খারাপ করে উত্তর দিল,
” না নেই। শুধু হিয়ান আহমেদ টুটুল। আমার নাম কি সুন্দর না? ”
অরু মুচকি হেসে তুরন্ত প্রতিত্তোর করলো,
” অবশ্যই সুন্দর। আমি এমনিতেই বলেছি। টুটুল তোমার বার্থডে সার্টিফিকেট কার কাছে আছে? ”
টুটুল ভাবুকতা গলায় পাল্টা প্রশ্ন ছুড়ল,
” সেটা কি? ”
অরু হতাশ হলো। ফোঁস করে তপ্ত শ্বাস টানল। এতটুকু বাচ্চা এসব জানে নাকি? তবে মনগহীনে সংকীর্ণ খুঁতখুঁতে বেশ কিছু প্রশ্নের যথাযথ উত্তর যে অরুর চাই-ই চাই!
” টুটুল, তোমাকে যে আমি এতকিছু জিজ্ঞেস করেছি সেটা কাউকে বলবে না। ”
” আব্বুকেও বলবো না? ”
” না, কাউকেই না। যদি বলে দাও, তোমাকে আর কাছে ডাকবো না, আদর করবো না। ”
টুটুল বেজার মুখে উঠে দাঁড়ায়। হ্যাভেন’কে কোনো কথা না বলে থাকতে পারে না। কিন্তু তার যে আম্মুর ভালোবাসা চাই।
অরু তাড়া দিয়ে শুধাল,
” কি বলে দিবে? ”
” ওকে বলবো না। তাহলে তোমাকে আম্মু ডাকতে দিবে? ”
অরু ঠোঁট চেপে হাসল। ভীষণ মিষ্টি বাচ্চাটা, সাথে বুদ্ধিমানও। নাদুস নুদুস কিউটের ডিব্বা একটা! অরুর মায়া হলো।
” তুমি আমাকে আম্মু ডাকতে পারো। তবে তোমার সাথে যে আমার ভাব হয়ে গিয়েছে, সেটা তোমার আব্বু যেন না জানে। ওকে? ”
টুটুল খুশি গদগদ হয়ে তুরন্ত জবাব দেয়,
” ওকে। ”
বলে অরুর গালে টুপ করে একটা চুমু দিয়ে দৌড়ে চলে যায়। অরু গালে হাত রেখে হেসে ফেলল।
অফিস রুমের ভেতর এক অস্বস্তিকর নীরবতা বিরাজ করছে। হঠাৎ হ্যাভেনের ধৈর্যের বাঁধ ভেঙে যায়। আকাশচুম্বি রাগ সমেত ফুঁসতে ফুঁসতে সে হাতে থাকা ফাইলটা টেবিলের ওপর ছুড়ে ফেলে দেয়। কাগজগুলো এলোমেলো হয়ে মেঝেতে পড়ে যায়। ম্রিনাল কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে দাঁড়িয়ে রয়েছে।
হ্যাভেন চিৎকার করে বলে ওঠে,
“এটা কি করেছো তুমি, ম্রিনাল? একটা সাধারণ হিসাবও ঠিকঠাক রাখতে পারো না? এই ফাইলে পুরো ঘাপলায় ভর্তি! কোনো একটা সংখ্যাও মিলছে না! তোমার দ্বারা এরকম ভুল হতে পারে আমি আশা করিনি! ”
ম্রিনাল শুষ্ক ঢোক গিলল। কাঁপা কণ্ঠে উত্তর দেয়,
” স্যার, আমি চেক করেছিলাম। মনে হয় কোথাও ভুল হয়ে গিয়েছে। আমি আরেকবার চেক করে এক্ষুনি ঠিক ক….. ”
হ্যাভেন কড়া কণ্ঠে বাঁধা প্রদান করল। চওড়া গলায় বলে,
” তোমার এই ভুল আমার কোম্পানির কত বড়ো ক্ষতির সম্মুখিন হবে, বুঝতে পারছো? একবারের জন্য কি দায়িত্ব নিয়ে কাজ করা যায় না? বারবার কি আমাকেই এসে ঠিক করে দিতে হবে সব? ”
ম্রিনাল মাথা নিচু করে চুপ করে দাঁড়িয়ে আছে। তার হাত, পা কাঁপছে। রাগ কমানোর চেষ্টা করে হ্যাভেন চেয়ারে বসে, কিন্তু রাগ এখনও চোখেমুখে স্পষ্ট।
হ্যাভেন লম্বা শ্বাস টানল। কিছুটা শান্ত হয়ে গমগমে গলায় বলল,
” ঠিক আছে, এবার শোনো। তুমি এই ফাইলটা নতুন করে তৈরি করবে। আজ রাতের মধ্যেই আমাকে সব হিসাব মিলিয়ে পাঠাবে। আর একটা ভুলও যেন না থাকে। স্পষ্ট? ”
ম্রিনাল মৃদু গলায় বলে,
” জ্বি, স্যার। আমি কাজ শুরু করছি।”
ম্রিনাল দ্রুত ফাইলগুলো কুড়িয়ে নিয়ে রুম থেকে বেরিয়ে যায়। তার মুখে উদ্বেগের ছাপ স্পষ্ট। হ্যাভেন টেবিলে বসে কপালে দুই আঙুল দিয়ে আলতো ভাবে স্লাইড করছে। শিরাগুলো টানটান হয়ে গিয়েছে। নিজের রাগ নিয়ন্ত্রণ করার চেষ্টা করছে। কাজে ভুল হওয়া তার সহ্য হয় না, আর সেটা তার বিশ্বস্ত অ্যাসিস্ট্যান্ট এর দ্বারা হলে তো কথাই নেই! তারউপর এই প্রজেক্টের সাথে আগামী অনেক কিছু জড়িত রয়েছে। হিসাব নির্ভুল নিখুঁত না হলে সবকিছু এলোমেলো হয়ে যাবে।
হ্যাভেন আজ অফিস থেকে তাড়াতাড়ি বাড়ি ফিরে এসেছে। আসার সময় সকল কাজ চাচা প্রত্যাশ’কে বুঝিয়ে দিয়েছে। একরকম ফুরফুরে মেজাজে বাসায় ঢুকেছে। দরজা খুলে বেডরুমে পা রাখতেই চোখে পড়ল টুটুল আরাম করে ঘুমিয়ে আছে। বিছানার ঠিক মাঝখানে চাদর মুড়ি দিয়ে ঘুমিয়ে রয়েছে তার কলিজা। এই দৃশ্য দেখে হ্যাভেনের মুখে একচিলতে হাসি ফুটে উঠল। জানালার পর্দা হালকা বাতাসে দুলছে, বাইরের নরম আলো এসে মেঝেতে পড়ছে। বিছানার পাশে রাখা টেবিলে একটা মগ, ভেতরে কিছু চায়ের দাগ শুকিয়ে গিয়েছে। বোঝাই যাচ্ছে অরু চা খেয়েছে। নয়তো হ্যাভেনের রুমে সচারাচর কেউ আসে না। সেখানে কেউ রুমে ঢুকে চা বা কফি কিভাবে খাবে? পরমুহূর্তে ভ্রু কুঁচকে ফেলল। টুটুল তো এসময় ঘুমায় না! ছেলেটা অসুস্থ হয়ে পড়েছে কি? হ্যাভেনের চিন্তা হলো। অফিস ব্যাগ যথাস্থানে রেখে, ওয়ালেট ড্রেসিং টেবিলের উপর রেখে, হাত ঘড়ি খুলতে খুলতে ধীর কদমে ঘুমিয়ে থাকা ছেলের নিকট এগিয়ে গেল। কপাল, গলায় হাত ছুঁয়ে বোঝার চেষ্টা করল শরীরের অবস্থা। না, সবকিছু স্বাভাবিক। হ্যাভেন আর মাথা ঘামালো না। টুটুলের কপালে চুমু খেয়ে, ফ্রেশ হতে চলে গেল।
অরু একা, স্বাধীনচেতা মেয়ে। কেউ তার জীবনে হঠাৎ করেই এসে নিয়ম-কানুন বানিয়ে দেবে, তা মেনে নেওয়ার মতো মেয়ে সে নয়! অথচ, সেই অরু এখন মুখবন্ধ করে অপছন্দের অনেক কিছু নিরদ্বিধায় মেনে নিতে হচ্ছে তাকে। আর হ্যাভেন? সে তো একেবারে উল্টো, ঘাড় ত্যাড়া মহারাজ! নিয়ম ভেঙে, খুনসুটি করে মানুষের জীবন উলট-পালট করতে তার কত-না আনন্দ! অরু একে তো হ্যাভেন’কে মোটেই মেনে নিতে পারছে না, তারউপর হ্যাভেনের বাড়াবাড়িতে অতিষ্ঠ হয়ে উঠেছে মেয়েটা!
ফ্রেশ হয়ে হ্যাভেন চুপচাপ একটা চেয়ার টেনে বসলো। রুমের একপাশে সাজানো বইয়ের তাকে চোখ বুলিয়ে নিলো। লাইন ধরে সারিবদ্ধভাবে বই সাজানো গোছানো। হ্যাভেন সবসময় বইগুলো নির্দিষ্ট জায়গায় রাখতে পছন্দ করে বেশ পরিপাটি গোছানো মানুষ যে! কিন্তু টুটুল এসে নিমিষে কিছু বই এলোমেলো করে দিয়ে মজা নিবে আর হ্যাভেন’কে জ্বালাবে। তবে ছেলের এসব কাজে সে বিরক্ত হয় না, বরং খুশি হয় ছেলের আনন্দ দেখে।
হ্যাভেন গ্রীবা এদিক ওদিক ঘুরিয়ে অরু’কে খুঁজলো। রুমের কোথাও তাকে দেখতে না পেয়ে চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়ায়। তক্ষুণি বারান্দা থেকে অরু রুমে এসে হাজির হয়।
হ্যাভেন’কে দেখে অরু মুখ বাঁকায়। দাঁতে দাঁত চেপে বিড়বিড় করে বলে,
” ওনাকে এক্ষুনি আসতে হলো? বজ্জাত লোক একটা! মস্তিষ্কে সবসময় অবাঞ্ছিত অশোভন চিন্তা নিয়ে ঘুরে-বেড়ায়! ”
আপন মনে বিড়বিড় করতে করতে অরু আলমারির কাছে এসে দাঁড়ায়। প্রয়োজনীয় জিনিস নিয়ে আলমারির দরজা বন্ধ করে পেছনে ঘুরতেই, সহসা কারো চওড়া বুকের সঙ্গে ধাক্কা খায়। অরু চকিতে তাকাল। হ্যাভেন একদম ওর সম্মুখে দাঁড়িয়ে। ঠোঁটে তার দুর্বোধ্য হাসি। অরু রাগি দৃষ্টিতে তাকায়। কিছু না বলে পাশ কাটিয়ে চলে যেতে চায়। কিন্তু হ্যাভেন সেটা হতে দিল না। পেশিবহুল ইস্পাত-দৃঢ় দুটো হাত অরু’কে বেষ্টনী করে নিলো। হাত দুটো অরু’কে স্পর্শ করল না, বরং তা আলমারির দু দিকে ছড়িয়ে রাখা। অরু নড়তে পারছে না। আলমারির সঙ্গে ঠেসে দাঁড়িয়ে রইল। পিঠ ঠেকে রয়েছে সেথায়। অরু রাগে ক্রমাগত ফুঁসছে! এই বুঝি এটম বো*ম হয়ে ব্লা’স্ট হয়ে যাবে! অরুর রিয়াকশন দেখে হ্যাভেন মিটিমিটি হাসছে। যা দেখে অরুর গা জ্বলে উঠল!
হ্যাভেনের বুকে মৃদু ধাক্কা দিয়ে অরু তিরিক্ষি মেজাজ সহিত বলে উঠলো,
” বেহায়ার মতো এভাবে দাঁড়িয়ে আছেন কেন? সামনে থেকে সরুন। ”
হ্যাভেন ত্যাড়া কন্ঠে বিদ্রুপ হেসে বলে,
” না সরলে কি করবে? আর কি বললে আমি বজ্জাত? ”
অরু দাঁত পিষে কটমটিয়ে উঠে। খোঁচা মেরে গম্ভীর কণ্ঠে জবাব দিল,
” আপনার মধ্যে কি নূন্যতম লজ্জা বলতে কিছু নেই? যেখানে একটা মেয়ে আপনাকে সহ্য করতে পারছে না, সেখানে আপনি নির্লজ্জের মতো বারবার তার কাছে ঘেঁষছেন! আমিতো ভেবেছিলাম আপনার পার্সোনালিটি অনেক মজবুত। চাইলেই তো কতশত মেয়ে আপনার উপর হুমড়ি খেয়ে পড়বে। তাহলে আমার পিছে পড়ে আছেন কেন? ”
হ্যাভেনের ভাবভঙ্গি বোধগম্য হচ্ছে না। সরু চোখে ললাটে প্রগাঢ় ভাঁজ ফেলে পলকহীন অরুর দিকে চেয়ে আছে। নিচের ঠোঁট কামড়ে অরুর নিকট আরেকটু ঝুঁকে আসে। হ্যাভেনের গরম নিঃশ্বাস অরুর চোখেমুখে উপচে পড়ছে। অরু চোখ বুঝে ফেলল। বক্ষস্থলে অজানা অচেনা অনুভূতিতে ঢিপঢিপ করছে। পেছাতে পারলো না। কারণ পিছিয়ে যাওয়ার কোনো ব্যবস্থা নেই। পৃষ্ঠদেশ আলমারিতে লেগে রয়েছে।
হ্যাভেন কন্ঠ খাদে এনে দৃঢ়তা সমেত কটাক্ষ করে বলল,
” তোমার কাছ ঘেঁষার জন্য কি আমি মরে যাচ্ছি? তুমি নিজেকে কি মনে করো, নায়িকা ভিক্টোরিয়া? তোমার গায়ের গন্ধ এতটা বিশ্রী! চুলের ঘ্রাণ। না না, ঘ্রাণ না, চুলের বাজে গন্ধ! আর ঠোঁট জোড়া, ইয়াক! দেখলে আমার তো বমি চলে আসে! টুকটাক তোমার কাছে এজন্য ঘেঁষি, যাতে গন্ধের পরিমাণ কতটুকু সেটা উপলব্ধি করতে পারি। সারাক্ষণ তো আর রুমে বসে থাকবে না! বাইরে যাবে, ভার্সিটি যাবে, জনসম্মুখে যাবে। তখন তোমার গায়ের বিশ্রী গন্ধ কারো নাসারন্ধ্রে প্রবেশ করলে, লোকে তো আমাকে কটুকথা শোনাবে! বলবে, হ্যাভেন তালুকদার কি মেয়ে বিয়ে করেছে গা থেকে গন্ধ বের হয়! আমি তো ভদ্রলোক। সেটা কিভাবে হতে দেই বলো? সেজন্য তোমার গায়ের সকল গন্ধ নিজের মধ্যে টেনে নেওয়ার ক্ষুদ্র প্রয়াস করছি মাত্র! সত্য হলো তুমি আমার বউ। তোমার গায়ের গন্ধ আমি ছাড়া কেউ পাবে সেটা তো আমি হতে দিতে পারি না! বউ বলে আমি না হয় তোমার গন্ধ সহ্য করে নিবো, কিন্তু অন্য লোকেরা কি সহ্য করবে? তাই তোমার কাছে আসি সকল গন্ধ নিজের মধ্যে লুফে নিতে। নয়তো তোমাকে ছুঁতে আমার ইগোতে লাগে! তোমার গোবর ভর্তি মাথায় এতটুকু বুদ্ধিও নেই? ”
বাক্যের ইতি টেনে হ্যাভেন দূরে সরে দাঁড়ায়। ভ্রু কুঁচকে নির্লিপ্ত ভঙ্গিতে চেয়ে আছে সম্মুখে রাগে ফুঁসতে থাকা অরুর দিকে। অরুর শিরা-উপশিরায় হ্যাভেনের অপমানজনক বিদ্বেষপূর্ণ কথাগুলো বিষের ন্যায় ছড়িয়ে পড়ছে! ক্রোধে শরীর কেঁপে কেঁপে উঠছে। অরুর কাছ ঘেঁষলে বমি আসে? কত ছেলে অরুর পেছনে ঘুরে! তাহলে এসব কথা বলার এই লোকের সাহস হলো কিভাবে?
রাগে হিতাহিত জ্ঞান হারিয়ে অরু হ্যাভেনের টি-শার্টের কলার চেপে ধরে। হ্যাভেন হকচকিয়ে যায়। অরু চেঁচিয়ে বলে উঠলো,
” আমার গা হতে গন্ধ বের হয়? আমার কাছ ঘেঁষলে আপনার ঘৃণা লাগে? অসহ্যকর লোক! ”
হ্যাভেন, অরুর হাত ছাড়িয়ে নিতে নিতে ব্যঙ্গাত্মক করে বলল,
” কি করছো? ছাড়ো। ছিঃ! গন্ধে আমার শ্বাস আটকে আসছে। দূরে যাও, দূরে যাও। ”
অরু গেল না। বরং দ্বিগুণ তেজ ফুটিয়ে একদম হ্যাভেনের বুকের সঙ্গে মিশে রইল। পায়ের গোড়ালি উঁচু করে হ্যাভেনের নিচের ঠোঁট পর্যন্ত নাগাল পেলো। সেভাবে থেকেই চিবিয়ে চিবিয়ে বলল,
” যাবো না দূরে! এভাবেই থাকবো! আমিও দেখি কিভাবে সরান আমাকে! ”
অরু ব্যালেন্স রাখতে পারছে না দেখে, হ্যাভেন অরুর কোমর প্যাঁচিয়ে নিজের সাথে আগলে নিলো। কথা বলার দরুন অরুর ঠোঁট হ্যাভেনের ক্লিন সেভ করা থুতনিতে আলতো ভাবে স্পর্শ করে চলেছে। মেয়েটা কি বুঝতে পারছে সে কি করছে? বুঝতে কি পারছে, তার এরকম হুট করে এতটা কাছে আসায় হ্যাভেন নামক পুরুষের হৃদয়টা বেসামালে বুঁদ হচ্ছে! টের পাচ্ছে কি হ্যাভেনের হৃৎপিন্ডের ক্ষুদ্র সত্তার কিছু পাওয়ার তীব্র আকাঙ্ক্ষা? অরুর বাঘিনী রূপে বোকা বোকা কর্মকাণ্ডে হ্যাভেন আনমনে হেসে ফেলল।
হ্যাভেনের হাসি মুখশ্রী দেখে অরু নাকের পাটাতন ফুলিয়ে ঝাঁঝালো গলায় বলে ওঠে,
” হাসছেন কেন? বললাম তো এভাবেই থাকবো! ”
হ্যাভেন ঠোঁট চেপে হাসি আটকে ছোট করে উত্তর দিল,
” আচ্ছা। ”
” আপনি খুবই বিরক্তিকর একজন লোক। ”
” জানি। ”
” আপনাকে দেখলে আমার রাগ হয়। ”
” ঠিক আছে। ”
” আপনি খুব খারাপ! ”
” হ্যাঁ। ”
” আপনাকে আমার সহ্য হয় না। ”
” অলরাইট। ”
প্রেমপিপাসা পর্ব ৩
হঠাৎ দরজায় খটখট শব্দ কর্ণগোচর হতেই অরুর সম্ভূতি ফিরল। চমকে ওঠে সহসা হ্যাভেন থেকে ছিটকে দূরে সরে গেল। লজ্জায় চোখমুখ খিঁচে শ্বাসরুদ্ধকর হয়ে দাঁড়িয়ে রইল। কি করছিল ও এতক্ষণ? লোকটার এত কাছাকাছি চলে গিয়েছিল কিভাবে? এখন, এই লোক অরুর সম্পর্কে কি ভাবছে? খোঁটা দেওয়ার একটা রাস্তা অরু নিজে এই লোককে দিয়ে দিলো? রেগে এরকম একটা কাজ কিভাবে করতে পারলো? ভাবতেই অরুর কান্না পাচ্ছে! অরুর মুখবিবর গভীর দৃষ্টিতে পর্যবেক্ষণ করে হ্যাভেন কিঞ্চিৎ লাল রঙের ওষ্ঠদ্বয়ের নিচের ঠোঁট কামড়ে মিটিমিটি হাসছে।